বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/আর্য ও অনার্য শিল্প
আর্য ও অনার্য শিল্প
ভারতশিল্পের ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব, ছবি মূর্তি মন্দির মঠ ইত্যাদির সঠিক ছাপ ও ফটোগ্রাফ দিয়ে হাজার হাজার বই ছাপা হ’ল। চোখ এবং মন দুই নিয়ে এই বিরাট সংগ্রহের মধ্য দিয়ে চলাফের করতে করতে একটা কথা বারবার আমার মন বল্লে—কই, এ তো সম্পূর্ণ ইতিহাস পেলেম না, এ যেন একখানা পুঁথির শেষ গোটাকতক অধ্যায় মাত্র পেলেম, পূর্বের অধ্যায়গুলো হারিয়ে গেছে। চোখ চলতে চলতে বৈদিক যুগের ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে উপস্থিত হ’য়ে দেখলে সামনে হিমালয় প্রমাণ কুয়াসার প্রাচীর, তার ওপারে ভারতশিল্পের ধারা শব্দ দিয়ে ঝরছে কিন্তু দেখা নেই সে ধারার। ভারত শিল্পীদের রচনা সমস্ত ধারাবাহিক ভাবে যেমন যেমন প্রকাশ পেয়েছিল তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন তো আমাদের চোখের সামনে ধরা নেই আজ,—এখানে গোটাকতক টুকরো, ওখানে খানিক, মাঝে মাঝে মস্ত মস্ত ফাঁক,—এইভাবে দেখা দিচ্ছে সব। সুতরাং খানিকটা কল্পনার সাহায্য দরকার হ’য়ে পড়ে বিষয়টা চর্চার বেলায়। চোখের দেখা গাছের শাখা পত্র পুষ্পের মতো ভারত শিল্পকলার তিন চার যুগব্যাপী এলোমেলো ভাবে ছড়ানো প্রত্যক্ষ নিদর্শন কেবলি যদি দেখে’ চলা যায় অপ্রত্যক্ষ মূলের রহস্য বাদ দিয়ে, তাতে করে’ তার আগাগোড়া জান হ’ল বা দেখা হ’ল তা বলা তো যায় না। চোখ এবং মনকে পাঠাতে হবে সেখানে মহাকালের মধ্যে যেখানে ইতিহাসের অখ্যাত যুগের ভারতবাসী আরণ্যক ঋষিরা যাঁদের নাম দিলেন অন্যব্রত—তাঁরা কায করেছেন।
তত্ত্ব অনুসন্ধানের জায়গায় কল্পনার প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু শুধু চোখে দেখা যাচ্ছে যা, তা তো বেশী দূরে নিয়ে যেতে পারে না আমাদের। ধর, পুষ্পক রথের কথা পড়ে’ যদি সত্যিই কল্পনা করি আর্যদের পূর্বপুরুষ তাঁরা আকাশে উড়তেন তবে ভুল কল্পনা করা হয়, কিন্তু আজকের দিনে প্রত্যক্ষ হচ্ছে যে সব মন্দির মঠ তা থেকে আর্যপূর্ব জাতি কাঠ ও বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে ঘর বাঁধতেন এটা কল্পনা করা অন্যায় হয় না; কাযেই যুক্তি-সঙ্গত কল্পনার স্থান আছে তত্ত্বানুসন্ধানের বেলায়। কি শিল্পের দিক দিয়ে, কি ধর্ম-কর্মের দিক দিয়ে, আমাদের সব চিন্তা যেখানে গিয়ে ঠেকে, সেই বৈদিক যুগে গিয়ে উপস্থিত হওয়া যাক। সেখানে গিয়ে দাঁড়াই যেখানে আরণ্যক ঋষিরা যজ্ঞক্রিয়া করছেন; এই হ’ল আর্য সভ্যতার জ্ঞাত যা কিছু তার প্রাচীনতম সীমানা, এর পরেই আবছায়া —সমস্ত অন্যব্রত এবং অকর্মা বলা যায় যাঁদের, তাঁরা কল্পনা ধরে’ মনের সামনে আসা যাওয়া করেন।
যাঁদের আমরা আর্য বলছি তাঁদের ক্রিয়াকাণ্ড কেমন ছিল, তাঁদের মধ্যে কি কি শিল্প প্রচলিত ছিল, কি ভাবতেন তাঁরা, এবং কি ভাবে চলতেন তাঁরা, তার ছবি সুস্পষ্ট হ’য়ে ধরা পড়েছে আজকের কালে, জানবার বিষয় অল্পই আছে বল্লেও হয় এই আর্যগণের সম্বন্ধে। কিন্তু এই সব অন্যব্রত ও অকর্মা যাঁদের উদ্দেশ করে’ ঋষিগণ বার বার নানা মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন তাঁরা ঋষিদের মিত্র ছিলেন না এটা ঠিক। কিন্তু ভারতবর্ষের কোন্ আদিতম যুগ থেকে এই সব অন্যব্রত এবং অকর্মা আরণ্যক ঋষিদের আশে পাশে কেউ ঋষিদের অনুষ্ঠিত ব্রত থেকে স্বতন্ত্র ব্রত নিয়ে রয়েছেন, কেউ একেবারে ক্রিয়াকর্মযাগযজ্ঞহীন অবস্থায় রয়েছেন, এঁরা ভারতশিল্প চর্চার বেলায় কোন্ স্থান অধিকার করেন এসে সেটা দেখার বিষয়।
