বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/জাতি ও শিল্প

জাতি ও শিল্প

 সব মানুষ এক রকমের নয়। এক এক জাত এক রকমে খাচ্ছে পরছে চলছে এবং ভাবছেও। এক এক জাতির বাইরের চালচোল রকম-সকম এবং জাতির অন্তরের ভাবনা-চিন্তা—এই দুয়ের যোগে উৎপন্ন হ’ল শিল্পের মধ্যে দেশীয়তা, জাতীয়তা। নানা ছন্দে লেখা নানা ভঙ্গিমায় গড়া অন্তরে বাইরে একে অন্যে যে ভিন্নতা তারি ফলে আসে শিল্প, আর তা একভাবে এক ভঙ্গিতে চলে’ আসে জাতিগত সংস্কারগত ঐক্য থেকে। যখন জগতের মধ্যে মানুষগুলি বালুকণার মতো স্বতন্ত্র দলে ধরা সেখানে জাতীয় শিল্প নেই কিন্তু একের শিল্প আছে, ভিন্ন ভিন্ন রকমের শিল্পও আছে। মাঠের মধ্যে একটা গাছ রইলো, মাঠের শেষে একটা গাছ রইলো, এইভাবে যখন সমস্ত অরণ্যটা ছড়িয়ে রইলো দিক্‌বিদিকে তখন গাছগুলি তারা প্রত্যেকে নিজের নিজের রূপ ও রূপের ছায়া স্বতন্ত্রভাবে গেল ধরে’, যখন এক হ’য়ে একটা দেশ জুড়ে’ দাঁড়ালো তখন আর এ গাছের সঙ্গে ও গাছের রূপ ও রূপের ছায়ায় যে ভিন্নতা তা ধরা গেল না। তেমনি একের শিল্পে অন্যের শিল্পে এক জাতির ভাবনায় অন্য জাতির ভাবনায় এবং একের আচারে অন্যের ব্যবহারে এই ভাবে একতা ও ভিন্নতা দেখা দিলে যখন, তখন প্রথা রীতি ইত্যাদির বিভিন্নতা ও একতা দেখে বলা চল্লো এটি ভারতীয় এটি ইউরোপীয় সেটি চীনের অন্যটি জাপানের। এই যে শিল্পের মোটামুটি জাতি-বিভাগ দেশ কাল পাত্র ভেদে ঘটেছে, সেইদিক দিয়ে শিল্পচর্চা করে’ দেখার মানে হ’ল শিল্পের সঙ্গে ইতিহাস পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে একেবারে বাইরে বাইরে পরিচয়। আর এক দিক দিয়ে পরিচয়—সে হ’ল রসের দিক দিয়ে, সেখানে জাতি-বিভাগ ঐতিহাসিক রহস্য ইত্যাদি না হ’লেও কায চলে’ যায়।

 এক দেশের মানুষে অন্য দেশের মানুষে যেমন একদিক দিয়ে স্বতন্ত্র, তেমনি অন্যদিক দিয়ে এক। সঙ্গীতের চাল দেশ কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন কিন্তু সঙ্গীতের প্রাণ যেটি সুরের দোলায় দুলছে সেখানে ভেদাভেদ নেই। কালানুগত প্রথা আচার বিচার ধরে’ সৃষ্টি হয় চালচোলের— যেমন বাংলা কীর্তন এবং পশ্চিমের ওস্তাদী গান। এখানে চাল দুটোকে স্বতন্ত্রভাবে দেখাচ্ছে কিন্তু যখন রসের দিক দিয়ে দেখি তখন বিষয়ের উচ্চ নীচ চালের রকম সকম দিয়ে এতে ওতে যে ভিন্নতা তার হিসেবের খাতার দরকারই হয় না—বীণা বাজছে, কি পিয়ানো, না বাঁশী, বিলাতী সুর বাজছে, না দেশী বাউল, না দরবারি এটা ভুল হ’য়ে যায়। রসটি পাওয়াই হ’ল আসল কায কাব্যে শিল্পে সঙ্গীতে এবং মানব-জীবনে।

 এই যে রসের প্রাধান্য এই নিয়ে জগতের তাবৎ শিল্প এক, এই নিয়ে যা শিল্প এবং যা শিল্প নয় তা যে সম্পূর্ণ আলাদা তাও প্রমাণিত হয় রসিকদের কাছে; এবং এই নিয়ে দেবশিল্প (Nature) ও মানবশিল্প (Art) দুই নয়, এক—এও বলেন তাঁরা। ফুলের যেমন পরিমল শিল্পের তেমনি রস। ফুলটি কোন্ জাতীয়, তার রূপ কেমন, সেটি বড় না ছোট, এ জ্ঞান এক ফুলে অন্য ফুলে পার্থক্য জানায়, ফুলের পরিমলটুকু সেও জানায় কি ফুলের বাস পাচ্ছি, কিন্তু এই সব ব্যাপারের বাইরের জিনিষ হ’ল ফুল দেখে এবং পরিমল পেয়ে মন মাতলো যখন তখন যে অনির্বচনীয় বস্তুটি পাই সব ফুল থেকেই সেই বস্তু; সেই একমাত্র বস্তু নিয়ে রসিকের রসচর্চা চলে।

 বীণার কটা তার কটা ঘাট এবং বীণাতে যা বাজছে তার স্বরগ্রামের শ্রুতির সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিভাগ-জ্ঞান নিয়ে রসভোগ তো বর্ধিত হয় না, বীণা বাঁধার কৌশল সেটা বাজাবার কৌশল যখন আপনাকে হারিয়ে দিলে রসের তলায়, জানলেম বীণা যথার্থ ভালো বাজলো গানও ঠিক হ’ল; কিন্তু বীণা যেখানে আপনার খুঁটিনাটি খটখটি দিয়ে প্রমাণ করতে থাকলো আমি রুদ্রবীণ আমি সরস্বতী-বীণ আমি শ্রুতিবীণ, কিংবা কালোয়াত যেখানে প্রকাশ করতে থাকলো আমি দক্ষিণী চাল আমি নারদ আমি বিলাতি কিছু, সেখানে গান শুনে’ আনন্দ নেই গানের ভঙ্গি দেখে’ আনন্দ, সঙ্গীত-শাস্ত্রের কথকতা শুনে’ আনন্দের মতো আনন্দ। কার্যেই দেখা যাচ্ছে যে, জাতির সঙ্গে জাতীয় শিল্পের জ্ঞান এক জাতিগত প্রথা ধরে’ দেখা, জাতি থেকে আলাদা করে’ নিয়ে শুধু তার কারিগরি ও শিল্প হিসেবে দেখা, এবং রসের বিচার করে’ দেখা— এই তিন রকম দেখার পথ। যারা পড়ে’ শুনে’ শিল্পকে জানতে চায় তারা চলে প্রথম পথে, কারিগর শিল্পী এরা চলে দ্বিতীয় পথে, এরা কাযের বাহাদুরি দেখে, এবং রসিক তারা চলে শেষের পথ ধরে’ শিল্পকাজের প্রাণের সন্ধানে। নিজের রুচি অনুসারে দেখার সঙ্গে রসিকের দেখার পার্থক্য এই যে রসিক তিনি গণ্ডির হিসেব জেনে গণ্ডি পেরিয়ে জিনিষটিকে প্রাণ দিয়ে ধরার সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন, আর যে নিজের রুচি অনুসারে এটা ওটা দেখে সে গণ্ডির হিসেব একেবারেই অগ্রাহ্য করে, যেটা তার ভালো সেইটেই, সবার ভালো ঠাউরে নেয়। নিছক নিজত্ব নিয়ে আছে, কোনো জাতির সঙ্গে কোনো কালান্তগত প্রথার সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন শিল্প বিশ্বের কোথাও নেই, সুতরাং একেবারে আপ রুচি নিয়ে রসের জগতে রচনার জগতে বিচরণ করতে গেলে এমন হ’তে পারে যে, হয়তে হাতে মণি উঠলে কিন্তু ফেলে দিলেম সেটা ঢেল। বলে’, কিম্বা শবরীর হাতের গজমুক্তার মতো নিজের কাছে রাখলেম দিবির খেলার জিনিষ বলে’, মর্মটা অজ্ঞাত রইলো।

