বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/আর্যশিল্পের ক্রম
আর্যশিল্পের ক্রম
দেখা যায় যে আর্য অনার্য নির্বিশেষে এক সময়ে তাবৎ মানুষই নানা দেবতার কল্পনা ও উপাসনা করছে প্রাতঃসূর্য মধ্যাহ্নসূর্য অস্তমান সূর্য আকাশ অগ্নি গাছ পাথর ইত্যাদি ইত্যাদি। বৈদিক যুগেও আরণ্যক ঋষিরা দেখছি এই সকল ভিন্ন ভিন্ন দেবতার কল্পনা করে’ নানা মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন এবং কোথাও কোথাও এই সব দেবতার মন্ত্রমূর্তি গড়ে তোলারও লক্ষণ দেখি —যেমন ঊষাকে ভাষা দিয়ে একটি কুমারী মূর্তিতে ধরা হ’ল, যেমন সূর্যকে তিন বর্ণের তিন মূর্তি দেওয়া হ’ল, অগ্নিকে দেখা হ’ল যজমানের কামনাবাহী দূতরূপে। এইভাবে তাবৎ দেবতা একটি একটি স্বনির্দিষ্ট ধ্যানমূর্তি পেতে পেতে চল্লো আস্তে আস্তে। মানুষের কাছে অগ্নিদেব যূপকাষ্ঠ এরা প্রত্যক্ষ রূপ পেয়ে গেল, বৈদিক আমলে ঋষিরা নানা কোণবিশিষ্ট বেদীর মধ্যে অগ্নিকে ধরে’ এবং যূপ ও ইন্দ্রধ্বজকে নানা বর্ণের পুষ্পমালা চামর ইত্যাদিতে সাজিয়ে ধরলেন। ভারতবাসী আর্যগণের সঙ্গে এই বৈদিক যুগে ভারতের বাহিরে আর্য ও অন্যব্রতগণের দেবতার রূপকল্পনা ও রূপপ্রদানের মধ্যে একটা চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে দেখা যায়। ভারতের ঋষিদের কল্পিত ইন্দ্রকে আমরা নানা নামে নানা উপাখ্যানের মধ্যে খুঁজে পাই খুব আদিম মনুষ্যসমাজের মধ্যেও, এ ছাড়া দেবশিল্পী আছেন যিনি নানা অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি গড়েন। বেদে ত্বষ্টা এবং ঋভুগণ শিল্পী বলে’ কথিত হচ্ছেন—“যাঁহারা অশ্বিদ্বয়কে রথ নির্মাণ করেন, যাঁহারা অসংত্রা কবচ নির্মাণ করেন” ইত্যাদি নানা কারিগরির কথা। কারিগরের হাতের কাযের প্রশংসা এবং কারিগরকে সম্মান দেওয়া হয়েছে বারে বারে বৈদিক যুগে।
(১) “হে বলের পুত্র, সুধন্বার পুত্র, ঋভুগণ তোমরা এখানে আগমন কর, তোমরা অপগত হইও না। এই সবনে মদকর সোম রত্নদাতা ইন্দ্রের পরেই তোমাদের নিকট গমন করুক।”
(২) “ঋভুগণের রত্নদাম আমাদের নিকট এই যজ্ঞে আগমন করুক। যেহেতু তাঁহারা শোভন হস্তব্যাপার দ্বারা ও কর্মের ইচ্ছা দ্বারা এক চমসকে চতুর্ধা করিয়াছিলেন এবং অভিযুত সোম পান করিয়াছিলেন।”
(৩) “তোমরা চমসকে চতুর্ধা করিয়াছিলে এবং বলিয়াছিলে, হে সখা অগ্নি, অনুগ্রহ কর। হে রাজগণ! হে ঋভুগণ তোমরা কুশলহস্ত, তোমরা অমরত্বপথে গমন কর।”
(৪) “যাহাকে কৌশলপূর্বক চারিটা করা হইয়াছিল সেই চমস না জানি কি প্রকারেরই ছিল? তোমরা হর্ষের জন্য সোম অভিষব কর, হে ঋভুগণ! তোমরা মধুর সোমরস পান কর।”
(৮) “তোমরা সুকর্মদ্বারা দেবতা হইয়াছিলে, হে বলের পুত্রগণ। তোমরা শ্যেনের ন্যায় দ্যুলোকে নিষণ্ণ আছ, তোমরা ধন দান কর, হে সুধন্বার পুত্রগণ! তোমরা অমর হইয়াছ।
(৯) হে সুহস্ত ঋভুগণ! যেহেতু তোমরা রমণীয় সোমদানযুক্ত তৃতীয় সবনকে সুকর্মেচ্ছা প্রযুক্ত প্রসাধিত করিয়াছ, অতএব তোমরা হৃষ্ট ইন্দ্রিয়ের সহিত অভিযুত সোম পান কর।” (বামদেব ঋষি) ঋভুগণকে বলা হয়েছে—সুন্দরান্তঃকরণ—“হে সুন্দরান্তঃকরণ ঋভুগণ!” ঋভুগণ কিছু নকল করেন না তাও বলা হয়েছে—“তোমরা মানসিক ধ্যান দ্বারা সুবৃত ও অকুটিলগামী রথ নির্মাণ করিয়াছিলে।” ঋভুগণকে বলা হয়েছে রূপদক্ষ—“তোমরা শ্রেষ্ঠ ও দর্শনীয় রূপ ধারণ করিয়াছ।...তোমরা ধীমান, কবি ও জ্ঞানবান, আমরা তোমাদিগকে এই স্তোত্র দ্বারা আবেদন করিতেছি।”
এক আকারের হাত কি চামচ ছাঁচে ঢালাই হয়ে চারখানা কেন দু’শোখানা হাতা ও চামচ হচ্ছে এখন—এতে আমরা অবাক হইনে, কিন্তু শিল্পের যখন সূত্রপাত হচ্ছে ভারতবর্ষে তখনকার দিনের মানুষ কি বিস্ময়ের চোখেই দেখছে এই সমস্ত কারিগরদের ব্যাপার এবং কি সম্মানই বা দিচ্ছে তাদের, তা বেশ বোঝা যায় উপরের মন্ত্রগুলি থেকে।
ঋষির বল্লেন, মানুষের রচনা সমস্ত দেবতার রচনার কনিষ্ঠ— “দেবশিল্পানাম্ অনুকৃতিঃ”।
দেবতার কার্যের সতত সহায় হ’ল শিল্পিগণ এই পর্যন্ত পাওয়া গেল বৈদিক যুগের সে হিসেব নিলেম তা থেকে। নির্মাণের কৌশলকে ও সমস্ত রূপ দেবার চেষ্টাকে অস্তে আস্তে পাচ্ছে মানুষ। মানুষ তপস্যা করছে উৎকৃষ্ট জ্ঞান পাবার জন্য, মানুষ তপস্যা করছে সুন্দর সমস্ত শিল্পকলাকে পাবার জন্য—এরও প্রমাণ পাচ্ছি বৈদিক যুগে। জ্ঞানের উৎকর্ষ সব দিক দিয়ে পাবার জন্য ঋষিরা তপস্যা করছেন যখন তখন দেখি অন্য আর এক সমাজের মানুষ তারা অন্যব্রত হ’লেও মানব শিল্পের উৎকর্ষের হিসেবে আরণ্যক ঋষিদের চেয়ে একটু যেন উপরে রয়েছে—লোহার কেল্লা সুরক্ষিত নগর নির্মাণে পটু অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ ইন্দ্রেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমন সব অন্যব্রত তারা।
ইন্দ্রের দূতী সরমা যখন পণিগণের নিকটে এসে ইন্দ্রের বীরত্ব বর্ণন সুরু করলেন সেই সময়ে পণিগণ উপহাস করে’ বল্লে—ইন্দ্রের কথা কি বল? আমাদেরও অস্ত্রশস্ত্র আছে এবং যুদ্ধবিদ্যায় আমরাও একেবারে অপারগ নই।
বৈদিক যুগে প্রধান দেবতা হলেন ইন্দ্র। এই ইন্দ্রের মূর্তি ঋষিরা যে ভাবে কথায় ফুটিয়েছেন তাতে করে’ তাঁকে হিন্দু আমলের ঐরাবতে চড়া নধর মূর্তিতে আমরা দেখতে পাইনে। বেদের ইন্দ্র রথে চড়ে’ যুদ্ধে চলেন, ঘোড়ায় চড়ে’ যজ্ঞে আসেন। আমাদের সুপরিচিত সূর্যমূর্তির কিংবা কল্কি অবতারের সঙ্গে কতকটা মিল দেখি বেদের ইন্দ্রের—“অভিমুখবর্ত ইন্দ্র, আমাদিগকে আশ্রয় ও ধন দানের জন্য আমাদের নিকটে অশ্বে আরোহণ করতঃ আগমন করুন। .........যিনি পর্বতের ন্যায় প্রবৃদ্ধ ও মহান, যিনি তেজস্বী, যিনি শত্রুর পরাভবের জন্য সনাতন কালে উৎপন্ন হইয়াছেন।”
ঋষিরা যাদের নাম মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন সে সব দেবতা সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র মেঘ জলরূপেই ছিল তাঁদের চোখের সামনে—সাক্ষাৎ অগ্নি সাক্ষাৎ সূর্য; সুতরাং খুঁটিনাটি মূর্তির ধ্যান তাঁরা দিলেন না—যদিও মূর্তিশিল্প বড় একটা এগোয়নি, কিন্তু অন্যান্য শিল্প ব্যাপার চলেছে দেখি—বস্ত্র অলঙ্কার রথ শকট এবং নানা তৈজসপত্র এ সকল প্রস্তুত হচ্ছে দেখা যায়। বৈদিক যুগে মাটির বাসন হাঁড়ি-কুঁড়ি জাঁতা এবং লোহা ও নানা প্রকারের ধাতু ঢালাই করে’ অস্ত্র শস্ত্র ইত্যাদি গড়তে গড়তে এই ভাবে কত যুগ কেটেছিল আর্যগণের প্রতিমাগঠনের শিল্প জানার পূর্বে তার ঠিক নেই।
রামায়ণ থেকে পাওয়া যায় স্বর্ণ-সীতার কথা। সেই যদি ধরা যায় প্রথম প্রতিমা গড়ার আরম্ভ আর্যজাতির, তবে বলতে হবে সেটাও রাক্ষসদের কাছ থেকে এসেছিল, কেননা লঙ্কায় মায়াসীতার খবর রামের অশ্বমেধের আগের ঘটনা। রাবণের পুষ্পক রথ এবং রাবণের পুরীর যা বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে বুঝি যে, আর্যেতর সমস্ত জাতি তারা কলাকৌশলে ভারতবাসী আর্যদের অপেক্ষা অনেকখানি এগিয়ে গেছে।
মহাভারতের যুগে ভারতীয় আর্যের সভ্যতার প্রায় চরম শিখরে উপনীত দেখা যায়। কিন্তু তখনও দেখি যুধিষ্ঠিরের সভা প্রস্তুত করতে এল শিল্পকার ময়দানব, কিরাতের ঘর থেকে এল গাণ্ডীব অর্জুনের। এমনি সব খুঁটিনাটি কথা থেকে ধরা যায় আর্যেতর তারাই ছিল আর্টিষ্ট এবং কারিগর, রূপ দিতো তারা কল্পনাকে। এর বিশ্বের তাবৎ রূপকে দখল করতে পারতো বিদ্যার দ্বারা—সেইজন্য অনেক সময় এদের যাদুকর ভাবা হত। মায়াবী আর শিল্পী এ দুয়ের মধ্যে পরিষ্কার ভেদ অনেক দিন করেনি মানুষ।
ঋষিরা যে সব দেবতার কল্পনা করে গেলেন তাদের মধ্যে ইন্দ্রকেই তাঁরা প্রধান স্থান দিলেন কিন্তু ইন্দ্রের প্রতিমা তাঁরা গড়েননি, ধ্যানমাত্র দিয়েছিলেন। রামায়ণ মহাভারতের সময়েও ইন্দ্রের মূর্তি নেই। রাজার পর রাজা নরেন্দ্র যথার্থভাবে ইন্দ্রত্ব পাবার জন্য শতাশ্বমেধের আয়োজন করেছেন, সেখানে ইন্দ্রের বাহন অশ্ব এবং ইন্দ্রধ্বজ দুইই পূজা পায় কিন্তু স্বয়ং প্রতিমাটির দেখা নাই। সুমন্ত্র সারথি ইন্দ্রের রথ নিয়ে আসেন নরেন্দ্রের জন্য, ইন্দ্রও আসেন পৃথিবীতে, কিন্তু তাঁর রূপ ধরা পড়ে না আর্টিষ্টের কৌশলের মধ্যে। এইভাবে চলতে চলতে একদিন ইন্দ্রপূজা বন্ধ হ’য়ে শ্রীকৃষ্ণের পূজা আরম্ভ করে’ দেয় বৃন্দাবনের গোপজাতি। তার পর আসেন আর্যেরা গোপজাতির অনুসরণে পূজা দিতে নতুন দেবতাকে। এই ভাবে দেখি দুই যুগের তুই দেবতা শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণ বৈদিক ইন্দ্রের স্থান পেয়ে বসেছেন। বৈদিক ইন্দ্রের পাশে ইন্দ্রাণীকে দেখিনে, মরুৎগণকে দেখি, কিন্তু রামের পাশে সীতা, শ্যামের পাশে রাধা—এও জানাচ্ছে আর্য অনার্য দুই সভ্যতার পরিণয়ের ইতিহাস।
মূর্তিপূজা এবং প্রতিমা-শিল্পের সূত্রপাতেই বুদ্ধের আবির্ভাব হয়। তত্ত্ব-চিন্তার দিক দিয়ে ভারতবাসীর মন তখন উপনিষদের একেশ্বরবাদ থেকে শূন্যবাদে পৌঁছে গেছে, কিন্তু শিল্পকলার দিক দিয়ে ভারতবাসী তখন দেখি সবে কাটতে শিখছে পাথর। সেই পুরাতন যুগের বনস্পতি, কল্পতরু ইন্দ্রধ্বজ অশ্বমেধের ঘোড়া সূর্যরথের একটি চাকা—এমনি নানা প্রাচীনতম কল্পনা নতুনতরো প্রতীক দিয়ে ধরে’ চলেছে মানুষ পাথরের স্তূপের গায়ে।
সাহিত্যে জাতকের উপাখ্যান সমস্ত বলে’ চলেছে কোন্ আর্যপূর্ব যুগের বনবাসী অবস্থার নানা জন্তু-জানোয়ার সমস্তর উপাখ্যান। এই বৌদ্ধযুগে আর্যেরা যেন আর একবার পুনরাবৃত্তি করে’ চলেছে সব দিক দিয়ে সেই পুরাতনী ঊষার আলো-অন্ধকারে ঘেরা অবস্থা, রাবণ রাজার অশোকবনের স্মৃতি অনেকখানি। মায়াদেবীর অশোকতলার মূর্তিখানিতে দেখা গেল, বুদ্ধের কণ্ঠক ঘোড়া ইন্দ্রাদি দেবতা তাকে অনুসরণ করেছেন, ধর্মচক্র সে একচক্র সূর্যের আকারে দীপ্তি পাচ্ছে স্তম্ভের উপরে, সাঞ্চিস্তূপের কল্পতরুর ছায়ায় বুদ্ধের চরণচিহ্ন মনে পড়াচ্ছে শ্রীরামের পাদুকা কিংবা তারও আগেকার বনস্পতির পূজাটি।
নতুন ভাবের নতুন উন্মেষ, নতুন শিল্পের নতুন উন্মেষের লক্ষণ সুস্পষ্ট ধরা পড়ে বৌদ্ধ-শিল্পের প্রথমাবস্থায়। যূপ-কাষ্ঠ নেই, হ’য়ে গেছে তারা পাথরের স্তম্ভ একটার পর একটা, এবং সেই সব স্তম্ভের শিখরে সিংহ হস্তী পশু পক্ষী যারা আর্যেতর অবস্থার দেবতা এবং পরে দেবতার বাহন হ’য়ে পড়লো তারা শোভা পাচ্ছে যূপে বাঁধা জন্তু। পাথরের সঙ্গে তখন নতুন ভাব করছে শিল্পীরা, কাঠের উপরের কারুকার্যের অভ্যাস সম্পূর্ণ ভুলতে পারেনি, চৈত্যবিহার গিরিগুহা সব জায়গাতে এরি ছাপ রাখছে শিল্পীদের হাত। বৈদিক দেবতার ধ্যানের অবশেষ তখনো মনে রয়েছে—ইন্দ্রের বজ্র বৌদ্ধযুগের অলঙ্কার-শিল্পে স্থান পাচ্ছে সুগঠিত রূপ পেয়ে, “দ্বা সুপর্ণ” তারা হংসমিথুন হ’য়ে দ্বারের উপরে উড়ে’ বসছে, অতি প্রাচীন ঋভুগণের নির্মিত রথের চাকা ধর্ম চক্র এবং চাকা চাকা পদ্ম ফুলের রূপ ধরে’ নতুন শোভা বিস্তার করছে চৈত্যে বিহারে মঠে প্রাসাদে। মানুষের আর্য অবস্থার এবং তারও পূর্বেকার স্মৃতি ও কল্পনা বৌদ্ধ-শিল্পের প্রত্যেক পাষাণে আপনাদের ব্যক্ত করে’ চল্লো, তারপর একদিন বুদ্ধের ধ্যানী প্রতিমা গড়তে শুরু করলে শিল্পীরা। আর্য্যেতর জাতির শিল্পচেষ্টা এবং আর্যজাতির উৎকৃষ্ট চিন্তা এক পরিণয়-সূত্রে ধরা পড়লো বুদ্ধপ্রতিমাতে। এই সময়ে গ্রীক শিল্পী কেউ গান্ধার দেশে বুদ্ধমূর্তি গড়তে চেয়েছিল কিন্তু ঠিক মূর্তি সঠিক প্রতিমা দিতে পারেনি—তারা কাপড় পর কুঞ্চিত-কেশ নকল বুদ্ধ দিয়ে গেল, আসল বুদ্ধমূর্তি সম্পূর্ণ অন্যভাবে গড়া হ’ল দেখি। অনুরাধাপুরের অরণ্যে এই বুদ্ধ-প্রতিমা পাওয়া গেল বুদ্ধের নির্বাণের অনেক শত বৎসর পরে—বহির্ভারতের এক শিল্পীর গড়া প্রতিমা। সেখানে ঋষিপ্রতিম একটি মহাপুরুষ, কোনো সাজসজ্জা না দিয়ে গড়েছেন শিল্পী, চোখভোলানো চাকচিক্য বা সৌন্দর্য মোটেই নেই ঐ মূর্তিতে। রূপবান পাথর ধ্যাননিমগ্ন—এই টুকুই দেখালেন শিল্পী। সেই যুগযুগান্তরের আরণ্যক অবস্থার কথা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলে, বৌদ্ধ সভ্যতার চরম ক্ষণে আবার উচ্চারিত হ’ল ভারতের বাহিরে সমুদ্র পারে—“যিনি পর্বতের ন্যায় প্রবৃদ্ধ ও মহান এবং যিনি তেজস্বী”।
বৈদিক কাল থেকে আরম্ভ করে’ অনেক যুগ ধরে’ অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ধারণাতে পৌছেচে যখন মানুষের মন গভীর জ্ঞানের ধারা ধরে’, সেই সময় থেকে রসের ধারা ধরে’ চলতে সুরু করলো শিল্পীদের মানস সারা বৌদ্ধযুগ অতিক্রম করে’ অদ্বিতীয় বুদ্ধমূর্তির ধারণাতে পৌঁছোতে। জ্ঞানীর পথে যেমন নানা জটিল ও বিচিত্র তর্ক-বিতর্ক, শিল্পীর পথেও তেমনি নানা কর্মের নানা রীতি-পদ্ধতির বিচিত্রতা গিয়ে মিল্লো একটি কেন্দ্রে; জ্ঞানী বল্লেন, “বৃক্ষৈব স্তব্ধোদিবি তিষ্ঠত্যেকঃ”, শিল্পী দেখালে—স্তব্ধ মূর্তি!
এই বৌদ্ধযুগ, আর্য এবং অন্যব্রত, কুরু এবং পাণ্ডবদের ইতিহাসের আর একবার যেন পুনরাবৃত্তি হ’তে দেখি বৌদ্ধভিক্ষু এবং ব্রাহ্মণগণের ধর্ম-সংঘর্ষে, ধর্মরাজত্বে ইন্দ্রত্ব পাবার জন্য সংগ্রাম, একের জন্য অনেকের সমাবেশ। ধর্মে একাধিপত্য এবং কর্মে একাধিপত্য এই হ’ল বৌদ্ধযুগের পরের ইতিহাস।
রাজতন্ত্র যেমন, তেমনি ধর্মতন্ত্র শিল্পতন্ত্র সমাজতন্ত্র একই সঙ্গে বিধিবদ্ধ হ’তে চল্লো শিল্পের দিক দিয়ে। আরণ্যক ঋষিদের তেত্রিশ কোটি দেবতা নতুন করে’ বিধিবদ্ধ ভাবে গড়ে তোলবার কায আরম্ভ হ’তেই সেই আর্যেতর শিল্পীদের মতামত নিয়ে টানাটানি পড়ে’ গেল— ময়শিল্প মত, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মত অনুসারে গড়া হ’য়ে মন্দিরচুড়া সমস্ত অরণ্য আর পর্বতের প্রতীক এবং প্রতিমা হ’য়ে দেখা দিলে—হিন্দু সভ্যতার উৎকর্ষের যুগেও মানুষ পাথরকে পর্বতকে অরণ্যকে তুলতে পারলো না—ত্রিলোকের প্রতিমা দিয়ে লোকারণ্য হ’য়ে উঠলো মন্দিরের আগাগোড়া প্রস্তর কল্পনার রাজ্য ছেড়ে রূপের রাজত্বে বেরিয়ে এল তেত্রিশ কোটির চেয়ে বেশি দিনের পুরোনো সমস্ত দেবতা!
নতুন নতুন দেবতার রূপে, বাহনের রূপে, প্রতীকের ছলে, প্রতিমার বেশে দেবলোক নেমে এল মর্তলোকের বুকের উপরে। শিল্পীর রচা রূপের পরিখা ও দুর্গপ্রাচীর তারি মধ্যে চিরদিনের মতো দেবতা সমস্ত বরাভয়-হস্তে স্থির হ’য়ে বসলেন, শিল্প-কৌশলের চমৎকারিতা পরিপূর্ণতা পেয়ে তাবৎ শিল্পকে একটি অদ্বিতীয় স্থান দিতে চল্লো জগতে।
এই যুগটাকে ভারতশিল্পে অবতার-যুগ বলে’ ধরতে পারি। আর্য অনার্য সবাই মিলে’ কালে কালে যে সব কল্পনার সঞ্চয় কাব্যে সাহিত্যে ধর্মগ্রন্থে জম করে’ তুল্লে মানুষ, সেইগুলোই রূপ পেয়ে অবতীর্ণ হ’তে থাকলো কলা-কৌশলের রাস্তা ধরে’। যা গল্পে কথায়, যা সুরে ও ছন্দে, যা তত্ত্ব-জিজ্ঞাসায় অগোচর ভাবে বর্তমান হচ্ছিল চোখের সামনে তা রূপ ধরে’ দাঁড়ালো চিত্রপটে প্রস্তরের ও ধাতুর মূর্তিতে নাট্যে নৃত্যে যাত্রায়।
ইন্দ্রের বজ্র সে রূপ ধরে’ পূজার্হ হ’য়ে রইলো তিব্বতের শিল্পীদের হাতে, ইন্দ্র রূপ পেলেন ইলোরা গুহার শিল্পীর হাতে, সূর্য রূপ পেলেন উড়িষ্যার কারিগরের হাতে, বাঙলা রূপ দিলে দেবীগণের, দ্রাবিড় সভ্যতা রূপ দিলে প্রলয় তাণ্ডবের ছন্দকে রূপের বিরাট ঢেউ। দুই ভাবে মিলে’ রূপের রাগলীলা চল্লো। আর্যাবর্তের অন্তর বাহির দুই গতি মস্ত একটা চক্র সৃষ্টি করলে পৃথিবীর শিল্পীদের জগতে। কত ঊষা কত রাত্রি কত শীত কত শরৎ ও বসন্ত ক্ষণে ক্ষণে আলো ছায়া এবং মায়ায় রঙ বুলিয়ে গেছে এই যুগ যুগ ব্যাপী আমাদের শিল্প-চেষ্টার উপরে—পাথরে চিত্রে অলঙ্কারে ভূষণে কাপড়ে মন্দিরে দীনের কুটীরে রাজার প্রাসাদে—তার লক্ষণ সমস্ত সুস্পষ্ট বিদ্যমান দেখি আজও।
প্রত্নতত্ত্ববিদ তাঁরা যে ভাবে এক একটা রাজবংশের সঙ্গে জড়িয়ে শিল্পের ইতিহাস টুকরো টুকরো ভাবে বিচার করে চলেছেন তাতে করে’ আর্য-শিল্পের পরিপূর্ণ রূপটা চোখে পড়তে বিলম্ব হয়। মৌর্য শিল্প গুপ্ত শিল্প মোগল শিল্প এমনি গোটা কতক ভাগ দেখি, কিন্তু শুধু এই টুকুর মধ্যেই শিল্প বদ্ধ নয়—নদীর একমুখে যেমন অনন্ত প্রস্রবণ, অন্য মুখে যেমন অনন্ত সমুদ্র, দুটি কূল যা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে যেমন বদ্ধ নয় নদী—তেমনি এই আর্য-শিল্পের ধারার এক মুখ অনার্য অবস্থার অদৃশ্য গোপনতার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, আর এক মুখ তার আর্য অবস্থার অপার বিস্তারের মধ্যে নিমগ্ন হয়েছে।
সমুদ্রের একটা বিন্দু জল থেকে সমুদ্রের বিরাট প্রসার কিছুই ধরা যায় না, সমুদ্রের জল নীল ও নোনা, মিঠা নয়, এটা এক ফোঁটা থেকেও বোঝা যায়—কিন্তু সমুদ্র কি ব্যাপার তার একটুও ধারণা হয় না একটি ফোঁটা দিয়ে। তেমনি মৌর্য বংশাবলীর এতটুকু পাত্রে কি গুপ্ত রাজ্যের আমলে ধরে’ দেখলেম ভারত অভারত ব্যাপী বিরাট আর্য-শিল্পকে। এ যেন ঐরাবতকে দেখা সেই ভাবে হ’ল যে ভাবে একদল অন্ধকারে কেউ ঐরাবতের পা, কেউ শুঁড়, কেউ লেজ, কেউ কান ছুয়ে ছুঁয়ে বল্লে—এর সপের আকৃতি, এর সূর্পের আকৃতি।
বঙ্গোপসাগরের তীরে মরুভূমির মাঝে কোণার্কের সূর্যরথ এবং বোম্বাই অঞ্চলের একটা সম্পূর্ণ পর্বতকে এক টুকরো পাথরের মতো কেটে কৈলাসপতির কৈলাস, এই দুই সীমানাতে আর্য-শিল্পের চলাচল বদ্ধ হল, তারপর এসে পৌঁছলো বাইরের একটা নতুন ধারা। এখন সহজেই মনে হয় আর্য-শিল্পের শেষ করি অস্তমিত সূর্যের রথের এবং শূন্য কৈলাসের কাছে। ওদিকে মরুভূমি এদিকে পর্বতকন্দর—এ শুধু একটা অধ্যায় শেষ হ’ল শিল্পের ইতিহাসে। মোগল আমলে আর্যশিল্পই আবার নতুন রূপসৃষ্টির সূত্র ধরলে কিন্তু সেই পুরাতন ভারতীয় ভাব বইতে থাকলো মোগল শিল্পের অন্তরে অন্তরে।
দেবতা নয় এবারে নরদেব—‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’—তাঁর পুরী নির্মাণের জন্যে ডাক পড়লো শিল্পীর, মন্দির নয় কিন্তু সমাধিমন্দির। সেই বৌদ্ধ যুগের রামায়ণের যুগের কুরুপাণ্ডবের যুগের স্বপ্ন নতুন করে’ নতুন আকারে ধরা পড়ে’ গেল শ্বেত পাথরে রক্ত পাথরে নীল যমুনার ধারে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের নতুনতরো ত্রিমূর্তি যার অপূর্ব সৌন্দর্য ও কলা-কৌশলের কাছে জগতের শিল্পরসিক তারা আর্য অনার্য নির্বিশেষে সসম্ভ্রমে কুর্নিশ দিচ্ছে প্রণাম দিচ্ছে আজ।
কলকাতার কাছেই দুটো তিনটে কবরস্থান রয়েছে, সেখানে অনেকগুলো নানা আকারের কবর আছে কিন্তু সেগুলো কবর মাত্র—কাগজ চাপা ঢেলা যে ভাবে থাকে সেই ভাবে মৃতদেহগুলোকে চেপে রয়েছে পাথর আর ইঁট। কবরগুলো কারো কিংবা কিছুর প্রতিমা দেয় না, বলে মাত্র—আমি কবর, রূপকে আচ্ছাদন করেছি, রূপকে ফোটাতে আমি নেই। কিন্তু ঐ তাজবিবির কবর কত কবি কত যাত্রী তাকে দেখে মুগ্ধ হ’ল ও বল্লে—এ কি সুন্দরী! এ কি সুন্দরী! এই বিচিত্ররূপে নানা লোকের কাছে দেখা দিচ্ছে অথচ একটি সে! বহুযুগের সন্ধানে ভারতবাসী শিল্পীরা পেয়ে গেল এই সত্য, ভুলবে কেমন করে’? তাজমহলের পাথরের রক্ত শ্বেত এবং নদী ও আকাশের নীল এক করে’ আর্টিষ্ট গোরস্থানের একটা সামান্য কবর গড়ে’ গেল বল্লে ভুল বলা হয়—অনেক বর্ণের পাথরের ত্রিমূর্তি নতুন ছাঁদে গড়া, শিল্প-শাস্ত্রের বাঁধা নিয়মে গড়া নয় কিন্তু রসের আপন নিয়মে গড়া একটি প্রতিমা বলতে পারি একে। ইউরোপের শিল্পী তারা ভারতবাসী শিল্পীদের মতোই এক যুগে সুবিধা পেলে প্রতিমা গড়ে’ তোলবার, তাদের ধর্ম তাদের ডাক দিলে যিশুর প্রতিমা গড়ে’ দিতে। প্রতিমার মধ্য দিয়ে বুদ্ধকে যে ভাবে সবার করে’ দিয়ে গেল ভারতবাসী শিল্পীরা, কই তেমন ভাবে ওরা তো গড়তে পারলে না, নিষ্ফল রইলো ওদের চেষ্টা যিশুর প্রতিমার বেলায়। রাজাদের প্রতিমা তাও গড়তে পূর্ব পশ্চিম দুই ভাগ পৃথিবীর যে কেউ শিল্পী তাদের ডাক পড়লো—ভারতবাসী রাম রাজা রাবণ রাজা দেবরাজ থেকে আরম্ভ করে’ রাজরাজেন্দ্র সবই লিখনে রাজদেহের সাদৃশ্য দিলে অথচ ঠিক রাজাটি নয়, রাজশ্রীর প্রতিমা একটি একটি—এই দিলে ভারতশিল্পী। কিন্তু সেই রোমক আমল থেকে এ পর্যন্ত সমস্ত ইউরোপের রাজাদের ছবি দেখি—সেখানে এ রাজা সে রাজা কেউ বুড়ো কেউ যুবা সুন্দর সবাই সুবেশ সবাই, কিন্তু যে ভাবে ঔরঙ্গজেবকে পাই, সাজাহানকে পাই, জাহাঙ্গীরকে পাই একটা একটা রসমূর্তিতে—সে ভাবে পাই না তো ওদের রাজাদের! রসের প্রকাশ এই বিশ্বসংসার এটা ভারতের আর্য-শিল্পের কথা; ও-দেশের কথা স্বতন্ত্র রূপের জয়, দৃষ্টরূপের মানসরূপের নয়। ইউরোপের শিল্পী এবং ভারতের শিল্পী, একের কাছে অপরে অন্যব্রত বলে’ পরিচিত হচ্ছে শিল্পের দিক দিয়ে এখনো। এমন একদিন আসবেই যখন এই দুই অন্যব্রত এক হবে, যে ভাবে এক হয়েছিল আর্যে অনার্যে বহুযুগ পূর্বে এই ভারতবর্ষে। এই যে দুই ভিন্নপন্থী এক হ’তে চল্লো এর লক্ষণ আমাদের ঘরবাড়িতে আমাদের বেশভূষায় চারিদিক থেকে ফুটছে যা দেখে’ দেখে’ আমরা সময়ে সময়ে ভয় পেয়ে বলি বুঝি আর্টের সঙ্গে আপনাদেরও হারাতে বসেছি আমরা। ঠিক এই কথাই একদিন হয়তো বলেছিলেম আমরা মোগল আমলে এবং তার পূর্বে ও তারো পূর্বে—‘পরধর্মো ভয়াবহঃ’; কিন্তু ভয়ের মধ্য দিয়ে তবে আসে অভয়রূপ আশীর্বাদ—এই সত্য এখনো দেশের শিল্পীরা সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি দিয়ে ঘোষণা করছে, যুগ যুগ আগেও কৃষ্ণবর্ণোদ্ভবা শ্বেতবর্ণ ঊষা ভারতবাসী আর্যশিল্পীদের রচনার মধ্য দিয়ে ফুটেছে কতবার। রাধা শ্যাম ভিন্ন এবং এক, গোচর রূপ এবং অগোচর রসরূপ দুই মিলে’ এক—এ কথা বর্ণে বর্ণে অক্ষরে অক্ষরে সত্য করে’ তুলেছে আর্য এবং অনার্য দুয়ে মিলে নিজেদের শিল্পে। ভারতশিল্পের সূত্র হ’ল এই—রূপের সঙ্গে রূপাতীত এক হ’য়ে গাঁথা। যুগে যুগে একটি একটি যুগচিহ্ন যা আমাদের শিল্পের ধারা রেখে গেল ফেলে দেশের উপরে তার প্রত্যেকটি এই সূত্র ধরে’ রইলো। “সব মূরত বীচ অমূরত", মূর্তের সঙ্গে মিলিয়ে রইলো অমূর্তও। গাছের ফুল হাতের সূতোয় মিলে’ হ’ল এক গাছি মালা, মানব শিল্পী আর দেব শিল্পী দুয়ের মিলনে হ’ল রসরচনা, এ সব কথা কবীর যিনি মুসলমান হয়েও আর্য্য তিনিও বল্লেন, ঋষি যিনি আর্য হয়েও অনার্য তিনিও বল্লেন।