নিজেদের সঙ্গে সকল বিষয়ে ধর্মে কর্মে পৃথক যাঁরা, তাঁদের বলেছেন ঋষিরা অন্যব্রত। অকর্মা বলা হ’ল তাঁদের যাঁরা ক্রিয়াকাণ্ড-হীন জীবনযাত্রা ধরে’ রয়েছেন। অন্যব্রত—তাঁরা ব্রতধারী, কিন্তু আর্যদের সমান ব্রত পালন করছেন না—যেমন আজকের হিন্দু এবং ক্রীশ্চান দুজনেই একই আর্যজাতি, কিন্তু ব্রতের দিক দিয়ে উভয়ে উভয়ের কাছে স্বতন্ত্র ও অন্যব্রত বলে’ পরিচিত হচ্চে।
ঋষিরা যাদের বলেছেন অকর্মা, নিশ্চয়ই তাদের কোন জীবলীলার কোন চিহ্ন ধরা নেই কোথাও—তারা খেয়েছে, বেড়েছে, মার খেয়েছে ও মরেছে। তাদের ভাবনা চিন্তা ছিল নিশ্চয়, কিন্তু সেগুলো পাথরে মন্দিরে সাজে সজ্জায় নাচে গানে নিরূপিত হ’তে পেলে না। মানুষের ক্রিয়াবান অবস্থারই প্রকাশ হ’ল শিল্পকলা, অকর্মা তারা অশিল্পী, শুধু তারা বর্বরের মতো অন্যের ক্রিয়া পণ্ড করেছে। নিষ্ক্রিয় এরা সব ছায়ামূর্তির মতো কেবল বাসই করেছে ভারতবর্ষে, ভূ-ভারতের ইতিহাস গঠনের মধ্যে এদের স্থান হয়নি, জীবনব্রত-ক্রিয়ার মধ্যেও এদের আসন পড়েনি, মরার পরে এদের হাড় মাংস ভারতের মাটিকে খানিক রসিয়ে দিয়ে গেছে মাত্র। এই সমস্ত নিক্রিয় মানুষ ক্রিয়াবান অন্যব্রত এবং যাজ্ঞিক আর্যদের সঙ্গে এক সূত্রে বাঁধা এবং হয়তো আরণ্যক ঋষিদেরই পূর্বতন যুগের বর্বরাবস্থার কথা জানাচ্ছে। জন্মায় না মানুষ একেবারেই ঋষি হ’য়ে, আগে বর্বর তারপর অনেকগুলো অবস্থা অতিক্রম করে’ তবে তো আর্যাবস্থা। একই মানুষ যেমন জাগার আগে ঘুমিয়ে থাকে, আজকের ক্রিয়াকর্মে পটু ছেলে একদিনের অকর্মণ্য শিশু অবস্থায় যেমন পড়ে’ আছে দেখছি, তেমনি এই সমস্ত অকর্মা তারা যে কর্মঠ ব্রতক্রিয়াশীল অন্যব্রত এবং আর্যদের একটা আদিম অবস্থার কথা জানায় না, তাই বা কে বলবে! ঘুমন্ত, অর্ধজাগরিত এবং জাগ্রত এই তিন অবস্থা সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট, অপেক্ষাকৃত ক্রিয়াশীল এবং পরিপূর্ণ ক্রিয়াবান—এই নিয়মে সব দেশের সব মানুষই উন্নতির পথে এগিয়েছে, ভারতবর্ষের আর্যগণের বেলাতেও যে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি সেটা ধরে’ নিতে পারি। ছেলেটা অকৃতকর্মা, পড়লে না, শুনলে না, সংসার পাতলে না—আর এক ভাই সংসার পাতলে, অফিসে গেল, রোজগারী হ’ল, এবং আর এক ভাই সে প্রকাণ্ড চিন্তাশীল মহাপুরুষ ঋষি হ’য়ে বসলো। একটি পরিবারের মধ্যে সহোদরে সহোদরে এই পার্থক্য যখন স্বভাবের নিয়মে ঘটছে দেখি, তখন একই জাতির কেউ পেলে আর্য আখ্যা, কেউ পেলে অন্যব্রত, কেউবা অকর্মা দস্যু ইত্যাদি বদনাম—এতে আশ্চর্য হবার কি আছে।
