বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/রূপের মান ও পরিমাণ
রসের আশ্রয় হ’ল রূপ—“আলম্বন সেই যাহে রসের আশ্রয়” (—ভারতচন্দ্র)। হাওয়ার রূপ নেই, কিন্তু আলম্বন-ভেদে বাতাসের স্বাদ ও গতির ভেদাভেদ স্থির করে নিই আমরা,—যেমন তালপাখার হাওয়া কুলোর বাতাস ইলেক্ট্রিক ফ্যানের বাতাস চামরের বাতাস আঁচলের বাতাস বিলেতের হাওয়া ম্যালেরিয়ার হাওয়া উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম হাওয়া। রসশাস্ত্রকার তাঁরা এই আশ্রয়ভেদ নিয়ে রসের ভেদ স্থির করে’ বল্লেন আদি করুণ ভয়ানক বীভৎস—এই প্রকার নয় রস। এই সব নানা রসের পাত্র তারা নানা রূপ এবং তাদের গড়ার বাঁধাধরা মাপজোখ শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে পাওয়া যায়; অঙ্কশাস্ত্রেও চতুষ্কোণ ত্রিকোণ দীর্ঘ হ্রস্ব বৃত্ত এমনি নানা রূপের সঠিক মাপ পাই আমরা। শাস্ত্রমতে রূপের আকার ও প্রকার হ’ল ষোল রকম—“রূপন্তু ষোড়শবিধম্”, যথা—হ্রস্ব দীর্ঘ স্থূল চতুরস্র ইত্যাদি ইত্যাদি হ’ল আকারের মাপজোখ নিয়ে, আকার রঙের মান পরিমাণ নিয়ে প্রকারভেদ হ’ল, আকার হয়তে রইলো ঠিক, যথা—রক্ত আরক্ত পীত পাণ্ডু কৃষ্ণ নীলারুণ শুক্ল রজত,—তারপরে আবার বস্তুটির গুণাগুণ নিয়ে ভেদ হ’ল—দারুণ পিচ্ছল চিক্কণ মৃদু ইত্যাদি ইত্যাদি।
একখানা লাল বনাতে একখানা লাল মখমলে সমান হ’ল না স্পর্শে, একপাট সাদা খদ্দরে একপাট সাদা সিল্কে সমান হ’ল না লাবণ্যে ও স্পর্শে। একটা তালগাছে আর এক গাছা আখের ছড়ে সমান নয়, ডৌলে মাপে যদিও দুইই দীর্ঘ। একই আকাশ কিন্তু দিনের আকাশে রাতের আকাশে সমান হ’ল না, রূপে গুণে রঙে ও স্পর্শে বিষম ভেদ রইলো এতে ওতে। রূপের বহিরঙ্গীন অংশের মাপ ডৌল থেকে স্থির করা গেল এবং দেখা গেল সেখানে দুটো এক মাপের ডৌল নেই—বর ও কন্যা রূপে গুণে দুইজনে আলাদা আলাদা, এর ডৌলে ওর ডৌলে কোন মিল নেই। স্বভাবের নিয়মে সবাই আলাদা মান আলাদা ডৌল পেলেম আমরা, বিয়ের মন্ত্র নিয়েও দু’ হাত এক করা গেল না, দক্ষিণ ও বাম যে আলাদা সেই আলাদাই রইলো।
সমান ডৌল সে সমপরিমাণ না হ’লে হয় না। স্বভাবের নিয়মে সমান সমপরিমাণ দুটো গাছ নেই। জগতে দুটো মানুষ সমান নয়, এমন কি হাত পা চোখ কান সেখানেও সমান মাপ দেখা যায় না। স্বভাবের গড়ন সমস্ত হ’ল অসম বিষম ছন্দে প্রস্তুত—সবার স্বতন্ত্র মাপ। বিশ্বশিল্পীর রূপ-সৃষ্টির ধারা চল্লো অসম বিষম ছন্দে ও তালে। রূপের বৈচিত্র্য রসের বৈচিত্র্য এই লক্ষ্য ধরে’ গড়লেন বিশ্বকর্মা, একের সমান আরেক নেই, নিজস্ব মান পরিমাণ নিয়ে সবাই সেখানে রূপবান এবং পরস্ব প্রমাণ ধরে’ সবাই সেখানে কেউ ছোট কেউ বড়, কেউ দূরে কেউ নিকটে, এমনি নানা আকার প্রকারের হ’ল। কাছের বন সবুজ, দূরের বন নীল রূপ। কাছের তালগাছ দেখায় বড়, দূরের তালগাছ দেখতে ছোট। মানুষের পাশে কুকুরটি ছোট কিন্তু খরগোশের পাশে সে মস্ত বড়—পরস্ব প্রমাণ বলে’। কেবল যা প্রতিবিম্ব প্রতিচ্ছবি সে ডৌলে মাপে সমানের নিয়ম ধরলে, কিন্তু সেখানেও ভেদ রইলো দুয়ে—জলে পড়লো প্রতিবিম্ব, ফুলের সব দিক দিয়ে দুটো দুটো এক হ’য়েও হ’ল না—সত্য ফুলকে তোলা গেল, ফুলের প্রতিবিম্বটি তোলা গেল না, ফুলে রইলো সৌরভ, প্রতিবিম্বে রইলো—না মধু না সৌরভ।
