বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/রূপ
রূপ
রূপের ভেদাভেদ জ্ঞান ও রহস্য প্রকাশ হ’ল কায আর্টিষ্টের, এই জন্যে ‘আর্টিষ্ট’ কথার ঠিক প্রতিশব্দ হ’ল ‘রূপদক্ষ’। কুঠার ঠিকরূপে গড়া হ’ল তবেই সে কাটলে ঠিক মতো। প্রথম আর্টিষ্ট যখন কুঠার গড়লে তখন সে কুঠারের বাইরের আকৃতিটা ও মান-পরিমাণ হয়তে এক রকম দিলে, কিন্তু যে ধাতুতে কুঠার গড়লে ঠিক কাটবে কুঠার জলের মতো সেটুকুর জন্যে অনেক দিন ধরে’ অনেক রূপদক্ষের জন্মানো এবং মরার অপেক্ষা ছিল এ কথা ঠিক। শুধু এই একটি মাত্র কুঠার রূপ নয় নানা প্রহরণ তারি নানা রূপভেদ এও এক এক আর্টিষ্ট এসে দখল করলে যুগে যুগে—ক্ষুরপ্র বাণ অর্ধচন্দ্র বাণ শিলীমুখ কত কি রূপের ভেদ। বাঁশপাতা গাছের কাটা পাখীর পালক সবাই উপদেশ করলে রূপভেদের। রূপটি ঠিক হ’ল তবেই চললো তীর ঠিক লক্ষ্য স্থান ভেদ করতে। রূপটি এমন হ’ল সে এমন করে বিঁধলে, অমন হ’ল রূপ বিঁধলে তেমন করে’। সহজ কথা—সুরটি ঠিক বসলো গলায়, রাগটি পেলে ঠিক রূপটি, ছন্দ পেলে ঠিক কথা, কথা পেলে ঠিক ছন্দ—কবির কল্পিত রূপটি ঠিক ফুটলো তখন। উপযুক্ত রূপ অনুপযুক্ত রূপ এ কথা আর্টে খাটে কিন্তু স্বরূপ কুরূপ বলে’ স্বতন্ত্র দুটো রূপ আর্টিষ্টের কাছে নেই; তার কাছে আছে শুধু নানা রূপ—কোনটা এ কাযে উপযোগী সে কাযে অনুপযোগী এই রকম। যেমন বাঁকাকে নিয়ে তীর গড় চল্লো না, তীরের অনুপযোগী সে, আবার ধনুকের বেলায় বাঁকাই যত বাঁকলো ততই দেখতেও হ’ল চমৎকার, কাযও দিলে সুন্দর। তীর সোজা ধনুক বাঁকা—সোজাতে বাঁকাতে মিলন, একই ক্ষেত্রে রূপের ভেদ ও অভেদ। এমনি ভেদাভেদ সে সঙ্গীতে সে কবিতায় রূপ ধরে’ প্রকাশ পায় কথার মারপেঁচ সুরের ঘোরপেঁচ নিয়ে। বাঁকা দিলে এক রূপ, সোজা দিলে অন্য, বাঁকায় বাঁকায় মিলে এক রূপ, সোজায় বাঁকায় মিলে অন্য,—এমনি নানা ভেদ রূপের। মেঘের উপরে ইন্দ্রধনু—সে একটি মাত্র রঙীন আলোর বাঁক, তার সঙ্গে আর একটা উপযুক্ত রকম সোজা তীর তো জোড়া হ’ল না, শুধু আলো অন্ধকার রৌদ্র ও মেঘের ভেদাভেদ নিয়ে সুন্দর ফুটলো রূপটি বর্ণপ্রধান ও বাঁকা। সমুদ্রতীরে রূপের ভেদাভেদ শব্দ ধরে’ ফুটলো আর স্থিতি ও গতি ধরে’ ফুটলো ঠিক সঙ্গীতের মতোই আকাশ—নিস্তব্ধ নিথর নীল এবং সমুদ্র—সচল সশব্দ নীল।
সূর্যের কিরণচ্ছটায় বাঁকায় সোজায় মিলিত রূপ, গাড়ির চাকায় বাঁকার কোলে সোজা। ঢেউয়ের পরে ঢেউ সেখানে বাঁকায় বাঁকায় মিলন, সারি সারি তালগাছে বৃষ্টিধারা পড়ছে অবিশ্রান্ত—সোজায় সোজায় মিল। রূপের ঘেরে বন্দী আমরা গোড়া থেকেই, এই বাঁধন থেকে মুক্তি হচ্ছে রূপমুক্তির সাধনা রূপকারের।
যে রূপ সমস্ত নিয়ে রূপকারের কারবার তারা বাঁধা রূপ, আর্টিষ্ট তাদের মুক্তি দিলে তবেই তারা পথ পেলে মন থেকে মনে চলাচলি করবার। রূপ-সাগরের তলায় সুপ্তি দিয়ে বন্ধ করা রূপকথার রাজকন্যা, রূপ-মুক্তির সাধনা হ’ল তাকে জাগিয়ে আনা। রেখা মুক্তি পেলে তো রঙ ধরে’ বাঁধা রূপের প্রাচীর টপকে সে ভাবরাজত্বে পালালো বন্দী।
কথা থাকে অর্থ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, কবি তাকে মুক্তি দেন তবে জানায় সে বেদনা গুঞ্জন করে’ ভ্রমরের মতো হৃদয়পদ্মের পাপড়ি খোলাতে, তখন আর শুধু থাকে না কথা আর তার অভিধান দোরস্ত মানেটা। যেমন এই ‘বাচ্ছা’ কথাটিতে সে সর্বজীবে সর্বকালেই বাচ্ছা এইটেই বুঝায়, কিন্তু এই বাচ্ছারূপী কথাটি মুক্তি পেলে যেমনি বলা হ’ল বাছা বাছনি। যেমন জুতো সে মুক্তি পেলে বাঁধা রূপ থেকে জুতুয়াতে, পাট—পট্ট—পট একই কথা কিন্তু রূপ দেখায় স্বতন্ত্র, তেমনি অসংখ্য কথা ছাড়া পেয়ে গেছে ও যাচ্ছে কবির হাতে বদ্ধ রূপের শিকল কাটা পাখী সমস্ত।