 নিজের রুচি খাবার জিনিষের বেলায় চলে, পেট আপনার সেখানে আপ রুচি খানা, কিন্তু হৃদয় নিয়ে যেখানে কথা সেখানে আপ রুচি চালাতে গেলে চলে না। হৃদয়কে কেবল আপনার করে’ রাখলে নিজেই ঠকি, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় মেলানোতেই রস পাই, সুতরাং বলতে পারি যে, রস হ’ল দুইকে মিলিয়ে সেতু, রুচি হ’ল দুইকে পৃথক করে প্রাচীর।

 মানুষের অন্তর অন্যের সঙ্গে মিলতে চায়, ভাব করতে চলে, কিন্তু ভাবের লোকটি সহজে তো খুজে পায় না, ফলেই সেখানে একের রুচি অন্যের রুচিতে ভিন্নতা নিয়ে দুটি মানুষ পৃথক। এই ভাবে মানুষ এককালে দলে দলে পাশাপাশি থেকেও ছিল রুচি দিয়ে পৃথক, ক্রমে মানুষ নিজের বড় সমাজ বড় ধর্ম এমনি সব বাঁধন নিজে সৃষ্টি করে দলে ভারি হয়ে একটি কৃত্রিম ঐক্য পেয়ে বিভিন্ন সমাজ ও বিভিন্ন জাতি হ’য়ে উঠলো, এবং সেই জাতির কুলানুগত আচার ব্যবহার শিক্ষা দীক্ষার ধারা ধরে চলতে চলতে অন্ততরের ভাবনা-চিন্তাতেও দেখতে এক হ’য়ে উঠলো দুটি ভিন্ন রুচির মানুষ—এ যেন বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতে থাকলো। এই কৃত্রিম ভাবের মিলন থেকে উৎপত্তি হ’ল জাতীয় শিল্প যাকে বলা যায় তা— সেখানে গড়ে তোলার ধরণ ধারণ শিল্পী বিশেষের উপরে ছাড়া রইলো না, শিল্পশাস্ত্রের কুল-পঞ্জিকার মধ্যে শক্ত করে বাধা রইলো সব।

 আমাদের এক শ্রেণীর মূর্তি-শিল্প অনেকটা এই শক্ত করে' বাঁধা পাথর; তারপর সঙ্গীত অভিনয় ইত্যাদি, সেখানে দেশ কাল পাত্র ভেদে এবং নিজের নিজের রুচি অনুসারে যে সব রাগ-রাগিণী রচনা হয়ে গেল, তার থেকে সময়ে সময়ে নানা বঁধুনী ও কায়দার হিসেব জড়ো করে আইন প্রস্তুত হ’ল—সঙ্গীতশাস্ত্র হ’ল, ছন্দশাস্ত্র হ’ল, নাট্যশাস্ত্র হ’ল। নতুন যখন মানব-সমাজ, তখন এই বেড়া খুব কাজে এল তার শিল্পকলাকে বঁচিয়ে রাখতে, কিন্তু গাছ বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আল ও বেড়া তুষ্ট বাড়িয়ে চলতে হ’ল, না হ’লে জাত বাঁচে কিন্তু গাছ বাড়ে না। এই বেড় বাড়ানো বা জাত না বঁচিয়ে গাছের জীবন বাঁচানোর কাজ রসিকেরা সময়ে সময়ে এসে এদেশে ওদেশে করে গেলেন, এ গাছের সঙ্গে ও গাছের এ জাতের সঙ্গে ও জাতের মিলন সেও ঘটালেন রসিকেরা-জাত শিল্পফল ধরিয়ে ফুল ফলিয়ে ফসল বৃষ্টি করে চল্লো এবং জাতি রাজার ভাড়ারে সে সব জমা হ’তে থাকলো, জাতি খাজনা নিলে জাতীয় শিল্পের, দিলে খাজনা দু’চার রসিকের মারফত দু’চার কবি দু’চার শিল্পী দু’চার গাইয়ে দু’চার বাজিয়ে নাঁচিয়ে তারা। জাতির সঙ্গে জাতীয় শিল্পকলা সমস্তর সম্বন্ধ কালিদাসের রাজার প্রজার “স পিতঃ” গোছের নয়, “পরের ধনে পোদারী” করার সঙ্গে তার মিল আছে।

 সমঝদারে কারিগরে রসিকে গুণীতে দরদ দিয়ে করে গেল গান বল, ছবি বল, কবিতা বল সব নিয়ে উৎসব। তাদের ক'জনের উৎসবের শেষে পড়ে রইলো যা ফুলশয্যা কিম্বা ময়ূরসিংহাসন তারি উপরে জাতের কত এসে মিল বসিয়ে দিয়ে গেল—হঠাৎ-নবাব জাত নিলেমে সেগুলো কিনে নিয়ে সস্তায় নবাবি আমলের একটা অভিনয় করতে থাকলো, সভাকবির দল শিল্পীর দল সৃষ্টি হ’য়ে কবির লড়াই গানের লড়াই ইত্যাদি মুরু হ’ল; স্বভাব-কবি কন্ধে পেলে না সে সভায়, কেননা সে আসল বস্তু দিতে চায়, কোন এক বড় আসলের নকল দিতে পারে না একেবারেই। নবাবি আমলের পরে এল যখন সাধারণের আমল তখনি জাতীয় শিল্পের খোঁজ পড়ে গেল দেখি; সাধারণ অসাধারণ রকমে রসিক হয়ে উঠলো তখন। এই ভাবের জাতীয় যুগ ইতিহাসের পাতায় চিহ্ন রেখেছে যেমন, তেমনি কবিতায় গানে শিল্পকলায়ও ছাপ রেখেছে। এই সাধারণ সভা বা জাতীয় সভায় কবির লড়াই দিতে দিতে প্রাণান্ত হয়েছে কত কবির তার ঠিক আছে কি? শিল্পের সঙ্গে জাতির বিবাহ রাক্ষস-বিবাহ, জাতার সঙ্গে মণিমুক্তার বিবাহ দিলে যা ফল হয় সেই রকমের বস্তু হচ্ছে জাতীয় শিল্প; তাতে রস থাকে না, ছাতুর মতো ভারি শুকনো জিনিষ থাকে জাতীয় শিল্পে—অনেক খানি গুড় না হ’লে সেই জাতীয় পুষ্টিকর জিনিষ রোচেেে না একেবারেই।

