বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/রূপ দেখা

রূপ দেখা

 প্রত্যেক রূপের সঙ্গে রূপের ডৌলটি কতকগুলি রেখা দিয়ে সুনির্দিষ্ট আকারে আমাদের চোখে পড়ে এবং তাই দিয়ে আমরা বুঝি এটি এ, ওটি তা । ইনি অমুক তিনি অমুক এটা মানুষের মুখ না দেখেও খুব দূরে থেকে চিনি, মানুষটি যে কে তা বুঝি এই সমস্ত রেখা দিয়ে যা তার রূপের সঙ্গে এক হ’য়ে আছে। রঙ্গমঞ্চের উপরে যখন মানুষটিকে চড়াতে হ’ল তখন তার নিজের রূপটি নিয়ে বা রূপ-রেখাগুলি নিয়ে কায হ’ল না— অন্ত এক প্রস্থ রেখা দিয়ে তাকে ভিন্ন রূপ করে’ নিতে হ’ল । এখন, যে রূপকার রঙ্গমঞ্চের চরিত্রগুলিকে নির্দিষ্ট রূপ দিয়ে উপযুক্ত ভাবে সাজাবে সে যদি দক্ষ না হয় রূপ-রেখার বিষয়ে, তবে নানা অঘটন উপস্থিত হয় অভিনয়ের রস ফোটাবার কাযে, তেমনি ছবিতে রেখার রহস্য ভেদ করতে যে পারলে না, রূপকে দিয়ে রসও ফোটাতে সে পারলে না ; রেখার ঘোরপেঁচ্‌, দিয়ে সে চমক লাগিয়ে দিলে, হয়তো যে ভাবে তান মানের কর্তব দিয়ে চমক দেয় তথাকথিত কালোয়াত সমস্ত শ্রোতার কান, কিংবা জমকালো সাজগোজ দিয়ে ভুলিয়ে দেয় যাত্রার অধিকারী দর্শকের চোখ —সেই ভাবে বিস্ময় জাগালে ; কিন্তু একে রূপদক্ষত। বলা গেল না। রূপদক্ষতা সেইখানে যেখানে রূপে-রেখায় রূপে-ভাবে সুরে-কথায় এবং এক রেখায় অন্ত রেখায় এক রূপে অন্ত রূপে এক সুরে অন্ত সুরে একাত্ম হ’য়ে রস সৃষ্টি করে । রেখা ছাইলো রূপকে, রূপ ছাইলো রেখাকে এমনভাবে যে কেউ কাউকে মারলে না কিন্তু মিল্লো সহজ ছন্দে—তখনি হ’ল রস, না হ’লে বিরস হ’ল ব্যাপারটি ।

 বর্ষার ধারা সরু রেখা টেনে আকাশ থেকে পড়ে, হঠাৎ দেখে’ মনে হয় একটা আবছায়া, ছবির উপরে হাল্কা রঙের রেখা টেনে বৃষ্টির ছবি সহজেই দেখানো যাবে, কিন্তু আঁকবা মাত্র বুঝি এ বৃষ্টি পড়লো না, রেখার জাল পড়লো ছবির উপরে। পদে পদে ঠেকি কেন এই জলের রেখা টানতে ? বৃষ্টিধারী রূপরেখা দিয়ে সৃষ্টি ; সেই এক একটি রেখার মধ্যে বর্ষার ছায়া-করা রূপ, জলের ঝরে’ পড়ার সুর, বৃষ্টি থেমে রোদ ফোটার এবং মাঠের সবুজ হ’য়ে ওঠার নানা স্বপ্ন এক হ’য়ে আছে। রুপদক্ষতা না পেলে এই রেখা আঁকাই অসম্ভব হ’য়ে ওঠে। অলঙ্কারের মধ্যে বৃষ্টিধারী ধরে’ নেওয়া চলে, মুক্তার ঝুরি থেকে আরম্ভ করে’ সোনার তার দিয়ে বর্ষার একটা প্রতীক ধরে’ নেওয়া যায় রেশমের পর্দায় কিংবা আর কিছুতে, কিন্তু এই অলঙ্কার-শিল্পের উপরের জিনিষ হ’ল রূপদক্ষের হাতের টান। এ কথা তো মিছে নয় যে ভিজে মাটির সুবাসে ভরপুর জল ঝরার শব্দে মুখর রেখার টান কথার টান সুরের টান রূপদক্ষের কাছ থেকেই আমরা পেয়েছি। যে রূপদক্ষ ওধারে বসে’ কায করছেন আর যে রূপদক্ষ আমাদের মাঝে বসেই কায করছেন—দুজনেই রূপ-রেখার অধিকারী ।

