বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/অরূপ না রূপ
“অরূপ বীণা রূপের আড়ালে”
বীণা দেখা যায় কিন্তু সুর তাকে দেখা যায় না; কিন্তু চেনা যায় সেই সুর দিয়ে যে এটি বীণা বাজছে, ঢাক নয় ঢোল নয় গ্রামেফোনের বীণা নয়। দেখা বীণার সঙ্গে না-দেখা যে সুরটি জড়িয়ে রয়েছে, সেটি বীণার প্রাণস্বরূপ, বীণার কাঠামো ধরে’ আছে প্রাণ।
“রূপের পাথরে আঁখি ডুবিয়া রহিল,
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।”
একটি রূপের অশেষ প্রকাশ, দৃষ্টি খুঁজে খুঁজে রূপ-সাগরের পায়ে অরূপ বলে একটা কিছু ধরতে সাঁতরে চল্লো না, রূপের মধ্যেই তলিয়ে গেল। মন যৌবনের শেষ চাইলে না, নতুন থেকে নতুনতর আনন্দে আপনাকে হারিয়ে ফেলেই চল্লো। এই হ’ল রূপদক্ষের কথা, রূপ-সাধনের চরম সিদ্ধি। এক সঙ্গে রূপ-লাবণ্য ভাবভঙ্গি যা চোখে দেখা গেল তা এবং সেই সঙ্গে রূপের মাধুরী তাও পেয়ে গেল যখন মানুষ, তখন সে হ’ল রূপদক্ষ।
রূপ সবারই চোখে পড়ে কিন্তু রূপের মাধুরী তো সবার কাছে ধরা দেয় না। ফুলটা দেখলাম, ফুলের আভ্রাণ নিয়ে ফুলের সৌরভ কেমন তাও জানলাম, কিন্তু এই হ’লেই যে ফুলের মাধুরীটিও পেয়ে গেলাম এমন নয়।
রূপের মধ্যে তিনটি জিনিয—একটি তার আকার প্রকার, একটি তার অন্তর্নিহিত ভাব আর এই দুই জড়িয়ে যে মাধুরী ফুটলো সেটি। পর্বত যে পর্বত এবং সে যে বিরাট ভাব নিয়ে বিরাট, এটুকু সাধারণের পক্ষে ধরা শক্ত নয়, কিন্তু পর্বতের নবীন নীরদ শ্যামরূপের মাধুরী সবার ধারণার বিষয় তো হয় না। তেমনি একটা কবিতা ছবি গান এরা যা দেখালে তা পেলেম, অথচ এদের মাধুরী মনকে একেবারেই স্পর্শ করলে না এমন ঘটনা সাধারণ। রূপদক্ষ যাঁরা তাঁরা এই মাধুরীকে পেয়ে যান, তাই সব রূপই তাঁদের কাছে কালে কালে পুরাতন হ’য়ে যায় না, কোন কালে এই আকাশ-পর্বত নদ-নদী জল-স্থল এরা পরিচয়ের দ্বারা ঔদাসীন্য এনে দেয় না তাঁদের মনে, পলে পলে বারে বারে এরা মনের সঙ্গে এসে লাগে, চোখে এসে লাগে এরা নতুন হ’য়ে মধুর হ’য়ে।
পর্বত একবার দুবার দেখলে তাকে দেখার তৃষ্ণ মিটে গেল আমাদের, কিন্তু রূপদক্ষ তাঁরা আমাদের চেয়ে সৌভাগ্যবান, তাঁরা তো শুধু রূপ বা ভাবটাই পেলেন না পর্বতের বা অরণ্যের বা ফুলের বা কবিতার বা ছবির অথবা গানের—তাঁরা রূপের সঙ্গে রূপের ভাব এবং তাদের মাধুরী যা রূপকে চিরযৌবন দেয় তা পর্যন্ত পেয়ে ধন্য হলেন।
যাঁরা সত্যি রূপদক্ষ তাঁদের আনন্দের শেষ নেই, চোখ, মন সব দিয়ে একটি রূপকে তাঁরা বিচিত্রভাবে দেখে’ যাচ্ছেন নতুন নতুন—চিরকাল ধরে’ নতুন। হিমালয় পর্বত সেও রূপের রঙের সঞ্চয় নিয়ে পুরোনো হ’য়ে শেষ হ’য়ে গেল যাদের কাছে এমন মানুষ খুব কম নেই, কিন্তু হিমালয়ের একটা পাথর একটা গাছ মাধুরী পেয়ে অফুরন্ত হয়ে রইলো, চিরনূতন হ’য়ে গেল যার কাছে এমন মানুষই কম দেখা যায়।
গানে যে রূপ ফুটছে, কবিতায় যে রূপ, ছবিতে যে রূপ এবং বিশ্বের এই বিশ্বরূপ—সবারই কায মাধুরীতে মনকে তলিয়ে দেওয়া। এই মাধুরী স্পর্শ করে’ চলেছে তাবৎ জীব, কেউ এতে তলিয়ে যাচ্ছে, কেউ সমুদ্রের জলে তেলের মতো উপরে উপরে ভাসতে থাকছে তলাতে পারছে না।
চন্দ্রোদয় দেখে ‘আহা সুন্দর’ বলে না এমন লোক কম, কিন্তু তারা সবাই চাঁদের মাধুরীকে পেয়ে যায় না। এই ধরণের সাধারণ ভাবপ্রবণতা চন্দ্রকান্ত-মণির মতো চাঁদ উঠতেই ভিজে ওঠে, কিন্তু কিছু উৎপন্ন করে না মনের সামগ্রী। অসাধারণ ভাবপ্রবণতা হ’ল মাটির মতো, রসে ভেজে, বীজে ফল ধরায়, শক্তি গজায়, ফুল ফোটায়, ফল দেয় নানা রকম।
জিনিষটাকে বার থেকে বেশ করে’ চেনা হ’ল এবং তার ভিতরের ভাবটাও যাহ’ক নিপুণভাবে বার করে’ দেখা হ’ল কিন্তু বাকি রইলো তখনো আসল যেটা পাবার সেটি পাওয়া—রূপের মাধুরীটুকু।
আর্টের সঙ্গে আর্টিষ্টকে পাই তাই আর্টের আদর করি, রূপের আড়ালে অরূপকে দেখি তাই রূপের আদর করি, এমনি কতকগুলো বচন আর্ট-সমালোচনাতে প্রচলিত হ’য়ে গেছে। আর্টিষ্টের এবং অরূপের কাছে পৌঁছে দিতে রূপ এবং আর্ট যেন আমাদের সোপান। রূপ সিঁড়িও নয় প্রহরীও নয় আর্ট exhibition এর, যে তাকে ধরে’ আর্টিষ্টের সঙ্গে পরিচয় করতে চলবে, বা অরূপ অদ্ভুত একটা বাজি দেখবে তার কাছে ছাড়পত্র নিয়ে!
