বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/রূপবিদ্যা
অরুচি নেই! এতকাল ধরে’ মানুষ বিশ্বের সৌন্দর্য রূপ ভাব সমস্তই উপভোগ করছে কিন্তু কই অরুচি তো নেই দেখায় শোনায়! তা ছাড়া আর এক রহস্য এই—মানুষ যা দেখলে শুনলে শুধু তাই পেয়ে সে চুপ করে’ বসেও নেই, নিজে দেখাতে শোনাতে চলেছে অক্লান্তভাবে যুগ যুগ ধরে’। সে ছবি লেখে মূর্তি গড়ে গান গায় কথা বলে—চোখ-জুড়ানো মন-ভোলানো কত সৃষ্টি! বনের কোলেই প্রথম মানুষ ফুলের সঙ্গে পাতার সঙ্গে পশু-পক্ষী, জল-বাতাস এদের সঙ্গে রূপের মধ্যে সুরের মধ্যে ডুবে থাকলো, কিন্তু শুধু দেখেই সে তৃপ্ত হ’ল না, শুনে শুনেও সে বল্লে না যে যথেষ্ট হ’ল! মানুষ তখন ঘর বাঁধতে শেখেনি, গুহায় থাকে, বনে ঘোরে, জীবন্ত হরিণ খেলে’ বেড়ায় চোখের সামনে, দিনের পর দিন পাখী গেয়ে চলে ফুল ফোটে পাতা খোলে পাতা ঝরে—অশেষ ছবি অশেষ সুর। তাই দেখে’ মানুষ গাছের ছবি লেখে, ফুল লেখে, পাতা লেখে, হরিণের ছায়ামূর্তি লেখে—ঘরের দেওয়াল ভর্তি করে’ লেখে। ময়ূর নাচে কোকিল ডাকে কিন্তু মানুষ ঐটুকু দেখেই খুসি হ’য়ে নকল নিতে বসে না—সে নিজের নাচ নিজের সাড়া খুঁজে খুঁজে বার করে। তার নাচ ময়ুরের নাচের তার সাড়া কোকিলের সাড়ার প্রতিধ্বনি করে না, নতুন সুরে নতুন ছন্দে প্রকাশ পায়। ক্রমে বিশ্বের রূপ সমস্তকে বিরাট ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে মানুষ চালাতে চলে, স্বর সমস্তকে নিয়ে খেলতে খেলতে সুরের সৃজন করতে থাকে, চরাচরের চলাচল নাট্যরূপে নতুন করে’ দেখিয়ে যায় সে, চোখ-জুড়ানো মন-ভোলানে ষড়্ঋতুর সৌন্দর্য ছবিতে মূর্তিতে নাচে গানে ধরে’ রেখে যায়। মানুষ কোন্ আদি যুগ থেকে এই খেলা খেলেছে তার ঠিক ঠিকানা নেই, আজও তার খেলা বন্ধ হ’ল না—এ কি রহস্য এ কেমন খেলা! মানুষ কোন্ কালে ছবি লিখে লিখে খেলতে সুরু করেছে—আজও সেই সেই খেলাই চল্লো; মানুষের এ খেলায় অরুচি হ’ল না কেন? সুরের যত রকম খেলা হ’তে পারে মানুষ তা খেল্লে, নাচের ভঙ্গি কথার ছন্দ রঙ রেখার ছন্দ সব নিয়ে খেল্লে মানুষ; কিন্তু সে খেলেই চল্লো, থামলো না। শুধু এই নয়, মানুষ নিজের এক কালের খেলার সব খেলেও আবার সেই খেলার রস পেতে চল্লো—নতুন নতুন উপায়ে নয়, সেই সব পুরোনে উপায়েই। সেই বাঁশী আজকে বাজছে নতুন সুরে, সেই তুলি আজ লিখছে নতুন কথা, সেই লোহার তার—তারি সুর বাজছে কিন্তু আজকের সুরে। আদি যুগের মানুষ তার হরিণ যেমন করে’ আঁকতে হয় তা এঁকে গেল, কিন্তু আজকের মানুষ তেমনিভাবেই হরিণ গাছ আরো কত কি নিয়ে নিজের খেলা খেলতে লাগলো! কালোয়াত যেমন গাইতে হয় গেয়ে গেল, নট নটী তারা যেমন করে নাচতে হয় নেচে গেল, কিন্তু ‘ও সব হ’য়ে গেছে এখন স্থির হ’য়ে বসে’ থাক মৌনী বাবা হ’য়ে’ কিংবা ‘আগের যা তাই পুনরাবৃত্তি করা যাক’—এ তো বল্লে না মানুষ। হঠাৎ মনে হয় এই যে ছবি মূর্তি কবিতা গান নাট্য নৃত্য এসব মানুষের ছেলেমানুষির মতো, মানুষের একটা নেশার মতো। কোন কোন পণ্ডিত তাবৎ রূপবিদ্যা এই ছেলেখেলার ভিতে দাঁড় করিয়ে আর্টকে দেখতে চলেছেন এবং একদল মানুষও এদেশে আজকাল দেখি যাঁরা নেশা এবং খেলার কোঠায় রূপবিদ্যাকে ফেলে এসব থেকে মানুষকে নিরস্ত করতে চাচ্ছেন। ছবি লেখার বিষয়ে একদিন মুসলমান ধর্মে কঠিন শাসন ছিল, মানুষ-লেখার বিরুদ্ধে আমাদের শাস্ত্র শুধু নয় দলে দলে মানুষের নিজের মনেও একটা বিষম ভয় এক এক সময়ে উদিত হয়েছিল। রূপ-বৈরাগ্য রস-বৈরাগ্য এরও প্রমাণ যুগে যুগে দিয়েছে মানুষের ইতিহাস, কিন্তু রূপবিদ্যাকে তো মানুষ ছাড়তে পারলে না এ পর্যন্ত। যদি এসব সত্যিই ছেলেখেলা হ’ত তবে লোকের ধমকানির চোটে নয়তো আপনা হতেই এ সব খেলা কোন কালে বন্ধ হ’ত! ছেলেখেলায় ছেলের অরুচি হয়—সে আজ খেলে ফুটবল, কাল খেলে হাডু-ডু-ডু; বয়স হ’লে দেখি অনেক ছেলে খেলতেই চায় না, এমন কি ফুটবল খেলতেও তার অরুচি হয়, কিন্তু কতক ছেলে সত্যি ফুটবল খেলছে তো বটে। ছেলে শেলেটে ছবি লেখে, মাষ্টারের তাড়ায় আঁকা বন্ধ করে’ আঁক কসতে লেগে যায় এবং অঙ্কবিদ্যায় পণ্ডিত হ’য়ে যায়—তখন আঁকাকে ছেলেখেলা বলেই ভাবে সে। এই যে সমস্ত রূপ নিয়ে ব্যাপার এ যে খেলা নয়, লীলা মানুষের—এ বল্লেও তখন সে চটে’ ওঠে। এই দুই রকমের ঘটনা যে মানুষে নেই তা বলিনে কিন্তু মানুষের লীলার ইতিহাস যুগে যুগে সাক্ষ্য দিচ্ছে—মানুষ প্রথম থেকেই এই রূপবিদ্যাকে তার লীলার সহচরী বলেই গ্রহণ করেছে এবং এখনো এইভাবেই একে দেখছে। “গৃহিণী সচিবঃ সখীমিথঃ” একথা রূপসীর বেলায় যেমন, তেমনি রূপবিদ্যার বেলাতেও বলা চলে।
