বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/সাদৃশ্য
এক পাটি জুতো দু’পাটি জুতো, একটা ফুল দুটো ফুল, অমুক মানুষ, ঐ জানোয়ার—এই হিসেবে যতক্ষণ খালি রূপ চেনা চলেছে ততক্ষণ সাদৃশ্য উপমা ইত্যাদি ব্যাপারের কথাই উঠচে না। নিত্যকার দেখা, সাধারণ দেখা, কাজ-চলা হিসেবে দেখা—এর মধ্যে ভেবে দেখা ফলিয়ে বলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কমিয়ে বাড়িয়ে বলার অবসরই নেই—যেটা যা তারই জ্ঞান এই পর্যন্ত হ’ল। ভাবরাজত্বে যখন পৌঁছে গেল রূপ, তখন সাদৃশ্য উপমা ধরে’ রূপ পাল্টাপাল্টি ভাব পাল্টাপাল্টি চল্লো। ইংরাজীতে যাকে বলে Likeness বা একটার মত আর একটা, তার দেখা পাই কৃষ্ণনগরের পুতুলে, পোর্ট্রেট পেণ্টিংএ। একজোড়া কানের দুল হাতের বালা পায়ের নূপুর এ ওর সদৃশ, এবং অনুরূপ সাদৃশ্য। কিন্তু একটা সোনার ঝুম্কো সে গাছের ঝুম্কো ফুলের অনুরূপ না হ’য়েও ফুলের সদৃশ শোভা পেলে। এমনি আবার মুক্তার হার কি হীরার কণ্ঠীতে নানা বিসদৃশ জিনিষ গাঁথা পড়ে’ হ’ল একটা একটা ফুল কি ফুলের মালা, কিংবা আকাশের তারকাপুঞ্জের সদৃশ। মুক্তার দুল জানালে, রত্নের টুকরো জানালে—তারা কেউ ইন্দ্রধনুর থেকে ঝ’রে পড়া ফুলের রেণু, কেউ বা চোখের জল এমনি কত কী উপমা ও সাদৃশ্য মনে পড়ালে। অলঙ্কার-শিল্পের মূলে হ’ল সদৃশকরণের নানা কৌশল।
যখন আমরা দেখি ছবিটা এমন হ’ল যে, ভ্রম হ’ল ঠিক মানুষটি দেখছি, তখনই বলে ফেলি—বা চমৎকার সাদৃশ্য হয়েছে। আবার মানুষকেও দেখে বলি—বাঃ চেহারাটি যেন ছবিখানি!
“করিতেছি ছায়া দরশন
যেন কোন মায়ার রচন,
কাচেতে কনক কান্তি
চিত্ররূপে হয় ভ্রান্তি—
মোহিনী মূরতি বিমোহন।”
এখানে আসল মানুষকে যেমনি ভুল হচ্ছে ছবি ব’লে অমনি সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভেঙেও যাচ্ছে। চোখের পলক ইত্যাদি দেখে নিজের ভুলটা কেবল মনে বিস্ময় ও সন্দেহ দিচ্ছে। এমনি ছবির বেলাতেও ছবিকে চকিতে মানুষ বলে’ ভ্রম হ’ল, আবার চকিতে ভ্রম দূরও হ’ল। এই ধরণের সদৃশকরণ নিশ্চয়ান্ত সন্দেহালঙ্কার বলে ভ্রান্তিমৎ অলঙ্কারের কোঠায় রাখা চল্লো।
সদৃশ কাকে বলবো, তার বেলায় পণ্ডিতেরা বললেন—“তদ্ভিন্নত্বে সতি তদ্গতভূয়োধর্মবত্তম্”। আকারগত সাদৃশ্য বজায় রাখা না রাখার স্বাধীনতা রইলো কবির, কাজেই সহজে ‘মুখচন্দ্র’ এই উপমা দিয়ে বসলেন; এখানে চন্দ্রের গোলাকৃতি মুখের সঙ্গে মিললো কি না সে কথাই উঠলো না—দুই বিভিন্ন বস্তুও সহজে মিলে গেল। এমনি বাঙলাতে এই শ্রেণীর আর একটি চমৎকার উপমা হ’ল সোনামুখী। এখানে চাঁদমুখের সঙ্গে চন্দ্রমণ্ডলের যে একটু বা যোগ তাও নেই—সম্পূর্ণ দুই বিভিন্ন বস্তু সোনা আর মুখ।
ছবি মূর্তি সবই গোড়া থেকে আকৃতির বাঁধনে ধরা; কাজেই চিত্রকারকে উপমা দেবার বেলায় অন্য পথ দেখতে হয়েছে। আকৃতির মান এবং প্রকৃতির সম্মান দুই বজায় রেখে উপমা। হাতের উপমা হ’ল হাতীর শুঁড়, চোখের হ’ল খঞ্জন, মাছ, পদ্মপলাশ কত কী। এর মধ্যে কতক উপমা ছবিতেও যেমন কবিতাতেও তেমন খেটে গেল। সঙ্গীত কলা পুরোপুরি সাদৃশ্য দেবার পথে সবার চেয়ে এগোলো—বসন্তবাহার রাগিণী বীণাতে বাঁশীতে বাজলে, শুধু ভাবের দিক দিয়ে বসন্তশ্রীর সাদৃশ্য পেয়ে চল্লো সুর অথচ কোকিলের কুহুধ্বনি ইত্যাদির প্রতিধ্বনি একটুও দিলে না।