মাধুরী দিয়ে রূপের সাগর ভাসিয়ে নিতে তলিয়ে নিতেই রূপ আছে, রূপ আছে আর্টিষ্টের কথা অরূপের ধ্যান ভুলিয়ে দিতেই। সুরূপাদের শিরোমণি তাজবিবি সে মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে, কিন্তু তার রূপ সে এসে বল্লে, ‘এই রইলেম আমি রূপের স্বপ্নে বাঁধা এই পাথরের ভিতরে বাহিরে সুপ্রত্যক্ষ, অরূপে মিলালো না রূপ আমার, রূপের সঙ্গে মিল্লো এসে আমার নতুন রূপ।’ তাজমহলের দর্শন শিল্পীর নাম ও পরিচয় বা ইতিহাসের এক অধ্যায় পড়ে’ নেওয়াতে তো নয়, তাজমহলের রূপের মাধুরী পাওয়াই হচ্ছে দেখার শেষ। রূপ থেকে মাধুরীকে পেয়ে যাওয়াতে রূপের এবং রূপদক্ষের সার্থকতা। দেহতত্ত্ব আধ্যাত্মিকতত্ত্ব এমনি শক্ত রকমের একটা তত্ত্ব পেয়ে রূপ বা রূপদক্ষ ধন্য হয় না কোন কালে।
বর-কনের বিয়ের দিনে অনেকগুলো লোক থাকে যারা কেউ ‘তত্ত্ব’ বয়, কেউ শাস্ত্র কয়, কেউ বর কনের দাম কত যাচাই করে, এমনি নানা ঘটনা নিয়ে উৎসব একটা রূপ পেয়ে বসে সবারই কাছে। কিন্তু উৎসবের মাধুরিমা পেয়ে যায় শুধু দুটি তিনটি লোক—বর-কনে কনের মা এমনি দুচার অন্তরঙ্গ, যারা হাসে কাঁদে এক সঙ্গে।
বিশ্বজোড়া রূপ মাধুরী-সাগরে টলমল করছে,—বাতাসে মাধুরী, সাগরজলে মাধুরী, আকাশে মাধুরী, ধরিত্রী মাধুরী বহন করছে, অরণ্যে মাধুরী, পথের ধূলা তাতেও মাধুরী। এত মাধুরী ধরা রইলো দশ দিকে কিন্তু এর উপভোগের উপযুক্ত হ’ল না মানুষ ছাড়া আর কোন জীব। এই যে শ্রেষ্ঠ দান কবির কবি রচয়িতার রচয়িতা আর্টিষ্টেরও আর্টিষ্টের কাছ থেকে এল, একে পেয়ে মানুষ পরিতৃপ্ত হবে, না এতে খুসি হ’য়ে দাতারই কথা স্মরণ করবে—এই ভাবনা হিমালয়ে বসে’ আমার মনে উঠেছিল। আমার দেবতাকে আমি প্রশ্ন করেছিলেম, দান দেখেই যে ভুলে’ থাকি তোমায়, দেখতে চোখও চায় না মনও চায় না—এ কেমন দান তোমার!
সত্যই যে দান দাতাকে ভুলিয়ে দেয় সেই তো বড় দান, যে দান ঠেলে’ দাতা আপনি এগিয়ে আসেন সে দান তো তুচ্ছ দান। রূপদক্ষতার চরম তো সেইখানে যেখানে রচনার রূপ রঙ সমস্তই ভুলিয়ে দিলে রূপদক্ষকে, শুধু তার দান করা রূপের মাধুরী মনকে পরিপূর্ণ করলে।
ছবির কবিতার সঙ্গীতের উদ্দেশ্য রচয়িতাকে সুপরিচিত করা—এ হ’তেই পারে না। রচয়িতা যেখানে গোপন, রূপদক্ষের পূর্ণ দক্ষতা সেখানে। ছবির সঙ্গে আর্টিষ্টকে জানছি এ নয়, আর্টিষ্টকে জানলেম না শুধু জানলেম রচনাকে এবং পেলেম তা থেকে মাধুরী যা পাবার তা—এই হ’ল ঠিক ভাবে রূপের উপভোগ। কিন্তু এ না হ’য়ে ছবি নিয়ে কবিতা নিয়ে সঙ্গীত নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে চল্লেম কোথায় তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা দার্শনিকতা প্রভৃতি নানা তত্ত্বের সিংহাসনে আর্টিষ্ট বসে’ আছেন—এতে রূপকে কোন দিক দিয়ে দেখা শোনা কিছুই হ’ল না। ভোলাতেই রূপের সৃষ্টি হয়েছে যখন, তখন রূপকে অতিক্রম করে’ অরূপ প্রভৃতির সন্ধান কতকটা যেন বরকন্যার যুগল মূর্তির সামনে বসে’ দুজনের কুলপঞ্জী এবং তাদের আয়-ব্যয় ও ধর্মকর্মের হিসেব দেখে খুসি হয়ে যাওয়ার মতো কায।
মধুভরা আকাশে বাতাসে আলোর মধ্যে ফুলের কুঁড়ি প্রাণের পাত্র খুলে’ ধরলে, মধু সঞ্চিত হ’ল সেখানে, তেমনি রূপদক্ষ রচনার সামনে হৃদয় পেতে দিলেন, মধুতে পরিপূর্ণ হ’ল পাত্র—রূপের সবখানি এতেই পাওয়া হ’য়ে গেল। এটা কবিকল্পনা নয়, সৃষ্টির রূপের রহস্য এই নিয়ে এবং এই নিয়ে আর সব জীবের চেয়ে মানুষ আমরা বড় হলেম—‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’। বর্ষার আকাশ জলই ঝরায় তাদের কাছে যারা মেঘের পিছনে মেঘবাহন ইন্দ্র নয়তো মেঘনাদ নয়তো বৃষ্টিতত্ত্ব গোছের একটা কিছু দেখার চেষ্টা করে, আর সেই মেঘ অমৃত বর্ষণ করে তার প্রাণে যে মেঘের রূপ দেখেই ভুলে’ থাকে, কার দেওয়া মেঘ কোথাকার মেঘ কি দরের মেঘ এ সব খোঁজই নেয় না।
মধুকরের সঙ্গে রূপদক্ষের তুলনা দেওয়া হয় কখনো কখনো, কিন্তু রূপদক্ষ ফুলের মাধুরী ফুলের রূপের সঙ্গে পায়, মধুকর শুধু পায় ফুলের মধু, ফুলকে পায় না। রূপের মধ্যে মধুকর ছাঁকা অরূপ রস পেয়ে বঞ্চিত হ’ল, আর রূপদক্ষ মানুষ রূপে রসে সমান অধিকার পেয়ে চরিতার্থ হ’য়ে গেল।
রূপ কি তা বোঝাতে হয় না কাউকে, রূপ চোখে পড়লেই জানায় আপনি কি বস্তু; কিন্তু রূপের মাধুরী সে যে অন্তরের জিনিষ, তাকে বোঝাতে গেলেও বোঝানো হয় না, রূপদক্ষ যারা তারা তা জানে কিন্তু জানাতে পারে না। যাকে জানা গেল কিন্তু জানানো গেল না তেমন বস্তু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়া চলে না, কাযেই রূপ সম্বন্ধে চর্চা করি শুকনো ভাবে, মাধুরী তোলা থাক কিছু কালের জন্য।
মাধুর্য এবং রূপ দুটোর বিষয়েই “উজ্জ্বল নীলমণিতে” লেখা আছে। কিন্তু রূপ যে দেখলে না, রূপের মাধুরী হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করলে না, সে হাজার বার “নীলমণি” উল্টে পাল্টে পড়েও কিছুই পেলে না। রূপ দেখে’ ভুলে’ যাওয়া যার হ’ল না সে পড়েই চল্লো পুঁথি। রূপ যে নিজের দৃষ্টির বিষয় এবং তার মাধুরী নিজের মনের বিষয়, অন্যের—এমন কি খুব বড় কবিরও—পিছনে পিছনে গিয়ে তাদের চোখে দেখলে রূপ দেখা হয় না, অন্যের দেখার মতো করে’ দেখা হয়।
মহাকবি কালিদাস একরূপে হিমালয় পর্বত দেখে’ খুব সম্ভব কল্পনা করেই লিখলেন—
“অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা।
হিমালয়োনাম নগাধিরাজঃ॥
পূর্ব্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য।
স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ডঃ॥”