রূপবিদ্যাকে যারা সখের দিক দিয়ে দেখতে চলে তারা নেশা ছটলে অন্য কিছুতে লেগে যায়, কিন্তু রূপবিদ্যা যার কাছে সত্য হ’য়ে উঠলো, সেই বল্লে এ খেলা নয়, এ লীলা—
“এ তো খেলা নয়
এ যে হৃদয়-দহন জ্বালা।”
অন্তহীন রসের জন্য অফুরন্ত রূপের জন্য জ্বালা আর তৃষ্ণার শেষ নেই মানুষের, সমস্ত রূপ-রচনা এরি সাক্ষ্য দিয়ে চল্লো। রূপের জ্বালা রসের জ্বালা বহ্নির সমান জ্বলেছে সব উৎকৃষ্ট রচনার মধ্যে, রূপদক্ষের জীবন লীলাময় জ্বালাময় হয়ে উঠছে, প্রদীপ্ত সমস্ত রূপ ও রসের তপস্যায় মানুষ জীবনপাত করছে রূপবিদ্যার সাহায্যে এই জ্বালাকে এই তৃষ্ণাকে রূপের পাত্রে ধরতে; মানুষের এই তপশ্চরণ তাকে সখের ব্যাপার বলে’ যারা ভাবে তারা রূপবিদ্যাকে কি ছোট করেই না দেখে! বৈদুর্যমণি নিজের অন্তরের জ্বালা নিয়ে বাইরের বিরাট আলোক-রূপকে স্পর্শ করে’ দীপ্তি দিয়ে চল্লো, মানুষের প্রতিভা তেমনি গিয়ে মিল্লো বিশ্বের দিকে দিকে ধরা ভাস্বর সমস্ত রূপের ও রসের সঙ্গে,—এই ঘটনা নিয়ে রূপবিদ্যার সূত্রপাত; প্রতিভাবানের লীলা তারি সাক্ষী রূপ রচনা সমস্ত, রূপ নিয়ে ছেলেখেলা নয়, প্রাণের জ্বালা নিয়ে রূপের জ্বালাকে গিয়ে স্পর্শ করা,—রূপের সঙ্গে চোখ-ফোটাফুটি খেলা একেবারেই নয়।
খেলার নেশা ছুটলে খেলা থেমে যায়—কিন্তু লীলার অবসান নেই; লীলা করে’ চলায় অবসাদ নেই, আজীবন রূপদক্ষ মানুষের কাছে লীলাময়ী মায়াময়ী বিশ্বরূপিণী। তিনি আসছেন যাচ্ছেন অনন্ত লীলা দেখিয়ে, তারি ছন্দ ধরছে মানুষ রূপবিদ্যা দিয়ে নিজের রচনায়, সে নিজের ও বিশ্বের লীলার পরিচয় ধরছে যুগ যুগ ধরে’। প্রতিভার প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি হচ্ছে অফুরন্ত রূপরসের দেবতার। মানুষ জগতের প্রাণী মাত্রের সঙ্গে সমান ভাবে প্রাণবন্ত অথচ শক্তি নিয়ে প্রতিভা নিয়ে সবার বড় হ’ল সে। রূপ-রচনা ধরে’ মানুষের প্রতিভা প্রকাশ করলে আপনাকে।
রূপবিদ্যা একে তো একদিনে কোনো এক মানুষ আবিষ্কার করেনি কালে কালে রূপদক্ষ এবং প্রতিভাবান সমস্ত এসে এই বিষ্ঠার এক এক সত্য ও তথ্য আবিষ্কার করে’ গেলেন, মানুষের রূপজ্ঞান ধীরে ধীরে বিকাশ পেতে পেতে ক্রমে রূপবিদ্যার সকল দিক পরিপূর্ণ করতে থাকলো। মানুষ যখন পাথরে পাথরে কাঠে কাঠে ঘর্ষণ করে’ আগুণ জ্বালতে শিখছে মাত্র এবং তারও পূর্বে যে সেখানেও দেখি মানুষ রূপ লিখছে—গুহার দেওয়ালে রূপবিদ্যার প্রথম পাঠ নিচ্ছে যেন; রূপের নকল রূপের ধারণা নামতা তার মুখস্থ এবং কাপিবুক লেখার মতো করে’ চলেছে তখন থেকে মানুষ। যে প্রতিভা নিয়ে মানুষ আগুন জ্বাললে শুকনো পাতার রাশিতে সেই প্রতিভা নিয়েই মানুষ জ্বাললে রঙের আগুন, যে প্রতিভা নিয়ে মানুষ লিখলে প্রথম অক্ষর সেই প্রতিভা নিয়েই মানুষ টানলে প্রথম টান ছবিতে প্রথম টান সুরে প্রথম টান তার বাঁকা ধনুকে। রূপবিদ্যা এই ভাবে আশৈশব মানুষের সহচারিণী হ’য়ে প্রতিভাবানের ঘর আলো করে’ মানবজাতির কল্যাণে নিযুক্ত রইলো।
সঙ্গীত নাট্য নৃত্য ছবি কবিতা নানা-বিভূষণ শিল্প এ সমস্তই প্রতিভা থেকে উৎপন্ন— এ সবই একই রূপবিদ্যার অন্তর্গত বলে’ ধরা যায়, কেননা এরা সকলেই নানা ভাবের রূপই দিচ্ছে, নানা উপাদান নিয়ে প্রতিভাবান রূপ সৃষ্টি করছে। এই সব রচনা মানুষের কি কাজে এসেছে এ পর্যন্ত এবং এখনো এ সবের দরকার আছে কি না মানুষের জীবনযাত্রার পক্ষে, এ নিয়ে সত্যই তর্ক ওঠে মানুষের মনে। শুধু তাই নয়, রূপকর্ম সমস্ত নিয়ে নাড়া চাড়া করলে একদল মানুষ আছে যারা সত্যি ভয় পায় পাছে মানবসমাজ ও সেই সঙ্গে কচি কচি মানবকগুলিও সুপথভ্রষ্ট হয়! এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই; রূপবিদ্যার সাধনাপথে চলতে অনেক সময়ে অনেক মানুষ অনেক ছেলে বিগড়েছে—যেন ধর্ম সাধনের পথে চলতে গিয়ে মানুষ বকা-ধার্মিক হ’য়ে উঠেছে; সেই ভাবের বকা দেখা দিয়েছে রূপবিদ্যা-সাধকের মধ্যে ষথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু ধর্মের পথ রুদ্ধ করলে কে, রূপের পথই বা রুদ্ধ করলে কোথায়? এ সব তর্ক বিতর্ক নতুন নয়। অতি পুরাকালেও এই সব তর্ক উঠে চুকেছে, প্রতিভাবান রূপদক্ষকে যাদুকর ডাইন ইত্যাদি বলে’ পুড়িয়ে মেরেছে মানুষ, তারও কথা ইতিহাস খুঁজলে পাই। কিন্তু এততেও রূপের আকর্ষণ মানুষের প্রতিভাকে কম্পাসের কাঁটার মতো টানছে তো টানছেই। মানুষের প্রতিভাকে রূপ-কর্মের পথে আকর্ষণ করে’ চলেছে যে সব রূপ তাদের বিরাট শক্তিতে বাধা দেয় এমন দৈত্যের দল সৃষ্টি হয়নি হবে না কোনো কালে।