 প্রকৃতির লীলা যা চলেছে আমাদের চোখের সামনে তা নিরীক্ষণ করে’ দেখলে দেখি তার মধ্যে কারিগর এবং রূপদক্ষের হাত একই সঙ্গে কায করছে। কারিগর বাঁধলে নানা রেখা দিয়ে গাছের কাঠামো, পাতার শিরা উপশিরা, জীবের অস্থিপঞ্জর এমনি কত কি একেবারে শক্ত করে’ বাধা রেখা দিয়ে, আর রূপদক্ষ লীন করে দিলেন এই বাঁধা রেখার কসন এবং কর্কশতা, রূপরেখার আবরণ অবগুণ্ঠন পড়লে সবটার উপরে। নরকঙ্কালের বাঁধা রেখা দিয়ে বাঁধা চক্ষু-কোটর তাকে ঢেকে রূপ-রেখা টেনে দিলে দুটি কালে চোখের হাসি-কান্নার সুরের টান, শক্ত রেখা দিয়ে টানা বাঁশপাতা তার উপরে রঙ আর আলো টানটোনের ঘোমটা ফেল্পে। একই সঙ্গে কারিগরি এবং রূপ-কর্ম এ মানুষের কাযেও দেখা দিয়েছে অনেক স্থলে ; যে রেখায় বাঁধা গেল সেই রেখা দিয়েই ছাড়া পেলে রূপ –এই অভাবনীয় দক্ষতা যে লাভ করেছে মানুষ, এর পরিচয় ধরেছে তারা পাথরে ছবিতে কবিতায় গানে। দেশভেদে কোনো এক জাতি যে এই রূপ-রেখা প্রথম পেয়ে গেল তা নয়—যেমন ছোট ছেলেদের মধ্যে দেখা যায় যে বড় হ’য়ে একটা কেউ হ’য়ে না উঠেও রূপকথা বলছে, বেশ গাইছে বেশ নাচছে, তেমনি সব দেশের মানুষের শিল্পচর্চা করে’ দেখি দেশে দেশে খুব আদি কালেরও মানুষ রূপ-রেখা বিষয়ে সম্পূর্ণ পাকা হ'য়ে গেছে। ইতিহাসে অখ্যাত যুগের মানুষ তাঁদের বাল্যে বিশ্বদেবতার রূপ-রেখা বিষয়ে কত উপদেশ দিলেন–রূপ-রেখা দিয়ে কেমন করে’ গড়তে হয়, লিখতে হয়, সুর বাঁধতে হয় তার সব শিক্ষা ধরে’ দিলেন জলে স্থলে আকাশে। আজও সে শিক্ষার পথ খোলা রয়েছে শুধু এইটুকু তফাৎ হয়েছে—আগেকার তারা শিখতে রূপরেখাকে চোখের সামনে দেখে’, আর আজ ছাত্র এবং মাষ্টার দুই দলেই বক্তৃতায় শুনে’ বুঝতে চলি রূপ-রেখার আমূল তত্ত্ব । দুগ্ধফেননিভ বিছানার কথা শুনে’ শুনে’ বস্তুটির সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ আর বিছানাটায় একবার গড়িয়ে নিয়ে বস্তুটি কি জেনে নেওয়া—দুই রকমের জ্ঞানলাভের মধ্যে প্রভেদ আছে তো ! একজন যে রূপ-রেখা টানলে বা রচলে সে এবং যে বই পড়লে রূপ-রেখার হিসেবের কিন্তু টেনে দেখলে নী ব্যাপারটা কি—দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান রইলো ; যে শুধু গান গাইতে পারে এবং যে গান রচতে পারে দুজনের মধ্যে যেমন স্বর-জ্ঞান বিষয়ে বিষম অমিল, তেমনি অমিল কারিগরে আর রূপদক্ষে, তেমনি অমিল রূপ-রেখাকে যে জানে আর রূপ-রেখাকে যে জানে না কিন্তু রেখা দিয়ে রূপকে বাঁধতে জানে তাদের কাযের মধ্যে। একটি ছোট মেয়ে যে পল্লীগ্রামের দাওয়ায় বসে আলপনা টানছে, কাঁথা বুনছে, সে পেয়ে গেছে রূপ-রেখাকে কিন্তু একজন মস্ত ইঞ্জিনিয়ার যে রুল কম্পাস দিয়ে রেখা টানছে কিংবা কারখানা ঘরের শিল্পী যে বাঁধা চালে কাপেটের ফুল তুলে চলেছে এ দুজনের মধ্যে কেউ পায়নি রূপ-রেখার সন্ধান—এ তো মিছে কথা নয়। তেমনি দেখি একজন বাউল পথে পথে ঘুরছে কিন্তু গলার সুরে সুরে রূপ-রেখার টান এসে গেছে তার কাছে, কিন্তু একজন তথাকথিত কালোয়াত যে হারমোনিয়ম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছে সভাস্থলে চাল দোরস্ত হিন্দী গান হিন্দুস্থানী সুর দিয়ে ঘাড় মোচড়ানো বাঙলা কথা—তার ডাকাডাকির ত্রিসীমায় রূপ-রেখা আসছে না সুরের সূত্র ধরে’ । এ-গাছে ও-গাছে এ-ফুলে ও-ফুলে এ-পাখীতে ও-পাখীতে তোমাতে আমাতে শুধু রূপের বিভিন্নতা নয়, চলা বলা ভাবনা চিন্তা কায কর্মও আমাদের এক এক রূপ।