সঙ্গীতে স্বরমালা সাত রাজার ধন সাতটি মাত্র, কিন্তু সাতাশ লক্ষেরও বেশি রূপ পেয়ে ঝলক দেয় সাত সুর—গুণীর কণ্ঠে অপূর্ব সাতনরী হার। উৎসঙ্গে লীনা বীণা সে মুক্তস্বরা, তাকে পরিত্যাগ করে’ নির্গুণ যখন চলেন একটা বাক্সে বাঁধা সারগমের অচল ঠাটের মধ্যে গলাটা বলিদান দিয়ে গান গাইতে, তখন রাগ রূপ সমস্ত তারা মুক্তির স্পর্শ পায় না কিন্তু ছাঁদ পায় বাক্সের ও সিন্দুকের, তেমনি এই য়্যানাটমির কিংবা ফটোযন্ত্রের বাক্সের মধ্যে হাতের টান ও মনের পরশ মিলিয়ে টানার কথা—সে সব রঙ রেখা তাদের যখন ঢালাই হ’তে দেখি তখন দেখি রূপ পাচ্ছে য়্যানাটমি ও পার্স্পেক্টিভ কিন্তু পরশ পাচ্ছে না একটুকুও মুক্তির।
যখন প্রাচীন প্রথার মধ্যে কিংবা আধুনিক কোনো বাঁধা প্রথায় রূপকে ঢালাই হ’তে দেখি তখন আমার আতঙ্কের সীমা থাকে না—জলের মাছকে বঁড়শী দিয়ে গেঁথে হাঁড়ির মধ্যে মুক্তি দেওয়ার মতো ঠেকে ব্যাপারটি। রূপ-সাধককে এই রকমের নিষ্ঠুর খেলা খেলতে হয় শুধু রূপবদ্ধ হ’লে কি হয় আর ছাড়া পেলেই বা কি হয় তা জানার বেলায়, কিন্তু রূপ সমস্তকে রসের স্পর্শে মুক্তি দেওয়াতেই রূপদক্ষের আনন্দ ও চরম সার্থকতা এ কে না বলবে!
একটা মাটির ঢেলা এক চাংড়া পাথর তাদের রূপ নিরেট করে’ বাঁধা নিয়তির নিয়মে—একেবারে সুনির্দিষ্ট রূপ, কিন্তু সেই ঢেলা আর পাথর রূপদক্ষের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে যখন আসে অপরূপ সব মূর্তি ধরে’, তখন মানুষ তার পূজো দেয়, তাকে প্রেমালিঙ্গন দেয়, খেলা করে মাটি পাথর মানুষের সঙ্গে। পাষাণ দিলে বর অভয়, পাষাণ দিলে ভিজিয়ে মন—এ অঘটন কি ঘটতো যদি না সুহস্ত রূপদক্ষ তাঁরা পাষাণকে তার জড়ত্বের কঠিন কারাগার থেকে মুক্তি না দিতেন! অনড় পাথর নটরাজ মূর্তিতে নাচলো, অচেতন পাষাণ সে চেতনার স্পর্শে আর এক জীবন্ত সুন্দর মূর্তির মতোই চমকে উঠলো থমকে দাঁড়ালো। নবজীবন দিলে রূপদক্ষ তাদের। যেখানে আলো সেখানে অন্ধকার যেখানে সোজা সেখানে বাঁকা, জড় পাষাণের কাঠিন্যের সঙ্গে মেশা সজীবতার তারল্য, এই ছন্দ রূপের জগতে মানুষ প্রথম এসেই লাভ করেছে সহজে, এই বাতাসের মতো সহজে। এ ছন্দ ভাঙলেই সর্বনাশ! এই কাঠিন্য এবং তারল্যের ছন্দে গাঁথা মানুষের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবটাই। দূরের পাহাড় সে জানায় এই ছন্দটি। চাঁদ সে আলো অন্ধকারের ছন্দ ধরে’ সুন্দর, রাত্রি ঘিরে’ আছে তবেই পূর্ণ চন্দ্রের রূপ আছে, প্রতিপদের চাঁদ সে আর এক ছন্দ ধরে’ মনের আকাশে ভাবরূপে বিদ্যমান হ’ল—সে আছে অথচ নেইও। এই ছন্দ। ছবিতে মূর্তিতে কবিতায় গানে শুধু ফুটন্ত রূপ নিয়ে কারবার নয় আর্টিষ্টের—দেখা না-দেখা দুই রূপ মিলে তবে ছন্দোময় হয় কায। ফটোগ্রাফ শুধু দৃশ্য রূপের মধ্যে বদ্ধ, কাযেই ছন্দ ছাড়া রূপ দিয়ে চলে সে। রেখার কাঠিন্য ও রেখার তারল্য—এই নিয়ে অঙ্কনের ছন্দ, সুরের কাঠিন্য মিল্লো গিয়ে মীড়ের তারল্যে এই হ’ল গায়নের ছন্দ। সবদিকেই রূপ দেবার বেলায় এই ছন্দ না ধরে’ উপায় নেই।
“চক্ষুর্গ্রাহ্যং ভবেদ্রূপম্” কিংবা “ননু রূপাণি পশ্যন্তি”। দৃশ্য রূপের কঠিন অংশের সম্বন্ধে একথা খাটলো, কিন্তু যে সব রূপ মনে গিয়ে পৌঁছচ্ছে চোখে পড়ছে না, কিন্তু অনির্বচনীয় স্পর্শটুকুর উপরে যার নির্ভর এমন সব তরল রূপ? তার বেলায় মনশ্চক্ষু প্রাণরসনা ইত্যাদি না নিয়ে সেখানে কায চল্লো না। রূপের এই রহস্য জেনেই বাউল কবি বলেছেন—
“চোখে দেখে প্রাণে ঠেকে ধূলো আর মাটি
প্রাণ রসনায় দেখরে চাইখ্যা রসের শাইখ্যাটি!”
