বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/হাঁড়িচাচা
বাংলার পল্লীর প্রত্যেক বাগানে ইহার বাস। এই পাখী মানুষের সান্নিধ্য পরিহার করিয়া চলে না, বরং আমাদের উঠানে এমন কি সময় সময় বারান্দার রেলিং-এ আসিয়াও উপস্থিত হয়। অবশ্য বৃক্ষশাখাবিহারী এই পাখীটিকে কলিকাতার মত বড় বড় সহরে দেখা যায় না, কেন না বাগান ইহাদের বিচরণক্ষেত্র। কিন্তু কলিকাতার উপকণ্ঠে ইহাকে যথেষ্ট দেখা যায়। ইহার সুদীর্ঘ পুচ্ছটির জন্য পাঠকের ইহাকে চিনিতে বেগ পাইতে হইবে না। ইহার দেহ শালিক অপেক্ষা বড় হইবে না, কিন্তু পুচ্ছটি একফুট লম্বা হইবে। পুচ্ছটির আবার বাহার আছে। পুচ্ছের মধ্যভাগের পালক দুইটি দীর্ঘতম, তাহার অব্যবহিত দুই পার্শ্বের পালক তদপেক্ষা হ্রস্ব এবং একেবারে দুই প্রান্তের পালকদুটি হ্রস্বতম। লেজের রং সাদা তবে ধবধবে নয়, ময়লা, এবং উহার অগ্রভাগ কালো। মাথা, ঘাড় ও বক্ষোদেশ কাল, তবে উজ্জ্বল কালো নয়। শরীরের অপর অংশ বাদামী। ডানার পালকগুলির মধ্যভাগের রং লেজের মত— সাদা এবং কৃষ্ণবর্ণের অগ্রভাগ বিশিষ্ট, সুতরাং ডানার উপর মলিন সাদা একটি রেখা দেখা যায়। ইহাদেরও স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বর্ণের কোনও তারতম্য নাই, যদিও ইহারা উন্মুক্ত নীড়ই রচনা করে, গর্ত্তে নহে। ইহার চক্ষু ও চঞ্চু দেখিলেই বুঝা যাইবে যে আমাদের চিরপ্রতিবেশী বায়সের সঙ্গে ইহার নিকট সম্বন্ধ আছে। একজন ইংরেজ লেখক ইহাকে “ক্রো ইন্ কলার্স” বলিয়াছেন। ইহারা বাস্তবিকই বায়স-গোষ্ঠি সম্ভূত। তবে কাকের মত ধূর্ত্ত ইহারা নহে। চৌর্য্যবৃত্তিও ইহারা করে, তবে মানুষের ঘরে নহে; অন্য বিহঙ্গের
হাঁড়িচাচা নীড় হইতে ডিম ও বাচ্চা জোগাড় করিয়া প্রাতরাশ করিতে ইহাদের দেখা যায়। তাহা হইলেও কাককে অন্য পাখীরা যতটা সন্দেহের চোখে দেখে, ইহাকে ততটা খারাপ মনে করে না। কিন্তু পক্ষিজগতের শান্তিরক্ষক বা চৌকিদার ফিঙ্গে ইহাকে দাগী সম্প্রদায়ভুক্তই মনে করে এবং হাঁড়ীচাচা দেখিলেই ফিঙ্গের মেজাজ খারাপ হইয় উঠে।
ইহার শরীরে সাদা কালো রঙ্গের সমাবেশের জন্য এবং ইহা বৃক্ষবিহারী বলিয়া ইংরেজ ইহার নাম দিয়াছে “দি ট্রিপাই”। ইহাদের বাংলা সংজ্ঞাটি ইহারা গলার স্বরের জন্য লাভ করিয়াছে। মাটির হাঁড়ি একখানি খোলা দিয়া ঘর্ষণ করিলে যে শ্রুতিকটু শব্দ উৎপন্ন হয়, তাহার সহিত ইহাদের স্বরের সাদৃশ্য বশতঃই বোধহয় ইহা এই