এই রূপভর জগৎ এখানে সব কিছু যা দেখছি জলে স্থলে আকাশে তারা যেমন নিজ নিজ রূপটা দেখাচ্ছে তেমনি ভাবও জানাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে এবং নানা ভঙ্গি ও ভাবের দ্বারা এ ওর উপমা হ’য়ে নানা সাদৃশ্য লাভ করছে। সূর্যকে তো সূর্য বললেই যথেষ্ট এবং সূর্যকে সেই তার নিজ মূর্তিতে দেখেই কাজও চলে সত্য, কিন্তু ওই যে বর্ণন করলেন ‘জবাকুসুমসঙ্কাশং’ করে’ সূর্য—এতে ক’রেই জানি যে, গ্রহাধিপতি একটি ফুলের সাদৃশ্য ও সাযুজ্য পেতে ব্যাকুল হ’য়ে কোনো এক কবিকে বেদনা জানিয়েছিল কোনো সময়ে। শাদা মেঘ শরতের হাওয়ায় ভেসে এল,—সে কি মেঘ বলেই দেখলো নিজেকে? কবিতায় বলা হ’ল ছবিতে লেখা হ’ল—‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’, এটার মানে এই যে এই সাদৃশ্য ধরে’ সত্যই দেখা দিলে মেঘ। কত কী রূপ, তার বিচিত্রভাবে কখন্ কাকে কিসে সদৃশ হ’য়ে দেখা দেয়, তারই পরিচয় ছবির রূপে কবিতার রূপে গীতের রূপে ধরা দেয়।
অজন্তা গুহায় যারা অপসরার চিত্র লিখেছিল অপ্সরার কাঁধে দুখানা করে’ ডানা বেঁধে দেবার দরকারই তারা বোধ করেনি, মেঘকেই তার ডানা সদৃশ ক’রে লিখে গেল। কী চমৎকার উপমা দিয়ে বললে তারা—মেঘ-পাখনা অপ্সরা! কবিতায় এ উপমা হয়তো এখনো চলেনি, কিন্তু চলবার বাধাও দেখিনে।
তাজবিবির রৌজা—পাথরে গাঁথা মস্ত একটা কবরের ঢাকন মাত্র, কিন্তু সেটি অনেক কিছু উপমা পেলে। ধর আমরা কেউ উপমা দিলেম তাজের—যেন স্ফটিক পেয়ালায় বাদশাহী মদের শেয গাঁজলা, কিংবা তাজমহলটি দেখাচ্ছে যেন চার চারটে বাণবিদ্ধ মরুঞ্চে চাঁদের শ্বেত হরিণী কি বড়দিনের চিনিমোড়া কেক অথবা ময়রার দোকানের মুণ্ডি সন্দেশ। তবে অবশ্য সাদৃশ্য টানা হিসেবে এরূপ ভাবে নিজের নিজের মনোমত উপমা দেওয়াতে বাধা দেবার কথা উঠতে পারে না, কিন্তু উপমার যোগ্যতা অযোগ্যতা নিয়ে তর্ক উঠবে সভাস্থলে। উত্তমাধম সব উপমাই যাচাই হ’য়ে তবে স্থান পাচ্ছে কাব্যে সাহিত্যে শিল্পে। এই যাচাই হবার দুটো যায়গা—তার একটা হ’ল রসিকের সভা আর একটা হ’ল মহাকালের বিচারালয়। এই কারণে কবিপ্রৌঢ়োক্তিসিদ্ধ অলঙ্কার উপমা ও সাদৃশ্য দেবার ব্যবস্থা দিলেন পণ্ডিতেরা। প্রাচীন অনেক সাদৃশ্য ও উপমা কালে কালে কবিপ্রৌঢ়োক্তির ছাড়পত্র পেয়ে গেছে, তেমনি নতুন উপমাও অনেক সৃষ্টি হ’য়েছে যা সুরু থেকেই জানিয়ে দিচ্ছে যে কালে কালে চলবে তারা। দিল্লীর লাড্ডু ঘোড়ার ডিম এরা কেউ প্রাচীন উপমা নয়, কিন্তু সাদৃশ্য দেবার হিসেবে এমন দুটো আধুনিক উপমা আর চমৎকার উপমা নেই বললেও চলে ভাষায়। ‘গোমাতা’ অতি প্রাচীন সাদৃশ্য পৃথিবীকে বোঝাতে, কিন্তু গ্লোবকে গোরুর আকৃতি দেওয়া হ’ল না, কিংবা এই প্রাচীন কবিপ্রৌঢ়োক্তি একে নিয়ে কাজ চললো না আর্টে, ও কেবল গো-রক্ষিণী সভার বিজ্ঞাপনে আর গো-ফল ব্রতে কাজ দিলে। মেলিন্স্ ফুডওয়ালার কাছেও গোমাতার সাদৃশ্য আদর পেতে চল্লো, কিন্তু আর্টিষ্টের কাছে এই সাদৃশ্য আদর পেলে না,—নটরাজের পায়ের তলায় প্রলয়ের দিনে পৃথিবী টলমল করছে এটা একটা গোরু দিয়ে বোঝাতে চল্লো না আর্টিষ্ট, সহস্রদল পদ্মের সঙ্গে সাদৃশ্য দিয়ে বসলো! বসুন্ধরা ব্রত করছে গাঁয়ের মেয়েরা। সেখানেও বসুমাতাকে গোমাতা সদৃশ করে’ আলপনা দিলে না, একটি পদ্মপাতায় একটি মাত্র জলবুদবুদ্ এরি সাদৃশ্য দিলে ব্রতচারিণী কুমারী শিল্পী।