 জাতীয় উৎকর্ষ এবং শিল্পের উৎকর্ষ সমাজের মতো একভাবে একসঙ্গে হয় না, এ এক হিসেব ধরে' বাড়ে ও অন্যের এক হিসেব নিয়ে বাড়ে—একের বাড় অন্যের বাড়ের সাপেক্ষ নয়। ধন বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাও বাড়বে এ যেমন ভুল, জাতির উৎকর্ষ বলতে শিল্পীর উৎকর্ষ ভাবাও ঠিক তেমনি ভুল। জাত যে হিসেবে বড় হয় সে হিসেবে তার সঙ্গে শিল্পকলাও যে বড় হ’য়ে ওঠে এমনটা ঘটে না। জাত বলতে বলি—নেশন। আজকের জাপান জাত হিসেবে মস্ত কিন্তু শিল্পের দিক দিয়ে আমাদের কবির সেই ‘অসভ্য জাপানের কাছে আজকের জাপানের হার হয়েছে। নেশন হিসেবে এই উৎকর্ষ আজ পেলে জাপান, সেদিনের জাপান নেশন হিসেবে উৎকর্ষ পায়নি কিন্তু আর্ট হিসেবে বড় ছিল প্রাচীন জাপান।

 জাতি আর্টের জননী নয়, হ’তেও পারে না; জাতির সঙ্গে আর্টের তো গান্ধর্ব বিবাহ হয় না, আর্টিষ্টের সঙ্গেই সেটা হ’য়ে থাকে বরাবর। বসন্তকালে বাগানের গাছে ফুল ধরে, তাই দেখে ফুল-স্মৃষ্টিকত। বাগানের মালিককে ভেবে নেওয়া ভুল, বসন্ত দেবতা বলে মাত ধরিত্রী বলে দক্ষিণ বায়ু বলে কতকগুলো যে আছে। জাতির ফুয়ে জাতীয়তার গৌরব জ্বলে কিন্তু ফুলের মুখ খোলে না। জাতির গড়া ন্যাশানাল পার্ক সেখানেও ফুল ফোটে না ফুঁয়ে।

 জাতির কোলে শিল্পী এবং শিল্পও ধরা থাকে, দাস দাসী জ্ঞাতি কুটুম্বের মাঝে যে ভাবে থাকে মা ও ছেলে। মাতৃগর্ভ থেকে সস্তান জন্ম নিলে, দাসীর কোলে সে ঘুমোলো, হয়তো মরলো—তেমনি শিল্পীর অন্তরে শিল্প জন্ম নিলে, জাত দাসীর দলে সে নানা লীলা বিস্তার করলে, দাসীর দল আনন্দ পেয়ে বল্লে—ওগো জাতীয় শিক্ষা দীক্ষার দিক দিয়ে আমাদের ছেলেটির জাতের সঙ্গে জাতীয় শিল্প কবিতা ইত্যাদির যেটুকু যোগ তাও বাইরে বাইরে ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে। জাত গেলে জাতির বিপদ গণে, কিন্তু শিল্প গেলে গান বন্ধ হ’লে কবিত। বন্ধ হ’লে চঞ্চল হয় জাতের মধ্যেকার দু-চার জনের মন। জাতীয় শিল্পের কত মন্দির ভাঙলো, তার জন্তে চাঁদা তুল্লে কয়েকজন, জাতীয় কংগ্রেস বসলোে, তাঁতশালী বসলে, পাঠশালা খুল্লো। চাঁদামামার ছড়া আউড়ে বার হ'ল জাত পথে পথে এক তালে, এক সুরে, এক প্রাণে, একটা হারমোনিয়াম বাজিয়ে খুসি করে’ চাঁদ। তুলতে। জাতীয় নাট্যমন্দিরে, কলাভবনে বা ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা, তাতে করে’ আজকের ভারতবাসীর সঙ্গে কালকের ভারতবাসীর কলাবিদ্যার বাইরে বাইরে কতকটা পরিচয় হ’ল, যেন সেকালের রূপকথা শোনার কায হ’ল, মনের কল্পনা উত্তেজিত হ’ল খানিক, কিন্তু এতে করে’ আজকের আমরা আমাদের শিল্পকে নিজের করে’ যথার্থভাবে পেলেম না। যে রসবোধ তখনকার তাদের নানা সুন্দর সৃষ্টির বিষয়ে নিযুক্ত করেছিল তাকে আবার ঘরে আনতে হ’লে এ ভাবের জাতীয় আয়োজনে চলবে না। জাতি যে উপায়ে শিল্পকে জীবন-প্রদীপের আলোয় বরণ করে’ ঘরে আনতে পারে নতুন বধূরূপে তারি আয়োজন করা চাই, নতুন করে’ উৎসব লাগুক ঘরের মানুষটির প্রাণে কলাবৌটির সঙ্গে, ঘরে বাইরে লক্ষ্মী বিরাজ করবেন তখন এসে, শ্রী ফিরে যাবে জাতির।

 আমাদের জাতির বাস্তুভিটে সেখানে পুরাকালের ঘরে ঘরে সৃষ্টির তৈজসপত্র জমা করে’ যেমন বুড়ো কর্তা গিন্নিরা চলে গেলেন, সব দেশে সবার ভিটেয় তেমনি ঘটনাই ঘটে। কিন্তু আমার দেশে আর এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটলো; সেই বুড়োবুড়ী ছেলে-বৌ হ’য়ে নাতি নাতবৌ হ’য়ে বারে বারে ফিরে ফিরে পুরোনো বাসায় ঠিক অতীত কালের জীবন যাত্রা নির্বাহ করতে এলো। সাজে তেমনি, কাজে তেমনি,—সেই নাচ গান সেই ছবি সেই ঝাড়-লণ্ঠন, শুধু কালটা এই। একে বলতে পারি অতীত-বর্তমানে ভয়ঙ্কর রকম একটা রাক্ষস-বিবাহ, এতে করে’ অতীত বাঁচলো বর্তমানকে মেরে—এই সৃষ্টিছাড়া বিবাহের ফল শুভ হ’ল না শিল্পসৃষ্টির পক্ষে।

 কালচক্র ঘুরতে ঘুরতে জাতীয় জীবনযাত্রার রথখানি পৌঁছে দিলে যদি আজকের আমাদের সেই নৈমিষারণ্যে, তবে সে জীবন নিয়ে সত্য ত্রেতা দ্বাপরের যা কিছু তার পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া আমাদের তো আর কোন কায রইলো না।

 জাতি বর্তে’ থাকে যেখানে সেকালের সঞ্চয়ের উপরে, সেখানে হয়তো তার জাত থাকে, কিন্তু শিল্প প্রভৃতি নানা রচনা ও সৃষ্টির দিক দিয়ে তার মান বজায় থাকা ক্রমেই দুষ্কর হয়। বর্তমান ধরে’ তবে বর্তে’ থাকে শিল্পকলা, অতীতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয় কিন্তু অতীতমুখীও নয় শিল্প। যে দিক দিয়েই চল আজকের জাতি ও তার মানুষগুলির সঙ্গে সেকালের যোগ স্বাভাবিক না হ’লে আজ আমাদের জাতীয় অনুষ্ঠানের সার্থকতা ভূত নামানোতে গিয়ে ঠেকে। রেলগাড়ী ষ্টেশন ছেড়ে বার না হ’য়ে ষ্টেশনের দিকে পিছোতেই যদি থাকে ক্রমান্বয়ে, তবে যাত্রীদের সে গাড়ী চড়ে’ গম্য কোথাও পৌঁছোনো মুস্কিল হয়। পুরোনো ঘরে নতুন বর-বধূ তারা ইচ্ছামতো সেকালের কতক জিনিষ সংসারের কাযে লাগালে, কতক জিনিষ দিয়ে নিজেদের ‘ড্রয়িং রুম’ সাজালে, এইভাবে যখন সেকালকে একালের সঙ্গে যুক্ত করা হ’ল তখন হ’ল নতুন কালের উপযোগী সেকাল। আবার যেখানে সেকালের সঞ্চয় ভাঁড়ার ঘর থেকে সোজা পুরোনো পিতলের দোকানে চলে’ গেল কিংবা ভাঁড়ারেই রইলো এবং তার স্থানে বিদেশীয় দোকান ও হোটেল এসে ভর্তি করলে ঘরখানা, সেখানে নতুন পুরোনো দুয়ের মিলন একেবারেই হ’তে পেলে না।

