বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
গুপ্তাধিকার কাল।
গুপ্তরাজবংশের অভ্যুদয়—(প্রথম) চন্দ্রগুপ্ত—গৌপ্তাব্দের প্রারম্ভ—সাম্রাজ্যের সূত্রপাত—বর্দ্ধমানে আবিষ্কৃত প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রা—সমুদ্রগুপ্ত—তাঁহার দিগ্বিজয় ও অশ্বমেধ—এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি—দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত—মালব ও সৌরাষ্ট্র অধিকার—সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ অবস্থা—চীন পরিব্রাজক ফা-হিয়েন্—প্রথম কুমারগুপ্ত—অশ্বমেধ—নাটোরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন—পুষ্যমিত্রীয় ও হূণজাতির আক্রমণ—অর্থাভাবে নিকৃষ্ট মুদ্রার প্রচলন—স্কন্দগুপ্ত—হূণসমস্যা-অন্তর্বিদ্রোহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ—গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসসূচনা—পুরগুপ্ত—সাম্রাজ্য মগধ ও বঙ্গে সীমাবদ্ধ—নরসিংহগুপ্ত—দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত—বুধগুপ্ত—ভানুগুপ্ত—তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত (দ্বাদশাদিত্য)—বিষ্ণুগুপ্ত (চন্দ্রাদিত্য)—মুরশিদাবাদে বিষ্ণুগুপ্ত ও জয়গুপ্তের সুবর্ণমুদ্রাবিষ্কার।
খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে পাটলিপুত্রের কে রাজা ছিলেন, তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই এবং বঙ্গ ও মগধে কাহার অধিকার ছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। মরুবাসী পুষ্করণা দেশের অধিপতি চন্দ্রবর্ম্মা যখন সিন্ধুর সপ্তমুখ পার হইয়া বাহ্লীকদেশে ও বঙ্গদেশে দিগ্বিজয়যাত্রা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তখন বোধ হয় আর্য্যাবর্ত্তের কোন ক্ষমতাশালী নৃপতির অস্তিত্ব ছিল না। চন্দ্রবর্ম্মার দিগ্বিজয়কালে মগধে লিচ্ছবিরাজবংশের জামাতা, চন্দ্রগুপ্ত নামক জনৈক ব্যক্তি, একটি ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। সেই সময় হইতেই গৌড় ও রাঢ় এই নূতন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলিয়া অনুমান হয়। চন্দ্রগুপ্তের পুত্র, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে, এই ক্ষুদ্র রাজ্য ক্রমে আয়তনে বর্দ্ধিত হইয়া সমগ্র উত্তরাপথব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল। চন্দ্রগুপ্তের পিতার নাম ঘটোৎকচগুপ্ত ও তাঁহার পিতামহের নাম শ্রীগুপ্ত; ইঁহারা বোধ হয় সামান্য ভূস্বামী ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবিরাজদুহিতা কুমারদেবীকে বিবাহ করিয়া স্বতন্ত্র রাজ্য স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই কারণে তিনি সুবর্ণমুদ্রায় তাঁহার মূর্ত্তির পার্শ্বে রাজ্ঞী কুমারদেবীর মূর্ত্তি অঙ্কিত করাইয়া তাহার পার্শ্বে লিচ্ছবিগণের নাম উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন[১]। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের একটি মুদ্রা বর্দ্ধমান জেলার মশা গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা এক্ষণে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। কনিংহাম গয়া জেলায় প্রথম চন্দ্রগুপ্তের এইজাতীয় একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কার করিয়াছিলেন[২]।
চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর পুত্র তাঁহার খোদিতলিপিতে আপনাকে লিচ্ছবিদৌহিত্র বলিয়া পরিচিত করিয়াছেন[৩]। সমুদ্রগুপ্ত খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। তিনি সর্ব্বপ্রথমে আর্য্যাবর্ত্তের অন্যান্য রাজগণের উচ্ছেদ সাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্ম্মা, গণপতিনাগ, নাগসেন, অচ্যুত, নন্দী, বলবর্ম্মা প্রভৃতি আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণের রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। আর্য্যাবর্ত্ত অধিকৃত হইলে আটবিক অর্থাৎ বনময় প্রদেশসমূহের রাজগণ তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। সমগ্র উত্তরাপথ বিজিত হইলে সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণাপথ জয় করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার রাজধানী পাটলিপুত্র হইতে যাত্রা করিয়া মগধ ও উড়িষ্যার মধ্যবর্ত্তী বনময় প্রদেশের দুইজন রাজাকে পরাজিত করিয়াছিলেন। এই দুইজনের মধ্যে প্রথম, দক্ষিণ কোশলরাজ মহেন্দ্র ও দ্বিতীয় মহাকান্তার বা ভীষণ বনের অধিপতি ব্যাঘ্ররাজ। ইহার পরে তিনি কৌরলদেশের অধিপতি মণ্টরাজকে পরাজিত করিয়া কলিঙ্গদেশের পুরাতন রাজধানী পিষ্টপুর (আধুনিক পিট্টপুরম্), মহেন্দ্রগিরি ও কোট্টুর দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন। কোট্টুর ও পিষ্টপুরের অধিপতি স্বামিদত্ত, এরণ্ডপল্লরাজ দমন, কাঞ্চিনগরাধিপতি বিষ্ণুগোপ, অবমুক্তরাজ নীলরাজ, বেঙ্গীনগরাধিপতি হস্তিবর্ম্মা, পলক্করাজ উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের অধিপতি কুবের এবং কুস্থলপুররাজ ধনঞ্জয় প্রভৃতি দক্ষিণাপথের রাজগণ সমুদ্রগুপ্ত কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। সমতট (দক্ষিণ অথবা পূর্ব্ববঙ্গ), ডবাক (সম্ভবতঃ ঢাকা), কামরূপ, নেপাল, কর্ত্তৃপুর (বর্ত্তমান কুমায়ুন ও গঢ়োয়াল) প্রভৃতি সীমান্ত রাজ্যের নরপতিগণ, এবং মালব, আর্জ্জুনায়ন, যৌধেয়, মদ্রক, আভীর, প্রার্জ্জুন সনকানীক, কাক, খরপরিক প্রভৃতি জাতিসমূহ তাঁহাকে কর প্রদান করিত[৪]। উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথ বিজিত হইলে সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তাঁহার আদেশে নির্ম্মিত যজ্ঞীয় অশ্বের একটি প্রস্তরমূর্ত্তি হিমালয় পর্ব্বতের পাদমূলে বনময় প্রদেশে আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহা এক্ষণে লক্ষ্ণৌ চিত্রশালায় রক্ষিত আছে[৫]। অশ্বমেধ যজ্ঞের দক্ষিণা প্রদানের জন্য তিনি এক নূতন প্রকারের সুবর্ণমুদ্রা মুদ্রাঙ্কিত করাইয়াছিলেন। এই সমস্ত মুদ্রার একদিকে যজ্ঞযূপে আবদ্ধ অশ্ব ও অপরদিকে প্রধানা মহিষীর মূর্ত্তি অঙ্কিত আছে। সমুদ্রগুপ্তের অশ্বমেধের সুবর্ণমুদ্রা অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। মগধে এই জাতীয় তিনটিমাত্র মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে[৬]। গৌড় ও রাঢ় প্রদেশ যে সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল, সে ষিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। সমতট যদি বর্ত্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম হয়,[৭] তাহা হইলে পূর্ব্ব এবং দক্ষিণবঙ্গও গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মগধ ও বঙ্গের নানাস্থানে সমুদ্রগুপ্তের নানাবিধ সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে; পাটনা নগরের অপরপারে মজঃফরপুর জেলার অন্তর্গত হাজীপুর গ্রামে সমুদ্রগুপ্তের তিন প্রকার সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল; প্রথম প্রকারের মুদ্রায় ধনুর্ব্বাণ হস্তে রাজার মূর্ত্তি, দ্বিতীয় প্রকারের মুদ্রায় পরশুহস্তে রাজমূর্ত্তি ও তৃতীয় প্রকারের মুদ্রায় শূল হস্তে রাজমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়[৮]।