 এই যে রূপে রূপে ভিন্নতা এটা সবারই চোখে পড়ছে কিন্তু এই ভিন্নতাটুকু ছবিতে কি কবিতায় কি কথায় ধরে’ দেখানোর কৌশল সবার কাছে নেই। মানুষে পাখীতে যে একরূপ নয় তা ছোট ছেলেও জানে ; তাকে মানুষ আঁকতে বল্পে সে এক প্রস্থ রেখা ব্যবহার করে যেগুলি পাখীর বেলায় সে মোটেই ব্যবহার করে না। যেমন লিখে’ আমরা জানাচ্ছি মানুষ এই তিনটি অক্ষর দিয়ে, তেমনি ছেলেও বোঝাচ্চে এক প্রস্থ রেখা দিয়ে মানুষ । ছেলের লেখা মানুষ যেমন কোনো বিশেষ মানুষ নয়, সে তার আপনার মানুষের প্রতীক তেমনি রূপদক্ষের লেখা রূপ সেও তার আপনার কল্পিত রূপ, দেখা রূপের ছাপ নয় । কিন্তু এক জায়গায় রূপদক্ষের সঙ্গে ছেলের লেখার পার্থক্য—রুপের বিভিন্নতা দিয়ে রসের বিচিত্রতা ছেলের দ্বারা হয়ে ওঠে না বড় একটা, তা ছাড়া ছেলের হাতের সঙ্গে তার হাতে টানা রেখার একটা আড়ি থাকে—ছেলে জানে না রেখাকে বাগ্‌ মানাতে হয় কি উপায়ে। এই রেখাজ্ঞানের রহস্য-ভেদ করে’ তাকে দিয়ে ইচ্ছামতো রূপ বাঁধা এবং রূপে ও রেখায় এক করে’ দিয়ে রসের পথ খুলে দেওয়া জেনে’ শুনে’—এ হ’ল রূপদক্ষের সাধনার বিষয় । চোখে দেখছি যে সমস্ত বাঁধা রূপ ধরে’ ধরা রূপ বাইরে ধরা রূপ এরা যদি রঙ্গমঞ্চের দৃশ্য-পটে আঁকা জিনিষগুলোর মতো সম্পূর্ণভাবে অনড় ও অপরিবর্তনীয় রূপে ধরা থাকতো, তবে পৃথিবীতে এদের চিত্রিত করতে চাইতো না বা কবিতায় গানে গল্পে এদের কথা বলতেও চাইতো না মানুষ। খাড়া দাঁড়িয়ে রইলো রেখা, মড়ার মতে পড়ে রইলো রেখা-—দুইটি অবিচিত্র সম্পূর্ণ নিস্পন্দ এবং অচল ; এই দুই রেখা যেয়ে চলতে গিয়ে রেলগাড়ির দৌড়ের ধারে ধারে সাইনবোর্ডগুলো যে ভাবে পড়তে পড়তে চলে যায় যাত্ৰী শ্রীরামপুর হুগলী বর্ধমান বোলপুর—সেই ভাবে খালি দেখে যায় চোখ আম গাছ জাম গাছ লাল পাখী কালো পাখী এ-দেশ সে-দেশ এ-মানুষ সে-মানুষ,—মন খোজে চলাচলের বিচিত্রতা কিন্তু পায় না। সৃষ্টির কঠিন নিয়মে বাঁধা সমস্ত রূপ, একের সঙ্গে অন্যের ভিন্নতা দিয়ে বন্দী করা, রূপ-সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই রূপ-মুক্তি কামনা করে এরা মুখ তুলে’ চাইলে আলোর দিকে, হাত পেতে দিলে বাতাসের কাছে, কবির কাছে, চিত্রকরের কাছে জানালে এর নানা ছন্দে মুক্তি পাবার কামনা-রুপ বাজলো রূপের কান্না বাজলো রূপদক্ষের মনে, রূপের বেদনার মধ্যে রূপ সমস্ত মুক্তি লাভ করলে ; এ যেন পাথরে বাঁধা জল নিঝর দিয়ে ঝরলো, নদী হ’য়ে বইলো, রসের সমুদ্রে গিয়ে মিল্লো। বাঁধন থেকে মুক্তি পেয়ে রূপ বাঁচালো যখন ভাবকে সে বহন করলে আপনার মধ্যে ।

