বাঙ্গালার ইতিহাস (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)/ষষ্ঠ অধ্যায়
ষষ্ঠ অধ্যায়।
কার্র্টিয়র সাহেব, ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, গবর্ণরী পরিত্যাগ করিলে, শ্রীযুত ওয়ারন হেস্টিংস সাহেব তৎপদে অধিরূঢ় হইলেন। হেষ্টিংস, ১৭৪৯ খৃঃ অব্দে, রাজকীয় কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, আঠার বৎসর বয়ঃক্রম কালে এতদ্দেশীয় আগমন করেন; এবং গুরুতর পরিশ্রম সহকারে এতদ্দেশীয় ভাষা ও রাজনীতি শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। ১৭৫৭ খৃঃ অব্দে, ক্লাইব তাঁহাকে মুরশিদাবাদের রেসিডেণ্টের কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তৎকালে গবর্ণরের পদ ভিন্ন এতদপেক্ষায় মান্য কর্ম্ম আর ছিল না। যখন বান্সিটার্ট সাহেব কলিকাতার প্রধান পদ প্রাপ্ত হয়েন তখন কেবল হেষ্টিংস সাহেবই তাঁহার বিশ্বাসপাত্র ছিলেন। ১৭৬১ খৃঃ অব্দের ডিসেম্বর মাসে,হেষ্টিংস কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বর হন। তৎকালে অন্য সকল মেম্বরেরাই বানসিটার্ট সাহেবের প্রতিপক্ষ ছিলেন কেবল তিনিই একাকী তাঁহার পোষকতা করিতেন। ১৭৭০ খৃঃ অব্দে ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে মাদ্রাজ কৌন্সিলের দ্বিতীয় পদে অভিষিক্ত করেন। তিনি তথায় নানা সুনিয়ম প্রচলিত করেন; তাহাতে ডিরেক্টরেরা তাঁহার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। পরে, কলিকাভার গবর্ণরের পদ শূন্য হইলে, তাঁহারা তাঁহাকে সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া তৎপদে অভিষিক্ত করিলেন। তৎকালে তাঁহার চল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রম হইয়াছিল।
দেশীয় লোকেরা যে রাজস্ব সংক্রান্ত সমুদায় বন্দোবস্ত করেন ইহাতে ডিরেক্টরেরা অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন। তাঁহারা দেখিলেন আয় ক্রমেই অল্প হইতেছে। অতএব, দেওয়ানী প্রাপ্তির সাত বৎসর পরে, তাঁহারা যথার্থ দেওয়ান হইতে, অর্থাৎ রাজস্বের বন্দোবস্তের ভার আপনাদের হস্তে লইয়া ইউরোপীয় কর্ম্মকারক দ্বারা কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে, মনস্থ করিলেন। এই নূতন নিয়ম হেষ্টিংস সাহেবকে অসিয়াই প্রচলিত করিতে হইল। তিনি ১৩ ই এপ্রিল গবর্ণরের পদ গ্রহণ করিলেন। ১৪ই মে, কৌন্সিলের সম্মতি ক্রমে এই ঘোষণা প্রচার হইল যে ইঙ্গরেজেরা স্বয়ং রাজস্বের কার্য নির্ব্বাহ করিবেন; যে সকল ইউরোপীয় কর্ম্মকারকেরা রাজস্বের কর্ম্ম করিবেন, তাঁহাদের নাম কালেক্টর হইবেক; কিছু কালের নিমিত্ত, সমুদায় জমী ইজারা দেওয়া যাইবেক; আর কৌন্সিলের চারি জন মেম্বর সমুদায় প্রদেশে গিয়া সমস্ত বন্দোবস্ত করিবেন। ইঁহারা প্রথমেই কৃষ্ণনগরে ষাইয়া কার্য্যারম্ভ করিলেন। কিন্তু পূর্ব্বাধিকারিরা অত্যন্ত কম নিরিখে মালগুজারী দিতে চাহিবাতে, তাঁহারা সমুদায় জমী নীলাম ডাকাইতে লাগিলেন। যে জমীদার অথবা তালুকদার ন্যায্য মালগুজারী দিতে সন্মত হইলেন,তিনিই আপন বিষয় পুর্ব্ববৎ অধিকার করিতে লাগিলেন। আর যিনি অত্যন্ত কম দিতে চাহিলেন, তাঁহাকে পেন্সিয়ন দিয়া অধিকারচ্যুত করিয়া, তৎপরিবর্ত্তে অন্য ব্যক্তিকে অধিকার দেওয়াইলেন। গবর্ণর স্বচক্ষে সমুদায় দেখিতে পরিবেন, এই অভিপ্রায়ে মালের কাছারী মুরশিদাবাদ হইতে কলিকাতায় আনীত হইল।
