বাঙ্গালার ইতিহাস (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)/পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়।
ভারতবর্ষীয় কর্ম্মকারকদিগের কুব্যবহার নিমিত্ত যে সকল বিশৃঙ্খলা ঘটে এবং মীরকাসিম ও উজীরের সহিত যে যুদ্ধ ও পাটনায় যে হত্যা হয়, এই সকল ব্যাপার অবগত করিয়া, ডিরেক্টরেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন। তাঁহারা এই ভয় করিতে লাগিলেন যে পাছে এই নবোপার্জ্জিত রাজ্য হস্তবহির্ভূত হয়; এবং ইহাও বিবেচনা করিলেন যে ব্যক্তির বুদ্ধিকৌশলে ও পরাক্রমপ্রভাবে রাজ্যাধিকার লব্ধ হইয়াছে, তিনি ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তিই এক্ষণে তাহা রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না। অতএব তাঁহারা ক্লাইবকে পুনরায় ভারতবর্ষে আসিতে অনুরোধ করিলেন।
তিনি ইংলণ্ডে পহুছিলে, ডিরেক্টরেরা তাঁহার সমুচিত পুরস্কার করেন নাই; বরং তাঁহার জায়গীর কাড়িয়া লইয়াছিলেন। তথাপি তিনি তাঁহাদের অনুরোধে পুনরায় ভারতবর্ষে আসিতে সম্মত হইলেন। ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে, কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করিয়া, বাঙ্গালার গবর্ণর ও প্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিলেন; এবং কহিয়া দিলেন ভারতবর্ষীয় কর্ম্মকারকদিগের নিজ নিজ বাণিজ্য দ্বারাই এত অনর্থ ঘটিতেছে; অতএব তাহা অবশ্য রহিত করিতে হইবেক। আট বৎসরের মধ্যে তাঁহাদের কর্ম্মকারকেরা উপর্য্যুপরি কয়েক নবাবকে সিংহাসনে বসাইয়া, দুই কোটির অধিক টাকা উপঢৌকন লইয়াছিলেন; অতএব তাঁহারা স্থির করিয়া দিলেন সেরূপ উপঢৌকন রহিত করিতে হইবেক। তাঁহারা আরো আজ্ঞা করিলেন কি রাজকীয় কি সেনাসম্পৰ্কীয় সমস্ত কর্ম্মকারকদিগকেই এক এক নিয়ম পত্রে স্বাক্ষর ও এই প্রতিজ্ঞা করিতে হইবেক,চারি হাজার টাকার অধিক উপঢৌকন পাইলে সরকারী ভাণ্ডারে জমা করিয়া দিব এবং গবর্ণরের অনুমতি ব্যতিরেকে হাজার টাকার অধিক উপহার লইব না।
ডিরেক্টরেরা এই সকল উপদেশ দিয়া ক্লাইবকে ভারতবর্ষে প্রেরণ করিলেন। তিনি, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের ৩রা মে, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলেন ডিরেক্টরেরা যে সকল আপদ্ আশঙ্কা করিয়া উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন সে সমস্ত অতিক্রান্ত হইয়াছে, কিন্তু গবর্ণমেণ্ট যৎপরোনাস্তি বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছে। অন্যের কথা দূরে থাকুক, কৌন্সিলের মেম্বরেরাও কোম্পানির মঙ্গল চেষ্টা করেন না। সমুদায় কর্ম্মকারকেরই এই অভিপ্রায়, যে কোন উপায়ে শীঘ্র শীঘ্র অর্থ সঞ্চয় করিয়া ত্বরায় ইংলণ্ড প্রতিগমন করিব। সকল বিষয়েই সম্পূর্ণরূপ অবিচার। আর এতদ্দেশীয় লোকদিগের উপর এত অত্যাচার হইতে আরম্ভ হইয়াছিল যে ইঙ্গরেজ এই শব্দ শুনিলেই তাঁহাদের মনে ঘৃণার উদয় হইত। ফলতঃ, তৎকালে গবর্ণমেণ্ট সংক্রান্ত ব্যক্তিদিগের ধর্ম্ম জ্ঞান ও ভদ্রতার লেশমাত্র ছিল না।
