মাছরাঙা

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী, বিল ও দহের অভাব নাই, সুতরাং দুই তিন জাতীয় মাছরাঙা থাকিবে তাহাতে আশ্চর্য্য কি? মনুষ্যাবাসের সান্নিধ্যে, গৃহসংলগ্ন পুকুর বা ডোবার পাশে আমরা দুটিকে দেখিতে পাই। অপরটিকে নদী ও বৃহৎ জলাশয়েই দেখা যায়। যেটিকে আমরা খুব সচরাচর লক্ষ্য করি সেটি হ্রস্ব-দেহ, ক্ষুদ্রায়তন। আকারে ইহা চড়ুই পাখী অপেক্ষা বড় হইবে না, শুধু দীর্ঘ চঞ্চুটির জন্য এবং একটু হৃষ্টপুষ্ট বলিয়া বড় দেখায়। ইহাদের মস্তকে নীল ও কালো রঙের সমাবেশ এবং দেহের উপরিভাগ নীল। পৃষ্ঠের নীল রঙ বেশ ঘন। দেহের নিম্নভাগ ময়লা লাল রঙ, তামাটে বলা চলে। গণ্ডোপরি খানিকটা সাদা। পা দুখানি যদিও রক্তকমলের মত, চঞ্চুটি একেবারেই কৃষ্ণবর্ণ, লেজটি অত্যন্ত খাটো, যেন লেজ তাহার সমস্ত দৈর্ঘ্যটুকু চঞ্চুকে দান করিয়াছে। চঞ্চুর এই দৈর্ঘ্য ইহার জীবনযুদ্ধের সহায়ক, নহিলে জল হইতে ছোঁ মারিয়া মাছ তোলা সহজ হইত না। জমির উপর চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতে হয় না বলিয়া ইহাদের পা দুটি অতিশয় হ্রস্ব। চেষ্টা করিলেও ইহারা ভূপৃষ্ঠে দৌড়াইয়া বেড়াইতে সক্ষম নহে। ইংরেজ ইহার নাম দিয়াছে “দি কমন কিং-ফিসার”। বাংলায় অন্য মাছরাঙা হইতে পৃথক করিবার জন্য ইহাকে “ক্ষুদে মাছরাঙা” আখ্যা দিতে পারি।

 জলের ধারে বৃক্ষের যে শাখাটি জলের উপর আসিয়া পড়ে তাহারই অগ্রভাগে নিতান্ত মৌনী তপস্বীর মত নিশ্চল হইয়া মাথাটা ঘাড়ের দিকে ঠেলিয়া দিয়া ইহারা বসিয়া থাকে। দৃষ্টি জলের উপর নিবদ্ধ থাকে। মাছ দেখিতে পাইলেই গুলতি হইতে নিক্ষিপ্ত গুলির মত তীরবেগে নামিয়া ঝুপ করিয়া জলমধ্যে প্রবেশ করে এবং ক্ষণপরেই দেখা যায় যে, একটী মাছকে আড়াআড়ি চঞ্চুবদ্ধ করিয়া সে উঠিয়া পড়িয়াছে। উড্ডীয়মান অবস্থায় মাছ গলাধঃকরণ করিতে ইহারা পারে না, সেইজন্য পুনরায় ডালের উপর আসিয়া মাছটীকে ঠুকিয়া হত্যা করে এবং পরে লম্বালম্বি ধরিয়া মুখমধ্যে চালনা করে। ক্ষুদে মাছরাঙা মাছ ছাড়া অন্য কিছু খায় না। ছোট ছোট মাছই ইহারা শীকার করে। শুনিয়াছি আস্ত মাছটা গলাধঃকরণ করিলেও, আহারের কয়েকঘণ্টা পরে কাঁটাগুলি গোলাকার অবস্থায় উদ্গার করিয়া ফেলে। পেচকদেরও এই অভ্যাস আছে।

