বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/স্মৃতি ও শক্তি
“অন্তর বজে তো যন্তর বজে”। মনে বাজলে যে সুর যে রূপ তারি ছন্দ ছাঁদ পেয়ে যন্ত্রীর যন্ত্র বাজলো, রাগ রাগিণীর রঙ ও রূপ ধরে’। অহোরাত্র মনে রাখা অথবা না রাখার ক্রিয়া চলেছে আমাদের মধ্যে। এখানে একটা লাইব্রেরী তো আছে, তার বইয়ের সংখ্যা কত কেবল লাইব্রেরিয়ান জানেন, হয়তো দপ্তরী সেও শুনে’ শুনে’ মুখস্থ’ করে’ নিয়েছে। এই যেমন বইগুলোর সংখ্যার সঙ্গে পরিচয় আর যেমন তাদের বিষয় নাম ইত্যাদি, তাদের রাখার স্থানের হিসেব ইত্যাদিরও মোটামুটি আন্দাজ—সেই ভাবের পরিচয় নানা রূপের সঙ্গে মানুষ করে’ চলে সারা জীবন ধরে’। কিছুর সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ ভাবে হ’ল, স্মৃতি রইলো মনে ধরা পরিষ্কার কি আবছায়া কিংবা জলের রেখার মতো অস্থায়িভাবে।
আনন্দের ব্যাপার, দুঃখের ব্যাপার, কাযের ব্যাপার, এবং নানা বাজে ব্যাপার নিয়ে একরাশ স্মৃতি—যেন নানা বিষয়ের বই একটা লাইব্রেরীতে। এর মধ্যে কতকগুলো ব্যাপার বিজ্ঞাপন নোটিস দৈনিক ঘটনার সঙ্গে মনের একটা কোণে জমা হ’তে থাকলো, কতক চিরকুট কাগজের মতো যেমন এল তেমনি গেল, ধরা রইলো না মনের ফাইলে গাঁথা হয়ে। এমন লোক যথেষ্ট দেখতে পাওয়া যায় যারা খুব চেনা মানুষের ছবি দেখেও মোটেই ধরতে পারে না ছবিটা কার। আঁকা ছবির কথা ছেড়ে দিই, ধর জগন্নাথের মন্দিরের একটা ফটোগ্রাফ,—একজন যে শ্রীক্ষেত্র করে’ এসেছে তাকে ফটোখানা দেখাও, বুঝতেই পারবে না সে দৃশ্যটা কোথাকার, সেটা যে একটা স্থানের চিত্র এ বিষয়টাও বোঝে না, একটা হেঁয়ালীর মতো ঠেকে তার কাছে চিত্র মাত্রেই। গাছ দেখে’ যে বলতে পারে গাছ, সে গাছের ছবিকে দেখে’ গাছই যে বলবে এমন কথা নেই। ছবি দেখতে অভ্যস্ত নয় এমন চোখের পরীক্ষা ঘরের দাসী চাকর বেহারা এমন কি ভদ্রলোকদেরও অনেককে নিয়ে করে’ দেখতে পারো। এই তো গেল সহজ দেখার বেলায়, তারপর নিরীক্ষণ করে’ দেখা, মন দিয়ে দেখা, ভালবেসে দেখা ইত্যাদি নানা রকম দেখার হিসেব আছে যা অনেকের কাছে একেবারেই ধরা নেই।
এই যে সেনেট হাউসে এলেম, কিন্তু আসার পথে কি দেখলেম, কি কি ঘটনা, কোন্ কোন্ মুখ—তার কারো মনে আছে হয়তো একজন বন্ধু গেছে পাশ দিয়ে তারি একটুখানি, নয়তো কেউ মটর চাপা পড়ছিল তার একটু, কিংবা একটা বরাত চলছিল তারই ঝক্মক্ ঝম্ঝম্ এমনি খানিক—যেগুলো জোর করে’ মনের মধ্যে এল তাদেরই একটু ছাপ রইলো মানসপটে, তার বেশি একটুও নয়।
কাল কি দিয়ে ভাত খেয়েছি মনে পড়ে, কিন্তু পরশুর কথা মুছে’ যায় মন থেকে যদি না সেদিন একটা বিশেষ রকম ভোজ খেয়ে থাকি। বড় ভোজের সন্দেশ কেমন, দই কেমন, রান্না কেমন, কে কে খেতে বসলেন, কি কি কথা হ’ল তার অনেকখানিই মনে রইলো।
চোখ নিরীক্ষণ করে’ দেখলে একটা কিছু, তার আকার প্রকার ধরা রইলো মনে, চোখের সঙ্গে মনও দেখলে—না হ’লে দেখাই হ’ল না, চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল রূপটি। মন দিয়ে অভিনিবিষ্ট হ’ল মানুষ কিছুতে—ধারণা হ’ল তবে সম্পূর্ণরূপে পদার্থটির বা বিষয়টির।
অনেকবার এককে দেখার ফলে মানুষ না দেখে’ তাকে আঁকতে, না বই খুলে’ তার কথা মুখস্থ বলতে, নির্ভুল করে’ নামতা তাড়াতাড়ি বলতে, অঙ্ক এবং অঙ্কন করতে বেশ সক্ষম হ’য়ে ওঠে। এই ভাবের রূপচর্চায় রচনা করার মাল মসলা যথেষ্ট দখল হয়, কিন্তু রচনাশক্তি পাওয়া হয় একথা বলা চলে না। অদ্ভুত শক্তিবলে বেদ বেদান্ত ইতিহাস পুরাণ সবই একজন না হয় মুখস্থ রাখলে, কিন্তু সেইটুকু হ’লেই কথক হয় না তো কেউ, কবি হয় না তো কেউ! মুখস্থ বিদ্যে কণ্ঠস্থ সরস্বতী নিয়ে অনেকখানি বিস্ময়কর ব্যাপার করেও দেখানো যায়, একভাবের দক্ষতাও প্রকাশ করা হয়, কিন্তু প্রবন্ধ করে’ কিছু বলা, ছন্দে-বন্ধে কিছু বলা লেখা—এ সবের দক্ষতা অন্য পথে লাভ করে মানুষ। মনঃকল্পিত যা কিছু তার প্রকাশ মুখ্যতঃ মানুষের কল্পনা ও স্মৃতিশক্তির উপরে নির্ভর করে। এককে ঘিরে’ ঘিরে’ স্মৃতি ঘোরে ফেরে, কল্পনা অনেককে ধরে’ ধরে’ উধাও হ’য়ে চলে। একের স্মৃতি কল্পনার শতদলে ধরা—এই হ’ল রূপদক্ষের রূপকর্মের উদ্দেশ্য।
ফটোগ্রাফ যন্ত্র তার তো কোনো কিছু কল্পনা করার শক্তি নেই, সে শুধু আকার মাত্র পুনরুক্তি করে’ চলে হাজার দু’হাজার বার—যেভাবে নামতা বলে ছেলে। আর কবি যখন তাঁর মনের একটি কিছুর কথা বলছেন তখন নানা কল্পনা নানা জল্পনা নানা বর্ণনা ধরে’ ধরে’ ফুটছে সেখানে মনে ধরা স্মৃতি।
রূপদক্ষ মাত্রেরই মধ্যে প্রখর স্মরণশক্তি কায করছে দেখা যায়—“The great writer is one who has profusion of words at his command, together with a great stock of observation.” এখন একটা কথা হচ্ছে এই যে, স্মৃতির ভাণ্ডারে না হয় নানা জিনিষ সংগ্রহই হ’ল, কিন্তু সেগুলো কি ভাবে কাযে খাটানো গেল তারি উপরে সমস্তটা নির্ভর করছে। জমা টাকা অনেক রইলো কিন্তু ভোগে এল না মানুষটির এমন ঘটনা বিরল নয়, কিংবা জমা টাকা অপচয় হ’য়ে পাঁচ ভূতের পেট ভরালে এও হয়। এইখানে রূপদক্ষের দক্ষতার কথা ওঠে—কথা বেছে বেছে নেবার, ভাব বেছে নেবার। এইজন্য অলঙ্কারশাস্ত্রে শক্তির কথা বলেই নিপুণতার কথা বল্লেন পণ্ডিতেরা—শক্তি নিপুণতা অবেক্ষণ শিক্ষা অভ্যাস এমনি পরে পরে বলা হ’ল।
একটা শক্তি যা রূপ-রচনার বিশেষ সহায় হয় তা হচ্ছে এই অভ্যাস। চলার অভ্যাস যার আছে সে সহজে স্বচ্ছন্দ গতি পেলে, লেখার অভ্যাস যার আছে, ছবি লেখার মূর্তি কাটার নানা কৌশল যার অভ্যাস আছে, সে রচনা সহজে নিম্পন্ন করলে। হাত পা সব থাকতেও অচল থাকি শুধু চলার অভ্যাস নেই বলেই। অক্লান্ত ভাবে নানা শক্তি একটা ছবি কি একটা কবিতার রচনার বেলায় প্রয়োগ করতে হয় রূপদক্ষকে। এর সব শক্তিগুলোই বহু সাধনাসাপেক্ষ কিন্তু এমন আস্তে আস্তে নিজের অজ্ঞাতে রূপদক্ষ মানুষ এই সব শক্তি অর্জন ও প্রয়োগ করে’ চলেন যে রচনা যেন স্বতঃক্ষত হ’য়ে ওঠে। কষ্টকল্পিত রচনা এবং সহজ রচনা দুটো পাশাপাশি রাখলেই কোন্ খানে রচয়িত নিজের শক্তি প্রয়োগ বিষয়ে বেশ একটু সজাগ এবং কোন্ খানে তিনি একেবারেই তা নন, এটা ধরা পড়ে। ইঞ্জিন যখন চলে তখন শক্তি বিষয়ে সজাগ একটা দৈত্যের মতো চলে, আর নৌকো যখন চলে পাল ভরে বাতাসের প্রচণ্ড শক্তিকে ধরে’ চলে সে, কিন্তু দেখে মনে হয় যেন স্রোতের উপর আপনার সবখানি এলিয়ে দিয়ে ভেসে চলেছে। ঝড়ের বাতাস জানলা দরজায় ঝাঁকানি দিয়ে বলে, শক্তি কাকে বলে দেখ। দক্ষিণ বাতাস দিকে দিকে ফুল পাতার মধ্যে এমন গোপনে নিজের দিগ্বিজয়ের ইতিহাস ধরে’ যায় যে সকালে উঠে দেখি ফুল যেন আপনি ফুটে উঠলো আপনার কথা বলতে, পাতা সব সবুজ হ’য়ে উঠলো আপনা আপনি। অথচ কি প্রচণ্ড শক্তির প্রেরণা বসন্ত ঋতুর মধ্য দিয়ে পৌঁছয় গাছের শিকড় থেকে গাছের আগার ফুলের কুঁড়ির প্রতি পাপড়িতে তার একটু আভাস পাওয়া যায় বায়স্কোপের ফুল ফোটার নানা ব্যাপার লক্ষ্য করলে। আমরা শুধু চোখে ফুল ফোটার সবটা তো দেখতে পাইনে, ধরতেও পারিনে যে একটা ফুলের পাপড়ি কেমন করে’ বিকাশ-শক্তির তাড়নায় আলোর দিকে বন্ধ চোখ মেলছে, কিন্তু একটা কল প্রচণ্ড শক্তির সমস্ত ঘূর্ণন নিয়ে মূর্তিমান করে’ ধরে যখন ব্যাপারটা আমাদের চোখে, তখন ফুলের স্বতঃস্ফূর্ত ভাব সেখানে দেখি না, কেবল ফুলটির বিস্ময়কর বিপুল শক্তির গতিবিধি লক্ষ্য করে’ অবাক হ’য়ে থাকি। মানুষের রচনাতেও এই শ্রেণীর কাযের ধারা লক্ষ্য করা যায়।
কবিতা সঙ্গীত ছবি যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত নয়, কিন্তু যন্ত্রশক্তির পরিচয় দিয়েই বিস্ময় জন্মায়, সেখানে মন অভিভূত হ’ল। কালোয়াতের গানে প্রায়ই এই যন্ত্রশক্তির ব্যাপার সুস্পষ্ট হ’য়ে ওঠে এবং গীতটা মাধুর্য হারিয়ে বসে খানিক শোনার পরেই। অনেক কবিতাও দেখি যার বাঁধুনি চমৎকৃত করে, কিন্তু মন টানে না। এই তাক্ বনিয়ে দেওয়া শক্তির কায, স্মৃতির নয়। স্মৃতিসভায় গেলেই দেখা যায়, কেউ কবিতা কেউ বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতাদের তাক্ বনিয়ে চলে’ গেল, আবার একজন হয়তো মানুষটির স্মৃতি পরিষ্কার করে’ মনোহর করে’ দু কথায় ধরে’ দিয়ে গেল মনে। যার সঙ্গে যার স্মৃতি তার সঙ্গে সেই স্মৃতিটুকু মধুর করে’ নানা কথায় নানা ভাবে ফলিয়ে মনে ধরানোর শক্তি ধরা আছে।
মানুষের সব রচনাকে মোটামুটি দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা চলে; একটা হ’ল শক্তিমন্ত আর একটা হ’ল শ্রীমন্ত রচনা। শক্তিমন্ত রচনা তারও অবশ্য শ্রী আছে এবং শ্রীমন্ত রচনা তারও মধ্যে শক্তি যে নেই তা নয়; যেমন রূপবান এবং রূপসী বলতে ভিন্ন বুঝি, তেমনি এখানে শক্তিমন্ত রচনায় একটা পুরুষভাব আর শ্রীমন্ত রচনায় একটা সুকুমার ভাব লক্ষ্য হয় বলেই দুটো আলাদা ঠেকে।
মানুষ যখন তার বাইয়ের কোন শক্তিকে বাধা দিতে চেয়ে কিংবা নিজেরই গঠনশক্তি ধীশক্তি ইত্যাদির পরিচয় দিতে চেয়ে রচনা করলে কিছু, তখন সেই কায শক্তির পরিচয় না দিয়ে থাকতে পারে না, যেমন, চীনের প্রাচীর, ঈজিপ্টের পিরামিড, একটা যুদ্ধজাহাজ, একজোড়া গোরার বুট,—এর সব কেউ শক্ত, কেউ পোক্ত, মানুষের স্মৃতিক্ষেত্রের ফসল এরা নয়, এরা শক্তির শক্ত মাটি ও পাথরের সন্তান—যদি কোন স্মৃতি এদের সঙ্গে জড়ানো থাকে তাও শক্তিমন্ত রূপের স্মৃতি। জগদ্দল পাথরের স্তূপের স্মৃতি শক্ত করে’ চাপা দিয়েছে ঈজিপ্টের রাজারাণীর শ্রী ও স্মৃতির সৌন্দর্য, প্রকাণ্ড বিপুলকায় শক্ত চামড়া মোড়া অজগর যেন কত কালের কোন্ একটা যক্ষের ধনভাণ্ডারের প্রহরী,—এই তো হ’ল চীনের প্রাচীরের শক্ত রূপ! যুদ্ধজাহাজ সব দেখি আগাগোড়া শুধু ইস্পাত আর শক্তি দিয়ে সাজানো, বৃহৎ বিরাট শক্তির প্রাচুর্য এদের কল্পনায়। তাজবিবির কবর, মন্দিরের গোপুর ও প্রাচীর সেখানেও শক্তিমান শিল্পীরা কায করছে, কিন্তু সে কায তাদের মনে ধরা নানা স্মৃতি দিয়ে গড়ে’ গেছে সুকুমার স্বপ্নমণ্ডিত করে। চীনের ফুলদানি—বড় কম শক্তির দরকার নয় সেটা গড়তে, কিন্তু ফুলের স্মৃতি ফলের স্মৃতি ধরে’ শ্রীমণ্ডিত হ’ল। একটি লোহার চিমটে কোন্ একটা পাখীর স্মৃতি ধরলে কে জানে! একখানি বাঁকা তলোয়ার—সে দ্বিতীয়ার চন্দ্রকলার মনোহরণ স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া আর কি! একটা লোহার বেড়ি—কিন্তু ফুলের ফাঁস কি বাহুপাশ বলে’ তাকে ভুল ক্কচিৎ হয়, হাতুড়ি সেখানে শক্তি শক্ত হয়ে বসেছে, শাবল আর সূঁচ একটা সবল আর একটা সবলের স্মৃতির অবশেষ ঝিক্ ঝিক্ করছে শরতের জলধারার প্রায়। ঝরণা পাথর ঠেলে’ চলে এত শক্তি তার, কিন্তু সে আনে স্মৃতি—ফুলের মঞ্জরীর চাঁদের আলোর সাদা একখানি সাড়ির এমনি কত কি’র। স্মৃতির আবরু ঢাকলে গঠনশক্তি— শক্ত করে’ বাঁধা কঙ্কালের কথা মনে রাখে না কেউ, রাখতে চায়ও না, কঙ্কাল ঢেকে যেটুকু স্মৃতির ঘোমটা তারি কথা মনে রাখলে সবাই। গ্রীক শিল্পের একটা বীরমূর্তি আর একটা কুস্তিগীরের ফটো—দুটোর প্রথমটাকে কারিগর ভীমকান্ত রূপ দিলে অদ্ভুত কৌশলে, আর ফটোগ্রাফ সে শক্ত রূপটাই দেখিয়ে চুকলো। যেমন ভিতরের কঙ্কাল তেমনি বাইররে আকৃতির কঙ্কাল মাত্র পেলেম ফটোতে, ফটোযন্ত্রের স্মৃতিশক্তি কল্পনাশক্তি তো নেই যে ছবি দেবে! লাবণ্যের আবরণ পড়ছে শক্ত পাহাড়ের উপরে যেমন, সেইভাবেই স্মৃতির আবরণ সৌকুমার্য দিচ্ছে দেখি মানুষের রূপ-রচনায়। একেই বলেছেন শাস্ত্রকার—নিপুণতা, শক্তি গোপনের নিপুণতা, রচনাটিকে শক্ত হ’য়ে না উঠতে দেওয়ার নিপুণতা।
চাঁদের যে মণ্ডল আর লোহার কলের চাকার যে মণ্ডল—এই দুয়ের মধ্যে একটা শক্ত অন্যটা সুকুমার। সকালের সূর্য আলোর সৌকুমার্যে ঢাকা দিলে আপনার তেজ ও শক্তির ইতিহাস; সকালে ফোটা সূর্যমুখী ফুল তাকেও এই হিসেব দিয়ে রচেছেন বিশ্বশিল্পী কিন্তু একটা মোমের ফুলের রচনা শক্তি ধরে’ হ’ল! কোর্টের পেয়াদা যখন সূর্যের মতো লাল গালার শিলমোহর ছেপে যায় বাড়ির দুয়োরে, সেটাকে তে রূপসৃষ্টি বলে ভুল হয় না—সে আইনের নিছক শক্তিকেই প্রকাশ করতে থাকে রক্ত বর্ণ নিয়ে, কিন্তু একখানি সুন্দর করে’ গড়া তাম্রশাসন—সেখানে শাসন-শক্তি ঠেলে’ দেখা দেয় জিনিষটির সৌন্দর্য। একটা প্রাচীন মুদ্রা—সেখানেও এই হিসেব কাযের কথা ঢেকে দিতে সেখানে অনেকখানি কারিগরি। কিন্তু এই আজকের কালে আমাদের বাজারে চলতি যে এক টাকার নোট আধুলী সিকি দুয়ানি, এদের তে রূপসৃষ্টির হিসেবেই গড়ন দেওয়া হয়, কিন্তু রাজশক্তির শিলমোহরের ছাপ পেয়ে এরা কাযের উপযুক্ত হ’ল, বাজে ঠিক, কিন্তু বাজে কায ওর মধ্যে যতটা সম্ভব কম রইলো। পুরোনো টাকা দেখতে হ’ল সুন্দর, কিন্তু কতখানি বাজে সোনা তামা কাযকর্ম তার মধ্যে