পূর্ব্ব বৎসর ডিরেক্টরেরা দৃঢ়রূপে আজ্ঞা করিয়াছিলেন তাঁহাদের কর্ম্মকারকেরা আর কোন রূপে উপঢৌকন লইতে পারিবেন না। এই আজ্ঞা উপস্থিত হইবার সময় বৃদ্ধ নবাব মীরজাফর মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। কৌন্সিলের মেম্বরের উক্ত আজ্ঞা কৌন্সিলের পুস্তকে নিবিষ্ট করেন নাই; বরং, মীরজাফরের মৃত্যুর পর, অন্য এক ব্যক্তিকে নবাব করিয়া তাঁহার নিকট অনেক উপহার গ্রহণ করেন। সেই পত্রে ডিরেক্টরেরা ইহাও আদেশ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কর্ম্মকারকদিগকে নিজ নিজ বাণিজ্য পরিত্যাগ করিতে হইবেক। কিন্তু এই স্পষ্ট আজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়া কৌন্সিলের সাহেবেরা নূতন নবাবের সহিত বন্দোবস্ত করেন যে ইঙ্গরেজেরা পূর্ব্ববৎ বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিতে পাইবেন।
ক্লাইব, উপস্থিতির অব্যবহিত পরেই, ডিরেক্টরদিগের আজ্ঞা সকল প্রচলিত করিতে ইচ্ছা করিলেন। কৌনসিলের মেম্বরেরা বানসিটার্ট সাহেবের সহিত যেরূপ বিবাদ করিতেন তাঁহারও সহিত সেই রূপ করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু ক্লাইব অন্যবিধ পদার্থে নির্ম্মিত। তিনি জিদ করিতে লাগিলেন যে, সকল ব্যক্তিকেই,আর উপটৌকন লইব না বলিয়া, নিয়ম পত্রে স্বাক্ষর করিতে হইবেক। যাঁহারা অস্বীকার করিলেন তিনি তাঁহাদিগকে তৎক্ষণাৎ পদচ্যুত করিলেন। তদ্দর্শনে কেহ কেহ স্বাক্ষর করিলেন। আর যাঁহারা অপর্য্যাপ্ত অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন তাঁহারা গৃহ প্রস্থান করিলেন। কিন্তু সকলেই নির্ব্বিশেষে ক্লাইবের শক্র হইয়া উঠিলেন।
সমুদায় রাজস্ব যুদ্ধ ব্যয়েই পর্য্যবসিত হইতেছে, অতএব সন্ধি করা অতি আবশ্যক; ইহা বিবেচনা করিয়া ক্লাইব, জুন মাসের চতুর্ব্বিংশ দিবসে, পশ্চিমাঞ্চল যাত্রা করিলেন। নজমউদ্দৌলার সহিত এইরূপ সন্ধি হইল যে ইঙ্গরেজেরা রাজ্যের সমস্ত বন্দোবস্ত করিবেন, আর তিনি, আপন ব্যয় নির্ব্বাহের নিমিত্ত, প্রতি বৎসর পঞ্চাশ লক্ষমাত্র টাকা পাইবেন; মহমদ রেজাখাঁ, রাজা দুর্লভরাম ও জগৎ শেঠ এই তিন জনের মতানুসারে ঐ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ব্যয়িত হইবেক। কিছু দিন পরেই অযোধ্যার নবাবের সহিত ও সন্ধি হইল।
এই যাত্রায় যে সকল কার্য্য নিষ্পত্তি হয়, দিল্লীর সম্রাটের নিকট হইতে কোম্পানির নামে তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্তি সেই সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর। পূর্ব্বে লিখিত হইয়াছে, সম্রাট্ অঙ্গীকার করিয়াছিলেন ইঙ্গরেজেরা যখন প্রার্থনা করিবেন তখনি তিনি তাঁহাদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানী দিবেন। অতএব ক্লাইব, এলাহবাদে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, এই প্রতিজ্ঞা পরিপুরণার্থে প্রার্থনা করিলেন। তিনিও তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। ১২ই আগষ্ট, সম্রাট্ কোম্পানি বাহাদুরকে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী প্রদান করিলেন; এবং ক্লাইব স্বীকার করিলেন উৎপন্ন রাজস্ব হইতে সম্রাটকে প্রতি মাসে দুই লক্ষ টাকা দিবেন।
এই স্থলে ইহা উল্লেখ করা উপযুক্ত বোধ হইতেছে যে সম্রাট্ তৎকালে আপন রাজ্যে পলাতক স্বরূপ ছিলেন; সুতরাং তাঁহার রাজকীয় কোন পরিচ্ছদাদি ছিল না। তন্নিমিত্তে ইঙ্গরেজদিগের খানা খাইবার দুই মেজ একত্রিত ও কার্ম্মিক বস্ত্রে মণ্ডিত করিয়া সিংহাসন প্রস্তুত করা গেল। সমস্ত ভারতবর্ষের সম্রাট তদুপরি উপবিষ্ট হইয়া বার্ষিক দুই কোটি টাকার রাজস্ব সহিত তিন কোটি প্রজা ইঙ্গরেজদিগের হস্তে সমর্পণ করিলেন। তৎকালীন মুসলমান ইতিহাসলেখক এই বিষয়ে ইঙ্গিত করিয়াছেন যে সময়ান্তরে এরূপ গুরুতর ব্যাপার নির্ব্বাহ বিষয়ে কত কত নীতিজ্ঞ মন্ত্রী ও কার্য্যদক্ষ দূত প্রেরণ ও কত কত বাদানুবাদের আবশ্যকতা হইত। কিন্তু এক্ষণে ইহা এত অল্প সময়ে সম্পন্ন হইল যে এক পাল পশু অথবা একটা গর্দভ বিক্রয়ও ঐ সময় মধ্যে সম্পন্ন হইয়া উঠে না। পলাশির যুদ্ধের পর ইঙ্গরেজদিগের পক্ষে যে সকল হিতজনক ব্যাপার ঘটে, এই বিষয় সেই সকল অপেক্ষা গুরুতর। ইঙ্গরেজের ঐ যুদ্ধ দ্বারা বাস্তবিক এতদ্দেশের প্রভু হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু এতদ্দেশীয় লোকের এপর্যন্ত তাঁহাদিগকে কেবল জেতৃস্বরূপ গণনা করিতেন; এক্ষণে, সম্রাটের এই দান দ্বারা, তিন প্রদেশের যথার্থ অধিকারী ৰোধ করিলেন। তদবধি মুরশিদাবাদের নবাব সাক্ষিগোপাল হইলেন। ক্লাইব এই সকল ব্যাপার সমাধান করিয়া, ৭ই সেপ্টম্বর, কলিকাতা প্রত্যাগমন করিলেন।
কোম্পানির কর্ম্মকারকেরা যে নিজ নিজ বাণিজ্য করিতেন, তাহাতেই যৎপরোনাস্তি অত্যাচার ঘটিত। অতএব ডিরেক্টরেরা বারম্বার এই আদেশ করেন যে ইহা একবারেই রহিত হয়। কিন্তু তাঁহাদের কর্ম্মকারকেরা ঐ সকল হুকুম এপর্যন্ত গোলমাল করিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের অন্তিম আদেশ কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট ছিল; এবং ক্লাইবও বিবেচনা করিলেন যে সিবিল সরবেণ্টদিগের বেতন অত্যন্ত অল্প; সুতরাং তাহারা অবশ্যই গৰ্হিত উপায় দ্বারা পোষাইয়া লইবেক। অতএব তিনি তাহাদের বাণিজ্য, একবারে রহিত না করিয়া, ভদ্র রীতিক্রমে চালাইবার মনস্থ করিলেন।