বৃদ্ধ বয়সে সম্রাট্ সমুদ্রগুপ্ত তাঁহার দিগ্বিজয়-কাহিনী রাজকবি সান্ধিবিগ্রহিক কুমারামাত্য হরিষেণ কর্ত্তৃক শ্লোক রচনা করাইয়া সম্রাট্ অশোক কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিলাস্তম্ভগাত্রে উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের পত্নীর নাম দত্তদেবী। তাঁহার দেহাবসান হইলে দত্তদেবীর গর্ভজাত পুত্র চন্দ্রগুপ্ত (দ্বিতীয়) সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।
মহারাজাধিরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়া বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা সমুদ্রগুপ্ত কোন্ সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। গুপ্ত রাজবংশের অধিকার কালে একটি নূতন বর্ষ গণনা আরম্ভ হইয়াছিল, ইহাই খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌপ্তাব্দ নামে পরিচিত হইয়াছিল[৯]। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, এই বর্ষগণনা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যাভিষেক কালে প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। ৩১৯ খৃষ্টাব্দ হইতে গৌপ্তাব্দের গণনা আরব্ধ হইয়াছে সুতরাং ধরিয়া লইতে হইবে যে, ৩১৯ অথবা ৩২০ খৃষ্টাব্দে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময়ের কোন খোদিতলিপিই অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যকালের তিনখানি খোদিতলিপি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইহার মধ্যে দুইখানি শিলালিপি ও তৃতীয় খানি তাম্রশাসন। শিলালিপি দুইখানিতে তারিখ নাই[১০], এবং তাম্রশাসনখানি কূটশাসন বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে[১১]। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি সমূহে গৌপ্তাব্দের বর্ষ গণনানুসারে তারিখ প্রদত্ত হইয়াছে। মালবে উদয়গিরি পর্ব্বতের একটি গুহায় সনকানীক জাতীয় জনৈক সামন্তরাজ কর্ত্তৃক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ৮২ গৌপ্তাব্দে একটি গুহা খনিত হইয়াছিল[১২]। ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট স্মিথ অনুমান করেন যে, এই ঘটনার পঞ্চবিংশ বর্ষ পূর্ব্বে সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যু হইয়াছিল[১৩] ও চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ৮২ গৌপ্তাব্দে অথবা ৪০১ খৃষ্টাব্দে উদয়গিরির পর্ব্বতগুহা খনিত হইয়াছিল। ইহা হইতে অনুমান হয় যে, খৃষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীর শেষপাদে মালব গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। চতুর্দ্দশ বর্ষ পরে ৯৬ গৌপ্তাব্দে মহারাজাধিরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে অম্রকার্দ্দব নামক তাঁহার একজন কর্ম্মচারী নিত্য পঞ্চজন ভিক্ষু ভোজন করাইবার ও মন্দিরের রত্নগৃহে প্রদীপ জ্বালাইবার জন্য পঞ্চবিংশ দীনার (সুবর্ণ মুদ্রা) ও কিঞ্চিৎ ভূসম্পত্তি দান করিয়াছিলেন। প্রাচীন কাকনাদবোট অর্থাৎ বর্ত্তমান সাঞ্চিতে এই খোদিতলিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল[১৪]। মালবের উদয়গিরি পর্ব্বতের পূর্ব্বোক্ত গুহায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে তাঁহার মন্ত্রী পাটলিপুত্রবাসী শাব অপর নামধেয় বীরসেন শিবপূজার নিমিত্ত একটি গুহা উৎসর্গ করিয়াছিলেন[১৫]। বীরসেন তাঁহার খোদিতলিপিতে বলিয়া গিয়াছেন যে, রাজা যখন পৃথিবী জয়ার্থ আগমন করিয়াছিলেন তখন তিনি তাঁহার সহিত এতদ্দেশে আসিয়াছিলেন[১৬]। এই তিনটি খোদিতলিপি হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কালে, ৪০১ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে, অর্থাৎ খৃষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীর শেষপাদে, মালব গুপ্তসম্রাট্ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল।
মালব অধিকারের অব্যবহিত পরে, সৌরাষ্ট্রের শকজাতীয় প্রাচীন ক্ষত্রপোপাধিধারী রাজবংশের অধিকার লোপ হইয়াছিল। কুষাণবংশীয় সম্রাট্ প্রথম বাসুদেবের রাজত্বকালে, অথবা হুবিষ্ক ও প্রথম বাসুদেবের রাজ্যকালের মধ্যবর্ত্তী সময়ে, উজ্জয়িনীর ক্ষত্রপ চষ্টনের পৌত্র রুদ্রদাম, অন্ধ্ররাজ দ্বিতীয় পুলুমায়িকে পরাজিত করিয়া, কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র ও আনর্ত্তদেশে একটি নূতন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন[১৭]। রুদ্রদামের বংশধর ও স্থলাভিষিক্তগণ ৩১০ শকাব্দ (৩৮৮ খৃঃ অঃ) পর্য্যন্ত সৌরাষ্ট্রদেশ অধিকার করিয়াছিলেন। মহাক্ষত্রপ সত্যসিংহের পুত্র ৩১০ শকাব্দে স্বনামে রজতমুদ্রা মুদ্রাঙ্কন করিয়াছিলেন[১৮]। ৯০ গৌপ্তাব্দ হইতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সৌরাষ্ট্রের শকরাজগণের অনুকরণে নিজ নামে রৌপ্য মুদ্রা মুদ্রাঙ্কন আরম্ভ করেন[১৯]। ইহা হইতে অনুমান হয় যে, ৩১০ শকাব্দ ও ৯০ গৌপ্তাব্দের (৩৮৮ হইতে ৪০৯ খৃষ্টাব্দের) মধ্যবর্ত্তী সময়ে মহাক্ষত্রপ রুদ্রসিংহের অধিকার গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল[২০]। মহারাজাধিরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে চীনদেশীয় ভিক্ষু ফা-হিয়েন বৌদ্ধতীর্থ দর্শন উপলক্ষে ভারতবর্ষে আগমন করিয়াছিলেন। তিনি ছয় বৎসরকাল গুপ্তসাম্রাজ্যের সীমা মধ্যে বাস করিয়াছিলেন এবং পুরুষপুর, তক্ষশিলা, মথুরা, সঙ্কাশ্য, কান্যকুব্জ, কপিলবাস্তু, পাটলিপুত্র, শ্রাবস্তী, বুদ্ধগয়া, রাজগৃহ, তাম্রলিপ্তি প্রভৃতি প্রাচীন নগরসমূহের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সময়ে মগধদেশের নগরগুলি উত্তরাপথের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বৃহত্তম ছিল। তিনি বৈশালী, পাটলিপুত্র, রাজগৃহ, গয়া প্রভৃতি প্রধান বৌদ্ধতীর্থসমূহ দৰ্শন করিয়াছিলেন। রাজধানী পাটলিপুত্র নগরের ঐশ্বর্য্য দর্শনে চৈনিক শ্রমণ বিস্মিত ও মুগ্ধ হইয়াছিলেন। গুরুভার বৃহদাকার পাষাণখণ্ডনির্ম্মিত মৌর্য্য-সম্রাট্ অশোকের প্রাসাদ তখনও ধ্বংস হয় নাই। সেই পাষাণখণ্ডসমূহ যোজন ও স্থাপন তৎকালে মানবের অসাধ্য বলিয়া বিবেচিত হইত। খৃষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর মগধবাসিগণ, অশোকের প্রাসাদ ও চৈত্যসমূহ দানবগণ কর্ত্তৃক নির্ম্মিত বলিয়া অনুমান করিতেন। তখন পাটলিপুত্রে হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের শত শত ভিক্ষু বৌদ্ধসঙ্ঘারামসমূহে বাস করিতেন। মঞ্জুশ্রী নামক ব্রাহ্মণজাতীয় উপাধ্যায়কে উভয় সম্প্রদায়ের ভিক্ষুগণ অতিশয় শ্রদ্ধা করিতেন। পাটলিপুত্র নগরে বৎসরের দ্বিতীয় মাসের অষ্টম দিবসে দেবগণের রথযাত্রা দেখিয়া চীনদেশীয় শ্রমণ আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন। তখন নগরে বহু চিকিৎসালয় ছিল; আতুর, রোগগ্রস্ত ব্যক্তিগণ অর্থব্যয় না করিয়া এই সকল স্থানে ঔষধ ও পথ্য পাইতেন। ফা-হিয়েনের বৃত্তান্ত পাঠ করিয়া ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট স্মিথ আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন[২১]। ফা-হিয়েন বঙ্গদেশের প্রধান বন্দর তাম্রলিপ্তি নগরে দুই বৎসরকাল বাস করিয়াছিলেন এবং এই স্থান হইতে অর্ণবপোতে আরোহণ করিয়া সিংহল যাত্রা করিয়াছিলেন[২২]। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পত্নীর নাম ধ্রুবদেবী বা ধ্রুবস্বামিনী[২৩]। ধ্রুবস্বামিনীর গর্ভে কুমারগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্ত[২৪] নামক দুই পুত্র উৎপন্ন হইয়াছিল। কুমারগুপ্ত পিতার মৃত্যুর পরে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের দুইজন রাজকর্ম্মচারীর নাম আবিষ্কৃত হইয়াছে। মালবের উদয়গিরি পর্ব্বতগুহার খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া ষায় যে, পাটলিপুত্রবাসী বীরসেন অর্থাৎ শাব তাঁহার সচিব ছিলেন[২৫]। গোরক্ষপুর জেলায় ভরডি ডিহ গ্রামে একটি শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হইয়াছিল; শিবলিঙ্গের গাত্রে একটি খোদিত লিপি আছে, তাহাতে উল্লিখিত আছে যে, বিষ্ণুপালিতভট্টের পুত্র কুমারামাত্য শিখরস্বামী সম্রাট্ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন[২৬]।
মগধ ও বঙ্গের নানাস্থানে মহারাজাধিরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষ খননকালে ডাক্তার স্পুনার দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কয়েকটি তাম্রমুদ্রা আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই জাতীয় তাম্রমুদ্রা অতীব দুষ্প্রাপ্য[২৭]। ভাগলপুরজেলায় সুলতানগঞ্জের নিকটে একটি প্রাচীন বৌদ্ধস্তূপ খননকালে সৌরাষ্ট্রের শকজাতীয় শেষ মহাক্ষত্রপ রুদ্রসিংহের রজতমুদ্রার সহিত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের একটি রজতমুদ্রাও আবিষ্কৃত হইয়াছিল[২৮]। তাঁহার বহুবিধ সুবর্ণমুদ্রাও আবিষ্কৃত হইয়াছে। ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে মজঃফরপুর জেলায় হাজীপুর গ্রামে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ত্রিবিধ সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই তিন প্রকারের মুদ্রায় যথাক্রমে ধনুর্ব্বাণহস্তে রাজমূর্ত্তি, ছত্রের নিম্নে দণ্ডায়মান রাজমূর্ত্তি ও সিংহহন্তা রাজমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়[২৯]। শূলহস্তে রাজমুর্ত্তিযুক্ত তিনটি সুবর্ণমুদ্রা গয়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তন্মধ্যে একটি বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায়,[৩০] দ্বিতীয়টি রঙ্গপুর সদ্যঃপুষ্করিণীর ভূস্বামী রায় শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় রায় চৌধুরী বাহাদুরের নিকট ও তৃতীয়টি কলিকাতানিবাসী শ্রীযুক্ত প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের নিকট রক্ষিত আছে। পাটনানিবাসী বিখ্যাত শ্রেষ্ঠী রায় রাধাকৃষ্ণ বাহাদুরের নিকট ও ভাগলপুর নিবাসী বাবু দেবীপ্রসাদের নিকট মগধে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বহু সুবর্ণমুদ্রা আছে। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে হুগলী জেলার অন্তর্গত জাহানাবাদ মহকুমায় মাধবপুর গ্রামে ধনুর্ব্বাণহস্তে রাজমূর্ত্তিযুক্ত পাঁচটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৩১]। এই জাতীয় আর একটি সুবর্ণমুদ্রা শতাধিকবর্ষ পূর্ব্বে কলিকাতার নিকট কালীঘাটে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। তদানীন্তন শাসনকর্ত্তা ওয়ারেন হেষ্টিংস তৎকালে ইহা ইংলণ্ডে প্রেরণ করিয়াছিলেন। এই মুদ্রাটি এক্ষণে লণ্ডন নগরে ব্রিটিশ্ মিউজিয়মে আছে[৩২]। যশোহর জেলায় মহম্মদপুর গ্রামে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কতকগুলি রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৩৩]। মগধে বা বঙ্গে অদ্যাবধি মহারাজাধিরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কোন খোদিতলিপি আবিষ্কৃত হয় নাই। ৯৩ হইতে ৯৬ গৌপ্তাব্দের মধ্যে কোন সময়ে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের দেহাবসান হইয়াছিল এবং প্রথম কুমারগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। প্রথম কুমারগুপ্ত রাজ্যাভিষেকের পরে মহেন্দ্র বা মহেন্দ্রাদিত্য উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। ৯৬ গৌপ্তাব্দে, আধুনিক যুক্তপ্রদেশের ইটা জেলায়, বিলসড গ্রামে আবিষ্কৃত একটি শিলাস্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই শিলাস্তম্ভের খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ধ্রুবশর্ম্মা নামক একব্যক্তি প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালে একটি তোরণ, একটি মন্দির ও একটি ধর্ম্মসত্র নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন[৩৪]। এই ঘটনার দুই বৎসর পরে মাতৃদাস প্রমুখ কয়েকজন ব্যক্তি আর একটি সত্র স্থাপন করিয়াছিলেন। এলাহাবাদ জেলার কর্চ্ছনা তহশীলের অন্তর্গত গঢ়োয়াগ্রামে আবিষ্কৃত একটি শিলালিপিতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে[৩৫]। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালে উদয়গিরি পর্ব্বতগুহায় গোশর্ম্ম নামক জনৈক জৈনাচার্য্য ত্রয়োবিংশতিতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের একটি মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৩৬]। ১১৩ গৌপ্তাব্দে মথুরানগরে আর একটি জিনমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[৩৭]। চারি পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গদেশে রাজশাহী জেলার অন্তর্গত নাটোর মহকুমায় বড়ইগ্রাম থানার অধীন ধানাইদহ গ্রামে জনৈক মুসলমান কৃষক একখানি ক্ষুদ্র তাম্রশাসন আবিষ্কার করিয়াছিল। তাহার নিকট হইতে নাটোরের ভূস্বামী মৌলবী ইর্শাদ-আলি খাঁ-চৌধুরী তাম্রশাসনখানি পাইয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় এই আবিষ্কারের সংবাদ পাইয়া উহা মৌলবী ইর্শাদ-আলির নিকট হইতে লইয়া গিয়াছিলেন। ১৯০৬-৭ খৃষ্টাব্দে কলিকাতায় যে শিল্প-প্রদর্শনী হইয়াছিল, তাহাতে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ্ বাঙ্গালা দেশের পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধীয় কতকগুলি দ্রব্য প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে মৈত্রেয় মহাশয় নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনখানি পরিষদে প্রেরণ করিয়াছিলেন। তৎকালে পরিষদের অন্যতম সহকারী সম্পাদক পরমশ্রদ্ধাস্পদ ৺ব্যোমকেশ মুস্তফী মহাশয় আমাকে উহার পাঠোদ্ধারের ভার অপর্ণ করিয়াছিলেন। মৈত্রেয় মহাশয়ের অনুমতি অনুসারে উদ্ধৃতপাঠ পরিষদ্ পত্রিকায় ও এসিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। এই তাম্রশাসনের অনেক অংশ পাঠ করা যায় না এবং ইহা ক্রমশঃ ক্ষয় হইয়া যাইতেছে। যখন ইহা পরিষদে প্রেরিত হইয়াছিল তখন ইহার প্রথম ছত্রের প্রথমাংশে মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের নাম ছিল, কিন্তু এই অংশ ক্রমশঃ ক্ষয় হইয়া যাওয়ায় ইহার রক্ষার জন্য পরিষদের কর্ত্তৃপক্ষগণকে বিশেষ ব্যবস্থা করিতে হইয়াছিল। আট দশ বৎসর পূর্ব্বে মৈত্রের মহাশয় ইহা রাজশাহীতে ফিরাইয়া লইয়া গিয়াছেন। এই খোদিতলিপিতে মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের নাম, শতত্রয়োদশ গৌপ্তাব্দ (৪৩২ খৃষ্টাব্দ), শিবশর্ম্মা ও নাগশর্ম্মা নামক ক্ষুদ্রক-গ্রামনিবাসী ব্রাহ্মণদ্বয় এবং মহাখুষাপার বিষয় নামক প্রদেশের নাম উল্লিখিত আছে। বরাহস্বামী নামক জনৈক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ এই তাম্রশাসন দ্বারা কিঞ্চিৎ ভূমি লাভ করিয়াছিলেন এবং ইহা স্থহ্নেশ্বর দাস কর্ত্তৃক উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৩৮]।