 খুব বেশী উড়িয়া বেড়াইতেও ইহারা পারে না। ডানা দুটী ছোট বলিয়াই বোধ হয় এইরূপ। স্বভাবতঃই এরা নিশ্চল আর নীরব, বেশীর ভাগ সময়ই জলের উপর বিলম্বিত কোনও ডালে বসিয়াই কাটায়। কখনও কখনও জলাশয়ের উপরে জলের খুব নিকট দিয়া উড়িয়া যায় এবং সেই সময় ইহাদের কণ্ঠ হইতে কর্কশ ধ্বনি বাহির হয়। ইহারা সঙ্গীপ্রিয় নহে, জোড়ায় জোড়ায় থাকে, অন্য মাছরাঙা সেখানে আসিলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়া যায়।

 যে মাছরাঙাটী বৃহৎ জলাশয়, নদী এবং বড় খালের ধারে থাকে, সেটী আকারে বেশ বড়, শালিকের মত। ইহাদের গায়ে শুধু সাদা ও কালো রঙের অসংখ্য ডোরা। সুতরাং ইহাকে আমরা “ডোরাদার মাছরাঙা” আখ্যায় অভিহিত করিতে পারি। ইংরেজ ইহাকে “দি পায়েড কিং-ফিসার” বলে। মাছরাঙার মধ্যে এইটী সদা-ক্ষিপ্র ও চঞ্চল। ইহারা কেবলই ডানার উপর থাকে। ইহাদিগকে খুব কমই বসিয়া থাকিতে দেখা যায়। জলের কোন একটা স্থানের সোজা উৰ্দ্ধে একটা জায়গা তাক করিয়া দ্রুত পক্ষসঞ্চালনদ্বারা অনেকক্ষণ একই স্থানে উড়িয়া থাকিতে পারে। অন্য কোনও পাখী একস্থানে
ক্ষুদে মাছরাঙা
স্থির হইয়া উড্ডীন অবস্থায় থাকিতে পারে না। বোধ হয় কোনও মাছের গতিবিধি লক্ষ্য করে। হঠাৎ পক্ষবিধুনন বন্ধ করিয়া জলের দিকে তীব্র বেগে নামিয়া আসে। মাঝে মাঝে মাছটী অপসৃত হওয়ায় আবার ডান মেলিয়া উড়িয়া চলে। এইভাবে উড়িতে উড়িতে এক এক সময়ে সবেগে নিক্ষিপ্ত লোষ্ট্রখণ্ডের মত জলের মধ্যে ঝুপ্‌ করিয়া গিয়া পড়ে। মাঝে মাঝে জলমধ্যে একেবারে তলাইয়া যায়। বোধ হয় মাছের পিছনে খানিকটা ধাওয়া করিতে হয়। ক্ষুদে মাছরাঙা কিন্তু জলে পড়িয়াই উঠিয়া পড়ে, এক লহমাও জলমধ্যে থাকে না। ডোরাদার মাছরাঙা সারাদিন খুব ডাকে, ইহাদের স্বর খুব তীব্র ও ধ্বনি গিটকিরীর মত কাঁপিয়া কাঁপিয়া যায়। কিন্তু ক্ষুদে মাছরাঙার মত অতটা কর্কশ গলা ইহাদের নহে।

 আর এক জাতীয় মাছরাঙা আমাদের দেশে যথেষ্ট সংখ্যায় দেখা যায়। ইহার কণ্ঠ ও বুকের সম্মুখ ভাগ সাদা। মাথা, ঘাড় ও নিম্ন অঙ্গের বক্ষ ব্যতীত, অন্য অংশ লালচে বাদামী। দেহের ঊর্দ্ধভাগ নীল— ডানাতে কিছু সাদা, লাল ও কালো রং আছে, চঞ্চুটি গাঢ় লাল ও পদদ্বয় টক্‌টকে লাল। সুতরাং ইহার দেহে বহুবর্ণের সমাবেশ রছিয়াছে। ইহার ইংরাজী নাম “দি হোয়াইট-ব্রেষ্টেড কিং-ফিসার”; ইহার ডানার নীচে মধ্যভাগের পতত্রগুলি সাদা হওয়ায় উড়িবার সময় ডানায় একটা স্পষ্ট শুভ্র দাগ লক্ষিত হয়। শালিকের ডানাতেও উড়িবার সময় এইরূপ শ্বেত রেখা চোখে পড়ে। পণ্ডিতরা বলেন যে অনেকগুলি শালিক একত্র যখন মাঠের এদিকে ওদিকে আহার অন্বেষণে রত থাকে, তখন যে কোনও একটী পাখী যদি বিপদের আভাষ পায় সে তখন একরূপ শব্দ করিয়া উড্ডীয়মান হয়। যেই সে পাখা মেলিয়া শূন্যে উত্থিত হয় অমনি এই সুস্পষ্ট সাদা রেখাটা সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। সব পাখীগুলিই এই সাদা রেখার ইঙ্গিতে বুঝিতে
শ্বেতবক্ষ মাছরাঙা