অনন্তর ক্লাইৰ লবণ, গুবাক, তবাক, এই তিন বস্তুর বাণিজ্য ভদ্র রীতিক্রমে চালাইবার নিমিত্ত এক সভা স্থাপন করিলেন। নিয়ম হইল, শীত করা ৩৫ টাকার হিসাবে কোম্পানির ধনাগারে মাশুল জমা করা যাইবেক; এবং যে উপস্বত্ব হইবেক রাজকীয় ও সেনা সম্পর্কীয় সমুদায় কর্ম্মকারকেরা তাহা অংশ করিয়া লইবেন। কৌন্সিলের মেম্বরেরা অধিক অংশ পাইবেন এবং তাঁহাদিগের নীচের কর্ম্মকারকেরা অপেক্ষাকৃত ন্যুন পরিমাণে প্রাপ্ত হইবেন।
ডিরেক্টরদিগের নিকট এই বাণিজ্য প্রণালীর সংবাদ পাঠাইবার সময়, ক্লাইৰ তাঁহাদিগকে গবর্ণরের বেতন বাড়াইয়া দিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়াছিলেন; কারণ, তাহা হইলে তাঁহার এই বাণিজ্য বিষয়ে কোন সংস্রব রাথিবার আবশ্যকতা থাকিবেক না। কিন্তু তাঁহার তৎপরে পঞ্চদশ বৎসর পর্যন্ত এই সৎপরামর্শ গ্রাহ্য করেন নাই। তাঁহারা উক্ত নূতন সভা স্থাপনের সংবাদ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র রূঢ় বাক্যে তাহা অস্বীকার করিলেন; ক্লাইব এই সভা স্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার যথোচিত তিরস্কার লিখিলেন; এবং এই আদেশ পাঠাইলেন যে উক্ত সভা রহিত করিতে হইবেক ও কোন সরকারী কর্ম্মকারক বাঙ্গালার বাণিজ্যে লিপ্ত থাকিতে পারিবেক না।
এ কাল পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের সমুদায় রাজস্ব কেবল রাজকার্য্য নির্ব্বাহের ব্যয়েই পর্য্যবসিত হইতেছিল। কোম্পানির শুনিতে অনেক আয় ছিল বটে; কিন্তু তাঁহারা সর্ব্বদাই ঋণগ্রস্ত ছিলেন। কি ইউরোপীয় কি এতদ্দেশীয়, সমুদয় কর্ম্মকারকেরাই কেবল লুঠ করিত; কিছুই দয়া ভাবিত না। ইংলণ্ডে ক্লাইবকে জিজ্ঞাসা করা গিয়াছিল যে কোম্পানির এত আয় থাকিতেও চিরকাল এত অপ্রতুল কেন। তাহাতে তিনি এই উত্তর দেন যে কোন ব্যক্তিকে কোম্পানি বাহাদুরের নামে এক বার বিল করিতে দিলেই সে তাহাতে বিষয় করিয়া লয়।
কিন্তু ব্যয়ের প্রধান কারণ সৈন্য। সৈন্য সকল যাবৎ নবাবের হইয়া যুদ্ধ করিত, তিনি তত দিন তাহাদিগকে ভাতা দিতেন। এই ভাতাকে ডবলবার্টা কহা যাইত। এই পারিতোষিক তাহারা এত অধিক দিন পর্য্যন্ত পাইয়া আসিয়াছিল যে পরিশেষে তাহা আপনাদিগের ন্যায্য প্রাপ্য বোধ করিত। ক্লাইব দেখিলেন যে সৈন্যের ব্যয় লাঘব করিতে না পারিলে কখনই রাজস্ব বাঁচিতে পারে না। তিনি ইহাও জানিতেন যে ব্যয় লাঘবের যে কোন প্রণালী করিব তাহাতেই আপত্তি উত্থাপিত হইবেক। কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন; অতএব একবারেই এই আজ্ঞা প্রকাশ করিলেন যে অদ্যাবধি ডবলবাটা রহিত হইল।
এই ব্যাপার শ্রবণ করিয়া সেনাসম্পৰ্কীয় কর্ম্মকারকেরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহারা কহিলেন আমাদের অস্ত্রবলে দেশ জয় হইয়াছে; অতএব তদ্দ্বারা আমাদের উপকার হওয়া সর্ব্বাগ্রে উচিত। কিন্তু ক্লাইবের মন বিচলিত হইবার নহে। তিনি তাঁহাদিগকে কিছু কিছু দিতে ইচ্ছুক ছিলেন; কিন্তু ইহাও স্থির করিয়াছিলেন সৈন্যের ব্যয় লাঘব করা অত্যন্ত আবশ্যক। সেনাপতিরা ক্লাইবকে আপনাদিগের অভিপ্রায়ানুসারে কর্ম্ম করাইবার নিমিত্ত চক্রান্ত করিলেন। তাঁহারা পরস্পর গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন সকলেই এক দিনে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিব।
প্রথম ব্রিগেডের সেনাপতিরা এইরূপে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিবামাত্র, ক্লাইব তাহার সংবাদ পাইয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন; এবং সন্দেহ করিতে লাগিলেন হয় ত সমুদায় সৈন্য মধ্যেই এইরূপ চক্রান্ত হইয়াছে। তিনি অনেক বার অনেক আপদে পড়িয়াছিলেন; কিন্তু এমন দায়ে কখন ঠেকেন নাই। এ দিকে মহারাষ্ট্ৰীয়েরা পুনর্ব্বার বাঙ্গালা দেশ আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন, এ দিকে ইঙ্গরেজদিগের.সেনা অধ্যক্ষহীনা হইল। কিন্তু ক্লাইব, তাহাতেও চলচিত্ত না হইয়া, আপন স্বভাবসিদ্ধ সাহস সহকারে কার্য্য করিতে লাগিলেন। তিনি মাদ্রাজ হইতে সেনাপতি আনয়নের আজ্ঞা প্রদান করিলেন। বাঙ্গালার যে যে সেনাপতি স্পষ্ট বিদ্রোহী হয়েন নাই তাঁহারা ক্ষান্ত হইলেন। ক্লাইব প্রধান প্রধান বিদ্রোহিদিগকে পদচ্যুত করিয়া ইংলণ্ড পাঠাইয়া দিলেন। এবম্বিধ কাঠিন্য দ্বারা পুনর্ব্বার সৈন্যদিগকে বশীভূত করিয়া আনিলেন; এবং গবর্ণমেণ্টকেও এই অভূতপূর্ব্ব ঘোরতর আপদ হইতে মুক্ত করিলেন।
ক্লাইব ভারতবর্ষে আসিয়া বিংশতি মাসে কোম্পানির কার্য্যের সুশৃঙ্খলা স্থাপন ও ব্যয়ের লাঘব করিলেন তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্তি দ্বারা রাজস্ব বৃদ্ধি করিয়া প্রায় দুই কোটি টাকা বার্ষিক আয় স্থিত করিলেন, এবং সৈন্যের মধ্যে ষে ঘোরতর বিদ্রোহ উপস্থিত হয় তাহার শান্তি করিয়া বিলক্ষণ রূপে সুরীতি স্থাপন করিলেন। তিনি এই সমস্ত গুরুতর পরিশ্রম দ্বারা শারীরিক এরূপ ক্লিষ্ট হইলেন যে স্বদেশে প্রস্থান না করিলে চলে না। অতএব ১৭৬৭ খৃঃ অব্দের ফেব্রুয়ারিতে জাহাজে আরোহণ করিলেন।
ইঙ্গরেজেরা দেওয়ানী প্রাপ্ত হইয়াছিলেন বটে অর্থাৎ সম্রাট্ তাঁহাদিগকে বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার সমুদায় রাজস্ব দান করিয়াছিলেন; কিন্তু এতদ্দেশীয় রাজস্ব সংক্রান্ত কার্য্য নির্ব্বাহবিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ ছিলেন। কোম্পানির ইউরোপীয় কর্ম্মকরের এপর্য্যন্ত কেৰল বাণিজ্য ব্যাপারেই ব্যাপৃত ছিলেন, ভূমির কর সংগ্রহ বিষয়ে কিছুই অবগত ছিলেন না।
পূর্ব্ব পুর্ব্ব সুবাদারেরা, হিন্দুদিগকে অভ্যন্ত সহিষ্ণু স্বভাব ও হিসাবে নিপুণ দেখিয়া,এই সকল বিষয়ের ভার তাঁহাদের হস্তে অৰ্পণ করিতেন। ইঙ্গরেজের এই জয়লন্ধ দেশের তাবৎ বিষয়েই অজ্ঞ ছিলেন, সুতরাং তাঁহাদিগকেও সমস্ত ব্যাপারই পুর্ব্ব রীতি অনুসারে প্রচলিত রাখিতে হইল। রাজা সিতাব রায়,বিহারের দেওয়ানের কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, পাটনায় অবস্থিতি করিলেন; আর মহমদ রেজা খাঁ, বাঙ্গালার দেওয়ান হইয়া, মুরশিদাবাদে রহিলেন। প্রায় সাত বৎসর এইরূপে রাজ্যশাসন হইল। পরে, ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, ইঙ্গরেজের স্বয়ং সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে আরম্ভ করিলেন।