 বক্তৃতা দিয়ে প্রদর্শনী খুলে’ নানা উপায়ে সেকালের শিল্পকলার আদর বাড়ানো গেল আজকের জাতির কাছে; এতে করে’ উত্তরাধিকার-সূত্রে জাতি এবং দেশ যদি কিছু পেয়ে থাকে তাকেই ধরে’ রাখা চল্লো। প্রাচীন কীর্তি সংরক্ষণের আইন করে’ লাট কর্জন এ কায অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন—কিন্তু রক্ষণ ও বর্জন দুটো কথার অর্থে তো কিছু অর্জন করা বোঝায় না।

 আমাদের জাতি স্বভাবতঃ অতীতমুখী, এই বৃত্তি আমাদের কুলানুগত প্রথা ধরবার দিকে চালাতে চাচ্ছে। এই বৃত্তি নিয়ে আমরা আজ যদি ছবি আঁকি মূর্তি গড়ি ঘর তুলি, তবে সব দিক দিয়ে আমাদের কাযের ধারা অতীতকে স্বীকার করে’ চলতে বাধ্য। শিল্পের কৌলীন্য রক্ষা করে’ চলতে চলতে আমরা পৌঁছেচি এমন অবস্থায় যখন আমাদের গান-বাজনা সমস্তই হ’য়ে গেছে আজকের নয়—আকবর ও তাঁর পূর্বের আমলের। আমাদের সঙ্গীত ও শিল্প প্রাচীন কৌলীন্য বজায় রাখতে গিয়ে আজকের জীবনধারার সঙ্গে এক হ’য়ে মিলতে পারছে না, কাযেই সখের জিনিষ হ’য়ে রয়ে গেছে। ঠিক যে ভাবে অসংখ্য মানুষ যাদুঘরে ধরা নানা ভারত-শিল্পের জিনিষগুলি দেখে’ বেড়ায় ও তার নানা রকম সমালোচনা করে, ঘোরাঘুরি করে যাদুঘরের ঘরে ঘরে, নাচ গান ইত্যাদিকেও ঠিক সেইভাবেই আমাদের অধিকাংশ লোকেই গ্রহণ করেছে তাদের জীবনে —গান শুনি, নিজে গাই না ; নাচ দেখি, নিজে নাচি না ।

 নৃত্যকলা গীতকলা চিত্রকলা এ সবকে জাতীয় শিক্ষার মধ্যে স্থান দিতে বারংবার বলা সেই থেকে সুরু হয় যখন থেকে গাইতে গলা চায় না, নাচতে পা সরে না, আঁকতে লিখতে হাত চায়ই না। তখন সঙ্গীতসভাই করি, নাট্যমন্দির শিল্পশাল এ সবই বা খুলে’ বসি জাতিকে জাগাতে, দেখা যায় তাতে করে’ দেশে ও জাতির প্রাণে ষে সুর পৌঁছয়, ষে রঙ ধরে, তার ছন্দ ছাঁদ সমস্তই পুরাকালের গানের টানটােন ভাবভঙ্গির ব্যর্থ অনুকরণ। তখন মনে আসে যে পুরোপুরি অতীতমুখী শিক্ষা নিয়ে বর্তমান জাতিকে অতীতের আবছায়াবাজির তামাসা দেখাতে পারা ছাড়া সত্যি কাযের লোক করে’ তোলা যায় না।

 দেবী বীণাপাণি কালে কালে নিজের হাতের বীণা একটির পর একটি তাঁর বরপুত্রকে দিয়ে আসছেন, প্রত্যেক বার গুণী কবি তাঁরা একটি একটি নতুন তার চড়িয়ে তবে বাজাচ্ছেন সেই বীণা—পুরোনো তারে পুরোনো বীণা ভাল বাজে না, নতুন তারে বাজে সে চমৎকার! সরস্বতীর বীণার তার প্রত্যেক বারে বদল হ’ল, বিচিত্র সুর দিয়ে চল্লো নতুন নতুন গুণীর হাতে । নারদের বীণায় নারদ ছাড়া কারো হাত পড়লো না, সেই পুরোনো তার, সুরও সেই সেকালেও যা ছিল একালেও তাই র’য়ে গেল ।

 সেদিন আমার এক ছাত্র তার মামাতো প্রমাতামহের প্রপিতামহের আঁকা একখানা ছবি নিয়ে এল, আমি কাযটা ছাত্রের হাতের বলে’ ভুল করে’ বসলেম, এতে আমার ছাত্র ভারি খুসি হয়ে উঠলো ; তার নামের আগে আমি ষে একটা চন্দ্রবিন্দু টেনে দিলেম সেটা সে দেখতেই পেলে না ।

 এমনি আর একদিন আমার সামনে আর এক ছাত্র একখানি বিলাতি ছবি এনে বল্লে সেটা তার কায, আমি তার নামের আগে ‘শ্ৰীযুক্ত’ কথাটি উড়িয়ে দিয়ে ছোট করে’ বসিয়ে দিলেম ‘মিষ্টার’, এবং দু-একটা মিষ্টি কথা দিয়ে খুসি করে’ বিদায় করলেম। ঘরের ছেলে ঘরে গেল আনন্দে ।  একদিকে যখন আমার দেশের পদ্মফুল কেবলি আউড়ে চল্লো দাশরথি রায়ের পদ্য আর ভ্রমরের পাঁচালী, অন্যদিকে হ’য়ে গেল আকাশ স্কটল্যাণ্ডের ব্লবেল ফুলের নীল স্বরে বিদেশিনীর চোখের প্রায় নীল, অথচ লোকে বল্লে ‘ভালই হ’ল’, ‘ভালই হ’ল’, ভাল হ’ল না একথা গোপনে কিন্তু লেখা হ’য়ে গেল যমরাজের দরবারে চিত্রগুপ্তের খাতায়।

 কাক এক কৌশলে বাসা বাঁধছে, বক স্বতন্ত্র রকমে বাঁধছে বাসা। এই কৌশল নিয়ে কি কাকে বকে এজাত ওজাত বলে’ আপনাদের পরিচয় দিচ্ছে। কোকিল বাসা বাঁধেই না, কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, অথচ তার সন্তান কোকিলই থাকে। আমাদের এই জাতিটা আগে তুলোট নয় তালপাতায় সংস্কৃতে পুঁথি লিখতো, এখন লিখছে বিলাতি কাগজে বিলাতি শ্লেটে ইংরাজিতে,—এতেই রচনার জাতিপাত হ’ল এটা ভাবা ভুল। হীরের ধাঁচাটা চেপটা কি গোল এ নিয়ে তার জাতিভেদ হয় না, তার জ্যোতির হিসেব ধরে’ হয় বিচার। রচনার প্রাণটি হচ্ছে আসল জিনিষ যা থেকে পরিচয় পাই এটি ভারতীয় না অ-ভারতীয়।