পারে বিপদ উপস্থিত এবং সকলেই যেন একসঙ্গে চালিত হইয়া স্থান ত্যাগ করিয়া উঠিয়া পড়ে একথা পূর্ব্বেই লিখিয়াছি। সেনানায়কের নীরব বাহুর ইঙ্গিতে যেমন পদাতিক সৈন্যরা চালিত হয়, দলবদ্ধ পাখীরাও একজনের ইঙ্গিতে ঐক্যবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। শালিকের ডানার সাদা রেখার তাৎপর্য্য এইভাবে পক্ষি-পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু মাছরাঙা তো দলবদ্ধ হইয়া থাকে না, সুতরাং তাহার ডানার এই উজ্জ্বল শ্বেত রেখাটী প্রকৃতি কি শুধু খেয়াল বশতঃই বিন্যস্ত করিয়াছে? ইহার উত্তর পাওয়া যায় নাই।

 নীলকণ্ঠ পাখীর ধরণধারণে যেমন অনেকে সন্দেহ করেন যে সে এক কালে মাছরাঙা ছিল, এই শ্বেতবক্ষ মাছরাঙাটিকে দেখিলে সে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। এই মাছরাঙাটীও বিবর্ত্তনের পথে নিজ জাতীয়তা হারাইতে বসিয়াছে। প্রাণিজগতে বিবর্ত্তন অল্পে অল্পে, এত দীর্ঘ দিন ধরিয়া চলে যে, অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য না করিলে উহা ধরা যায় না। এই পাখীটীকে লক্ষ্য করিলে ইহার চরিত্রে মাছরাঙা-বিরুদ্ধ কতকগুলি লক্ষণ দেখা যাইবে। যে পাখী মাছ খাইয়াই বাঁচে, তাহার তো জলের ধারেই থাকার কথা। কিন্তু এই সাদা-বুক মাছরাঙাটী এমন বাগানেও থাকে যার ত্রিসীমানায় জল নাই। কলিকাতা সহরে আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের আম্‌স হাউসের (এখন যেখানে থানা) অভ্যন্তরে বৃক্ষাগ্রে বসিয়া ইহাকে তারস্বরে চিৎকার করিতে দেখিয়াছি। বুঝা যাইতেছে যে একমাত্র মাছদ্বারা প্রাণটাকে বাঁচাইয়া রাখার অভ্যাস সে পরিত্যাগ করিতেছে। জলের ধারেও যখন সে শীকার খোঁজে তখন সে কদাচিৎ কষ্ট করিয়া শরীর ভিজাইয়া মাছ ধরে। তখনও পাড়ে যে সব ছোট ছোট ভেক বসিয়া থাকে, সেইগুলির প্রতিই ইহার লোভ দেখা যায়। আবার নীলকণ্ঠের মত মাঠে ঘাসের উপর আসিয়া উপবেশন পূর্ব্বক কীটাদি খুঁটিয়া খাইতেও ইহাকে দেখা গিয়াছে। ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে এলাহাবাদ সহরের চৌকের পাশে জিরো রোডে টেলিফোনের তারের উপর এই শ্রেণীর এক মাছরাঙা লক্ষ্য করি। মাঝে মাঝে তার হইতে অবতরণ করিয়া রাস্তার আবর্জ্জনা হইতে কাক শালিকের মত খাদ্য সংগ্রহে ইহাকে রত দেখিতে পাইতাম। এরূপভাবে খাদ্য-সংগ্রহ করা মাছরাঙা পাখীর ধর্ম্মবিরুদ্ধ। মাছরাঙা পাখীরা মাটীতে সুড়ঙ্গ খনন করিয়া গর্ত্ত মধ্যে ডিম্ব রক্ষা করে। কিন্তু এই সাদা-বুক মাছরাঙাকে কতকগুলি পাথরের বড় বড় নুড়ির পাশে কিছু খড়কুটা বিছাইয়া তদুপরি ডিম্ব রক্ষা করিতে কেহ কেহ দেখিয়াছেন। মাছরাঙা জাতীয় অন্য পাখীরা খালি মেজের উপরই ডিম্ব রাখে—অন্যান্য পাখীর মত গর্ত্ত মধ্যে কোনও গদী রচনা করে না। সুতরাং হয়তো কোনও দূর ভবিষ্যতে একদা এই শ্বেতবক্ষ মাছরাঙা সম্পূর্ণরূপে স্থলচর পাখী হইয়া পড়িবে এবং তখন ইহাকে ‘মাছরাঙা’ এই আখ্যা দেওয়া আর চলিবে না।