এই কয়েক বৎসর, রাজ্যশাসনের কোন প্রণালী বা শৃঙ্খল ছিল না। জমীদার ও প্রজাবৰ্গ, কাহাকে প্রভু ৰলিয়া মান্য করিবেক, তাহার কিছুই জানিত না। সমুদায় রাজকার্য্য নির্ব্বাহের ভার নবাব ও তদীয় অমাত্যবর্গের হস্তে ছিল। কিন্তু ইঙ্গরেজের এ দেশের সর্ব্বত্র এমত প্রবল হইয়াছিলেন যে, তাঁহারা যৎপরোনাস্তি অত্যাচার করিলেও, ব্লাজপুরুষের তাঁহাদের শাসন করিভে পারিতেন না। আর পার্লিমেণ্টের বিধানানুসারে কলিকাতার গবর্ণর সাহেবেরও এমত ক্ষমতা ছিল না যে মহারাষ্ট্র খাতের বহির্ভাগে কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করিলে তাহার দণ্ড বিধান করিতে পারেন। ফলতঃ, ইঙ্গরেজদিগের দেওয়ানী প্রাপ্তির পর সাত বৎসর, সমস্ত দেশে যেরূপ ক্লেশ ও গোলযোগ ঘটিয়াছিল তাহার ইয়ত্তা করা যায় না।
এইরূপে কয়েক বৎসর রাজ্যশাসন বিষয়ে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে, ডাকাইতেরা অত্যন্ত সাহসিক হইয়াছিল। সকল জিলাই ডাকাইতের দলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল; তাহাতে কোন ধনবান্ ব্যক্তি নিরাপদে ছিলেন না। ফলতঃ ডাকাইতীর এত বাড়াবাড়ি হইয়াছিল, ষে ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, যখন কোম্পানি বাহাদুর আপন হস্তে রাজ্যশাসনের ভার লইলেন, তখন তাঁহাদিগকে, ডাকাইতীর দমনের নিমিত্ত,অতি কঠিন কঠিন আইন জারী করিতে হইয়াছিল। তাঁহারা এরূপ আজ্ঞা করিয়াছিলেন যে ডাকাইতকে তাহার নিজগ্রামে লইয়া গিয়া ফাঁশী দেওয়া যাইবেক; তাহার পরিবার চিরকালের নিমিত্ত রাজকীয় দাস হইবেক; এবং সেই গ্রামের সমুদায় লোককে শক্তি অনুসারে দগু দিতে হইবেক।
এই অরাজক সময়েতেই অধিকাংশ ভূমি নিষ্কর হয়। সম্রাট্ বাঙ্গালার সমুদায় রাজস্ব ইঙ্গরেজদিগকে নির্দ্ধারিত করিয়া দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা কলিকাতায় আদায় না হইয়া মুরশিদাবাদে আদায় হইত। মালের কাছারিও সেই স্থানেই ছিল। মহমদ রেজা খাঁ, রাজা দুর্ল্লভরাম ও রাজা কান্তসিংহ এই তিন ব্যক্তি বাঙ্গালার রাজস্বসম্পৰ্কীয় সমুদায় কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। তাঁহারাই সমুদায় বন্দোবস্ত করিতেন এবং রাজস্ব আদায় করিয়া কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতেন। তৎকালে জমীদারেরা কেবল প্রধান করসংগ্রাহক ছিলেন। তাঁহারা, পুর্ব্বোক্ত তিন মহাত্মার ইচ্ছাকৃত অনবধানবলে, ইঙ্গরেজদিগের চক্ষুঃ ফুটিবার পূর্ব্বে, প্রায় চল্লিশ লক্ষ বিঘা সরকারী ভূমি ব্রাহ্মণদিগকে নিষ্কর দান করিয়া, গবর্ণমেণ্টের বার্ষিক প্রায় ত্রিশ চল্লিশ লক্ষ টাকা ক্ষতি করেন।