প্রতিভা মানুষের চিরকালই আছে, রূপ-কর্ম সমস্ত ধরে’ চিরকাল থাকবেও; তর্ক করে’ তাকে ঠেকানো যায়নি যাবেও না। এ প্রতিভাবানের উপর নির্যাতন যারা করলে পুরাকালে তারা বিলুপ্তির তলায় চলে গেল, কিন্তু নির্যাতিতের প্রতিভা দিয়ে রচিত অতৈলপুর-প্রদীপ রূপলোকে একটা একটা ধ্রুবতারার মতো জ্বলে’ রইলো যুগ যুগ ধরে’ আলো দিয়ে সৌন্দর্য দিয়ে।
মানুষ নিজেকে নিজে আবিষ্কার করতে পারে না, নিজেকে অপরের নিকটে প্রকাশ করতে পারে না, চোখে দেখা রূপ, কানে শোনা রূপ, মনে ভাবা রূপ সমস্তই—তার কাছে অর্থহীন যার কাছে রূপবিদ্যা নেই। প্রতিভাবানের রচনা সমস্ত অর্থহীন বলে যারা উড়িয়ে দিতে চলে, জগতে কোন কিছুর অর্থ কোনো কালে তাদের কাছে আবিষ্কৃত হবে এ তো বিশ্বাস করা যায় না।
বিশ্বজোড়া এই যে সমস্ত রূপ, প্রতিভার আলোয় এদের স্বরূপ যুগে যুগে আবিষ্কৃত হ’তে থাকে,তবেই তো মানুষ বিশ্বের দেবতাকে দেখলে জ্বাজ্জ্বল্যমান এই সৃষ্টির ভিতরে। জীবনের অর্থই অনাবিষ্কৃত থাকতো যদি না রূপদক্ষ মানুষের প্রতিভা জীবন্তরূপ সমস্তকে স্পর্শ করতো। অনাবিষ্কৃত যা তা প্রতিভার আলোকে আবিষ্কৃত হ’ল—নিউটনের আবিষ্কার যেমন। তেমনি রূপের জগতে প্রতিভাবান এল এবং ধরে’ গেল নানা সত্য। প্রতিভা রূপের জগতে যে সমস্ত অঘটন ব্যাপার ঘটিয়েছে তার মধ্যে কত দৃষ্টান্ত দেবো? একটা ঘটনা যা ঘটেছে রূপ-জগতে তার কথা বলি। রূপের জগতে বসে’ মানুষ পাখী আঁকে—যুগের পর যুগ যায়—কল্পনার পাখী, গাছের পাখী, ডালের পাখী রঙে রেখায় ধরে রূপ বিষয়ে ধীমান মানুষ। বসা পাখী হয়, ভাসা পাখী হয়, ঘুমন্ত পাখী হয়, চলন্ত পাখী হয় না, দূর আকাশের উড়ন্ত পাখী হয় না।ধীমানের হাতের রেখা হার মানে রঙ হার মানে যুগে যুগে এই পাখীকে ছবিতে ধরতে। ডানা মেলানো পাখী হয়, কিন্তু নীল পটে সে স্থির নিশ্চল—যেন লাগিয়ে দেওয়া ভাবে থাকে। হঠাৎ কোন দেশে একদিন একজন প্রতিভাবান এল,—হয়তো ছিল সে নিউটনের মতোই বালক মাত্র, হয়তো বা ছিল সুলেমান বাদশার মতো প্রকাণ্ড শক্তিমান—উড়ন্ত পাখীকে তুলির একটি টানে ছবির আকাশে উড়িয়ে দিয়ে গেল সে। যেমন আলোর কম্পন বিজ্ঞান-জগতে, রূপের জগতে, এই উড়ন্ত পাখীর ডানার ওঠা-পড় বুঝিয়ে জীবন্ত রেখার একটু কম্পন একটা মস্ত আবিষ্কার,—রেখা প্রাণ পেলে।
রত্নাকরের মুখে ফুটি ছত্র শ্লোক প্রতিভার প্রভায় যেদিন ঝলমল করে’ উঠলো, সাহিত্যে ও কাব্যজগতে সে একটা মহাদিন, ভাষা নতুন ডান মেল্লে আলোর ছন্দে। সঙ্গীতকার তাঁরা চটবেন—যদি বলি গানের সাত স্তর দেবতার কাছ থেকে না এসে মানুষের প্রতিভার কাছ থেকে পাওয়া; কিন্তু মানুষের ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে তিন পাঁচ এবং পরে সাত যুগ ধরে’ একটির পর একটি প্রতিভার আলো এসে ধ্বনিকে বাতাসের ফাঁদে ধরেছে তবে পেয়েছি আমরা সঙ্গীতবিদ্যাকে পূর্ণভাবে।
সহজ কথা কিন্তু টীকাকারের বোঝানোর চোটে শক্ত হ’য়ে উঠলো, এটা তো সংস্কৃত টীকাশুদ্ধ একটা বই পড়লেই বোঝা যায়। প্রতিভাবান কবি এক ছত্রে সহজে বল্লেন কিছু, ধীশক্তিমান সেটাকে এতখানি করে’ পেঁচিয়ে বলে’ গেলেন। প্রতিভার বিশেষণ হ’ল যেমন ‘সর্বতোমুখী’ তেমনি ধীশক্তির বেলাতেও নানা বিশেষণ এল ‘সূচ্যগ্র’ ‘সুতীক্ষ্ণ’ প্রভৃতি। বালকের প্রতিভা আর বয়স্কের প্রতিভা দুয়ের ভিন্নতা কেমন তা বোঝাতে হ’লে প্রদীপের সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রতিভা জ্বলছে সূচ্যগ্র পলতেটি থেকে আসছে যে বুদ্ধি বা ধী তা নিয়ে; স্বল্পতৈলের প্রদীপ আর অনেক তৈলের প্রদীপ, অপরিস্কৃত তৈলের আলো আর সুপরিষ্কৃত তৈলের আলো। নানা দরের আলো নিয়ে যুগে যুগে মানুষের ঘরে জ্বল্লো প্রতিভা এবং তারি খবর নানা রূপ-রচনায় এবং লীলায় ধরা রইলো। যুগে যুগে মানুষের উৎকর্ষের ইতিহাস এই প্রতিভা ও ধীশক্তির ক্রিয়ার ইতিহাস। প্রতিভার আলো ধরে’ কোন্ দেশের মানুষ কোন্ দিকে কতটা এগোলো তার হিসেব রূপবিদ্যা দখল না হ’লে তো ঠিক ধরা মুস্কিল। কলাবিদ্যার চর্চার আনন্দই যেখানে সেখানে প্রতিভার আলোয় দেখছি মানুষের অন্তর্জগৎ-বহির্জগৎ দুই নতুন নতুন দিকে বিস্তৃতি পাচ্ছে, কর্মজগৎ ও ধর্মজগৎ রসের দ্বারায় আপ্লুত হচ্ছে, শ্রান্তিহরা নব রষের ধারা বর্ষিত হচ্ছে চিত্তক্ষেত্রে মানুষের।