বড় কবির দেওয়া এই মানদণ্ড, এ দিয়ে হিমালয় পর্বতের রূপের পরিমাপ করে’ দেখতে গেলে দেখবো এই শ্লোকের দুটো ছত্র এবং এরি প্রতিরূপ। এ ছাড়া আর কিছু ভাল মন্দ চোখে পড়বেই না এবং দেখবো মনও এই শ্লোকের প্রতিধ্বনি ধরে’ চলছে চোখের সঙ্গে পাহাড়ে ও অরণ্যে পরের দেওয়া রূপ ও রসের ভাল-মন্দর মধ্যে—রেলের উপরে গাড়ির মতো বাঁধা পথে।
মহাকবির চশমা নিজের চশমার চেয়ে বড় চশমা, কিন্তু বৃদ্ধের চশমা যুবা চোখে পরলে অথবা যুবার চশমা বুড়োয় পরলে কি দশা হয় সেটাও তো দেখা চাই! আমি যদি কালিদাসি করে’ লিখি যে—গিরিচূড়ার মতো উন্নত নাসা, তার উপরে ধরা রয়েছে সোনার তারের দুই ধারে ধরা দুখানি মোতিয়া-বিন্দু, সে তো চশমা নয়, সে রূপ অরূপ দুই সমুদ্রের জলের পরিমাণ করে’ নেবার দাঁড়ি পাল্লাখানি!—তবে হয় লোকে বলবে আমার চোখ খারাপ কিংবা উল্টো চশমা পরেছি। এর চেয়ে বেশীও বলবে। হিমালয়কে একটা মাটির ঢেলা ওজন করবার দাঁড়িপাল্লার মত দেখায় মজা আছে, রসও এক রকমের আছে, কিন্তু তাই বলে সেটা হিমালয়ের উপযুক্ত বর্ণনা একেবারেই নয়। বলতে সাহস হয় না, তাই বলি যে মহাকবি কালিদাসের ভুল বর্ণন চাঁদের কলঙ্ক, আর চশম চোরা অকবির ভুল বর্ণন তার নিজের মুখের চুণকালির প্রায়। এ কথাট সহজ সত্য কথা, কিন্তু এ কথা মতো চলা অত্যন্ত কঠিন সেই জন্যে জগতে অনেক কবি নেই, অনেক আর্টিষ্ট নেই, অনেক রসিকও নেই, ঋষিও নেই—যাঁদের আর্ষ প্রয়োগ মাপ করা চলে। তিন মাস আমি নিজের লাঠি ধরে’ পাহাড় প্রদক্ষিণ করেছি, কোনদিন পর্বতের কাছে বখসিস পেয়েছি, কোনোদিন পাইনি। মহাকবির চাদরের খুঁট ধরে গেলে হয়তো পদে পদে কিছু না কিছু প্রসাদ পেতেম। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই যে, কবির বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে পর্বতকে পাওয়া অকবির বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে পাওয়ার চেয়ে ভাল হ’লেও নিজে খুঁজে পাওয়ার আনন্দের একবিন্দুর সঙ্গে তার পরিমাপ হয় কি? মহাজনের সঙ্গে চলা নিরাপদ এটা সবাই বলে, কিন্তু মহাজন নিজের চোখের চশমা অন্যের চোখে পরিয়ে যে সহজ দেখার পথ বন্ধ করেন এ তো মিছে কথা নয়। রূপ নিজের দৃষ্টির বিষয়, সে মধুর কি মধুর নয় তা নিজে দেখে বুঝি। ‘রূপের পর্দা পরিয়ে অরূপকে দেখ’—এটা মহাজনদের কথা, কিন্তু রূপ রূপ দেখাতেই তো আছে এটা সহজ মানুষের কথা।
পূর্ণচন্দ্রের আলোকে পরাস্ত করে’ পর্বতের উপরের তারাটি জ্বলছে, তার রূপ দেখেই আনন্দ, তারাটা কোন্ তারা, তারার অন্তরে কোন দেবতার দীপ্তি—এ সব মনে নাই বা এলো। যার রূপ আছে সে রূপ দিয়েই মন টলায়, নকিবের দরকার তার যার নিজের রূপগুণাদির পরিমাণ যথেষ্ট নয়। ইন্দুমতীর স্বয়ংবর সভায় রূপ নকিবের দেওয়া সাজ না পেয়েই বরমাল্য লাভ করলে। রূপের দর্শন করে আনন্দিত হওয়াতেই তার পরিণতি, রূপ থেকে স্বতন্ত্র রঙ থেকে স্বতন্ত্র বর্ণহীন রূপহীন অরূপের প্রতীক হওয়াতে রূপের সার্থকতা নয়। প্রতিমার মর্য্যদা প্রতীক হ’য়ে পড়াতে নয়, রূপের আসনই তার গৌরবের আসন। গৌরীশঙ্কর হিসেবে বরফের পাহাড় দেখা পাহাড়কে সত্য দেখা বলে’ তো মনে হয় না। একটা সমুদ্রের তরঙ্গ ঘোড়া হিসেবে দেখে কবিদের আনন্দ হয়, কেননা কবি ভাবুক কিন্তু আর্টিষ্ট তিনি যে রূপদক্ষ।
দেশলাইয়ের বাক্স একটা, সিগারেটের টিন একটা, লোহার সিন্দুক একটা এবং কালীঘাটের কৌটা একটা—এদের ভাল-মন্দের হিসেব এদের রূপের মধ্যেই রয়েছে। দেশলাইয়ের বাক্সর কবি বাক্সটার রূপ বড় উপমার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে হয়তো কালীঘাটের কৌটোর চেয়ে তাকে ভাল বলে’ প্রমাণ করতে পারেন কারো কাছে, কিন্তু আর্টিষ্ট রূপ দিয়েই রূপের পরিমাপ করে দেখবে, উপমার ভাল-মন্দ দিয়ে নয়।
কি প্রাচীন কি আধুনিক ভারত-শিল্পের একটা রূপ আছে, শুধু তাই দিয়েই তার ভাল-মন্দ উচ্চ-নীচ বিচার। আধ্যাত্মিকতার প্রশংসাপত্রের উপরে তাকে বসালে সে যে জগৎ শিল্পে বড় জিনিষ বলে’ চলে’ যাবে একথা ভাবাই ভুল। গুণের অপেক্ষা না রেখেই রূপবান সহজেই প্রমাণ করে যে সে রূপবান। অষ্টাবক্র তিনি ঋষি হয়েও একটা ছেলের কাছে ধরা পড়লেন যে তিনি রূপবান একেবারেই নন, নির্দোষীকে কিন্তু তিনি অভিসম্পাত দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন তিনি বড় ঋষি।
ইন্দুমতীকে নিয়ে সহচরী সুনন্দা এক এক রাজার রূপগুণের বর্ণনা কত ব্যাখ্যানা দিতে দিতে চল্লো, মালা পড়লো না কারু গলায়। অজ রাজার সামনে এসে সুনন্দা শুধু বল্লো, ‘আর্য্যে ব্রজামোঽন্যতঃ’। অজ রাজা যে রূপবান ছিলেন সুতরাং সেখানে সুনন্দার ব্যাখ্যানার প্রয়োজন একেবারেই রইলো না। রূপের পর্যাপ্তির মধ্যে রূপের একটু আধটু খুঁৎ যেমন, তেমনি গুণেরও বাহুল্যের মধ্যে কুরূপের সবটা তলিয়ে যায়। পয়সার পর্যাপ্তি রূপ গুণ সবার দোষ ফিল্টার করে’ পাত্রটিকে বিয়ের সভায় হাজির করে, কিন্তু তাই বলে’ কালো কোন দিন সাদা হয় না, যা কুরূপ তা অরূপের ছাড়পত্র পেয়েও সুরূপ হয় না।
অনেক সময় দেখি কুরূপ সেও স’য়ে গেছে চোখে। যেমন দেখতে দেখতে স’য়ে গেলে রূপের খুঁৎ চোখেই পড়ে না, তেমনি রূপ অনেক সময়ে অতিপরিচিত হ’য়ে মর্যাদাও হারায় আমাদের কাছে। হিমালয় পর্বত তার দিকে ফিরেও দেখে না পাহাড়ি মানুষ, আর তিন মাস ধরে’ প্রতি মুহূর্ত্তে তার দিকে চেয়ে চেয়ে চোখ আমার তৃপ্তি আর মানলো না।
হারমোনিয়ামের শব্দ অত্যন্ত বদ কিন্তু কেমন করে’ আমাদের কানে স’য়ে গেছে বুঝতেই পারিনে যে দেবী বীণাপাণির কাল লজ্জায় রাঙা হ’য়ে ওঠে সেটা দেখা মাত্র। আমি সেদিন একটা ছদ্মবেশের সভায় চীনের জুতো আর কোর্তা পরে’ গেলেম, বন্ধুরা আমায় দেখে চাপ হাসি হাসলেন, কিন্তু আমার পাশেই আধখানা ধুতি আধখানা কোট পরে’ কত লোক এল গেল, কারু চোখে তার কদর্যতা ধরা দিলে না; স’য়ে গেছে বলেই তো!