লার্ড ক্লাইবের প্রস্থানের পর বেরিলষ্ট সাহেব ১৭৬৭ খৃঃ অব্দে বাঙ্গালার গবর্ণর হইলেন। পর বৎসর ডিরেক্টরেরা, সরকারী কর্ম্মকারকদিগের লবণ ও অন্যান্য বস্তু বিষয়ক বাণিজ্য রহিত করিবার নিমিত্ত, চূড়ান্ত হুকুম পাঠাইলেন। তাঁহারা এইরূপ আদেশ করিয়াছিলেন যে দেশীয় বাণিজ্য কেবল দেশীয় লোকেরাই করিবেক, কোন ইউরোপীয় তাহাতে লিপ্ত থাকিতে পারিবেক না। কিন্তু ইউরোপীয় কর্ম্মকারকদিগের বেতন অত্যন্ত অল্প ছিল; এ জন্য তাঁহারা ইহাও আদেশ করিয়াছিলেন যে বেতন ব্যতিরিক্ত সরকারী খাজানা হইতে শতকরা আড়াই টাকার হিসাবে দেওয়া যাইবেক সেই টাকা সমুদায় সিবিল ও মিলিটারি কর্ম্মকারকেরা যথাযোগ্য অংশ করিয়া লইবেন।
ক্লাইবের প্রস্থানের পর, কোম্পানির কার্য্য সকল পুনর্ব্বার বিশৃঙ্খল হইতে লাগিল। ভারতবর্ষে আয় অনেক ছিল বটে, কিন্তু ব্যয় তদপেক্ষায় অধিক হইতে লাগিল। ধনাগারে দিনে দিনে বিষম অনাটন হইতে লাগিল। কলিকাতার গবর্ণর, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দের অক্টোবরে, হিসাব পরিষ্কার করিয়া দেখিলেন অনেক দেনা হইয়াছে,এবং আরও দেন না করিলে চলে না। তৎকালে টাকা সংগ্রহ করিবার এই রীতি ছিল। কোম্পানির ইউরোপীয় কর্ম্মকারকেরা যে অর্থ সঞ্চয় করিতেন, গবর্ণর সাহেব, কলিকাতার ধনাগারে তাহা জমা করিয়া লইয়া, লণ্ডন নগরে ডিরেক্টরদিগের উপর সেই টাকার বরাত পাঠাইতেন। ভারতবর্ষ হইতে যে সকল পণ্যদ্রব্য প্রেরিত হইত, তাহা বিক্রয় করিয়া অর্থ সংগ্রহ ব্যতিরেকে, ডিরেক্টরদিগের ঐ হুণ্ডীর টাকা দিবার অন্য কোন উপায় ছিল না। কলিকাতার গবর্ণর যথেষ্ট ধার করিতে লাগিলেন কিন্তু পুর্ব্বাপেক্ষায় ন্যুন পরিমাণে পণ্যদ্রব্য পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন। সুতরাং ঐ সকল হুণ্ডীর টাকা দেওয়া ডিরেক্টরদিগের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিল। এজন্য তাঁহারা কলিকাতার গবর্ণরকে এই আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন যে,আর এইরূপ হুণ্ডী না পাঠাইয়া, এক ৰৎসর কলিকাতাতেই টাকা ধার করিয়া কার্য্য সম্পন্ন কর।
ইহাতে এই ফল হইল, ষে সরকারী কর্ম্মকারকেরা ফরাসি, ওলন্দাজ ও দিনামারদিগের দ্বারা আপন আপন উপার্জ্জিত অর্থ ইউরোপে পাঠাইতে লাগিলেন, অর্থাৎ চন্দন নগর, চুঁচুড়া ও স্ত্রীরামপুরের ধনাগারে টাকা জমা করিয়া দিয়া, বিলাতের অন্যান্য কোম্পানির নামে হুগুী লইতে আরম্ভ করিলেন। উক্ত সওদাগরের ঐ সকল টাকায় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করিয়া ইউরোপে পাঠাইতেন, এবং হুগুীর মিয়াদ মধ্যেই ঐ সমস্ত বস্তু তথায় পহুছিত ও বিক্রয় হইত। এই উপায় দ্বারা ভারতবর্ষবাসি অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদিগের, টাকার অসঙ্গতি নিমিত্ত, কোন ক্লেশ ছিল না। কিন্তু ইঙ্গরেজ কোম্পানি যৎপরোনাস্তি ক্লেশে পড়িলেন। ডিরেক্টরেরা নিষেধ করিলেও, কলিকাতার গবর্ণর অগত্যা পুনর্ব্বার পুর্ব্ববৎ ঋণ করিয়া, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দে ইংলণ্ডে হুগুী পাঠাইলেন; তাহাতে লণ্ডন নগরে কোম্পানির কার্য্য একবারে উচ্ছিন্ন হইবার সম্ভাবনা হইয়া উঠিল।