থাকলো তার ঠিক নেই, রাজশক্তির চেয়ে রাজ-ঐশ্বর্যের শোভা সেখানে ধরা পড়লো অনেকখানি সোনায় রূপায়। একটা বুট জুতো—যে ছয়টা ব্যাপার নিয়ে চিত্র লেখা মূর্তি গড়া কবিতা লেখা গান গাওয়া হয় তার সব কয়টাই বুটের নির্মাণে লাগলো—রূপভেদ প্রমাণ ভাবলাবণ্য সাদৃশ্য বর্ণিকাভঙ্গ কারিগরি নৈপুণ্য সবই প্রয়োগ হ’ল ওখানে, এ সত্ত্বেও জিনিষটা সুকুমার রূপসৃষ্টির অন্তর্গত হ’ল না, শক্তির পরিচয় ধরে’ শক্ত একটা কাযের জিনিষ হ’ল; আর সেদিন ঈজিপ্টের এক রাজার পায়ের দুপাটি চটিজুতোর ছবি দেখলেম, কারিগর কি সৌকুমার্য দিয়েই জুতোপাটি গড়েছে—কত স্মৃতি তাতে ধরেছে, সুন্দর দুখানি পায়ের ভূষণ—কাযের জুতো নয়—ধূলো আর পায়ের মাঝে দুখানি লঘুভার যেন পদ্মের পাপড়ি, একটা কবিতা, একটা গানও বল্লে বলা যায় জুতোপাটিকে। রূপসৃষ্টির নিয়ম ধরে’ গড়া হ’ল অথচ এই যে দুটো জুতো দু’রকম ভাব জানালে, এই যে একটা কেল্লার প্রাচীর আর মন্দির বা রাজপ্রাসাদের গোপুর দুটো একই স্থাপত্য বিদ্যার বলে তৈরী হ’ল, অথচ দিলে দু’রকম রস মানুষের মনে এবং রূপও দেখালে দু’রকম—এর রহস্য কোন্ খানে? চীনের রাজার অর্থাভাব হয়েছিল, সেই কারণে চীনের প্রাচীর তাজমহলের প্রাচীরটার মতো সুন্দর হ’ল না, কঠোর শক্ত রূপ ধরে’ রইলো, অথবা চীনের কারিগর ভারতবর্ষের কারিগরের চেয়ে গেঁথে তুলতে কম ওস্তাদ ছিল বলে এমনটা হ’ল—এ কথাই নয়, মানুষের ইচ্ছা কোন পথ ধরলে কায করার বেলায়, সে শক্তি দিয়ে আর একটা শক্তি-বেগ প্রতিহত করতে চাইলে, অথবা নিজের মনে-ধরা স্মৃতির মাধুরী দিয়ে পাষাণ গলাতে চাইলে—এই নিয়ে তফাৎ হ’ল দুটো রচনায়। আগুন যখন আতস বাজিতে লাগালেম, তখন আকাশ থেকে আগুনের পুষ্পবৃষ্টি ঝরে’ পড়লো, আবার আগুন যখন কামানের বারুদে দিলেম তখন একটা প্রাণঘাতী বিরাট শক্তির আবির্ভাব হ’ল। আতস বাজি যে আবিষ্কার করেছিল, সে তার স্মৃতিকে আগুনের ফুল দিয়ে বরণ করবে এই তার মনে ছিল; আর যে কামান রচনা করলে, সে মনে রেখেছিল দূর থেকে বিরাট শক্তিকে অন্যের উপরে নিক্ষেপ করার শক্তির ভাবনা। মানুষের প্রতিভার প্রেরণায় তার যত কিছু শক্তি সমস্তই চালিত হ’য়ে এই দুই পথ ধরে শক্তিরূপ ও স্মৃতিরূপ পেয়ে চলেছে ভাষা সুর রঙ রেখা নাট্যভঙ্গি এমনি নানা উপাদানের সাহায্যে।
ছেলেদের মধ্যে দেখি একটা দুটো খেলুড়ে থাকে তারাই খেলার সর্দার, অন্য ছেলেরা তার দেখাদেখি খেলে। এই যে খেলুড়ে সর্দার এ প্রতিভাবান, সারাদিন ধরে’ নানা খেলা কল্পনা করে’ চলে, খেলার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এই রকম বয়স্কের মধ্যেও দু’একজন দেখা দেয় রচয়িতা লোক—রূপবিষয়ে এদেরই বলা যায় রূপদক্ষ, এর কথা দিয়ে সুর দিয়ে রঙ রেখা ইত্যাদি দিয়ে রূপ ফোটায়, রচনার অপূর্ব কৌশল সমস্ত আবিষ্কার করে’ চলে, নতুন নতুন সব রূপসৃষ্টি নিয়ে যেন খেলে’ চলে।
ছেলেখেলায় থাকে ছেলেটির অফুরন্ত কল্পনা, নতুন নতুন সমস্ত খেলার রূপ সে রচনা করে’ চলে কোন একটা পুর্বেকার খেলার স্মৃতি ধরে’, ছেলে যে খেলে’ চল্লো সব সময়ে তা নয়, অপরূপ সমস্ত ব্যাপার কল্পনার দ্বারায় মূর্তিমান করে’ তুল্লে ছেলে। রূপদক্ষের মধ্যেও এই রকমের প্রবৃত্তি প্রবৃত্ত করায় তাকে নতুন নতুন সৃষ্টি করার দিকে। অসামান্য শক্তি পেয়ে রূপদক্ষ সে রূপকল্পনায় দক্ষ হ’ল, আর যে, মানুষটি শুধু সামান্য রূপ দখল করলে, রূপ কল্পনা করতে পারলে না—যেমন হাতী যেমন ঘোড়া যেমন মানুষ যেমন গাছ তেমনিই দেখিয়ে চল্লো,—সে হ’ল সামান্য রূপকমী। সঙ্গীত এবং হরবোলার বুলি—স্বরের রূপ দুজন দুরকমে দিয়ে গেল,—একজন অসামান্যভাবে আর একজন সামান্য রকমে এমনি লেখার বেলায় কথা বলার বেলায় সামান্য অসামান্য ভেদাভেদ হ’ল রূপকল্পনার ক্ষমতা এবং রূপকল্পনা করার অক্ষমতার দিক দিয়ে। কবি তাঁর একটা রূপকল্পনা আর যার কাছে শুধু কবিতা লেখার হিসেব আছে কিন্তু যে শক্তি নিয়ে মানুষ রূপকর্মে দক্ষতা পায় তা মোটেই নেই, এমন দুইজনের দুটি রচনা পাশাপাশি ধরলেই এক রূপকর্মের অসামান্যতা ও অন্যের সামান্যতা ধরা পড়ে। জলতরঙ্গ আনাড়ির হাতে বাজলো অর্থাৎ জলতরঙ্গের সঙ্গে মানুষটির নাড়ির সম্বন্ধ নেই, শুধু হাতের কৌশলের সম্বন্ধ রইলো এবং জলতরঙ্গ গুণীর হাতে পড়লো—বিষম তফাৎ হ’ল দুই বাজানোর মধ্যে, যেমন তরঙ্গের রূপকল্পনা ধরা হচ্ছে এক কবির লেখায়—
(তরঙ্গবালাগণের গীত)
“মোরা তরঙ্গবালা পরি তরঙ্গমালা
তরঙ্গে অঙ্গে ভঙ্গে করি গো খেলা।
সমীরণ সঙ্গে তরঙ্গে তরঙ্গে
(খেলি) করি নানা রঙ্গে লহরী লীলা॥
শিকর সিঞ্চিত চন্দ্রমা-কিরণে
সুষমা শোভিত তটিনী-পুলিনে
কুলু কুলু তানে আকুল পরাণে
ঢালি সুধাধারা নিবারি জ্বালা।
তারকিত অম্বরে সম্বরি সরমে
বহিয়া চলেছি সাগর সঙ্গমে
সুর তরঙ্গিণী জাহ্নবী সঙ্গিনী
ফেনিল সলিল চুমিছে বেলা।”
কোন ভাল-মন্দ সমালোচনা না করে এরি পাশে আর একটি লেখা ধরি, আপনিই বুঝি কোন্টা তরঙ্গের সামান্য আর কোন্টা অসামান্য রূপকল্পনা। পূর্বেকার লেখায় যেমন দেখছি তরঙ্গ সব সাগর সঙ্গমে চলেছে, এখানেও সেই কথা বলা হচ্ছে—
“অবিনাশী দুলহা কব মিলিহৌ
আদি অন্ত কমাল॥
জল উপজী জলতী সোঁ নেহা
রটত পিয়াস পিয়াস।
সৈঁ ঠাঢ়ী বিরহিল মগ জোউঁ
প্রীতম তুমরী আশ॥
ছোড়েব গেহ নেহ লগী তুম সোঁ
ভঈ চরণ লব লীন।
তালাবেলি ঘট ভীতর
জৈসে জল বিল মীন।”
আদি নেই অন্ত নেই, অপরিসীম পরিপূর্ণতার সমুদ্র তারি সঙ্গে মিলতে চায় জীবন। জলের তরঙ্গ জলের সঙ্গেই তার প্রেম, জলের জন্য কত না তার পিয়াস, সাগর-বিরহিণী নদী সে পথ চেয়েই থাকলো—প্রিয়তমের আশাপথ। সাগরের প্রেম চেয়ে নদী ছাড়লে আপন ঘর, সাগরের ধ্যানে নদী রইলো স্বপ্নে মগ্ন, জল জল করে’ তার অন্তরের অন্তর জলহারা মীনের সমান কাতর থাকলো।
যা দেখছিলে, যাকে দেখা হয়নি, তার কল্পনা ধরে’ মন চলতে থাকে নতুন নতুন রূপ সৃষ্টি করে’, আর যাকে দেখা হ’য়ে গেল মন তার স্মৃতি বহন করে’ নতুন নতুন রস পেতে পেতে একই স্মৃতিকে নানা ভাবের মধ্যে বিচিত্র করে’ দেখে’ চলে। কল্পনার ক্রিয়া আর স্মৃতির গতি দুয়েরই কায এককে বহু করে’ দেখা,—কল্পনা দেখায় রূপের দিক দিয়ে বিভিন্ন এবং বহু, স্মৃতি দেখায় ভাবের দিক দিয়ে বিভিন্ন এবং বহু। অজ্ঞাত রূপের কল্পনা আর জ্ঞাত রূপের স্মৃতি—এই হ’ল দুই পথ রূপ-জগতের যাত্রী শক্তিমান মানুষের সামনে ধরা এবং এই দুই পথের খবর এদের কাছ থেকে পাওয়া যায়।
শিশুর জীবনে অনেকখানি পথ অজ্ঞাত, সেখানে কল্পনার অবাধ গতি দেখতে পাওয়া যায় এবং প্রত্যেক শিশু এই অজ্ঞাতকে নিজের নিজের চরিত্র ও শক্তি অনুসারে নানা বিভিন্ন মূর্তি দিয়ে চলে। বড় হ’লে মানুষের অনেক জিনিষকে জানা হ’য়ে যায়—স্মৃতি কাজ করতে থাকে তখন তার মনে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ নিজের চরিত্র ও শক্তি অনুসারে এই স্মৃতি সমস্ত নিয়ে ব্যবহার করতে থাকে এবং এই ভাবে কল্পনার সঙ্গে স্মৃতি, স্মৃতির সঙ্গে কল্পনার মেলামেশা সম্পন্ন হয় মানুষের রচনায়।
সোনার কর্ণফুল তার সঙ্গে দেখা ফুলের স্মৃতি এবং না-দেখা ফুলের রূপকল্পনা এক হ’য়ে সেটিকে সুন্দর রূপ দিলে, জলতরঙ্গ চুড়ি সেটি দেখা এবং না-দেখা নদীর রূপ একসঙ্গে মিলিয়ে দেখালে। তাবৎ অলঙ্কারশিল্পের মূলের কথা হ’ল কল্পনা এবং স্মৃতির যথাযথ মিলন।
একটা কথা আছে—কণ্ঠস্থ করা। স্মরণশক্তি এখানে বিন ভাবনা বিনা কল্পনায় নামতা কণ্ঠস্থ করিয়েই চুকলো। কোন জিনিষ দু’একবার দেখে’ ঠিকঠাক এঁকে দেওয়া গেল; এখানে স্মরণশক্তি কণ্ঠস্থ মুখস্থ করিয়ে দিয়ে থামলো। এই ভাবের স্মরণশক্তি দিয়ে ছবি লেখা কি কবিতা লেখা যায় না তো। মুখস্থ কথা, কণ্ঠস্থ সুর, করতলগত রূপ—রূপসৃষ্টির লোকে যাবার একটা একটা ধাপ সত্য, কিন্তু শুধু ধাপ নিয়ে ওঠানামা করলেই ধাপ অতিক্রম করে’ পৌছনো হ’ল, কোথাও এটা বলিনে।
যে কিছুই মনে রাখতে পারলে না, এই দেখলে শুনলে, এই ভুল্লে, তাকে কোন কিছুর সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে সে হয় চুপ করে’ থাকে নয়তে স্বকপোলকল্পিত একটা উল্টোপাল্টা জবাব দিয়ে বসে। যার প্রখর স্মরণশক্তি সে বিষয়টির যথাযথ হুবহু বিবরণ দিয়ে যায়। এই যে হুবহু দেখানে শোনানো এদের রূপসৃষ্টি তো বলা যায় না—কাক হুবহু আঁকলে, ফটোযন্ত্র ও মানুষ দুজনেরই করা হ’ল প্রায় একই রকমের এ ক্ষেত্রে, কিন্তু এই হ’লেই যে কাকের আকৃতির ছাপ পেয়েই কাগজের টুকরো একটা ছবি হয়ে রূপসৃষ্টির শ্রেণীভুক্ত হ’ল তা নয়। কাকের আকৃতির ছাপ এবং কাকের ছবি দুটি স্বতন্ত্র ব্যাপার। গান্ধার সুর একটা কোন জন্তুর ডাক থেকে নেওয়া—এটা শাস্ত্রের কথা, এবং এর মধ্যে খানিকট সত্যও আছে। এখন একজন যদি নিজের স্মরণশক্তির জোরে ঐ জানোয়ারের ডাকটুকু ঠিক মনে রেখে’ বারবার ডেকে চলে, তবে সে গান্ধার সুরই গাইলে একথা কেউ বলে না। ঠিক এই ভাবেই একটা কিছুর ছাপ যখন কাগজে ধরা গেল তখন সেটি সেই কিছুর ছবি হ’ল না, ছাপ হ’ল বলতে পারি।
এটা অট্টালিকা, এটা কুটীর, এটা সহর, এটা সহরতলী কিংবা এ অমুক ব্যক্তি, সে অমুক লোকটি—দেখে আঁকার শক্তি নিয়ে এ পর্যন্ত ধরা চল্লো। এই ভাবে যা রইলো তার কায রূপটাকে ধরে’ দেওয়া মাত্র, চিনিয়ে রাখা মাত্র, কথাটাকে ধরে’ রাখা জানিয়ে রাখা মাত্র। দরকার হ’লেই যাতে সেটাকে ঠিকঠাক পায় এই জন্যই রইলো তারা ধরা হাতের মুঠোয়, কণ্ঠে গাঁথা বা মস্তিষ্কে বন্ধ করা—ঘরে ধরা দরকারি বে-দরকারি নানা জিনিষের মতো, অভিধানে ধরা নানা কথার মতো।
অভিধানে ধরা কথা—তাই নিয়েই তো কবিতা নভেল রূপকথা সবই লেখা হয়, কিন্তু তাই বলে’ অভিধানকে রূপকথাও বলা চলে না, কবিতা নভেল কিছুই বলা চলে না। ব্যাকরণ ধরে’ কর্তাকর্ম ইত্যাদি নিয়মে কথা সাজিয়ে গেলে কিংবা ঘটনাপরম্পরার অন্তর্গত করে’ সব কথা বলেও দেখি সেটা খবরের কাগজের প্রবন্ধ হয়, সাহিত্য হয় না, রূপ-রচনা হয় না। উত্তমাধম ভাবে এক দল লোক বসিয়ে তার ফটো—সে তো একটা নিপুণভাবে লেখা চিত্রের লোক-সন্নিবেশের সমান হ’য়ে উঠতে পারে না।
কথা সুর আকৃতি স্মরণশক্তি এদের শক্ত করে’ ধরলে—তালা বন্ধ ঘরে যে ভাবে জমা টাকা ধরা থাকে লোহার বাক্সয়,—খরচের বেলায় কথা উঠলো মানুষটা কি ভাবে কেমন করে’ তা খরচ করলে! কেমন ভাবে রূপ প্রকাশিত হ’ল কথায় সুরে রঙে রেখায় নানা অঙ্গভঙ্গিতে—এইখানে এল মানুষের মন নিয়ে কথা, ভাব নিয়ে কথা, শুধু বাক্স খুল্লেম আর টাকা দিলেম তা নয়, কিসের কি মূল্য দিলেম, কোন্ কথার সুরের রঙের রেখার বা অঙ্গভঙ্গির বিনিময়ে কতখানি রস ভাব সৌন্দর্য ইত্যাদি রূপ-রচনার জন্যে পেয়ে গেলাম এ বিচার বিতর্ক ওঠে। রূপ-সংগ্রহের মুহূর্ত—সেখানে স্মরণশক্তি কায করছে, আর রূপ-রচনার মুহূর্ত—সেখানে মানুষের মনে ধরা নানা বিষয়ের নানা জিনিষের স্মৃতি কায করছে।
রাস্তায় যেতে দেখলেম একজনকে, অচেনা লোক, মনে তার কোনো স্মৃতি ধরে গেল না, কিন্তু স্মরণশক্তির দ্বারা তার চেহারা ধরা গেল আমার কাছে, বৃদ্ধ কি যুবা কি শিশু মাত্র হ’য়ে, কালো কি সুন্দর কি শ্যামবর্ণ হ’য়ে, লম্বা কি খাটো কি গোলগাল মাঝারি মানুষটি হ’য়ে রইলো সে ধরা—এর বেশি একটুও নয়। পথ চলতে হাজার হাজার রূপ-সংগ্রহের মধ্যে সেও একটা সংগ্রহ—তলিয়ে রইলো, হয়তে তার কথা মনেই পড়লো না আর। কিন্তু ঐ একজনের সঙ্গে ভাব হ’য়ে যাক, ঘরে বাইরে ওর স্মৃতি জড়িয়ে যাক মনে, তখন বুকের কৌটোয় সে যত্নে ধরা র’য়ে গেল, বিশ্বের জিনিষের যত্নে ধরা স্মৃতির সঙ্গে এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেল সে। একটি মুখের স্মৃতি—সে যে ফুলের স্মৃতি চাঁদের স্মৃতির সঙ্গে সমান হ’য়ে ওঠে, একটুখানি মুখের হাসি, একটি কথার একটু সুর—সে যে আকাশের আলো জলের কলধ্বনির সঙ্গে সমান হ’য়ে যায়, তা এই স্মৃতিশক্তির যাদুমন্ত্রে। স্মরণশক্তির মধ্যে বদ্ধ রূপ সে সসীম এবং চিরকালেরও নয়, কিন্তু স্মৃতির মধু যাকে স্পর্শ করলে সেই রূপটি জলে স্থলে আকাশে অসীম রূপের সঙ্গে কালের অতীত জিনিষ হ’য়ে দুলতে থাকলো। জগতের যে কেউ এবং যা কিছু মন বিঁধলে তারই স্মৃতি রইলো মনে, সেই স্মৃতি যখন রূপ পেতে চল্লো, তখন মনোহর পথ ধরে’ প্রকাশ করতে চল্লো আপনাকে। বড় দুঃখের সঙ্গে জড়ানো কোন স্মৃতি মনোহর, বড় সুখের সঙ্গে জড়ানো স্মৃতি সেও মনোহর, কবিতায় গানে নাট্যে নৃত্যে ছবিতে মূর্তিতে, এর অজস্র সাক্ষী ধরা রয়েছে।
তাজবিবির স্মৃতি বড় দুঃখের, কিন্তু সেটা তো একটা দুঃখের বিমলিন প্রকাশ হ’ল না, কত সুখ বিলাস কত মধুরতা কত সৌন্দর্যের স্মৃতির সঙ্গে এক হয়ে বাজলে সেই বেদনার সুর। বাঁশীর গান সকরুণ সুখের স্মৃতি দিয়ে বাজে বুকে, “রূপ দেখি আঁখি ঝুরে”—এ সব তো মিছে কথা নয়!