এইরূপে রাজস্ব কর্ম্মের নিয়ম পরিবর্ত্ত হওয়াতে, দেশের দেওয়ানী ও ফৌজদারী কর্ম্মেরও নিয়ম পরিবর্ত্ত আবশ্যক হইল। প্রত্যেক প্রদেশে, এক ফৌজদারী এক দেওয়ানী, দুই দুই বিচারালয় সংস্থাপিত হইল। ফৌজদারী আদালতে কালেক্টর সাহেব, কাজী, ও মুকতী এই কয়েক জন একত্র হইয়া বিচার করিতেন। আৱ দেওয়ানী আদালতেও কালেক্টর সাহেব মোকদমা করিতেন, দেওয়ান ও অন্যান্য আমলারা তাঁহার সহকারিতা করিত। মোকদ্দমার আপীল শুনিবার নিমিত্ত কলিকাতায় দুই বিচারালয় স্থাপিত হইল। তন্মধ্যে যে স্থলে দেওয়ানী বিষয়ের বিচার হইত, তাহার নাম সদর দেওয়ানী আদালত; ও যে স্থানে ফৌজদারী, তাহার নাম সদর নিজামৎ আদালত রহিল।
এপর্য্যন্ত আদালতে যত টাকার মোকদ্দমা উপস্থিত হইত, জজ সাহেব তাহার চতুর্থাংশ লইতেন; এক্ষণে তাহা রহিত হইল; অধিক জরীমানা রহিত হইল; আর মহাজনদিগের, স্বেচ্ছাক্রমে খাদককে রুদ্ধ করিয়া টাকা আদায় করিবার, যে ক্ষমতা ছিল তাহা নিবারিত হইল; আর দশ টাকার অনধিক দেওয়ানী মোকদ্দমার নিষ্পত্তির ভার পরগনার প্রধান ভূম্যধিকারির হস্তে অপিত হইল। ইঙ্গরেজেরা, আপনাদিগের প্রণালী অনুসারে বাঙ্গালা শাসন করিবার নিমিত্ত, প্রথমে এই সকল নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত করিয়াছিলেন।
ডিরেক্টরেরা স্থির করিয়াছিলেন যে মহমদ রেজা খাঁর অসৎ ব্যবহারেই বাঙ্গালার রাজস্ব ক্ষতি হইতেছে। তাঁহার পদ প্রাপ্তি দিবসাবধি তাঁহারা তাঁহার চরিত্র বিষয়ে সন্দেহ করিতেন। আর তাঁহারা ইহাও বিস্মত হয়েন নাই, যে যখন তিনি, মীরজাফরের রাজত্ব সময়ে, ঢাকার চাকলায় নিযুক্ত ছিলেন তখন তথায় অনেক লক্ষ টাকা তহবীল ঘাটি হইয়াছিল। কেহ কেহ তাঁহার নামে এ অভিযোগও করিয়াছিল যে তিনি, ১৭৭০ খৃঃ অব্দের দারুণ অকালের সময়, সমধিক লাভপ্রত্যাশায় সমুদায় শস্য একচাটিয়া করিয়াছিলেন। আর সকলে সন্দেহ করিত, তিনি অনেক রাজস্ব ছাপাইয়া রাখিয়াছিলেন এবং প্রজাদিগকেও অধিক নিষ্পীড়ন করিয়াছিলেন।
যৎকালে তিনি মুরশিদাবাদে কর্ম্ম করিতেন, তখন বাঙ্গালায় তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। নায়েব সুবাদার ছিলেন, তদনুসারে রাজস্বের সমুদায় বন্দোবস্তের ভার তাঁহার হস্তে ছিল; আর নায়েব নাজিম ছিলেন, সুতরাং পুলিসেরও সমুদায় ভার তাঁহারই হস্তে ছিল। ডিরেক্টরেরা বুঝিতে পারিলেন, ষত দিন তাঁহার হস্তে এরূপ ক্ষমতা থাকিবেক, কোন ব্যক্তিই তাঁহার দোষ প্রকাশে অগ্রসর হইতে পরিবেক না। অতএব তাঁহারা এই আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন যে মহমদ রেজা খাঁকে কয়েদ করিয়া সপরিবারে কলিকাতায় আনিতে হইবেক, এবং তাঁহার সমুদায় কাগজ পত্র আটক করিতে হইবেক।
হেষ্টিংস সাহেব গবর্ণরের পদে অধিরূঢ় হইবার দশ দিবস পরেই, ডিরেক্টরদিগের এই আজ্ঞা তাঁহার নিকট পহুছে। যৎকালে ঐ আজ্ঞা পহুছিল তখন অধিক রাত্রি হইয়াছিল; এজন্য সে দিবস তদনুযায়ি কার্য্য করা হইল না। পর দিন প্রাতঃকালে তিনি, মহমদ রেজা থাঁকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, মুরশিদাবাদের রেসিডেণ্ট মিডিল্টন সাহেবকে পত্র লিখিলেন। তদনুসারে রেজা খাঁ সপরিবারে জলপথে কলিকাতায় প্রেরিত হইলেন। মিডিল্টন সাহেব তাঁহার কার্য্যের ভার গ্রহণ করিলেন। রেজা খাঁ চিৎপুরে উপস্থিত হইলে,তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে অকস্মাৎ এরূপ ব্যাপার ঘটিবার কারণ জানাইবার নিমিত্ত, এক জন কৌন্সিলের মেম্বর প্রেরিত হইলেন। আর হেষ্টিংস সাহেব এইরূপ পত্র লিখিলেন, আমি কোম্পানির ভৃত্য, আমাকে তাঁহাদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইয়াছে; নতুবা, আপনকার সহিত আমার যে রূপ প্রণয় আছে, তাহার কোন ক্রমে ব্যতিক্রম হইবেক না, জানিবেন।
বিহারের নায়েব দেওয়ান রাজা সিতাব রায়েরও চরিত্র বিষয়ে সেইরূপ সন্দেহ জন্মিয়ছিল; অতএব তিনিও কলিকাতায় আনীত হইলেন। তাঁহার পরীক্ষা অল্প দিনেই সমাপ্ত হইল, পরীক্ষায় তাঁহার কোন দোষ দৃষ্ট হইল না, অতএব তিনি মান পূর্ব্বক বিদায় পাইলেন। তৎকালীন মুসলমান ইতিহাসলেখক তাঁহার সরকারী কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ের প্রশংসা করিয়াছেন; কিন্তু ইহাও লিখিয়াছেন, প্রধান পদারূঢ় অন্যান্য লোকের ন্যায়, তিনিও অন্যায়াচরণ পুর্ব্বক প্রজাদিগের নিকট অধিক ধন গ্রহণ করিতেন।
তাঁহাকে অপরাধী বোধ করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করাতে তাঁহার যে অমর্য্যাদা হইয়াছিল, তাহার প্রতিবিধানার্থে কিছু পারিতোষিক দেওয়া উচিত বোধ হওয়াতে, কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকে এক মর্য্যাদা সুচক পরিচ্ছদ পুরস্কার দিলেন এবং বিহারের রায় রাইয়াঁ করিলেন। কিন্তু অপরাধী বোধ করিয়া পরীক্ষার্থ কলিকাতায় আনয়ন করাতে তাঁহার যে অপমান বোধ হইয়াছিল, তাহাতে তিনি একবারে ভগ্নচিত্ত হইলেন। ইঙ্গরেজেরা এপর্য্যন্ত এ দেশীয় যত লোক নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে তাঁহারা রাজা সিতাব রায়ের সর্ব্বদা অত্যন্ত গৌরব করিতেন। তিনি এরূপ তেজস্বী ছিলেন, যে অপরাধি বোধে অধিকারচ্যুত করা,কয়েদ করিয়া কলিকাতায় আনা, এবং দোষের আশঙ্কা করিয়া পরীক্ষা করা এই সকল অপমান তাঁহার অত্যন্ত অসহ্য হইয়াছিল। ফলতঃ, পাটনা প্রত্যাগমন করিয়া এই মনঃপীড়াতেই তিনি প্রাণ ত্যাগ করিলেন। তাঁহার পুত্র রাজা কল্যাণসিংহ অবিলম্বে তদীয় পদে অভিষিক্ত হইলেন। পাটনা প্রদেশ উৎকৃষ্ট দ্রাক্ষা ফলের নিমিত্ত যে প্রসিদ্ধ হইয়াছে, রাজা সিতাব রায়ই তাহার আদিকারণ। তাঁহার উদ্যোগেই ঐ প্রদেশে দ্রাক্ষা ও খরমুজের চাস আরম্ভ হয়। মহমদ রেজা খাঁর পরীক্ষায় অনেক কাল লাগিয়াছিল। নন্দকুমার তাঁহার দোষোদঘাটক নিযুক্ত হইলেন। প্রথমতঃ স্পষ্ট বোধ হইয়াছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ সপ্রমাণ হইবেক। কিন্তু দ্বৈবার্ষিক বিবেচনার পর নিৰ্দ্ধরিত হইল, মহমদ রেজা খাঁ নির্দ্দোষ; নির্দ্দোষ হইলেন ৰটে কিন্তু আর তিনি পুর্ব্ব কর্ম্ম প্রাপ্ত হইলেন না।
মহমদ রেজা খাঁ পদচ্যুত হইলে পর, নিজামতে তাঁহার যে কর্ম্ম ছিল, তাহা দুই ভাগ হইল। নবাবকে শিক্ষা দেওনের ভার মনিবেগমের প্রতি অর্পিত হইল। আর সমুদায় ব্যয়ের তত্ত্বাবধানার্থে হেষ্টিংস সাহেব নন্দকুমারের পুত্র গুরুদাসকে নিযুক্ত করিলেন। কৌন্সিলের অধিকাংশ মেম্বর এই নিয়োগ বিষয়ে বিস্তর আপত্তি করিলেন; কহিলেন গুরুদাস অত্যন্ত বালক, তাহাকে নিযুক্ত করায়, তাহার পিতাকে নিযুক্ত করা হইতেছে; কিন্তু তাহার পিতাকে কখন বিশ্বাস করা যাইতে পারে না। হেষ্টিংস তাঁহাদের পরামর্শ না শুনিয়া গুরুদাসকেই নিযুক্ত করিলেন।
এই সময়ে, ইংলণ্ডে কোম্পানির বিষয়কর্ম্ম অত্যন্ত ৰিশৃঙ্খল ও উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়াছিল। ১৭৬৭ সালে লার্ড ক্লাইবের প্রস্থান অবধি, ১৭৭২ সালে হেষ্টিংসের নিয়োগ পর্য্যন্ত, পাঁচ বৎসর ভারতবর্ষে যেমন ঘোরতর বিশৃঙ্খলতা ঘটিয়াছিল; ইংলণ্ডে ডিরেক্টরদের কার্য্যও তেমনি ৰিশৃঙ্খল হইয়াছিল। যে সময়ে কোম্পানির দেউলিয়া হইবার উপক্রম হইয়াছে, এমত সময়ে ডিরেক্টরেরা মুলধনের অধিকারিদিগকে শতকরা সাড়ে বার টাকার হিসাবে মুনফার হিস্যা দিলেন। যদি তাঁহাদের কার্য্যের বিলক্ষণরূপ উন্নতি থাকিত, তথাপি এরূপ মুনফা দেওয়া কোন প্রকারেই উচিত হইত না। যাহা হউক, এইরূপ পাগলামির কর্ম্ম করিয়া, ডিরেক্টরেরা দেখিলেন, ধনীগারে এক কপর্দ্দকও সম্বল নাই। অতএব তাঁহাদিগকে, ইংলণ্ডের ব্যাঙ্কেতে, প্রথমতঃ চল্লিশ লক্ষ ও তৎপরে আর বিশ লক্ষ টাকা ধার করিতে হইল। পরিশেষে রাজমন্ত্রির নিকটে গিয়া এক কোটি টাকা ধার চাহিতেও হইয়াছিল।