নজমউদ্দৌলা ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে নবাব হইয়াছিলেন। পর বৎসর তাঁহার মৃত্যু হইলে, সৈফউদ্দৌলা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন। ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, বসন্ত রোগে তাঁহার প্রাণান্ত হইলে তদীয় ভ্রাতা মোবারিকউদ্দৌলা তৎপদের অধিকারী হইলেন। তাঁহার পুর্ব্বাধিকারিরা, আপন আপন ব্যয়ের নিমিত্ত, যত টাকা পাইতেন, কলিকাতার কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকেও তাহাই দিতে লাগিলেন। কিন্তু ডিরেক্টরেরা প্রতি বৎসর তাঁহাকে তত না দিয়া ১৬ লক্ষ টাকা দিবার আদেশ করিলেন। ১৭৭০ অব্দে, ঘোরতর দুর্ভিক্ষ হওয়াতে, দেশ শূন্য হইয়া গিয়াছিল। উক্ত দুর্ঘটনার সময় দরিদ্র লোকেরা যে কি পর্য্যন্ত ক্লেশ ভোগ করিয়াছিল তাহা বর্ণন করা যায় না। এই মাত্র কহিলেই এক প্রকার বোধগম্য হইতে পরিবেক যে ঐ ছুর্ভিক্ষে দেশের প্রায় তৃতীয়াংশ লোক কালগ্রাসে পতিত হয়। ঐ বৎসরেই ডিরেক্টরেরা মুরশিদাবাদে ও পাটনায় কৌন্সিল অব রেবিনিউ স্থাপন করিতে আদেশ প্রদান করেন। তাঁহাদিগের এই কর্ম্ম নিৰ্দ্ধারিত হইয়ছিল যে তাঁহারা রাজস্ব বিষয়ক তত্ত্বানুসন্ধান ও দাখিলা পরীক্ষা করিবেন। কিন্তু রাজস্বের কর্ম্মনির্ব্বাহ এখন পর্য্যন্তও দেশীয় লোকদিগের হস্তেই রহিল। মহমদ রেজা খাঁ মুরশিদাবাদে, ও রাজা সিতাব রায় পাটনায়, থাকিয়া পুর্ব্ববৎ কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। ভূমিসম্পৰ্কীয় সমুদায় কাগজ পত্রে তাঁহাদেরই সহী মোহর চলিত।
শ্রীযুত বেরিলষ্ট সাহেব, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দে, গবর্ণরী পদ পরিত্যাগ করাতে, কার্টিয়র সাহেব তৎপদে অধিরূঢ় হইলেন। কিন্তু, কলিকাতার গবর্ণমেণ্টের অকর্ম্মণ্যতা প্রযুক্ত, কোম্পানির কার্য্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ও উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়া উঠিল। অতএব ডিরেক্টর সাহেবেরা, সমুদায় কুরীতি সংশোধন ও ব্যয় লাঘব করিবার নিমিত্ত, কলিকাতার পুর্ব্ব গবর্ণর বান্সিটার্ট, স্ক্রাফটন, কর্ণেল ফোর্ড এই তিন জনকে ভারতবর্ষে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু তাঁহারা যে জাহাজে আরোহণ করিয়াছিলেন, কেপ উর্ত্তীর্ণ হইবার পর, আর তাহার কোন উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই। সকলে অনুমান করেন ঐ জাহাজ সমুদায় লোক সহিত সমুদ্রে মগ্ন হইয়াছে।