জীবতত্ত্ববিদ্ যাঁরা তাঁরা মানুষের জাতিবিভাগ করেছেন মুখাকৃতি ও দৈহিক মাপজোখ দিয়ে, তাঁরা কাউকে বলেছেন আর্য, কাউকে অনার্য। সেদিক দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে যে আর্যজাতি এসে ভারতবর্ষে অনার্যদের মধ্যে বসতি করলেন এবং অনার্যদের ক্রমে সকল দিক দিয়ে জয় করে’ আর্যাবর্ত বলে’ প্রকাণ্ড একটা রাজত্ব স্থাপন করলেন। এ ঘটনার অনুরূপ ঘটনা আজও ঘটছে দেখবো,—আজকের মিশনারি তারা এই ভাবে আফ্রিকা ফিজি প্রভূতি জায়গায় ধর্মবল এবং বাহুবল নিয়ে ক্রিয়া করে’ চলেছে অকর্মা ও অন্যকর্মাদের মধ্যে; শুধু এই নয়, অপেক্ষাকৃত সুসভ্য কিন্তু অন্যব্রত অথচ একই আর্যজাতি তাদের মধ্যেও পশ্চিমের আর্য সভ্যতার দূত সমস্ত নানা ভাবে নানা ক্রিয়া করে’ চলেছে আজকের ভারতবর্ষে। এ ছাড়া আকৃতির হিসেবে দেখছি আর্য ছাঁদের মানুষ, কিন্তু বৃত্তির হিসেবে দেখছি রাক্ষস বা দস্যু এবং বুদ্ধির হিসেবে একেবারে বর্বর—এরও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পৃথিবী জোড়া আর্যদের মধ্যে আজও ছড়ানো দেখতে পাই। সুতরাং যদি বলি ভারতের মধ্যে একটা জাত আর্যব্রত, অন্যব্রত এবং অকর্মা এই তিন থাকে বিভক্ত ছিল ভারতশিল্পের উৎকর্ষের শৈশবাবস্থায়, তবে একেবারে যে অসঙ্গত কল্পনা করা হ’ল তা নয়।
আর্য যাঁরা ভারতবর্ষে বৈদিক যুগে বাস করছেন, তাঁদের মধ্যেই আমরা নানা শ্রেণীর নানা থাকে বিভক্ত মানুষ দেখি—একদল আরণ্যক, তাঁরা বনে বাস করেছেন, একদল বণিক, একদল যোদ্ধা, একদল চিকিৎসক ও যাদুকর, এঁরা সবাই একটা জাতিরই ভিন্ন ভিন্ন থাক—এঁদের মধ্যে কারিগরদেরও নাম পাই যাঁরা স্পষ্টভাবে অন্যব্রত।
হঠাৎ একদল মানুষ সিঁড়ি না ভেঙে তেতালায় উঠে’ এল, উড়োকল সৃষ্টি না করে’ উড়ে’ পড়লো আকাশে—এ অসম্ভব কল্পনা আর্টিষ্ট হ’য়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে বলা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। আর্যরা পেয়ে গেলেন এবং নিয়ে এলেন এদেশে সকল সভ্যতা, সকল বিদ্যা হঠাৎ—এ বল্লে অনেক আপদ এড়িয়ে যাওয়া চলে কিন্তু নিজের মনের কাছ থেকে খোঁচার শেষ হয় না।
আর্যজাতি বলতে মস্ত একটা দল যা পৃথিবীর অনেকখানি জুড়ে’ বসবাস করছিল। তাদের উপরে পণ্ডিতেরা নানা দিক থেকে আলো ফেলে আমাদের দেখিয়েছেন যে, যেমন এদের চেহারায় মিল তেমনি ভাষাতেও মিল—এই মিলটা ক্রিয়াবান, এবং ক্রিয়াহীনে একেবারেই লক্ষ্য করা যায় না। এ দল ব্রত করে, যজ্ঞ করে, ও-দল ব্রতভঙ্গ করে যজ্ঞনাশ করে; এ-দল গড়ে, ভাষা দিয়ে গড়ে, সুর দিয়ে গড়ে, হাত দিয়ে গড়ে, মন দিয়ে গড়ে, বুদ্ধি দিয়ে গড়ে; আর ও-দল তারা গড়তে পারে না—ছেলেরা যেমন তেমনি—কেবলি গড়া জিনিষ পেলেই ভাঙে; এর কালো ওরা সাদা। এই শেষের দলকে অকর্মা বলে’ ধরা চল্লো, কিন্তু এই আর্য এবং অন্যব্রত এদের দুটো জাত বলে’ না ধরে’ যদি একই জাতির দুটো থাক বলে’ ধরা যায়, তা হ’লে আর্য শিল্প সাহিত্য ভাষা ইত্যাদির ক্রমবিকাশ পরিষ্কার ভাবে ধরার পক্ষে অনেকখানি সুবিধা পাওয়া যায় বলে’ মনে হয়।
অকর্মা যারা ছিল তারা সাদাই থাক বা কালোই থাক কোন চিহ্ন ধরেনি নিজ নিজ কর্মের, শুধু এরা অন্যের ক্রিয়া পণ্ড করেছে—এইটুকু ঋষিদের কথা থেকে পাচ্ছি, সুতরাং এদের আর্য ও অন্যব্রতদের থেকে সম্পূর্ণ অন্য বলে’ ধরলে বিশেষ কায আটকায় না। কিন্তু অন্যব্রত অবস্থার মানুষের আচার ব্যবহার ক্রিয়াকাণ্ড সমস্তর হিসেব যা আজকের ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা সন্ধান করে’ বার করেছেন, তার সঙ্গে পৃথিবীর তাবৎ আর্যজাতির ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে মিল দেখা যাচ্ছে এবং সেই রাস্ত ধরে’ ইউরোপে যে সকল আর্যগণ বসতি করছেন তাঁদের শিল্প ধর্ম কর্ম সমস্তেরই নতুন পন্থায় চর্চা হচ্ছে, ভারতশিল্পের বেলায় এর ব্যতিক্রম করা ঠিক নয়।