এপর্য্যন্ত পার্লিমেণ্টের অধ্যক্ষেরা ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কোন বিষয়েই কখন দৃষ্টিপাত করেন নাই। কিন্তু এক্ষণে কোম্পানির বিষয়কর্ম্মের এই প্রকার দুরবস্থা প্রকাশ হওয়াতে, তাঁহারা সমুদায় ব্যাপার আপনাদিগের হস্তে আনিতে মনস্থ করিলেন। কোম্পানির রাজ্যশাসনে যে সকল অন্যায়াচরণ হইয়াছিল, তাহার পরীক্ষার্থে এক কমিটী নিয়োজিত হইল। ঐ কমিটী বিজ্ঞাপনী প্রদান করিলে,রাজমন্ত্রিরা বুঝিতে পারলেন,যে সম্পূর্ণরূপে নিয়ম পরিবর্ত্ত না হইলে, কোম্পানির পরিত্রাণের উপায় নাই। অতএব তাঁহারা, সমুদায় দোষ সংশোধনার্থে, পার্লিমেণ্টে নানা প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। ডিরেক্টরেরা তদ্বিষয়ে,যত দূর পারেন, আপত্তি করিলেন; কিন্তু তাঁহাদের অসদাচরণ এত স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়াছিল,ও তাহাতে মনুষ্য মাত্রেরি এমত ঘৃণা জন্মিয়াছিল, ষে পার্লিমেণ্টের অধ্যক্ষেরা, তাঁহাদের সমস্ত আপত্তি উল্লঙ্ঘন করিয়া, রাজমন্ত্রির প্রস্তাবিত প্রণালীরই পোষকতা করিলেন। অতঃপর, ভারতবর্ষীয় রাজকর্মের সমুদায় প্রণালী, ইংলণ্ড ও ভারতবর্ষ উভয় স্থানেই, পরিবর্ত্তিত হইল। ডিরেক্টর মনোনীত করণ বিষয়েও কিছু কিছু রীতি পরিবর্ত্ত হইল। ইংলণ্ডে কোম্পানির কার্য্যে যে সমস্ত দোষ ঘটিয়াছিল ইহা দ্বারা তাহার অনেক শোধন হইল। ইহাও আদিষ্ট হইল, ষে প্রতি বৎসর ছয় জন ডিরেক্টরকে পদ পরিত্যাগ করিতে হইবেক, এবং তাঁহাদের পরিবর্ত্তে, আরও ছয় জনকে মনোনীত করা যাইবেক। আরও অনুমতি হইল, ষে বাঙ্গালার গবর্ণর ভারতবর্ষের গবর্ণর জেনেরল হইবেন এবং অন্যান্য রাজধানীর রাজনীতি ঘটিত ষাবতীয় ব্যাপার তাঁহার অধীনে থাকিবেক।
গবর্ণর ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের ক্ষমতা বিষয়ে সর্ব্বদাই বিবাদ উপস্থিত হইত; অতএব নিয়ম হইল, গবর্ণর জেনেরল ফোর্ট উইলিয়মের এক মাত্র গবর্ণর ও সেনানী হইবেন। গবর্ণর জেনেরল, কৌন্সিলের মেম্বর, ও জজদিগকে বাণিজ্য করিতে নিষেধ হইল। অতএব গবর্ণরের আড়াই লক্ষ ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের আশী হাজার বার্ষিক বেতন নিৰ্দ্ধারিত হইল। ইহাও আজ্ঞপ্ত হইল, যে কোম্পানির অথবা রাজার কার্য্যে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি উপটৌকন লইভে পরিবেন না। আর ডিরেক্টরদের প্রতি আদেশ হইল, যে ভারতবর্ষ হইতে রাজশাসনসম্পৰ্কীয় যে সকল কাগজ পত্র আসিবেক, সে সমুদায় তাঁহারা রাজমন্ত্রিগণের সম্মুখে উপস্থিত করিবেন।
বিচার নির্ব্বাহ বিষয়ে,এই নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত হইল, যে কলিকাতায় সুপ্রীমকোর্ট নামে এক প্রধান বিচারালয় স্থাপিত হইবেক। তথায় বার্ষিক অশীতি সহস্র মুদ্রা বেতনে এক জন চীফ্ জষ্টিস্ অর্থাৎ প্রধান বিচারকর্ত্তা, ও ষষ্টি সহস্ৰ বেতনে তিন জন পিউনি জজ অর্থাৎ কনিষ্ঠ বিচারকর্ত্তা থাকিবেন। এই জজেরা কোম্পানির অধীন হইবেন না, স্বয়ং রাজা তাঁহাদিগকে নিযুক্ত করিবেন। আর ঐ ধর্ম্মাধিকরণে ইংলণ্ডীয় ব্যবহার সংহিতা অনুসারে ব্রিটিশ সবজেক্টদিগের বিবাদ নিষ্পত্তি করা যাইবেক। পরিশেষে এই অনুমতি হইল, যে ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে পার্লিমেণ্টের অধ্যক্ষেরা প্রথম এই যে নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত করিলেন, ১৭৭৪ সালের ১লা আগষ্ট তদনুযায়ি কার্য্যারম্ভ হইবেক।