বিয়ের বেলায় নানাদিকে উপযোগিতা নিয়ে কথা ওঠে, উপমা দেবার বেলাতেও তাই। সাদৃশ্যসূত্রে দুই বিভিন্ন এক হ’য়ে মিলতে চল্লো কি না তাই উঠল লাখো কথা। আর্টিষ্ট হ’ল ঘটক, সে উপমান উপমেয় দুয়ে মিলিয়ে দেওয়ার কাছ করে। নরগণে রাক্ষসগণে যে মিলতে বাধা এটা যেমন ঘটক জানে, তেমনি কোন্ রূপে কোন্ রূপে মিশতে বাধা নেই বা বাধা আছে তা জেনেই কাজ করে আর্টিষ্ট। অনেক বস্তু সহজে এ ওর উপম হ’য়ে উঠলো দেখছি, অনেক বস্তু টেনেবুনে’ দড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা হ’য়ে এক হ’তে চল্লো কোন রকমে খুঁড়িয়ে, আবার অনেক বস্তু ভাবের বাঁধন পরলে কিন্তু রূপে রূপে সাদৃশ্যের বাঁধন মানতেই চাইলে না কিংবা হয়তো স্থান কাল পাত্র হিসেবে মিল্লো পাঁচপাঁচি রকমে। লুচির সঙ্গে চন্দ্রের উপমা বদ্রসিকতার চূড়ান্ত বলেই বলি, কিন্তু এরূপ সাদৃশ্য ছবিতে চল্লো কেননা আকাশে লুচি ধরে’ দিলেও ছবি চাঁদই বোঝাচ্ছে, স্থান কাল পাত্র হিসেবে এই বিশ্রী উপমাও কথায় কথায় বেশ একটু রসের সৃজন করেছে দেখা গেছে। আমার এক রসিক বন্ধু তিনি হ’লেন একাধারে ভোজন-রসিক এবং কলা-রসিক দুইই। একবার মাঘীপূর্ণিমাতে বন্ধুটি কোন এক অজ পাড়াগেয়ে বিয়ের ভোজে বসেছিলেন। পাতে লুচি ও ধারে খোলা ছাদের উপরে পূর্ণচন্দ্র—ব’লে বসলেন, “এ যে দেখি এখানেও পূর্ণচন্দ্র, ওখানেও পূর্ণচন্দ্র।” স্থান কাল পাত্র বুঝে’ সে-ক্ষেত্রে লুচি ও চাঁদের উপমাটা উপযুক্ত হ’লেও ঐ ভোজের সভা ও হাসির কোঠাতেই মানালো। তা বৈরূপ্য দেবার দরকার হ’লে বেঢপ উপমা কাজে লাগে। গাল দু’খানা যেন পাঁউরুটি—এ একটা বিরূপ সাদৃশ্য দিলে, গোলাপফুলের মত টুক্টুকে গাল, আপেলের মতো গাল—ও সব সাদৃশ্য অপরূপ রূপসৃষ্টির সময়ে এবং কনে সাজানোর বেলায় বড় দরকারী হ’য়ে পড়ল। এমনি দেখি সহজ ও স্বাভাবিক উপমা তার সঙ্গে বিকট ও বেঢপ উপমা, দুই-ই কাজে আসছে আর্টিষ্টের—কুলোকানি, মূলোদাঁতি এ সব উপমা হাজির হ’ল রাক্ষসী দানবী এমনি নানা বিরূপ চিত্র দেবার বেলায়। সুরূপ দেবার বেলাতেও এই ভাবের বিরূপ সাদৃশ্য খানিকটা কাজে লাগলো, যেমন—বৃষস্কন্ধ, শালপ্রাংশু, হয়গ্রীব, সহস্রবাহু ইত্যাদি ইত্যাদি। রূপের আতিশয্য দিয়ে ভাবের বিরাট্ত্ব দেখানো চল্তি ভাষাতেও চল্লো, যেমন—সখের প্রাণ গড়ের মাঠ, দিল দরিয়া। রূপগুণের অভাব বোঝাতেও এই রকমের আর এক প্রস্থ উপমা রয়েছে—ঠুঁটো-জগন্নাথ নড়েভোলা, এসব উপমা অকর্মণ্য, নড়তে চড়তে যার ভুল হয়—তাকে বোঝালে। সহজ কথায় সাদৃশ্য কাকে বলি যদি বলতে হয় তো বললো ‘যেমন দেবা তেমনি দেবী’ হওয়া চাই তবে মিল্লো ঠিক সাদৃশ্য।
সেই বৈদিক আমল থেকে এ পর্যন্ত উপমা ধরেই তাবৎ রূপসৃষ্টি হ’য়ে চলেছে, উপম হ’য়ে দেখা দেওয়া বিচিত্র রূপে ও ভাবে—এই হ’ল নিয়ম, এই বিশ্বজগৎ এও একটা বিরাটরূপ সৃষ্টি যা ভাবের উপম হ’য়ে বিচিত্র হ’য়ে দেখা দিলে। মানুষের মন সেই বিশ্ব-রচয়িতাকেও উপমার মধ্যে দিয়ে দেখে নিয়ে ব’লে গেছে—“বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ” এটি হ’ল রূপের দিক দিয়ে বিশ্ব-নিয়ন্তার সুন্দর উপমা। আবার ভাবটা কেমন জানবার বেলায় উপমাই কাজে এল—“রসো বৈ সঃ”। কাজেই দেখবো, রূপ-রচনার বেলায় সাদৃশ্য উপমা ইত্যাদি কখনই বাদ দেওয়া চলে না। উত্তমের জন্য উত্তম উপমা অধমের জন্য অধম উপমা বড়র জন্য বড় উপমা ছোটর জন্যে ছোট,—এই হচ্ছে নিয়ম। নিরুপম নিরুপমা দুটি নাম ঘরে ঘরে চল্তি; কিন্তু এই দুইটি উপমা নাম রূপেই রইল এবং কথা-সাহিত্যেও বদ্ধ থাকলো বিশেষণের কোঠায়, যারা গড়বে আঁকবে তাদের কাজে এল না বড় একটা। উপমা দিতে অনন্তকেও টান দিলেন কবি, কেন না অনন্তকে গড়ে’ দেখাতে হ’ল না এঁকে দেখাতে হ’ল না তাঁর; কিন্তু যে বেচারা ছবি