আর্য বলতে একটা পদবী বোঝায়, কিন্তু এই পদবীতে উপনীত হবার আগের ধাপ যে আর্যেরা অতিক্রম করেননি, এমন তো নয়। এক সভ্যতার এক ভাবের পরিক্রম ও আন্দোলন বহু দেশ বহু জাতি বহু যুগ ধরে’ হয়েছে। আর্যাবর্ত্তের ঠিক রূপটি কি এই? না, বলব অনেকখানি বিস্তার নিয়ে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র চক্রে যা রয়েছে তার পরিণতি হ’ল একে? একটা আবর্তের দুটো গতি আছে, সে দুটি হচ্ছে বহির্মুখী এবং অন্তর্মুখী, তলিয়ে রয়েছে যেটুকু তা বিস্তার পেতে চাচ্ছে, উঠে আসতে চাচ্ছে, ছড়িয়ে রয়েছে যতখানি তা ঘূর্ণিপথে তলিয়ে চলেছে একটি দিকে। যাগযজ্ঞে ব্রতী হ’ল যারা সেই সব আরণ্যক মানুষ এবং তাদের থেকে বাইরে বাইরে নানা ব্রতধারী মানুষ—এরা হয়তো ভিন্নজাতীয়, হয়তো নয়, কিন্তু আর্যাবর্তের আগাগোড়া গঠন এরা দুয়ে মিলে’ দিলে,—তলার জল এবং উপরের জল যেভাবে রচনা করে আবর্ত, সেইভাবে কায করলে আর্যধর্ম আর্যশিল্প আর্যভাব—এক কথায় আদ্যন্ত মহাভারতের সবটা, এ যেন স্পষ্ট দেখি।
যজ্ঞাদি কর্মনিরত একটি মণ্ডলী, এরি বাইরে যারা তাদের সম্বন্ধে ঋষির বলছেন—“আমাদিগের চতুর্দিকে দস্যুজাতি আছে, তাহারা যজ্ঞ করে না, তাহারা কিছু মানে না, তাহারা মনুষ্যের মধ্যেই নয়, তাহাদের ক্রিয়া ভিন্ন রকমের। হে ইন্দ্র, তুমি তাহাদিগকে বিনাশ কর।” যারা মানতে চায় না এই সমস্ত আরণ্যক ঋষিদের ক্রিয়াকাণ্ড, হঠাৎ মনে হয় তারা সত্যিই কেউ ছিল না আর্যদের, না হ’লে এমন করে’ অভিসম্পাত? গোঁড়ার দল, তারা বৈদিক যুগেও ছিল এখনো আছে, জ্ঞাতিবিবাদ তখনো ছিল এখনো আছে, এ-দল শাপ দেয় ও-দলকে, অথচ জাতে এক তারা—এও দেখি জগতে। এমন কোনো সভ্যতা কোনো ধর্ম নেই যেখানে একে ও অন্যে বিবাদ ও মনান্তর নেই;—পণ্ডিতদের মতে আমরা আর্য, ইউরোপীয়রাও আর্য, কিন্তু ব্রত নিয়ে মারামারি তো ঠেকেনি এতে করে’। হিন্দু ব্রাহ্ম দুই দলই আর্যজাতি অথচ ব্রত এক নয়। সুতরাং আর্য ও অন্যব্রত দুটো জাতি না বলে’ একই জাতির দুটো থাক বলে’ কল্পনা করলে একেবারে ভুল যে হয় তা নয়—ক্রিয়ার দিক দিয়ে ভিন্ন, চিন্তার দিক দিয়ে উচ্চ এবং নিম্ন শ্রেণীতে বদ্ধ এ বল্লেও বলা চলে। চেহারায় চেহারায় ভিন্নতা, বর্ণে বর্ণে ভিন্নতা, ভাষায় ভাষায় ভিন্নতা প্রকৃতির নিয়মে ঘটছে দেখি, তাই দেখে’ জাতিবিভাগ স্থির করি মানুষে মানুষে; এক দেশের শিল্পে অন্য দেশের শিল্পে যে ভিন্নতা তাও এই ভাবে স্থির করতে যাই আমরা। কিন্তু এই বাহিরে বাহিরে ভিন্নতা এটা কি মানবতত্ত্বের কি মানবের শিল্পতত্ত্বের চরম কথা নয়—তাবৎ মানুষ যা নিয়ে এক, তাবৎ শিল্প আর্য অনার্য নির্বিশেষে যা নিয়ে এক, তাও চোখের এবং মনের সামনে এসে পড়ে।
আমের মঞ্জরী সকালের কুয়াসার মধ্যে রয়েছে, আম রোদের দিনে পেকে টুস্টুস করছে,—কি রসের দিক দিয়ে কি আকার-প্রকার ভাবভঙ্গি সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এরা দুটি। গুটি পোকাতে আর প্রজাপতিতে এক জাতি বলে’ কিছুতে ধরা যায়না—এ চলে মাটি আঁকড়ে, ও চলে বাতাসে আলোতে গা ভাসিয়ে, খেচরে ভূচরে যতটা তফাৎ ততটা এই একই জীবের দুই অবস্থায়। একই মানব এবং সেই মানবজাতির মধ্যে একমাত্র আর্যগণকে নিয়ে প্রকৃতিদেবী যে ওলট পালট খেলেননি এই ভাবে তা কে বলবে? মাটি হ’ল সোনা, জল হ’ল মেঘ, কাচ হ’ল হীরক, কালো হ’ল সাদা, যুগযুগান্তর বহে’ এই খেলার স্রোত চলে’ আসছে এটা তো অস্বীকার করা যায় না। আজকের সৌরজগৎ একদিন এক টুকরো নীহারিকার বাষ্প ছিল এ কথা যদি মানতে পারি, তবে আর্য শিল্পের গোড়া পত্তন আর্য্যেতর শিল্পে একথা মানতে দ্বিধা হবে কেন।
নিকৃষ্ট অবস্থা, উৎকৃষ্ট অবস্থা, আর্য অবস্থা, অনার্য অবস্থা এ বল্লে কোন গোল নেই। ছোটয় ভাষা নেই, বড়য় ভাবা আছে ছোটয় ঢেলা খেলা, বড়য় পাথরের মূর্তিকে কেটে লীলা, ছোটয় চলি চলি পা পা, বড়য় নটরাজের লাস্য ও তাণ্ডব, ছোটয় মা মা, বড়য় সা রি গা মা—এই দাঁড়ায় ব্যাপারটা। গাছের শিকড় মাটি থেকে জল টানে, ডাল সেই রসে বাড়ে, পাতা গজায়, ফল ফলায়, ফুল ফোটায়—এমনি ঘনিষ্ঠতা আর্যে অনার্যে। কেবলি আর্যগণের সম্বন্ধে নয়, আর্যেতর যাঁরা তাদেরও সঙ্গে আর্যগণ কিরূপ সম্বন্ধে বদ্ধ তারও সাক্ষ্য দিচ্ছে চতুর্বেদ। আর্য-শিল্প সাক্ষ্য দিচ্ছে আর্যেতর অরস্থার শিল্পের, আর্যচিন্তার প্রবাহ বহন করছে আর্যেতর অবস্থার চিন্তার ধারা। বেদ যদি আর্য বলে’ একটি মাত্র দলের হ’ত তো একটা বেদই হ’ত, চারখানা মিলে একটা হ’ত না। যেমন চতুর্বেদ, তেমনি চারিদিকের সভ্যতা শিল্পকলা এ সব নিয়ে এক আর্য-শিল্প। অতীতকালে আর্যেতর অবস্থাকে অস্বীকার করা অসম্ভব ছিল আর্যদের পক্ষে, কেননা তাঁরা সেই মানব সভ্যতার উৎকর্ষের প্রাতঃসন্ধ্যায় বর্তমান ছিলেন যখন নতুন আলোয় পূর্ব রাত্রির অন্ধকারকে জড়িয়ে রয়েছে, দিনের গায়ে জড়িয়ে রয়েছে রাতের কৃষ্ণসার মৃগচর্ম।
সব দিক দিয়ে—ভাষায় শিল্পে গীতে নাট্যে সাহিত্যে—তপস্যার সূত্রপাত হচ্ছে তখন, মানবাত্মা নিস্ক্রান্ত হচ্ছে প্রজাপতির মত অজ্ঞতার আবরণ কেটে। এই সন্ধিক্ষণে যখন আর্যেরা তাদের অনার্য অবস্থা সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেননি সেই সময়ে আলোর সঙ্গে অন্ধকারকে, নিজেদের বতর্মান অবস্থার সঙ্গে অতীতকেও স্বীকার করতে বাধ্য তাঁদের সমস্ত শিল্পরচনা। ঊষা দেবীর মূর্তি পাথরে বা কাঠে তাঁরা কেমনতরো করে’ কেটেছিলেন তার উদ্দেশ এখন তো পাওয়া যাবে না, মূর্তিশিল্প নিশ্চয়ই খুব বেশি দূর এগোয়নি তখন আজকের আফ্রিকানদের শালভঞ্জিকার চেয়ে, কিন্তু ভাষা দিয়ে যে মূর্তি তাঁরা উষাদেবীকে দিলেন তা আলো-অন্ধকারের ছন্দে তাঁদের অতীত এবং বর্তমানকে চমৎকার রূপ দিয়ে ধরলে আমাদের কাছে।
“কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার হইতে পূজনীয়া, বিচিত্র গতিমতী ও মনুষ্য আবাসের রোগনাশিনী ঊষা উদয় হইলেন, বিচিত্র রূপবতী অহোরাত্র দেবতাদ্বয় ব্যবধানরহিতভাবে চলিতেছেন। একজন গমন করেন আর একজন আইসেন। পর্যায়গামিনী দেবতাদ্বয়ের মধ্যে একজন পদার্থসমূহ গোপন করেন, অন্য জন (ঊষা) অত্যন্ত দীপ্তিমান রথ দ্বারা তাহা প্রকাশিত করেন।......ঊষা দিনের প্রথম অংশের আগমনের সময় জানেন। তিনি স্বতোদীপ্তা ও শ্বেতবর্ণা, কৃষ্ণবর্ণ হইতে তাঁহাদের উদ্ভব ......।” অথবা যেমন বলা হ’ল—“স্বসা (রাত্রি) জ্যেষ্ঠস্বসাকে (ঊষাকে) উৎপত্তিস্থান (অপর রাত্ররূপ) প্রদান করিয়াছেন এবং ঊষাকে জানাইয়া স্বয়ং চলিয়া যাইতেছেন, ঊষা সূর্যকিরণ দ্বারা অন্ধকার বিদূরিত করিয়া বিদ্যুৎ রাশির ন্যায় জগৎ প্রকাশ করিতেছেন। এই সকল স্বসৃভাবাপন্ন পুরাতনী ঊষাগণের মধ্যে প্রথমা অপরার পশ্চাৎ প্রত্যহ গমন করেন। নবীয়সী ঊষা পুরাতন ঊষাসমূহের ন্যায় সুদিন আনয়ন করতঃ আমাদিগকে বহুধনবিশিষ্ট করিয়া প্রকাশ করুন।”
অতীতের আর বর্তমানের মধ্যে একজন কালো অন্যজন সাদা, এ ওর ভগ্নী, শুধু রঙ ভিন্ন ভিন্ন,—এ একেবারে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে আর্য অনার্য অবস্থার কথা। সঙ্গীতশাস্ত্রের দিক দিয়ে এই মূর্তির তুলনা পাই দিনের বেহাগ আর রাতের বেহাগে, মূর্তিশিল্পের দিক দিয়ে এই সাদা-কালোর রূপকে রূপ পেলে হরি-হর শিব-শক্তি কৃষ্ণ-রাধা এমনি অসংখ্য জায়গায়—চিত্রকলায় আজ আমরা যাকে বলছি Light and Shade. আলো ছায়া ইত্যাদি তা এই পুরাতনী ও নবীয়সী ঊষার প্রকাশ—“দেবতাদ্বয়ের মধ্যে একজন পদার্থসমূহ গোপন করেন, অন্য জন (ঊষা) অত্যন্ত দীপ্তিমান রথ দ্বারা তাহা প্রকাশিত করেন।” অজন্তা গুহার ছাদের চন্দ্রাতপ তার মাঝখানে যে মস্ত পদ্ম আঁকা হ’ল তারি কোণে কোণে এই সাদা আর কালো দুই ঊষাদেবতার রূপ লিখে’ গেল শিল্পীরা। যুগযুগান্তরের কল্পনা এই ভাবে যুগ যুগ ধরে’ আর্যশিল্পের নানা কৌশলে ধরা রইলো।
মানব মনের, তার ভাষার, তার শিল্পকলার উন্মেষ কত যুগ যুগ ধরে’ হচ্ছিল আলো-ছায়ার নিবিড় ঊষার মধ্য দিয়ে তার ঠিক ঠিকানা নেই। আর্য অবস্থায় পৌঁছতে একটা আর্যেতর অবস্থা কল্পনা করে’ নেওয়াতে ভুল নেই, ভুল করি তখন যখন কল্পনা করি যে পথ না চলেই আর্যেরা পথের শেষে উপস্থিত অতৈলপুর আশ্চর্য প্রদীপ হাতে!
ঊষাদেবতার মূর্তি ঋষিরা ভাষায় ফোটালেন এবং তার পরে কালে কালে কি ভাবে সেই একই ঊষার কল্পনা পাটায় পটে ইটে কাঠে পাথরে সাহিত্যে সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হ’ল তা দেখলেম, কিন্তু ঐ ঊষা ও স্বসা এবং ঐ যে কৃষ্ণবর্ণোদ্ভবা শ্বেতবর্ণা এদের প্রতীক আর্যেতর এবং অন্যব্রতদের দেওয়া নয় এটা ভাবাই ভুল।
রেড-ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিয়ান হিসেবে যে আর্যগণের জ্ঞাতি ভ্রাতা—তা ঠিক করে’ এখনো বলা চলে না, কিন্তু এটা অভ্রান্তভাবে স্থির হ’য়ে গেছে, এই রেড ইণ্ডিয়ান তারা খুব প্রাচীনকাল থেকেই নানা রঙ দিয়ে ব্যক্ত করেছে, সকাল-সন্ধ্যা জল-হাওয়া আকাশ-বাতাস এবং নানা ঋতুপর্যায় এবং জীবন-মৃত্যুও। ঐ রেড-ইণ্ডিয়ান তাদের কাছে শ্বেতবর্ণ মানে বোঝাচ্ছে—White innocence, awakening, disclosing the first glimpse—ঊষা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাত্রিকে কৃষ্ণবর্ণ উষার স্বসা বলেছেন আর্য ঋষিরা। রেডইণ্ডিয়ানরা সায়ংসন্ধ্যা বোঝাতে এবং বৃষ্টি বোঝাতে ব্যবহার করছে পীত ও কৃষ্ণবর্ণ—Yellow streak crossed with black lines symbolise rain and the evening sky, rain is commonly represented by eight vertical lines painted black. ঋষিরা বলছেন, “বিচিত্র রূপবতী অহোরাত্র