হেষ্টিংস সাহেৰ বাঙ্গালার রাজকার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে এমত ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে তিনিই প্রথম গবর্ণর জেনেরলের পদ প্রাপ্ত হইলেন। সুপ্রীম কৌন্সিলে তাঁহার সহিত রাজকার্য্য পর্য্যালোচনার্থে, চারি জন মেম্বর নিযুক্ত হইলেন। ইহাঁদের মধ্যে, বারওএল সাহেব বহুকালাবধি এতদ্দেশে রাজকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। আর কর্ণেল মনসন্, সর জান ক্লাবরিং ও ফ্রানসিস সাহেব, এই তিন জন কখন এ দেশে আইসেন নাই।
হেষ্টিংস এই তিন নুতন মেম্বরের মাদ্রাজ পহুছিবার সংবাদ শ্রবণমাত্র তাঁহাদিগকে এক অনুরাগসূচক পত্র লিখিলেন। অনন্তর তাঁহারা খাজরীতে পহুছিলে, তিনি কৌন্সিলের প্রধান মেম্বরকে তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পাঠাইলেনএবং তাঁহার এক জন নিজ পারিজদও স্বাগতজিজ্ঞাসার্থে প্রেরিভ হইলেন। তাঁহারা কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলে, তাঁহাদের যেরূপ সমাদর হইয়াছিল, লার্ড ক্লাইব ও বানসিটার্ট সাহেবেরও সেরূপ হয় নাই। আসিবামাত্র সতরটা সেলামি তোপ হয় ও তাঁহাদের সম্বৰ্দ্ধনা করিবার নিমিত্ত কৌন্সিলের সমুদায় মেম্বর একত্র হন। তথাপি তাঁহাদের মন উঠিল না।
তাঁহার ডিরেক্টরদিগের নিকট এই অভিষোগ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে আমরা সমুচিত সমাদর প্রাপ্ত হই নাই; আমাদিগের সম্বৰ্দ্ধনা করিবার নিমিত্ত সৈন্য বহিস্কৃত করা যায় নাই; এবং সেলামি তোপও উপযুক্ত সংখ্যায় হয় নাই; আর আমাদিগের সম্বৰ্দ্ধনা, কৌন্সিল গৃহে না করিয়া, হেষ্টিংসের বাটীতে করা গিয়াছিল; এবং আমরা যে নূতন গবর্ণমেণ্টের অবয়বস্বরূপ আসিয়াছি উপযুক্ত সমারোহ পুর্ব্বক তাহার ঘোষণা করা হয় নাই।
২০ এ অক্টোবর, কৌনসিলের প্রথম সভা হইল; কিন্তু বারওয়েল সাহেব তখন পর্য্যন্ত না পহুছিবাতে, সে দিবস কেবল নূতন গবর্ণমেণ্টের ঘোষণমাত্র হইল। অন্যান্য সমুদায় কর্ম্ম, আগামি সোমবার ২৪ এ তারিখে, বিবেচনার নিমিত্ত রহিল। নূতন মেম্বরেরা ভারতবর্ষের কার্য্য কিছুই অবগত ছিলেন না; অতএব, সভা আরম্ভ হইলে, হেষ্টিংস সাহেব, কোম্পানির সমুদায় কার্য্য যে অবস্থায় চলিতেছিল, তাহার এক সবিশেষ বিবরণ তাঁহাদের সম্মুখে ধরিলেন। কিন্তু এই প্রথম সভাতেই এমত বিবাদ উপস্থিত হইল যে, তদ্দ্বারা ভারত বর্ষের রাজ্যশাসন তদবধি প্রায় সাত বৎসর পর্য্যন্ত অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়াছিল। বারওয়েল সাহেৰ একাকী গবর্ণর জেনেরলের পক্ষ ছিলেন। অন্য তিন জন মেম্বর সকল বিষয়ে সর্ব্বদা তাঁহার বিরুদ্ধ পক্ষেই মত দিতেন। তাঁহাদের সংখ্যা অধিক, সুতরাং গবর্ণর জেনেরল কেবল সাক্ষিগোপাল হইলেন। যেহেতু, যে স্থলে বহু সংখ্যক ব্যক্তির উপর কোন বিষয়ের ভার থাকে, তথায়, মতভেদ হইলে, অধিকাংশ ব্যক্তির মতানুসারেই যাবতীয় কার্য্য নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। বস্তুতঃ সমস্ত ক্ষমতা তাঁহাদের হস্তেই পতিত হইল। তাঁহাদের ভারতবর্ষে আসিবার পুর্ব্বে হেষ্টিংস এতদ্দেশে যে সকল ঘোরতর অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়াছিলেন তাঁহারা তৎসমুদায় সবিশেষ অবগত ছিলেন, এবং হেষ্টিংসকে অতি অপকৃষ্ট লোক স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। অতএব, ন্যায় অন্যায় বিবেচনা না করিয়াই, হেষ্টিংস যাহা কহিতেন,তাহাই অগ্রাহ করিতেন, সুতরাং তাঁহারা যে ক্রোধ দ্বেষ শূন্য হইয়া সকল কর্ম্ম করিবেন তাহার সম্ভাবনা ছিল না।