 বসন্তের শেষ হইতে নিদাঘের অন্তপর্য্যন্ত শ্বেতবক্ষ মাছরাঙার সন্তানজননকাল। ইংরেজী মাস হিসাবে ধরিলে বলিতে হয় মার্চ্চ হইতে জুলাই। ডোরাদার মাছরাঙা জানুয়ারী হইতে এপ্রিল এবং ক্ষুদে মাছ রাঙা জানুয়ারী হইতে জুন মাস পর্য্যন্ত শাবকোৎপাদন করে। পুকুর, নদী, ডোবার ধারে উচ্চ পাড়ে গর্ত্ত খুঁড়িয়া ইহারা সুড়ঙ্গ করে। এই সুড়ঙ্গ ছয় ইঞ্চি হইতে কয়েক হাত দীর্ঘ হয়। সুড়ঙ্গের একেবারে শেষ প্রান্তে পাঁচ, ছয় কিংবা সাতটা ডিম পাড়ে। ডিমগুলি হয় সাদা। অন্ধকার গর্ত্ত মধ্যে যে সব পাখী ডিম্ব রক্ষা করে প্রকৃতি তাদের জন্য সাদা রঙের ডিমের ব্যবস্থা করিয়াছেন। সম্ভবতঃ অন্ধকারে দেখিতে সুবিধা হয় বলিয়াই এই নিয়ম। কেননা দেখিতে না পাইলে ঠিক মত তা দেওয়া না হইতে পারে—পেটের নীচ হইতে সরিয়া গেলে পাখীর নজরে না পড়ায় ডিম প্রয়োজন মত উত্তাপের অভাবে পচিয়া নষ্ট হইয়া যাইতে পারে।

 মাছরাঙাদের মধ্যে নীলকণ্ঠের মত স্ত্রীপুরুষের দেহের বর্ণে কোনও প্রভেদ নাই। যে সব পাখী উন্মুক্ত খোলা নীড় রচনা করে তাহদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীপাখীর বর্ণ পুরুষপাখীর মত উজ্জ্বল হয় না, সাদামেটে কিংবা নিষ্প্রভ হয়। নীড়োপবিষ্টা অবস্থায় যাহাতে আততায়ীর দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, বোধ হয় সেইজন্য প্রকৃতি এই নিয়ম করিয়াছেন। মাছরাঙা, নীলকণ্ঠ, কাঠঠোকরা, বাঁশপাতি প্রভৃতি পাখী গর্ত্তমধ্যে নীড় নির্মাণ করে বলিয়াই সম্ভবতঃ ইহাদের স্ত্রীপুরুষের বর্ণে কোনও পার্থক্য রাখা বিধাতাপুরুষ নিষ্প্রয়োজন মনে করিয়াছেন।