রূপবিদ্যার চর্চা তো তুচ্ছ করবার মতো নয়। এ সেই আদি যুগ থেকে মানুষের সহচর, এর ব্যাপার সমস্ত যুগযুগান্তর ধরে’ মানুষের অন্তরে বাহিরে যা ব্যাপার ঘটছে তার পথ দেখায় অভ্রান্ত পরিষ্কার ভাবে।
আলোর কম্পন ইথরের সাড়া প্রভৃতি ব্যাপার কোন্ কালে কোন্ মানুষের মধ্যে কোন্ দেশে কোন্ বছরের কোন্ মাসের কোন তারিখে প্রথম ধরা পড়লে এটা জানা যেমন দরকারি ঠিক ততখানি দরকারি রূপবিদ্যার চর্চা করতে করতে খুঁজে পাওয়া কোনো একটা রূপ-সৃষ্টির আদ্যন্ত ইতিহাস। রেখার নানা কম্পনকে কি ভাবে মানুষের প্রতিভা একটার পর একটা আবিষ্কার করে’ গেল তার কথা সম্পূর্ণভাবে ধরা পড়লে একটা বিস্ময়কর ইতিহাস খুলে’ যাবে আমাদের কাছে। শুধু ছবি মূর্তির দিক দিয়ে রূপবিদ্যার চর্চা, তার মধ্যেও এত অদ্ভুত রহস্য মানুষের ইতিহাসে রয়েছে যে বলবার নয়।
টেলিগ্রাফের বিনা তারের খবরের ব্যাপার যে কি ভাবে সারা পৃথিবীতে ঘুরে’ ঘুরে’ চল্লো দেশের পর দেশ সাগরের পর সাগর অতিক্রম করে’ তার ইতিহাস যেমন বিচিত্র তেমনই অদ্ভুত। এমনি একটা নয় অনেকগুলো কাণ্ড রূপজগতে ঘটে’ গেছে।
দাঁড়ি আর কসি এই নিয়ে এতটুকু স্বস্তিক চিহ্নটি কালচক্রের সঙ্গে সঙ্গে এক ধর্ম এক সভ্যতা এমনি এক এক দেশের সংস্পর্শে কি ভাবে এল নানা দিক দিয়ে তা জেনে নিতে হলে পৃথিবী ব্যেপে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলতে হয়; একটি শঙ্খলতা এই বাঙলার রূপবিদ্যার ইতিহাসের একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। প্রাচীনকালের গ্রীক স্পাইরাল পেঁচ আর বাংলায় ব্রতচারিণীদের শঙ্খলতা একই, কিন্তু এদের উৎপত্তি এক সময়ে নয়, এক সভ্যতা থেকে নয়, দুই বিভিন্ন দেশ দুই বিভিন্ন কালে একে ফুটিয়ে গেল—এ কেন হ’ল কেমন করে’ হ’ল, জানতে হ’লে যুগযুগান্তরের মধ্য দিয়ে চলে’ যেতে হয় কত দেশের কত শিল্পের আচারের ব্যবহারের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে তার ঠিক নেই।
রূপবিদ্যার দিক দিয়ে যুগ যুগান্তরের মানবজাতির কর্মকাণ্ডের ইতিহাস ও রহস্য প্রত্যক্ষ গোচর হয় যেমন, এমন কোনদিক দিয়ে হওয় সম্ভব নয়। কেননা রূপ প্রথম থেকে মানুষের সব কর্ম কে নিরূপিত করে’ ধরে’ গেল শুধু এই নয়, রূপের মধ্যে মানুষের অন্তর বাহির দুয়ের হাব ভাব সমস্তই অভ্রান্তভাবে আটকা পড়লো। মানুষ যখন প্রথম আরম্ভ করলে মানুষের মুখ আঁকতে—ইতিহাসের ঠিক ঠিকানার বাইরের যুগের সে কথা—সে সময়ের অনেকগুলি ছবি অল্পদিন হ’ল ইউরোপ এৱং পুথিবীর বিভিন্ন দেশেও আবিষ্কৃত হয়েছে। এর প্রত্যেক ছবি দেখাচ্ছে মানুষকে মানুষ এঁকেছে হয় একেবারে সামনে থেকে, নয় তো পিছন থেকে,—দু এক জায়গায় দেখি মানুষের দেহটি আঁকা একপাশে থেকে কিন্তু মুখের বেলায় সামনের বা পিছনের গোলাকৃতি ছাড়া পাশের মুখ আঁকা সাধ্য হচ্ছে না। জন্তু জানোয়ার আঁকার বেলার তখনকার মানুষ কিন্তু দেখি সম্পূর্ণ পাশ থেকেই আঁকছে তাদের। কত যুগ যুগান্তর গেল এই ভাবে আঁকতে আঁকতে, তারপর ঈজিপ্টের সভ্যতার সূত্রপাত হ’ল, সেই খানে প্রথম দেখি মানুষ মানুষকে আঁকছে একেবারে পাশ থেকে। এখন সহজে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক আর ঐতিহাসিক যুগের মধ্যে পাশের মুখ আঁকার হিসেব সম্বন্ধে মানুষের প্রতিভা ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তা নয়; সেই ইতিহাসের যুগের পূর্বেকার মানুষের মধ্যে একজন প্রতিভাবান এল সে অভ্রান্তভাবে গুটিকতক রেখায় লিখে’ গেল পাশ থেকে দেখে’ একটি মানুষের মুখ (The Chidhood of Art—Spearing. Fig. 74, Page 76)। এই কাণ্ড ঘটলো Aurignacian যুগে স্পেন দেশের গুহাবাসী মানুষের মধ্যে! এর পরের একটা যুগ সে সময় দেখি ঐ সব মূর্তি গড়তে মুরু করেছে ছবি আঁকা রেখে। এই যুগকে Solutrian নাম দেওয়া হয়েছে। সেখানেও দেখি প্রতিভা কায করছে, থেকে থেকে মূর্তি-শিল্পকে উৎকর্ষ দিচ্ছে (The Childhood of Art, Fig. 12)। তার পরে এল Magdalenian যুগ। সেখানে আর একজন প্রতিভাবানের দেখা পাই। সে শুধু একট দুটো কি দশটা হরিণ পটে নিয়ে বোঝাতে চলছে না হরিণের দঙ্গল ও পাল, সে গতিমান রেখা দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে হরিণের পাল চলেছে এইটে বুঝিয়ে দিচ্ছে (The Childhood of Art—Spearing. Fig. 76. Page 123.).
এমনি কত শত দিক দিয়ে কত প্রতিভা রূপ দিয়ে চিহ্নিত করল এক একটা যুগ-পরিবর্তন, তার বিচিত্র ইতিহাস রূপবিদ্যার দ্বারা অধিকার করা ছাড়া তো উপায় নাই!
আমরা দেখতে পাই স্পেন দেশের গুহাবাসী যে কালে মানুষের সম্মুখ দৃশ্যই এঁকে চলেছে, ঠিক সেই কালেই অষ্ট্রেলিয়ার জঙ্গলবাসী (ব্যুস্ম্যেন) তারা আঁকছে তাদের প্রত্যেক মানুষ একেবারে পাশ থেকে, এবং এই যুগের পর কত যুগ কত সভ্যতা এল গেল তার ঠিক ঠিকানা নেই, তারপর মানুষ না-পাশে না-সামনে এই ভাবে আধফেরা অবস্থায় আঁকতে শিখে নিলে কোন এক দেশের প্রতিভাবানের কাছ থেকে। অজন্তার ভিত্তি-চিত্রণের মধ্যে এই ভাবের আধফেরা মূতি সমস্ত পাই। সেখান থেকে আরম্ভ করে’ কত যুগ ধরে’ চলতে চলতে কোন দেশে কোন কালে দেখি একজন প্রতিভাবান এই ভাবে আঁকার সূত্রপাত করলেন।
সুলেমান বাদশার একটা কবচ ছিল সেটা ধারণ করলে পুথিবীর গোপন রহস্য সমস্তই অবগত হ’তে পারতেন তিনি। এইরূপ বিদ্যা সেই কার্যই করে মানুষের সমস্ত গোপন রহস্য ধরে’ দিতে আজকের দিনের আমাদের সামনে। ইউরোপ অক্লান্ত ভাবে এই রূপবিদ্যার চর্চা করে চল্লো তাদের সামনে দিনের পর দিন, রূপের সমস্ত রহস্য ধরা পড়তে থাকলে, আমরা রূপবিদ্যাকে চাই না, কাজেই পাই ও না এসব খবর, যতক্ষণ না ওদের কাছ থেকে খবরটা কাগজে ছাপা হ’য়ে আসে।
আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পাইনি এমন কিছু নেই বল্লেও চলে—কাব্য সাহিত্য সঙ্গীত নাট্য নৃত্য বাদ্য চিত্র মূর্তি সবই। এত বড় ঐশ্বর্য কোনো দেশের মানুষ তার সন্তানদের জন্যে রেখে গেল না। কিন্তু আমরা জানিনে যে এই সম্পদ এর কতখানি আমাদের প্রতিভাবানদের স্বোপার্জিত, কতখানি বা দেশ-দেশান্তর থেকে জয় করে’ সংগ্রহ করে’ ধার করে’ এমন কি চেয়ে আনা তাও!
একটা ছোটখাটো দৃষ্টান্ত দিই। সঙ্গীত নিয়ে আজকাল খুবই চর্চা চলেছে, কিন্তু খুব ভাল ওস্তাদ তাকে বল, ইমন কল্যাণের সঠিক বিবরণ দাও, বড় জোর শুনবে, একটা যাবনিক ও একটা হিন্দু দুটো সুরে মিলে একটা হয়েছে ব্যাপার, কিন্তু এও শুনবে হয়তো যে আমীর খসরু কি আর কেউ এটার আবিষ্কর্তা। তারপর যদি প্রশ্ন কর, কল্যাণ কোথা থেকে এল, শুনবে মহাদেবের কাছ থেকে, নয়তো নারদের কাছ থেকে বা ভরত মুনির কাছ থেকে। এ ভাবের চর্চাকে রূপবিদ্যার দিক দিয়ে চর্চা বলে না। কল্যাণ সুর কি ইমন সুর এদের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে মানুষের কি ভাবে কোথায় কোথায় পরিচয় তা জানতে সাত বারের বেশি পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে’ আসতে হবে, রূপবিদ্যার প্রদর্শিত পথ ধরে’ কত মানুষ কত সভ্যতা অসভ্যতার কোঠায় কোঠায় সন্ধান করতে হবে, তবে পাওয়া যাবে সঠিক খবর ইমন কল্যাণের।
মনে হয় শুনলে, এই ভাবে সব জিনিষের চর্চা করে’ চলা শক্ত ব্যাপার। কিন্তু ইউরোপের মানুষ—তারা তো চলেছে এইভাবে, তারা তো মাটির তলা থেকে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্বের এক একখানি পাতা এক এক অধ্যায় উঠিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ করছে পৃথিবীর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত তার রূপের নানা পবিবতনের ইতিহাস—উপন্যাসের মতোই যা মনোহর, রূপকথার মতোই যা অদ্ভুত।
রূপবিদ্যা মানুষকে বিষয়টির সত্যে পৌঁছে দিতে চায়। যার কাছে রেখার সত্য রঙের সত্য সুরের সত্য ছন্দের সত্য ধরা রইলো না, সে ছবিই বা জানবে কি, গানই বা গাইবে কি, কবিতাই বা লিখবে কি এবং এদের ইতিহাসই বা বুঝবে কি! একটা সোজা কসির মধ্যে প্রাণ কি অনিমেষভাবে জ্বলছে, একটা তরঙ্গিত রেখার প্রাণশক্তি কি উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে, আর একটা দপ্তরীর টানা রেখায় প্রাণ কি ভাবে নিষ্পেষিত হ’য়ে গেছে,—রূপবিদ্যার সাহায্য ছাড়া এ কেমন করে’ জানা হবে। সুরের অভিমতে সমস্ত কি রূপ ধরছে, ছন্দের দোলা সব কেমন ভঙ্গি ধরে’ ধরে’ নৃত্য করে’ চলেছে রূপবিদ্যা দখল না হ’লে কে তা বুঝবে!
বাতাস ঝড়ের উন্মাদ রূপ ধরে’ আসে, বাতাস বসন্তের ছন্দ ধরে’ বয়, বাতাস শীতের শিহরণ দিয়ে দিয়ে চলে, জলে স্থলে আকাশে তার রূপ নিরূপিত হ’য়ে যায়, মেঘের বিস্তারে ফুলের ছন্দে জলের কম্পনে ধরা থাকে তার কথা সুর রূপ ভাব ভঙ্গি সমস্তই—রূপবিদ্যার জ্ঞান যার নেই সে দেখে সব শোনে সব অবাক হ’য়ে, দেখাতে পারে না শোনাতে পারে না বলতে পারে না কিছুই।
ধীশক্তি প্রতিভার আলোর অনুগামী এবং ধীশক্তির অনুগামী নিপুণতা প্রভৃতি কতকগুলি। আলঙ্কারিকরা এইজন্য বলেছেন—শক্তিনিপুণতা লোকশাস্ত্রকাব্যাদ্যবেক্ষণাৎ কাব্যঞ্চ শিক্ষয়াভ্যাস ইতি হেতুসমূদ্ভবে। প্রতিভার সঙ্গে ধীশক্তি নিপুণতা লোকশাস্ত্র ও কাব্যাদির আবেক্ষণ কবিজনের নিকট শিক্ষা এবং অভ্যাস—এতগুলো ব্যাপার জুড়ে’ থাকে, তবে হয় রূপবিদ্ মানুষ।
প্রতিভা হ’ল অতৈলপুর প্রদীপ, দৈবাৎ কোন কোন মানুষ আসে রূপের জগতে সেটি বহন করে’ এক কালের থেকে আর এক কালের মধ্যে জ্ঞান-অজ্ঞান উৎকর্ষ-অনুৎকর্ষ আচার-অনাচার সমস্তর হিসাব মিটিয়ে নতুন পথে চালিয়ে নিতে মানুষকে। প্রতিভাবান নতুন পথ খুলে’ দিয়ে গেল, মানুষের চিন্তাস্রোত সেই ধারার অনুসরণে চল্লো যুগ যুগ ধরে নতুন নতুন রূপ-সৃষ্টির পথে।
বাঙলা ভাষার সঙ্গে যার একটু মাত্র পরিচয় আছে সেই জানে বাঙলা গদ্য পদ্য এ দুয়ের মধ্যে এক এক প্রতিভাবানের পরিচয় কি ভাবে সুস্পষ্ট ধরা রয়েছে—ছন্দের দিকে বর্ণনার ধরণ-ধারণ সমস্তেরই দিকে। ভাব-প্রকাশের বাধা সমস্ত প্রতিভাবান কাব্য ও সাহিত্যের দিক দিয়ে কালে কালে যেমন দূর করে’ চলেছেন, তেমনি সব প্রতিতাবানের আসা যাওয়া চিত্রকলা সঙ্গীতকলার বেলাতেও ঘটছে এবং ঘটে’ গেছে কালে কালে। প্রতিভাবান নতুন নতুন যে পথ সৃজন করে তার সঙ্গে যার কোনো প্রতিভা নেই কিন্তু একটা কিছু নতুনতরো কাণ্ড করে’ বসলো তার কর্মে তফাৎ রয়েছে।
কবি বাল্মীকির প্রতিভা যখন সাতকাণ্ড রামায়ণ সৃষ্টি করলে তখন কাব্যজগতে একটা নতুন রসের পথ খুল্লো, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ ‘শকুন্তলা’ সেখানেও নতুন রসের ধারা ঝরলো রূপ-জগতে; তারপর এল কবির লড়াইয়ের কালে ভ্রমর-দূত হংস-দূত এমনি কত দূত তার ঠিক নেই, কিন্তু কোনো দূত পাঁচালী কোন দূত ছড়া কেটেই চলে’ গেল,—নতুন ফুল ফুটলো না কাব্যজগতে, নতুন পথও খুল্লো না নতুন যুগের। বৈষ্ণব কবির এলেন, প্রতিভার স্পর্শে নতুন ছন্দে বেজে উঠলো কাব্যলক্ষ্মীর নূপুর-কঙ্কণ।
এক কবির সঙ্গে অন্য কবির কাযের খুঁটিনাটি হিসেব নিয়ে দেখলে হংস-দূতের ভ্রমর-দূতের কবিদের মধ্যে কিছু যে পাইনে তা নয়, শুধু একটা যুগ-পরিবতনের মধ্যে বৈষ্ণব কবির কাব্যকলা আর ইতর কবিদের কাব্যকলার স্থান কি ভাবে ধরা সেইটেই দেখানো ঊদ্দেশ্য আমার।
প্রতিভাশালী কবির রামায়ণ যে দেশকালের অতীত, আর যে কবিতা নয় তার রামায়ণী গান শুধু যে এক দেশের বা এক দলের,— এটা কালই প্রমাণ করে’ দিচ্ছে— অন্য প্রমাণের অপেক্ষা নেই এখানে ধীশক্তিমানদের অগ্রণী বলে’ ধরতে পারি চাণক্য পণ্ডিতকে; তার একটা শ্লোক আর প্রতিভাবান কবি কালিদাস তাঁর একটা শ্লোক—দুয়ের ইতর-বিশেষ আছে এবং ঠিক সেই রকমের ইতর-বিশেষ আছে আজকের যথার্থ কবির গানে এবং অসত্য কবির গানে—এ নিয়ে ঝগড়া তো নেই কারু সঙ্গে।
আমাদের প্রাচীন আমলের একখানা স্থান-চিত্র—স্থান-চিত্রের গভীর রহস্য সবটা তার মধ্যে যে নেই সেটা আজকের ইউরোপের বা চীনের বা জাপানের অপূর্ব একটি স্থান-চিত্রের পাশে ধরলেই বোঝ যায়। স্থান-চিত্র আঁকার প্রতিভা কখন কোন দেশে প্রথম জাগলো, তার ইতিহাস জেনে আনন্দই পাই, এ দুঃখ তো মনে আসে না যে আমাদের দেশে স্থান-চিত্র সম্পূর্ণ বিকাশ পেলে না! রূপবিদ্যা আমাদের যে রাস্তা ধরে চালায় সেটা এত বড় রাস্তা যে সেখানে একটা জগৎব্যাপী রূপের প্রকাশ-বেদনার সামনে গিয়ে আমরা পৌছই—ভুলে’ যেতে হয় এ-দেশ ও-দেশ এ-জগৎ ও-জগৎ এ-মানুষ সে-মানুষ এ-কাল সে-কাল। মানুষের রূপ-সৃষ্টি যেখানে বৃহত্তর ভাবে চোখে আসে, দেখি যে মানুষের প্রতিভার আলো বিকীর্ণ হয়েছে সেখানে বৃহত্তম রূপের রহস্য প্রকাশ করে' দিয়ে।
প্রত্নতত্ত্ব-বিদ্যা তা দিয়ে একটা জিনিষের স্থান কাল সবই ঠিক হ’ল কিন্তু তখনও সেটিকে জানতে অনেকখানি বাকী থাকলো। একটা সহজ দৃষ্টান্ত দিই। তাজমহলটা কখন হ’ল, কারা গড়লে, কি ধাঁচে গড়লে, গড়তে কত টাকা পড়লো, কত মানুষ খাটলে, তারা কে কত তঙ্কা মাইনে পেলে, কোন কোন দেশ থেকে তার পাথর এল, কার ভাণ্ডার থেকে তাকে সাজাবার মণিমুক্ত এল—এ সবই জ্ঞান হ’ল পুরাতত্ত্ব ইতিহাস দিয়ে, কিন্তু তবু অনেক খানি জানার বাকী রইলো, রূপবিদ্যা দিয়ে সে খবর না নিলে কোন উপায় নেই। সেদিক দিয়ে দেখি তাজমহল তো শুধু একটা বাড়ী মাত্র নয়, কবর মাত্র নয়, সে একটা কবিতা—মানুষের ভাষারূপ জগতের একটা যুগচিহ্ন, প্রতিভার আকাশ-প্রদীপ, হিন্দু-মুসলমান দুই সভ্যতার উৎকর্ষের পরিণয়ের সাক্ষী, এবং দেখি তার ইতিহাস ঈজিপ্টের পিরামিড, জগন্নাথের রথ, বৌদ্ধস্তূপ এবং যুগ-যুগান্তরের মানুষের প্রতিভা দিয়ে রচনা করা সমস্ত স্মৃতিমন্দির এবং স্মরণীয় গীত ও কথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিবিড় ভাবে। চার মিনারের মাঝে দেউল, দুই পাশে দুই জওয়াব্ –পার্শ্বদেবতার মাঝে এ কেন চতুভূর্জা, এ কেন সপ্ততন্ত্রী বীণা! এই রহস্য রূপবিছা না হ’লে ধরি কোথা থেকে?
রূপের যথার্থ পরিমাপ একমাত্র রূপবিদ্যার দ্বারা হওয়া সম্ভব, আর কোনো বিদ্যা রূপের তল পর্যন্ত পৌছে দিতে পারে না। দপ্তরী সোজা রেখা টেনে যায় বটে কিন্তু রেখার যে রহস্য তার তলতে পায় না কোনো দিন, রূপবিদের কাছে সামান্য আচড়টিও আপনার জীবনরহস্য ধরে’ দেয়। রূপবিদ্যা নিয়ে যারাই চর্চা করছে তারাই জানে এতে করে’ একটা জিনিষের গুণটিও যেমন দোষটি ও তেমনি সুস্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয় চোখে।
অজন্তা গুহার ছবির সামনে যদি এমনি একজন মানুষ, একজন পুরাতত্ত্ববিদ এবং একজন রূপদক্ষ গিয়ে দাঁড়ায়, তবে দেখবো ক’জনই বলবে চিত্রগুলো চমৎকার, কিন্তু কেন চমৎকার তার বেলায় ক’জনই আলাদা আলাদা কথা বলবে। সাধারণ মানুষটি কেন যে চমৎকার তা ধরতে পারবে না—সেই ব্যাপারটির সামনে অভিভূত হ’য়ে থাকবে; পুরাতত্ত্ববিদ ছবির প্রাচীনতা তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে’ এমনি কতক ইতিহাস কতক কুলপঞ্জী ইত্যাদি মিলিয়ে সুন্দর একটা বক্তৃতা দিয়ে চলবে এবং ঐ সাধারণ মানুষটির মতোই রসও গ্রহণ করবে জিনিষটার; কিন্তু সত্যি যে রূপদক্ষ সে ছবির খবর সব দিক দিয়ে পাবে। সে শুধু ছবির প্রাচীন ইতিহাস দেখবে না ছবিগুলো চিত্রবিদ্যার কতটা উৎকর্ষ দেখাচ্ছে সেটাও দেখবে। এক কথায় সে দেখতে পাবে অজন্তার চিত্র যেন তার সামনে আজ আঁকা হচ্ছে,—কারু হাত নির্ভয়ে রেখা টানছে, কারু হাত ভয়ে কাঁপছে। শুধু এই নয়, এই সব চিত্রের পিছনে মানুষের চিত্রবিদ্যার ধারা কত যুগ ধরে’ বইতে বইতে কি রেখে গেল রঙের কুলে রেখার কূলে কি চিন্তার ছাপ—তাও দেখবে রূপবিদ্।
পুরাতত্ত্বের বিষয় এক জিনিষ, রূপতত্ত্বের বিষয় অন্য—এটা বলা ভুল। একই অজন্তার ছবি তার পুরাতত্ত্বও রয়েছে তার রূপতত্ত্বও রয়েছে তার রসতত্ত্বও রয়েছে, সুতরাং বলতে পারি রূপবিদ্যার মধ্যে এ সবারই স্থান আছে।
রূপবিদ্যা নানাদিক দিয়ে রূপটির পরিমাপ করতে নিযুক্ত করে মনকে, তাই রূপের অন্তর বাহিরের খবর এত করে’ ধরা পড়ে রূপবিদের কাছে। বৃহত্তর ভাবে রূপকে দেখায় বলে রূপবিদ্যার দিক দিয়ে চর্চায় রূপ-রচনা সমস্তের বিস্তৃত ইতিহাস ধরে চলতে হয় শিক্ষার্থীকে। কোনো একটা তত্ত্ব ধরে’ চল্লে রূপের এক অংশ যেমন তার ঐতিহাসিক অংশ বা তার কোনো এক জাতি বা ধর্মের সঙ্গে সম্বন্ধের দিক পরিষ্কার হ’য়ে উঠলো, কিন্তু বিশ্বজোড়া রূপ ও রসের রচনা সমস্তের সঙ্গে কি প্রকারের যোগ নিয়ে জিনিষটি রয়েছে মহাকালের মানদণ্ডে তার কি মূল্য নির্ধারিত হ’ল—এর হিসেব রূপবিদ্যার অধিকারীর হাতে। রূপ-রচনা সমস্তকে সর্বাঙ্গীণ ভাবে বুঝতে বা বোঝাতে হলে রূপবিদ্যার দরকার। কোনো একটা রচনার রসতত্ত্ব পেতে হলে অলঙ্কারশাস্ত্রে নানাদিক দিয়ে রচনাটি আলোচনা করে দেখার উপদেশ সমস্ত রয়েছে, তেমনি রূপতত্ত্ব তারও আলোচনার পথ হয়েছিল এ দেশে। রূপতত্ত্ব সম্বন্ধে হেমচন্দ্র বলেছেন—
“রূপতত্ত্বং স্যাদ্রুপং লক্ষণং ভাবশ্চাত্মপ্রকৃতিরীতয়ঃ।
সহজ্যে রূপতত্ত্বঞ্চ ধর্মসর্গোনিসর্গবৎ॥”
ললিতবিস্তরে কলাবিদ্যার যে সব হিসেব ধরা গেছে তার মধ্যে ‘রূপ’ম্ এবং ‘রূপকর্ম্ম’ এই দুয়ের কথা বলা হয়েছে। ইউরোপের একজন পণ্ডিত যিনি এই রূপতত্ত্ব ও রূপবিদ্যা নিয়ে বিশেশভাবে আলোচনা করেছেন তিনি শুনেছি আমাদের মেয়েদের হাতের আলপনার যে নক্সা আমি ছাপিয়েছি সেগুলি পেয়ে বলেছেন যে তাঁর দেশের অনেকগুলি ঐ ভাবের নক্স কোথা থেকে কেমন করে উৎপত্তি হ’ল তার ইতিহাসের সন্ধান তিনি পেয়েছেন বাঙলার আলপনা থেকে। এইভাবে দেখি সেকালে এবং একালেও রূপবিদ্যা রূপতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলেছে রূপ সমস্তের পরিষ্কার ধারণ পাবার জন্য।
রূপের রাজত্বে প্রবেশ রূপের রহস্যে অনুপ্রবেশ এ সব রূপবিদ্যা নিয়ে চর্চা না করলে হবার জো নেই। ছাত্র যখন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তখন সমস্ত বিদ্যার সঙ্গে পরিচয় করে নেবার অধিকার পেলে সে, বিদ্যার ছাড় মুক্ত হ’ল তার সামনে। তেমনি এই রূপবিদ্যার প্রবেশিক পরীক্ষা পাস হ’ল শিল্পী তবে তার রূপের তথ্য রূপের তত্ত্ব জানার জন্যে যে সব বিদ্যা রয়েছে যে সব শাস্ত্র রয়েছে তাদের নিয়ে নাড় চাড়া করার ক্ষমতা পেয়ে গেল সে, রূপ-রাজত্বের রহস্য-নিকেতন মুক্ত হ’ল তার কাছে।
একটা বিদ্যা দিয়ে আমরা ফুলের রহস্য অবগত হচ্ছি, কোন বিদ্যা আমাদের পশুপক্ষীর বিষয়ে জানাচ্ছে, কোনটা মানব চরিত্র, কোন বিদ্যা বা শিশু-চরিত্র স্পষ্ট করে’ ধরছে আমাদের কাছে, রূপের তত্ত্ব তেমনি রূপবিদ্যা জানাচ্ছে—মানুষকে রূপটির রচনার দোষগুণ তার সমস্ত ইতিহাস কলাকৌশল সবই জানাচ্ছে।
আমরা যখন নিজেদের কিছুর চর্চা করতে চলি তখন অনেক সময়ে মা যে চোখে তার ছেলেকে দেখে সেই চোখেই দেখে চলি, এতে করে দোষ চোখে পড়ে না, দোষগুলোও গুণ হ’য়ে দেখা দিয়ে চর্চার বিষয়টি সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা পৌছে দেয় মনে, কিন্তু রূপদক্ষের চোখে রূপের সামান্য খুঁৎটিও এড়ায় না। যেমন গুণটি তেমনি, রূপটি ঠিক যা তা যথাযথ ভাবেই উপস্থিত হয় তাদের কাছে।
ধর, এই অজন্তার চিত্রাবলী কি অদ্ভুত কি অদ্ভুত এই কথাই শুনে আসছি, ওর রঙ যেমন রেখা তেমন—সবই তখনকার সমস্ত রূপকল্পনার মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ তো শুনে এলেম এবং মেনেও নিলেম তাই, কিন্তু অজন্তা চিত্রের একটা দিক আছে সেটা তখনকার শিল্পীর চিত্রকরণে অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে সুস্পষ্ট রকমে। এটা শুধু চোখে যারা দেখলে কিংবা ইতিহাস পুরাতত্ত্ব প্রভৃতি বিদ্যা দিয়ে আলাদা আলাদা দেখে’ গেল ছবিগুলো, তাদের চোখ এড়িয়ে গেল, অথচ সেই অক্ষমতা শুধু অজন্তায় নয় অজন্তায় আগে অজন্তার পরে পৃথিবীর সব চিত্রকরদের মধ্যে ধরা যাচ্ছে। অনেক কাল মানুষ ছবিতে পাহাড় আঁকতে পারেনি, একটা স্থানচিত্র আঁকিতে পারেনি, নদী আঁকিতে পারেনি, আকাশ আঁকতে পারেনি, মেঘ আঁকতে পারেনি, বাতাস ঝড় উত্তাল তরঙ্গ সমুদ্র কত কি আঁকতে অক্ষম ছিল জগতের শিল্পী তার ঠিক নেই,—এ সব পরিচয় অজন্তার গুহায় এখনো ধরা, ইউরোপের খুব উৎকৃষ্ট ছবিতেও ধরা রয়েছে। ইতালীয় বড় বড় শিল্পী বাতাস আঁকছেন হুটো গলাফুলে ছেলের মুণ্ডূ ফুঁ দিচ্ছে মানুষের গায়ে। অজন্তার শিল্পীরা এত বড় ছেলেমানুষি করেনি সতী, কিন্তু এক জায়গায় চিত্রবিদ্যার খুব বড় দিকের বিষয়ে তখনো তাদের চোখ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের শিল্পীর সঙ্গে একেবারেই ফোটেনি দেখ’ যাচ্ছে |
সেকালে মানুষকে যদি বলা যেতো—বুদ্ধ যাত্রা করেছেন পথেদিকে—তাকে, তবে সে ঘটনার মধ্যে তিন চারবার একই বুদ্ধকে না একে কিছুতে বোঝাতে পারতে না ব্যাপারটা। একটা বুদ্ধ দিয়ে তিনি ওখান থেকে এলেন, আর একটি দিয়ে এখান দিয়ে চল্লেন সেখানে পৌছতে, এই যে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঘটনাপরম্পরার ইঙ্গিত তিনটি বুদ্ধ না একেও দেওয়া চলতে পারে তা তখনকার দিনে অজ্ঞাত ছিল। একটা প্রতিভার ইঙ্গিতের অপেক্ষা করে’ ছিল পৃথিবী জুড়ে সমস্ত চিত্রকর এই কলাকৌশলটুকু লাভের জন্য। সেই প্রতিভা কোন্ দিন কবে কোন্ দেশে কার কাযের মধ্যে প্রথম দেখা দিলে, রূপবিদ্যার সাহায্যে এটা দেখতে পেলে একটা নতুনতরো দেখার চেয়ে যে কম জিনিষ দেখা এবং দেখানো হয় তা তো নয়; একটা মূর্তি গুপ্ত রাজার আমলে না সেন রাজার আমলে এই তত্ত্বের চেয়ে একটা কম জিনিষ আবিষ্কার করা হয় তাও তো নয়; ভারতশিল্প সবই আধ্যাত্মিক এমনি একটা বড় গোছের রহস্যের চেয়ে কিছু ছোট রহস্য ভেদ করে যাওয়া হয় শিল্পবিষয়ে তাও তো নয়!
সমস্তখানি জল স্থল আকাশের সঙ্গে সম্বন্ধ নিয়ে তবে ফোটে একটি ফুল একটি ফল, তাই তো ফুল ফলের মর্ম এত বিচিত্র বিস্তার নিয়ে ধরা পড়ছে কবিতায় ছবিতে গানে নাচে,—কত ভাবে কত রূপে কভ কাল ধরে’ কত রূপদক্ষের রচনায় তার ঠিক নেই। তেমনি মানুষের দেওয়া একটি রূপ-রচনা বিশ্বের মানবজাতির ভাবনা চিন্ত সুখ দুঃখ সভ্যতা ভব্যতা শিক্ষা দীক্ষা সমস্তেরই সঙ্গে লিপ্ত হ’য়ে আছে। মানব জাতির পুর্বাপর সমস্ত সংস্কার বাদ দিয়ে কোনো রূপদক্ষ তো ফোটায় না কিছুই সেই জন্যেই একটি রূপ কিন্তু তার ইতিহাস তার খবর জগৎ জুড়ে ছড়িয়ে আছে, কালকের ছবি মূর্তি কবিতা সে ধারণাতীত কালের রহস্য সমস্ত বহন করছে। যেমন আজকের গোলাপ সেই প্রথম দিনের এবং তারপর থেকে সমস্ত গোলাপের সৌরভ ও বর্ণ ধরে” প্রফুটিত হ’ল, আজকের চাঁদ সে যেমন আজকের সে যেমন কালকের সে যেমন যুগ যুগান্তরের চাঁদনী আর স্বপ্ন ধরে’ রইলো, তেমনি প্রতিভাবান রূপদক্ষের রূপ-সৃষ্টি সমস্ত মানুষের পূর্বাপর যা কিছুর সাক্ষী স্বরূপে বর্তমান হ’ল –এই প্রকাণ্ড রহস্ত ভেদ হ’য় রূপবিদ্যার শক্তিতে।