এই তাম্রশাসনখানি বর্ত্তমান সময়ে রাজশাহীতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক এই তাম্রশাসনের নবোদ্ধৃত পাঠ প্রকাশ করিয়াছেন, তদনুসারে যে বিষয়ে প্রদত্ত ভূমি অবস্থিত ছিল, তাহার নাম খাটাপার এবং ইহা স্তম্ভেশ্বর দাস কর্ত্তৃক উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৩৯]। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে যুক্ত প্রদেশের ইটা জেলায় ভরডি ডিহ গ্রামে একটি শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হইয়াছিল, এই লিঙ্গের পাদমূলে যে খোদিত লিপি উৎকীর্ণ আছে, তাহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে ১১৭ গৌপ্তাব্দে (৪৩৬ খৃষ্টাব্দে) মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমার গুপ্তের প্রধান কর্ম্মচারী পৃথিবীষেণ, পৃথিবীশ্বর নামে একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৪০]। ইংরাজী ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে দিনাজপুর জেলায় ফুলবাড়ী রেলষ্টেশনের নিকটবর্ত্তী দামোদরপুর গ্রামের ছমীরুদ্দিন মণ্ডল কর্ত্তৃক নিযুক্ত কতকগুলি লোক হরিপুকুর এবং খোলাকুটী পুকুর নামক দুইটি পুষ্করিণীর মধ্য দিয়া পথ প্রস্তুতকালে পাঁচখানি তাম্রলিপি আবিষ্কার করিয়াছিল। এই পাঁচখানি তাম্রলিপি বর্ত্তমান সময়ে রাজশাহীতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির চিত্রশালায় রক্ষিত আছে এবং অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক এইগুলির পাঠোদ্ধার করিয়াছেন। এই তাম্রলিপিগুলি তাম্রশাসন নহে অর্থাৎ চক্রবর্ত্তী রাজা বা কোন সামন্তরাজ কর্ত্তৃক দেবতা বা ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের পত্র নহে। এই পাঁচখানি তাম্রলিপির একখানি হইতে জানা যায় যে, ১২৪ গৌপ্তাব্দে (৪৪৩ খৃষ্টাব্দে) পরম দৈবত পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ কুমারগুপ্তদেবের রাজ্যকালে পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তিতে চিরাতদত্ত নামক উপরিক শাসনকর্ত্তা ছিলেন। উপরিক উপাধিযুক্ত রাজকর্ম্মচারীর নাম অনেক তাম্রশাসনে ও শিলমোহরে পাওয়া গিয়াছে কিন্তু এই তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হইবার পূর্ব্বে তাঁহারা যে কি কার্য্য করিতেন তাহা জানা ছিল না। এই চিরাতদত্ত কর্ত্তৃক নিযুক্ত বেত্রবর্ম্মা নামক কুমারামাত্য তখন কোটীবর্ষ বিষয়ের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি এবং কোটীবর্ষ বিষয় ইহার পূর্ব্বে প্রথম মহীপালদেবের বাণগঢ়ে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে পরিচিত ছিল। প্রথম মহীপালদেবের রাজ্যকাল হইতে লক্ষ্মণসেনদেবের রাজ্যকাল পর্য্যন্ত দিনাজপুরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনসমূহে ভুক্তি ও বিষয়ের এই নামই পাওয়া যায়। দামোদরপুরে আবিষ্কৃত তাম্রলিপি দ্বারা প্রমাণ হইতেছে যে, বরেন্দ্রভূমির উত্তরাংশ সার্দ্ধ সহস্ৰ বৎসর পূর্ব্বেও কোটীবর্ষ নামে পরিচিত ছিল এবং গঙ্গার উত্তর তীরস্থ ভূভাগ পুণ্ড্রবর্দ্ধন আখ্যায় অভিহিত ছিল। দামোদরপুরের প্রথম তাম্রলিপি হইতে জানা যায় যে কর্প্পটিক নামক এক ব্রাহ্মণ কুমারামাত্য বেত্রবর্ম্মা, নগরশ্রেষ্ঠী ধৃতিপাল, সার্থবাহ বন্ধুমিত্র, প্রথমকুলিক ধৃতিমিত্র, প্রথমকায়স্থ শাম্বপাল প্রমুখ কর্ম্মচারিগণকে এক কুল্যবাপমাপের “অপ্রদা প্রহত খিল” ভূমি তিন দীনার মূল্যে ক্রয় করিবার জন্য আবেদন করিয়াছিলেন এবং উক্ত বিক্রয়ের আদেশ এই তাম্রশাসনদ্বারা লিপিবদ্ধ হইয়াছে[৪১]। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে স্বৰ্গীয় পণ্ডিত ভগবানলাল ইন্দ্রজী যমুনাতীরে, এলাহাবাদ জেলায় কর্চ্ছনা তহশীলের অন্তর্গত মনকুয়ার গ্রামে একটি বুদ্ধমূর্ত্তি আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই মূর্ত্তির পাদপীঠে একটি খোদিত লিপি উৎকীর্ণ আছে, ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ১২৯ গৌপ্তাব্দে (৪৪৮ খৃষ্টাব্দে) মহারাজাধিরাজ কুমারগুপ্তের রাজ্যে ভিক্ষু বুদ্ধমিত্র কর্ত্তৃক এই বুদ্ধপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[৪২]। দামোদরপুরের আর একখানি তাম্রলিপি হইতে জানা যায় যে, ১২৯ গৌপ্তাব্দে পরমদৈবত পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ কুমারগুপ্তের রাজ্যকালে উপরিক চিরাতদত্ত পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তিতে শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং কুমারামাত্য বেত্রবর্ম্মা তৎকর্ত্তৃক কোটীবর্ষ বিষয়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। উক্তবর্ষে একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কুমারামাত্য বেত্রবর্ম্মা, নগরশ্রেষ্ঠী ধৃতিপাল, সার্থবাহ বন্ধুমিত্র, প্রথমকুলিক ধৃতিমিত্র, প্রথম কায়স্থ শাম্বপাল প্রমুখ কর্ম্মচারিগণের নিকট পঞ্চমহাযজ্ঞ প্রবর্ত্তনের জন্য প্রতি কুল্যবাপের তিন দীনার মূল্যে কিঞ্চিৎ ভূমি ক্রয় করিবার জন্য আবেদন করিয়াছিল এবং তাহার আবেদন গ্রাহ্য হইয়াছিল। তাম্রশাসন ক্ষয়ের জন্য ক্রীত ভূমির পরিমাণ এবং যে ব্রাহ্মণ ভূমি ক্রয়ের জন্য আবেদন করিয়াছিল তাহা পড়িতে পারা যায় নাই। দ্বিতীয় তাম্রলিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, ১২৯ গৌপ্তাব্দেও উপরিক চিরাতদত্ত পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির এবং কুমারামাত্য বেত্রবর্ম্মা কোটীবর্ষ বিষয়ের শাসনকর্ত্তা ছিলেন[৪৩]। দামোদরপুরে আবিষ্কৃত এই দুইখানি তাম্রলিপি দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে যে, পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি অর্থাৎ বাঙ্গালাদেশের উত্তরভাগ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি বলিতে কেবল উত্তর বঙ্গ বুঝায় না, বর্ত্তমান সময়ে আমরা যে দেশকে পূর্ব্ববঙ্গ বলি তাহারও কিয়দংশ পুণ্ড্রবর্দ্ধন বা পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। লক্ষ্মণসেন দেবের পুত্র কেশবসেন দেবের রাজ্যকালের একখানি তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, সে সময়ে অর্থাৎ খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে বিক্রমপুর পর্য্যন্ত পুণ্ড্রবর্দ্ধন বা পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল[৪৪]।