স্মৃতি একেরই কিন্তু ছন্দে বন্ধে নানা প্রবন্ধে বারে বারে তার কথা বলে’ শেষ করা গেল না, আর একটা কিছু স্মরণ করে’ রাখা গেল, সময় মতো সেটা উচ্চারণ করে’ দিলেম ঠিকঠাক,—এ অন্য জিনিষ।
চীনের প্রাচীর আর তাজমহল পৃথিবীতে দুই আশ্চর্য রচনা বলেই বিখ্যাত, কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে রচনা-মূহূর্তের দুটো আশ্চর্য রহস্য ধরা পড়েছে। চীনের প্রাচীরের বেলায় স্মৃতি কায করছে না। রাজশক্তি জোর হুকুম জোর তলব দিলে গঠনশক্তিকে শক্রকে বাধা দিতে প্রকাণ্ড শক্তিমান অজগরের মতো, প্রাচীর সেখানে পর্বত ঘিরে’ দেখা দিলে দুই দেশের মানুষের মধ্যে;—স্মৃতি ধরলে না মানুষ, পাথরের প্রাচীরেব শক্তিকেই ধরে’ গেল। তাজমহলে সেখানে স্মৃতির স্পর্শ অম্লান ভাবে পড়লো। বর্মার একটি মন্দিরের প্রাচীর সেও সাপের মতো আঁকা বাঁকা, কিন্তু চীনের প্রাচীরের মতো শক্ত ব্যাপার নয়, কোন কালের রূপকল্পনা তারি স্মৃতি ঢেউ দিয়ে এল মন্দির ঘিরে নিতে। পদ্মার পুল সেখানে শক্তি এবং হয়তো বিলাতের কোন একটা শক্ত বাঁধুনির স্মৃতিও আছে একটু একটু, কিন্তু চীন দেশের বাসন্তী নদীর (Yellow river) একটি শাখার এপার ওপার এক করে’ একটা মনোহর সেতু দুই তীরের মাটির বুকের একটুখানি স্পন্দনের স্মৃতি ধরে’ প্রকাশ পেলে সুন্দর বাঁকা নিয়ে, তার সঙ্গে তুলনায় পদ্মার ব্রিজে শক্তি ছাড়া আর কিছুই নেই বল্লেও চলে, কিন্তু রূপদক্ষ এই পদ্মা ব্রিজ আঁকুক স্মৃতির মাধুরী মিশিয়ে—সে হবে একটি অপূর্ব ছবি,—ফটোগ্রাফ যা দিতে পারে না, আসল ব্রিজ যা দিতে পারে না।
রূপের সংক্ষেপ, রূপের বিস্তৃতি, এমনি নানা ব্যাপার যা রূপকর্মের অন্তর্গত—সবই নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের স্মরণশক্তি এবং স্মৃতি দ্বারা। স্মৃতির প্রেরণা না স্মরণশক্তি ধী-শক্তি এমনি নানা শক্তির প্রেরণ এই নিয়ে রচনা সমস্ত নানা শ্রেণীতে বিভক্ত হ’য়ে যাচ্ছে আপনা আপনি। রূপকর্মের খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়ে সহজ উপায়ে রূপের সঙ্গে পরিচয় করে’ নেওয়া হ’তে পারে এই স্মৃতির এবং যাকে বলতে পারি যান্ত্রিক শক্তির পথ ধরে’। যা নিজের মনে ধরা রইলো না, সে মুঠোতেই থাক গলাতেই থাক যা মাথাতেই থাক তা নিয়ে মনোহর কিছু করা মুস্কিল। আমার যা মনে ধরলো সেইটিকেই অপরের মনে ধরানোর পক্ষে কত যে বাধা তার ঠিক ঠিকানা নেই, স্থান কাল পাত্র এরা নানা বাধা নিয়ে দাঁড়ায় রসদাতা ও রস-পিপাসুর মধ্যে। রূপ-রচনার মর্ম উদ্ঘাটন সেও স্থান কাল পাত্র সাপেক্ষ হ’য়ে পড়ে—এ বিপত্তি নিবারণের উপায় তো রচয়িতার হাতে নেই, সে আছে রসিক সমালোচকদের হাতে। সমালোচনা একটা শক্তির কায, তার দ্বারা তাই সব সময়ে রসের ব্যাপারের ঠিক যাচাই হয় না, রচনার শক্ত দিকের কথাই জানিয়ে চলে সমালোচনা। স্মৃতির প্রকাশ সে পথের মতো বিকাশের পরিপূর্ণতা পেয়ে থামে, পরিমল তার বাতাস ব’য়ে আনে, যারা ফুল দেখছে না তাদের কাছে জানায় ফুল ফুটলো। রসিকের সমালোচনার শক্তি যেখানে বাতাসের পরিমল বহনের মতো কায করে, সেখানে রচনার রস বিস্তৃতি পায়, তখন রসিকের স্মৃতির সঙ্গে রচয়িতার স্মৃতির মিলনে রসভোগের বাধা সমস্ত দূর হয় এক মুহূর্তে। বাতাস একাধারে সু-কু দুয়েরই খবর দেয়, সে সংবাদ-বাহক, কিন্তু রসিক সে শক্তিধর জীব, রসের খবরই নেয় ষট্পদের মতো।
মক্ষিকার সমালোচনা সে রূপের ও রসের বিপরীত সমালোচনা। রচয়িতার ইচ্ছার সঙ্গে যেমন রচনার যোগ তেমনি মক্ষিকা ও ষট্পদ দুই সমালোচকের ইচ্ছার সঙ্গে রচনার উপভোগেরও যোগাযোগ, কাযেই একই কথা নানা রকমে বলে মানুষ এবং সেই একই কথার নানা ব্যাখ্যা দেয় মানুষ। কাল হচ্ছে সব চেয়ে বড় বিচারক এ ক্ষেত্রে, সে দেখি কোন রচনাকে স্মৃতির মধু দিয়ে অমর করে’ রাখলে, কোন কিছুকে একেবারে লোপ করে’ দিয়ে গেল।
বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এইভাবে কত জিনিষ কালে কালে স্মৃতির ও সৌন্দর্যের ভাণ্ডারে ধরা রইলো, আবার কত জিনিষ একেবারে লোপ পেয়ে গেল, তার হিসেব নিলে দেখা যায় যে, যা স্মৃতির বিষয় হ’ল সেই রইলে ধরা, আর যা তা না হ’ল সে গেল মরে’। স্মৃতি জাগিয়ে রাখার হিসেবের মধ্যে রচনার নিত্যতা এবং অনিত্যতা অনেকখানি ধরা আছে দেখি।
“মত্ত দাদুরি” এরি ডাকটুকু যদি কোন শক্তি ও কৌশলে ধরে’ কানের কাছে বাজানো যায় তবে সেটা বিষম ব্যাপার হ’য়ে ওঠে, কিন্তু বর্ষা-রাতের নানা স্মৃতির দ্বারা মধুর হ’য়ে যখন সে ডাক আসে কানে, তখন কবিতা লেখা হ’য়ে যায় দাদুরির ডাকের উপর।
“মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওয়ত ছাতিয়াঁ।”
সানায়ের পোঁ এমন কিছু মিষ্টি নয় কিন্তু স্মৃতির স্পর্শ হ’ল তাতে, তাই মধুর লাগলো।
একটা চন্দ্রোদয় কি সূর্যোদয় কি সমুদ্র কি পর্বত দেখে’ কোন একটা কবিতার দুতিন ছত্রের স্মৃতি মনে জাগে, সেখানে কবির স্মৃতি পথ খোলে একভাবে সাধারণের দর্শনের। নিজের চোখ এবং মন দিয়ে জিনিষটাকে ধরা হ’ল না এখানে; তা যদি হ’ত তো সবাই রূপদক্ষ হ’য়ে যেতে।
একই জিনিষের বর্ণনায় রচয়িতাতে রচয়িতাতে বিভিন্নতা দেখি যখন, তখন জানি রূপটিকে দুয়ের স্মৃতি দুইভাবে ধরলে। সাধারণ মানুষের বেলায় এ হয় না। তারা সবাই দেখে মাঠকে মাঠ পাহাড়কে পাহাড় সমুদ্রকে সমুদ্র মাত্র,—যেমন ভূগোলের ক্লাসের সব ছেলেই পর্বতের চিহ্নটাকে পাহাড় ছাড়া সমুদ্র বলে না। কিন্তু ওর মধ্যে একটা ছেলে যদি তার রচনাশক্তি থাকে তবে হয়তো সে পাহাড়ের চিহ্নটাকে এক সাপ বা বিছে দেখে’ ফেলে এবং মাষ্টারের ধমক খায়, সহপাঠীদেরও টিটকারি পায়, অথচ এই স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেবার ক্ষমতা রূপদক্ষের সাধনার বিষয় এ তো অস্বীকার করা চলে না।
একটা পর্বতের রূপ যে প্রকাশ-বেদনার কথা জানায়, একটি ফুলের রূপও সেই প্রকাশ-বেদনার কথা বলে। মানুষের হাতে এত বড় ভাষা নেই যে এই বেদন পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে, তাই মানুষের বুকে রূপের জন্য বেদনা বাজে, ‘রূপ দেখি আঁখি ঝুরে’। সেই বেদনার স্মৃতি বয়ে’ চলে মানুষ, সেই বেদনার কথা নানা সুরে ছন্দে নানা রঙে রেখায় ধরে’ উল্টেপাল্টে প্রকাশ করতে চায় মানুষ। রূপদক্ষ চায় মানুষ যে বেদনা ধরলে বুকে তারি স্মৃতিকে উল্টেপাল্টে নানা ভাষায় প্রকাশ করতে। রূপের অন্তরে যে বেদনা বাজছে তারি সাক্ষী রূপ রচনা। স্মৃতির করুণ স্পর্শ দিয়ে যে সমস্ত রচনা মানুষ করে’ চলে তা মধুর হ’য়ে ওঠে, মনোহর হ’য়ে ওঠে, আর শুধু রূপকে দৃষ্টিশক্তি বাক্শক্তি এই সব দিয়ে যেখানে ধরলে মানুষ সেখানে রচনাতে শক্তির পরুষ ছাপ পড়লো। রূপের সঙ্গে ভাব হ’ল তখনি, যখন রূপের বেদনার স্মৃতি রূপদক্ষের প্রাণে গিয়ে পড়লো; রূপের সবটা জয় করে’ নেওয়া হ’ল তখনি, যখন স্মৃতির বিষয় করে’ নেওয়া গেল রূপকে। মানুষের রচা তাবৎ সুকুমার শিল্প বিশ্বে ধরা রূপের সঙ্গে এই ভাবের অন্তরের সম্পর্ক পাতিয়ে বসার সাক্ষ্য দেয়।
অন্তরের সবটুকুর স্পর্শ পেয়ে কোথায় মধুর হ’য়ে ফুটলো রূপের নিবেদন, কোথায় শক্তির স্পর্শ পেয়ে রূপ সে হ’য়ে গেল স্থির নির্বাক, রূপচর্চার বেলায় এই দুই রকমের প্রকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে চলা চাই—না হ’লে দুটো রচনার রসের তারতম্য ধরা পড়ে না।
রূপ বেদনা জানাচ্ছে, আকাশ বেদনা জানাচ্ছে, বাতাস বেদনা জানাচ্ছে, জল চলেছে বেদনা জানিয়ে, মাটি কাঁপছে রঙের বেদনায়, আলোর বেদনায়। বড় মধুর এই বেদনার স্মৃতি সমস্ত—দুঃখের বেদনা, সুরের বেদনা, সুরূপের বেদনা, কুরূপের বেদনা। সবাই মিনতি জানাচ্ছে, সবাই বলছে ‘মনে রেখো মনে রেখো’। সকালে পূর্বদিক বলছে—‘আজকের প্রকাশ মনে রেখো’, সন্ধ্যার সূর্যাস্ত বলে’ যাচ্ছে—‘এই শেষ, মনে রেখো, ভুলো না, ভুলতে দিও না—এই নিবেদন’। শুকতারা আসে, সন্ধ্যাতারা আসে, ঋতুর পর ঋতু আসে মনে ধরাতে মনে পড়াতে ধরা পড়তে, মানুষের মাঝে তারা বুকের বাসা খুঁজে বেড়ায়। মানুষের মধ্যে কারো প্রাণে তারা স্থান পায় এই আশায় চেয়ে থাকে জল স্থল অন্তরীক্ষে ধরা রূপ সমস্ত। সামান্য মানুষ সন্ধ্যাতারার কথা বোঝে না, শুধু দেখে’ বলে, কি সুন্দর! কিন্তু রূপদক্ষের প্রাণে তারার কথার স্মৃতি জাগে সুর দিয়ে কথা দিয়ে—
“তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি থাকি কাছাকাছি
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি
তবু মনে রেখো।”
একথা আজকের কবি শুধু নয় প্রাচীন কবিরাও বলেছেন বার বার করে’। শ্রীরাধিকাকে দিয়ে তাঁরা মিনতি জানিয়ে দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে। এর মধ্যে দুই কথা নেই,—রূপ চাচ্ছে স্মৃতির অমৃত পরশ, স্মৃতির মধ্যে জাগতে চাচ্ছে রূপ। রসের ঝরণা বিরাট শক্তির প্রেরণা স্মৃতির মাধুর্যে ডুবিয়ে দিয়ে বইছে। স্মৃতিশক্তি হচ্ছে সোনার কাঠি, ঘুমন্ত রূপকে জাগিয়ে তোলে, লাবণ্য আনে, ভাব ভঙ্গি সবই আনে রূপে, আর শুধু রচনা-শক্তি বাচন-শক্তি তা নিয়ে রূপ কাঠামো পায় সুন্দর, ভাব ভঙ্গি সবই পায়, কিন্তু বেঁচে ওঠে না। একপাটি জুতো সে যতক্ষণ স্মৃতির স্পর্শ পেলে না ততক্ষণ জুতো মাত্র পূর্বেই বলেছি, কিন্তু এই জুতোপাটি কিংবা একটুখানি ছেঁড়া কাঁথা যখন কারু স্মৃতির স্পর্শ পেলে তখন সিণ্ডারিলার জুতো এবং আমাদের ঘরের ছেলেভোলানো ছড়ায় যে দুপাটি অপূর্ব জুতোর খবর পাই, সেই লাল জুতুয়া হ’য়ে দেখা দিলে।