বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/ভাব
ভাবয়তি পদার্থান্ ইতি ভাবঃ।
ভাবযুক্ত পদার্থ নিয়ে কথা, শুধু রূপটা আর তার মান পরিমাণ দিয়ে খালাস নয় আর্টিষ্ট। ছুতোরে কুঁদে দিলে লাটিমের ডৌল, কামারে পরালে তাতে আল, তাঁতি পাকিয়ে দিলে দড়া। পেশা বিভিন্ন হ’লেও এরা তিন জনেই কারিগর,—কেউ ডৌল দিতে পাকা, কেউ সূচ বেঁধাতে পাকা, কেউ সূতো জড়াতে পাকা, কিন্তু লাটিমকে বিয়ের ক’নেটির মতো অলকা-তিলকা দিয়ে সাত রঙের বরণডালাটি মাথায় সাজিয়ে ভাবযুক্ত করলে আর্টিষ্ট,—ভুল্লো তবে ছেলে। একটু বড় হ’লে ঘুড়ির সঙ্গে এই ভাবে ভাব হ’ল, আরো বড় হ’লে হ’ল ছবির সঙ্গে ভাব, পরে হ’ল রঙ্গীন কাপড়ের সঙ্গে ভাব, এই ভাবে কেউ ভাব করে ফেল্লে কবিতার সঙ্গে, কেউ বা আর কিছুর সঙ্গে। বণিকের ঘরে সুন্দর সুন্দর অলঙ্কার ধরা থাকে স্তূপাকারে—কিন্তু এতে করে বুঝতে হবে না যে বণিকের সঙ্গে অলঙ্কারগুলোর ভাব হ’য়ে গেছে। ভাবুক সে নিজে ভালবাসে সাজ, অপরকে ভালবাসে সাজাতে, ভাব হ’ল তার যেখানে যা কিছু অলঙ্কৃত এবং যা কিছু অলঙ্কারক আছে তার সঙ্গে। একজন যে সংসারের তেল-নুন চাল-ডালের ভাবনা নিয়ে বসে’ আছে কিংবা যে গট্ হ’য়ে বসে’ মস্ত আফিসের ফাইল আর হিসেবের ভাবন ভাবছে—তাদের বলতে হ’ল ভাবনাগ্রস্ত। পরকালের ভাবনা ভেবেই আকুল, হরিনামের মালা জপছি, শাস্ত্রমতে ত্রিবিধ ভাবনাই ভাবছি, কিন্তু ভাবুক নয় একেবারেই। মালাও জপছি না হরিসভাতেও যাচ্ছি না খাচ্ছি-দাচ্ছি আফিস করছি আর খাতায় মিষ্টি মিষ্টি পদাবলী গীতা ছড়া নাটক লিখছি যা শুনে লোকের ভাব লেগে যাচ্ছে, তখন আমাকে ভাবনাগ্রস্ত নয় ভাবুকই বলবে লোকে। মালি রয়েছে ফুলগাছের ভাবনা নিয়ে কিন্তু পুষ্পলতার ভাবের সে তো ভাবুক হ’ল না এতে করে’। মালাকার গাছের ভাবনা ভাবে না, অথচ সে পড়লো ভাবুকের দলে—তার ভাবনাগুলি ফুলের হার ফুলের সিঁথি ফুলের তোড়া কত কি রূপ ধরে প্রকাশ হ’ল। উকিল ভেবেচিন্তে পাকা দলীল লিখে ফেল্লে— যথেষ্ট গুণপন প্রকাশ হ’ল তার, কিন্তু ভাবুকতা প্রকাশ করলে দলীল লিখতে উকিল এ বল্লে তার ওকালতী বুদ্ধিকে খাটো করা হয়; তেমনি “কৃষ্ণকান্তের উইল”—সেখানে বঙ্কিমবাবু তাঁর ওকালতী বুদ্ধি খাটিয়েছেন ভাবুকতা নয় বল্লে মুস্কিল। কুবেরের ছিল হিসেবি বুদ্ধি, তিনি ভাবতেন ধনের হিসেব, আর কুবেরের অনুচর যক্ষরাজের ছিল রসবোধ, হিসেবি-বুদ্ধি একটুও নয়, সে বলে’ হিসেবের খাতায় অঙ্ক ন কসে’ এঁকেই চল্লো প্রিয়ার ছবি—এ ওর ভাব বুঝলে না, এক বছরের জন্য সস্পেণ্ড হ’লেন যক্ষরাজ। এই এক বছরে বুদ্ধির জোরে তবিলের ফাঁক পূর্ণ হ’ল ধনপতির, আর বিরহী যক্ষের বুক ভাবসম্পদে ভরে’ উঠলো দিনে দিনে। যক্ষ যদি বুদ্ধি খাটাতে চলতে তো মেঘকে দিয়ে ডাক-পেয়াদার কাজ করাতে চলতো না, সে ভাবুক ছিল তাই নির্ভাবনায় মেঘকে দূতের পদে বরণ করে নিয়েছিল। মেট্রোলজির রিপোর্ট বুদ্ধিমানে লেখে, আর ভাবুকে লেখে মেঘদূতম্।
কেল্লায় তোপ পড়লো—রাত নটা বাজলো এই জ্ঞান জন্মে’ দিয়ে চুকলো তার কাজ, রাত্রির যে ভাবটি সেটি মনে পৌঁছে দেওয়া হ’ল না তোপের শব্দে, তোপ জানান দিলে মাত্র প্রহর। সন্ধ্যায় আরতির ঘণ্টাধ্বনি—সে শুধু জানালে না আরতির বেলা হয়েছে, গির্জের ঘণ্টা— সে শুধু জানালে না এত প্রহর হয়েছে, বিয়ের বাঁশী—সে শুধু জানালে না লগ্ন আর সময়টা; ভাবযুক্ত ধ্বনি এরা, রসের সংবাদ দিয়ে গেল সবাই ভাবের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে। শাস্ত্রকার বলেছেন, রস ছেড়ে ভাব নেই, ভাব ছেড়ে রস নেই। ধর সখ্যরস—ভাব হ’ল দুই ছেলেতে তবে রস জাগলো মনে মনে। এমনি ছেলেতে ছেলেতে ঝগড়া—সেখানে দুই বিপরীতমুখী ভাবের ধাক্কা জাগালে আর এক রকম রস। আবার কোথাও কিছু নেই হঠাৎ মনে একটা ভাব জাগলো, রসও বিঁধলো প্রাণে সেই সঙ্গে। অহেতুক ভাবের উদয়ে কোথাও কিছু নেই হঠাৎ একটা সুর মনের মধ্যে গুণগুনিয়ে ওঠে, একটা ছন্দ দোল খেতে লাগে প্রাণের দোলায়, রঙের একটা নেশা উপস্থিত হয়, চোখে—কারণ সন্ধান করে’ পাইনে খোঁজ।
কোকিল ডাকলো বলেই বসন্ত এলো, না বসন্ত এলো বলেই কোকিল ডাকলে? ভাব হ’ল বলে রস হ’ল, না রস জাগলো বলে’ ভাব হ’ল? এর মীমাংসা করা নৈয়ায়িকদের কাজ, তবে এটা নিজে নিজে আমরা সবাই অনুভব করেছি যে শীতকালের বর-কনে দুজনের কাছেই কোকিল দিলে না সাড়া বাইরে, কিন্তু বুকের ভিতরে পড়ে’ গেল তাদের তাড়া ভাবের ফুল ফোটাবার; কিন্তু ফুল রইলো ঘুমিয়ে শীতের রাত্রে বনে বনে, হঠাৎ মনে মনে বসন্তবাহার রাগিণীতে মনোবীণা বেজে উঠলো আপনা হ’তে, লেগে গেল সেখানে বসন্ত উৎসব।
মানুষের ভাব প্রকাশ করে যে সমস্ত রস-রচনা কবিতা গান ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি—তারা কোনটা সহেতুক কোনটা এইভাবে অহেতুক বলে ধরতে পারি। দু’ তিন পাট কাপড় জুড়ে কাঁথা বোনা হচ্ছে। এই কাঁথা বোনা হ’ল শীতের নিমিত্ত, শীত হ’ল হেতু এখানে কাঁথার। যেখানে শীত নেই সেখানে কাঁথা বোনার কাজ হয় অকারণে কাজ। শীতের কাঁথার উপরে যে কাজটা করা যাচ্ছে সেটা কি শীত নিবারণের নিমিত্ত করা হচ্ছে? সুন্দর দেখাবে বলেই তো কাঁথার উপরটায় কাজ করছি, কাজেই শীত এবং সৌন্দর্য দুটো হেতু হ’ল কাঁথা রচনার বলতে হয়।
যে রচনার হেতু মাত্র আপনা হ’তে রসের উদয়, তাকে বলতে পারি অহেতুক রচনা। না হ’লে হেতু নেই কারণ নেই কোনো কিছুর নিমিত্তও নয় অথচ রচনা হ’ল কিছু,—এমনটা হয় না। ছেলেটা কোথাও কিছু নেই খেলতে খেলতে হঠাৎ কান্না ধরলে কি গেয়ে উঠলো কি নাচ সুরু করলে, ছেলের মনের ভিতরটাতে কি হচ্ছে ধরা গেল না, কাজেই বল্লেম—ছেলে অকারণে হাসে কাঁদে কেন দেখতো।
শিল্প-কাজ সমস্তের মধ্যে একটা দিক থাকে যেটা রস ও ভাবের দিক। সেখানে ভাব উদয় হল, কবিতা লিখলেম, ছবি লিখলেম, পান গাইলেম, নৃত্য করলেম; ভাবের বশে কলম চল্লো তুলি চল্লো হাত চল্লো পা চল্লো। শীতের জন্য যে কাঁথা সেটা সুন্দর না হ’লেও কাজের ব্যাঘাত হয় না কিন্তু তাকে যদি শুধু শীত-নিবারণকারী না রেখে চিত্তহারীও করে’ দিতে চাই তবে খানিক সুন্দর কারুকার্য দিয়ে ভাবযুক্ত করা চাই, তবেই সেটা একটা স্থান পেলে শিল্পজগতে, না হ’লে সে রইলো কাজের জগতে খুব কাজের জিনিষ হ’য়ে পড়ে।
একটা দিক শিল্প-কাজের যেটা হচ্ছে প্রকরণের বা টেকনিকের দিক, সেখানে নৃত্যের আঙ্গিক ব্যাপার গানের বাচিক ব্যাপার ও কৌশল—এক কথায় রূপ দেবার ও ভাব প্রকাশ করার কৌশল—সমস্ত রয়েছে। ভাল করে’ লিখতে হবে তাই ভাল করে’ কলম্ বাড়ছি, রুল টানছি,—ভাল করে’ বাজাবো বাঁশী ফুটোফাটা বেছে কারিগরি করছি’ সরল বাঁশে;—নাচতে হবে ভাল করে’ তাই পায়ের নানা কায়দা শিখছি। ভাব নেই, ভাষাতে দখল নেই—ছন্দ ছাড়া হ’ল সব। পাগলের প্রলাপ আর ওস্তাদের আলাপ দুয়েরই মূল হ’ল ভাব, তবু যে দুয়ে ভেদ করি তার কি কোনো কারণ নেই?
লেখার বেলায় দেখি যে চেক্ লিখছে আর যে ছবি লিখছে—দুয়ের কাজে ভেদ হচ্ছে সব দিক দিয়ে। তামাক আনতে দেরী হওয়াতে রেগে চাকরের নাকে ঘুসি বসালেম, আর অভিনয় করে’ ষ্টেজের উপরে উঠে একজন কারু বুকে ছুরি দিলেম—ভাবের বশে দুই ক্রিয়াই হ’ল—কিন্তু দুই কাজকেই এক শ্রেণীর কাজ বলে ধরা চল্লো না। চাকরকে মারলেম রাগের হেতু, নাটকের জগৎসিংহ হ’য়ে ওসমানকে মারলেম রসের খাতিরে, রাগের হেতু মোটেই নয়। রূপের কারণে নয় রসের কারণে যে মার তাই হ’ল ষ্টেজের মার বা মারের ভাণ মাত্র। এখন রস ও ভাব সৃষ্টির জন্য সকারণ মার বা সত্যিই মার যদি রঙ্গমঞ্চে গিয়ে দেওয়া যায় তবে রসের আগেই এসে হাজির হয় পুলিশ এবং লোকটিকে অকারণে প্রহারের জন্যে পড়ে হাতে হাতকড়ি; ভাবের দোহাই চলে না তখন, কেননা সত্যি সত্যি মার রস দেয় না বেদনা দেয়। মানচিত্র—ভাব জাগাবার কালে তাকে কাজে লাগানো চল্লো না, কোনো একটা জায়গার স্মৃতি তাও জাগিয়ে দিতে কাজে এলো না মানচিত্র। চিত্রপট দিয়ে ভাব জাগানো চল্লো, রস জাগানো চল্লো। এমনি তারাপীঠ শ্রীপাট প্রভৃতি প্রতীক চিত্র তন্ত্র-মন্ত্রের কাজে এলো কিন্তু ভাব জাগাবার কাজে এলো না, আবার নীলাম্বরের নীরস চিত্র প্রতীক নয় কিন্তু আকাশের ভাবটার প্রতিম। নীলাম্বরী সাড়ি তাকে আকাশের প্রতীক বলে’ এক হিসেবে ধরা চলে আবার চলেও না—সে প্রতীক হ’য়েও প্রতিমা, কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্রের একটা যন্ত্রচিহ্ন সে কেবলমাত্র প্রতীক—বিশেষ নামে অভিহিত কতকগুলো রঙ ও রেখার সমাবেশ—নিজে সে কিছুর প্রতিমা নয় ভাবও জাগায় না, ভক্তেরই কাজে লাগে। প্রতিমা-শিল্পের কৌশলই হচ্ছে রূপটাকে ভাবের প্রতিম করে’ তোলাতে। একটা পোড়ামাটির পুতুল—তার সঙ্গে ভাব হয় কেননা সেটা ভাবের প্রতীক করে’ গড়া হ’য়েছে বলেই, কিন্তু বেশ করে পোড়ানো একখানা এগারো ইঞ্চি ইট বা টালি তার সঙ্গে ভাব হওয়া শক্ত—সেটা ভাবের বস্তু নয় বলেই। আকাশ থেকে ঝরে’ পড়া এক পশলা জল, চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়া এক বিন্দু অশ্রু—ভাবের বস্তু এরা, কিন্তু নোনা ধরা দেয়াল থেকে খসে’-পড়া এক চাংড়া বালি ভাবের বস্তু নয়, অথচ নদীর বালুচর—সেখানে বালি একটা ভাবের সৃজন করলে। বর্ষার শেষে আকাশে ভাসছে এক টুকরো মেঘ—সারা বর্ষার ভাবটা তাকে তখনো রাখলে মনোহর করে; পুরোনো শালের চমৎকার টুকরো পুরোনো ছবি মূর্তি চিনের বাসনের টুকরো যে ভাবে মনোহর তার চেয়েও ভাব-সম্পদে মনোহর ঐ ছেঁড়া মেঘের একটি খণ্ড। কাজেই বলি ভাবের প্রতিম যেটি হ’ল সে অখণ্ড ভাবেও যেমন খণ্ড ভাবেও তেমনি রস ও ভাবের বস্তু হ’য়ে রইলো। একটি ইটের পাঁজা—সে জাগাচ্ছে ভাব, একটা পাথরের স্তূপ পিরামিড বা পাহাড়—তারা জাগাচ্ছে ভাব, একটা ভাঙা বাড়ী—সে জাগাচ্ছে ভাব, কিন্তু একটা ভাঙা টালি বা ইট সে ঝরা ফুলের পাপড়ি একটি যেমন ভাবের বস্তু তেমনতরো ভাবের বস্তু বলে’ চলতে পারলে না। পুরো মানুষটা কি বাঁচা কি মরা দুই অবস্থাতেই ভাবের সঙ্গে এক হ’য়ে আছে। শুধু মানুষ কেন সব জানোয়ারের বেলাতেই এই কথা। কিন্তু মরা মানুষের কি বন মানুষের হাড়—তার সঙ্গে ডাক্তারেরও পুরোপুরি ভাব হয় কি না সন্দেহ, অথচ কঙ্কাল-মালিনী তাঁকে প্রতিমাতে ধরেছে আর্টিষ্ট ভাব দিয়ে কত বার কত ভাবে কত ছাঁদে তার ঠিক নেই। যাদুকরের সঙ্গে জড়িয়ে বন মানুষের হাড় জাগায় একটা ভাব। ভাবের ইতর-বিশেষের কথা ছেড়ে দিয়ে দেখ—এক থলি টাকা দেখে যে ভাব হয়, এক থলি মোহর কি একখানা কোম্পানীর কাগজ দেখে ভাবটা সেই একই রকম হয়, কেবল মাত্রাটা বেশি হয় মাত্র। যে রস দেয় খাদ্য সে রস দেয় না অর্থ, এক থাল মোয়া সম্পূর্ণ অন্য ভাব দেয় এক থলি মোহর থেকে। যে সব জিনিষ নিয়ে মানুষ খেল্লে যাদের সঙ্গী করে’ পেলে লীলায় এবং কাজেও বটে, এমন কি যাদের চিবিয়ে খেয়ে ফেল্লে পর্যন্ত, তাদের সঙ্গেই ভাব হ’য়ে গেল মানুষের—একটা কোন না কোন রকমের ভাব। ধূলো নিয়ে খেলে, ধুলো তুলে’ মুখে পোরে ছেলে—ধূলো-কাদার সঙ্গে তার রকম রকম দিক দিয়ে ভাব, এমনি টাকার সঙ্গে ভাব হ’ল কারু জুয়োখেলার দিক দিয়ে, কারু খাওয়া-পরার গাড়ী-ঘোড়ার স্বপ্নের দিক দিয়ে। খুঁটিনাটি তারতম্য নিয়ে দেখতে গেলে দেখি রসের রকম ভাবের রকম অনেকগুলো,—রস কেবল নয়টা নয়, রস অনন্ত, ভাবও গোটাকতক নয়, ভাব অনন্ত।
রূপের বেলায় শাস্ত্রকার বল্লেন “রূপভেদাঃ”—লক্ষ্য রইলো রূপে রূপে ভেদ নির্দেশ করা। মান পরিমাণের বেলায় তেমনি বল্লেন “প্রমাণানি”—বহুবচন দিয়ে নির্দেশ করা হ’ল ভিন্ন ভিন্ন রূপের জন্য বহু প্রমাণ। ভাবের বেলায় বল্লেন ‘ভাবযোজনম্—রূপকে ভাবের সঙ্গে যুক্ত করা চাই, ভাব যোজনা করতে হবে রূপে। এতে করে বোঝাচ্ছে যে ভাবে রূপের সঙ্গে তার মান পরিমাণকে আমরা পেয়ে যাচ্ছি সে ভাবে ভাবকে পাচ্ছি না—বস্তুরূপ রয়েছে একঠাঁই, ভাব রয়েছে অন্যঠাঁই। বলে থাকি ভাবযুক্ত কথা, ভাবযুক্ত রূপ, ভাবযুক্ত লেখা, ভাবযুক্ত সুরসার ছবি মূর্তি, কাযের সময় কিছু একটা দেখে’ বলিও আমরা এটা ভাবযুক্ত অন্য কিছু সেটি ভাবযুক্ত নয়। সকালের ভাব সন্ধ্যার ভাব দিনের ভাব রাতের ভাব এ সব বুঝতে দেরী হয় না আমাদের, জীবনটা দিন রাতের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ওদের সঙ্গে খানিক ভাব করে’ নিয়েছে। এমনি আরো জগৎ শুদ্ধ জিনিষ কারু সঙ্গে কাজের সম্পর্ক কারু সঙ্গে বা বাজে একটা সম্বন্ধ নিয়ে চেনাশোনা ও পরিচয় করে’ যাচ্ছি আমরা, চেনা পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যাদের কাছে পাই তাদের ভাবের খানিকটা পেয়ে যাই সেই সূত্র ধরে’ ক্রমে বন্ধুতা থেকে আত্মীয়তা পর্যন্ত ঠেকে গিয়ে ভাব হয় উভয় পক্ষে। অবসরের অভাব ভাব বোঝার ব্যাঘাত ঘটায় অনেকক্ষেত্রে—কেরানীর অবসর নেই সকাল সন্ধ্যা অন্তরে অন্তর মিলিয়ে ভাব করে’ নেওয়া, কবির সে অবসর আছে। সামান্য অবসর সেখানে দু’ একদিক দিয়ে অল্পভাব, অনেকখানি অবসর সেখানে বহুদিক দিয়ে অনেকখানি ভাব। সহজে ভাব করতে চট করে’ ভাব ধরতে পাকা থাকে এক একজন—তারাই ভাবুক। পূজোর কন্সেসন পেয়ে যেন আমরা সবাই ছুটেছি নতুন নতুন দৃশ্য ও দেশের মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন জিনিষ দেখতে দেখতে, সবাই কিছু আমরা ভাবুক নয়, সুতরাং ভাব হ’য়েও হ’ল না আমাদের যা দেখছি যা শুনছি যা নাগালের মধ্যে আসছে চোখের হাতের মনের তাদের সঙ্গে। ভাবুকের বেলায় এমনটা হয় না, সে ভাব কুড়োতে কুড়োতে চলে যাত্রার আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত, সে যখন ছুটির শেষে দেশে ফেরে ফেরার পথেও ভাব করে নিতে আসে সবার সঙ্গে, ফিরে এসেও সে চলে নতুন থেকে নতুনের সঙ্গে ভাব করে’ নিয়ে। আর আমি যে ভাবুক নয় আমি আসি মাত্র নতুন দেশ দেখে’ বেশ খেয়ে মোটা হ’য়ে শীত কি গ্রীষ্ম বেশ ভোগ করে’, জলে স্থলে ঘুরে’, অনেকখানি স্বাস্থ্য নিয়ে,—অনেকখানি ভাব নিয়ে নয়। একটা কিছুর তত্ত্ব জানা এক, আর ভাব জানা অন্য। বিশ্বের শিল্পকার্যের পুরাতত্ত্ব জানলেম এবং তাদের ভাবটা জেনে নিলেম—এই নিয়ে তফাৎ তত্ত্ববিদে আর ভাবুকে।
কোনো কিছুর হৃদ্গত ভাব বাইরের কতকগুলো ভঙ্গি দিয়ে ধরা পড়ে। রচনার ভঙ্গিতে কথার ভঙ্গিতে সুরের ভঙ্গিতে ওঠা বসা চলাফেরার ভঙ্গিতে ধরা পড়লো ভাব তবেই তো পেলেম মনের সঙ্গে মিলিয়ে বস্তুটির আসল রসটা। শাস্ত্রকার বলেছেন, “যাহা গ্রীবা তির্য্যক-করণ ও ভ্রূনেত্রাদির বিকাশকারী তথা ভাব হইতে কিঞ্চিৎ প্রকাশক তাহাকে ‘হাব’ কহা যায়।” অন্তরের মধ্যে কুলুপ দেওয়া থাকে তো ভাব হয় না, কুলুপ খুল্লো তো ভাব হয়ে গেল এতে ওতে তাতে। হাবভাব দিয়ে সহজে জানা গেল এবং জানান দেওয়া চল্লো মনে কি আছে। চোখের ইসারা হাতের ভঙ্গি ইত্যাদি সব ব্যাপার এবং গলার স্বর ইত্যাদি—এর হ’ল ভাব প্রকাশের ভাষা। সকালের আকাশ সন্ধ্যার আকাশ জানাচ্ছে রঙের ভাষায় নানা ভাব, একমাত্র ভাবুক জানে এই ভাষা যা দিয়ে মেঘ যাচ্ছে জানিয়ে ভাব-ফুল ফুটছে এবং ঝরছেও জানিয়ে ভাব। যখন কবি একটি গাছকে সবুজপরী বলে বর্ণনা করলেন তখন এটা হ’তে পারে যে কবি নিজের মনের ভাবটা গাছেতে আরোপ করে’ গাছকে দেখছেন পরীরূপ, আবার এও হ’তে পারে যে গাছটি সত্য সত্যই আপনাকে ধরেছে কবির সামনে পরী সেজে। যাত্রার অধিকারী যখন যাত্রার পালার জন্য গেল কবির কাছে তখন কবি নিজের কল্পনার সাহায্যে মনোমত করে পাত্রপাত্রীদের সাজিয়ে ছেড়ে দিলেন। সেখানে রূপ সমস্ত কবির কল্পনার কবির ভাবের দ্বারা মণ্ডিত হ’ল—যেমন ভীমের কল্পনা রাবণের কল্পনা। ভীম ও রাবণ চাক্ষুষ হ’ল না কবির কাছে কিন্তু কবির দেওয়া সাজ ধরলো এক একটা ভাব ও রস ভীষণ মূর্তিতে। ধর কবি যখন বল্লেন উপমা দিয়ে “সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব”—এখানে ভাবটা তিনি মন থেকে আরোপ করছেন এও বলতে পার, আবার লতার মতো অনেক রূপসী ও রূপসীর মতো অনেক লতা প্রত্যক্ষ দেখে’ এই কথাগুলি কবি বলছেন এও বলতে পার। পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ রুদ্রের ভাব ভঙ্গি আকৃতি প্রকৃতি কিছুই নেই তাতে, অথচ শিবত্ব সম্পূর্ণ আরোপ করে’ দেখলেন ভক্ত, কিন্তু পূর্ণ চন্দ্র তাতে দেখলেম সোনার থালের ভাবটা, ফুলে দেখলেম ফুলকুমারীকে,—সেখানে নিজের মনোভাব বা কল্পনা আরোপ করে দেখতে হ’ল না, ভাবটা বস্তু থেকেই পেয়ে গেলাম। এই ভাবে বলতে পারি আরোপিত ভাব এবং আহরিত ভাব এই দুই রাস্তায় চলাচলি ভাবুকের মনের। কেন যে একটা ভাবে একটা কিছুকে দেখি আমরা তার সঠিক হিসেব সব সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। পেঁচাটা রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলা ফেরা করে, চিৎকারটা বিকট পেঁচার, সুতরাং নিশাচর বলে’ একটা ভয়ের ভাবের সঙ্গে জড়িয়ে দেখার অর্থ বুঝি, কিন্তু কাক সে দিব্যি দিনের আলোতে দেখা দেয়, রঙটাও তার কালো কৃষ্ণের মতোই সুন্দর চিকণ কালো, কেন যে যমদূত ভেবে ভয় খেলে মানুষ তাকে তার অর্থই পাইনে। যার ভাবটা ঠিক বোঝা যায় না তাকে ভয়ের ভাবে দেখি আমরা, আবার যা ভাল বুঝি না এমন গভীর রহস্যে ঘেরা কিছু সেও ভাব নিয়ে মনকে টানে। চাঁদনী রাত সেখানে ভাবুকের আনন্দ, হয়তে যে ভাবুক নয় তারও আনন্দ, সুতরাং দুজনেই না হয় জ্যোৎস্নারাতকে একটা ফুটন্ত ফুলের মতো আনন্দরূপ বল্লে, কিন্তু রাত্রির ভাব বুঝিনে সবাই যেখানে অন্ধকারে, যে ভাবুক নয় সে ভয়ে চুপ রইলো কিন্তু ভাবুক সে গভীর রাতের স্তব্ধ ভাব দেখে’ ভাবে বিভোর হ’য়ে কত কথাই বলে’ চল্লো দেখি।
দিনে বোধ করি চারিদিকে জাগ্রত ভাব, রাতে বোধ করি সুপ্তির ভাব এবং এই দুই ভাবেতে করে’ সত্যিই আমাদের ঘুম ভাঙায় ঘুম পাড়ায়ও। উৎসবের রাত আলোতে আলো হ’ল, নাচে গানে আনন্দে পরিপূর্ণ হ’ল, ঘুম এল না তখন, রাত পোহালো জেগে জেগে কোথা দিয়ে, কিন্তু যেমনি উৎসব বন্ধ হ’ল অমনি আলস্যের ভাব এসে ধরল চেপে, ঘুম এল, মনমরা হ’য়ে থাকলেম শুয়ে যদিও জানি তখন বেলা দুপুরের জাগরণে সবাই জেগে বিশ্বে। বিচিত্র রকমে হয় ভাবের ক্রিয়া চরাচরের যা কিছু তার উপরে। একটা গাছ এক মনোভাব নিয়ে দেখলেম একরকম, পর মুহূর্তেই অন্যভাব নিয়ে দেখলেম সে অন্যরূপ। একই বস্তুকে আমি দেখি একভাবে, তুমি দেখ অন্যভাবে। ফুল-পাতায় সেজে এই দেখা দিলে গাছ একভাবে, ফুল পাতা ঝরিয়ে দেখা দিলে সেই গাছই আবার অন্যভাবে। আমরা কখনো নিজের ভাবে চরাচরকে বিভাবিত দেখি কখনো বা নিজের অন্তরকে বিভাবিত দেখি চরাচরের ভাবের দ্বারা। ভাবুকের রচনা থেকে এবং আমরা নিজের নিজের কাছ থেকেও এর প্রমাণ পাই।
সূর্যের আলোয়, রুদ্র তেজস্বিতা ইত্যাদি অনেক ভাব, চাঁদের আলোয় শীতল কান্ত নানা ভাব। সূর্যের এক রকম ভাব, জলের এক রকম, আকাশের অন্য রকম ভাব। ঋতুতে ঋতুতে চরাচরের ভাবপরিবর্তন এসব চাক্ষুষ ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভাবের ক্রিয়ার। অবস্থাভেদে ভাবভঙ্গির ভেদ, ভাবের ভেদে নানা অবস্থাভেদ দেখতে পাই আমরা;—শয়ন, উপবেশন, গমন, গমনের ইচ্ছা, হাত মুখ চোখ ইত্যাদি নেড়ে বলা কওয়া, সভাতে গম্ভীর হ’য়ে বসা, পাতে বসে’ যাওয়া ভোজে, বর সেজে আগমন, তালঠুকে মারামারি করতে যাওয়া, খেলা করতে এগোনো, কোমর বেঁধে কাজ করতে চলা, নৃত্য করা ঘুরে’ ফিরে’ তালে তালে, যেন নাচবো এইভাবে নড়ে’ চড়ে’ ওঠা আনন্দে,—ক্রীড়া কৌতুক নিদ্রা সব অবস্থাতেই ভাব এক এক রকম, ভঙ্গি ও এক এক রকম; ভাব থেকে ভাবান্তর, অবস্থা থেকে অবস্থান্তর—এই হ’ল চরাচরের গতিবিধির নিয়ম।
হাব ভাব দিয়ে আসল ভাবটা ব্যক্ত করা হয় যেমন তেমনি আবার হাবভাব দিয়ে আসল ভাবটা—যেটাকে বলতে পারি স্বভাব অভিপ্রায় (intention)—তাকে গোপন করাও হয়; যে চাবি খুল্লে তালা সেই চাবিই বন্ধ করলে তালা। অভিনেতাকে নিজের ভাবটা ধরে’ চল্লে তো চলে না, কেননা নিজের মনোভাব যাই থাকুক সেটা গোপন রেখে নায়কের ভাবটা অভিনয় করে’ দেখাতে হয়। হয়তো বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনার চিন্তায় মুহ্যমান অভিনেতা, কিন্তু দেখাতে হচ্ছে অভিনয়ক্ষেত্রে তাকে বেশ ফুর্তিবাজ নায়কের ভাব। চোর তার মনে মনে কুভাব, কিন্তু বাইরে দেখাচ্ছে সাধুর ভাব উদ্দেশ্য-সিদ্ধির জন্য। ছবিতে কবিতায় ভাব একেবারে গোপন রাখলে রচনার উদ্দেশ্য মাটি হয়, কাজেই নানা ব্যঞ্জনা নানা ভঙ্গি দিয়ে কোথাও ভাবকে সুপরিস্ফুট কোথাও অপরিস্ফুট করে দিয়ে কাজ চালাতে হয়। ভাব ভাবাভাস ভাবোদয় ভাবসন্ধি ভাবসরলতা এমনি ভাবের নানা দিকের কথা অলঙ্কারশাস্ত্রে বলা হয়েছে, এ সবই কাজে আসে আর্টিষ্টের রকম রকম কাযের বেলায়। বিষয়টা এক কিন্তু কি ভাবে তাকে প্রকাশ করা হ’ল লেখায় বা চিত্রে—এই নিয়ে প্রভেদ এক রচনাতে অন্য রচনাতে। চন্দ্রোদয় জলের ধারে সে এক ভাব, চন্দ্রোদয় বনের শিয়রে সে আর এক ভাব,—“চন্দ্রোদয়ারম্ভেমিবাম্বুরাশিঃ”—এ এক ভাবের ছবি জলের ঢেউয়ের গুটিকতৃক টান আর পূর্ণ চন্দ্রটির আভা—জাপানের আঁকা ছবির ভাব। আবার “শারদ চন্দ্র পবন মন্দ বিপিনে ভরল কুসুমগন্ধ”—এখানে আর এক ছবি আর এক ভাব যেন কাংড়ার কোনো শিল্পীর আঁকা ছবিখানি, হুবহু সেই ভাব। এখন কবি কালিদাসের চন্দ্রোদয়ের ছবি থেকে পাচ্ছি জলরাশির স্ফীত ও উচ্ছ্বসিত ভাব—এপার-ওপার নেই কেবল ফুলে’ ফুলে’ উঠছে জল আর জল, চাঁদ উঠি উঠি করছে—এই ভাব এই ভঙ্গি এই অবস্থা। আবার ছেলে ভুলোনো ছড়ার অজানা কোন এক কবি—তাঁর চন্দ্রোদয়—“দুলতে দুলতে বান এসেছে, জলে কত চাঁদ ভেসেছে, সোনার বরণ সোনার চাঁদ!” চাঁদের আলোয় কোন্ নদী বইছিলো গাঁয়ের ধারে সেই দেখে ভাব জাগলো গেঁয়ো কবির কিন্তু কাজটা হ’ল আর্ট হিসেবে কালিদাসের চন্দ্রোদয়ের সমানই ভাবের জিনিষ। যে ভাবুক সে সব জিনিষেই ভাব যোজনা করে’ দিতে পারে, ভাব জাগাতেও পারে সামান্য অসামান্য সব জিনিষ দিয়েই; এক আঁজলা ফুল এক মুঠো পুঁতি বা মোতী এগুলোকে ভাবযুক্ত করে দেওয়া সহজ কর্ম নয়।
প্রথম রাত্রে সুভদ্রার অভিসার অর্জুনের কাছে নির্মল হয়েছিল, তারপর আর্টিষ্ট সত্যভামার হাতের একটু পরশ যখন সুভদ্রাকে ভাবময়ী করে’ ছেড়ে দিলে তখন ভাব হ’য়ে গেল অর্জুনে সুভদ্রায়। মালিনী সে যে হার গেঁথে দিলে সুন্দরকে, তা তো শুধু ফুলহার হ’ল না, ভাবের বেড়িও হ’ল। শ্বেতপাথর গেঁথে গেঁথে ইমারৎ সাহেব-কোম্পানীও করেছে কিন্তু কী পাথরের গাঁথনিই গাঁথলে তাজের নির্মাতা যা দেখে ভাবে বিভোর হ’তে হয় আজও কবি অকবি সবাইকে। ঈজিপ্টের পিরামিড তাকে কোনো অলঙ্কার দিয়ে সাজালে না আর্টিষ্ট, কেবল ভাবযুক্ত ক’রে ছেড়ে দিলে; একগোছা শুকনো পাতা—শীতের বাতাস তার রঙ ঢঙ সব হরণ করে’ মাটির উপরে ছড়িয়ে দিয়ে গেল শুধু একটু ভাবযুক্ত করে’; এক পাট সাদা কাপড় তাতে সকালের শিশির—ভাব দিয়ে বুনে’ গেল আর্টিষ্ট। বস্তু সামান্য ঘটনা সামান্য কিন্তু ভাবযোজনাতে অমূল্য অসামান্য অরূপ হ’য়ে উঠলো সবাই—এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের ঘরে বাইরে যথেষ্ট ধরা রয়েছে। ভাব দিয়ে ধূলো-মুঠোকে সোণা-মুঠো করে’ দিচ্ছে আর্টিষ্ট,—এ রোজই ঘটছে চোখের সামনে আমাদের। ভাবুকের হাতে এক তাল কাদা, একখানা পাথর, একটা কাঠ যেমন ভাব পায়, রূপ পায়, তেমনি কথাগুলো তেমনি সুরগুলোও ভাব পেয়ে যায় রূপ পেয়ে যায় যখন তখন বলতে পারি বস্তু ভাষা ও সুর এরা পাষাণী অহল্যার মতো জেগে উঠলো ভাবের স্পর্শে।
ছবি যে লিখছে তার হাতে গোটাকতক রেখা আর তাদের গোটাকতক ভঙ্গি,—দাঁড়ি কসি ইত্যাদি বোঝাতে রইলো উন্নত আনত অবনত এমনি গোটাকতক অবস্থা, এই নিয়ে ভাবুক সে কখন একটান কখন দুটান মিলিয়ে এক একটা ভাবযুক্ত রূপ লিখছে, রেখার ভঙ্গি দিয়ে জানাচ্ছে—বক দাঁড়ালো, বক উড়লো। বক ঘুমোলো, উড়ি উড়ি করছে বক, চলি চলি করছে বক—এমনি নানা ভাব নানা ভঙ্গি গোটাকতক রেখায় রেখায়। ঝরণা করছে, সমুদ্র গর্জন করে’ ফুলছে—সবার ভাব রেখার ফাঁদে ধরে’ নিচ্ছে ভাবুক ও আর্টিষ্ট। দপ্তরী তো রেখা বিষয়ে পাকা কিন্তু কই তার দ্বারা তো ভাবযুক্ত রেখা টানা কোনো কালেই হয় না। রূপের আর বস্তুর মূল্য তার ভাবসম্পদে না হ’লে একটুকরো পাথর ছেঁড়া কাগজ দুটো একটা রঙ বা রেখা তার মূল্য কি?
রূপকথায় শুনেছি—পাতার ঠোঙায় কোন এক রাজকন্যার একগাছি চিকণ কেশ তাই দেখে বিভোর হ’ল ভাবে রাজপুত্র। এটা রূপকথা সুতরাং কথার কথা বলতেও পারো, কিন্তু আকাশের প্রান্তে কাজল মেঘের সরু একটি টান সেটা দেখে যে কবির ভাব জাগে তার কি! শুনেছি চীন দেশে তারা একটা তুলির টান দেখে’ রস পায়। সাদা কাগজে একটি টান, অন্ধকারে একটি আলোর রেখা—এ সব ভাব জাগায় কি না পরীক্ষা করে’ দেখলেই পারো।
জোর করে’ কারু সঙ্গে ভাব হয় না, জোর করে’ রচনাতে ভাব ঢোকানো চলে না। অভিনেতা কিংবা গায়ক যখন একেবারে চোখ আকাশে তুলে’ কতকগুলো কৃত্রিম হাব ভাব করে তখন ধরা পড়ে’ যায় তার চেষ্টা আপনা হ’তে, এমনি ছবিতেও একটা যেমন-তেমন কিছুকে খানিকট ভঙ্গি দিয়ে ছবির নীচে বড় কবির একটা কবিতা জুড়ে’ টেনে বুনে ভাবযুক্ত ছবি করতে চল্লে রচয়িতার ও রচনার ভাবের অভাবই অনেক খানি ব্যক্ত করা হয়। আর্টিষ্ট নানা উপায়ে ভাবযোজনা করে’ থাকে রূপ-রচনাতে। প্রথমতঃ ডৌল দিয়ে ভাবটা প্রকাশ হ’ল, তারপরে সাজসজ্জা দিয়ে ভাব প্রকাশ হ’ল, অঙ্গভঙ্গি ও সাজগোজ, এই দুই দিয়ে ছবিতে মূর্তিতে ভাবটা ধরা পড়লো।
কুটির আর রাজবাড়ি দুটোর ভাব—ডৌল ও সাজ দুই মিলিয়ে একটা। সিংহদ্বারে আর খিড়কির দরজায় আঙ্গিক ভেদ এবং সাজসজ্জাতেও ভেদ। এমনি অনেক সাজসজ্জা বোঝায় উৎসবের ভাব, সাজসজ্জার অভাব বোঝায় উৎসবের অভাব দীনতা কত কি! অভিনয়ের সময়ে পরীকে দৈত্যকে খালি সাজ ও ডৌল দিয়ে প্রকাশ করি যেমন তেমনি ছবি মূর্তির বেলাতেও সাজের আর ডৌলের তারতম্য দিয়ে বোঝাই রূপের ভিন্নতা এবং ভাবেরও ভিন্নতা। পৈতের দিনে হঠাৎ ছেলেটা মাথা কামিয়ে গেরুয়া বসন পরে’ দণ্ড কমণ্ডলু ধরে’ যে হুবহু দণ্ডী বনে যায় তার মূলে সাজ আর ডৌল ফেরানোর কায়দা। বিয়ের দিনে বরবধূর ভাবযুক্ত রূপ এই কৌশলেই প্রকাশ হয় চোখের সামনে। এগুলো হ’ল সহজ উপায় আর্টিষ্টদের হাতে, ভাব ফোটাতে চলে তারা নানা রঙ চঙ ইত্যাদি দিয়ে। এখন একটা দোকানঘরের ভাব আছে, বসতঘরের ভাব আছে,—দোকানীর তৈজসপত্র দিয়ে বোঝানো গেল দোকানটা, বসতবাড়ির নানা জিনিষ দিয়ে বোঝালেম এটা বসতবাড়ি, কিন্তু সাহেব কোম্পানীর দোকান সেখানে বাড়ির ডৌল রাজবাড়ীর মতো, ভিতরের সাজও যেন একটি ড্রয়িংরুম বৈঠকখানা কি দোকান বোঝাবারই জো নেই—এখানে দোকানি আসবাব খানিক জুড়ে’ তবে বোঝাতে হ’ল এটা দোকান। কাজেই দেখতে পাচ্ছি কি বাইরের দৃশ্যটার ভাব কি নিজের অন্তরের ভাব দুই কাযেই আর্টিষ্টকে ভাবোপযোগী রেখা রূপ প্রভৃতি জুড়ে’ দিতে হয় রচনাতে—একেবারে পরিকল্পনা বাদ দিয়ে কাজ হয়ই না। খেতাবে রাজা মহারাজা—সত্যিও হয়তো বা একটা রাজ্যেশ্বর, কিন্তু তার স্বাভাবিক ভাবখানা সাধারণ রকম, সুতরাং রাজা বলে’ তাকে চালানোই চল্লো না খালি ফটো দিয়ে, কাযেই তার ডৌল মান পরিমাণ ভাব ভঙ্গি সব ফেরালেম তবে পেলেম রাজরূপটি রাজভাবটি।
কথাই আছে—“কামালে জোমালে বর আর নিকোলে জুকোলে ঘর।” ডৌল ও সাজ ফেরানোর সঙ্গে ভাবের হেরফের ঘটে ছবিতে মূর্তিতে এটা জানা কথা। শুধু সাজ ফিরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের অনেকগুলি দেবতার রচনা হয়েছে—ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দেবদেবী, কেবল মুদ্রা আর সাজের পার্থক্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকম হ’ল। আবার ডৌলের ভিন্নতা নিয়েও অনেক মূর্তি রয়েছে, যেমন—গণেশ কৃষ্ণ নটরাজ বুদ্ধ ইত্যাদি সমভঙ্গ ত্রিভঙ্গ অতিভঙ্গ মূর্তি সব। বিষ্ণুমূর্তি আর সূর্যমূর্তি দুয়ের ভিন্নতা ভাব দিয়ে হ’ল না কিন্তু সাজসজ্জার একটু আধটু অদল-বদল নিয়ে হ’ল, আবার গণেশ আর বংশীধারী কিংবা নটরাজ ও বৃদ্ধ সবাই আলাদা আলাদা ভোল নিয়ে পৃথক পৃথক ভাবে দেখা দিলে। এখন দেখি যে কোন কিছুর ভাবটি নানা উপাদান নানা উপায় ধরে’ প্রকাশ করা চল্লো। একটা ঝরণার ভাব কোন আর্টিষ্ট ফোটায় সেটি ঝরণা পাহাড় আকাশ ইত্যাদি নানা সামগ্রী জুড়ে’ একটা ছবি করে’, আবার কোন আর্টিষ্ট শুধু মস্ত পটখানায় গোটাকতক জলের ধারা মাত্র টেনে বুঝিয়ে দিলে ভাবখানা। কিন্তু দুই আর্টিষ্টের কেউ ঝরণাকে বাদ দিয়ে কিছু করলে না; শুধু একজন ঝরণার সঙ্গে তার আশ পাশকে জুড়ে দেখালে, অন্য জন জলধারাটুকু মাত্র পৃথক করে’ নিয়ে ধরলে পটে—ঝরণা বাদ গেল না কোন ছবিতেই। এইবার যাকে নিয়ে কথা—যার রূপ ও ভাব ফোটানো—তার নিজ মূর্তিটা বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র উপাদান দিয়ে তাকেই প্রকাশ কেমন করে’ হয় দেখ। একটি সন্ধ্যার ভাব দুখানা মাণিক আর একটি পিদুম দিয়ে ফুটলো, যথা—
“সায়মণির কোলে
রতন মণি দোলে
দুর্গাপিদিম ঝলে।”
শুধু কবিতাতেই যে এইভাবে তাকে ফোটানো চল্লো তা নয়। সঙ্গীতে উপাদান উল্টে পাল্টে ভাবের প্রকাশ হয়,—যেমন সকালের ভৈরবী সন্ধ্যার পূরবী; কিংবা গড়ের বাদ্যির মার্চ সুর দিয়ে সকাল। সুর দিয়ে সন্ধ্যা, সুর নিয়ে যুদ্ধ। মূর্তি গড়ে’ এমনটা করা সহজ নয় তবু তাজমহলটা অনেককে বাড়ী না হ’য়ে নারী হ’য়ে দেখা দিয়েছে! অলঙ্কারশিল্পে এর প্রমাণ জলতরঙ্গ চুড়ি ও সাড়ি, গঙ্গাজলি কাপড়—এমনি কত কি জিনিষে বতর্মান। প্রতীক চিত্রেও এর নিদর্শন দেখি, যেমন পদ্মপত্রে জলবিন্দু জগৎ-সংসারের ভাবটা বোঝালে।
এককে ভাব ভঙ্গি সব দিক দিয়ে অন্যের প্রতিম করা—এই হ’ল সোজা রাস্তা ভাবরাজত্বের, আর একটি রাস্তা হ’ল প্রতীকের রাস্তা—কাক দিয়ে বক বোঝানোর মতো একটা রাস্তা—যাকে বলতে পারে ঘুরুণে রাস্তা। বাধা নেই কারু এই দুই পথেই চলার কিন্তু আর্টিষ্ট না হ’লে চলতে গিয়ে পদে পদে ঠকতে হয় এবং অপ্রযুক্ততা নিহতার্থতা প্রতিকূলবর্ণতা প্রসিদ্ধিত্যাগ দূরান্বয় প্রকাশিতবিরুদ্ধতা প্রভৃতি নানা অলঙ্কার-দোষে ঠেকতেও হয়।
ভাবের আদান-প্রদানের সম্বন্ধ নিয়ে মিল্লেম রূপ সমস্তের সঙ্গে তবেই হ’ল যথাভাবে পাওয়া—আপনার করে’ পাওয়া কোনো কিছুকে, এই জন্য অনেকে বলেছেন Art is love—আর্টের মূলে ভালবাসা। ভাব বুঝলেম তো ভাব হ’ল এবং তা থেকে ভালবাসাও জন্মালো, তখন তাকে নিয়ে ছবিই আঁকি, মূর্তিই গড়ি, কবিতা গান যাই করি—সেটি ভাল এবং ভাবের জিনিষ হ’ল এবং অন্যের কাছেও আদর পেলে রচনাটি। প্রথম আপন করে’ নেওয়া ভাব করে’, তার পর সেটিকে সকলের আপন করে’ দেওয়া ভাবযুক্ত করে’—এই হ’ল কৌশল আর্টিষ্টের। আমার আপন যে হ’ল তোমারো আপন সে হ’ল—এই কৌশল আর্টের।
মায়া পড়ে’ যায় আমাদের অনেক জিনিষে কিন্তু যথার্থ ভাব হয় না। তাতে করে’ অনেক দিন যেখানে বাস যাদের সঙ্গে ঘরকন্না মায়া পড়ে তাদের উপর—ভাব থাক বা নাই থাক কিছু আসে যায় না। অনেক বন্দীর কারাগারের উপরে একটা মায়া পড়ে’ যায় অনেক দিন সেখানে বন্ধ থেকে, পোষা পায়রার মায়া পড়ে’ যায় বিশ্রী খাঁচাটার উপর, কিন্তু এতে করে’ খাঁচার সঙ্গে ভাব হ’য়ে গেছে পায়রার তা জোর করে’ বলতে পারিনে, কেননা “অঘটনপটীয়সী মায়া”। ৺ঈশ্বর গুপ্তের মায়া পড়েছিল পাঁঠার উপরে এবং তিনি পাঁঠার উপরে কবিতাও লিখেছেন, কিন্তু সেটাকে কোনো দিন ভাবযুক্ত পদার্থ বলে’ ভ্রম হয় কারু? থেলো হুঁকোর উপরে মায়া পড়েছে শতসহস্রের কিন্তু থেলো হুঁকো কোনো দিন ভাবের প্রতিম বলে’ চলতে পারে এ বিশ্বাস কর কেউ? মায়া দিয়ে একটা বস্তু যুক্ত হ’তে পারে কেবল আমারই সঙ্গে কিন্তু অন্যের সঙ্গে তার মিলন ঘটে না। দেশটার উপরে মায়া আছে কিন্তু তাই বলে’ দেশটার সঙ্গে ভাব হ’য়ে গেছে একথা বলা চলে না। ভাবের জিনিষ সে মায়ার অতীত জিনিষ, কেননা সত্যভাবে তাকে লাভ করি আমরা এবং সেই কারণেই সত্য হ’য়ে ওঠে সে অন্যের কাছেও।