হেস্টিংস সাহেব, কিয়দ্দিবস পূর্ব্বে, মিডিল্টন সাহেবকে লক্ষণৌ নগরে রেসিডেণ্ট নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এক্ষণে নূতন মেম্বরেরা তাঁহাকে সে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিতে আজ্ঞা দিলেন; এবং হেষ্টিংস সাহেব নবাবের সহিত যে সকল বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, সে সমুদায় অগ্রাহ্য করিয়া তাঁহার নিকট নুতন বন্দোবস্তের প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন। হেস্টিংস তাঁহাদিগকে ক্ষান্ত হইতে অনুরোধ করিলেন, এবং কহিলেন এরূপ হইলে সর্ব্বত্র প্রকাশ হইবেক যে গবর্ণমেণ্ট মধ্যে অনৈক্য উপস্থিত হইয়াছে। এতদ্দেশীয় লোকেরা সর্ব্বদাই গবর্ণরকে গবর্ণমেণ্টের প্রধান বিবেচনা করিয়া থাকে; কিন্তু এক্ষণে তাঁহাকে এরূপে ক্ষমতাশূন্য দেখিয়া,সহজেই বোধ করিতে পারে যে রাজবিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু ফ্রান্সিস্ ও তৎপক্ষীয়েরা ক্রোধ-দ্বেষ-পরবশতা প্রযুক্ত তাহা শুনিলেন না।
দেশীয় লোকের অল্পকাল মধ্যেই কৌন্সিলের এই প্রকার বিবাদের বিষয় অবগত হইলেন; এবং ইহাও জানিতে পারিলেন, যে হেষ্টিংস সাহেব এত কাল সকলের প্রধান ছিলেন, এক্ষণে আর তাঁহার কোন ক্ষমতা নাই। অতএব যে সকল লোক তৎকৃত কোন কোন ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিল, তাহারা ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয় মেম্বরদিগের নিকট তাঁহার নামে অভিযোগ করিতে আরম্ভ করিল। তাঁহারাও আন্তরিক যত্ন ও উৎসাহ সহকারে তাহাদিগের অভিযোগ গ্রাহ্য করিতে লাগিলেন। সেই সময়ে, বর্দ্ধমানের অধিপতি মৃত তিলকচন্দ্রের মহিষী স্বীয় তনয়কে সমভিব্যাহারে করিয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন। তিনি অবিলম্বে এই আবেদন পত্র প্রদান করিলেন যে আমি রাজার মৃত্যুর পর ইঙ্গরেজ ও তাঁহাদিগের কর্ম্মকারকদিগকে নয় লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়াছি; তন্মধ্যে হেষ্টিংস সাহেব ১৫০০০ টাকা লইয়াছেন। ইহাতে হেষ্টিংস, ৰাঙ্গালা ঐ পারসীতে হিসাব দেখিতে চাহিলেন; কিন্তু রাণী কিছুই দেখাইলেন না। কোন ব্যক্তিকে সম্মানদান করা এপর্য্যন্ত গবর্ণমেণ্টের প্রধান ব্যক্তির অধিকার ছিল; কিন্তু হেষ্টিংসের বিপক্ষেরা তাঁহাকে তুচ্ছ করিয়া স্বহস্তে শিশু রাজাকে খেলাত দিলেন।
অতি শীঘ্র শীঘ্র হেষ্টিংসের নামে ভুরি ভুরি অভিযোগ উপস্থিত হইতে লাগিল। এক জন এই বলিয়া দরখাস্ত দিলেক যে হুগলীর ফৌজদার বৎসরে ৭২০০০ টাকা বেতন পাইয়া থাকেন; তন্মধ্যে তিনি হেষ্টিংস সাহেবকে ৩৬০০০ ও তাঁহার দেওয়ানকে ৪০০০ টাকা দেন। আমি ৩২০০০ টাকা পাইলেই ঐ কর্ম্ম নির্ব্বহ করিতে পারি। উপস্থিত অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া, সাক্ষী লওয়া গেল। হেষ্টিংসের বিপক্ষ মেম্বরেরা কহিলেন যথেষ্ট প্রমাণ হইয়াছে। তদনুসারে ফৌজদার পদচ্যুত হইলেন। অন্য এক ব্যক্তি ন্যূন বেতনে ঐ পদে নিযুক্ত হইল; কিন্তু অভিযোক্তার কিছুই হইল না।