মূর্তি করে, এ সাদৃশ্য দেওয়া তার পক্ষে দুর্ঘট হ’ল—বড় জোর অনন্ত-শয্যা পর্যন্ত পৌছল সে। কবিরা এইভাবে উপমা দেবার বেলায়, সুমেরু-শিখর তাও এনে বুকের উপর সহজে বসিয়ে দিলেন, কিন্তু মূর্তিকার দেখলে এরূপ উপমা দিলে তার গড়া মূর্তি পাথর চাপা পড়ে’ মারা যায়, কাজেই উপমা দেবার সময় সে কনক-কটোরা পর্যন্ত এগোল। রূপের বাধা মানতে হয় রূপকারকে, কাজেই উপমার সাদৃশ্য ইত্যাদির বেলায় এক গঙ্গাজল এক গণ্ডূষের মধ্যে ধরার কৌশল আবিষ্কার করে’ নিতে হয় বেচারাকে। এখন এই সদৃশকরণের নানা উপায়ের মধ্যে প্রধান উপায়গুলোর একটু হিসেব নিই।
একটা মোটামুটি বাইরের সাদৃশ্য মানুষে মানুষে, মানুষে এবং বানরেও আছে, আবার এও দেখি নাক মুখ চোখের বিসদৃশ ভাব ও রূপ নিয়ে এতে ওতে ভিন্নতাও রয়েছে। কোন বাঙ্গালী দেখতে হ’ল যেন সাহেব, কেউ হ’ল কালো কাফ্রী, যে আছে নাদুস নুদুস গণেশ-ঠাকুর, বয়সে কিংবা ম্যালেরিয়ায় সে হ’য়ে গেল পোড়া-কাঠের সদৃশ। চালচলনের দিক দিয়েও রকম রকম সাদৃশ্য আর উপমার আবির্ভাব হচ্ছে দেখি; যেমন—অতিগজগামিনী কিংবা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব! আঁকা মানুষটি হ’ল দেখা মানুষের সদৃশ। এই রূপটা রইলো প্রথম মহলে আকৃতিগত সাদৃশ্যের কোঠায়, তারপর হ’ল ছবির মানুষটি বসে’ আছে যেন সিংহ কি গরুড় পক্ষী—এ হ’ল ভাবভঙ্গিগত সাদৃশ্যের নমুনা। প্রথমে সাদৃশ্য—পুরোপুরি নকলের দ্বারা সম্পাদন করা চল্লো, দ্বিতীয় বারে সাদৃশ্য দেবার সময়ে মানুষের ভাবে আর ইতর জীবের ভাবভঙ্গিতে মেলানোর কথা উঠলো।
এই দুই প্রকারের সাদৃশ্যতেই চিত্রকারের পূর্ব-দৃষ্ট রূপের জ্ঞানটি কাজ করছে। এতে করে’ ছবি কোথাও করে’ চল্লো দেখা মানুষের ভাবভঙ্গি নকল ও প্রতিকৃতি, কোথাও দেখা মানুষ দেখা জীবে ভাব ভঙ্গি মিলিত হ’য়ে দিলে একটি ভাবের প্রতিকাশ। বুদ্ধের নিজের মূর্তিটা কেমন ছিল না দেখা থাকলেও এই দ্বিতীয় উপায়ে নানা লক্ষণাক্রাস্ত নাক মুখ চোখের টানটোন দিয়ে পাথরের মূর্তিতে বুদ্ধত্বটুকু পরিষ্কার ধরে’ ফেলা চল্লো।
তাজবিবির রৌজা সেখানে সদৃশকরণের স্বতন্ত্র কৌশল ধরলে আর্টিষ্ট, নারী-ভাব ফুটলো সেখানে তাজবিবির ভৌতিক দেহভঙ্গি ইত্যাদি বাদ দিয়েও। এই হ’ল উপমা দেবার বাহাদুরির চরম নিদর্শন স্থাপত্য শিল্পে, এমনি নিদর্শন আরও আছে দেশে বিদেশে নানা শিল্পকলার মধ্যে। সেদিন একখানা তলোয়ার দেখলেম, সেটি গ্রীক ভিনাস মূতির মতোই সুন্দরী বোধ হ’ল; আর্টিষ্ট যথার্থই অস্ত্রখানিকে বীরের বামারূপে গড়ে’ গেছে—তন্বী শ্যামা ঝকঝকে মূর্তিখানি। মন্দিরের চূড়াগুলো যদি ভাল করে’ দেখা যায় তবে পর্বতের সাদৃশ্য চমৎকার পাই তাতে,—কোন গোপুরম্ দেবতা মানুষ পশু পক্ষী ইত্যাদি নিয়ে বিরাট্ যেন বিন্ধ্যাচলম্ কি সীমাচলম্, কোনটা বা বরফ-ঢাকা পাহাড়ের মতো সাদাসিধে রূপখানি,—মন্দিরচুড়া কি প্রাসাদচুড়াকে পর্বতের সঙ্গে টেনেবুনে’ মিলিয়ে দেখতে হয় না, সহজেই দেখি আমরা। দৃশ্য বস্তুর মর্যাদা বুঝে’ যে উপমা দিতে পারে সেই হ’ল সুকৌশলী। কবি কালিদাস উপমার ওস্তাদ ছিলেন, তাইতো বলে থাকি—‘উপমা কালিদুসস্য’। এখন বলতে পারি, কালিদাস থেকে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র উপমা না দিয়ে কালিদাসকেই চিরকাল সব কবিই উপমা টানার বেলায় অনুসরণ করবে কেন? পুরাকালে নতুন নতুন উপমা সৃষ্টি করার স্বাধীনতা কালিদাসেরও ছিল, এখানকার মানুষদেরও আছে একালে, এটা সত্য কথা। কিন্তু এখানেও