নাম, বা বদনাম, লাভ করিয়াছে। তবে সব সময়েই যে ঐরূপ কর্কশ স্বর ইহার কণ্ঠ হইতে বাহির হয়, তাহা নহে। প্রজনন ঋতুতে ইহাদের যে স্বর শুনিয়াছি তাহাকে শ্রুতিকটু বলা চলে না। বায়সের জ্ঞাতিভ্রাতা হইলেও তাহার মত অশ্রাব্য কর্কশ স্বর ইহাদের নহে। সাধারণতঃ যে স্বরটি ইহাদের কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হয় ইংরেজ লেখকরা তার পরিভাষা করিয়াছেন—“কক্-লী”। পূর্ব্ববঙ্গের গ্রাম্য অঞ্চলে উহার পরিভাষা “কুটুম-আলি” অর্থাৎ কুটুম্ব আসিলি। তাই ইহাকে “কুটুম” পাখীও বলে। এই পাখী বাড়িতে আসিয়া ঘন ঘন ডাকিলে বাড়ীতে কুটুম্ব আসে এইরূপ প্রবাদ পূর্ব্ববঙ্গে প্রচলিত আছে। ইহার কণ্ঠস্বর একটু উচ্চগ্রামের হইলেও বর্ষাকালে তাহা বেশ মিষ্টতা প্রাপ্ত হয়।
গাছের শাখা হইতে শাখান্তরে উড়িয়াই ইহারা দিবসের বেশীর ভাগ সময় কাটায়। কীটভূক্ পাখী বলিয়া ভূমির উপরও মাঝে মাঝে আসিয়া বলে। কিন্তু ধরিত্রীপৃষ্ঠে ইহাদের গতিবিধি লালিত্যহীন। চড়াই, ঘুঘু প্রভৃতির ডিম ও বাচ্ছা চুরি করিয়া অনেক সময় ইহারা উদর পূরণ করে। আহার সন্ধন্ধে ইহারা বেশ উদার। পেটে ক্ষুধা থাকিলে আমিষ নিরামিষ বা সামগ্রীর বাছবিচার করে না। একবার এক ভদ্রলোক ইহাকে গোটা একটা বাদুড় উদরসাৎ করিতে দেখিয়াছিলেন।
কাককে যেমন ভারতবর্ষের সর্ব্বত্র দেখিতে পাওয়া যায়, হাঁড়িচাচাও তদ্রূপ আসমুদ্র হিমাচলের সকলস্থানে দৃষ্ট হয়।
শীতের অবসানে গাছের কচিপাতায় যখন সবুজ রং ধরে, ইহাদেরও তখন যৌবনউৎসব আরম্ভ হয়। ইহারা তখন জোড়া বাঁধিয়া বসন্ত উৎসব সমাধা করিয়া বংশরক্ষার কার্য্যে মন দেয়। ইহাদের আঁতুড় ঘর গাছের উপরেই নির্ম্মিত হয়। এজন্য ইহারা বড় বড় গাছের আগডালই পছন্দ করে। কলিকাতার সন্নিকটস্থ গ্রামগুলিতে ইহাকে আমি আমগাছেই অধিকাংশ নীড় বাঁধিতে দেখিয়াছি। তবে নীম, অশ্বথ, বাবলা ও শিরীষ গাছেও ইহাদের বাস পাওয়া যায়। পাখীগুলি দীর্ঘ লেজের জন্য আকারে বড় সুতরাং বাসাগুলিও বেশ বড়ই হয়। কাকেরই মত ইহাদেরও বাসারচনার কোনও পারিপাট্য নাই। ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় যে ছোট ছোট পাখীরাই সাধারণতঃ বাসারচনায় নৈপুণ্য ও কারু-কৌশল প্রকাশ করে। কাক, হাঁড়িচাচা প্রভৃতি বুদ্ধিজীবী পাখীরা কোনও প্রকার শিল্পজ্ঞানের পরিচয় দেয় না। হাঁড়িচাচার বাসার ভিত হয় সরু সরু ডালপালা দিয়া এবং তজ্জন্য কাঁটাগাছের ডালই ইহারা অধিক ব্যবহার করে। বাসার অভ্যন্তরে ঘাসের গদি করিয়া তদুপরি ডিম রক্ষা করে।
ইহাদের ডিমগুলি দেখিতে একরকমের হয় না। প্রায় পাখীদেরই ডিমের বর্ণে নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে, যে কারণে ডিম দেখিয়া কোন পাখীর তাহা আমরা বলিতে পারি। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন হাঁড়িচাচার ভিন্ন ভিন্ন রকমের—সাদা, ধূসর, ফিকে গোলাপী, সবুজ প্রভৃতি ডিম পাওয়া গিয়াছে। পক্ষিতত্ত্ববিৎ সুধীগণ এখনও এইরূপ পার্থক্যের কোনও কারণ নির্দেশ করিতে পারেন নাই। বৈশাখ হইতে আষাঢ়ের মধ্যভাগ পর্য্যন্ত ইহাদের প্রজননকাল। ছোট বাচ্চাগুলি দেহে পালক গজাইবার সঙ্গে সঙ্গেই বাপ মায়ের বর্ণ প্রাপ্ত হয়। সব পাখীদের ক্ষেত্রে তাহা হয় না, পূর্ণবয়স্ক পাখীর দেহবর্ণ পাইতে একটু দেরী লাগে। ইহাদের শাবকগুলিও অত্যন্ত পেটুক হয় এবং খাবারের জন্য অহরহ চিৎকার করে। পক্ষিতত্ত্ববিৎ শ্রীযুক্ত সত্যচরণ লাহা মহাশয় একবার আগরপাড়ায় এক হাঁড়িচাচার বাসা হইতে দুইটি শাবক অপহরণ করিয়া আনিয়া খাঁচায় পূরিয়া রাখেন। তাহার ভৃত্য অবশ্য নিয়মমত ঘড়ির কাঁটা ধরিয়া ইহাদের খাওয়াইত। কিন্তু মানুষ দেখিলেই ইহারা এরূপ তারস্বরে চিৎকার ও সশব্দ অনুনয় করিত যে ইহাদিগের মুখে কিছু না দিয়া খাঁচার পাশ দিয়া হাঁটা যাইত না। বাগানের মধ্যে ইহারা যে ভাবে গলাবাজী করিতে করিতে ডানা ঝাপটাইয়া পিতামাতার অনুসরণ করে ও খাদ্যের জন্য অনুনয় জানায়, তাহা দেখিবার মত। আশ্চর্য্য, ইহাদের পিতামাতার কখনও ধৈর্য্যচ্যুতি হয় না। সারা বর্ষাকালটা ইহারা এইরূপ করিয়া পিতামাতার পিছনে পিছনে ফেরে। বর্ষাকালে পোকা মাকড়ের অভাব হয় না, সুতরাং ইহাদের বাপমাও আব্দার সহ্য করিয়া আহার জোগায়। কিন্তু শরতের আগমনে পাখীদের গৃহস্থালী ভাঙ্গিবার সময় হয়। পশুদের মধ্যে অপত্যস্নেহ খুব স্বল্পকালস্থায়ী। যতক্ষণ উহা বর্ত্তমান থাকে, ততক্ষণ উহা অত্যন্ত প্রবল। সন্তান বিপন্ন ভাবিলে পিতামাতা নিজ জীবন তুচ্ছ করিয়া আততায়ীকে যুদ্ধ প্রদান করে। কিন্তু সন্তান যখন বড় হয়, আত্মরক্ষা করিতে সক্ষম হয় এবং স্বয়ং আহার্য্য সংগ্রহ করিতে শেখে, তখন বাপমা ইহাদের জন্য আর কোনও চিন্তা করে না—বরং অনেক সময় নিজেদের ডেরা বা আড্ডার নিকট আসিলে বিতাড়িত করে। হাঁড়িচাচার মধ্যেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নাই।