রূপ সম্বন্ধে বলবার সময় অরূপের কথা ওঠে প্রায়ই দেখি এবং অরূপের আধার রূপ এও বলা হয় এবং অরূপের সাধনার জন্যই আর্টে রূপের অবতারণা এমনো বলা প্রচলিত হ’য়ে গেছে চিত্র-সমালোচনাতে, সুতরাং গত তিন মাস ধরে’ পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে’ ছবিতে এই রূপ-অরূপের ঠিক যোগাযোগটা কি ভাবের তা ধরার চেষ্টায় রইলেম। দেখতেম পর্বতের সামনে যখন কুয়াসা তখন অরণ্য নেই, পাহাড়ের ঝরণা নেই, চোখের কায ফুরিয়ে গেছে তখন, মনের এবং কানের কায আরম্ভ হ’য়ে গেছে। জলের শব্দ শুনছি, পাখীর গান শুনছি আর ভাবছি কত কি, কিন্তু এটা যে পাখী গাইছে ওটা যে ঝরণা করছে তা মনে ধরা রূপ সমস্ত কুয়াশা হবার আগে থেকেই জানিয়েছে আমাকে। আবার পর্বতের উপরে অমাবস্যার রাত্রি যে কি ভয়ানক অন্ধকার তা পাহাড়বাসী মাত্রই জানেন, পায়ের তলা থেকে মনের কাছ থেকে পথ সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়, অরূপ ঘিরে নেয় চারিদিক, দূরত্ব নৈকট্য আর থাকে না, বিষম ভ্রান্তির মধ্যে স্তব্ধ হ’য়ে খুঁজে বেড়ায় চোখ আর মন দুজনেই হারানো রূপ আর তার স্মৃতি।
যার কোন পরিচয় আমার কাছে ধরা পড়লো না সেই রইলো আমার কাছে অরূপ হয়ে বর্তমান। বড় সভায় বক্তার সামনে দুই একজন পরিচিত এবং নিকটবর্তী অপরিচিত মানুষ ছাড়া বেশীর ভাগ শ্রোতাই নিজের নিজের রূপ না দেখিয়ে লোকে পরিপূর্ণ ঘর এইটুকু মাত্র জানাতে থাকে;—এ একভাষে রূপ-অরূপের যোগাযোগ, এর ধারণা ছবিতে পৌঁছে দেওয়া চল্লো। অবগুষ্ঠিতা সুন্দরী সবাই আঁকে, পর্দানশীন সবাই আঁকে, সেখানে মানুষটি ছেড়ে দেওয়া গেল দর্শকের কল্পনার উপরে, শুধু অবগুণ্ঠন এঁকেই খালাস চিত্রকর। যন্ত্রসঙ্গীত আরো এগোলো, গোটা দুই সুরের টান কানের কাছে দিয়ে এক একটা রূপ জাগালে, সকাল বিকাল কত-কি’র কবিতার ব্যঞ্জনা সুরের রঙের রেখার রেশ দিয়ে যা বলতে পারলে না দেখাতে পারলে না, তা দেখালে শোনালে। ইসারায় বলা হ’ল যা তাকে আর যাই বলি অরূপ বল্লে ভুল হয়। এক রূপ আর এক রূপের, এক রঙ আর এক রঙের, এক সুর অন্য কিছুর ইঙ্গিত করলে—এ পর্যন্ত চলে আর্টে, বেরঙ দিয়ে বোঝানো চলে বাদলা, কিন্তু বেরঙ দিয়ে রঙ, বিনা রেখার ছবি এ সব তত্ত্বকথার কথা। পর্বতে বসে’ রূপ-অরূপ দুয়েরই হিসেব দিয়ে ছবি দেখে’ আমি অনেকগুলো নোট খাতায় টুকে এনেছি, তাই নিয়ে এ সমস্যাটা আর একটু পরিষ্কার করবার চেষ্টা করবো।
“সকালে ফোটা সূর্যমুখী ফুলটিকে নীল আকাশ আলোর খবর এনে দিতে না দিতেই প্রথম পৌষের দুরন্ত কুয়াসা দিক বিদিক ঘিরে’ নিলে।”
কিংবা যেমন—“পাহাড় তলিয়ে যাচ্ছে হিমের প্লাবনে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সকালের আলো—কূল হারানো একলা হাঁস।”
অথবা যেমন—“সন্ধ্যার আকাশ চেয়ে দেখছে দিনের শেষে আলোর জয়পতাকা শীতের কুয়াসা নামিয়ে রাখছে ফুলের বনের পায়ের কাছটিতে।”
তিনটি ছোট ছোট স্থান, চিত্রও নয় কবিতাও নয় গল্পও নয়। হাতের লেখায় ধরা দিলে ছবি কটা সহজে কিন্তু তুলির আগায় এদের আটকাতে গেলে দেখবো—দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছুটিই ছবি হ’য়ে রূপ পেয়ে বসে’ আছে কিন্তু প্রথমটির বেলায় মুস্কিল, সেখানে রূপ সাদা কাগজ থেকে পিছলে পড়তে চায়, ঘন কুয়াসা পটের সবটা অধিকার করতে চায়। বাদলের আকাশ যেমন শুধু রঙ দিয়ে জানায় জলের ধারা আছে তার বুকে, তেমনি এখানে কুয়াসা না-দেখা ফুল পাতা ইত্যাদি রূপের পরিমল বহন করে’ সার্থক একখানি ছবি হ’তে চাইলে। সাদা রঙের একটা প্রলেপ দিয়ে পাহাড় পর্বত ফুল পাতা সব ধরে’ দেওয়া পটের উপরে—এ মানুষের কর্ম নয়। ছবি করতে হ’লেই তাকে হয় রূপ নয় রূপের আভাসের মধ্যে বদ্ধ থাকতে হবেই। পর্বতের আভাস না দিয়ে পর্বতের কুয়াসার ঠিক রূপ এবং মাঠের আভাস না দিয়ে পাহাড়তলার কুয়াসার ঠিক রূপ দেওয়া বিশ্বকর্মার কায, মানুষের ক্ষমতায় কুলোয় না।
রূপ যতটুকুই হ’ক না কেন সে রূপ ছাড়া অরূপ নয়। জলের মতো হাল্কা রঙ দিয়ে পাহাড় লিখি, গাছ লিখি, কুয়াসায় গাছ পাহাড় তলিয়ে গেছে তাও লিখি—সে হ’ল ছবি নয় ছাপ। রেখা মাত্রেই রূপবান, রেখা ছেড়ে ছবি কোথায় এবং রং ছেড়েই বা রেখা কোথায়? এই রং আর রেখার যোগাযোগ ছবিকে সুনির্দিষ্ট অনির্দিষ্ট ভাবে ধরে চোখে।
রূপের বাধন ছেঁড়া রঙ সেই শুধু অরূপের কতকটা আভাস দিতে পারে, যেমন আকাশের গভীর নীল, রঙ্গীন কাপড়ের নিথর রঙ; কিন্তু তারা ছবি নয় ভাবের বাহন, রঙের একটা একটা স্ফূর্তি দিয়ে মনে এক এক ভাব ও রস জাগায় রূপের অপেক্ষা না রেখেই। সুর কতকটা যে কাজ করে, রঙ কতকটা সেই কাযই করে; বসন্তবাহার সুর আর বাসন্তী রঙের আলো দুই-ই অনির্দিষ্ট রূপের ধ্যানে মগ্ন করে দেয় মনকে, কিন্তু বাঁধা রঙ ও রূপের পাথারে মনকে তলিয়ে নিয়ে চলাই রেখার কায।
ছবি যারা লেখে তারাই জানে রূপ রঙ ইত্যাদি দিয়ে সম্পূর্ণ ফুটতে দিলে এবং সম্পূর্ণ না ফুটিয়ে দিলে একই বস্তুর দুটো ছবি দুরকম রস দেয় দর্শককে। পটখানির মধ্যে তলিয়ে আছে যে রূপ, আর পট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে যে রূপ—দুটি দুরকম জিনিষ, কিন্তু দুটিই রূপের বাইরের জিনিয নয়, দুটিই রূপ, একের ঘোমটা আছে অন্যের ঘোমটা নেই এই তফাৎ। জগৎ-শিল্প এই তলিয়ে থাকা রূপ এবং ফুটে ওঠা রূপ—এই দুই তটের মধ্যে ধরা। সব দেশের সব শিল্পের ধারা ধরা গেছে এই দুষ্ট কিনারার মধ্যে। এই দুই পারের হিসেব নিয়ে কলা-রসিকদের মধ্যে দুটো দল সৃষ্টি হয়েছে Idealist ও Realist নামে, এবং ছোটখাটো দঙ্গলও সৃষ্টি হচ্ছে যে কত তার ঠিকানা নেই, যথা, Futurist, cubist ইত্যাদি ইত্যাদি, দলে দলে দলপতিতে দলপতিতে ঝগড়ার ও সীমা নেই। Impressionist বলে’ একটা কথা চলেছে শিল্প-সমালোচলায়; mystic কথা তাও ভারত শিল্পের পরিচয়-পুস্তকে স্থান পেয়েছে। ছবিকে নাতিস্ফুট না অতিস্ফুট, নির্দিষ্ট না অনির্দিষ্ট হ’তে হবে এই নিয়ে তর্কের সীমা ছাড়িয়ে উত্তর-প্রত্যুত্তর গালাগালির বন্যায় গিয়েও ঠেকবার জোগাড় হয়েছে। এই তর্কজাল কুয়াসার মতো যখন সরে’ যায় তখন দেখি পর্বতে পর্বতে শুধু স্ফুট অস্ফুট দু’রকমের ছবি ঝরণা দিয়ে ব’য়ে আসছে দৃষ্টিপথে, এবং এও স্পষ্ট দেখি যে, যে খাত বেয়ে স্বভাবের দৃশ্যাবলী সেই খাত বেয়েই ভারত-শিল্পও চলেছে কি পুরাতন কি নূতন, অথচ সেটা হ’ল অস্বাভাবিক কারো কারো কাছে এবং এই অস্বাভাবিক শব্দটার কর্কশতা মেটাতে গিয়ে ভারত-শিল্পকে আধ্যাত্মিক বলে’ সুখানুভব করার চেষ্টাও করছেন দেখি কেউ কেউ। ভারত-শিল্প সত্যিই যদি ছেঁড়া পকেট হয় তো তাকে উল্টে ছেঁড়া বালিসের খোল বলে’ প্রমাণ করে’ মজা করা যেতে পারে কিন্তু ছেঁড়া বটে এটা তো ঢাকা পড়ে না!
হীরকের প্রভা জ্বল্ জ্বল্ করছে, চন্দ্রকান্ত মণির প্রভা কুয়াসার মধ্যে টল্ টল্ করছে—বাজারে দিলে একটাকে বহুমূল্য অন্যটাকে স্বল্পমূল্য বলে। অরূপের যে পক্ষপাতী সে চন্দ্রকান্ত মণিকে প্রাধান্য দিয়ে বলবে, এ যে অরূপের ধ্যান ধরে’ আছে—অতি ভাল জিনিষ, রূপের যে পক্ষপাতী সে হীরেকে হাতে তুলে’ বলবে, এর রূপের রঙের সীমা নেই, এর তুল্য ওটা নয়। অপক্ষপাতী শিল্পী মণি দুটোকেই এক সূত্রে গেঁথে বলবে এরা দুটি মাণিকজোড়—হীরকের সুপরিস্ফুট জ্যোতির মধ্যে হীরের মতো পলতোলা বা বাহ্য রূপ তলিয়ে আছে, চন্দ্রকান্ত মণির নিটোল সুবিম্বিত রূপের মধ্যে তার জ্যোতি তলিয়ে আছে। অনুপমের মধ্যে রূপ, রূপের মধ্যে অনুপম, অনির্দিষ্ট জ্যোতির অবগুণ্ঠনে সুনির্দিষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট রূপের গর্ভে অনির্দিষ্ট জ্যোতি রসিকের কাছে; দুয়ের উচ্চ-নীচ ভেদ কোথায়? ভিন্ন দেখে তারাই যারা রূপের র’ও দেখে না, কেবল ‘রূপ-অরূপ রূপ-অরূপ’ করে’ মালা জপে।
ঘরের দেওয়ালে ঘেরা জীবনে যে মাধুর্য আকাশের তারাখচিত নীল ঘেরাটোপে ঢাকা জীবনের মাধুর্যের চেয়ে তা কম জিনিষ এটা বলা চলে না। এটা এতখানি ওটা ততখানি এও বলা নিরাপদ নয়, অনেক সময়ে ঠকতে হয়,—জীবনের স্বাদ বিচিত্রতা হারায়। তেমনি রূপের এক প্রস্থ অরূপের আর এক প্রস্থ ভাগ করে’ নিয়ে যারা দুটো দেখে, তারা রসের এক নদীর চমৎকারি রূপ দেখতে পায় না, নদীর থেকে সরিয়ে আনা দুটো খালের কিনারায় কিনারায় বসতি বেঁধে বসে’ যায়।
মাটির প্রদীপখানি মাটির ঘরের কোণে; আকাশের তারা চেয়ে প্রদীপের দিকে, প্রদীপ চেয়ে তারার দিকে—এই দুই চাওয়ার সূত্রটি কেটে দেখতে চায় যে সে পায় ছেঁড়া মালার এ-আধখানা নয় তো ও-আধখানা। রসের ও রূপের পূর্ণ পাত্র পড়ে না তার হাতে।
পর্বতে বসে’ দেখতেম এক পাহাড় কুয়াসাতে ঝাপসা, আর এক পাহাড় আকাশপটে সুস্পষ্ট টানা—কিন্তু দুয়েরই থেকে এক ঝরণা করছে একই ছন্দে সুরে। তেমনি ইট পাথর ও কাঠের পাহাড় নগরের কোথায়ও রস নেই এটা মনে করলে অট্টালিকার অরণ্য আর পাহাড়ের ঝাউবন দুই-ই রহস্যময় ছবি দেখায়। পাহাড়ের বসতি আর আমার ঘরের পাশে সিংহির বাগানের বস্তি—রূপ হিসেবে কোন্টা বড় কোন্টা ছোট বলা শক্ত, রঙ আর সুর পেয়ে দুটোই মধুর লাগে চোখে। ঘরের মধ্যে এতটুকু টিপ পরা কালো মেয়েটি আর পর্বতের উপরকার অরণ্যের কোলে সন্ধ্যাতারা—দুজনেই সমান রূপবতী, দুজনেই প্রত্যক্ষ রূপ নিয়ে মধুর, অপ্রত্যক্ষের ইঙ্গিত না দিয়েও মধুর—এটা অস্বীকার করা তো যায় না। আবার পাটের সাড়ির মধ্যে ঘোমটা-টানা সহুরে নববধূ এবং পূর্ণ চন্দ্রিমার আলোর ঘোমটা-টানা পাহাড়ের কোলে চা-গাছের নতুন ফোটা ফুলের আড়ালে না-দেখা ঝরণা—দুজনের নূপুর-ধ্বনি মধুর হ’য়ে শুধু কানে বাজে না, প্রাণেও যে বাজে।
নগর তার এবং নগরবাসীর স্বভাবের অনুরূপ রূপটি যখন দিলে তখন সেটি স্বাভাবিক ছবি হ’ল। স্বভাবদৃশ্য কথার অর্থই থাকে না যদি আর্টিষ্টের নিজের ভাব দৃশ্যের মধ্যে অনুরূপ রূপটি লাভ করেছে—এটা ছবি প্রমাণ না করে। ভারতবাসীর পক্ষে যেটা স্বাভাবিক লণ্ডনবাসীর পক্ষে তা স্বাভাবিক মোটেই নয়, কিন্তু তাই বলে’ ভারতীয় ছবি অস্বাভাবিক রূপ সমস্ত নিয়ে কারবার করলে এটা বলা বিষম ভুল। বানরের ডানা স্বাভাবিক নয়, বাদুড়ের ডানা স্বাভাবিক—এ তর্ক করে’ বানরকে বাদুড়ের চেয়ে কম স্বাভাবিক বলে’ উড়িয়ে দেওয়া চলে না। রূপ যখন স্বভাবের নিয়ম ধরে’ স্ফুট অস্ফুট দুই সীমা মেনে চল্লো, সুর যেখানে স্বাভাবিক, চলা বলা সমস্তই যেখানে স্বাভাবিক ছন্দ পেলে সেইখানেই মাধুরী ফুটলো, এর বিপরীতে বিশ্রী কাণ্ড হ’ল। আমার পক্ষে ভারত-শিল্প স্বাভাবিক, ইংরেজের পক্ষে নয়। নূপুর পায়ের ছন্দে মধুর বাজে, পোষা কুকুর যখন সেটাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করে তখন বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া আর কিছু করে না।
আলোককে অন্ধকারের সঙ্গে পৃথক করে দেখা চলে না, প্রত্যক্ষ রূপকে অপ্রত্যক্ষ রূপের সঙ্গে পৃথক করেও দেখা চলে না। একের সঙ্গে অন্যের ঠিক যোগাযোগ না করতে পারলে ছবিও হয় না, সাদা পাথরে কাল পাথরে সাদা কাগজে কালো কাগজে যারা কিছু রচনা করে তারাই জানে যে এই যোগাযোগের কৌশলই হ’ল রূপদক্ষের সাধনার বিষয়।
পর্বতে পর্বতে অপরিসীম রূপের সামনে বসে’ মন একটি দিন উঠেছিল রূপের পর্দার ওপারের না-দেখা আর্টিষ্টের একটু পরিচয় পেতে। রূপকে প্রশ্ন করলেম, সে বল্লে, আর্টিষ্টকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যেই তো আমি আছি, আমাকে এ প্রশ্ন করা মিছে, আমি রূপবান রূপের মাধুরী আগলে রেখেছি, আমার আড়ালে আমার মধু। বনফুলের বুকের মধুবিন্দু তাকে প্রশ্ন করি, সে বলে, আমি কমলা ফুলের মধু, আমার উপরে ফুলের প্রতিবিম্ব, আমার ভিতরে ফুলের পরিমল!
মন অধীর হ’য়ে বলে, ফুলের মধ্যে যে মধু ধরলে তার খবর পাই কোথা? ভ্রমর এসে বল্লে তুমি মধু নাও তো নাও, নয় আমার পথ ছাড়। নিরুপায় হ’য়ে আমি নিজেকে তখন প্রশ্ন করি, মন উত্তর দেয়— এই যে বসে’ বসে’ নানারূপ ছবিতে নানা রস ধরছো, এগুলো মিথ্যা মায়া বলে’ যদি কোন লোক ছিঁড়ে ফেলে’ তোমার সঙ্গে মিলতে আসে এবং তোমার একটা ফটো তুলতে চায় তুমি তাকে কি ভাবো?
কবির সঙ্গে তাঁর রচনা দিয়ে পরিচয় হ’ল না, তাঁর নামটা লেখা Photograph দিয়ে পরিচয় হ’ল—এ যেন একের লেখা পর্বত-বর্ণনা কিংবা রূপ-অরূপের সমস্যা দিয়ে মস্ত একটা বক্তৃতা নিয়ে হিমালয় দেখার কায হ’য়ে গেল বলে’ মনে করা।
ভূগোলের এক একটা পাতায় কত নদ নদী পাহাড় পর্বত সেই গুলো পড়েই তো পৃথিবী দেখার কায হ’য়ে যেতে পারতো। ‘পরলোক ভ্রমণ’ বলে’ একখানা বই আছে তাতে সেখানে পরিক্রম করবার আটঘাটের বর্ণন এমন কি সেখানকার অধিকারী আলোর পর্দা খাটিয়ে তার মধ্যে ঘুমোচ্ছেন এও লেখা আছে। এই ভূগোল এবং ভ্রমণ-বৃত্তান্ত দুখানা মুখস্থ করে’ দক্ষতা পাওয়া গেল বলে’ কেউ কি ভুল করে?
পাহাড়ে যাবার সময় উড়ো সাপের মত রেল যখন এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে, এক মেঘ থেকে আর এক মেঘে আমাদের নিয়ে চল্লো সেই সময় পাশের একটা ছোট ছেলেকে বল্লেম, পাহাড় কি রকম ভাবতিস্? তার কথার পুঁজি কম, সে শুধু পর্বতের দিকে হাঁ করে চেয়ে বল্লে, পাহাড় যে এরকম তা একেবারেই মনে হ’ত না। ছেলের মনের পাহাড়ের রূপটা ছিল একটা ঢিবি যার এপার ওপার দৌড়ে ওঠা নামা যায়, তাতে গাছ ছিল না, ঝরণা ছিল না, পাথর ছিল না—রূপের মরুভূমির মাঝে বালির স্তূপ, কিংবা একটা বড় গাছের গুঁড়ি—তার বেশি একটুও নয়; ছেলের মনে আগের দেখা পাহাড় এবং পরের দেখা পাহাড়ে যে বিষম তফাৎ, ঠিক ততটাই তফাৎ চোখের দেখা থেকে বিচ্ছিন্ন অরূপ আর প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ হচ্ছে যে রূপ তার মধ্যে। দাড়িপাল্লার বামদিকে রাখো লিখিয়ের কালি কলম কাগজ রঙ তুলি, বীণা-বাঁশী এবং রূপ-অরূপের জল্পনার ভার, আর দক্ষিণে চাপাও শুধু তার চোখে দেখ রূপের মাধুরীবিন্দুটি,—জল্পনার বাটখারা ক্রমেই উঠবে আকাশে, চোখে দেখার বাটখারা ক্রমেই নামবে মাটির দিকে। ভারত-শিল্পে যে সকল দেবদেবী মূর্তি দেখি, যে সব ছবি দেখি, তার সবটাই ধ্যান এবং আধ্যাত্মিকতা এবং অরূপ—এটা আমি এক সময়ে কতবার বলেছি তা মনে নেই কিন্তু তাই বলে’ সেই ভুল আঁকড়ে ধরে’ থাকা চিরকাল তো সম্ভব হ’ল না—রূপ যে চোখ ভুলিয়ে নিলে মন মাতিয়ে দিলে একথা তো আজ বলতে হচ্ছে।
পাহাড়-পর্বত নদী-নির্ঝর অরণ্য-আকাশ রূপের সত্তায় বলীয়ান, টোলের পণ্ডিতের রূপ-অরূপের তর্ক কিংবা বিশেষ কোন ধর্মের ও জাতির আধ্যাত্মিকতা প্রমাণ করতে তারা নেই। বরফের চূড়া দেবীপুরাণের একটা শ্লোকের জন্য বড়, নিরুপম নীল আকাশ কৃষ্ণলীলার পদাবলীর ছাঁদ পেয়ে যে বড়—তা তো মনে হয় না! নানা রূপক উপমা অতিক্রম করে’ বিদ্যমান এই যে সব রূপ রঙ এদের সামনে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করা চলে না যে, রূপ নিজেতে নিজে স্বপ্রতিষ্ঠিত।
সেই স্বপ্রতিষ্ঠিত রূপের কথাই যেমন হিমালয়ের শিখরে শিখরে তেমনি সমস্ত ভারত-শিল্পেরও প্রত্যেক অঙ্গে দীপ্তি পাচ্ছে। আমাদের ঋষি চিত্রের ষড়ঙ্গ দিলেন, তার প্রথমেই লেখা হ’ল “রূপভেদাঃ”—বিচিত্র রূপের কথা নিরুপম রূপের কথা। অরূপের কথা সে দর্শনশাস্ত্রের কথা ধর্মশাস্ত্রের বিষয়, স্বপ্রতিষ্ঠিত নিরুপম রূপের কথা হ’ল চিত্রের এবং মূর্তির বিষয়।
সুনির্দিষ্ট রূপ, সুব্যক্ত সুর এই নিয়ে প্রকৃতি চারিদিকে ঘিরে’ রইলো মানুষকে। অনির্দিষ্ট সেও একটি রূপ, যাকে বলি অব্যক্ত তাও একটি সুব্যক্ত সুর নিয়ে বর্তমান হ’ল। এই যে পর্বতের ছবি কুয়াসার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে আবার আলোর মধ্যে জেগে উঠছে—এ দুটি ছবিই রূপের সুনির্দিষ্ট সীমা কোন দিন অতিক্রম করে’ চলছে না। কুয়াসা এখানে রূপ আবরণ করছে না, একটা রূপ থেকে আর একটা রূপ ফোটাচ্ছে—পাথরের কড়ি সুর মেঘের কোমল থেকে কোমলতর সুরে মিলে’ আর একটা নতুন সুরে পরিণত হ’তে চলেছে, রূপ রঙ এদের ছন্দে বিচ্ছেদ ফাঁক টেনে দিচ্ছে না, প্রলয় দিচ্ছে না টেনে চোখের এবং মনের উপরে মাধুর্যহীন নীরস নিকষ-প্রলেপ।
রূপকে নষ্ট করে’ অরূপের স্বাদ দেওয়া রূপদক্ষের কায নয়। পাথরের মূর্তি রঙ বাদ দিলে অথচ রঙের স্বপ্ন ধরে’ রইলো, সেই মূর্তিকে পুড়িয়ে এবং গুঁড়িয়ে চূর্ণ কর তাতে মূর্তিতে যা ছিল তা নেই। তেমনি সুন্দর পটখানি চূণের প্রলেপ দিয়ে সাদা করে’ দিই, কোথায় যায় ছবির রূপ কোথায় বা রঙ, কিন্তু সুন্দর দৃশ্যের উপরে রাত্রির কুয়াসা পড়ুক সে এক নিরুপম রূপ পায় দৃশ্যটি।
ছবির গায়ের চূণের প্রলেপ, রূপের রহস্য তাতে নাই। পর্বত ঢেকে কুয়াসার প্রলেপ—সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তার দিকে চেয়ে চেয়ে চোখ এবং মন বসে’ থাকতো, কিন্তু কোনদিন দেখলে না সে রূপ নেই রঙ নেই, কেবলি দেখলে রঙ ভোলানো রঙ, রূপ ভোলানো রূপ এসে মিল্লো রূপের পাশে রঙের পাশে! বুদ্বুদ ফেটে গেল, রূপ মিলিয়ে গেল, রঙ মুছে গেল—এ ঘটনা নিয়ে গভীর তত্ত্বকথা লেখা চল্লো, আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্বের কবিতা ও গান লেখা চল্লো, কিন্তু ছবি লেখা চল্লো না। ক্ষণভঙ্গুর রূপ মিলোতে চাচ্ছে, রূপ-হারানো অকূলের কিনারায় রূপ রঙে ভরে’ উঠে বুকের বেদনায় কাঁপছে—এটা ছবির বিষয় হ’ল।
মানুষ যদি কেবল চোখ নিয়েই চারিদিকের রূপ সমস্ত দেখতো তবে ফটোগ্রাফের ক্যামেরা যে ভাবে দেখে সেইভাবে তুলতো কেবলি রূপের ছাপ—ছবি নয়—শুধু দেখতো রূপ আর রূপ। জলের উপর তেল যে ভাবে ভাসে দৃষ্টি সেইভাবে পিছনে চলতো, দৃষ্টি রূপের গভীরতা অনুভব করতেই পারতো না মানুষ যদি তার চোখের সঙ্গে মন নিয়ে না দেখতো চেয়ে। চোখের দেখা রূপের বাইরে দৃষ্টির স্পর্শ দিয়ে ক্ষান্ত হয়, মনের দেখা রূপের মধ্যে যে রস তাকে পেতে চলে চোখ মন দুই মিলে, তবে দেখায় রূপের মাধুরীখানি।