কবিপ্রৌঢ়োক্তির কাজ আছে, সীমা টানা চাই কবিতে অকবিতে উপমার দিক থেকে, অকবি শুধু নতুন এই জোরে তো যা তা উপমা দিয়ে খালাস পেয়ে যেতে পারে না। এই কারণে পণ্ডিতেরা বলেন যে কিছু উপমা বা অলঙ্কার তা কবিপ্রৌঢ়োক্তিসিদ্ধ হ’ল তো চল্লো কাজ; কবির উক্তি পুরোনো কি নতুন এ কথা নয়। যে কবি নয় সে ফস্ করে’ যদি উপমা দেয় যে তাজমহলটি দেখছি যেন মুণ্ডি সন্দেশ, কি তাজের গম্বুজটা যেন দেখাচ্ছে চার চারটে বাণবিদ্ধ মরুঞ্চে চাঁদের শ্বেতহরিণীর নিটোল স্তনটি, তবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে যে সাদৃশ্যকরণের শিল্প তার কিছুই ঠিক থাকে না, এবং ভুল উপমা দোষদুষ্ট উপম ক্লিষ্ট উপমা অপকৃষ্ট উপমা নির্ভুল উপমা উৎকৃষ্ট উপমা বেরসিকের উপমা সুরসিকের উপমা,—এসব কিছুর কোন মূল্য থাকে না, কানাকড়িও ষোলকড়ার সমান ধারাতে চলে।
একই রকমে দেখতে বলেই ষোড়শকলায় পূর্ণ চাঁদের সঙ্গে চাঁদা মাছের সাদৃশ্যও উপমা দিলে ভাল বলতে পারিনে। ভেকের মকমকী তাকে মনোমত করে’ দিতে হ’লে যে সদৃশকরণের কৌশল ও রসজ্ঞান থাকা দরকার তা তো সবার থাকে না; কাজেই সোজা রাস্তা হচ্ছে মহাজনের অনুসরণ। বৈষ্ণব কবিতায় ব্যাঙের ডাক কোকিলের ডাকের তুল্য মূল্য হ’ল, সে কেবল কবির হাতে কলম ছিল বলেই—রসবিদ্ধ ও রসেতে প্রৌঢ় কবি। ঋগ্বেদের মণ্ডূকস্তোত্র, বৈষ্ণব কবির মত্ত দাদুরির স্বর, ভারতচন্দ্রের বর্ষাবর্ণন, তিনেরই মধ্যে ব্যাঙ চমৎকার ভাবসাদৃশ্য পেয়ে বসেছে দেখি। বিরুদ্ধ রূপ দিয়ে যে উপমা ও সাদৃশ্য, তা থেকে উৎপত্তি হ’ল বৈরূপ্যকলার নানা আদর্শ;—যেমন হাতী ও মানুষে মিলে গণপতি, নাগনাগিনী কিন্নর কিন্নরী যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব ছেলেভুলোনো ছড়ার হিট্টিমাটিম পাখী শেয়াল রাজা মায় অতি আধুনিককালে ব্যঙ্গ-চিত্রের নানা অবতার। এই বৈরূপ্য কথায় কথায় রোজ রোজ ব্যবহার করছি আমরা—যেমন, ‘ছেলে নয় পিলে’। সঙ্গীতে হাসির গানের ইংরাজী বাংলা সুরের বিরুদ্ধতা ইত্যাদি এই বৈরূপ্য সৃষ্টির সহায়তা করছে। এক শ্রেণীর কবিতা এক শ্রেণীর ছবি এক শ্রেণীর গল্প এক শ্রেণীর গান—এ যেমন বৈরূপ্যের ফলে হ’ল, তেমনি বাড়ীঘরের সাজসজ্জার এই বিরুদ্ধ রূপ এক হ’য়ে সাদৃশ্য পেলে। হ্যারিসন রোডের বাড়ীগুলো নানা বিরোধী অলঙ্কারের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নিদর্শন। ওকে দেখলেই বলবো মাড়োয়ারি ঢং মাড়োয়ারিদের সাজ-সজ্জা; কিন্তু বিরুদ্ধ বেঢপ রকম মোটেই নয়। এই সাজের বৈরূপ্য স্বজনে বাঙ্গালী আমরা ঢের পাকা—বিলিতি দেশীতে, খদ্দরে কাশ্মীরে, পঞ্চনদে পঞ্চাননতলায় অদ্ভুত রকমের খিচুড়ি পাকিয়ে বিরূপ সাদৃশ্য রচনা করতে পাকা। এমনটি বাঙলা ছাড়া কোথাও মিলবে না, এ বিবয়ে নিরুপম-নিরুপমার কোঠাতে পড়ে গেছি আমরা। গণেশ হ’লেন বিশ্বের দেবতা। আকারে অমিল নিয়েই তাঁর সৃষ্টি করলে আর্টিষ্ট। এও হ’তে পারে যে, প্রথমে আর্টিষ্ট গণেশকে নরমুণ্ড দিয়েই গড়েছিল, হঠাৎ বিঘ্ন পড়লো কিছু একটা, অমনি তাড়াতাড়ি হাতীর সাদৃশ্য দিয়ে জোড়াতাড়া দিয়ে বিঘ্নবিনাশন দেবতার সৃষ্টি করে’ পূজার জন্য প্রস্তুত হ’ল আর্টিষ্ট—বিঘ্নকে বিঘ্নবিনাশন করে’ তোলা হ’ল চরম কৌশল বিরুদ্ধ উপমা দিয়ে চলার, বিভিন্ন রূপে ঠোকাঠুকি লেগে রসভোগের বিঘ্ন না জন্মায় এই চেষ্ট।
পরীতে আর মানুষের ঘরে সুন্দরী মেয়েতে বিরোধ বাধলে ডানা নিয়ে, এরি মীমাংসা হ’য়ে সৃষ্টি হ’ল সুন্দর অবিরোধী উপমা বাঙলায়—‘ডানা-কাটা পরী’। কার্তিক ঠাকুরে আর ঘরের ছেলেতে বিরোধ বাধলো ময়ূরটাকে নিয়ে, যেমনি ময়ূর পালালো তাড়া খেয়ে আমনি উপমা এল এগিয়ে ‘ময়ূর ছাড়া নব-কার্তিক’। খিড়কি পুকুরের পদ্মফুল আর মানস-কমল দুয়ের মধ্যে নানা দিক দিয়ে বিরোধ মিটে গেল, তবে এল আর্টের কাজ।
আকারে আকারে ঠোকাঠুকি বিরোধ হ’ল স্বাভাবিক। তার বরাবরই বলে’ চলেছে আমি ও থেকে স্বতন্ত্র। ভাব তা বলে না, সে বিরোধ মিটিয়ে ভাবই করতে চলে। ভাব এলে আকৃতির বিরোধ যখন ভঙ্গ করে তখন রূপ এক-একটা ভঙ্গি পেয়ে সদৃশ হ’য়ে ওঠে অন্য একটা রূপের। ভাবুকের চোখে নায়িকা চলেছে দেখছি ‘সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব’। অথচ সাদা চোখে ঠেকলো লতা সে লতা, মানুষটি মানুষ। যতক্ষণ কাজের জগতে আছি ততক্ষণ এটা ওটা দেখছি এটা ওটাই, কিন্তু যেমনই ভাব উদয় আমনি—এ যেন ওর মতন ও যেন এর মতন এইরূপ দেখা সুরু হ’ল।
অবস্থাভেদে একই বস্তু ভিন্ন ভিন্ন সাদৃশ্য পেয়ে যায়; একই অগ্নি হোমকুণ্ডে একভাবে দেখা দিলে, রান্নাঘরে অন্যভাবে, দীপদানে অন্য সাদৃশ্য পেয়ে। ঋষিরা যে ভাবে অগ্নিদেবের নানা উপমা ও সাদৃশ্য দিয়ে একটা রূপ খাড়া করলেন, তাকে উনুনের আগুন চিতার আগুন কি সন্ন্যাসীর ধুনির আগুনের সদৃশ বলে’ বলাই চল্লো না, ক্রিয়া ভেদে স্থান কাল পাত্র ভেদে অগ্নি নানা জিনিষের নানা ভাবের সদৃশ হ’য়ে উঠলো দেখি। একটি ইংরেজী গল্পে এই অবস্থা ভেদে সাদৃশ্য ভেদের একটি বর্ণন পেলেম, যেমন—
‘Kristin sat and watched (the fire); it seemed to her the fire was glad that it was out, there (in the open fields) and free, and could play and frisk. It was otherwise than when, at home, it sat upon the hearth and must work at cooking food and giving light to the folks in the room.” (—The Garland by Sigrid Undset).
একই আগুন অথচ যখন মাঠের মধ্যে জ্বল্লো তখন তাকে দেখালো যেন চঞ্চল ফুর্তিবাজ একটি শিশু ঘর থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে, যখন উনুনে কি প্রদীপে হ’ল ধরা তখন সে যেন কর্মরতা গৃহিণী। ঊষা দেবতাকে ঋষিরা জোর করে’ টেনেবুনে’ ঘরের মেয়েটি বলে’ বর্ণনা করে গেলেন তো ঊষা নিশ্চয় ঐ মেয়েটির সাদৃশ্য ধরে’ রোজই আসতো তাঁদের কাছে। কাজেই বলি সাদৃশ্য উপমা এ সবই একটা একটা মনগড় কিছু নয়, রূপ সমস্ত আপনা হতেই ভাবুককে দেখা দেয়—এ ওর সদৃশ এবং উপম হয়ে।
অলঙ্কারশাস্ত্রে ভ্রান্তিমৎ অলঙ্কারের কথা বলা হয়েছে। এই ভ্রান্তি দিতে হ’লে আসলের অভ্রান্ত নকল দিতে হয়। সোনা আর মিনাকারি দিয়ে এমন অভ্রান্ত আকৃতি দিলে স্বর্ণকার সোনার প্রজাপতিকে যে ভুল হ’ল আসল বলে; এটা খুব কৌশলের পরিচয় দিলে, কিন্তু শিল্পীর শিল্পজ্ঞানের খুব বড় পরিচয় দিলে না এ ভাবের সদৃশকরণ। ঢাকা ও কটকের ভাল কারিগর সোনার তারে যখন চমৎকার প্রজাপতি ফুল খোপার জন্য গড়লে তখন তাকে বাহবা দিতেই হ’ল ওস্তাদ বলে।’ ইন্দ্রপ্রস্থের স্ফটিকের দেওয়াল ভ্রান্তি দিয়েছিল দুর্যোধনকে, দেওয়ালকে দ্বার বলে জেনেছিল বেচারা—
“স্থানে স্থানে প্রাচীরেতে স্ফটিক মণ্ডন।
দ্বার হেন জানিয়া চলিল দুর্যোধন॥
ললাটে প্রাচীর লাগি পড়িল ভূতলে।
হেরিয়া হাসিল পুন সভাস্থ সকলে।”
এই হ’ল নিম্ন শ্রেণীর ভ্রান্তিমৎ সাদৃশ্যের উদাহরণ। এ শুধু বরঠকানো খাবারের জিনিষের মতো জিনিষ দিয়ে ক্ষান্ত হ’ল, ঠিক ঐ মিনেকরা প্রজাপতি যা করলে তাই।
আবার আর এক রকমের সাদৃশ্য, সেও অন্য রকমে ভ্রান্তি দিলে; কিন্তু প্রতারণা করলে না দর্শককে, যেমন—
“রথ-চূড়া পরে শোভিল পতাকা
অচঞ্চল যেন বিদ্যুতের রেখা।”
যেমন সবুজ মখমলের মসনদ মনে পড়ালে তৃণভূমি, সেখানে প্রতারণা নেই, কিন্তু মাটির আম সে নিছক ভ্রান্তিই জন্মালো রসালো আমের—চিবোতে গিয়ে দাঁত পড়লো। প্রতারণা কৌতুক ইত্যাদি নানা ব্যাপার কাজ করলে সে রকম সাদৃশ্য দেবার বেলায়।
এখন দেখি যে বহুরূপী যে ভাবের সাদৃশ্য দিলে তাকে ভাণের কৌশল বলা গেল—মানুষ দিলে বাঘের চেহারার এবং হাঁক-ডাকের এমন নকল যে হঠাৎ ডরিয়ে উঠলো সবাই। কোকিল-ডাক এমন ডেকে চল্লো কলের পাখী যে, বনের কোকিলও মুগ্ধ হ’য়ে পালটা জবাব দিয়ে গেল। এই ভাবের সদৃশকরণ আর্টের জগতে অনুকরণ এবং সচকিত করণ,—এই দুটো পথ ধরে’ দিয়ে গেল ঠকাঠকি ব্যাপার। এর সম্পূর্ণ উল্টো রাস্তায় গেল সঙ্গীতকলা। শব্দ সেখানে কোকিল ডাকলে না কিন্তু সুর সমস্ত বসন্তবাহার দিয়ে ফুল ফুটিয়ে চল্লো হাওয়া বইয়ে চল্লো। উচ্চস্তরের আর্টে এই ভাবের সত্য-সাদৃশ্য দেবার চেষ্টাই হয়েছে, ভ্রান্তি জাগানো সাদৃশ্য নিম্নস্তরে পড়ে রয়েছে আজও।
আর্ট যতই নিম্নস্তরে নামতে থাকে ততই বহুরূপীর হরবোলার কৌশলের দিকে ঝুঁকতে থাকে। তখন থিয়েটারে দৃশ্যপট হয়ে ওঠে একেবারে ঠিকঠাক—রাস্তা বাড়ী ঘর দুয়োর সব ঠিক, ঠিক মেঘ ডাকে, ঠিক বজ্রপাত হয়।
“তদ্ভিন্নত্বে সতি তদ্গত ভূয়োধর্মবত্তম”—রূপের ধর্ম এক ভাবের, ধর্মরসের ধর্ম সে আর এক, সদৃশকরণ কখন্ রূপের ধর্মকে কখন্ রসের ও ভাবের ধর্মকে ধরে’ ধরে’ চলেছে দেখবো।
আগুনের ধর্ম আর পুষ্পমঞ্জরীর ধর্ম এক বলে স্বীকার করা চল্লো না—এ দেয় জ্বালা ও দেয় মোহনমালা; কিন্তু আর্টিষ্টের হাতে পড়ে’ এর চমৎকার একটি ফুলঝুরির রচনা করলে যাকে ফুলও বলা চল্লো আগুনও বলা চল্লো। আসল পাখী ওড়ে, লোহার চাদর ঝুপ করে’ পড়ে; দুই বস্তুর দুই ধর্ম, কিন্তু আর্টিষ্টের হাতে সাদৃশ্যের কৌশলে লোহার চাদর-মোড়া পাখনা মেলিয়ে উড়ো কলটা ঠিক পাখীর সাদৃশ্য ধরে’ উড়ে’ চল্লো শূন্যভরে। দুই বিভিন্ন বস্তু মিল্লো এক হ’য়ে সাদৃশ্য দেবার কৌশলে, কখনো ভাবে ভাবে মিল্লো কখনো রূপে রূপে মিল্লো। এই সদৃশকরণের কৌশল দিয়ে মানুষ দেবতাও সৃষ্টি করেছে রাক্ষসও সৃষ্টি করেছে, সুন্দর নিরূপম রূপ ও রস রচনা করেছে। এই কৌশলপ্রয়োগের জ্ঞান যার নেই সেই মূর্খ অসুন্দর পদার্থের স্তূপ রচনা করে মাত্র।
অসাদৃশ্যমূলক ভ্রান্তির কথা পণ্ডিতেরা বলেছেন, না থেকেও আছে—এই প্রকারের সাদৃশ্য আর্টের একটা বড় দিক। বৈষ্ণব গ্রন্থে ঝুড়িঝুড়ি উদাহরণ পাই যেমন—
“মহাপ্রভুর বিয়োগ মঙ্গল হয় মোর,
যেখানে যেখানে যাই প্রভুরে দেখিতে পাই
প্রেমরসে হইয়া বিভোর।”
ঐ যে বল্লেন কবি—
“সর্ব্বদাই হু হু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন।”
থেকেও নেই কিছুই এই রকমটা ছবি দিয়ে প্রকাশ করা কঠিন। সাদা কাগজ দিয়ে তো নিশ্চিন্ত হ’তে পারিনে, কাযেই যে লোকটি বিশ্বটাকে মরু বলে’ দেখছে, হয় তার দৃষ্টির শূন্যতা দিয়ে নয়তো সে যে দিকটাতে দেখছে সেই দিকের উদাস উদার মাঠখানা দিয়ে কোন রকমে ব্যাপারটা বোঝাতে হ’ল চিত্রে।
ধৌত বিঘট্টিত লাঞ্ছিত ও রঞ্জিত এই চার অবস্থা হ’ল চিত্রের। লাঞ্ছিত অবস্থা সাদৃশ্যে—ছবি রূপের ও ভাবের। এই যে সাদৃশ্য সেও আবার তিনটে আলাদা ধারা’ ধরে তিন শ্রেণীতে ভাগ হ’য়ে গেল দেখি।