১৩১ গৌপ্তাব্দে (৪৫০ খৃষ্টাব্দে) কাকনাদবোট (বর্ত্তমান সাঁচি) মহাবিহারে উপাসক সনসিদ্ধের ভার্য্যা উপাসিকা হরিস্বামিনী প্রত্যহ একটি করিয়া ভিক্ষু ভোজন করাইবার জন্য এবং প্রতিদিন দুইটি প্রদীপ প্রজ্বালিত করিবার জন্য চতুর্দ্দশ দীনার (সুবর্ণমুদ্রা) দান করিয়াছিলেন[৪৫]। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের শেষভাগে গুপ্তসাম্রাজ্য পরাক্রান্ত পুশ্যমিত্রীয় ও হূণজাতি কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল। পুশ্যমিত্রীয়দিগের সহিত যুদ্ধে সম্রাটের সেনা পরাজিত হইলে যুবরাজভট্টারক স্কন্দগুপ্ত বহুকষ্টে তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়াছিলেন[৪৬]। মধ্যএসিয়াবাসী হূণজাতি এই সময়ে তাহাদিগের মরুবাস পরিত্যাগ করিয়া প্রতীচ্যে রোমকসাম্রাজ্য ও প্রাচ্যে গুপ্তসাম্রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিল এবং খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণ প্রতিনিয়ত বর্ব্বর জাতির আক্রমণে অতিশয় বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। ১৩১ হইতে ১৩৬ গৌপ্তাব্দের (৪৫০-৪৫৫ খৃষ্টাব্দের) মধ্যে কোন সময়ে মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যু হইয়াছিল[৪৭]। কুমারগুপ্তের একাধিক বিবাহ ছিল এবং তাঁহার সুবর্ণ মুদ্রার রাজমূর্ত্তির সহিত দুইজন পট্টমহিষীর মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়[৪৮]। তাঁহার প্রথমা পত্নীর নাম অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই[৪৯]। অনুমিত হয় যে, স্কন্দগুপ্ত কুমারগুপ্তের প্রথমা পত্নীর গর্ভজাত। কুমারগুপ্তের দ্বিতীয়া পত্নীর নাম অনন্তদেবী[৫০]। অনন্তদেবীর গর্ভজাত পুত্র পুরগুপ্ত[৫১] স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।
সমুদ্রগুপ্তের ন্যায় প্রথম কুমারগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন এবং যজ্ঞের দক্ষিণা প্রদান করিবার জন্য নূতন প্রকারের সুবর্ণমুদ্রা মুদ্রাঙ্কন করিয়াছিলেন[৫২]। প্রথম কুমারগুপ্তের অশ্বমেধযজ্ঞের মুদ্রা সমুদ্রগুপ্তের অশ্বমেধের সুবর্ণমুদ্রার ন্যায়[৫৩]। বামনভটের ‘কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি’ গ্রন্থে প্রথম কুমারগুপ্তের উল্লেখ আছে। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সর্ব্ব প্রথমে এই শ্লোক আবিষ্কার করিয়াছিলেন[৫৪]। ডাঃ হর্ণলি অনুমান করিয়াছিলেন যে, ইহা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অপর পুত্রের নাম; কিন্তু পণ্ডিতপ্রবর কাশীনাথ পাণ্ডুরঙ্গ পাঠক[৫৫] ও জন আলান[৫৬] বলেন যে, চন্দ্রপ্রকাশ শব্দ কুমারগুপ্তের বিশেষণ মাত্র। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যের শেষভাগে পুশ্যমিত্রীয় ও হূণ যুদ্ধে রাজভাণ্ডার শূন্য হইলে, সম্রাট্ তাম্রমিশ্রিত সুবর্ণমুদ্রা ও তাম্রের উপরে রজতের ক্ষীণাবরণযুক্ত রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন[৫৭]।
মগধ ও বঙ্গের নানাস্থানে মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের সুবর্ণ-মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে, এই সকল সুবর্ণমুদ্রা পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হইতে পারেঃ–
(১) এক পৃষ্ঠে ধনুর্ব্বাণহস্তে রাজমূর্ত্তি ও অপর পৃষ্ঠে লক্ষ্মীমূর্ত্তি আছে। হুগলী জেলার জাহানাবাদ মহকুমার মাধবপুর গ্রামে এই জাতীয় তিনটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৫৮]। হুগলী জেলার মহানাদ গ্রামে এই জাতীয় আর একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহা এখন কলিকাতার চিত্রশালায় আছে[৫৯]। কনিংহাম গয়া জেলায় এই জাতীয় একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কার করিয়াছিলেন, এই মুদ্রাটি অতি নিকৃষ্ট সুবর্ণে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল[৬০]। ওয়ারেন্ হেষ্টিংসের শাসনকালে কালীঘাটে দুই শত সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে অন্ততঃ একটি এই জাতীয় ছিল[৬১]।
(২) এক দিকে অশ্বপৃষ্ঠে রাজমূর্ত্তি, অপর দিকে পদ্মাসনা লক্ষীমূর্ত্তি আছে। এই জাতীয় মুদ্রার দুইটি উপরিভাগ আছেঃ–
(ক) প্রথম উপরিভাগে রাজা অশ্বারোহণে দক্ষিণ দিকে গমন করিতেছেন। এই জাতীয় দুইটি মুদ্রা হুগলী জেলার মাধবপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৬২]।
(খ) রাজা অশ্বারোহণে বামদিকে গমন করিতেছেন। হুগলী জেলার মাধবপুর গ্রামে এই জাতীয় একটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৬৩]। এই জাতীয় আর একটি মুদ্রা প্রাচীন তাম্রলিপ্তি বন্দরে (মেদিনীপুর জেলার তমলুক নগর) আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৬৪]।
(৩) একদিকে রাজার মৃগয়ার চিত্র ও অপর দিকে সিংহবাহিনী দেবীমূর্ত্তি আছে। হুগলী জেলার মাধবপুর গ্রামে এই জাতীয় একটি মাত্র মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৬৫]।
(৪) একদিকে হস্তিপৃষ্ঠে রাজমূর্ত্তি ও অপরদিকে দেবীমূর্ত্তি অঙ্কিত আছে। এই জাতীয় একটি মাত্র মুদ্রা হুগলী জেলার মহানাদ গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা এখন কলিকাতার চিত্রশালায় আছে[৬৬]। এই জাতীয় আর একটিমাত্র মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল কিন্তু এখন তাহা কোথায় আছে বলিতে পারা যায় না।
(৫) একদিকে রাজা একটি ময়ূরকে আহার্য্য প্রদান করিতেছেন ও অপর দিকে ময়ূরবাহন কার্ত্তিকেয়মূর্ত্তি অঙ্কিত আছে। বর্দ্ধমান জেলার কোনও গ্রামে এই জাতীয় একটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল; তাহা এক্ষণে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় আছে[৬৭]। যশোহর জেলার মহম্মদপুর গ্রামে প্রথম কুমারগুপ্তের কতকগুলি রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৬৮]।
পুষ্করণাধিপতি চন্দ্রবর্ম্মার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নরবর্ম্মার পৌত্র বন্ধুবর্ম্মা (বিক্রমাব্দ ৪৯৩ অর্থাৎ ৪৩৭ খৃষ্টাব্দ), মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালে মালবদেশের শাসনকর্ত্তা ছিলেন[৬৯]। কুমারগুপ্তের রাজ্যকালে কুমারামাত্য পৃথিবীষেণ তাঁহার মন্ত্রী ছিলেন এবং তদনন্তর মহাবলাধিকৃত অর্থাৎ প্রধান সেনাপতির পদলাভ করিয়াছিলেন[৭০]।
মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পরে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। স্কন্দগুপ্ত যৌবরাজ্যে পুশ্যমিত্রীয় ও হূণগণকে পরাজিত করিয়া পিতৃরাজ্য রক্ষা করিয়াছিলেন। কথিত আছে যুবরাজভট্টারক স্কন্দগুপ্ত পিতৃকুলের বিচলিতা রাজলক্ষ্মী স্থির করিবার জন্য রাত্রিত্রয় ভূমিশয্যায় অতিবাহিত করিয়াছিলেন। প্রথমবার পরাজিত হইয়া হূণগণ উত্তরাপথ আক্রমণে বিরত হয় নাই, প্রাচীন কপিশা ও গান্ধার অধিকার করিয়া হূণগণ একটি নূতন রাজ্যস্থাপন করিয়াছিল। হূণরাজ তোরমাণ পঞ্চনদ প্রদেশে মহীশাসক সম্প্রদায়ের বৌদ্ধাচার্য্যগণের জন্য একটি সঙ্ঘারাম নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। রোট্ট সিদ্ধবৃদ্ধির পুত্র রোট্ট জয়বৃদ্ধি কর্ত্তৃক এই সঙ্ঘারাম নির্ম্মিত হইয়াছিল[৭১]। অনুমান হয় যে, স্কন্দগুপ্তের রাজ্যভিষেককালে পঞ্চনদে হূণজাতির নূতন রাজ্য স্থাপিত হইয়াছিল। সৌরাষ্ট্রে মৌর্য্যবংশীয় সম্রাট্ চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে গিরিনগরের অনতিদূরে অবস্থিত পর্ব্বতোপত্যকায় প্রাচীর নির্ম্মাণ করিয়া সৌরাষ্ট্রের শাসনকর্ত্তা বৈশ্যজাতীয় পুষ্যগুপ্ত সুদর্শন হ্রদের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোকের রাজত্বকালে প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা তুষাষ্ফ কর্ত্তৃক এই হ্রদের পয়ঃপ্রণালী নির্ম্মিত হইয়াছিল। ৭২ শকাব্দে (১৫০ খৃষ্টাব্দে) সৌরাষ্ট্রের শকজাতীয় মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামের রাজত্বকালে প্রবল ঝটিকায় সুদর্শন হ্রদের পাষাণনির্ম্মিত প্রাচীর ধ্বংস হইয়া যায় এবং রুদ্রদামের আদেশে তাঁহার অমাত্য সুবিশাখ কর্ত্তৃক পুনর্নির্ম্মিত হইয়াছিল[৭২]। ১৩৬ গৌপ্তাব্দে সুদর্শন হ্রদের পাষাণ-নির্ম্মিত প্রাচীর জলবৃদ্ধি ও ঝটিকার জন্য পুনরায় ধ্বংস হইয়াছিল। এই সময়ে পর্ণদত্ত সৌরাষ্ট্রের শাসনকর্ত্তা ছিলেন, তাঁহার পুত্র চক্রপালিত ১৩৭ গৌপ্তাব্দে (৪৫৬ খৃষ্টাব্দে) শতহস্ত দীর্ঘ ও প্রায় সপ্ততিহস্ত উচ্চ পাষাণ-নির্ম্মিত প্রাচীরদ্বারা সুদর্শনহ্রদ পুনরায় জলপূর্ণ করিয়াছিলেন। ১৩৮ গৌপ্তাব্দে চক্রপালিত এই হ্রদের তীরে একটি মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন[৭৩]। গির্ণার (গিরিনগর) পর্ব্বতগাত্রে উৎকীর্ণ খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ৪৫৭ খৃষ্টাব্দেও সৌরাষ্ট্র স্কন্দগুপ্তের অধিকারভুক্ত ছিল। ভাগলপুর হইতে উত্তর-পশ্চিমে চত্বারিংশৎ ক্রোশ দূরে অবস্থিত কহাউঁ গ্রামে আবিষ্কৃত শিলাস্তম্ভলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ১৪১ গৌপ্তাব্দে (৪৬০ খৃষ্টাব্দে) স্কন্দগুপ্তের রাজ্যকালে, মদ্রনামক এক ব্যক্তি ককুভ গ্রামে পঞ্চতীর্থঙ্করের প্রস্তরমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৭৪]। ১৪৬ গৌপ্তাব্দে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্ত্তী প্রদেশে মহারাজাধিরাজ স্কন্দগুপ্তের শাসনকর্ত্তা শর্ব্বনাগের অনুমত্যনুসারে দেববিষ্ণু নামক জনৈক ব্রাহ্মণ ইন্দ্রপুর নগরে ক্ষত্রিয়-জাতীয় বণিক্ অচলবর্ম্মা ও ভ্রূকুণ্ঠসিংহ কর্ত্তৃক নির্ম্মিত সূর্য্যদেবের মন্দিরে নিত্য একটি দীপ প্রজ্বালিত করিবার ব্যয় নির্ব্বাহার্থ কিঞ্চিৎ অর্থদান করিয়াছিলেন[৭৫]। অতএব ইহা অবশ্য স্বীকার্য্য যে, ৪৫৭ খৃষ্টাব্দেও অন্তর্ব্বেদী স্কন্দগুপ্তের অধিকারভুক্ত ছিল। এই সময় হইতে অন্তর্বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে গুপ্তবংশজাত সম্রাট্গণের ক্ষমতার হ্রাস হইতেছিল। প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তাগণ সম্রাটের নামোল্লেখ না করিয়াই ভূমিদান করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। পরিব্রাজকবংশীয় হস্তী ও সংক্ষোভ, উচ্ছকল্পের জয়নাথ ও সর্ব্বনাথ এবং বলভীর ধরসেন প্রভৃতি সামন্তরাজগণের তাম্রশাসন ইহার প্রমাণ। ৪৬৫ খৃষ্টাব্দের পরে হূণগণ পুনর্ব্বার ভারতবর্ষে প্রত্যাগমন করে ও বারবার গুপ্তসাম্রাজ্য আক্রমণ করে[৭৬]।
কোন্ সময়ে মহারাজাধিরাজ স্কন্দগুপ্তের মৃত্যু হইয়াছিল, তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই, তিনি সম্ভবতঃ চিরকুমার অবস্থায় জীবন যাপন করিয়াছিলেন। তাঁহার কতকগুলি অতীব দুষ্প্রাপ্য সুবর্ণমুদ্রায় রাজমূর্ত্তির দক্ষিণ পার্শ্বে একটি রমণীমূর্ত্তি দেখা যায়, ইহা দেখিয়া মুদ্রা-তত্ত্ববিদ্গণ অনুমান করিয়াছিলেন যে, স্কন্দগুপ্ত বিবাহ করিয়াছিলেন এবং মুদ্রার রমণীমূর্ত্তি তাঁহার পট্টমহাদেবীর মূর্ত্তি। সম্প্রতি পণ্ডিতপ্রবর জন্ আলান স্থির করিয়াছেন যে, স্কন্দগুপ্তের সুবর্ণমুদ্রার রমণীমূর্ত্তি শ্রী বা লক্ষ্মীদেবীর মূর্ত্তি, তাঁহার পট্টমহাদেবীর মূর্ত্তি নহে[৭৭]। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পরে তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা পুরগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পরে বোধ হয়, সিংহাসনের জন্য উভয় ভ্রাতায় বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল; কারণ, পুরগুপ্তের পৌত্র দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের রাজমুদ্রায় স্কন্দগুপ্তের নাম নাই[৭৮]। দীর্ঘকালব্যাপী হূণযুদ্ধে রাজকোষ শূন্য হইয়াছিল এবং মহারাজ স্কন্দগুপ্ত অবশেষে নিকৃষ্ট সুবর্ণের মুদ্রা প্রচলন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন[৭৯]। স্কন্দগুপ্তের সুবর্ণমুদ্রা অতীব দুষ্প্রাপ্য কিন্তু বঙ্গ ও মগধের নানা স্থানে তাঁহার মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে হুগলী জেলার মহানাদ গ্রামে স্কন্দগুপ্তের আর একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৮০]। কনিংহাম গয়া হইতে এই জাতীয় একটি সুবর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করিয়াছিলেন[৮১]। এই তিনটি মুদ্রাই ধনুর্ব্বাণহস্তে রাজমূর্ত্তিযুক্ত সুবর্ণমুদ্রা। ১৯০৪ খৃষ্টাব্দে মেদিনীপুর জেলায় রাজা ও রাজলক্ষ্মীযুক্ত স্কন্দগুপ্তের একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৮২]। ফরিদপুর জেলায় স্কন্দগুপ্তের আর একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৮৩]। যশোহর জেলায় মহম্মদপুর গ্রামে তাঁহার কতকগুলি রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৮৪]।
কিরূপে কিভাবে স্কন্দগুপ্তের রাজ্য শেষ হইয়াছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। সাত বৎসর পূর্ব্বে, ঐতিহাসিক-সমাজের মতানুসারে, স্কন্দগুপ্ত দীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়া, ৪৮০ খৃষ্টাব্দে অথবা তন্নিকটবর্ত্তী কোন সময়ে দেহত্যাগ করিয়াছিলেন; কিন্তু এই সাতবৎসরের মধ্যে অনেকগুলি শিলালিপি ও তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় এই মত পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। ১৪৮ গৌপ্তাব্দে (৪৬৭-৬৮ খৃঃ অব্দ) মুদ্রিত স্কন্দ্রগুপ্তের একটি রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে[৮৫]। ইহার পরে স্কন্দগুপ্তের রাজ্যের আর কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নাই। ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে বারাণসীর নিকটে সারনাথে তিনটি লিপিযুক্ত বুদ্ধমূর্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহার মধ্যে একটির পাদপীঠে যে শিলালিপি আছে, তাহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, কুমারগুপ্ত নামক একজন রাজা ১৫৪ গৌপ্তাব্দে (৪৭২-৭৩ খৃঃ অব্দ) সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন[৮৬]। শিলালিপিতে এই কুমারগুপ্তের বংশপরিচয় নাই কিন্তু যুক্তপ্রদেশের গাজীপুর জেলায় ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত একটি রাজকীয় মুদ্রা (শিল) আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, স্কন্দগুপ্তের পরে তাঁহার ভ্রাতা পুরগুপ্তের পৌত্র কুমারগুপ্ত সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন[৮৭]। ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত রাজকীয় মুদ্রার কুমারগুপ্তই যে সারনাথে আবিষ্কৃত শিলালিপির কুমারগুপ্ত, তাহার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ আবিষ্কৃত হয় নাই কিন্তু সারনাথের শিলালিপির কুমারগুপ্ত যে ভিন্ন ব্যক্তি সে বিষয়েরও কোন প্রমাণ নাই সুতরাং প্রমাণাভাবে উভয় লিপির কুমারগুপ্ত অভিন্ন বলিয়া গ্রাহ্য হইতে পারে। অধ্যাপক কাশীনাথ বিশ্বনাথ পাঠক প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত এই মত গ্রহণ করেন নাই[৮৮]। তাঁহাদিগের মতামতের জন্য পরিশিষ্ট গ দ্রষ্টব্য।
সারনাথে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে প্রমাণ হইতেছে যে স্কন্দগুপ্তের রাজ্যান্ত হইতে ১৫৪ গৌপ্তাব্দের পূর্ব্বে গুপ্তরাজবংশের তিনজন সম্রাট সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন। স্কন্দগুপ্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা পুরগুপ্ত সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন কারণ ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত রাজকীয় মুদ্রায় তাঁহার পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ উপাধি দেখিতে পাওয়া যায় এবং তাঁহার নামাঙ্কিত দুইটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে[৮৯]। ডাক্তার শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতানুসারে স্কন্দগুপ্ত ও পুরগুপ্ত একই ব্যক্তির[৯০] নামান্তর মাত্র কিন্তু কতকগুলি সুবর্ণমুদ্রায় স্কন্দগুপ্তের নাম এবং কতকগুলিতে একই স্থলে পুরগুপ্তের নাম থাকায় প্রমাণ হইতেছে যে স্কন্দগুপ্ত ও পুরগুপ্ত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি।
পুরগুপ্তের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র নরসিংহগুপ্ত সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। পুরগুপ্তের পত্নীর নাম বৎস দেবী এবং নরসিংহগুপ্ত বৎসদেবীর গর্ভজাত পুত্র[৯১]। পুরগুপ্তের কোন খোদিত লিপি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। তাঁহার নামাঙ্কিত সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে কিন্তু ভারতবর্ষের কোনও সংগ্রহশালায় এই মুদ্রা আছে বলিয়া বোধ হয় না। ইংলণ্ডে ব্রিটিশ মিউজিয়মে এই জাতীয় দুইটি মুদ্রা রক্ষিত আছে। কতকগুলি সুবর্ণমুদ্রায় প্রকাশাদিত্য নামক একজন রাজার নাম দেখিতে পাওয়া যায়। এই জাতীয় মুদ্রাগুলি স্কন্দগুপ্ত ও পুরগুপ্তের মুদ্রার অনুরূপ। স্বৰ্গীয় ডাক্তার হর্ণলি এবং স্মিথ অনুমান করিতেন যে এগুলি পুরগুপ্তের মুদ্রা[৯২]। শ্রীযুক্ত জন্ আলান অনুমান করেন যে পুরগুপ্ত সম্ভবতঃ শ্রীপ্রকাশাদিত্য ও শ্রীবিক্রমাদিত্য এই উভয় উপাধি ধারণ করেন নাই[৯৩]।
সারনাথের শিলালিপি ও দামোদরপুরের তাম্রলিপি আবিষ্কারের পূর্ব্বে ডাক্তার স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ অনুমান করিতেন যে নরসিংহগুপ্ত মালবরাজ যশোধর্ম্মদেবের সহিত মিলিত হইয়া উত্তরাপথে হূণ-সাম্রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন[৯৪]। তাঁহাদিগের এই বিশ্বাসের মূল চীনদেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন-থ্সং বা ইউয়ান-চোয়াংএর উক্তি। চৈনিক পরিব্রাজক লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, মগধরাজ বালাদিত্য হূণরাজ মিহিরকুলকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৯৫]। এই মগধরাজ বালাদিত্য যে পুরগুপ্তের পুত্র নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য, এই মত সর্ব্ব প্রথমে ডাক্তার হর্ণলি কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল কিন্তু পরে তিনি এই মত প্রত্যাহার করিয়াছিলেন[৯৬]। ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত জন্ আলানও এই মত গ্রহণ করিতে পারেন নাই[৯৭]। সারনাথের শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রমাণ হইতেছে যে এই মত একেবারে অগ্রাহ্য। নরসিংহগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত যখন ১৫৪ গৌপ্তাব্দে (৪৭২-৭৩ খৃঃ অব্দ) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন ইহা নিশ্চয় যে তাঁহার পিতা নরসিংহগুপ্ত এই তারিখের পূর্ব্বে দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। মালবরাজ যশোধর্ম্মদেব এই সময়ের ষষ্টিবৰ্ষ পরে মালবের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন[৯৮]। তাঁহার একটিমাত্র শিলালিপিতে তারিখ পাওয়া গিয়াছে। এই তারিখ বিক্রম সম্বৎসর ৫৮৯ (৫৩৩ খৃঃ অব্দ)[৯৯] সুতরাং তিনি নরসিংহগুপ্তের দেহত্যাগের ৬১ বৎসর পরে জীবিত ছিলেন, অতএব তাঁহার নরসিংহগুপ্তের সমসাময়িক ব্যক্তি হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। কোন্ সময়ে কি ভাবে নরসিংহগুপ্তের মৃত্যু হইয়াছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। নরসিংহগুপ্তের কোন শিলালিপি বা তাম্রশাসন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় বাই। ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের তাম্রশাসন হইতে জানিতে পারা যায় যে তাঁহার পত্নীর নাম মহালক্ষ্মী দেবী[১০০]। ভারতবর্ষের নানাস্থানে নরসিংহগুপ্তের মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইংরাজরাজ্যের প্রথম যুগে ওয়ারেণ হেষ্টিংসের শাসনকালে কালীঘাটে নরসিংহগুপ্তের কতকগুলি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১০১]। ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমায় নরসিংহগুপ্তের একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১০২]। বীরভূম জেলার অন্তর্গত নান্নুর গ্রামে আবিষ্কৃত নরসিংহগুপ্তের একটি সুবর্ণমুদ্রা উক্ত গ্রামবাসী শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের নিকট আছে।