চোখে দেখি এক রূপ প্রাণে দেখি অন্য রূপ এই হ’ল রূপের দুই প্রকাশ। দৃষ্টির পথে যেমনি চোখোচোখি অমনি অভিসার রসরূপে মানসকুঞ্জে। হয়তো সে একটি রূপ যৌবনে পরিপূর্ণ, হয়তো সে একটি রূপ ন্যুব্জ কুব্জ জরাজীর্ণ, হয়তো সে একটি গাছের তলায় হরিণশিশু, হয়তো সে একটা ছাতা মাথায় ব্যাঙ, কিন্তু দৃষ্টিপথ ধরে’ মনে পৌঁছোলো কি সেটি রসের বস্তু হ’ল রূপদক্ষের কাছে—
“সই কিবা সে সুন্দর রূপ
চাহিতে চাহিতে পশি গেল চিতে
বড়ই রসের কূপ।”
মানুষের মন বা চিত্তপট তো ক্যামেরার প্লেট নয় যে চোখ খুল্লেই ধরলে ছবি বুকে, কার কাছে কি যে মনোরম ঠেকে, কোন রূপটা কখনই বা প্রাণে লাগে তার বাঁধাবাঁধি আইন একেবারেই নেই; কিন্তু মনে না ধরলে সুন্দর হ’ল না, মনে ধরলে তবেই সুন্দর হ’ল—এ নিয়ম অকাট্য। ‘মনের মানুষ মনের মতো ঘরখানিতে’—এ তো কথার কথা নয়। রূপের ঠাট এক বাইরের মতো আর এক মনের মতো, ফটো দেয় বাইরের ঠাট রূপদক্ষ দেন মনোমত রূপের ঠাট সমস্ত।
উটের কিম্বা পেঁচার ও ব্যাঙের বাইরের ঠাট বিধাতার মনোমত হ’লেও সাধারণ লোকে দূর দূর করলে দেখে’। তবেই বলি সাধারণ মানুষের মনোমত হবার মতো রূপ পেলে না তারা, কিন্তু রূপদক্ষের রূপসৃষ্টির নিয়ম—যা হ’ল নিয়তিকৃত নিয়ম থেকে স্বতন্ত্র—তার রসে উটের রূপ পেঁচার রূপ ব্যাঙের রূপ সুন্দর হ’ল মনোমত হ’ল সুন্দর তাকে ব্যঙ্গ করলে না একজনও।
একটা ক্যামেরা সে রূপকে ধরে’ নেয় ঠিক কিন্তু রূপসৃষ্টির নিয়ম সে মানে না, পদার্থবিদ্যার জল বাতাস আলো ছায়ার অকাট্য নিয়ম মানে। তবুও সে কি ঠিক উট-পেঁচাটাই ঠিক ভাবে দেয়?—সৃষ্ট রূপের একটা একটা অপদার্থ নকল দেয় মাত্র। নিয়তির নিয়মে সৃষ্টির কিছুতে পুনরুক্তি হ’তে পারে না। কিন্তু কল সে বিজ্ঞানসম্মত নিয়মে এক জিনিসের হাজার হাজার পুনরুক্তি করে’ চলেছে সুতরাং এ হিসেবে সে নিয়ম লঙ্ঘন করছে কিন্তু স্বতন্ত্র কোনো এমন একটা নিয়ম নেই তার যার দ্বারা রূপসৃষ্টি করতে পারছে সে।
নিয়তিকৃত নিয়ম থেকে স্বতন্ত্র অথচ নিয়তির নিয়ম থেকেই নেওয়া সমস্ত রূপকারের কারিগরির নিয়ম। পাষাণ তার একটা আকৃতি আছে বর্ণও আছে কাঠিন্য ইত্যাদি গুণও আছে কিন্তু চেতনা নেই, সুতরাং তার সুখ দুঃখ মান অভিমান কিছুই নেই—এই হ’ল নিয়তির নিয়মে গড়া সে পাষাণ, কিন্তু রূপদক্ষের কাছে পাষাণী অহল্যা নিয়তিকৃত নিয়মের থেকে স্বতন্ত্র নিয়মে যখন রূপ পেলে তখনো সে পাষাণ কিন্তু তার সুখ দুঃখ মান অভিমান জীবন মৃত্যু সবই আছে। যে মাটির খেলনা গড়লে সে মাটিকে জড়তা থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষের খেলার সাথীরূপে ছেড়ে দিলে।
পাষাণে গাঁথা গোঁসাঘর তার মধ্যে ধরা রূপবান রূপবতী, হাতুড়ির ঘায়ে তবে ভাঙে সে গোঁসাঘরের দেওয়াল, তারপর পাথরের মান ভাঙাতে অসাধ্য সাধন। মাটির দেওয়াল, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে রূপ; সেও অভিমানে জলাঞ্জলি দিয়ে সহজে কি বেরিয়ে এল? সোনা সে কি কম জ্বালালে আর্টিষ্টকে? হীরক যাকে বল বজ্রমণি সে বজ্রের মতো দুর্জয়, তাকে মানিয়ে তবে দিতে হ’ল হীরের ফুল ফুটিয়ে। বিধাতার নিয়মে বাঁধা রূপজগৎ তার মধ্যেই আর একটা জগৎ যেটা আপনার নিয়মে চলেছে অথচ সেটা সত্যকার রূপজগৎ—বিশ্বামিত্রের ব্যাসকাশীর মতো ভূয়ো জগৎ নয়, সেখানে সত্য রূপ সমস্ত বিধাতার নিয়মকে কোথাও মেনে কোথাও বা আর্টের নিয়মকে ধরে’ সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন এই গাছ একে দিলেন নিয়ন্তা এক রূপ, যেমন সেই গাছ তাকে দিলে কারিগর টেবিল কেদারা নৌকো বাড়ীর কত কি রূপ,—একা নিয়তির নিয়মে গড়াই হ’তে পারে না মানুষের চৌকি টেবিল বাক্স তোরঙ্গ।
আলঙ্কারিকেরা এই রকমের শিল্পকার্য সমস্তকে বলেছেন বন্ধচিত্র। দুই সৃষ্টিকর্তার নিয়ম স্বীকার করে’ তবে হয়েছে টেবিল চৌকি সোনারূপার অলঙ্কার ইত্যাদি ইত্যাদি। উনি দিলেন মাত্র কাঁচা সোনাটুকু, ইনি দিলেন পাকা সোনার কর্ণফুলের রূপ লাবণ্য ভাব ভঙ্গি সবই; উনি দিলেন কাঁঠাল গাছ, উনি দিলেন কাঁঠাল কাঠের রাজ-তক্ত। এমনি দুই আর্টিষ্ট মিলে’ হ’ল গঠন সমস্ত। এই জন্য বলা হ’ল বেদে—আমাদের শিল্প দেবশিল্পীর অনুরণন দেয়। এ-শিল্পীর ও-শিল্পীর বন্ধুতার ফলে হ’ল এই সব নানা প্রবন্ধে নানা ছন্দে দেওয়া রূপ সমস্ত, শুধু নিয়তির নিয়ম লঙ্ঘন করেই হয় না আর্টের জগতে রূপসৃষ্টি। মনে ক’রো না যেই টেবিল চৌকি গড়ে সেই হ’য়ে ওঠে দ্বিতীয় স্বষ্টিকর্তা; কেননা রূপ-সাধন সে সহজ সাধনা নয়। কোন চৌকিতে বসলেই উঠি উঠি মন করে, কোন কেদারা এমন আরামের যে বসতেই শ্রান্তি দূর, সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রার আবেশ।
ফুটবল খেলা দেখতে মত্ত থাকি বলেই বুঝতে পারিনে ফুটবলের চার আনার বেঞ্চ একজন রূপদক্ষে গড়েনি—সে প্রায় সৃষ্টিকর্তার কাঠখানাই বেঞ্চ বলে’ চালিয়ে বঞ্চনা করছে দর্শকদের।
রূপদক্ষ নিজের মনোমত রূপটি রচনা করেই খালাস, যে রূপ দেখবে তাদের কথা রূপদক্ষকে একেবারেই ভাবতে হয় না—এ একটা কথাই নয়। আমার যা খুসি রেঁধেই খালাস তুমি খেয়ে দূর ছাই কর তাতে এল গেল না—এ কোনো ভাল রাঁধুনীই বলে না। আমার মনোমতকে দশের ও দশ হাজারের মনোমত করে’ দিলেম—এতেই আনন্দ হ’ল রূপদক্ষের।
রূপ দেবার শত সহস্র নিয়মের যে দেখা পাই রূপবিদ্যার চর্চার বেলায় তার কোন প্রয়োজনই ছিল না যদি না রচনা সমস্তকে তোমারো মনে ধরাবার দরকার হ’ত। ছেলে কাদা নিয়ে খেলে, কত গড়ন গড়ে সেও, কিন্তু রূপের কোন নিয়ম তার কাছে নেই, সে যথেচ্ছা গড়ে’ চলে কিন্তু সেও থেকে থেকে কোনো একটি দর্শকের তারিফ পেতে কায হাতে ছুটে আসে। কাজেই দর্শক ও প্রদর্শক চাই-ই থাকা।
বড় বড় কবি ও রূপদক্ষ নট ও পট-রচয়িতা তাদের কথা ছেড়ে দিই, যে লোকটা ছেলে খেলানোর পুতুল গড়ছে—বাঘ ভালুক সাহেব মেম পশুপক্ষী হাঁড়িকুঁড়ি কত কি—সেই যে পুতুলওয়ালা সে তো যথেচ্ছা গড়ছে না, ছেলে ভোলে কিসে এ তার স্মরণে রয়েছে অথচ তাকে নতুন নতুন রূপ দিতে হচ্ছে নিজের মতে। ছেলের একটি ফোঁটা প্রাণ কিন্তু বিশ্বরূপকে নিয়ে খেলার ইচ্ছা তার,—সে হাতী চায়, ঘোড়া চায়, পাখী চায়, বাঘকে চায়, শেয়ালকে চায় খেলার সাথীরূপে পেতে, কিন্তু সত্যি জানোয়ার দেখে’ সে ডরায়, ভারি খেলনা হ’লে তুলতে ও টানতে হয় শিশুর প্রাণান্ত, কাচের পুতুল নিয়ে খেলতে গেলে সে হাত পা কেটে বসে, এক খেলনা নিয়ে বেশিক্ষণও সে ভুলে’ থাকে না—নতুনের প্রেমে পাগল তার নতুন জীবন, সবই তার বিস্ময় জাগায়।
রূপ মান প্রমাণ ভাব ভঙ্গি সাদৃশ্য বর্ণ লাবণ্য কোনো দিক দিয়ে অনুকৃতির নিয়মকে মানা চল্লো না এখানে রূপদক্ষ খেলনাওয়ালার। বাঘ ঠিক বাঘ হ’লে চল্লো না, এমন একটি রূপ দিতে হ’ল পুতুলকে যা বল্লে—আমি বাঘ বটে কিন্তু খেলাতে এসে যোগ দিতে পারবো এমন বাঘ আমি। লঘুভার চমৎকার বাঘ যাকে দেখতে বাহার, খেলতে মজা যার সঙ্গে,—এই হ’ল তো ছেলে ভুল্লো, নচেৎ নয়। আইনও হ’ল এই সব ক্ষণভঙ্গুর পদার্থ দিয়ে খেলনা প্রস্তুতের।
মূর্তি-শিল্পের চরম হ’ল যেখানে পাষাণে দেবতার আবির্ভাব হ’ল। এই সব আর এক প্রস্থ বুড়ো বয়সের খেলনা। পুতুল গড়ার নিয়ম সেখানেও খাটলো অনেকখানি, তফাৎ শুধু হ’ল মাপের দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কোথাও কোথাও। ছেলের খেলনা হালকা, বুড়োর খেলনা ভারি, এটা ছোট মাপ, ওটা নবতাল দশতাল এমনি তাল তাল রূপ—এই যা তফাৎ। বালির স্তূপ গড়লে ছেলেতে আর পাথরের স্তূপ গড়লে বৌদ্ধ রাজা—সাজের বাহুল্য এবং রূপের সমাবেশ ইত্যাদি নিয়ে আরো অনেকখানি পরিপূর্ণ হ’ল বৌদ্ধ স্তূপ কিন্তু রূপটা রইলো সেই ছেলের গড়া বালির স্তূপেরই।
প্রতিকৃতি অনুকৃতি এ সবের স্থান আছে রূপবিদ্যার মধ্যে, এদের জন্য স্বতন্ত্র নিয়ম আছে—তারা হ’ল রূপকে শত শত বার পুনরাবৃত্তির নিয়ম। রূপদক্ষের সৃষ্টি যার পুনরাবৃত্তি নেই তার নিয়ম সমস্ত স্বতন্ত্র নিয়তিকৃত নিয়মরহিত নিয়ম বা খেলনা গড়ার নিয়মও বলতে পারো তাকে।
নিয়তির নিয়ম হ’ল বিধাতার নিয়ম, আর নিয়তির নিয়ম থেকে খানিকট স্বতন্ত্র নিয়ম হ’ল আর্টের নিয়ম। কিন্তু একেবারে যে নিয়তির নিয়ম লঙ্ঘন করলে সে আর্ট রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শ নিরপেক্ষ আর্ট—হয়তো আছে হয়তো নেই। দুই সৃষ্টির নিয়মকে মানিয়ে যে আর্ট তাই নিয়েই রূপদক্ষের কারবার। একটা মাটির খেলনা তাকে ছেলের সাথী হবার উপযুক্ত করে’ ক্ষণিকের জীবন দিয়ে ছেড়ে দিলে আর্টিষ্ট, একটা পাথরের দেবমূর্তিকে আরো বেশি পরমায়ু দিলে আর্টিষ্ট—কেননা যুগ যুগ ধরে’ মানুষের সঙ্গে খেলার সম্পর্ক পাওয়া চাই তার। ঠিক এই নিয়ম দেখি বিধাতারও সৃষ্টির মধ্যে কায করছে। নক্ষত্র একটা গড়লেন বিশ্বকর্মা—যুগ যুগ ধরে’ ফুলঝুরি জ্বালিয়ে খেলে চল্লো সে, একটা খদ্যোত গড়লেন তিনি—ক্ষণিক খেলার অবসর পেলে সে বিধাতার কাছে। আর্টিষ্টও ঠিক এর জবাব দিলে, ঘরের মধ্যে তার সে ঘরের প্রদীপ তারার মতোই জ্বল্লো—শুধু রূপটি পেলে সে ক্ষণিকের।
বিধাতার গড়া প্রজাপতি সে খেল্লে ক্ষণিক, আর্টিষ্টের গড়া পাষাণ সুন্দরী সে যুগ যুগ ধরে’ খেলতে লাগলো, মামুষের ঘরে সোনার কাটায় বেঁধা প্রজাপতি শোভা ধরলে—একের পর এক যারা সুন্দরী জন্মালো তাদের খোপায় উড়ে বসলো সে বিয়ের আগে। দেবতার সভায় বাজলো মেঘের বাদল, আর্টিষ্টের সভায় বাজলো মাটির মাদল। গাছ সে ফুল সেজে ইসারায় জানালে—আমি গাছ নয়, আমি সবুজ সাড়ি পরে’ বনদেবী, আর্টিষ্টের হাতের বীণা সে সুরের সাজে সেজে বল্লে আমি কি শুধু বীণাই, আমি পরিবাদিনী সুন্দরীও বটে। এমনি নিয়ন্তাতে আর রূপদক্ষে বাজিখেলা রূপসৃষ্টি নিয়ে। খেলার সময় যেমন তাসগুলো হাত বদল করে তেমনি এই রূপস্থষ্টির লীলা খেলতে নিয়তির নিয়মগুলো আসা যাওয়া করে আর্টিষ্টের হাতে বার বার। এই নিয়ম সমস্ত জানার জন্যই Nature study করতে হয় আর্টিষ্টকে, না হ’লে শুধু নিজের নিয়মে চল্লে খেলা চলে না ঘুরে’ ফিরে’ অনেকক্ষণ।
অক্ষর-মূর্তিতে কতক, শব্দরূপে কতক, স্পর্শরূপে কতক—এমনি ভাবে রূপ সমস্ত ধরা দিচ্ছে আমাদের চেতনায়, আবার এই তিনে মিলিয়ে একটা রূপ তাও পাচ্ছি আমরা। আকাশের তারা থেকে আরম্ভ করে’ সমুদ্রের তলায় শুক্তির মধ্যেকার মুক্তা সবই বিধাতার স্বাক্ষরিত রূপ। মিশরের মরুভূমির মাঝে পিরামিড সেখান থেকে সমুদ্রের বুকে যে লাইট-হাউস সমস্তই মানুষের স্বাক্ষরিত রূপ তারা। বিদ্যুল্লেখা একেবারে সোনার জলে টানা অক্ষররূপ, তার অনুগামী বজ্র একেবারে শব্দ দিয়ে গড়া সে। কোকিলের কুহু—শব্দরূপ মাত্রে বসন্তশ্রী রইলেন সেখানে, মলয় বাতাস স্পর্শরূপ পরিমল-রূপ তাঁর। বর্ণরূপা যাঁরা তাঁদের স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের হিসেবে অক্ষর-মূর্তির কোঠায় ফেলা চল্লো। এই ভাবে শুনে’ দেখা যায় ছুঁয়ে দেখা যায় চোখ বুলিয়ে দেখা যায় রূপ আর রূপের সমস্ত ইঙ্গিত ও আভাস।
পুতুলওয়ালা দুয়ারে পা দিয়েছে অমনি ছেলে ছুটেছে তার দিকে রূপের টানে,—সহজে গড়া পুত্তলিকা তাদের আকর্ষণ কতখানি! ছেলে কাঁদে পুতুল চেয়ে, ছেলে খায় না ঘুমোয় না পুতুল না পেলে, মায়ের কোল ছেড়ে পালায় শিশু—এমন আকর্ষণ রূপের। বিধাতার সৃষ্টিতে এক আগুনের এই ধরণের আকর্ষণ—পাখীকে টানে পতঙ্গকে টানে, দলে দলে মানুষ জড়ো হয় রূপ দেখতে। পুত্তলিকার আকর্ষণের মতো এমন বিরাট আকর্ষণ সেটা কি কুড়িয়ে পায় মানুষ? পুতুল গড়ার নিয়ম আর অগ্নিশিখার নিয়ম কিন্তু একটু স্বতন্ত্র। আগুনের আকর্ষণের শেষে ভীষণ নিরানন্দ, পুতুলের আকর্ষণের শেষে আনন্দ। যে পুতুল গড়ে সে বুড়ো, যে পুতুল খেলে সে ছেলে, রূপের ছাঁদে দুয়ের মিলন; আর ঐ বিশ্বকর্মা যিনি তারা গড়েন আর যে তারাবাজি পুড়িয়ে খেলে তাদের মিলন রূপের ছন্দে।
জগন্নাথের মন্দিরে একটা ঘর দেখেছি পুতুল দিয়ে ঠাসা—সৃষ্টির পশু পক্ষী জীবজন্তু গাছপালা গড়ে’ গড়ে’ ধরেছে সেখানে। পাল-পার্বণে এই সব পুতুলের ডাক পড়ে রাস দোল কত কি খেলার—দেবতায় মানুষে পুতুলে বেধে যায় রঙ্গ তারপর খেলায় শেষে রূপ সমস্ত যে যার স্থানে চলে’ যায়। ছেলে যতদিন ঘরে নেই ততদিন খেলনার আলমারিতে বন্দী সমস্ত পুত্তলিকা রূপ তারা বড় দুঃখেই আছে দেখি, যেমনি ছেলে এল আর রক্ষে নেই পুতুলগুলো হাঁফ ছেড়ে বল্লে—যাক্ বাঁচা গেল, এইবার খেলে’ যাবার অবসর এল। এমনি রূপ সমস্ত দিকে দিকে জলে স্থলে আকাশে বন্দী থাকে—আর্টিষ্টকে খোঁজে তারা সবাই, তাদের নিয়ে লীলা করবে এমন এক এক জন খেলুড়ি আর্টিষ্টকে খুঁজে ফিরছে বিশ্বজোড়া রূপ সকলে। সেই বিক্রমাদিত্যের আমলে একটা শুকনো গাছ—মাঠের ধারে সে অপেক্ষা করছিলো যে তাকে নিয়ে একটিবার সত্যি সত্যি খেলবে তার জন্য। রাজা গেলেন পথ দিয়ে, দেখলেন শুকনো গাছ। রাজার সঙ্গেই রাজকবি—তিনি কবি নয় কিন্তু পদ্যে কথা বলেন—তিনি পদ্যে বল্লেন—‘এ যে দেখি শুষ্ক কাঠ’। ভাগ্যি ছিলেন সঙ্গে সত্যিকার কবি ও খেলুড়ি, তিনি বলে’ উঠলেন—‘কি কও শুকনে কাঠ?’
‘ও সে তরুবর রসের বিরহে—
হুতাশে দহে!
একটি ছেলে দেখলে শুকনো কাঠ নয়—সে ঘোড়া, সে মানুষ, সে কত কি? একজন কবি দেখলেন শুকনো গাছ নয়—রসের পাত্র সেটি, ছেলে করে রূপের আরোপ, কবি করেন রূপের আবির্ভাব শুকনো কাঠে। ছেলে রূপ আরোপ করলে যখন, তখন সে যা চায় তাই হ’ল—সেই শুকনো কাঠের শুকনো কাঠ থাকা চল্লো না, ঘোড়া মানুষ কত কি হ’তে হ’ল। ছেলে সে স্বমতে চল্লো, কাঠ রাখলে না গাছও রাখলে না—একে বলা চল্লো স্বারোপক রূপ। কবি যখন শুকনো গাছকে তরুবর বলে’ দেখালেন তখন তিনি একটা ইচ্ছামতো রূপের আরোপ করলেন গাছে এ কথা বলতে পারিনে, কেননা, ‘রূপারোপাৎ তু রূপকম্’—এই কথা পণ্ডিতেরা বলেছেন। এখানে রূপের আরোপ হ’ল না রূপের নষ্ট হয়েছিল যা তা পুনর্বার ফিরে’ এল রূপে। সুতরাং একে বল্লেম স্বরূপক রূপ। এই দুই নিয়মই খাটলে রূপসৃষ্টির কাযে।
কথা দিয়েই লিখি ছবি দিয়েই কি সুর দিয়েই বলি গাছটিকে খানিক শুকনো কাঠ বলে’ জানালেম তো কাঠুরের কাযে এলো খবর, রসিকের তাতে কি এল গেল? শুকনো গাছের আশা নিরাশা—কত বর্ষায় তার পাতায় পাতায় ভরে’ ওঠার স্বপ্ন, কত শীতে তার পাতা ঝরানোর গান, কত বসন্তে তার ফুলদোলের স্মৃতি সব কথা জড়িয়ে থাকে মরা গাছেও, কত পাখীর আসা যাওয়ার খবর কত ছায়ার মায়া দিয়ে গড়া তার পরিপূর্ণ রূপ—তাই যদি না ধরা পড়লো রূপদক্ষের মায়াজালে তবে কি হ’ল?
কাঠুরে এবং তুমি আমিও দেখবো শুকনো কাঠ কিন্তু রূপদক্ষ যে সে দেখবে করুণ রসে সিক্ত বিরস বনস্পতিকে জীবন্তবৎ—এই হ’ল নিয়ম। না হ’লে সমালোচক সেও যে পড়ে’ যায় রূপদক্ষের কোঠায়!
রূপ প্রকাশের পূর্বে তিন অবস্থার মধ্য দিয়ে চল্লো—ঘটিত অবস্থা, লাঞ্ছিত অবস্থা, রঞ্জিত অবস্থা। চলিত কথায় আমরা বলি সাদামাটা অবস্থা, ছকা অবস্থা, রাঙ্গানো অবস্থা।
সাদামাটা অবস্থায় ঘটনা রয়েছে দ্রষ্টার অগোচরে আর্টিষ্টের মনে এবং সাদা কাগজে সাদা পাথরে সোনার তালে মাটির স্তূপে। খানিকটা গোচর হ’ল রূপ যখন নানা দাগদোগ মাপজোখ নিয়ে একটা কাঠামো পেলে ঘটনাটি, তারপর আলো ছায়া রঙ বেরঙে রঙিয়ে উঠলো সমস্ত ঘটনাটি—এই নিয়ম ধরে’ রূপের প্রকাশ আর্টে। যেন বৃন্ত হ’ল কলি জাগলো ফুল ফুটলো পরে পরে।
কিম্ভূতম্ আর কিমাকারম্—Grotesque আর Caricature—বৈরূপ্য শিল্পের এ দুটো প্রকাশ। কিম্ভূত যে সমস্ত রূপ এবং কিমাকার যে সমস্ত রূপ দুয়ের মধ্যে এক আইন কায করছে না। যেখানে রেখা সমস্ত আকৃতি পাবার বেলায় একটা নিয়ম ধরে’ বাঁকছে সোজা হচ্ছে—মানুষ পাচ্ছে গাছের রূপ, আধা মানুষ আধা গাছ রূপ, নরসিংহরূপ, অর্ধনারীশ্বর রূপ, কিন্নর রূপ—ভূষা ও মণ্ডন শিল্পের নিয়ম এবং ছন্দ ধরে’ রেখা রঙ সবই সেখানে প্রকাশ পাচ্ছে এবং রূপটি সেখানে একটা ভবিতব্যতা স্বীকার করছে, সেখানে সেটিকে বলা চল্লো কিম্ভূতরূপ বা Grotesque রূপ। Caricature বা কিমাকার সে এক আকৃতির বৈরূপ্য করা ছাড়া আর কোনো কিছু করছে না বা Grotesque অর্থাৎ কিম্ভূতের মতো মানানসই রূপও দিচ্ছে না। বেমানান অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রেখা রঙ সমস্ত দিয়ে বেমানান রূপ প্রকাশ করাই হ’ল Caricature। সাদৃশ্য সম্বন্ধে যখন বলবো তখন এদের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া যাবে, এখন ভূষা-নিরপেক্ষ রূপ—রূপদক্ষের চরম দক্ষতা যার সৃষ্টি করার বেলায় দেখাতে হয়—সেই বিষয়ে বলে’ আলোচনা শেষ করি।
“অঙ্গান্যভূষিতান্যেব কেনচিদ্ ভূষণাদিনা।
যেন ভূষিতবদ্ ভান্তি তদ্রূপমিতি কথ্যতে॥”
রূপজগতে কেবলি রয়েছে ‘সাজ সাজ’ ধ্বনি—যেন নাচঘরের সাজঘর, সবাই সাজছে এখানে। কি সাজ কত সাজ এই বাঙলা দেশটার তাই দেখ না, ঐ যে আকাশ ও কি তারার মালায় সাজেনি, সমুদ্র কি নীলাম্বর পরে’ সাজেনি, নদী সে কি জল-তরঙ্গ চুড়ি বাড়িয়ে নেচে চলছে না? পাতার বাহার দিলে উপবন, কুঞ্জবন ফুলের মালায় সাজলে—অষ্ট অলঙ্কারে ভূষিতা সখী এর রূপদক্ষকে ঘিরেই রইলে—দিবারাত্রি সকাল সন্ধ্যা। বিচিত্র ছাঁদ বিচিত্র সজ্জা এদের। বিভূষিত এই পৃথিবীতে কোথায় পাই নির্ভূষণ রূপটিকে?
নিরাভরণ নিরাবরণী সুন্দরী। রূপ-ভোজের প্রমোদ উদ্যানের গিল্টির অলঙ্কারে বাঁধা Nude study তারাই কি নির্ভূষণা সুন্দরী বলে’ বলাতে পারে নিজেদের? রূপজীবীদের সহচরী বলে’ তাদের অনায়াসে চেনা যায়।
পর্বতদুহিতা উমা তিনি নির্ভূষণা রূপসী, শকুন্তলাও কতকটা এই ধাঁচের সুন্দরী, শ্রীরাধিকা নয় কিন্তু মথুরার কুব্জা তাকে ধরতে পারো নির্ভূষণা সুন্দরী বলে’। অশোকবনের সীতা—ভূষা-নিরপেক্ষ সৌন্দর্য ছিল তাঁর।
এ তো গেল কবিজনের সৃষ্টি করা নির্ভূষণা রূপসী তাঁরা; বিধাতার সৃষ্টিতে ভূষা-নিরপেক্ষ রূপ কোথায় পাই দেখি। মরুভূমির নিঃসঙ্গ রূপ সে একেবারে বিরাটভাবে ত্যক্তভূষণ ও পরম সুন্দর। ময়ূরের সবটাই প্রায় ভূষিত, বাবু কার্তিকের বাহন হ’ল সে। মরাল নির্ভূষণ ও সুন্দর মানস সরোবরে পেয়ে গেল স্থান।
বৌদ্ধ শিল্প তার মধ্যে এক বুদ্ধমূর্তিটিই কেবল নির্ভূষণ সুন্দর রূপ, আর চৈত্য বিহার স্তুপ সবই ভূষাভারাক্রান্ত রূপ। সিংহলের কপিল মূর্তি—রূপেতেই সেটি রূপবান, বাঙলার নিকোনো ঘর—ভূষা-নিরপেক্ষ রূপের বাসা। এমনি পৃথিবীর সর্বত্র আর্টের মধ্যে এই পরম রূপ জায়গায় জায়গায় ধরা রয়েছে দেখবো অতি প্রাচীনকালে এবং একালেও।
রূপের অভাব দিয়ে ভূষা-নিরপেক্ষ রূপকে ফোটানো সম্ভব নয় এটি সুনিশ্চিত। কলঘরের চিমনি সম্পূর্ণ ভূষা-নিরপেক্ষ, কিন্তু তার রূপ কি? ভূষোকালি মেখে সে একটি নির্ভূষণ অশোকস্তম্ভের কিমাকৃতি দিচ্ছে মাত্র। রূপদক্ষের হাতে তাকে সাজতে হয় অনেকটা তবে সে স্থান পায় রূপ-রচনার মধ্যে। চৈতন্য ছিলেন নিজের রূপেই রূপবান, কিন্তু চৈতনচুটকিধারী বাবাজী যদিও ভূষণ পরলে না তবু সে ভেকধারী বাবাজী কি স্বামিজী এইটেই প্রমাণ করলে। জলের উপর জেলে-ডিঙ্গী ভূষা-নিরপেক্ষ সুন্দর সে। গাছের তলায় শুকনো পাতা শ্রীচৈতন্যের মতো নির্ভূষণ সোনার পুতুল সে। প্রভাতের চন্দ্রকলা আলোর সাজ ছেড়ে পরম সুন্দর; নির্ভূষণা সুন্দরী সে। আগ্রার তাজমহলের চেয়ে সুন্দরী দিল্লীর প্রাসাদে পাষাণ দিয়ে গড়া অন্দরমহলের গোপনতায় ঘেরা যে একটুখানি মোতী মসজীদ সে হ’ল নিরাভরণা নির্ভূষণা সুন্দরীর প্রতিমা, কিন্তু ঐ তাজমহল সেও সুন্দরী কিন্তু নাতিভূষিতা। একেবারে নিরাভরণা সূচ সে একেবারে নির্ভূষণ—সরল রেখাটি পরিষ্কার ঝরঝরে, কাযের উপযুক্ত রূপ তার কিন্তু তার রূপ দেখে’ মন মাতে না, সূচে তোলা নানা কায দেখে’ কিন্তু চোখ মন সবই ভোলে। কুশ ও কাশ তারাও নির্ভূষণ সরল কিন্তু সূচের থেকে স্বতন্ত্র তাদের রূপ। টিনের জলপাত্র তার ভূষারিক্ততা আর সাদাসিধে অথচ সুন্দর চুমকি ঘটি তার ভূষারিক্ততা এক ধরণের নয় কাযেই তারা একরূপও নয়।
ভূষার অতিরেক এবং ব্যতিরেক এই দুয়ের নিয়ম অতি সাবধানে প্রয়োগ করতে হয় রূপ ফোটানোর বেলা। কতখানি সাজাবো কতখানি সাজাবো না, কাকে সাজাবো কাকেই বা সাজাবো না এর বিচার রূপদক্ষের হাতে। এই দুই মহাস্ত্র এরা রূপ ফোটায়—যদি রূপদক্ষের হাতে পড়ে এবং রূপকে মারে—যদি এদের নিয়ে কারবার করে রূপবিলাসী অথচ মোটেই রূপদক্ষ নয় এমন কেউ। যথাযথভাবে পুরোপুরি ভূষিত এবং অযথাভাবে ভূষণভার-গ্রস্ত দুটো কায পাশাপাশি রাখি, নারকেলডাঙ্গায় পরেশনাথ টেম্পল রঙ্গীন কাচ আর সোনার হলকারি দিয়ে মোড়া, ঠিক এমনি সোনা আর কাচে সাজানো আগ্রার শিশমহল। দুটোতে তফাৎ কতখানি হ’য়ে গেল! একেও দেখতে লোক জমা হয়, ওকেও দেখতে লোক ছোটে। কিন্তু শিশমহল বইলে সার্থক রূপখানি, আর টেম্পল বইলে কাচ আর গিল্টির অনর্থক ভার মাত্র। গহনা কেড়ে নিলেও সে রূপবতী, রূপসীর আদর্শ তাকে বলতে পারো। ভূষা-নিরপেক্ষ রূপ হ’ল প্রকৃত রূপ—লাখে এক রচনায় তার দেখা পাই শিল্প-জগতে। রচনার কৌশলে বর্ণের ছটায় ভাবের সমাবেশে রূপ সমস্ত স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ভাবে আমাদের কাছে মূল্য পায়। চোখের দিক ঘেঁসা কোন রূপ, মনের দিক ঘেঁসা কোন রূপ। রূপের মোটামুটি ভেদ এই দুটো নিয়ে হয়, তারপর মন্দ নয়, পাঁচপাঁচি, মাঝারি—এমনি অসংখ্য রূপ তারাও আছে, একেবারে কাযের ও একেবারে অকাযের এমন সব রূপস্থষ্টি এও আছে—রূপের সংখ্যা করা যায় না এত রূপ, এবং তত নিয়ম রূপভেদের—এরি সাধন হ’ল রূপ-সাধকের অসাধ্য সাধন বলতে পারি।