প্রথম, ঘটনামূলক সাদৃশ্য—নিছক প্রতিরূপ পেলেম সেটি দিয়ে। বন গাছ আকাশ জল পর্বত ঘর বাড়ী সহর গ্রাম; বাজার বসেছে, লড়াই হচ্ছে, গরু লাফাচ্ছে, ঘোড়া দৌড়চ্ছে, ছেলে খেলছে, নৌকো চলেছে ইত্যাদি স্থানচিত্র ও দৈনিক ঘটনাবলীর ছবি; পোট্রেট্ পেণ্টিং পর্যন্ত এসে গেল। ঘটনা-সাদৃশ্যে দৃষ্টরূপ প্রধান স্থান পেল।
এর পর এল কল্পনামূলক সাদৃশ্য। এটি দিয়ে মনঃকল্পিত যা কিছু অবতারণা করা চল্লো। এখানে আর দেখা-রূপের সীমা মেনে চলতে হ’ল না। দেখা গাছ হ’ল এখানে কল্পবৃক্ষ, ছাতা ছৈ ছতরী কত কী, এখানে দেখা রূপে না-দেখা রূপে বা কল্পিত রূপে মেলামেশানোর অবসর হ’ল এবং তার ফলে নানা অদ্ভুত রূপ-সৃষ্টির দেখা পেলেম।
এর চেয়ে উচ্চ স্তরে উঠে পেলেম আর্টের মধ্যে ভাবনা-মূলক সাদৃশ্য। যা অন্তর্নিহিত ছিল, গোপনে ছিল, তা বাইরে প্রকাশিত হ’ল অপূর্ব কৌশলে। এ-ক্ষেত্রে রূপ ও কল্পনা দুই-ই ভাব-ব্যঞ্জনার কাজে লাগলো, এবং ভাব ও রসই এখানে প্রাধান্য পেলে দৃষ্ট এবং কল্পিত দুয়ের উপরে।
শীতের সকালে একটা ভাবনা বিশ্ব জুড়ে আছে; বর্ষার দিনে আর একটা ভাবনা। এমনি ক্ষণে ক্ষণে কালে কালে একই দৃশ্য নানা ভাবনায় বিভাবিত হ’য়ে উঠছে দেখা যাচ্ছে। ছবিতে গাছ লিখি মানুষ লিখি বা জন্তুই লিখি ভাবনাটি তার দ্বারা নিরূপিত হ’ল যেমনি তেমনি ভাবনা-সাদৃশ্য পেলে হাতের কাজ আর্টিষ্টের। নানা উপমা নানা সাদৃশ্য সূত্রে বাঁধা সমস্ত রূপ—এটা পাথর এটা গাছ ঐ মেঘ ওটি চাঁদ উনি সূর্য ওরা তারা, কেবলই এই পার্থক্য এবং ভিন্নতা নিয়েই তো বর্তে নেই বস্তুরূপ সমস্ত, ভাবের আদান-প্রদান বশতঃ এতে ওতে গলাগলি মিলছে তারা—এ হচ্ছে ওর মতো ও হচ্ছে এর মতো; এ-যেন সাজঘরের নটনটী সবাই অফুরন্ত একটা লীলার অন্তর্গত হ’য়ে ক্ষণে ক্ষণে ছাঁদ বদলে দেখা দিচ্ছে। উদয়-বেলার সূর্য কী সাজেই সেজে দাঁড়ালো প্রভাতে,—মনে হ’ল যেন সদ্যফোটা এতটুকু একটি রক্তজবা। এই দেখেই উপমা দিলেন ঋষি—“জবাকুসুমসঙ্কাশং”। হিমগিরি সে মহেশ্বরের অট্টহাস্যের স্বরমুর্তিতে দেখা দিলে কবিকে, আকাশের তারা মাটির প্রদীপের মতো দেখালো, মাটির প্রদীপ দেখালো যেন অনিমিখ তারাগুলি,—এমনিই চলেছে কাজ রূপজগতে। জগৎ-সংসার জুড়ে’ সাদৃশ্যের যে সহজ নিয়ম কাজ করছে সেই নিয়মই স্বীকার করলে আর্টিষ্টের রচনা “তদ্ভিন্নত্বে সতি তদ্গতভূয়োধর্মবত্তম্।” জগতে কোথাও একটা সূর্যের অনুরূপ আর একটা সূর্য এমনতর ঘটনা হ’ল না, একটা গাছের অনুরূপ আর একটা গাছ এও হ’ল না, একটি মানুষের অনুরূপ আর একটি মানুষ এও হ’ল না, কিন্তু দুখানি ডানা, ফুলের দুটি পাপড়ি, গাছের দুটি পাতা, চোখের দুটি তারা এ ওর অনুরূপ হ’ল দেখি, তবুও সেখানে দুজনে সমান আসন পেলে না—এ রইলো দক্ষিণে ও রইলো বামে, একের অভিমুখী আর এক এই নিয়ে চল্লো কাজ বিশ্ব রচনার।
যেমনটি গড়েছেন বিধাতা তেমনটি গড়তে চাইলে না মানুষ, দেখতেও চাইলে না মানুষ, এর প্রমাণ ইতিহাসের আদিমতম যুগের। মানুষের রচনা থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। নিজের গায়ের চামড়া তাকে চামড়া বলে দেখেই তার আনন্দ হ’ল না, উল্কীর অলকা-তিলকা সাজনের সুচিত্রিত সাদৃশ্য দিয়ে সে জানাতে চল্লো কিসের সদৃশ হ’তে চায় সে; কেবলমাত্র নর সে নারী সে এটুকু জ্ঞানেই তার আনন্দ হ’ল না। প্রমাণ করতে চল্লো মানুষ ধর্মেকর্মে সাজেগোজে—হয় সে নরদেব নয় নরশার্দুল, নয়তো সীতা সাবিত্রী সুকুমারী নিরুপমা রাজমহিষী। কত কী বিশেষণ ও উপমা ধরে' কত কী যে সৃষ্টি হ’ল তার সংখ্যা নেই।