 যে পথকে নিরেটভাবে বেঁধেছে রেল কোম্পানী কিংবা ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড সেই পথের রেখা আর যে পথকে বেঁধেও বাঁধেনি পথিক—সেই “গ্রামছাড়া রাঙ্গা মাটির পথ”—তার টানটোনে রূপে রসে সব দিক দিয়ে বিভিন্ন দেখা যায়। ইস্পাতে বাঁধা পথের রেখা আর সকাল সন্ধ্যার আলোতে সবুজ পৃথিবীর কোলে ছাড়া পাওয়া আঁকা বাঁকা পথের টান,— একে মনকে টেনে নিয়ে যায় দিগন্তরের শ্যাম শোভার মধ্যে, অন্যে আস্ত মানুষটাকেই ঝাঁকানি দিতে দিতে টেনে নিয়ে চলে বন্ধ খাঁচায় ভরে’ নিয়ে। এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে সে গাঁয়ে পথিক চল্লো, তাদের কারু মনে থাকলে না যে পথ রচনা করছি, অথচ চলার ছন্দে তাদের গাঁয়ের পথ আপনা হতেই তৈরি হ'য়ে গেল ; কিন্তু বাঁধা পথের রেখা ইঞ্জিনিয়ার রুল কম্পাস প্লেন ধরে তৈরি করছি বলেই টেনে চলে, কার্যেই সেটা ভয়ঙ্কর রকম ঠিক ঠাক থাকে বলেই রয়াল রোড, বা সাধারণ পথ হ’য়ে ওঠে । গাঁয়ের পথের চলার যে ছন্দ এবং মুক্তি সেটি সাধারণ সড়ক বেয়ে চলার হিসেব থেকে স্বতন্ত্র, তেমনি ছবি মূর্তি এ সবের যে রেখা তার কোনটা বেয়ে মন চলতে গিয়ে দেখে মন রেলে বাঁধা গাড়ির মতো গড়গড়িয়ে চল্লো কিন্তু রেখাকে অতিক্রম করে’ আর কোনো দিকে চলা তার সম্ভব হ’ল না। আবার কোন রেখা গাঁয়ের পথের মতো মুক্ত এবং স্বচ্ছন্দগতি, সেখানে পথের রেখাও যেমন মুক্ত পথের রূপও তেমনি সুবিচিত্র এবং মোটেই বদ্ধ এবং সঙ্কীর্ণ নয়, বাঁধা রূপ দেখা থেকে মুক্তি পেয়ে মন সেখানে ডানা মেলে’ দিলে ভাবের হাওয়ায়। গাঁয়ের পথের রেখা সে বল্লে, আমি পথ বটে আবার পথ নয়ও বটে, আমি মুক্ত রূপ, আর রেল পথ সে কেবলি বলে’ চল্লো, আমি পথ, পথ ছাড়া আর কিছুই নয়, আমি বদ্ধ রূপ ।

 রেলপথের মতো কসে’ বাঁধা রেখা আর গাঁয়ের পথের মতো ঢিলে ঢালা রেখা দুই ধরে’ মন কোন দিকে কি ভাবে কত খানি পায় তার দু একটা নমুনা যারা এই দুই পথ বেয়ে চল্লো তাদের ছটো লেখা থেকে বোঝাবার চেষ্টা করি ; যথা—“পৃথিবী জোড়া প্রকাণ্ড রাত্রি ভেদ করে চলেছি, তখন কেবল শুনছি পায়ের তলা দিয়ে একটা ঝনঝন লৌহ নির্ঝরের মতে ক্রমাগত গড়িয়ে চলেছে।”—এখানে রেল চলার শব্দ তার মধ্যেও বৈচিত্র্য আসতে পাচ্ছে অল্পই, যুগ যুগান্তর ধরে’ যেন একটানা শব্দের পথ কেটে চলেছে গাড়িগুলো উপর নীচে আশপাশ কোনোদিকের কোনো খবরই পৌঁছুচ্চে না মনে, তাই বল্পে মন পুনরায়, “নিশাচর পাখীরা রাত্রির নীরব নীলের মধ্যে আপনাদের নিশ্চল পাখা মেলিয়ে নিঃশব্দে যেমন ভেসে যায় এ তেমন করে’ যাওয়া নয়—এ যেন একটা উন্মত্ত দৈত্য চাকা-দেওয়া লোহার খাঁচাটা পৃথিবীর বুক আঁচড়ে চারিদিকে অগ্নিকণা ছিটিয়ে অন্ধকুহরের ভিতর ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে।” এই ভাবে চলার ফল তাও আমার নিজের কাছে ধরা পড়েছিল সেদিন যেদিন এই বর্ণনা লিখেছিলাম রেল-রাস্তার; যথা—“সুদীর্ঘ অনিদ্রা, অফুরন্ত অস্থিরতা, তার পরে বিরাট অবসাদ—নির্জীব প্রাণ নিরুপায় অবোলা একটা জন্তুর মতো চুপ করে’ পড়ে’ আছে অপার অন্ধকারের মুখে দুই চোখ মেলে’।” রূপ দিলে বটে একটা—এই বাঁধা পথের একটানা ভাবে চলা, কিন্তু সে হ’ল অবিচিত্র নির্জিত রূপ, মুক্ত রূপ মুক্ত রেখার আনন্দ যা মালার মতো মনকে দোলায় তা এ লেখার মধ্যে ধরা গেল না; কিন্তু গাঁয়ের পথের মুক্ত রেখা ধরে’ চলতে চলতে এই গান যে কবি গাইলেন এর মধ্য দিয়ে মুক্তির স্বাদ আপনা আপনি সহজে পৌঁছলো মনে; যেমন—

“গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে।
ওরে—কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
লুটিয়ে যায় ধূলায় রে॥
ও যে—আমায় ঘরের বাহির করে,
পায়ে পায়ে পায়ে ধরে—
কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে
যায় রে কোন্ চুলায় রে॥
ও সে—কোন্ বাঁকে কি ধন দেখাবে,
কোন্ খানে কি দায় ঠেকাবে
কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে
ভেবেই না কুলায় রে॥”