“God created man in His own image.” বিশ্বরূপ যিনি, বিশ্বরূপের কর্তা বিশ্বকর্মা যিনি, তিনি—“স্বয়ংরূপ দর্পণে ধরে মানবরূপ সৃষ্টি করেছেন” (—লালন ফকির); “যথাদর্শে তথাত্মনি”। বিশ্বকর্মা তিনি স্বয়ংরূপ, তাঁর কৃত যা কিছু তাদেরও স্বয়ংরূপ দিলেন তিনি। রূপসাধকের মনের দর্পণে ঠিক ঠিক প্রতিবিম্ব হয় রূপ এটা সুনিশ্চিত, কিন্তু সেই রূপই বাইরে প্রকাশ করলেন যখন সাধক তখন যেমনটি তেমনটি করে’ দেওয়া সম্ভব হ’ল না তাঁর পক্ষে। কাচের দর্পণে প্রতিবিম্ব পড়ে কিন্তু সেই রূপের ভোগ নেই দর্পণের। আত্মার দর্পণে রূপের ভোগ হচ্ছে, ক্রিয়া চলেছে আত্মার। জলের ক্রিয়া আরম্ভ হওয়া মাত্রেই স্থির চন্দ্রবিম্ব যেমন ভেঙে হয় চাঁদমালা, তেমনি স্বয়ংরূপ সমস্ত প্রতিবিম্ব ফেল্লে আত্মার দর্পণে, আবার আত্মার ক্রিয়া তাদের দিলে স্বতন্ত্র ডৌল মাপ। যেমন পাই ভিজে কাদায় পায়ের ছাপ তেমনি ক্যামেরায় সমানকে পেলেম—কতকটা সঠিক স্বয়ংরূপের পুনরাবৃত্তি পেলেম একের মতো আর এক, কিন্তু তবু সেটিকে স্বয়ংরূপ বলা গেল না, কারণ, অনেক দিক থেকে অনুকৃতি সে মিল্লো আসলের সঙ্গে আবার অনেক দিক থেকে মিল্লোও না—আসল সাপ দংশন করে কুণ্ডলী পাকায় চলে ফেরে মরেও, ফটোর সাপ তা করে না, আসল ফুল ফোটে গন্ধ বিলায় শুষ্ক হয় ঝরে যায়, ফটোর ফুল তা করে না। কাযেই এ ভাবের প্রতিবিম্ব সে খাটোই রইলো, স্বয়ংরূপের সমান হ’তে পারল না, অনুরূপ কিন্তু স্বয়ংরূপ নয় মোটেই। ফটোটা ঠিক মানুষটির মান পরিমাণ ধরে’ ছাপানো গেল রঙও করা গেল কিন্তু তবু দেখি মানুষটির স্বয়ংরূপের সঙ্গে অনেক খাটো থেকে গেল সে। ফটো এই কারণে প্রমাণ করতে পারলে না যে সে একটি স্বয়ংরূপ। স্বয়ংরূপ যে তার নিজস্ব মান পরিমাণ ও পরস্ব মান নিয়ে সলীল গতিশীল সশ্বাস সনিমেষ, জগৎ-রূপের সঙ্গে স্বতন্ত্র এবং একও বটে, সে কারু সমান নয় কারু প্রতিধ্বনি প্রতিরূপ প্রতিবিম্ব ও নয়। ঠিক এরি উল্টো হ’ল ফটোগ্রাফ―এ একের অনুরূপ ও সমান। স্থির জলে উড়ন্ত পাখীর প্রতিবিম্ব—সত্য পাখীর মতো সে উড়লো চল্লো বটে কিন্তু পাখী গাইলো কই! কলের পাখী চল্লে বল্লে কিন্তু খাঁচা খুলে দিলে পালালো না ধান ছড়ালে খেয়ে গেল না।
সমানের আদর আছে কাযের জগতে—একটি টাকা আর একটি টাকার সমান না হ’লে কায চলে না। স্বভাবের নিয়মে সমান দুটো কিছুই নেই কিন্তু দোকানে আফিসে স্কুলে সমান চেয়ার বেঞ্চ আলমারি দেখি সমানের মাপকাঠি যেটা কাযের জগতে খাটিয়ে চলেছি আমরা তাতে করে’ শিল্পজগতে কলে ছাঁটা একরকমের জিনিষ অনেকগুলো এসেছে দেখি। রেল গাড়ির চাকা, রেল লাইন, কাচের বর্তন, টেলিগ্রাফের তার, দ্বাদশ মন্দির, তার ঘাটের ধাপ ইত্যাদি একটার পরে একটার সমান।
অসমানের কৌশল রইলো স্বভাবের হাতে আর রইলো রূপদক্ষের হাতে—দর্জির হাতে দোকানির হাতে কর্মকারের স্বর্ণকারের হাতে। এমনি যারা রূপের ব্যবসাদার তারা সপরিমাণ ও সমান মাপে গড়ে’ চল্লো রূপ, কেননা একটা জিনিষের সমান হাজারটা না হ’লে ব্যবসা চলে না এদের। মিলিটারি ডিপার্টমেণ্ট একটা ইউনিফরম মাপ দিয়ে দিলে দর্জির হাতে এবং রিক্রুটিং অফিসার সেও এই সমানের মাপ ধরে’ যেছে’ চল্লো সেপাইগুলি, ইউনিফরম গায়ে ঢুকলো সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে। ফৌজের জন্যে টোটা বন্দুক যারা প্রস্তুত করছে তাদের হাতে রয়েছে নানা ধাতু নানা পদার্থের সমান মাপজোখ ভাগ-বাঁটোয়ারা, দপ্তরীর হাতে আছে সমান মাপ দেবার রুল ও ছুরি, চোখ বুঁজে দপ্তরী এমন সমান করে’ কেটে’ চলে পাতা যে অনেক সময়ে ছাপার লেখার উপর দিয়ে লেখা চলে যায় সমানের টান।
সমান মাপজোখ নিয়ে কাযের প্রতিরূপতার সৃষ্টি হ’ল—একটা দশ নম্বরের বুট আর একটা দশ নম্বরের বুটের প্রতিরূপ হ’ল, একটা চন্দ্রহার আর একটা চন্দ্রহারের সমান হ’ল, একটি সিদ্ধিদাতা গণেশ মূর্তি অন্য একটি সিদ্ধিদাতার অনুরূপ হ’ল। রূপ সৃষ্টি করছে যে সে একটা রূপকে দুটো করার দিকেই যাচ্ছে না কিন্তু তার দেওয়া একটা রূপ আর একটা রূপের সমকক্ষতা এবং প্রতিপক্ষতা একই সঙ্গে করছে—এমন চমৎকার মান পরিমাণ দিয়ে গড়ছে সব রূপ রূপদক্ষ।
এক রূপকে অন্য রূপের সমকক্ষ করার কৌশল ছাঁটে সমানের কৌশলে নয়—অগাধ জলের তলা থেকে উঠলে পদ্মের মৃণাল, শতদল মেলিয়ে ধরলে আলোয় বৃহৎ মান পরিমাণ নিয়ে, অনেক মধু অনেক সৌরভ নিয়ে—এই যে পদ্ম ফুল এর কাছে এতটুকু একটি ঘাসের ফুল খাটো সব দিকে একথা বলা চল্লো না; ঘাসের ফুল সে সমকক্ষ সে প্রতিপক্ষ হ’ল পদ্মের। মাপে খাটো নিশ্চয়ই একটা তারার কাছে খদ্যোত, কিন্তু তারার অনুরূপ নয় বলেই খদ্যোত সে হ’ল রূপে সমকক্ষ ও প্রতিপক্ষ তারার, কাযেই কবির মনে রস জাগালে খদ্যোতও।
রূপজগতে দুটো মাপ রয়েছে দেখি—একটা রূপের বহিরঙ্গীন মাপ আর একটা রূপের আভ্যন্তরীণ মাপ। ভাব নিয়ে যখন আলোচনা তখন এই আভ্যন্তরীণ মাপের কথা ওঠে। অন্তর বাহির দুই মিলিয়ে স্বয়ংরূপটি সম্পূর্ণতা পায়। রূপ সাগরের উপরের বিস্তার ও তলার রহস্য দুইই মেপে তবে পাই পরিপূর্ণ রূপটি; সুতরাং নিজস্ব পরস্ব, বহিরঙ্গীন ও আভ্যন্তরীণ এষ্ট চার প্রকার মাপ হ’ল।
সব মানুষই তার নিজের হাতের সাড়ে তিন হাত দীর্ঘ, মানুযের নিজের মুখমণ্ডল তারি নিজের এক বিঘত,—এমনি কতকগুলি রয়েছে, প্রমাণসই মানুষের মান পরিমাণ যা সব মানুষের পক্ষেই সাধারণ মাপ, এ ছাড়া দেখা যায় যে মানবশিশুর বেলায় মাপ কিন্তু একটু আধটু তফাৎ হ’ল—ছেলের মাথাটা ছেলের এক বিঘতের খানিক যেশি। এর উপর রোগা মোটা নানা মান পরিমাণ দিয়ে দেহের বৈচিত্র্য সাধন হ’ল স্বভাবের নিয়মে।
জাতিগত আর একটা মাপ আছে, যেমন চীনেম্যানে ও আন্দামানে, আফ্রিকায় ও এসিয়ায়, এই ইণ্ডিয়ানে ও রেড-ইণ্ডিয়ানে। একই জাতের আমগাছ কিন্তু অবস্থার গতিকে দুটো সমান বিস্তার সমান খাড়াই পেলে না, ডৌল পেলে না এক রকম। যখন বীজ অবস্থায় তখন ডৌল মায় ওজন ভার এক জাতীয় বীজে আর একটি সেই জাতীয় বীজে প্রায় সমান, চারা, অবস্থাতেও কতকটা মাপেজোখে সমান তারা, কিন্তু বয়সে বাড়ার সঙ্গে গাছেদের চেহারা ডৌল বিভিন্ন মাপ ধরলে। আবার নারকেল গাছ তালগাছ ধানের ছড় আখের গোছা—এরা সব বয়সের অসমান নিয়ম থেকে ছাড়া পেয়ে সমানের নিয়মে বদ্ধ হ’ল। ইতর জীব—যেমন হাঁসের ছানা মুরগীর ছানা—শৈশবে সমান বড় হ’লেও ডৌল থাকে প্রায় সমান, শুধু রঙের ভেদ এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদে স্বতন্ত্র রূপ পায় তারা। কাক কোকিল ময়ূর কাকাতুয়া টিয়ে এমনি আরো অনেক জন্তু তারা বয়সে এক ডৌল একবর্ণ, শৈশবেও তাই। দুটো কাকের ও কাকের ছানার মধ্যে, দুটো এক জাতির বাঘেরও বাচ্ছার মধ্যে বদল ভেঙে নেওয়া শক্ত।
সদ্য ঝরা দুটি শিউলী ফুল—ভারি শক্ত দুয়ের কোথায় অমিল সেটা ধরা। দুটো মুরগীর ডিম সমান মাপে ডৌলে, দুটি চোখ প্রায় তাই, কিন্তু কাকের ডিমে হাঁসের ডিমে মুরগীর ডিমে মাপে ও বর্ণে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বাঘের চোখে হরিণের চোখে সমান নয় কিন্তু বেরালের চোখে বাঘের চোখে ডৌলের মিল আছে যদিও মাপে ওটা বড় এটা ছোট। হাতীর কানে ঘোড়ার কানে সমান করলে ছবিতে ভুল হ’য়ে যায়, কিন্তু গাধার কান ঘোড়াতে একেবারে বেমানান যে হয় তা নয়।
নানা ঢঙের মাপজোখ নানা রঙের ওজন এমনি সব ব্যাপার নিয়ে উল্টেপাল্টে খেলে’ চলেছেন যেন কোন যাদুকর—নানা রঙ নানা ভাব নানা ডৌলের সংমিশ্রণে বিচিত্র হ’য়ে উঠেছে রূপজগৎ। বাঁধাবাঁধি ও স্থিরতা নেই বল্লেই হয় স্বভাবের মাপজোখে—কি বর্ণের কি ডৌলের কিবা ভাবের দিক দিয়ে সব দিকে আলগা। তেলাপোকার বেলায় দেখলেম এক জাতি এক ডৌল এক মান পরিমাণ পেয়ে সবাই এক রূপ এক রঙ, প্রজাপতিতে দেখলেম নিয়ম উল্টে গেল—এক জাতীয় অথচ বর্ণে ডৌলে ভেদ, মাপেও ভেদ। হনুমানের বেলায় হ’ল সব হনুমানই সমান মুখপোড়া, মানুষের বেলায় নিয়ম একেবারে যতদূর ওলটাতে পারে—সাধারণ মাপ সমান রইলো, জাতি ধরে’ ও ব্যক্তি ধরে’ মানুষের মান পরিমাণ বয়সে বয়সে হ’ল অসমান। এক কাঠবেরালী পালালে রাতারাতি আর একটাকে খাঁচায় ভরে’ বুড়োকেও ঠকিয়ে দেওয়া চল্লে, কিন্তু এক মানুষ চেয়ার ছেড়ে সরে পড়লে সেই সে চেয়ারে অন্য একটি মানুষ এনে বসিয়ে আগের মানুষ বলে বালককেও ঠকানো গেল না—পোষা কুকুর বেরাল তারাও ধরে’ ফেল্লে মাপের পার্থক্য মানুষে মানুষে। রামের এক ডৌল এক মাপ এক ভাব,—এখন রামও দুই হাত দুই পা এক মাথার মানুষ, শ্যামও তাই, এই মিলটুকুর জোরে অযোধ্যার সিংহাসনে বসেও শ্যাম বলতে পারে না আমি রাম,—রামের পরিমাপ সে রামেই শ্যামের পরিমাপ সে শ্যামেই নিঃশেষভাবে রইলো, রামের গুণ যদি পেলেন শ্যাম তো বহিরঙ্গীন মাপজোখের কথাই উঠলে না, প্রজার বল্লে রামরাজত্বেই বাস করছি।
গুণের সমতা নিয়ে অন্যের সঙ্গে মিলে যাওয়া এবং ভাবের সমতা নিয়ে অন্তের সঙ্গে সমান হওয়া—এর প্রমাণ রূপসৃষ্টির অনেক জিনিষেই দিচ্ছে। চাঁদ আর চন্দ্রবদনে বা চন্দ্রহারে, খদ্যোতে প্রদীপে তারায়, নীল জলে পদ্মের মালায় আর নীল আকাশে দোদুল বলাকায় যে ভাবে সমান—নিজস্ব মান বজায় রেখেও কিন্তু দুটো দেয়াশলায়ের কাঠি ঠিক সে ভাবে সমান নয়।
দর্পণে আমার প্রতিবিম্ব পড়লো—আমার সবই তাতে আছে অথচ আমার কিছুই তাতে নেই, সমান বলতে পারলেম না স্বয়ংরূপে আর তার প্রতিবিম্বে। আমারি তৈল-রঙ-করা প্রতিরূপ বা প্রতিচ্ছবি—আমার সব রইলো তাতে—ডৌল বর্ণ মান পরিমাণ, হ’লও ছবিটা জীবন্তবৎ—যেন বসে লেকচার দিচ্ছি, কিন্তু যে বস্তুটি বলছে আমার স্বয়ংরূপের অন্তরে থেকে “রইবো না বসে’ আমি চলবো বাহিরে” সেই সত্য ও নিত্য বস্তুটুকুই বাদ গেল প্রতিকৃতিতে, কাযেই ভেদ রইলো স্বয়ংরূপে রঙের সমতা পেয়েও। গোলাপ ফুলে আর গোলাপি আতরে কিন্তু প্রায় সমান সব দিক দিয়ে অসমান হ’য়েও। রূপে সমান কৃষ্ণনগরের ও লক্ষ্মৌয়ের মাটির আমটি আতাটি কলাটি কিন্তু মাটির স্বাদ আছে ফলের রস ফলের স্বাদ নেই, আসল ফল মাটিতে পড়লে ফেটে পড়ে রস, মাটির ফল সেও ভাঙে মাটিতে পড়লে—ছেলের মনে করুণরস জাগায়, বুড়োর মনে রাগ পৌঁছে দেয়, কিন্তু এত করেও সমান বলা গেল না। মাটির ফলে পিঁপড়ে লাগে না পোকা পড়ে না, পাখী ঠোকরায় যদি বা কিন্তু ঠোকর দিয়েই বোঝে মাটি।
রূপের অন্তরে বাহিরে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ, পরোক্ষ অপরোক্ষ, নিজস্ব পরস্ব, সমান ও অসমানের নিয়ম প্রমাণ দিচ্ছে—রূপ সকল প্রতিরূপ নয়, প্রতিবিম্ব নয়, তার প্রত্যেকেই স্বয়ংরূপ। কায়ায় ছায়ায় মিলে’ আছে অথচ যেমন মিলে’ নেইও, তেমনি রূপের বাইরের সঙ্গে মিলছে রূপকারী কায—অথচ মিলছেও না।
রূপের বেলায় বহুবচন, প্রমাণের বেলাতেও বহুবচন রূপশাস্ত্রকার প্রয়োগ করে’ বল্লেন—“রূপভেদঃ প্রমাণানি”। রূপের বহুভেদ যেমন, প্রমাণেরও তেমন বহুভেদ। রূপের বহিরঙ্গীন অংশ ও তার মান পরিমাণ রূপের আভ্যন্তরীণ অংশ ও তার মান পরিমাণ এবং ভিতর বাহির ইত্যাদি মিলিয়ে স্বপ্রমাণিত রূপ সকল—এই হ’ল তাবৎ রূপরচনার মূল কথা। নির্দিষ্ট মান পরিমাণ আর অনির্দিষ্ট মান পরিমাণ ধরে’ দুই প্রকারের রূপ। বিধাতার দেওয়া রূপ সমস্ত আর আর্টিষ্টের দেওয়া রূপ সমস্ত—দুয়ের স্বতন্ত্র মান পরিমাণ। আর্টিষ্টের মানস যেখানে আপন রাস্তা ধরলে সেখানে চোখে দেখার অপেক্ষা নেই, মনোমত মান পরিমাণ ধরে’ রূপের গঠন হ’ল সেখানে; স্থিরতা নেই রূপের প্রমাণের ভাবের লাবণ্যের সাদৃশ্যের বর্ণের হিসেবে, প্রবল ভেদনীতি ধরে’ বিধাতার সৃষ্টির সমকক্ষ সমতুল্য হ’তে চল্লো সেখানে রসসৃষ্টি মানুষের।
দাঁড়ি ও মাঝি দুজন রূপে গুণে অসমান। নৌকাটি চালাবার ভার কিন্তু দুজনেরই উপর। দাঁড়ি মাঝি সমান নয় দুজনে—তরী চল্লো, দুয়ের ক্রিয়ার বৈপরীত্য লক্ষ্যের একত্ব ধরলে। দাঁড়ি চল্লো দাঁড় টেনে ঝুপ ঝাপ, মাঝি রইলো হাল ধরে’ চুপ চাপ, কিন্তু পারঘাটের দিকে মন রাখলে দুজনেই সমানভাবে। খালে বিলে যে মাঝি সেই দাঁড়ি একই লোক সমানে অসমানে মিলিয়ে ডিঙ্গি বেয়ে গেল ঝাঁকি দিয়ে। প্রতি নায়কের প্রতি নায়িকার অনুকূল প্রতিকূল ভাব ও রসের স্রোতএ সব মিলে’ একটা নাটক যেমন সম্পূর্ণ রূপটি পায়, বাদী বিবাদী সংবাদী এমনি নানা সমান অসমানকে নিয়ে যেমন রাগরাগিণী রূপ পায়, কবিতায় ছবিতে মূর্তিতেও তেমনি নানা সমান অসমান একত্র হয়ে রূপ-রচনা মানানসই হ’য়ে ওঠে।
অলঙ্কারশাস্ত্রে তিন জাতীয় নায়ক নায়িকার কথা বলা হ’ল—দিব্য, আদিব্য এবং দিব্যাদিব্য। এই তিন রূপের কথা শিল্পশাস্ত্রেরও কথা—দেবতা, মানুষ, এবং দেবতা ও মানুষে মিলিত রূপ। দেবলোক, মর্তলোক এবং গন্ধর্বলোক এই তিন লোকের রূপ নিয়ে হ’ল কথা এবং মান পরিমাণ ও লক্ষণ দেওয়া হ’ল শিল্পশাস্ত্রে কিন্তু কাযের বেলায় দিব্যদিব্য রূপের মান পরিমাণ এবং অদিব্য মান পরিমাণই কাযে এল—রূপ হ’ল অদিব্য, রস হ’ল দিব্য, অদিব্য পাত্রে পরিবেষিত হ’ল দিব্য রস। সব দেশের প্রতিমা-শিল্পের দৌড় এই পর্যন্ত হ’ল—সমান অসমানের মিলন, নিত্যে অনিত্যে মিলন, মর্তরূপের সঙ্গে মিলে গেল দিব্য রস ও ভাব, মাটির পাত্রে স্বর্গ-সুধা এই সীমা ধরে’ রইলো মানুষের আর্ট রচনা।
শিল্পশাস্ত্রের প্রতিমা লক্ষণে যে মান পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে দেবতা ও দেবতাদের বাহনাদির জন্য—তা এই গোচর রূপ সমস্তেরই মাপ কমিয়ে বাড়িয়ে স্থির করা হয়েছে, যথা—নবতাল দশতাল কৌমার বামনী রাক্ষসী ইত্যাদি। মানবদেহের বিরাট্ত্ব ও বৈরূপ্য নিয়ে হ’ল রাক্ষসী মূর্তি, বরাহ আর মানুষের মান পরিমাণ বড় করে নিয়ে হ’ল বরাহ অবতার, পাখী আর মানুষে মিলে কিন্নর, মানুষের মাপের বিরাট্ত্ব ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাহুল্য এই নিয়ে হ’ল দেবদেবীদের মূর্তি সমস্ত—কেউ চার হাত কেউ দশ হাত কেউ চতুর্মুখ পঞ্চমুখ দশমুণ্ড গজানন নরসিংহ নরনারায়ণ হরিহর হরপার্বতী এমনি কত কি! পাখী আর চোখে মিলে দিলে খঞ্জন-চোখ যখন তখন বল্লেম দুই অসমান হ’ল সমান, হরিণ-চোখ—সেখানে কিন্তু দুই চোখে চোখে মিলে’ হল এক; এখানে বলতে পারি সমানে সমানে মিলন। পাখীতে মানুষে মিলে’ হ’ল কিন্নরী, এইভাবে সারা জীবজগতে সমান অসমান মান পরিমাণ এক করে দিয়ে রিশ্বরূপ গড়ে নিলে প্রতিমা-কারক। তারপরে আবার গাছ পালা ফুল পাতা নিয়ে—কল্পতরু পারিজাত এমনি নানা রূপের সৃষ্টি চল্লো, তারপর জড়জগৎ—সেখানে শালগ্রাম শিবলিঙ্গ ইত্যাদি পাই,—এর সবাই ধর্মপ্রচারের কাযে এসে গেল। এই যে প্রতিমা গড়ার মান পরিমাণ এর ভিত্তি হ’ল মর্তরূপের ব্যতিক্রমের উপরে। মর্তরূপ তাদের সুনির্দিষ্ট ও নিজস্ব ও পরস্ব মান পরিমাণ ডৌল ইত্যাদি স্বভাবের দেওয়া—সেখানে নর সে নর—বানরও নয় দেবতাও নয়, মাদার গাছ সেখানে মাদার গাছই—আম নয় জাম নয় স্বর্গের মন্দারও নয়। হিন্দুধর্ম চাইলে দিব্যমূর্তি, কিন্তু যে মূর্তি গড়বে না তার কাছে, যে প্রতিমা-লক্ষণ লিখবে না তার কাছে দিব্য রূপটি আপনার মান পরিমাণ নিয়ে বর্তমান রয়েছে, কাজেই অদিব্য মান পরিমাণ ভেঙে গড়া চলতি হ’ল।
প্রতিমা দেওয়ার বেলায় শাস্ত্রকার বলেন,
“প্রতিমাকারকো মর্ত্ত্যো যথা ধ্যানরতো ভবেৎ।
তথা নান্যেন মার্গেণ প্রত্যক্ষেণাপি বা খলু।”
প্রত্যেক রূপ ও তার মান পরিমাণ আদি একেবারে বর্জন করা কেমন করে’ হয় মানুষের দ্বারা। লিখলেন বটে শাস্ত্রকার “নান্যেন মার্গেণ”, শুধু ধ্যান ধরে’ আপনাতে আপনি ডুবে থাকা চল্লো কই। অরূপের অব্যক্তের ধ্যান অলৌকিক আধ্যাত্মিকের ধ্যান সন্ন্যাসী সে করতে করতে একটা তুরীয় অবস্থাতে গিয়ে পৌছে আনন্দে ভোঁ হ’য়ে বসে’ থাকে কিন্তু সেই রকম ধ্যানের পথ ধরে’ রূপ-রচনা অসম্ভব কোন কিছুর। সকালে উঠে’ প্রাতঃসূর্যের ধ্যান সুরু করলেম স্থির হ’য়ে চোখ বুঁজে, পাঠশালের ছেলেরা পড়তে যেতে দেখলে—ঋষি মশায় বসেন ধ্যানে, কিন্তু ঋষি আফিঙের গুলির ধ্যান করছেন, না আলোর গোলার ধ্যান করছেন, না মাখম মিছরীর ধ্যান করছেন—কেউ কিছু বুঝলে না যতক্ষণ না ঋষি ধ্যানকে ভাষা দিলেন—“জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং,” কিংবা ভৈরবীতে ঋষি তান ধরলেন সূর্যস্তবের, কিংবা তুলি ধরলেন ঋষি—লিখলেন জবাফুলে সূর্য মিলিয়ে দিব্যাদিব্য মূর্তি। এই ভাবে একের ধ্যান সপ্রমাণ করলে আপনাকে অন্যের কাছে। প্রতিমা সে প্রতিম হ’ল, আর্টিষ্টের ধ্যানের গোচর রূপের উপরে নির্ভর করে’ তবে পেলেম অরূপের রূপ। এখানে দুই অসমান—রপ ও অরূপ মিলে’ হ’ল এক।
কল দিতে পারে একটার প্রতিরূপ ঠিক আর একটি তেমনি, আর্টিষ্ট তা দিতে পারে না; আর্টিষ্টদের প্রতিমা অপরিমেয় রসকে পরিমিতির মধ্যে ধরে’ দিচ্ছে রসরূপ একটি একটি। রসকে ধরতে হ’লে রসের আলম্বনটির মান পরিমাণ কেমনটি হওয়া চাই তা আর্টিষ্টেরই ভাববার বিষয়, যেমন প্রাতঃকালের বর্ণন দিতে হ’লে বড় ছন্দে বা ছোট ছন্দে লিখবো, কি কি কথা কেমন করে’ কোথায় বসাবো—এ সবের হিসেব কবির হাতে ছেড়ে দেওয়া রইলো। আর্টিষ্টের মনোগত তাকে রূপ দিতে হ’লে আর্টিষ্টের মনোগত মান পরিমাণ প্রয়োগ করা চাই। এই ভাবে অনেকগুলো মনোমত মান পরিমাণ দিয়ে মনোগত অনেক যখন সৃষ্টি করলেন রূপ-সাধকেরা—তখন সে গুলো বিচার করে’ পরীক্ষা করে’ হ’ল শিল্পশাস্ত্রের প্রতিম লক্ষণ মান পরিমাণ ইত্যাদি লেখা।
আর্টিষ্টের মনোগত জনে জনে বিভিন্ন সুতরাং মনোগত মান পরিমাণ সেও ব্যক্তিগত এবং বিভিন্ন হ’তে বাধ্য। স্থির প্রতিমা নিয়ে ধর্মের কারবার, মান পরিমাণের অস্থিরতা রাখলে সেখানে কার্য চলেই না সুতরাং ব্যক্তিগত ভাবের উপরে প্রতিমা-লক্ষণ ছেড়ে রাখা চল্লো না, এই মাপ এই লক্ষণ এই দেবতা এমনি বাঁধাবাঁধির কথা উঠলো এবং শাসন হ’ল—‘নান্যেন মার্গেণ’। এই যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাপজোখ, তার সঙ্গে রীতিমত শাস্ত্রীয় শাসন যা প্রতিমার চোখের তারা ঠোঁটের হাসি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভঙ্গি ইত্যাদিকে একটু এদিক ওদিক হ’তে দিলে না, তাতে করে’ চুল তফাৎ হ’ল না মূর্তিটির প্রথম সংস্করণে ও দ্বিতীয় এবং পর পর তার অসংখ্য সংস্করণে, এতে করে পূজারীর কায ঠিকমত হ’ল কিন্তু আর্টের কাযে ব্যাঘাত এল। শাসনের জোরে মানুষের ক্রিয়া হ’য়ে উঠলো কল তবে চল্লো যেমন যুদ্ধের কায, তেমনি ধর্মটি প্রচার করতে শিল্পজগতে কতকগুলি আর্টিষ্ট ফৌজ সৃষ্টি করলেন শিল্পশাস্ত্রকার। বন্দুকের টোট একটার মতো যেমন দশ হাজারটা, ঠিক তেমনিভাবে একটি প্রতিমার দশ হাজার রকম প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করলে কি গ্রীস কি ভারত কি বা চীন কি বা ঈজিপ্টের কারিগরেরা যতদিন তারা শাস্ত্র মেনে প্রতিমা গঠন করলে; এর অন্যথা হ’ল বুদ্ধমূর্তি গঠনের বেলায় যিশুর ছবি আঁকার বেলায়। এমনি থেকে থেকে শাস্ত্রছাড়া প্রতিমা ও মান পরিমাণ আবিষ্কার করতে হ’ল এক এক আর্টিষ্টকে, তখন সেই মূর্তি হ’ল আদর্শ এবং তাই থেকে এল আবার শাস্ত্রীয় মাপ—বুদ্ধের যিশুর রামেসিসের। এই সব দেখেই শিল্পশাস্ত্রকার বলেছেন যে পূজার জন্য যে সব মূর্তি তারি কেবল লক্ষণ ও মাপ লেখা গেল, অন্য সকল মূর্তি যথেচ্ছ গড়তে পারেন শিল্পী মনোমত মাপজোখ দিয়ে।
এই যথেচ্ছ গড়ার ছাড়পত্র নিয়ে মান পরিমাণ ডৌল বর্ণ ইত্যাদি সম্বন্ধে যথেচ্ছাচার করা যে চল্লো তা নয়। শাস্ত্রের মতানুযায়ী মান পরিমাণ ধরে’ চলতে না চাই তো প্রকৃতিগত স্বাভাবিক মান পরিমাণ এবং নিজের মনোগত মান পরিমাণ ধরে’ চলতেই হ’ল। পরিমাণকে অতিক্রম করে’ যদি একটা মনুমেণ্ট খাড়া করি বস্তুর ভার ও ডৌলের সামঞ্জস্য রক্ষা না করে’—তবে পরিশ্রম ব্যর্থ হয় এবং কীর্তিস্তম্ভটি উঠতে উঠতে ভেঙে পড়ে আপনার ভারে আপনি। প্রমাণকে না মেনে ক্রোশব্যাপী একখানা ছাদ চারখানা দেওয়ালে চাপানো চল্লোই না, প্রথমেই ঠেকলে কড়ি বরগার মাপে জোখে—যত বড় ছাদ তত বড় কড়ির জন্য কাঠ পাওয়া দুষ্কর হ’ল, ছাদের ভরাণ দিতে মাপে কুলোয় না কাঠ বাঁশ কোনোটা,—এইভাবে স্বভাবের কাছ থেকে নানা বাধা; তারপর ছাদটার কাছ থেকেই বাধা এল, ছাদ বলতে থাকলো—আরো চারশোখানা এত খাড়াই এত মোটা দেওয়ালের ঠেকো দাও নচেৎ রক্ষে নেই। শাস্ত্রমতে না গড়লেও বস্তুগত সহজ মান পরিমাণ ছেড়ে গড়া সম্ভব হ’ল না। যে রেখা দিয়ে ছবিতে রূপ বাঁধি তার যথেচ্ছ ব্যবহার করা চল্লো না। বাঁকা সোজা সরু মোটা রেখা সমস্ত তাদের কোনটা এর সঙ্গে মেলে কোনটা ওর সঙ্গে মেলে না, কেউ জানায় সে ভারি, কেউ জানায় সে হাল্কা, এদের নিয়ে প্রমাণসই ভাবে সাজালেম তবেই তে। হ’ল গড় রূপটি পাকা, না হ’লে হ’ল হিজিবিজি ব্যাপার। রেখা সমস্তের সামঞ্জস্য এই মান পরিমাণের দ্বারা সুনির্দিষ্ট হয় তবে ফোটে রূপটি পরিষ্কার। এই সব অলিখিত মান পরিমাণ যদি না থাকে আর্টিষ্টের কাছে তবে ভুল হয় তার প্রতি পদে।
আমাদের উপর প্রায়ই হুকুম হয় ক্রেতার দিক থেকে—মুখটা একটু হাসি হাসি কর। এই যে হাসির পরিমাণ সে হাসা ঘোড়ার হাসি থেকে মুচকি হাসি চাপা হাসি পর্যন্ত রয়েছে। কি পরিমাণ হাসি কোন ডৌলের মুখে মানাবে তা না ভেবে যদি কায সুরু করি তো হয়তো ঘোড়ার হাসি দিয়ে বসলেম নদীয়ার গোরার মুখে! হাসির ধ্যান হ’ল ওষ্ঠের বিস্তার ও দন্তের বিকাশ, কিন্তু কি পরিমাণ ওষ্ঠের বিস্তার ও কতখানি দন্তের বিকাশ দরকার এ যার মান পরিমাণ ও সৌসামঞ্জস্য জ্ঞান আছে কেবল তাকে দিয়েই হয়।
কিমাকৃতি যখন দিচ্ছি রূপে তখন বসাচ্ছি মানুষের মুখে ঘোড়ার হাসি কিন্তু সেই ঘোড়ার হাসির সঙ্গে সঙ্গে মানুষটির নাক মুখ চোখ এবং সারা মুখমণ্ডলের রেখাগুলো আপনাদের মান পরিমাণ মিলিয়ে তবে হয় কিমাকার একটা রাক্ষুসে চেহারা। যেমন যখন কিম্পুরুষ দিতে হ’ল তখন মানুষ আর পাখীর মান পরিমাণ মেলাতে হ’ল সৌষ্ঠব দিয়ে যাতে করে’ কখনো মানুষের মাথার মাপে পাখীর দেহের মাপ হ’ল, কখনো এর উল্টোটা হ’ল, ও সেই সঙ্গে কমলো বাড়লো বাঁকলো চুরলো ডৌল রেখা ইত্যাদি সবই।
এখন লক্ষ্মী সরস্বতী কিংবা উমা দেবী—কিমাকৃতির মান পরিমাণ হিসেব কেতাব কিছুই খাটলো না এখানে, মানুষের স্বাভাবিক মান ধরা চল্লো না হুবহু। ভাটের বর্ণনায় বলা গেল বর্ধমানের বিদ্যাকে ‘রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী’, হিন্দুমতে ঘরের গিন্নীকে গৃহলক্ষ্মী বলাও চল্লে, কিন্তু এদের একটি একটি প্রমাণসই মর্মর মূর্তি কি ফটো প্রতিষ্ঠা করে’ লক্ষ্মী সরস্বতী পূজো করার কায চালানো গেল না। দেবপ্রতিম মানুষ হ’লে হ’ল না দোষের, কিন্তু মানুষপ্রতিম দেবতা হ’লেই গোল বাধলে কাযের বেলায়। রামায়ণের হনুমান সাধারণ মুখপোড়ার মাপে গড়লে ভুল হয়—অসাধারণ মাপ চাই অনন্যসাধারণ হনুমানের জন্যও।
করকমলেষু চরণকমলেষু এই হাত এই পা-কেই বলা চল্লো চিঠিতে, কিন্তু আঁকার বেলায় গড়ার বেলায় সাধারণ হস্ত ও পায়ের মাপটতে অদল বদল ঘটাতেই হ’ল, না হ’লে ঠিক রূপ পেলে না ঐ দুটি জিনিষ। এইভাবে পেলেম কলে ছাঁটা রূপের বেলায় শাস্ত্রমতো সমান মাপজোখ যা ধরে’ এককে হাজারবার আবৃত্তি করা চল্লো। শাস্ত্রলিখিত রাক্ষসী-প্রতিমার মান পরিমাণ সেটি ধরে’ কৌমার কি বামন মূর্তি গড়া চল্লো না, এইজন্য স্বতন্ত্র গোটাকতক মাপ রইলো—দশতাল দ্বাদশতাল নবতাল অষ্টতাল প্রভৃতি—যেমন কবিতার ত্রিপদী চৌপদী ইত্যাদি নানা ছাঁদ, যেমন সঙ্গীতে একতালা চৌতালা তেতালা নানা ঠেকা, এরা রূপ সমস্তকে ঠেকিয়ে রাখলে সুনির্দিষ্টতার মধ্যে—বাড়তে দিলে না কমতে দিলে না দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কোন দিকেই।
দ্বাদশতাল মানুষের পক্ষে অসাধারণ, কিন্তু যে রাক্ষসের কল্পনা করছি তার পক্ষে দ্বাদশ কিংবা তার বেশিও খাটে মাপ। সাধারণ মানুষ প্রভাবের নিয়মে একটা ছোট মাপ পেলে—অষ্টতাল সপ্ততাল নবতালের মাঝামাঝি একটা মাপ—একে অতিক্রম করা মানে অস্বাভাবিক করা। একটা পাহাড় প্রমাণ পাথরেই গড়ি বা এগারো ইঞ্চি ইটেতেই গড়ি, মানুষের স্বাভাবিক তালটি বজায় না রাখলে বেতাল মানুষ করা হ’ল। এই তাল বেতালকে মানিয়ে গড়তে পারলে যে সেই হ’ল রসিক ও আর্টিষ্ট এবং এই জন্যই রসরূপটিকে বলা হ’ল নিয়তিকৃত নিয়মরহিত হ্লাদময় ইত্যাদি।
স্বভাবের নিয়ম সেখানে নিয়মে এক পক্ষে বাঁধা এক পক্ষে ছাড়া সব রূপই; একটি গাছ বৃক্ষরূপের কঠোর নিয়মে বাঁধা কিন্তু স্বয়ংরূপের দিক দিয়ে সে সম্পূর্ণ ছাড়া দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বাড়তে কমতে। মানবরূপ সেও এক হিসেবে বাঁধা কিন্তু অন্য হিসেবে প্রত্যেক মানুষ স্বতন্ত্ররূপ।
শাস্ত্রের নিয়ম সে নিয়তির চেয়েও কঠোর নিয়ম, তার চারিদিক এমুখ ওমুখ সেমুখ করে’ বাঁধা—ধ্যান লক্ষণ মুদ্রা মান পরিমাণ সব দিয়ে; না হ’লে পুরুত ঠাকুরের কায চলে না, লক্ষ্মীতে আর গৃহলক্ষ্মীতে সব দিক দিয়ে স্বতন্ত্র করে’ রাখা ছাড়া উপায় নেই।
পুতুলওয়ালা যে খেলনা গড়েছে সে না মানলে নিয়তি, ন মানলে শাস্ত্র, অথচ অদ্ভুত কৌশলে সে রূপ সমস্ত দিয়ে চল্লো। রসের অনির্বচনীয়তাকে স্বীকার করে’ রূপ পেলে পুতুলওয়ালার হাতের পুতুল। রূপ দেবার দক্ষতা হিসেবে দেখতে গেলে পুতুলওয়ালাকে তারিফ দিতেই হয়, কেননা তার স্বষ্টিতে অপরিমেয়তা গুণটি পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান।
এক আত্মা থেকে আর একটি আত্মার রস পৌঁছে দেওয়া শাস্ত্রমান ধরে’ চল্লো না। আমাদের কাছে যা দেবতা সাহেবদের কাছে তা দৈত্য হ’য়ে রইলো, স্বাভাবিক মান পরিমাণ ধরেও এ কায চল্লো না,—আমার কাছে যার চেহারা ঠেকলো রূপে লক্ষ্মী তুমি তাকে বল্লে লক্ষ্মীপেঁচাটি! আমার মানুষ—তোমার ঘরে তার মমর মূর্তির স্থান দিতে ব্যস্ত হও না কেউ, কিন্তু পুতুলের যেলা স্বতন্ত্র কথা। মেলার পুতুল সোনার খেলনা সর্বদেশে সব ঘরেই তার স্থান হ’ল—বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ-সিংহাসনে পুতুল, খেলাঘরের কুলুঙ্গীতে পুতুল, হাটে পুতুল, বাটে পুতুল—যেখানে রাখ তাকে সব জায়গাতেই তার আদর আছে দেখবে। পুত্তলিকা-শিল্প—শিল্পের মূল সেখানে রসের মধ্যে শিকড় গাড়লে; প্রতিমা-শিল্প—ধর্মের মধ্যে শিকড় তার; তথাকথিত স্বভাব-শিল্প—প্রতিবিম্বকে আঁকড়ে ধরতে চলেছে তার শিকড়। বিশ্বকর্মার মানস মান পরিমাণ দিলে বিশ্বরূপ; সমস্তের, খেলনাওয়ালার মানস মান পরিমাণ দিলে খেলাঘরের রূপ সমস্তকে—এই দিক দিয়ে এ ওর হ’ল সমান এবং অসমানও।