 মস্ত একটা সোলা টুপির মধ্যে আমাদের জাতীয় জীবন ধরা পড়ে’ পালিত হচ্ছে, তুলে নেই কাঁথা নেই ঝুলনো নেই কপাটি খেলা নেই সরিষার তেল নেই ক্ষীরের ছাঁচ নেই, পুরোনে চুর্ষিকাঠির বদলে ‘বেবি প্যাসিফায়ার’ ধরা হয়েছে তার জন্যে; কিন্তু তবু তার ডাক যদি না সে বদলায়, সাড়া যদি ঠিক না দেয়, তবে জানবো সে জাত হারায় নি। জাতীয় ছবি মূর্তি কবিতা সবার ডাক আছে, সাড়াও আছে, সেই সাড়া নিয়ে তাদের জাতিভেদ ধরা পড়ে রসিকের কাছে। প্রাণে পূবের সাড়া পৌঁছোলো না পশ্চিমের, আজকের না কালকের, অথব। বতমান অতীতের সাড়া দিলে কি না এই নিয়ে জাত বিচার হয় রচনার। শিল্প বল, সাহিত্য বল, ধর্ম কর্ম যাই বল, সবার জাতীয়তা প্রাণের সাড়ার সঙ্গে যুক্ত, বাইরের ভৌতিক বা আধিভৌতিক জীবনযাত্রার সাজসরঞ্জামের ধূমধামের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।

 সোঁনাকে বিশেষ কোন একটা রূপ দিতে হ’লে ছাঁচে চালতে হয়, কিন্তু সেই ছাঁচের এমন গুণ নেই যে রূপোকে সোনা করে; তেমনি জাতিকে বিশেষ একটা গঠন দিতে হ’লে জাতীয় শিক্ষার ছাঁচ দরকার, কিন্তু সেই ছাচঁকে কিছু সৃষ্টি করার স্বাভাবিক উপায় বলে’ ভুল করা সোনা গালাবার মতিটাকে সোনা সৃষ্টি করার উপায় বলে’ ধরে’ নেওয়া। সোনা আপনি তৈরি হয় স্বভাবের নিয়মে, মানুষের হাতে গড়া সোনা সে জাত সোনা নয়—সে কেমিক্যাল সোনা।

 কাঁচা সোনার রঙ পায় পিতল, কিন্তু সোনার গুণ তাতে পৌঁছোয় না হাজার বার সোনা জাতীয় শিক্ষার ছাঁচে চালেও। পুড়িয়ে পিটিয়ে লোহাকে ইস্পাত করা যায়, পিতলকে ছুরির আকার দেওয়াও চলে কিন্তু ইস্পাতের গুণ পিতলে পৌছোয় না। মানুষ অদ্ভুত কৌশলে লোহাকে বাতাসের উপরে উড়িয়ে দিয়েছে পাখীর মতো, কিন্তু সেই লোহাতে পাখীর প্রাণ পৌছে দেবার সাধ্য মানুষের কোনো যুগে হবে বলে’ বিশ্বাস করে কি কেউ?

 ‘স্বভাবে মূর্দ্ধণি বর্ততে’। চিরাগত কতকগুলো প্রথা ধরে’ জাতির বা মানুষের মন বুঝে’ মনগড়া শিক্ষালয়ে যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেল তাকেই বল্লেম জাতীয় শিক্ষা। সার্কাসের জানোয়ারগুলো এক রকমের শিক্ষা পেয়ে প্রায় মানুষের মতো চলা ফেরা বলা-কওয়া করে, কিন্তু সে শিক্ষার মূলে স্বাভাবিকতা নেই। বেরাল স্বভাবের নিয়মে যে জাতীয় শিক্ষা পায় তাতে ইদুর ধরতে মজবুত হয়ে ওঠে, দুধ খেতে শেখে, মুড়ো চুরি করতে শেখে; প্রাণের দায়ে এ সব স্বাভাবিক শিক্ষার ফলে ঘটে, অবস্থা বুঝে’ ব্যবস্থা করে’ নেয় বেরাল। কিন্তু যে শিক্ষায় বেরাল বসতে শেখে, চৌকিতে যেতে শেখে, টেবিলে বাজাতে শেখে হারমোনিয়াম, সেই মনুষ্যজাতীয় শিক্ষা বেরালের পক্ষে জাতীয় শিক্ষা বলা যেতে পারে না।

 জাতীয় শিক্ষা স্বভাব বুঝে’ যেখানে চল্লো সেখানে ঠিক শিক্ষা হ’ল, আর যেখানে সে শিক্ষা সার্কাসের ঘুরপাক ধরে’ চল্লো সেখানে জাতি বড় একটা কিছু লাভ করতে পারলে না, সার্কাস বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে তারও কাজ ফুরিয়ে গেল এবং এমন উপায়ও রইলো না যাতে করে’ সে আবার স্বাভাবিক অবস্থা পেয়ে যায়।

 আমাদের জাত যদি সেকালের মধ্যে ধরা থাকতো—যেঁমন বেরাল জাত ধরা আছে এখনো সেই পুরাকালের ষষ্ঠীমাতার পায়ের কাছে, তবে কোন্‌ রকম শিক্ষা দিলে এদেশের কলাবিদ্যার পুনরাবির্ভাব হ’তে পারে এ সব কথা ভাববার অবসরই হ’ত না। কিন্তু মানুষজাত যে কালে কালে তার বাইরের সঙ্গে ভিতরটাও বদলে’ চলেছে, এক কালের নরপিশাচ আর কালে হচ্ছে নরদেব;—কাযেই দেখি সেকালের শিক্ষা তা একালে চালাতে পারা যায় না অটুটভাবে। জাতীয় শিক্ষার মধ্যে নানা শিল্পকলার স্থান আছে এটা এখন আর কেউ অস্বীকার করে না, যদিও জানি যে তপস্যা সাধনা প্রতিভা এ সব না হ’লে কবিও হয় না শিল্পীও হয় না কেউ। কাযেই আমার দেশের চিত্র মূর্তি কবিতা গান নাচ নাটক খেলাধুলো ইত্যাদির যে কুলামুগত নানা প্রথা কালে কালে জমা হয়েছে এবং দেশাচারগত যে সমস্ত ব্যবস্থার ছাপ তাতে পড়েছে, সেগুলো দেখে’ শুনে হিসেব ঠিক করে তবে আজকের আমাদের জাতিকে শিক্ষার ব্যবস্থা করে নিতে হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা জায়গায় এসে সমস্ত ব্যাপারটা ঠেকে—সেটি হচ্ছে একাল। প্রাচীন জাতির কুলানুগত আচার ব্যবহার আজকের কালানুযায়ী হ’ল কি না সেইটেই দেখবার বিষয়। সেকালের অনুকরণে একালের ছেলেরা মেয়ের ছবি আঁকলে পাঁচালী গাইলে চরকা কাটতে বসে গেল—এ হ’ল জাতীয় প্রদর্শনীতে মেডেল পাবার মতো করে শিক্ষা দেওয়া, একে জাতীয় শিক্ষা নাম দেওয়া যেতে পারে না, একজাতীয় এবং এককালীন শিক্ষা বল্পেও বলা যায়। কোনো জাত এবং কোনো জাতের কোনে কিছু এমন করে বড় হয় না। জাতীয় শিক্ষা সত্য হ’য়ে ওঠে তখনই যখন কালের সত্যকে সে মেনে চলে। যে জাত শিক্ষায় দীক্ষায় সেকালকেই মেনে চল্লো সে জাত কোনো দিন স-কালের মধ্যে জাগলে না—দেশজোড়া অ-কালের মধ্যেই তার যথাসর্বস্ব ক্ষয় হ’য়ে গেল।

 আগে গাছ বাড়লে তবে তো তার ফল-ফুল, তেমনি আগে জাত বাড়লে তবে তার শিল্পকলা ইত্যাদি কথা তর্কের মুখে বক্তৃতার জোরে প্রায়ই শুনি এবং হয়তো বলেও থাকবো; কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো ষে, ফলন্ত ফুলন্ত বীজ বলে একটা পদার্থ আছে এবং সেই পদার্থটিই তাল তমাল বট অশ্বথ হ’য়ে বাড়ে। মালি না থাকলেও ফলন্ত বীজ গাছ হ’য়ে বাড়তে থাকে আপনার রস আপনি খুঁজে নিয়ে, কিন্তু অফলন্ত বীজ যদি হয় তবে সার-মাটিতেও নিস্ফলা রয়ে যায় সেটি।

 শিশু দাঁত নিয়েই জন্মায়, শুধু দাঁত ফোটে ছেলে একটু বড় হ’লে, জাতির মধ্যে তেমনি জাতিটার যে সব বিকাশ ভবিষ্যতে হবে তা ধরা থাকে, কালে সেগুলো ফুটতে থাকে ভাল-মন্দ আবহাওয়ার বশে। কোন ছেলের কথা ফোটে আগে, কোন ছেলে কথা বলে দেরীতে, কিন্তু যে ছেলে বোবা তার কথা বড় হ’য়েও ফোটে না, বুড়ো হ’য়েও ফোটে না—যতই কেন ভাল আবহাওয়ায় সে থাকুক না।

 বয়সে দাঁত পড়লো চুল পাকলো, দাঁতও বাঁধালেম চুলও কালো করলেম; দুটোই সৌখীন জিনিষের মতে, শিকড় গাড়লো না জীবন্ত মানুষের রক্ত চলানোর ক্ষেত্রে। এই ভাবে জাতীয় শিল্প সঙ্গীত কবিতার রঙ ধরানো যায় একটা বুড়ো জাতির গায়ে কিন্তু সেই কৃত্রিম রঙ তো টেকে না বেশীদিন এবং সেটা দিয়ে জাতির জরা এধং মরার রাস্তাও বন্ধ করা চলে না একদিনও।

 যেখানে জাতীয় জীবন বলে একটা কিছু নেই সেখানকার মানুষগুলির সঙ্গে কতকগুলো শিক্ষাগার পাঠাগার কমশালা ধম শালা আখড়া আড্ডা আশ্রম ভবন ইত্যাদি যেন তেন প্রকারেণ জুড়ে দিলেই ষে ঠিক ফলটি পাওয়া যাবে এমন কোন কথা নেই। মরা আমগাছে নাইট্রোজেন বৃষ্টি করে আঁকসী হাতে বসে’ ফল পায় কি কেউ? জাত দু’তিন রকমের আছে; যেমন, ক্ষুপ জাত অর্থাৎ জাতে বড় গাছ কিন্তু এক বিঘতের বেশী তার বাড় নেই, ডালপালাগুলো চীনের পায়ের মতো বিষম বাকাচোরা, দেখতে গাছের মতো ঝাকড়া কিন্তু ফল দেয় না, ফুল দেয় না, ছায়া দেয় না, টবে ধরা থাকে। আর এক রকমের জাত ক্ষোপ, জাত, মৃত জাত, শুকনো গাছ, অনেক কালের মর কাঠ, দেশ বিদেশে পাখী কাঠবেরাল বনবেরাল কাগাবগার খোপ আর দাড়ের কায করছে। ক্ষুপ জাতের সুবিধে আছে যে কোন গতিকে টব থেকে ছাড়া পেলে সে তেজে বেড়ে উঠতে পারে, ক্ষোপ জাতের সে সুবিধে নেই, ক্ষেপে খাপে ফোপর কাঠ তাতে টেবিল চৌকিও তৈরি হয় না, জালাতে গেলে ধুয়া হয়, শুধু সেটা নিয়ে দেহতত্ত্বের এবং জাতিতত্ত্বের নানা গভীর কথা সমস্ত আলোচনা করা চলে। একদিকে বাড়হারানো বড় জাত, অন্য এক দিকে বাড়-দাবানে বড় জাত, ভারতবষী জাত বলতে এ দুটোর কোনটা বলা শক্ত। আমি দেখি আমাদের আজকের জাতীয় জীবনটা এই দুয়ের খিচুড়ী। ছিল জাত হবিন্যান্নজীবী, হ’ল ক্রমে খেচরান্নজীবী। আগের জাত ভাল ছিল এখন হ’ল মন্দ এ কথা আমি বলিনে। জাতীয় জীবনের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, কেউ তাকে ঠেকাতে পারে না, কালের উপযোগিতার নিয়ম মেনে তবে বাঁচে জাত। আর্য জাতি এককালে ছিল আমমাংসভোজী, তারপর খেতে সুরু করলে আমানি, এবং এখন খাচ্ছে আম আমানি দুই-ই,—একই জাত শুধু কালের পরিবর্তনের মধ্যে পড়ে ভিন্ন চেহারা ধরছে। এটার জন্যে ভাবনা নেই, শুধু ভাববার বিষয় এই যে, জাতটির জীবনীশক্তির দৌড় বাড়ের দিকে না তার উল্টে দিকে। আজ যদি কেউ আমাকে বলে হবিষ্যান্ন ধরলেই তুমি ঠিক তোমার আগেকার তাদের শিল্পকলায় বিশুদ্ধি ইত্যাদি সমস্তই পেয়ে য়াবে, বিশুদ্ধ সঙ্গীত বিশুদ্ধ কবিতা বিশুদ্ধ সাহিত্য এবং বিশুদ্ধ কর্মকাণ্ড সমস্তই এসে যাবে দেশ ও জাতির কবলে, তবে তাকে এই কথাই তো বলবো যে, কালকের মতো হ’য়ে পড়ার জন্য মাতুলী ধারণ করে’ নিতে ব্যস্ত হ’য়ে লাভ কি? সেকালের রক্ষাকবচ একালের জীবনসংগ্রামে তো কাযের হবে না, সেকাল রাখলে যে একাল যায় তার কি? নদীর জাত বাঁচাতে গিয়ে নদীর চলাচল বন্ধ করায় কোন লাভ? চীনদেশ ভোজন-বিলাসী, তারা তিন শত বছরের হাঁসের ডিম খেয়ে রসনা তৃপ্ত করে, কিন্তু তা খেয়ে প্রাচীন চীনের শিল্প-সম্পদ পাবে বলে’ তারা বিশ্বাস করে না একেবারেই—সখ হয় তাই খায়, সুস্বাদু বলে।

 পুরোনো চাল ভাল, পুরোনো শাল ভাল, পুরোনো কাঁথা তাও ভাল, সকল ভাল জিনিষের ভাণ্ডার বলতে পারো আমাদের প্রাচীন আমলকে, তথাপি পুরোনো হ’য়ে যাওয়া যে ভাল এ কথা তো কেউ বলছে না আমরা ছাড়া!

 আজকের কালে প্রাচীন শিল্পের আদর যথেষ্ট দেখে’ আমরা দলে দলে কেউ বৌদ্ধ যুগের মতো কেউ মোগল আমলের মতো ছবি মূর্তি গানবাজনা ইত্যাদি করতে বসি; শুধু এই নয়, পুরাণের পাতা থেকেই কেবল ছবি মূর্তি হাব ভাব ইত্যাদিও হুবহু নিয়ে কায করতে লেগে যাই। ত। হ’লেই বা কি হবে? এই ভাবে সাময়িক আদর বা অনাদরের বিচার করে’ চলায় ব্যবসার বুদ্ধি বৃদ্ধি পায় কিন্তু এতে করে’ রসবোধ জাগে না জাতির অন্তরে এবং জাতিটাও এতে করে’ নিজের শিল্প-সম্পদ পেয়ে ধন্য হ’য়ে যায় না।

 জাতিটাকে যখন চৌরঙ্গীবাতে ধরলে তখন তার হাতে পায়ে বুকে পিঠে পুরোনো ঘি মালিস করে’ দেখা গেল বেশ চলে’ ফিরে’ বেড়াতে লাগলো সে, তাই বলে পুরোণো ঘিয়ে লুচি ভেজে তাকে তুষ্ট ও পুষ্ট করা তো চল্লো না, ষে কবিরাজ পুরোনো ঘিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনিই তখন বল্লেন টাটকা গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজতে।

 আজকের হাঁস তিনশো বছর আগেকার ডিম পাড়বার সাধনা করবার আয়োজন করে’ বসলে পরমহংস বলে’ তাকে ভুল করে না কেউ, তেমনি আজকের জাত কালকের ভূত নামাতে শব-সাধনার আয়োজন করছে দেখলে তার সিদ্ধিলাভের পক্ষে সন্দেহ অনেকখানি থেকে যায়।

 আজকের সঙ্গে কালকের নাড়ির সম্বন্ধ আছে। আজকের শিল্প কালকের শিল্পের উপরে বসে পদ্মাসনা শবাসনা—এটা সত্যি কথা, কিন্তু এই শবাসনার সাধনায় অনাচার ঘটলে ভূত প্রেত এসে সাধকের ঘাড় ভাঙে, সিদ্ধিদাত্রী বরদা আসেন না,—এটা জানা কথা।

 শবাসনাব জন্যে ব্যস্ত নই, শব খুঁজছি কেবলি, এতে করে’ অতীতের ভূতের কবলে পড়ে’ কর্ম পণ্ড হওয়া বিচিত্র নয়। সাধাসাধি করে’ হাতে পায়ে ধরে’ লোককে দিয়ে কায হয়, মেরে ধরেও কার্য সিদ্ধি করিয়ে নেওয়া চলে, কিন্তু সে কায কার কায, সে সিদ্ধি কার সিদ্ধি?—যে সাধছে বা যে মারছে কেবল তারি নয় কি? আমার কথায় ভুলে’ বা ধমকানি শুনে’ যদি আজ দেশ শুদ্ধ ছবি মূর্তি গড়তে লেগে যায় আমি যেমনটি চাই তেমনি করে’, তবে তার ফল দেশ পাবে, না, দেশের যারা আমার কথায় উঠলো বসলো তারা পাবে? আমার খেয়ালমতো আমি লোক লাগিয়ে ঘর বাঁধলেম, সে ঘর আমার ঘর হ’ল, আমি তার আশ্রয় পেলেম, ছায়া পেলেম, মিস্ত্রী মজুর তারা ঢুকতেই পেলে না বৈঠকখানায়। যে গুরু হাত ধরে’ নিয়ে গেলেন শিষ্যকে শিল্পজগতে তিনিই যথার্থ গুরু; যে গুরু ঘাড় ধরে’ শিষ্যকে বল্লেন, ‘আমার আজ্ঞানুবত্তী হ’য়ে যেমন বলি তেমনি চল’, সে গুরু গুরুমশাই, তিনি নিজের বেতন বাড়িয়ে গেলেন ছাত্রের দৌলতে।’

 আগেও ছিল এখনো আছে এক এক শ্রেণীর লোক জাতের কর্তা হ’য়ে ওঠে তারা, যার জাত নেই তাকে জাত দিতে জানে না; যে জাত ঘুমোচ্ছে তাকে জাগাতে হ’লে কি করা উচিত তাও জানে না, জাত মারবার ফন্দিই তাদের মাথায় ঘোরে, পাশাঙ্কুশ-হস্তে তারা যমরাজের মতো বসে’ থাকে জাতকে বাঁধবার পাশ আর জাতকে মারবার অঙ্কুশ দুই অস্ত্র সর্বদা উঁচিয়ে।

 আগেও ছিলেন এখনো আছেন অন্য এক এক শ্রেণীর লোক যাঁরা বরাভয়-হস্তে বুদ্ধদেবের মতো দ্বারে দ্বারে হেঁটে বেড়ান, সমস্ত মানবজাতির হাতে ভিক্ষা নিয়ে তাঁরা জগৎবাসীকে ধন্য করে’ যান, অভয় দিয়ে নির্ভয় করেন, বর দিয়ে শক্তিমান করেন। ঘুমন্ত জাতির মুমূর্ষু জাতির আশার প্রদীপের শিখা এই সব জাগ্রত মানব-আত্মা যাঁরা রাত্রির অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আলো বহন করে’ আনেন।

 কালসূত্রে ধরা রইলো কালকের সকালের সঙ্গে আজকের সকাল, কালকের জাতির সঙ্গে আজকের জাতি, কাব্যকলা সঙ্গীতকলা শিল্পকলা জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনটিও তেমনি কালসূত্রে গাঁথা রইলো—বেজোড় মুক্তা! আজকের আমাদের জাতির উপরে সব চেয়ে যে বড় দায়িত্ব তা হচ্ছে এই অতীত কালের মালায় যে বেজোড় মুক্তা দুলছে তার সঙ্গী আর একটি কালসূত্র গেঁথে যাওয়া। আমাদের জীবন কেমন জিনিষটা ধরে’ গেল আগেকার জীবনের পাশে এই নিয়ে আমাদের পরে যারা আসবে তারা আমাদের গুণপনা বিদ্যা বুদ্ধি সমস্তেরই বিচার করবে। অতীতের পাশে আজ আমরা যাই ধরি, কাচই ধরি মাটির ঢেলাই ধরি কালে সেই আজকে ধরা তুচ্ছ জিনিষ তাও মালার একটা অংশ ধরে’ থাকবেই—চাঁদের কোলে কলঙ্কের মতো। পরবর্তী কেউ এসে অনুকূল সমস্ত প্রবন্ধ লিখে’ কিংবা মাটির ঢেলার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে হয়তো আমাদের আজকের তুচ্ছ কায সমস্তের গভীর অর্থ বার করে ভবিষ্যতের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবে; কিন্তু এমনো লোক থাকবে সেদিন যে সজোরে এই ঘোরতর রকমে মালা মাটি করাটাকে অভিসম্পাত দিয়ে আজকের আমাদের জাতীয় সভ্যতার বিরুদ্ধে সমালোচনা করে’ চলবে ক্রমাগত। এই ভাবে হয়তো কত কাল ধরে’ তা কে জানে মালা ফিরবে অনুকূল ও প্রতিকূল ভাবে জাতিতত্ত্ববিদ্ জাতীয় ঐতিহাসিক জাতীয় শিল্প-সমালোচক প্রভৃতির হাতে, মাটির ঢেলার পাশে আর একটি দানা তারা গাঁথবে না, শুধু হাওয়াই গেঁথে যাবে দিনের পর দিন, তারপর হঠাৎ একদিন সারা দেশ সমস্ত পৃথিবী দেখতে পাবে হয়তো মাটির ঢেলার পাশেই আর একটি অপূর্ব সুন্দর জীবন-বিন্দু ধরা পড়েছে কালসূত্রে। এই জীবন-বিন্দু জাতীয় কোন রকম শিক্ষাগার হাঁসপাতাল ল্যাবোরেটারী লাইব্রেরী ইউনিভারসিটি কিম্বা সিটি ফাদারদের চা খাবার পেয়ালায় কিম্বা আর্ট স্কুলের রঙের বাটির মধ্যে জন্মায়নি, মহাকাল একে সবার অসাক্ষাতে জন্ম দিয়েছে কোন এক লোকের বুকের ভাষায়, তারপর একদিন সেই একটি লোকের জীবন ও বিন্দু মহাকালই নিঃড়ে নিয়ে ধরেছে নিজের বিজয়মালার মধ্যে।

 এই যখন হ’ল তখন এল জাতি, বিচার করে’ ভেবে চিন্তে একটা মহাসভা ধূমধামে বসিয়ে সকলে জাতীয় কবি জাতীয় শিল্পী জাতীয় যে কেউ তার মূর্তি-প্রতিষ্ঠার জন্য চাঁদা তুলতে বার হ’ল এবং জাতীয় গৌরব অনুভব করার আয়োজন সার্থক করার চেষ্টায় কোথায় ন্যাশনাল কনসার্ট ন্যাশনাল থিয়েটার, ন্যাশনাল হোটেল আছে সেখানে বায়না দিতে ছুটলো, ও কাযটা যাতে ন্যাশনাল রকমে হয় তার জন্যে একটা রেজোলিউসান পাস করিয়ে নিয়ে খেটেখুটে অকাতরে গিয়ে নিদ্রিত হ’ল নিজের কেল্লায়। মহাজাতি রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে মহাকাল দৈত্যের মতো তাকে ধরতে এসে কেল্লার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে, কে জাগে? রাজকুমারী সাড়া শব্দ দেন না, সাড়া দেয় যে পাহারা দিচ্ছে মহাজাতির শিয়রে। কে জাগে?—সওদাগরের পুত্র জাগে। কাল নিরস্ত হয় আবার আসে দ্বিতীয় প্রহরে, কে জাগে?—মন্ত্রীপুত্র জাগে। তৃতীয় প্রহর যায়, কাল ফিরে’ এসে বলে, কে জাগে?—কোটালের পুত্র জাগে। রাত-শেষে অন্ধকার পাতলা হয়, কাল ছুটে এসে বলে, কে জাগে? কে জাগে?—রাজপুত্র জাগে!

 বারে বারে এইভাবে মানবজাতি ঘুমোয়, জাতির শিয়রে জাগরণ বসে’ থাকে কালের কবল থেকে তাকে বাঁচাতে, সকাল হ’লে এদের কায শেষ হ’য়ে যায়। এদের রাতের গাঁথা অসমাপ্ত মালা রাজকুমারীর ঘরের দুয়োরে পড়ে থাকে, সে মালা মহাজাতি সাহাজাদীর হাতে গাঁথা মালা নয়, সে চাহার দরবেশ তাদের জপমালা। রাজকুমারী তাকে অনেক সময় মাড়িয়ে চলে যান নিজের গরবে, হয়তো বা রাজকুমারীর দাসী সে পেয়ে যায় সে মালা ঘর ঝাঁট দিতে, কিংবা ঘরের দুয়োরে আলপন টানতে বসে’ অথবা এমনি চলে’ যেতে যেতে!

 জাতির সঙ্গে শিল্পী কবি এদের যোগ জাগ্রতের সঙ্গে ঘুমন্তের যোগ। জাতির চোখে ঘুম আসে, এদের চোখে ঘুম নেই, জেগে থাকে এরা একলা, একলা বসে’ খেলে এরা, একলা মালা গেঁথে চলে, বীণা বাজায়, গান গেয়ে বলে—

“ছিল যে পরাণের অন্ধকারে
এল সে ভুবনের আলোক পারে।
স্বপন বাধা টুটি
বাহিরে এল ছুটি
অবাক আঁখি দুটি
হেরিল তারে।
মালাটি গেঁথেছিল অশ্রুহারে,
তারে যে বেঁধেছিনু সে মায়া হারে
নীরব বেদনায়,
পূজিনু যারে হায়
নিখিল তারি গায়
বন্দনা রে!”

—রবীন্দ্রনাথ

 জাতীয় অনুষ্ঠানের ফলে দেশে বড় শিল্প বড় কাব্য আসে না—বড় বড় বাড়ী আসে, মন্দির আসে, মস্ত জনতা আসে, মস্ত কোলাহল, সবই মস্ত প্রকাণ্ড ধূমধামের সঙ্গে সঙ্গে আসা-যাওয়া করে, কিন্তু যা কিছু সত্য বস্তু জাতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয় তা ফুলের মধ্যে মধুর মতো স্বাতী নক্ষত্রের চোখের জলের মতো গোপনে নেমে আসে অদৃশ্য লোক থেকে; তার আসা-যাওয়ার পথের চিহ্ন পড়ে না দেশের বুকে। যার কাছে আসে তার বুকেও সে গোপনে আসে দেশ কালের অতীত এক দেশ থেকে, সে ডাক দেয় কবির প্রাণে, সে সাড়া পৌঁছে যায়।

 কবি বলেন—

“ডাকে ডাহুকী ফাটি যাওয়ত ছাতিয়াঁ।”

এ কোন্ ডাক পাখী, এ কোথা থেকে আসে যার ডাক শুনে’ প্রাণ ফাটে। এ কি জাতীয় খালের কাদায় বাসা বাঁধে? স্বদেশী পাখী ধরার ফাঁদে একে কি ধরা যায় না? হেনরী মার্টিনের বন্দুকে একে আকাশ থেকে পাড়া চলে খানার টেবিলে? একের প্রাণে যে বসন্তকালের সমীরণ বইলো তাই ধরে’ এ আসা-যাওয়া করলে কালে কালে দেশে দেশে বারে বারে, দেশের কবি গাইলে এই ডাক পাখীর উদ্দেশে—

“তুমি কোন পথে যে এলে পথিক
দেখি নাই তোমারে,
হঠাৎ স্বপন সম দেখা দিলে
বনেরি কিনারে।”

—রবীন্দ্রনাথ

 লোকারণ্যের একধারে হঠাৎ আগমনী বেজে উঠলো, জাত জানেও না সোনার তরী এসে গেছে পসরা ব’য়ে নতুন অতিথিকে ব’য়ে, সমস্ত জাতির বিনা বেতনের চাকর কবি শিল্পী এরা ছুটে গেল অতিথির অভ্যর্থনা করতে, অতিথি তাদের ধন্য করে’ গেল, জাত তার কোন খবরই নিলে না। বিদায় বেলায় দেশের কবিই একা তাকে বল্লেন—

“তোমার সেই দেশেরি তরে
আমার মন যে কেমন করে,
তোমার মালার গন্ধে তারি আভাস
আমার প্রাণে বিহরে।”

 অষ্ট্রেলিয়ার ঘোড়ার আড়গোড়ার একটা সাহেব সমুদ্রের উপরে সূর্যাস্তকে তাদের বিদেশী সন্ধ্যা বলে বর্ণন করেছিল আমার এক বন্ধুর কাছে; সে হিসেবে আর্টকে বলা চলে ন্যাশনাল কিন্তু আসলে আর্ট তা নয়, সে পথিক, তার বাসা জাতীয় আগারে নয়, তার পথ জাত দেবতার রথচক্র-লাঞ্ছিত বড় রাস্তাও নয়, ছোট গলিও নয়, ঠিক ঠিকানা সব নিশান-হারানো পথে—বিস্ময়কর অপূর্ব-দর্শন। সে কবিকে বলায়—

“কোন দেশে যে বাসা তোমার
কে জানে ঠিকানা,
কোন গানের সুরের পারে, তার
পথের নাই নিশানা।”

—রবীন্দ্রনাথ