খুব প্রাচীনকালে মানুষ যখন গুহাবাস করছে, তখন তারা কি দেখছে এবং কেমন ভাবে দেখছে তার ছবি এখনো গুহার দেওয়ালে এবং ছাদে লেখা রয়েছে। এই ছবিগুলির মধ্যে এক প্রস্থ ছবি দেখি যেগুলি শুধু চোখে দেখা রূপের নমুনা—হরিণ বসে’ আছে, গরু চরছে, মানুষ লড়ছে, সবগুলোই কিন্তু চক্ষুহীন; একটাতেও চোখ দেয়নি চিত্রকর, শুধু রূপ—দেওয়ালের গায়ে ছায়া পড়লে যা দেখায় তাই। (—Childhood of Art, Spearing, page 114, Fig. 74)। আর এক প্রস্থ ছবি চোখের সঙ্গে মন জুড়ে দেখার নমুনা—হরিণ চেয়ে আছে সামনের বনের দিকে, হরিণ হরিণীর সঙ্গে যাচ্ছে আর ফিরে ফিরে দেখছে,—এই দুই ছবিতে চোখ এঁকেছে যত্নে মানুষ, শুধু হরিণের ছায়াচিত্র নয় তার রূপ এবং ভাব এক হ’য়ে পুরো ছবি হয়েছে তখন। (—Childhood of Art, Spearing, Figs. 70 and 65, pages 104-108)।
অনেকে দেখি শুনতে বেশ পায় অথচ সুর বিষয়ে একেবারে বধির; তেমনি রূপ দেখছে অথচ রূপ দেখছে না এমন লোক বিস্তর। প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ দুয়ের সমস্যা শাস্ত্রকার যে ভাবে মীমাংসা করেছেন তার জটিলতার মধ্যে যাবার সাধ্য নেই।
শিল্পের দিক দিয়ে এর একটা মীমাংসা উপস্থিত হবার চেষ্টা হয়েছিল আমরা দেখতে পাই, সেটা থেকে ব্যাপারটা হয়তো আমরা সহজে বুঝবো। চীন দেশে ‘তাওইষ্ট’ সাধক—শিল্পের দিক দিয়ে অপ্রত্যক্ষ সাধনার অনেকগুলি উপায় এদের ছবি থেকে পাই। তাঁদের প্রধান কথা হ’ল এই যে, পটের ধৌত অংশ (সাদা জমী) এবং লাঞ্ছিত ও রঞ্জিত অংশের যথাযথ হিসেবের উপরে ছবির ভাবের বিস্তৃতি নির্ভর করছে; তাঁরা বলেন যে, ঘর সাজানোর বেলায় নানারূপ জিনিষ দিয়ে ঘর ভর্তি করা মানে ঘরের প্রসার ও সঙ্গে সঙ্গে মনের এবং দৃষ্টির প্রসার নষ্ট করা। এই হ’ল তাঁদের মত এবং এইভাবে অপ্রত্যক্ষের স্বাদ শিল্পকাযে পৌছে দেবার উপদেশ তাঁরা দেন।
আমাদের দেশের শিল্পসাধক এর উল্টো দিক দিয়ে রূপের বিস্তারের পথ নির্দেশ করলেন—“দাক্ষিণাত্যের মন্দির ধারণাতীত সংখ্যাতীত রূপে ভরে’ উঠে একটা বিরাট বিপুলতা এবং অনির্দিষ্টতায় গিয়ে মিল্লো, লক্ষ্য হারালো গিয়ে দুর্লক্ষ্যতার মধ্যে, রূপ থেকেও রইলো না!” চীনের ছবিতে ছবিতে যেটি সাদা অংশ সেটি রূপ না থেকেও রূপে ভর্তি হল, আমাদের মন্দিরের চূড়া সেটি রূপ থেকেও রূপ না থাকা দিয়ে পরিপূর্ণ হল।
জয়পুরি আঁকা ছবি সেখানে কড়া রঙের তলায় কড়া রেখা তলিয়ে দিয়ে শিল্পী অপ্রত্যক্ষের সমস্যা মিটিয়েছে।
মোগল আমলের আঁকা ছবি কোমল থেকে অতিকোমল রেখাকে প্রায় দুর্নিরীক্ষ্যতার কাছাকাছি টেনে নিয়ে তার উপরে রঙ্গীন ওড়নার আড়াল টেনে এই সমস্যা মিটিয়েছে।
আফ্রিকার শিল্প সেখানে রেখার রঙের সরল টান অদ্ভুত কৌশলে কাটা, সমস্ত রূপের দুর্নির্দিষ্টতা অরূপের দিকেও যায় না, সেখানে শুধু রূপ আর রূপ, কিন্তু সেখানেও চোখের দেখাকে অতিক্রম করছেন শিল্পী ভীমকান্ত কল্পনার পথ ধরে’।
পাহাড়ের ঘরে বসে’ থাকতেম, সামনের খোলা জানালায় দুটি পাহাড় একখানি আকাশপটে ধরা ছবির মতো ধরা থাকতো, কিন্তু সেইটুকু পলে পলে নতুন রূপ নতুন ভাবে ভরে’ উঠতে দেখতেম। পাহাড় পথে চলতেম, দেখতেম—এক স্থানে পথ শেষ হয়েছে অপার রূপের কূলে, এক স্থানে থেমেছে মন-ভোলানো কুয়াসায় ঢাকা শূন্যের পাশে, এক স্থানে বা পথ আপনাকে হারিয়েছে গভীর অরণ্যে আলো-ছায়ায় নিবিড় রহস্যের অন্তরালে। ঝরণা রূপ ধরে’ কোথাও এসে পড়তো কাছে, ঝরণা রূপ হারিয়ে কোথাও শোনাতো সুরটুকু—এই ভাবে গেছে দিনরাত হৃদয় এবং দৃষ্টি দুজনে মিলে’ একদিনও এ কথা ভাবতে পারেনি যে রূপ নেই, রহস্য নেই, অরূপ আছে; দিনরাতের মধ্যে রূপ ও রহস্য এরা হরগৌরী যুগলমূর্তির মতো বিরাজ কচ্ছে—এই কথাই বলেছে বার বার। আনন্দে পূর্ণ পাত্র পেয়ে চোখ এবং মন কবির ভাষায় বলেছে, ছবির ভাষায় বলেছে—
“আমার নয়ন ভুলানো এলে!
আমি কি হেরিলাম হৃদয় মেলে!
শিউলি তলার পাশে পাশে,
ঝরা ফুলের রাশে রাশে,
শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে
অরুণ রাঙা চরণ ফেলে
নয়ন ভুলানো এলে!
আলো-ছায়ার আঁচল খানি
লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
ফুলগুলি ঐ মুখে চেয়ে
কি কথা কয় মনে মনে।
তোমায় মোরা করব বরণ,
মুখের ঢাকা করব হরণ,
ঐটুকু ঐ মেঘাবরণ
দু হাত দিয়ে ফেল ঠেলে!
নয়ন ভুলানো এলে!
বনদেবীর দ্বারে দ্বারে
শুনি গভীর শঙ্খ ধ্বনি,
আকাশ বীণার তারে তারে
জাগে তোমার আগমনী।
কোথায় সোনার নূপুর বাজে,
বুঝি আমার হিয়ার মাঝে
সকল ভাবে সকল কাযে
পাষাণ-গলা সুধা ঢেলে
নয়ন ভুলানো এলে।” —রবীন্দ্রনাথ
পর্বতের পাষাণের কামনা পাষাণ-গলানো রূপের ঝরণা হ’য়ে রইলো—সে এক রূপ সে এক ভাব সে এক সুর দিলে, মরুভূমির বুক জুড়িয়ে ঝরণা নদীরূপে বইলো—সে আর এক রূপ আর এক ভাব আর এক সুর দিলে। নদী সমুদ্র হয়ে কুল হারালো, নীল ছন্দে দুলতে থাকলো—সে এক,—সমুদ্র ঘন মেঘের দিক-ভোলানো রূপ ধরে’ নীল পর্বতের কোলে এসে লুকোলো বৃষ্টি জলের ঝরণা বইয়ে,—সে অন্য। এই এক থেকে অন্যে, অন্য থেকে আর একে—এদেরই ধরে’ ধরে’ মন-ভোলানো পাষাণ-গলানো কামনাসূত্রে গেঁথে গেথে রচনা করলেন যিনি রূপদক্ষ তিনি অদৃষ্টপূর্ব মনোরম রূপের মালা গাছি।