 রেখামাত্র-শেষ যে চন্দ্রকলা সে যেমন পরিপূর্ণ রূপ ও রসের আধার, তেমনি পূর্ণিমার চন্দ্রমণ্ডল—রেখায় ঘেরা আলো করা রূপ—সেও রূপে রসে ভরপূর। কিন্তু এই যে খাতার একখানি পাতা যা রেল লাইনের মতো রেখার পর রেখা দিয়ে ভর্তি-সাদা কাগজে রুল টানা হয়েছে এইটুকুমাত্র বোঝাচ্ছে—এই রুলটানা রেখা সমস্ত চাচ্ছে আঁকা বাঁকা অক্ষর মূর্তির তলায় আপনাকে লুপ্ত করে’ দিয়ে সার্থক হ’তে! রূপদক্ষের হাতে টানা রেখা এই ভাবের সার্থক রেখা, বিস্তীর্ণ পটখানির প্রসারের উপরে আকাশের বুকে ধরা চন্দ্র-রেখার মতো—রূপে ভর্তি রেখা। ত্রিপদী চৌপদী নানা ছন্দ আছে যা দিয়ে কবিতার স্বচ্ছন্দ রূপটি বাঁধা হ’য়ে থাকে, সকোণ নিষ্কোণ নানা রেখা আছে যা নিয়ে রূপের ছাঁদ বাঁধা হয়, সঙ্গীতে টানটোন তাল-লয় ইত্যাদি নানা মাত্রার কসন আছে যা বেঁধে রাখে সুর ও কথা একত্রে, কিন্তু এই যে কথা বাঁধা পড়ছে ছন্দে, রূপ বাঁধা পড়ছে রেখায়, সুর বাঁধা যাচ্ছে তানে লয়ে—এদের সবারই দাবী রূপদক্ষের কাছে—ছন্দ যেন নিগড় না হ’য়ে নূপুর কাঞ্চী হ’য়ে বাজতে থাকে, রেখা যেন বেড়ী না হ’য়ে ফুলের মালা হ’য়ে দোলে, তাল লয় ইত্যাদি যেন ভয়ঙ্কর রকমে ঠিক ঠাক একটা বেতাল হ’য়ে গলা জড়িয়ে না ধরে’ “তমালতালী বনরাজিনীলা” হয়। কাজল-রেখার টানটোনের বেলাতেও এই কথা। বেহালার ছড়ি যখন খ্যেঁচ্ খ্যেঁচ্ করে সুর টানতে থাকে তখন সঙ্গীত কোথায় থাকে ভেবেই পাই না। ছাঁদ্‌লা তলায় কন্যা বাঁধা পড়ে বরের সঙ্গে একগাছি রক্ত-সূত্রে কিন্তু কন্যার দাবী থাকে—এই বাঁধন যেন নিগড় হ’য়ে গলার ফাঁসি হ’য়ে তাকে পীড়ন না করে। এমনি রূপ ধরা দেয় রেখার বাঁধুনীর মধ্যে কিন্তু রূপের দাবী থাকে রেখার কাছে—রেখার বাঁধুনী যেন রূপকে পরিখার মতো ঘিরে’ না বন্দী করে, মেখলার মতো, নূপুরের মতো, কাজলের মতো, কূল উপকূলের মতো রেখা যেন রূপের সহচারিণী সহধর্মিণী হ’য়ে সুরের ছন্দে বাঁধা বীণার ঝক্‌ঝকে তারের মতো বাজতে থাকে, রূপের সঙ্গে এক হ’য়ে থাকে যেন রেখা, এককে না মারে অন্যে, রূপ ও রেখা দুজনের সত্তা এক হ’য়ে যেন রস জাগায়।

 রূপদক্ষের হাতে টানা রেখা আর খবরের কাগজে যে সব সচিত্র বিজ্ঞাপন বার হয় তার রেখা—দুয়ের তফাৎ এইটুকু নিয়ে যে রূপদক্ষের রেখা সে রূপ-রেখা, সেখানে রেখা রূপ রঙ সমস্তই এক হয়ে আছে, কালীঘাটে পটে টানা রেখা সেখানেও এই হিসেব; কিন্তু রায়স্কোপের দরজায় যে সচিত্র মস্ত মস্ত বিজ্ঞাপন, মাসিক পত্রের মলাটে যে রঙ্গীন আবরণ—সেখানে রেখা রূপ রঙ সবই আলাদা আলাদা বর্তমান।

 রূপ এবং রেখা দুয়ের যথার্থ মিলন সপ্রমাণ করে রূপবতী রেখা, সেখানে রূপকেও পাই রেখাকেও পাই রসকেও পাই একসঙ্গে মিলিয়ে। দপ্তরীর টানা খাতার রেখায় খালি রেখাকে পাচ্ছি; এই সোজা সোজা পাহারার মধ্যে একটা রেখা একটু যদি বেঁকে দাঁড়ায় কিংবা নেচে চলে তখনি খাতার পাতা শুধু আর রেখার সমষ্টি থাকে না, সোজা রেখা বাঁকা রেখায় মিলে একটা সম্বন্ধ স্থাপন করে’ নক্সা হ’য়ে উঠতে চলে। যেমন এই রেখায় রেখায় সম্বন্ধ তেমনি রূপ আর রেখার সম্বন্ধ নিয়ে তবে ছবিতে ফোটে ভাব রস ইত্যাদি। দপ্তরীর রেখা সে যা তাই বলে, পড়ে’ থাকে সোজা, লেখার বেলাতেও তেমনি খাড়া শব্দ। কাক বল্লে, আমি কাকই আর কিছুই নয়, কিন্তু যখন বল্লেম কাক-চক্ষু জল তখন কথারূপী কাক এবং জল এবং চক্ষু এর স্বকীয়তা ছেড়ে তিন সখীর মতো গলাগলি মিল্লো পুকুর পাড়ে। সা রি গা মা এর প্রত্যেকে সম্বন্ধ স্থাপন করতে চল্লো প্রত্যেকের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য বর্জন করে’ অনেকখানি, তবেই হ’ল গান। এমনি রূপে রেখায়, কথায় কথায়, সুরে ও সুরে, সুরে এবং কথায়, এমন কি বলতে পারি সুরে বেসুরেও একত্র মিলে তাবৎ রস-রচনার সহায়তা করছে। বাঁধন এবং মুক্তি এরি ছন্দ নিয়ে রেখা হ’ল রূপবতী ছবির বেলাতে, কথার বেলাতেও এই কথা, গানের বেলাতেও ঐ কথা। এক অন্যেতে লীন এই লয়ে বাজছে রূপজগৎটাই একখানি বীণার মতো, যেখানে এই লয় ভঙ্গ হ’ল সেইখানেই ব্যাপারটি নীরস হল।

 যেমন কথা সুর এবং লয় তেমনি রঙ রেখা ও রূপ তিনে মিলে এক হ’তে চায়, রূপদক্ষ সে এদের এক করবার উপায় জানে, কিন্তু যে মোটেই দক্ষ নয় সে এদের আলাদা আলাদা রাখে, নয়তো এদের কষ্টে সৃষ্টে এমনভাবে মেলায় যাতে করে’ এদের আপনার আপনার শ্রী ছাঁদ পর্যস্ত নষ্ট হ’য়ে একট। বিশ্রী জিনিষের সমষ্টি গড়ে’ ওঠে।

 এই যে রূপ-রেখা যা পরিখার মতে রূপকে আপনার মধ্যে বন্দী করে না একে কারিগর নয় রূপদক্ষেরাই খুঁজে বার করেছে। খুব প্রাচীনকালের মানুষ তারা দেখি একদল রেখাকে দিয়ে রূপকে বাঁধছে, হরিণের শিঙ কাঠের ফলক গায়ের কাপড় কত কি’তে রেখা টানছে তারা, কিন্তু রেখা সে থাকছে রূপের এবং রূপ সে থাকছে রেখার অটুট জালে বন্দী হ’য়ে। কিন্তু সেই অতকাল পূর্বেও মানুষের কারিগরিকে সার্থক করতে দু’একজন রূপদক্ষ দেখা দিয়েছিল যাদের হাতের লেখায় রূপ ও রেখা এক হ’য়ে রয়েছে দেখি এক অন্যের ধর্ম পেয়ে,—রূপের কুহকে সেখানে রেখা ভুল্লো, রেখার স্বপ্নে রূপ আপনাকে হারালে।

 খুব প্রাচীন কালে ঈজিপ্টের ভাস্কর্য থেকে দেখি রেখাকে সত্যিই দুর্গের পরিখার মতো করে’ কেটে’ রূপকে তার মধ্যে বদ্ধ করেছে মানুষ। আমাদের তালপাতায় লেখা পুঁথির ছবি সেখানেও রেখার এই ভাব,—তারের খাঁচার মতো রেখা ধরে’ রেখেছে রূপকে। কিন্তু মানুষের মূর্তিশিল্প যেখানে সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা পেয়েছে সেখানে দেখি রেখা থেকেও নেই, রূপের হিল্লোলে ভাবের বাতাসে রেখা স্রোতের জলে মালার মতো ভরা পালের বাঁকটির মতো কখনো রূপের সঙ্গে ওতপ্রোত হ’য়ে রইলো কখনো বা রূপের গরবে ভর্তি হ’য়ে থাকলো।

 যেমন রূপটির সঙ্গে রেখা ঠিক ভাবে মেলাতে পারলে রেখা হয় সুন্দরী তেমনি রূপও হয় সুন্দর যখন ঠিক রেখাকে সে পেয়ে যায়। খাতার পাতায় টানা রেখাগুলি রূপ না পেয়ে যেমন ভাবে আছে তেমনিই যদি থাকে তো আমরা পাতাটাকে বিশ্রী বলিনে, রেখাগুলিকেও বিশ্রী বলিনে; সাদা পাতায় সাদাসিধে রেখা তারা দুয়ে মিলে একটা সৌন্দর্য সৃষ্টি করলে—যেমন সাদা সাড়ির কিনারায় কিনারায় পাড়ের টান কিংবা বীণাদণ্ডের উপরে ঝক্‌ঝকে গুটিকতক তারের টান। এই ভাবের একাকিনী রেখা সে রইলো যেন না-বাজা বীণা। খাতার রেখাগুলি তারা চাইছে অক্ষর-মূর্তিকে পেতে, বীণার তার তারা চাইছে স্বর-মূর্তিকে পেতে, যখন সেই মিলনটি ঘটলো তখন সার্থক হ’ল বীণা এবং খাতা দুইই। এ না হ’য়ে শুধু দৃষ্টিসুখটুকু দিয়ে গেল মাত্র যে সুদৃশ্য রেখা ও টান সে শুধু চোখের বস্তু; অলঙ্কারশিল্পে এই সুদৃশ্য রেখা ব্যবহার করা হয়। সুশ্রাব্য ছন্দ ও সুর কিছু না বল্লেও যেমন শ্রবণ মাত্রেই তৃপ্তি দেয় তেমনি একটি নিখুঁৎ সোজা বা সুন্দর বাঁকা রেখার দ্বারা দর্শনসুখ পাই আমরা। অলঙ্কার দিয়ে মানুষ যখন চোখ ভোলাতে চাচ্ছে তখন চোখে পড়ে এমনই সব রেখা দিয়ে সে রূপকে বাঁধছে। অলঙ্কার গায়েই পরি বা তা দিয়ে একটা পুঁথির পাতা কি ঘরের দেওয়াল কি পাটের কাপড়ই সাজাই সেটা বাইরের জিনিষ বাইরে বাইরেই রইলো এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হ’ল কায তার, কিন্তু মানুষের সুন্দর চোখের ভুরুর ঠোঁটের হাতের আঙ্গুলের আগা থেকে পায়ের আঙ্গুলটি পর্যন্ত যে সমস্ত রেখার টানটোন দেখি সেই রেখা সমস্ত তো শুধু মানুষটিকে দেখতে কেমন এইটুকু প্রমাণ করতেই থাকলো না, সে সব রেখার ভঙ্গি দর্শকের মনের মধ্যে ভাবের তরঙ্গ তুলে’ দিলে, রেখা রূপ রস তিনে মিল্লো সেখানে এবং একেই বলতে হ’ল রূপরেখা—বাইরে এর স্থান অন্তরে এর স্থান। গ্রীক-স্মৃতিতে এই রেখা, বুদ্ধ-মূর্তিতে এই রেখা, চমৎকারী শুধু রেখা দিয়ে টানা চীন এবং জাপানী ছবিতে এই রেখা, শীতের গাছ মাঠের মাঝে একলা দাঁড়িয়ে নীল আকাশের কাছে সবুজ আশীর্বাদ প্রার্থনা করছে—সেখানেও এই রেখা। একটুকরো পাথর একখানা কাগজ খানিকটা শুকনো কাঠ এদের কি এমন শক্তি আছে যে রসিকের মন টানে কিন্তু এদের যখন রূপদক্ষ রূপ-রেখার সঙ্গে মেলালে তখন মানুষে পাথরে যোগ হ’য়ে গেল প্রাণে প্রাণে।

 মাঠের ধারে পাতা-ঝরা গাছ আর তার ডালপালাগুলিকে বাতাস রেখার জাল পেতে ধরছে যখন, তখন আকাশের এবং মাটির সম্পর্কে এসে সুন্দর ঠেকছে তার আঁকা বাঁকা টানটোন, কিন্তু কাঠুরে যখন তাকে কেটে ধরে এনেছে তখন দেখা গেল ধরিত্রী ও আকাশের সঙ্গে যে সম্বন্ধটি নিয়ে শুকনে গাছের আঁকা বাঁকা রেখাজাল সুন্দর ঠেকছিল সে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হ’য়ে গাছটি বিশ্রী হ’য়ে গেছে। বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন যে হতশ্রী গাছ তাকে জ্বালানি কাঠ করে কেউ আর কেউ বা সেই কাঠের টুকরো সমস্ত নিয়ে তাদের নতুন করে’ গড়ন দেয়, তখন আবার রূপ-লোকে তাদের স্থান হয়, রূপ-রেখার মন্ত্রবলে একখানা জ্বালানি কাঠ একটা ভাঙ্গা পাথর একটুকরো যেমন-তেমন কাগজ রূপে ও রসে ভর্তি হ’য়ে নতুন প্রাণ পেয়ে যায়।