দেবতাদ্বয়, এই পর্যায়গামিনী দেবতাদ্বয়ের মধ্যে কৃষ্ণবর্ণ যিনি তিনি পদার্থসমূহ গোপন করেন, অন্যজন তাহা প্রকাশিত করেন। এই কালো রঙ সম্বন্ধে রেড-ইণ্ডিয়ানদের ধারণা হ’ল— Black covers and hides, কালো গোপন করেন, আবরণ করেন; it is a line seldom seen in nature, for her days and years are full of promise. ভারতের আর্যগণ এবং আমেরিকার রেডইণ্ডিয়ান এ দুয়ের জাতিগত ঐক্য প্রমাণ হ’ল না তাতে বড় আসে যায় না, এক চিন্তা আর্যে অনার্যে, এক শিল্প আর্যে অনার্যে, এর সাক্ষ্য অগ্রাহ্য হ’তে পারে না আর্য সভ্যতারই ইতিহাস চর্চার বেলায়।
আমাদের দেশেই আর্যেতর জাতি এখনো বিদ্যমান যারা অন্য ব্রত পালন করছে। গারো এবং খাসিয়া পাহাড়ের এই আর্যেতর জাতির এক কবি তার সামনে নবীয়সী ঊষার মতো যখন প্রেয়সী এসে উপস্থিত হ’ল তখন ঋষিদেরই মতো সেও বর্ণনা করলে ছন্দে—
মরি মরি রাতের দেআ
রাতারাতি গড়তে ছিল
এই পুতলি!
আসতে দিবা—আদুল গায়ে
জড়িয়ে দিল তাড়াতাড়ি
নীলাম্বরী!
ঘুমঘোরে বা ভুল করে বা
রঙ ধরালো এমন নীলি
উজল নীলি।”
“Before the Sun shouldst thou have been created,
Thou art as the blue of the new drawn indigo.”
এখানেও সেই ঋষিবর্ণিত অহোরাত্র দুই দেবতায় মিলে’ গড়া সুন্দরী—কালো এবং আলো করা রূপ মিলে’ এক প্রতিমা।
আর্যেরা এবং আর্যেতর তারাও বহু দেবতার উপাসনা করতেন—সূর্য অগ্নি জল মেঘ নদনদী বনস্পতি কত কি যে দেবতা তার ঠিকঠিকানা নেই। এই তেত্রিশ কোটি দেবতাকে উত্তরাধিকারসূত্রে আর্যেরা যে পেয়েছিলেন তাতে ভুল নেই। ভাষার দিক দিয়ে দেখতে গেলে আর্যে এবং আর্যেতরে বড় একটা মেলে না, কিন্তু দেবতার নামে নামে এবং সেই সেই দেবতার কাযে কাযেও ভারি একটা মিল দেখি।
নিউজিল্যাণ্ডের মাওরীজাতি তাদের একজন বজ্রদেবতা আছেন; তাঁকে বলে তারা Waitari বা দৈত্যারি। দেবতাদের সঙ্গে দেবতাদের পূজার উপচার ও বিধি আর্যগণ যে পাননি আর্যেতরগণের কাছ থেকে তাই বা কে বলবে। বেদী-নির্মাণ, অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে যথাযথ স্থানে বসে’ গান ও সোমপান যুপকাষ্ঠের পূজা পশুবলি সমস্তই প্রমাণ করছে আর্য এবং আর্যেতরে সকল দিক দিয়ে নিকট সম্বন্ধ।
ঋষির বাচ্যরূপে ধরে’ গেছেন আমাদের কাছে তাঁদের কল্পিত নানা দেবদেবী মূর্তি। এক এক রকম যজ্ঞক্রিয়ার জন্য নানা কোণ কাটা বেদী এবং যজ্ঞের ব্যবহার্য নানা উপকরণ থেকে তাঁরা কি ভাবে কেমন করে নানা সামগ্রী গড়তেন তার আভাস পাই। কল্পিত দেবতাকে পাথরে কি কাঠে অথবা মাটিতে কিংবা চিত্রে তাঁরা ফুটিয়েছিলেন কি না তা জানার উপায় নেই। কিন্তু ইন্দ্রধ্বজ আর যুপ এই দুটির গড়ন এখনো আমাদের চোখের সামনে রয়েছে যা থেকে আর্যেতর জাতিগণের শিল্পকলার সঙ্গে আর্যদের শিল্পকলার সাদৃশ্য অনেকখানি ধরা পড়ে।
