বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/লাবণ্য
লাবণ্য সম্বন্ধে উজ্জ্বলনীলমণি-কার’ বল্লেন, “মুক্তাকলাপের অন্তর হইতে যে ছটা বহির্গত হয় এবং স্বচ্ছতাপ্রযুক্ত অঙ্গ সকলে যে চাকচিক্য প্রতীয়মান হইয়া থাকে তাহাকেই লাবণ্য বলে।” স্ত্রীরাধার অঙ্গদ্যুতির সঙ্গে মণিময় মুকুর এবং শ্রীকৃষ্ণের বক্ষদেশের সঙ্গে মরকত-মুকুরের তুলনা দিয়ে এটা বোঝালেন রসশাস্ত্রকার। বৈষ্ণব কবিতায় লাবণি শব্দ অনেকবার ব্যবহার হচ্ছে দেখি—‘ঢল ঢল কাঁচা সোনার লাবণি’। বৈষ্ণব কবিদের মতে লাবণ্য হ’ল—প্রভা, দীপ্তি, স্বচ্ছতাবশতঃ ঔজ্জ্বল্য, চলতি কথায় পালিস বা চেকনাই। অভিধানের মানের সঙ্গে মিলছে না—লবণস্য ভাবঃ অর্থাৎ লবণিমা কথাটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে স্বাদের, যাকে ইংরিজিতে বলে taste তাই। রূপ দিয়ে প্রমাণ দিয়ে ভাবভঙ্গি দিয়ে যা রচনা করা হ’ল তা tasteful বা লাবণ্যযুক্ত করা হ’ল তো হ’ল ভাল। ‘ভাবলাবণ্যযোজনম্—ভাব-যোজনা এবং লাবণ্য-যোজনার কথা বলা হ’য়েছে চিত্রের ষড়ঙ্গে। যাতে যেটা নেই তাতে সেইটি মেলালেম যখন তখন বল্লেম—এটি যোজনা করা গেল। রূপকে বা রূপরেখাকে ভাবযুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই লাবণ্যযুক্ত করার কথা উঠলো। রন্ধন-শিল্পে লবণিমা ও লাবণ্যের যোজনা একটা বড় রকম ওস্তাদি, সেখানে বেশি লবণ কম লবণ দুয়েতেই বিপদ আছে। রান্নাতে যখন নুন মিশলো তখন সমস্ত জিনিষের স্বাদটি ফিরিয়ে দিলে লবণ-সংযোগ, লবণ জিনিষটাও তখন পৃথক নেই, সবার সঙ্গে মিলে’ একটা চমৎকার স্বাদে পরিণত হ’য়ে গেছে। তেমনি সকল রচনার বেলাতেই সূপকারের মতে রূপকারও একটুখানি লাবণ্য যোগ করে, যাতে করে’ স্বাদু হ’য়ে ওঠে রচনাটি।
রসশাস্ত্রকার বলেছেন,—“মুক্তাকলাপের অন্তর হইতে যে ছটা বহির্গত হয় তাহাকে লাবণ্য বলি।” এতে করে’ বোঝাচ্ছে রূপের প্রমাণের ভাবের অন্তনিহিত হ’য়ে বর্তমান থাকে লাবণ্য, শুধু শিল্পীর অপেক্ষা রচনার কৌশলে সেটিকে প্রকাশ করা। খনির মধ্যে সোনা যখন আছে তখন লাবণ্য তার থেকেও নেই, কারিগরের হাতে পড়লে তো লাবণ্য দেখা দিলে সোনায়—‘ঢল ঢল কাঁচা সোনার লাবণি’; মুক্তার বেলাতেও এই কথা,—আর্টিষ্টের স্পর্শসাপেক্ষ হ’ল লাবণ্য। যিশুখৃষ্ট বলেছিলেন, ‘Ye are the salts of Earth’. এ কথার দুটো অর্থ হয়—মাটির নিমকে তোমরা মানুষ, কিংবা ধরাতলের লাবণ্যই তোমরা মর্ত-জীবনে স্বাদ দিতে তোমরা। আজকের বায়োকেমিক মতে মানুষ নানা প্রকার লবণের সমষ্টি—এটা খৃষ্টের আমলে জানা ছিল কি ছিল না জানা যায় না,—কিন্তু বহু পূর্ব থেকে মানুষ লবণ নিমক লবণিমা নানা অর্থে নানা ভাবে প্রয়োগ করছে দেখা যায়। এক কথায় বলতে হ’লে বলতে হয়—স্বাদ ফিরে’ যায় যার দ্বারা এবং স্বাদু করে’ তোলে যে বস্তুকে কিংবা রচনাকে সেই হয় লাবণ্য।
মুক্তা ফলের লাবণ্য এক রকম, হীরকের লাবণ্য অন্য, পাকা কাঁচা আমের লাবণ্য, মানুষের কালো চামড়ার লাবণ্য, সাদা চামড়ার লাবণা, মাথাঘসা দিয়ে মাজা চুলের লাবণ্য, গন্ধ তৈলে চিক্কণ-চুলের পাকা-চুলের কাঁচা-চুলের লাবণ্য—সবই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র রকমের। কড়ি দিয়ে মাজা সূতোর কাপড়ে যে লাবণ্য সিল্কের কাপড়ে সে লাবণ্য নেই, পাথর বাটির লাবণ্য আর চিনের বাটি কি সোনা রূপোর বাটির লাবণ্য সমান নয়। লাবণ্য প্রচ্ছন্ন রইলো এবং লাবণ্য প্রকাশ পেল এটা বলা চল্লো, লাবণ্য হারালো বস্তুটি এও বলা গেল। নতুন টুক্টুকে মলাটের বইটি, নিভাঁজ ধোয়া কাপড়খানি, হাতে হাতে চট্কাচট্কিতে হারিয়ে ফেল্লে লাবণ্য,—রঙ জ্বলে’ গেল, ধোপ মরে’ গেল, অপছন্দ করলে সাধারণ লোকে, কিন্তু আর্টিষ্ট দেখলে দুটির মধ্যেই আর একটুকু নতুন ধরণের লাবণ্য পুরাতনের স্বাদ দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। অলঙ্কারশিল্পে ওল্ডগোল্ড (old gold) বাদ গেল না,—উজ্জ্বল সোনা ম্যাড়মেড়ে সোনা দুই ধরণের লাবণ্য দেখালো। পাথরের লাবণ্য সে পাথরে আছে, সোনার লাবণ্য সোনাতেই, জলের একটুখানি লাবণ্য আছে যেটা সমুদ্রে এক, নদীতে অন্যভাবে প্রকাশ পায়, মাটিতে জলের লাবণ্য নেই মোটেই,—এখন নদীজল আঁকতে সমুদ্রজলের লাবণ্য দিলে যেমন বিস্বাদ হয় ছবিটা তেমনি মাটিকে জল করে’ লিখলেও ভুল হ’য়ে যায় জলে স্থলে। তবেই দেখা গেল এক এক বস্তুর ধাত বুঝে’ তবে ছবিতে লাবণ্য যোজনা করাই হ’ল কাজ।
স্বভাবের নিয়মে গাছ পাতা ফুল স্বাভাবিক লাবণ্য পেয়েছে; ধূলো পড়লো, রোদে তাতলো,—লাবণ্যটুকু ঢাকা পড়লো; বৃষ্টিজলে ধোয়া হ’য়ে গেল গাছ-পালা—প্রকাশ হ’ল পূর্ব লাবণ্য তাদের। জলভরা মেঘ সে এক লাবণ্য এক সোয়াদ দিলে চোখে ও মনে, জলঝরা মেঘ সে আর এক লাবণ্য আর এক সোয়াদ ধরলে সামনে।
লবণের সংযোগে বস্তুর স্বাভাবিক তারের সঙ্গে সুস্বাদ যেমন মিলছে দেখি রন্ধনশিল্পে, তেমনি লাবণ্যের যোগে অন্যান্য শিল্পেও রূপ প্রমাণ ভাব সমস্তই চোখের এবং মনেরও তৃপ্তিদায়ক হ’য়ে উঠছে এবং তখন দর্শকের শ্রোতার পাঠকের ভাল লাগছে রচনাটি। লাবণ্য তো অনুভব করি এবং চোখেও দেখি এক সঙ্গে, অথচ জিনিষটা এমনই যে পাকাপাকি একটা ব্যাখ্যার মধ্যে ধরাছোঁয়া দিতেই চায় না। কথায় বলে মণিকাঞ্চন যোগ—পিত্তল ও মণি, কিংবা তাম্র ও মণি, দন্ত ও মণি, রজত ও মণি অজস্র শিল্পকাজে ব্যবহার হচ্ছে দেখি। মণি সোনায় বাঁধা হ’য়ে একটি লাবণ্য দেয়, পিত্তলে তামায় রৌপ্যে ও গজদন্তে বাঁধা হ’য়ে আর এক রকমের লাবণ্য পায় দেখি, এমনি শিল্প-রচনাটি ভাবভঙ্গির দিক দিয়ে, মান-পরিমাণের দিক দিয়ে এবং রূপের দিক দিয়ে লাবণ্যের সংস্পর্শ পেয়ে গেল তবেই সুন্দর তার দিলে আমাদের। রূপ সমস্ত বিভিন্ন, প্রমাণ তারাও স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র, ভাব সমুদয় নানা ভঙ্গিতে বিভক্ত, লাবণ্যের ঘেরে এরা এক হ’য়ে বাঁধা পড়ে যখন তখনই হয় মনোহর। সোনাতে সোহাগার কাজ করার মতো কাজ হ’ল লাবণ্যের। “মুক্তাফলেষু ছায়ায়া স্তরলত্বমিব”। তরঙ্গায়মাণ হচ্ছে লাবণ্য এই বল্লেন রসশাস্ত্রকার। রূপে প্রমাণে ভাবে একটা তরলতা দেয় লাবণ্য এই হ’ল ভাবটা। যে সব রেখা রূপ দিতে আছে, মান পরিমাণের বাধুনি শক্ত করে’ বেঁধে দিতে আছে, ভাবভঙ্গি বাঁধা রকমে প্রকাশ করতে আছে—সেই সব দস্তুরমতো টানা রেখা রুল কম্পাসের শক্ত রেখা, তারি মধ্যে লাবণ্য যোজনা করা চাই তবে তারা আর্টের কাজে আসে—না হ’লে আফিসের দপ্তরখানার মিস্ত্রীখানার মধ্যেই বদ্ধ থেকে যায়। সাদা কথায় বলা গেল—উত্তরের আকাশে মেঘ লেগেছে। ঘটনাটা বোঝালে কাটা কাটা কথাগুলো, কিন্তু নড়ে না চড়ে না যতটুকু বলবার বলে’ চুকলো এক আঁচড়ে। এই কথাগুলোকে একটু গুছিয়ে বলা গেল—উত্তরেতে মেঘ লেগেছে;—কাট কাটা কথা বেশ একটু দোলন পেলে লাবণ্যের স্পর্শ হ’তেই। আরো সুন্দর হ’ল যখন বল্লেন কবি—‘মেঘৈর্মেদুরমম্বরম’ ইত্যাদি। লাবণ্যের ছন্দে ধরে’ লেখা যায় না বলেই গদ্য অনেক সময়ে কানে খটোমটো ঠেকে।
কবিতাতে ছন্দ গতি দেয় কথাগুলোকে, নানা লয়ে বিলয়ে পা ফেলে’ চলে কথাগুলো ছন্দের বশে। কথার লাবণ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা গেল না কিন্তু ছন্দে গাঁথা গেল কথাগুলো, তাতে করে’ কাজ হ’ল না—দু’এক ছত্র কবিতা থেকে বোঝাতে চেষ্টা করি। মা সরস্বতীর পাদপদ্মে যেন ভক্তি থাকে—এ হ’ল নিছক কেজো কথা, এইটেই শুধু ছন্দে গেঁথে ফেল্লেম লাবণ্যের দিকে নজর না রেখেই—
“হে মা ভারতি। দিলাম প্রণতি
তোমারি সরোজ চরণে ”
আবার আর এক কবি ঐ কথাই কথার এবং ছন্দের লাবণ্য বজায় রেখে বল্লেন—
“নমি নমি ভারতি—
তব কমল চরণে ”
শুধু ছন্দে গতিমান হ’য়েও কথা বেশিক্ষণ চলতে পারে না, লাবণ্য দিয়ে ছন্দে গাঁথা হ’ল কথা, তবে হ’ল রচনাটি উত্তম। এমনি ছবির বেলাতেও রূপ-রেখাগুলি লাবণ্য দিয়ে বাঁধা হ’ল তবে হ’ল কাজ।
গাড়ীর চাকা মিস্ত্রী ঠিক ছন্দে বাঁধলে কিন্তু কারখানার বড় মিস্ত্রী দুচার পোঁচ চর্বি মাখিয়ে দিলে তবে নিখির্কিচ্ চাকা ঘুরলো। আনাড়ির হাতের রান্নায় কিংবা তার প্রস্তুত করা জিনিষে লাবণ্যের অতিরেক কিংবা ব্যতিরেক ঘটেই,—হয় বেশি নুন নয় কম নুন। পাউডার মাখলে তো এমন মাখলে যে একটা রাক্ষুলী সেজে দাঁড়ালো মেয়েটা, ছেলেটা চুল বাগালে তো এমন ছাঁটন দিলে যে তার চেয়ে মাথাটা মুড়িয়ে এলে ভাল দেখাতো। লবণিমার ওজন বোঝা সব চেয়ে কঠিন ব্যাপার,—সূপকারের পক্ষে এই কথা রূপকারের পক্ষেও ঐ কথা। এটা তো রোজই দেখা যায় যে, মাসিক পত্রের হাফটোন ও ত্রিবর্ণের ছবিতে আসলের লাবণ্যটি ভেস্তে যায় এবং কাগজওয়ালা সেইগুলো দেখেই আর্টিষ্ট ও আট-শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক সমালোচনা করে’ বসে। আসল ছবির বিচিত্র বর্ণচ্ছটাকে তিন বর্ণের কাটছাঁটের মধ্যে ধরাতে জিনিষটার লাবণ্য আরবী থেকে বাংলাতে তর্জমা করার চেয়েও বেশি পরিমাণে ভেস্তে যায়, অথচ গম্ভীরভাবে সমালোচক বসে’ যায় চিত্র-সমালোচনায়, যথা—“হরপার্বতী” তিন বর্ণের, শিল্পী (অমুক)—নিতান্ত কাঁচা; “মুসাফির” তিন বর্ণের, শিল্পী (অমুক)—ভাল; “বিরহী যক্ষ” তিন বর্ণের, শিল্পী (অমুক)—বেচারা যক্ষের অবস্থা শোচনীয়; “পদ্মাবতী” তিনবর্ণের, শিল্পী (অমুক)—গোড়াতেই রঞ্জনের অভাব, প্রস্ফুটিত না হইলেই ভাল হইত; “ওমার খৈয়ামের ছবি” শিল্পী (অমুক),—পণ্ডশ্রম; “আড়িপাতা” তিনবর্ণের, শিল্পী (অমুক)—তুলি ছাড়িয়া পেন্সিল ধরা আবশ্যক; ইত্যাদি ইত্যাদি। তিন বর্ণের রঙের টিনগুলোর উপরে বসে’ মাছি যদি চিত্র-সমালোচনা করতে চলে তবে সে চিত্রের লাবণ্য বাদ দিয়ে রূপ বাদ দিয়ে রঙ বাদ দিয়েই বকে’ চলে যা তা নিশ্চয়ই। চটকানো পদ্মে বসে’ ফুলের লাবণ্য সম্বন্ধে বলতে পারি যে লাবণ্য অনেকখানি হারিয়েছে ফুল চটকানোর দরুণ, কিন্তু ফুলের রচয়িতাকে উপদেশ দিইনে ফুল-সৃষ্টি ছেড়ে মাছিক পত্রিকা লিখতে। এই লাবণ্য আছে বলেই সুকুমার শিল্পের নকল দেখে’ আসলটাকে বোঝাই শক্ত হয় এবং সেজন্য অনেক সময়ে শিল্পীকে অযথা দায়-দোযে পড়তেও হয় কাগজওয়ালার কাছে।
আলো মাখা হ’য়ে ফুল একটি লাবণ্য পাচ্ছে, ছায়াতে ফুল আর এক লাবণ্য পাচ্ছে, শিশিরে ধোয়া ফুল, বৃষ্টিজর্জর ফুল—লাবণ্য সবটাতেই রয়েছে শুধু অবস্থাভেদে লাবণ্যের বিভিন্নতা ঘটছে মাত্র। কবি কালিদাস বিরহী যক্ষকে একটি চমৎকার লাবণ্য দিলেন—“কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ”। এটা ম্যালেরিয়া রোগীর লাবণ্য বলে’ ধরা চলে না—অবস্থা বিশেষে ক্ষীণ-চন্দ্রকলার মতো লাবণ্যময় রূপটি দিয়েছেন যক্ষকে কবি; আবার যক্ষ যখন ফিরেছিল অলকায় তখনকার তার লাবণ্য যদি দিতেন কালিদাস তবে সেটা স্বতন্ত্র রকমের নিশ্চয়ই হ’ত। এমনি সকল দিকেই দেখবো লাবণ্যের প্রকার-ভেদ হচ্ছে অবস্থা ও পাত্র ভেদে। অনেক জিনিষের সঙ্গে তুলনা দিয়ে লাবণ্যের প্রকারভেদ বোঝাতে চলেছেন প্রাচীন কবিরা, যেমন—“চম্পক শোণ কুসুম কনকাচল জিতল গৌরতনু লাবণীরে”, কিংবা “তপত কাঞ্চন কান্তি কলেবর”, অথবা “অখিল ভুবন উজারকারি কুন্দ কনক কাঁতিয়া”, “অপরূপ হেমমণি-ভাস অখিল ভুবনে পরকাশ” এই হ’ল গৌরাঙ্গের লাবণ্য বোঝাতে অনেকগুলো ধাতু এবং ফুলের অবতারণা। তারপর শ্যামলাবণ্য বোঝাতে বলা হ’ল, যথা—“জনু জলধর রুচির অঙ্গ”; রাধাকৃষ্ণ দুজনের লাবণ্য বোঝাতে বলা হ’ল—“ও নব জলধর অঙ্গ; ইহ থির বিজুরী তরঙ্গ; ও বর মরকত ঠাম, ইহ কাঞ্চন দশবাণ”, আবার যেমন—ও তনু তরুণ তমাল, ইহ হেম যুথী রসাল, ও নব পদুমিনী সাজ, ইহ মত্ত মধুকর রাজ, ও মুখ চাঁদ উজোর” ইত্যাদি। মানুষের লাবণ্য তারপর কাপড়ের লাবণ্য, তার বেলাতেও বল্লেন কবি—“বিজুরী বিলাসিত বাস”, গলার হারের লাবণ্য—“হার কি তারক দৌতিক ছন্দ”, হাসির লাবণ্য—“হাস কি ঝরয়ে অমিয়া মকরন্দ, পদতলের লাবণ্য—“পদতলে থলকি কমল ঘনরাগ”, করতলের লাবণ্য—“করকিসলয় কিয়ে অরুণ বিকাশ”। শুধু রঙ বোঝাতেই নানা তুলনা তা নয় লাবণ্যটি বোঝানোর দিকে বিশেষ লক্ষ্য রেখে বৈষ্ণব কবিরা একটি একটি বস্তুর উপমা দিয়ে চলেছেন; যেমন—“কুবলয় নীলরতন দলিতাঞ্জন মেঘপুঞ্জ জিনি বরণ সুছাঁদ”—বর্ণের ও লাবণ্যের ছন্দ এক সঙ্গে পাই এখানে। আবার—“মরকত মঞ্জু মুকুর মুখমণ্ডল”, কিংবা “কুবলয় কন্দর কুসুম কলেবর, কালিম কান্তি কলোল”—লাবণ্যের কল্লোল পাচ্ছি। ভাবের লাবণ্য বোঝাতে নানা ভঙ্গি বা ভঙ্গের অবতারণা করেছেন কবিরা; যেমন—“হেলন কল্পতরু ললিত ত্রিভঙ্গ”,—যেমন তেমন করে’ তেড়া বাঁকা নয় ভঙ্গিটি। ভুরুর ভঙ্গি “কামের কামাল জিনি ভাঙ বিভঙ্গ”, আবার যেমন—“ও মুখচাঁদ উজোর, ইহ দিঠি লুবধ চকোর”, কিংবা “অরুণ নিয়ড়ে পুন চন্দ, গোবিন্দ দাস রহু ধন্দ”—লাবণ্যের পরিসীমা না পেয়ে কবির বিভ্রম ঘটলো। বিশেষণ হিসেবে শুধু যে কথাগুলো নানা পদাবলীতে বসালেন কবিরা তা তো নয়, বিশেষ করে লাবণ্যটি বোঝাতে চেষ্টা পেলেন তাঁরা।
ভাবের ভঙ্গিমার সঙ্গে লাবণ্যের যোগাযোগ দেখলেম, এমন মান পরিমাণের সঙ্গে তার যোগের দু’একটা দৃষ্টান্ত কবিদের কাছ থেকে দেবো, যেমন—“বিষদ বারণ বাহু বৈভব”, “কনক লতায় তমালহুঁ কত কত দুহুঁ দুহুঁ তনু বাঁধ”, “মাঝহি মাঝ মহা-মরকত সম শ্যামের নটরাজ” “অবনি বিলম্বিতবলি বনমাল”, “বনি বনমাল আজানুলম্বিত”, “কামিনী কোটী নয়ননীল উতপল পরিপূরিত মুখচন্দ”,—মুখচন্দ্রে লাবণ্য সৌন্দর্য মাপজোখ এক সঙ্গে পেয়ে গেলেম। রাধিকার রূপের লাবণ্য জানাচ্ছেন কবি—“পঞ্চম রাগিণী রূপিণী রে”,—সুরে লয়ে বিশুদ্ধ রূপের লাবণ্যটি পাই এখানে, আবার “তনু তনু অতনু অযুত শত সেবিত, লাবণী বরণি না যাই।” চুল বাঁধার ছাঁদ ও লাবণ্য দেখাচ্ছেন কবি—“ধনি কানড় ছাঁদে কবরী বাঁধে”, কিংবা “দলিতাঞ্জন গঞ্জ কালো কবরী, ক্ষণ উঠত বৈঠে তাহে ভ্রমরী”। হাতপায়ের নখের লাবণ্য—“নখচন্দ্র ছটা ঝলকে অনুপম, হেরি গোবিন্দ দাস তঁহি পরিণাম।”
লাবণ্য যেখানে তরঙ্গিত হচ্ছে মুক্তাফলের কান্তির মত তারি বর্ণন দিচ্ছেন কবি—
“যাঁহা যাঁহা নিকশয়ে তনু তনু জ্যোতি
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকয় হোতি।
যাঁহা যাঁহা অরুণ চরণে চল চলই
তাঁহা তাঁহা থল-কমল-দল খলই।
যাঁহা যাঁহা ভাঙর ভাঙ বিলোল
তাঁহা তাঁহা উছলই কালিন্দী হিলোল।
যাঁহা যাঁহা তরল বিলোকন পড়ই
তাঁহা তাঁহা নীল উতপল বন ভরই।
যাঁহা যাঁহা হেরিয়ে মধুরিম হাস
তাঁহা তাঁহা কুন্দ কুমুদ পরকাশ।”
লাবণ্যের ঠিক প্রতিশব্দ ইংরাজি ভাষায় নেই, Grace বল্লে সবটা বুঝায় না, Beauty তাও বলা গেল না। লাবণ্য স্বাদ পৌঁছে দেয় সেইজন্য তাকে বলতে পারি Taste, লাবণ্য চমৎকার সামঞ্জস্য দেয় ভাবে ভঙ্গিতে মানে পরিমাণে ও রূপের বিভিন্ন অংশে সেজন্য তাকে বল। চলে Unity, এই ভাবে Quality এবং Balance তাও এসে পড়ে লাবণ্যের কোঠায়। Taste সম্বন্ধে বিখ্যাত ফরাসী শিল্পী Rodin বলেছেন, “It is the human soul’s smile on the house and its belongings.” লাবণ্য-যোজন ছাড়া এ আর কি বোঝাচ্ছে?—অন্তরের লাবণ্যচ্ছটা বাহিরকে লাবণ্য দিচ্ছে, “যাঁহা যাঁহা হেরিয়ে মধুরিম হাস, তাঁহা তাঁহা কুন্দ কুমুদ পরকাশ।” Quality বা গুণ তার বেলাতেও ইউরোপী পণ্ডিতেরা লাবণ্যের ইঙ্গিত করলেন—“We say a line, a tone, a colour, an action has quality—when the artist has succeeded in endowing it with such beauty within itself (লাবণ্য-যোজন) that gives an interest quite beyond its purpose as storytelling machinery.”
এই ভাবে লাবণ্য বলতে অনেকগুলো হিসেব বোঝায় দেখতে পাচ্ছি—কালে কালে নানা গজদন্ত নানা রূপ ধরে, পিতলের জিনিষের উপরে মৃদু লাবণ্য আপনা হ’তে দেখা দেয়, পুরোনো শানের রঙে একটি চমৎকার লাবণ্য আসে যেটা নতুনে থাকে না, প্রাচীন অয়েলপেণ্টিংগুলোও এই ভাবে একটি স্বতন্ত্র লাবণ্যযুক্ত হয় কালবশে। কাজেই নতুনের লাবণ্য এবং পুরাতনের লাবণ্য দুই প্রকার হ’ল। এমনি আকাশ জল স্থল এদের লাবণ্য ঋতুতে ঋতুতে বদল হচ্ছে—নবজলধরের লাবণ্য, শরতের মেঘের লাবণ্য, এমনি নানাপ্রকার ভেদ দেখি লাবণ্যে এবং এই লাবণ্য ভেদ দিয়ে বস্তু তাকেও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পাই আমরা। বর্ষার আকাশ এক ভাব দিচ্ছে এক স্পর্শ দিচ্ছে মনে, শীতের আকাশ অন্য ভাব ধরছে মনে, দিনের আকাশ, রাতের আকাশ, সকালের আকাশ, সন্ধ্যার আকাশ বিচিত্র বিভিন্ন লাবণ্যে ভরে’ উঠছে দেখি এবং সেই সঙ্গে মনের ভাবেরও বদল হচ্ছে আমাদের।
জাপানি চিত্রকরেরা যে রেশমের পটের উপরে আঁকে অপরূপ তার একটুখানি লাবণ্য আছে। যেমন-তেমন একটা পটে তারা আঁকেই না। আমাদের দেশে মোগল শিল্পীরা যে কাগজে আঁকতো তার লাবণ্য এখনকার কোনো কাগজেই নেই। আমি অনেককে বলতে শুনেছি যে মোগল পেণ্টিংএর মতো এখনকার ছবি হ’তেই পারে না। এইটির প্রধান কারণ হচ্ছে লাবণ্যে মাজা এক টুকরো কাগজের অভাব, আর্টিষ্টের ক্ষমতার অভাব নয়। ‘যেমন পাটা তেমন পট’—এ তো জানা কথা, দেওয়ালে আঁকা ছবি আর গজদস্তের পাটায় আঁকা ছবিতে লাবণ্যের তফাৎ অনেকটা হ’য়ে যায়। ছাপাখানায় কিছু ছাপাতে দিলে প্রুফ আসে এক কাগজে, ছাপা শেষ হয় গিয়ে অন্য কাগজে। এখন দুই কাগজের quality বা গুণ দুই রকমের লাবণ্য দেয়, প্রুফকপির আকাট লাবণ্য এবং প্রকাশিত বইটার কাটছাঁট লাবণ্য সুস্পষ্ট দুটো স্বাদ দেয় চোখে ও মনে। এমনি ছবির বেলাতেও আসল ছবি আর তার নকল এবং তিনবর্ণ প্রতিলিপি এক লাবণ্য দেয় না, দিতে পারেও না। এই লাবণ্যের ছোঁয়াচ নিয়ে শিল্প-কাজের উচ্চনীচ ভেদ স্থির করা চলে। একটা মোমের পুতুলের লাবণ্যে আর আসল মানুষটির লাবণ্যে এই ভাবে ভেদাভেদ লক্ষ্য করি আমরা এবং বলে’ থাকি—আহা মেয়েটি যেন মোমের পুতুল। সেকালের গিন্নিদের মনে ননীর পুতলী বলে একটা বিশেষ রকম লাবণ্যের বাটখারা ধরা ছিল,—এখনো সুন্দর কিছু বলতে ঐ বিশেষণটা চলছে ভাষায়। আর্টের জগতে কিন্তু নিছক ননীর পুতুলের লাবণ্যের মূল্য বড় বেশি নেই। সংসারে ননীর পুতুল বৌ এনে গিন্নি নিশ্চিন্ত, বৌটি ননী খেয়ে খেয়ে ক্রমে ননীর তাল হ’য়ে গিন্নি-জগতে উচ্চ স্থান অধিকার করতে চল্লে খুসিই হ’ত সেকালে সবাই, কিন্তু ছবিতে মূর্তিতে এরূপ ঘটনা লাবণ্যে ঘটতে দিলে বাড়াবাড়ি হ’য়ে পড়ে। এই অতিলাবণ্যের নিদর্শন বাঙলার নধরমূর্তি মহাদেবের অঙ্গে সুস্পষ্ট বিদ্যমান—জার্মান প্রিণ্ট তাতেও পাবে। বিবাহের সময় মেয়েরা ‘শ্রী’ বা ছিরী বলে’ একটা মাখনের তাল গড়ে’ তোলে সেইটেই পুরাকালের লাবণ্যময়ীর আদর্শ ছিল হয়তো! এই ননীর পুতুলে যেমন অতিলাবণ্য দেখি তেমনি পিটুলির পুতুলে আর একরকম অতির দেখা পাই, কাজেই আর্টের দিক থেকে লাবণ্য-যোজনের বেলাতেও বলা চল্লো—‘অতিশয় কিছু নয়’।
বিশ্বকর্মা লাবণ্য দিচ্ছেন সকল রূপে সকল ভাবে নানা উপায়ে—আলো ছায়া দিয়ে রঙবেরঙ মিলিয়ে, কঠোরে কোমলে একত্র বেঁধে। নিছক কড়ি নিছক কোমল সুর নিয়ে সঙ্গীতে যেমন কাজ হয় না বিশ্ব জগতেও সৌন্দর্য-সৃষ্টি রস-সৃষ্টির কাজে আসে না নিছকের নিয়ম; সেখানে দেখি—একেবারে ভয়ঙ্কর শক্ত পাথর, তার উপর দিয়ে বইছে একেবারে তরল ঝরণা, নয় তো সবুজ শেওলাতে কোমল হয়েছে পাথরগুলো। পাহাড় শক্ত ঠেকে তখনই যখন তাকে বিচ্ছিন্ন ভাবে নিয়ে হাতুড়ি পিটে’ দেখি, কিন্তু আকাশের আলো যখন তাকে নানা লাবণ্যে বিভূষিত করেছে তখন কতখানি কমনীয় হ’য়ে গেছে পাহাড় তা তো দেখতেই পাই। জলের মধ্যে সবটা তরল বস্তু, মেঘ সবটাই বাষ্প, কিন্তু আশ্চর্য উপায়ে বিশ্বশিল্পী তিনি জলেতে মেঘেতেও কড়ি এবং কোমল দুই সুরই ধরেছেন, বাতাসেও কখনো ঘন কখনো ফুরফুরে কখনো তীব্র কখনও ক্ষুরধার নানা লাবণ্য দিয়ে পাঠাচ্ছেন শিল্পী। জয়দেবের কোমলকান্ত পদাবলীটাই কেবলি বাজছে না বিশ্ববীণাতে, সেখানে জীবন-মরণ হাসিকান্না আলো-অন্ধকার সবই বাজছে এক সঙ্গে সুরে বেসুরে চমৎকার, এবং সমস্ত ব্যাপারটি দেখি একটি লাবণ্যের পরিপূর্ণতার ঘেরে ধরা পড়ে’ যাচ্ছে,—একেই আর্টের ভাষায় বলা হয় Unity। লাবণ্যের ঘেরের মধ্যে বিচিত্র রূপ প্রমাণ ভাব ভঙ্গি সবই একটি অপূর্ব একতা পাচ্ছে কি না এইটেই লক্ষ্য করবার বিষয় ছবিতে মৃতিতে। হাড়ে-মাসে জড়িত দিব্য লাবণ্যযুক্ত শরীর—তার স্থানে আছে আর্ট, কিন্তু শুধু মাস শুধু হাড় বা কঙ্কাল রূপসৃষ্টির বেলাতে অদেয়। পৃথক ভাষটা ঘুচিয়ে না দিলে কিছু কিছু লবণ সংযোগ না ক’রে উপায় নেই। পাখীর পালকে প্রজাপতির ডানাতে কিংখাব মখমলের কাপড়ে যে লাবণ্য তা শুধু কোমল স্বর দিয়ে তৈরি হয় না—শক্ত সোনার তার, শক্ত কাঁটা, আঁস, বিচিত্র বিভিন্ন রকমের কত কী দিয়ে এই লবণ্যের সৃষ্টি করে আর্টিষ্ট তবে চোখে লাগে মনে ধরে রচনাটি। লাবণ্য-যোজনের কৌশল শেখা বিদ্যের বাইরের জিনিষ, শিল্প-বিদ্যাপীঠে পাচ টাকা মাইনে দিয়ে ডিগ্রী নিয়ে সেটা দখল করা যায় না। ওটি আপনাতে রইলো তো ফুটলো, আপনার কাজে লাগলো ছোঁয়াচ ওর, তবে সুন্দর হ’ল নিজের ঘরের সাজ ও বাইরের সজ্জা।