 রেখা নিরূপিত করে’ দিলে যাকে আঁকা হবে তার স্থানটি চিত্রপটে, ডৌল দিলে রেখা, সুনির্দিষ্ট ভঙ্গি দিলে রেখা,—এক কথায় রূপের পত্তন দিলে রেখা। ঘর বাড়ি টেবেল চৌকি এদের পত্তন দিতে হ’ল সুনির্দিষ্ট সমস্ত রেখা দিয়ে; কোথাও কসি—সে কসে বাঁধলে, কোথাও দাঁড়ি—দাঁড়িয়ে পাহারা দিলে রূপকে ধরে’ রাখতে। এই ভাবের বন্ধনী-রেখা সমস্ত যা রূপদক্ষের হাতের কাছে হাজির রইলো তারা সকলেই ভৃত্যের মতো—তালপাতার লেখা ছবি পাথরের ফলক এবং নানাধাতুতে নকাসীর কায করতে কাযে এল; এই সব স্থির রেখা পাহার দিলে রূপকে, যেমন খাতার রুল টানা অংশ লেখাকে আঁকতে দেয় না বাঁকতে দেয় না তেমনি এই সব বাঁধা রেখা ধরে’ থাকলো শক্ত করে’ নানা রূপ। শ্রমজাত যে সমস্ত শিল্প তাতে রেখার বাঁধুনী প্রধান হয়ে উঠলো, কিন্তু মানুষের মানস থেকে জাত হ’ল যখন, তখন এ ধরণের রেখা নিয়ে কায চল্লো না, রেখাকে রূপের মধ্যে মেলাতে হ’ল, রঙের তলায় তলাতে হ’ল—এতে ওতে তাতে একত্রে গাঁথা হ’ল। ভাল পাথরের মূর্তি সেখানে রেখা কি সুন্দরভাবে একদিকে বাতাসে মিলিয়ে অন্যদিকে রূপটির ডৌলের সঙ্গে ওতপ্রোত হ’য়ে আছে দেখ। এই যে রেখার সংযোগ রঙের সঙ্গে রূপের সঙ্গে—এর রহস্য রূপদক্ষ জানলে, কারিগর সে তো জানলে না, তাই দুটো থাক হ’ল দুই রকমের শিল্পীর মধ্যে। কারিগর সুনির্দিষ্ট প্রকট রেখা দিয়ে বাঁধলে রূপকে যেন বিনিসূতোর হারে। গাড়ীর চাকায় যে রেখাগুলি দাগলে সামান্য কারিগর এবং যে রেখা টানলে একজন অসামান্য রূপদক্ষ মাথার এক এক গাছি চুলের টান দেখাতে—এই দুই রকমের টান থেকে পরিখা-রেখা আর রূপ-রেখার তফাৎটা বুঝি।

 খোন্তা দিয়ে খুঁড়ে চল্লো নানা রেখা মানুষ—যুগের পর যুগ গেল রূপের সঙ্গে মিলতে পারলে না সে সব রেখা—রূপের গায়ে গায়ে থাকে কিন্তু রূপের সঙ্গে এক হ’য়ে যেতে পারে না। বৃষ্টির ধারা যেমন এক হ’য়ে মেলে বর্ষার মেঘ বাতাস আলো ছায়ার সঙ্গে, সে ভাবে মিলতে পারে না—টেলিগ্রাফের তার থেকে লট্‌কানো ঘুড়ির সূতোর মতো ঘরের কোণে ঝুলের মতো ঝুলতে থাকে রূপকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। খোন্তা ফেলে’ মানুষ তুলি ধরলে—যে তুলি রূপকেও টানে রেখাকেও টানে রঙকেও টানে, মানুষের মনের কথা রূপ-রেখায় ব্যক্ত হ’ল চিত্রপটে; চারিদিকের আলো বাতাসের সঙ্গে পাথরের মূর্তির গায়ের রেখাগুলি মেলাবার অস্ত্র এবং মন্ত্র পেয়ে গেল মানুষ,—পাষাণ তখন তরল ভাষায় ব্যক্ত করলে মানুষের মনের ছবি। এমনি সঙ্গীতে ও ভাষায় সুর বার করলে মানুষ সাতটা, কথা বার করলে অসংখ্য, কিন্তু মেলাতে পারলে না কতকাল ধরে’ কথাকে সুরকে সঙ্গীতে; সুর রইলো আকাশে ভেসে শকুনের মতো, কথা পড়ে’ রইলো মাঠে, সুর শুধু কথার গায়ে আপনার কালো ছায়াটা বুলিয়ে যেতে লাগলো। নক্সা করতে মানুষ অনেক অনেক রেখা সন্ধান করে’ বার করে’ আনলে—যে রেখা জেগে দাঁড়িয়ে আছে, যে রেখা ঘুমিয়ে আছে সটান অঘোরে, যে রেখা আলুথালু বেশে কাঁদছে, যে রেখা শিউরে উঠেছে ভয়ে, যে রেখা দুলে উঠেছে আনন্দে, যে রেখা নুয়ে পড়েছে ভাবের হাওয়ায়, যে রেখা ঢেউয়ে চলেছে তালে তালে—এমনি কত কি রেখা যার অন্ত নেই। এরা সবাই মিলে রূপকে ঘিরে’ দাঁড়ালো সকোণ নিষ্কোণ নানা ভঙ্গিতে, রূপের পেয়ালার গায়ে গায়ে এরা ছায়া ফেলে’ অলকা তিলকার মতো থাকলে কারিগরের দ্বারা, রূপ ও রেখার মিলন ব্যাপার এই পর্যন্ত এসে থামলো। রূপদক্ষ দেখে বল্লেন “এহ বাহ্য”, রূপ যে পিঠে বইতে থাকলে রেখাকে, একি হ’ল! গোণা যায় না এত রেখা, রূপের বাঁশী শুনে মুগ্ধ তারা সখীর মতো ঘিরলো রূপকে এ এক শোভা, কিন্তু রূপদক্ষ বল্লেন “এহ বাহ্য”, রূপের সঙ্গে একাত্মা হ’য়ে এরা মিল্লো কই? রূপের সঙ্গে মিলতে পারে যে রেখা তাকে খুঁজতে চল্লো মানুষ, যুগ যুগ ধরে’ সাধনার ফলে পেলে মানুষ রূপ-রেখার দেখা প্রতিপদের চাঁদের মতো যার রূপ।