বৈদিক যুগের আর্যগণ শিল্পী হিসেবে তৎকালীন আর্যেতর জাতিগণের চেয়ে খুব যে বড় ছিলেন না তার প্রমাণের অভাব নেই, তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র যানবাহন সবই আর্যেতরগণের অপেক্ষ উৎকৃষ্ট ছিল কি না সে বিষয়েও সন্দেহ থেকে যায়। সেই বৈদিক যুগে ঋষিগণের চিন্তা এবং কল্পনা এবং ভাষা উৎকৃষ্টতর এ কথাও জোর করে বলা যায় না। সবেমাত্র সব দিক দিয়ে উন্মেষের অবস্থা তখন ফুটতে চাচ্ছে, কিন্তু ফোটেনি তখনো সবই। একেশ্বরের উপমা খুঁজতে গিয়ে তখনো আরণ্যক ঋষিদের মধ্যে অরণ্যদেবতার প্রাচীন বনস্পতি মূর্তিটি সুস্পষ্ট হ’য়ে উঠছে, তাঁরা বলছেন,—“বৃক্ষৈব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ”। অনার্য অবস্থার সেই বনস্পতি দেবতার কথা! বৈদিক যুগ চলে গেল, নতুন নতুন চিন্তা কল্পনা করে’ চল্লো মানুষ, কিন্তু সেখানেও এল সেই অতি পুরাতন কল্পবৃক্ষ নন্দনের পারিজাত যার ছায়ায় তেত্রিশ কোটি দেবতার লীলা চল্লো। বৌদ্ধযুগ প্রকাণ্ড এক ওলট পালট আনলে চিন্তায় ধর্মে কর্মে, কিন্তু সেখানেও প্রথমে পাথরে অটুট করে’ ধরা গেল অক্ষয়বটের স্মৃতি। খুবই আধুনিক বৈষ্ণব ধর্ম সেখানেও গাছ পূজা পেলে—গহন বনের তুলসী গাছ। সেই আর্যেতর অবস্থার অরণ্যদেবতা সে বারে বারে জানিয়ে দিলে আর্যগণ কোন দূর আরণ্যক অবস্থার স্মৃতি বহন করে’ চলেছে,—উত্তরের নদী যেমন তুহিনকণা বহন করে’ চলে দক্ষিণ সমুদ্রে। সৃষ্টির কথা স্রষ্টার কথা বলতে আর্যেরা বল্লেন—“ইদম্ বা অগ্রে নৈব কিঞ্চিৎ আসীৎ” ইত্যাদি। নিউজিলাণ্ডের অনার্য তারাও এই স্বষ্টি-রহস্য কি ভাবে বর্ণন করলে দেখ—
“Io dwelț within the breathing space of Immensity.
The Universe was in darkness, with water everywhere
There was no glimmer of dawn, no clearness, no Light,
And he began by saying these words,—‘That he
Might cease remaining inactive:
Darkness! Become a Light possessing darkness’,
And at once Light appeared.
“Heaven be formed’, then the sky became suspended
‘Bring forth thou, Tupua-horo-nuku’,
And at once the moving earth lay stretched abroad.”
ভারতবর্ষের আর্য ঋষিগণের চিন্তা কল্পনা ক্রিয়া কর্ম সবেতেই তাদের পূর্বতন আর্যেতর অবস্থার ছাপ কি সুস্পষ্ট ভাবে বিদ্যমান তা দেখছি—সুতরাং ভারতশিল্পের ইতিহাস শুধু বৈদিক যুগ পর্যন্ত নয় তারো এবং আরো পূর্ব থেকে তার ধারা চলে আসছে—এইটেই বলতে হ’ল। আত্মা এবং পরমাত্মা দুটি কেমন যেমনি দেখাতে হ’ল অমনি ঋষিরা তাঁদের সেই পূর্বতন অবস্থার দুটি পাখীর উপাখ্যান দিয়ে ছবি দিলেন “দ্বা সুপর্ণা”—একটি পাখী জেগে থাকে একটি পাখী ঘুমিয়ে থাকে। কোন্ অখ্যাত যুগের রূপকথার পাখী যখন আর্যদের পূর্বপুরুষরা সবেমাত্র কথা বলতে আগুন পোহাতে শিখেছেন তারি স্মৃতিছন্দের দ্বারা নিরূপিত হ’ল, ঋষিদের গভীর তত্ত্বজ্ঞান তাকে তলিয়ে দিতে পারলে না। তারপর থেকে পাথরে ধাতুতে কবিতায় গানে রূপকথায় আর্যসভ্যতা কতবার কতভাবে এই দুটি পাখী বেঙ্গমা-বেঙ্গমী এবং শুক-সারীর আকারে ধরে’ গেল তার ঠিক নেই—
“সাই সূয়া দুড পাখী গহিন নদী চরে
স্যাও গহিন শুকায়া গেলে শুন্যি উড়াল ছাড়ে
ধবল বরণ কবুতর চিরল বরণ আখি—”
এমনি সব কথা এ আর্য অনার্য দুয়ের আত্মীয়তার কথা,না জানিয়ে থাকতে পারছে না। কাযেই বলতে হয় আর্যশিল্পের ভিত্তি অনার্য যুগের উপরে।
পাকা ফলের বুকের মাঝে যেমন শক্ত কষি, তেমনি আর্য-শিল্পের অন্তরে অন্তরে অনার্য-শিল্পের প্রাণ বীজের মতো লুকিয়ে রয়েছে—তাকে ফেলে’ হয় তো রস পেতে পারি, কিন্তু সে যদি বাদ যেতো আরম্ভেই একেবারে তবে নিস্ফলা হ’ত আর্যসভ্যতা এটা নিশ্চয়।