এক মাসের মধ্যে আর এক অভিযোগ উপস্থিত হইল। যে মনিবেগম নয় লক্ষ টাকার হিসাব দেন নাই। পীড়াপীড়ি করাতে, বেগম কহিলেন হেষ্টিংস সাহেব যখন আমাকে নিযুক্ত করিতে আইসেন, তাঁহাকে,আমোদ উপলক্ষে ব্যয় করিবার নিমিত্ত,এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়াছি। হেষ্টিংস সাহেব কহিলেন আমি ঐ টাকা লইয়াছি বটে; কিন্তু সরকারী হিসাবে খরচ করিয়া কোম্পানির দেড় লক্ষ টাকা বাঁচাইয়াছি। তিনি ইহাও কহিলেন, যে বাঙ্গালায় নবাব যখন যখন কলিকাতায় ভাসিয়া থাকেন, দৈনন্দিন ব্যয়ের নিমিত্ত, তাঁহাকে ১০০০ টাকা দেওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু হেষ্টিংস সাহেবের এই হেতুবিন্যাস কাহারও মনোগত হইল না।
এক্ষণে স্পষ্ট দৃষ্ট হইল, যে অভিযোগ করিলেই গ্রাহ্য হইতে পারে; অতএব নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন যে গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, সাড়ে তিন লক্ষ টাকা লইয়া, মনিবেগমকে ও আমার পুত্ত্র গুরুদাসকে মুরশিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা প্রস্তাৰ করিলেন, সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত নন্দকুমারকে কৌন্সিলের সম্মুখে আনয়ন করা যাউক। হেষ্টিংস উত্তর করিলেন, আমি যে সভার অধিপতি, তথায় আমার অভিযোক্তাকে আসিতে দিব না। বিশেষতঃ, এমত বিষয়ে অপদার্থ ব্যক্তির ন্যায় সম্মত হইয়া গবর্ণর জেনেরলের পদের অমর্য্যাদা করিব না; বরং এই সমস্ত ব্যাপার সুপ্রীমকোর্টে প্রেরণ করা যাউক। ইহা কহিয়া হেষ্টিংস গাত্রোত্থান করিয়া কৌন্সিল চেম্বার হইতে চলিয়া গেলেন; এবং বারওয়েল সাহেৰও তাঁহার অনুগামী হইলেন।
তাঁহাদের প্রস্থানের পর, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা নন্দকুমারকে কৌন্সিল গৃহে আহ্বান করিলে,তিনি এক পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন মনিৰেগম যখন যাহা ঘুস দিয়াছেন তদ্বিষয়ে এই পত্র লিখিয়াছেন। কিছু দিন পূর্ব্বে বেগম গবর্ণমেণ্টে এক পত্র লিখিয়াছিলেন; সর জান ডাইলি সাহেব, নন্দকুমারের পাঠিত-পত্রের সহিত দিলাইবার নিমিত্ত, ঐ পত্র বাহির করিয়া দিলেন। মোহর-দলিল, হস্তাক্ষরের ঐক্য হইল না। যাহাহউক, কৌন্সিলের মেম্বরেরা নন্দকুমারের অভিযোগ যথার্থ বলিয়া স্থির করিলেন এবং হেস্টিংসকে ঐ টাকা ফিরিয়া দিতে কহিলেন। কিন্তু তিনি তাহাতে. কোন ক্রমেই সম্মত হইলেন না।
এই বিষয় নিম্পত্তি না হইতেই, হেষ্টিংস নন্দকুমারের নামে, চক্রান্তকারী বলিয়া, সুপ্রীমকোর্টে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। হেষ্টিংসের অভিযোগের কিছুদিন পরেই কামালউদ্দীন নামে এক জন মুসলমান এই অভিযোগ উপস্থিত করিল যে নন্দকুমার এক কাগজে আমার নাম জাল করিয়াছে। সুপ্রীমকোর্টের জজের এই অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া নন্দকুমারকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করিলেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা জজদিগের নিকট বারম্বার প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন যে জামীন লইয়া নন্দকুমারকে কারাগার হইতে মুক্ত করিতে হইবেক। কিন্তু জজেরা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন পুর্ব্বক তাহা অস্বীকার করিলেন। বিচারের সময় উপস্থিত হইলে, চীফজাষ্টিস্ সর ইলাইজা ইম্পি একাকী ধর্ম্মাসনে অধিষ্ঠান করিলেন এবং কেবল কতকগুলি ইঙ্গরেজ জুরী নিযুক্ত হইলেন। জুরীরা নন্দকুমারকে দোষী নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দিলেন এবং চীফজাষ্টিস্ বাহাদুর নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ বিধান করিলেন। তদনুসারে, ১৭৭৫ খৃঃ অব্দের জুলাই মাসে, তাঁহার ফাঁশী হইল।