নরসিংহগুপ্তের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন। যুক্তপ্রদেশের গাজীপুর জেলায় ভিটরী গ্রামে দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের রাজকীয় মুদ্রা (শিল) আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইহা তাম্রমিশ্রিত রজতের উপরে মুদ্রিত[১০৩]। ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে কালীঘাটে দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের বহু সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১০৪]। দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত সম্ভবতঃ শৈশবে সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হইবার পূর্ব্বেই সিংহাসনচ্যুত হইয়াছিলেন অথবা দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। কারণ সারনাথে আবিষ্কৃত আর একখানি শিলালিপি হইতে জানা গিয়াছে যে, ১৫৭ গৌপ্তাব্দে (৪৭৬ খৃঃ অব্দ); বুধগুপ্ত নামক আর একজন রাজা গুপ্তসাম্রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন[১০৫]। সারনাথের শিলালিপিদ্বয় ও দামোদরপুরের তাম্রলিপিগুলি আবিষ্কৃত হইবার পূর্ব্বে ঐতিহাসিকগণ স্থির করিয়াছিলেন যে দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের মৃত্যুর সহিত প্রাচীন গুপ্তরাজবংশ লুপ্ত হইয়াছিল এবং এই সময়ে অথবা ইহার কিছু পূর্ব্বে গুপ্তসাম্রাজ্য ধ্বংস হইয়াছিল কিন্তু সারনাথে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তের শিলালিপি এবং দামোদরপুরে আবিষ্কৃত দুইখানি তাম্রলিপি হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, স্কন্দগুপ্তের পরে বুধগুপ্ত নামক একজন রাজার অধিকার গৌড়দেশ ও মধ্যদেশ হইতে মালবদেশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই বুধগুপ্ত কে ছিলেন তাহা অদ্যাপি জানিতে পারা যায় নাই। তাঁহার নাম দেখিয়া বোধ হয় যে তিনি প্রাচীন গুপ্তরাজবংশ সম্ভূত। সারনাথের শিলালিপি ও দামোদরপুরের তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হইবার পূর্ব্বেও বুধগুপ্তের অস্তিত্ব অবিদিত ছিল না, কারণ বহুপূর্ব্বে মধ্যপ্রদেশে ইরাণ নামক স্থানে আবিষ্কৃত একখানি শিলালিপি হইতে জানা গিয়াছিল যে, ১৬৫ গৌপ্তাব্দে বুধগুপ্ত নামক একজন রাজা উক্ত ভূভাগের অধিপতি ছিলেন এবং তাঁহার অধীনে মহারাজা উপাধিধারী সুরশ্মিচন্দ্র নামক একজন সামন্তরাজা কালিন্দী ও নর্ম্মদার মধ্যবর্ত্তী ভূভাগ শাসন করিতেন[১০৬]। দুঃখের বিষয় এই যে দামোদরপুরে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তের রাজ্যকালের তাম্রলিপিগুলিতে যে অংশে তারিখ ছিল তাহা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে[১০৭] সুতরাং গৌড়দেশে কতকাল পর্য্যন্ত বুধগুপ্তের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। সারনাথে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, ১৫৭ গৌপ্তাব্দে (৪৭৬ খৃঃ অব্দ) বারাণসীতে অর্থাৎ মধ্যদেশে বুধগুপ্তের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। দামোদরপুরের তাম্রলিপিতে যদিও তারিখ নাই তথাপি ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে যে পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি কিছুকাল বুধগুপ্তের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। অতএব ইহা অনুমান করা যাইতে পারে যে, যে সময়ে মধ্যদেশ বুধগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল সেই সময়ে অথবা তাহার অব্যবহিত পূর্ব্বে বা পরে গৌড়দেশও তাঁহার রাজ্যভুক্ত ছিল। অতএব ইহা অবশ্য স্বীকার্য্য যে এই সময়ে গুপ্ত-সাম্রাজ্যের কেন্দ্র মগধও বুধগুপ্তের অধিকারভুক্ত ছিল। ইরাণে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, এই সময়ে অর্থাৎ সারনাথে আবিষ্কৃত শিলালিপির তারিখ হইতে আটবৎসর পরে, ১৬৫ গৌপ্তাব্দে (৪৮৪-৮৫ খৃঃ অব্দ) মালবদেশ ও যমুনার দক্ষিণ ভাগ, অর্থাৎ যে ভূখণ্ড মোগলযুগে মালবসুবা ও আগরাসুবা নামে পরিচিত ছিল[১০৮], তাহা বুধগুপ্তের অধিকারভুক্ত ছিল। মধ্যদেশের পশ্চিমভাগ বুধগুপ্তের অধিকারভুক্ত ছিল কি না তাহা প্রমাণাভাবে বলিতে পারা যায় না। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, দামোদরপুরে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তের রাজ্যকালের তাম্রলিপিগুলিতে তারিখ নাই, সুতরাং বুধগুপ্তের অধিকার মধ্যদেশে, মগধে ও গৌড়দেশে কত দিন পর্য্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। তাঁহার যে সমস্ত রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে, সেগুলি ১৭৫ গৌপ্তাব্দে (৪৯৫-৯৬ খৃঃ অব্দ) মুদ্রিত হইয়াছিল[১০৯]। এই সমস্ত মুদ্রার তারিখ হইতে প্রমাণ হইতেছে যে মালবদেশে বুধগুপ্তের অধিকার ১৬৫ গৌপ্তাব্দ হইতে ১৭৫ গৌপ্তাব্দ (৪৮৪-৪৯৫ খৃঃ অব্দ) পর্য্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। কিরূপে কি ভাবে বুধগুপ্তের রাজ্যশেষ হইয়াছিল তাহা প্রমাণাভাবে বলিতে পারা যায় না। তাঁহার রাজ্যকালের দুইখানি শিলালিপি ও দুইখানি তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। শিলালিপি দুইখানি বারাণসীর নিকট সারনাথে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। প্রথম শিলালিপি অনুসারে অভয়মিত্র নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু গৌপ্তাব্দের ১৫৭ বৎসরে একটি বুদ্ধমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করাইয়াছিলেন[১১০]। দ্বিতীয় শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে উক্ত বৌদ্ধ ভিক্ষু ১৫৭ গৌপ্তাব্দের বৈশাখ মাসের সপ্তমীতে ছত্র এবং পদ্মাসনের সহিত আর একটি বুদ্ধমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করাইয়াছিলেন[১১১]। তাম্রলিপি দুইখানি দিনাজপুর জেলায় দামোদরপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। প্রথম তাম্রলিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, বুধগুপ্তের রাজ্যকালে উপরিক, মহারাজ ব্রহ্মদত্ত পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির শাসনকর্ত্তা ছিলেন। এই সময়ে নাভক নামক একজন গ্রামীক, কতকগুলি ব্রাহ্মণ বাস করাইবার জন্য, এককুল্যবাপ পরিমাণ ভূমি ক্রয় করিতে ইচ্ছুক হওয়ায়, তাহার আবেদনে পলাশবৃন্দক গ্রাম হইতে উক্ত ভূমি বিক্রয়ের আদেশ প্রদত্ত হইয়াছিল। উক্ত ভূমি সম্ভবতঃ চণ্ডগ্রামে অবস্থিত ছিল। নাভকের নিকট দুই দীনার মূল্য পাইয়া উক্ত পরিমাণ ভূমি যাহা বায়িগ্রামের উত্তরপার্শ্বে অবস্থিত ছিল, তাহা নাভককে প্রদত্ত হইয়াছিল। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক অনুমান করেন যে, এই তাম্রলিপি ১৬৩ গৌপ্তাব্দে (৪৮১-৮২ খৃঃ অব্দ) উৎকীর্ণ হইয়াছিল[১১২]। দামোদরপুরে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তের রাজ্যকালের দ্বিতীয় তাম্রলিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, বুধগুপ্তের রাজ্যকালে উপরিক-মহারাজ জয়দত্ত পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং তাঁহার অধীনে আয়ুক্তক সাণ্ডক বা গাণ্ডক কোটিবর্ষ বিষয়ের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। এই সময়ে নগরশ্রেষ্ঠী রিভুপাল কোকামুখস্বামী এবং শ্বেতবরাহস্বামী নামক দেবদ্বয়ের জন্য দুইটি মন্দির ও দুইটি কোষ্ঠিকা নির্ম্মাণ করিবার জন্য হিমবচ্ছিখর নামক স্থানে কিঞ্চিৎ বাস্তুভূমি ক্রয় করিবার আবেদন করিয়াছিলেন। এই আবেদনানুসারে পুস্তপাল (শেরেস্তাদার বা মহাফেজ) বিষ্ণুদত্ত, বিজয়নন্দী এবং স্থাণুনন্দী, এই রিভুপাল পূর্ব্বে হিমবচ্ছিখর নামক স্থানে কোকামুখস্বামী ও শ্বেতবরাহস্বামী নামক দেবদ্বয়কে একাদশ কুল্যবাপ পরিমিত ভূমি পূর্ব্বে দান করিয়াছেন স্থির করায়, প্রতি কুল্যবাপের তিন দীনার মুল্য অনুসারে কিