বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/খেলার পুতুল
খেলার পুতুল
একদঙ্গল ছেলেমেয়ে হাঁ করে চেয়ে আছে—আর খাঁচায় ধরা কালো বাঘ মস্ত একটা কাঠের বারকোস নিয়ে খেলছে! এক ছেলে বলে—ও ভাই বেরাল দেখ!
সিংহের খাঁচা—সেখানে পশুরাজ, তাঁকে দেখে’ বলে আর এক ছেলে—সিংহীর মামা ভোম্বল দাস, বাঘ মেরেছে গণ্ডা দশ।
আর এক ছেলে—সে সবে কপচাতে শিখেছে—সমুদ্রতীরে প্রাতঃসূর্যকে দেখে বল্লে, চাঁদটা কি লাল দেখ।
পশুরাজ সেখানে বেরাল সেজে খেলতে আসে, উদয়াচলের সূর্য আসেন তেজ লুকিয়ে ছদ্মবেশে রঙ মেখে মন ভোলাতে; নির্ভয় খেলার জগৎ—সেখানে ভয় দিতে এল না বাঘ কিন্তু খেলে’ যেতে এল, অন্ধকার এল সেখানে লুকোচুরি খেলার রহস্যময় রূপ ধরে’ খেলতে, ভয় পাওয়াতে নয়, আলো এল কিন্তু স্বপন ভাঙাতে নয়—ঝিলিমিলি রূপ রঙ নিয়ে নতুন নতুন স্বপ্নের জালে ঘিরে’ দিতে দিগ্বিদিক্। সেখানে কি ঘরের কোণে কি বাইরে বনের তলায়, কিবা আকাশে মেঘের ফাঁকে, নদীজলে ঢেউয়ের দোলায়, সব জায়গাতেই খেলাঘরটি রইলো পাতা সকল সময়ে। পড়া সেখানে খেলা—পাখী পড়ে ঝুঁটি ঝাড়ে মাথা নাড়ে। কায সেখানে খেলা—
‘আয়রে ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই,
দোলায় আছে ছ’পোণ কড়ি
গুণতে গুণতে যাই।’
লড়াই সেখানে খেলা,—
‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার,
তালপাতার সেপাই নিয়ে যুদ্ধে আগুসার!’
সংসার সেখানে খেলা, মরণ বাঁচন সেও এক খেলা।
ভাবনা-শূন্য জীবনের একটি একটি কণা,—সব খেলুড়ি তারা, লঘুভার প্রজাপতির সমান উড়তে উড়তে খেলতে খেলতে হঠাৎ ডানা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যায়—ঘরের প্রদীপ আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র খেলাঘরের মাটির পুতুল ঠিকানা পেতে চায়; খেলুড়িরা এ ওকে শোধায়—
“ভোর বেলা যে খেলার সাথী
ছিল আমার সাথে,
মনে ভাবি তার ঠিকানা
তোমার জানা আছে।”
খেলুড়ির রাজা হ’ল মানবশিশু—নটরাজ সে, নিজে নাচে বিশ্বকে নাচায়। বিশ্বরাজের লীলা-সহচর রূপ সমস্ত—চন্দ্র সূর্য জীব জন্তু ফুল পাতা মেঘ বৃষ্টি—তারা সবাই এই খেলুড়ির রাজা মানবশিশুকে চিনলে, ঘিরে’ ঘিরে’ বল্লে তাকে—‘হাসি কাঁদি যেমন নাচাও তেমনি নাচি’। মায়ের কোলে ধরা সেই মাটির ঘরের খেলুড়ি ছেলে মেয়ে দুটিতে ভোলে সে খেলনা পেয়ে। ফেলনা জিনিষ দিয়ে তৈরি হ’ল না সে সমস্ত খেলাঘরের হেলা-ফেলার পুতুল,—যে মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয় প্রাণ, যে মাটিতে মাটি হ’য়ে মেশে প্রাণের পাত্র দেহ, সেই মাটিতে গড়া হ’ল পুতুলখেলার পুতুল। মাটির ঘরের ধারেই বাইরের খেলাঘরখানি পাতা, সেখানে আতা গাছে তোতাপাখী উড়ে বসে’ ডাকে—এস খোকা খেলি এস। মা বলেন—যেও না খোকা। খোকা বলে—যাবো! খেলতে কাঁদে খোকা, ভোলানো শক্ত তাকে চাঁদমুখে রোদ লাগার ভয় দিয়ে। রোদও সে ডাকছে—গাছের পাতায় আলোর ফুলঝুরি জ্বালিয়ে আর মাটি দিয়ে নিকোনো উঠোনের একটি ধারে আলো ছায়ার চাকাচাকা ফুল সাজিয়ে খেলো এসে খোকা।
বাইরের মাটির পুতুল তারা সব ডাক দেয় ঘরের পুতুলটিকে—হাতছানি দিয়ে ইসারা করে’ কথা কয়ে’ গান গেয়ে। মন ভোলালো ছেলের, সে এক মায়ের কোল ছেড়ে আর এক মায়ের ঘরে খেলতে ছুটলো বাইরে। সেখানে চলে ধরা-ছোঁয়ার খেলা জলে স্থলে ধরাতলে, মেঘে মেঘে আকাশতলে।
খোকা চলে তুলতে আলো ছায়ার ফুল—তারা ছোঁয়া দেয়, কচি হাতের মুঠোয় আসে কিন্তু ধরা দেয় না। আকাশের পাখী ডাক দেয় কাছে আসতে, কিন্তু ডাকলে আসে না কাছে পাখী, আতা গাছের তোতা পাখী সে—আগ ডালে উড়ে বসে, আতাপাতার নৌকো বাতাসে ভাসানোর খেলা জুড়ে’ দেয় একা একাই। দড়ি-ছেঁড়া রামছাগল—বাঁকা দুটো শিং যেন হিট্টিমাটিম্টিম্—আতাপাতার গন্ধে গন্ধে পায়ে পায়ে এগোয় সে, দাড়ি নেড়ে বলে—খোকা দেখবে মজা? এক গরাসে গোটা পাঁচ পাতার নৌকো খেয়ে খোকার দিকে চায় ছাগল—ন্যেঁকরে কাঁদে খোকা, ট্যেঁ করে’ টিয়ে তাকে ভেংচায়, ন্যাঁ-ন্যাঁ বলে’ ছাগল ভোলায় খোকাকে।
হুঁকো হাতে তামাকখেগো বুড়োরা বসে’ বসে’ গল্পই করে, পাঁড়েজী পড়েন সুর করে’ গীতার মাথামুণ্ডু ব্যাখ্যা, আহ্লাদী পিসি তাই শুনে’ হেসে’ যেন ফুটিফাটা হ’য়ে যান।
আতাতলার নাটশালার ধারে গোয়াল-পোরা গাই বাছুর, খোকা চলে সে দিকে, কুয়োতলার কুণো বেরাল এঁটোকাঁটা খেয়ে গোঁফ মুছে’ চায় টিয়েপাখীর দিকে। খোকা ডাকে—আয় মেনি,পুস্! ওদিকে টিয়ে ওড়ে ফুস্।
খেলার বেলা শেষ হ’য়ে আসে, তিন পহরের রোদ ছায়ার কাছেই মাদুর বেছায়, খেলা ভুলে’ খোকা শুয়ে পড়ে রোদের কোলে মাথা রেখে, চেয়ে থাকে নীল আকাশে, তালগাছের শিয়রে, বাবুইয়ের বাসার দিকে। দূরে ডাকে পুতুলওয়ালা—খেলনা চাই চুড়ি চাই। খুকি বার হ’ল পরণে ডুরে সাড়ি খোপায় ফুল—যেন চলে পুতুলটি। খেলতে জানে সে পুতুল খেলা, চেনে তাকে পুতুল-ওয়ালা। খোকাতে খুকিতে চলে হাটে রাসের মেলায় খেলনা কিনতে।
দূর দেশের খেলনা—মাটির খেলনা, সোলার খেলনা। কেউ এল খোকার হাতে হাতে, কেউ এল খুকির কোলে কোলে, কেউ বা এল সাথীদের ঝুড়ি চেপে’; খেলাঘরে বাসা নিলে অবেলার সব অতিথি তারা—মেলার ফেরৎ নতুন সাজ সবার। সকালের সেই পলাতকা টিয়ে তিনি পরেছেন কমলাফুলির ওড়না, বাঘা মামা হয়েছেন নামাবলী তিলক ছাপা বোষ্টম, ঘোড়া হয়েছেন পক্ষিরাজ, হাতী সেজেছেন ব্যাঙ, ব্যাঙ সেজেছেন হাতী, সাপ হয়েছেন ময়ূর, ময়ূর হয়েছেন সর্প, কুমীর হয়েছেন নৌকা, নৌকা হয়েছেন কুমীর; তার মধ্যে জলজীয়ন্ত বেরালবৌ আর খোকা খুকি তিনজনে খেলা করে, সূয্যি মামার বিয়ের ডুলি ঘরের কোণে ধরা, তারি কাছে খেলাঘরের পিদুম জ্বলে।
আগাডুম বাগাডুম
ঘোড়াডুম সাজে,
ডাং মৃদং ঝাঁঝর বাজে।
গভীর রাতে চাঁদের আলো চুপি চুপি খেলতে এসে দেখে খেলাঘরে ভাঙা পুতুলের ছড়াছড়ি, ঘুমে অচেতন খোকা খুকি তারা।