যে দোষে সুপ্রীমকোর্টের বিচারে নন্দকুমারের প্রাণদও হইল, তাহা যদিই তিনি যথার্থ করিয়া থাকেন, সুপ্রীমকোর্ট স্থাপিত হইবার ছয় বৎসর পুর্ব্বে করিয়াছিলেন; সুতরাং তৎসংক্রান্ত অভিযোগ কোন ক্রমেই সুপ্রীমকোর্টের গ্রাহ্য ও বিচার্য্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ, যে আইন অনুসারে এই সুবিচার হইল, ন্যায়পরায়ণ হইলে ইম্পি কদাচ উপস্থিত ব্যাপারে ঐ আইনের মর্ম্মানুসারে কর্ম্ম করিতেন না। ঐ আইন ভারতবৰ্ষীয় লোকদিগের বিষয়ে প্রচলিত হইবেক বলিয়া নিরূপিত হয় নাই। ফলতঃ, নন্দকুমারের প্রাণবধ ন্যায় মার্গানুসারে বিহিত হইয়াছে ইহা কোন ক্রমেই প্রতিপন্ন হইতে পারে না।
এতদ্দেশীয় লোকেরা এই অভূতপূর্ব্ব ব্যাপার দর্শনে একবারে হতবুদ্ধি হইলেন। কলিকাতাবাসি ইঙ্গরেজেরা প্রায় সকলেই গবর্ণর জেনেরলের পক্ষ ও তাঁহার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত ছিলেন; তাঁহারাও অবিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড দেখিয়া যৎপরোনাস্তি মনস্তাপ ও অক্ষেপ করিয়াছিলেন।
নন্দকুমার এতদ্দশের এক জন অতি প্রধান লোক ছিলেন। ইঙ্গরেজদিগের সৌভাগ্যদশা উদয় হইবার পুর্ব্বে, তাঁহার এরূপ আধিপত্য ছিল যে ইঙ্গরেজেরাও, বিপদ পড়িলে, সময়ে সময়ে তাঁহার আণুগত্য করিতেন ও শরণাগত হইতেন। নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন অসম্ভব নহে; কিন্তু ইম্পি ও হেষ্টিংস তদপেক্ষা অধিক দুরাচার তাহার কোন সন্দেহ নাই।
নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে নানা অভিযোগ উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন! হেষ্টিংস দেখিলেন নন্দকুমার জীবিত থাকিতে আমার ভদ্রস্থতা নাই; অতএব যে কোন প্রকারে ইহার প্রানবধ সাধন করা আবশ্যক। তদনুসারে কামালউদ্দীনকে উপলক্ষ্য করিয়া সুপ্রীমকোর্টে পুর্ব্বোক্ত অভিযোগ উপস্থিত করেন। ধর্ম্মাসনারূঢ় ইম্পি, গবর্ণর জেনেরল পদারূঢ় হেষ্টিংসের পরিতোষার্থে, একবারেই ধর্ম্মাধর্ম্মজ্ঞান ও ন্যায় অন্যায় বিবেচনাশূন্য হইয়া নন্দকুমারের প্রাণবধ করিলেন। হেস্টিংস তিন চারি বৎসর পরে এক পত্র লিখিয়াছিলেন; তাহাতে ইম্পিকৃত এই মহোপকারের বিষয় উল্লিখিত আছে। ঐ পত্রে এইরূপ লিখিত আছে যে এক সময়ে ইম্পির আনুকুল্যে আমার সৌভাগ্য ও মান সন্ত্রম রক্ষা পাইয়াছে। এই লিখন দ্বারা ইহাও প্রতিপন্ন হইতে পারে যে নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে যে সকল অভিষোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন সে সমস্ত অমুলক নহে; এবং সুপ্রীমকোর্টের অবিচারে তাঁহার প্রাণদণ্ড না হইলে তিনি সে সমুদায় সপ্রমাণও করিয়া দিতেন; সেই ভয়েই হেষ্টিংস ইম্পির সহিত পরামর্শ করিয়া নন্দকুমারের প্রাণবধ করেন।
মহমদ রেজাখাঁর পরীক্ষার কলিতার্থ সংবাদ ইংলণ্ডে পহুছিলে, ডিরেক্টরেরা কহিলেন আমাদের বিলক্ষণ প্রতীতি জম্মিয়াছে যে মহমদ রেজা খাঁ নিরপরাধ। অতএব তাঁহারা, নবাবের সাংসারিক কর্ম্ম হইতে গুরুদাসকে বহিষ্কৃত করিয়া, তৎপদে মহমদ রেজা খাঁকে নিযুক্ত করিতে আদেশ প্রদান করিলেন।
সুগ্রীম কৌন্সিলের সাহেবেরা দেখিলেন, তাঁহাদের এমত অবসর নাই যে কলিকাতা সদর নিজামত আদালতে স্বয়ং অধ্যক্ষতা করিতে পারেন। অতএব, পুর্ব্বপ্রণালী অনুসারে, পুনর্ব্বার ফৌজদারী আদালত ও পুলিসের ভার এক জন দেশীয় লোকের হস্তে সমৰ্পণ করিতে মানস করিলেন। তদনুসারে ঐ আদালত কলিকাতা হইতে মুরশিদাবাদে নীত হইল এবং মহমদ রেজা খাঁ তথাকার প্রধান পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন।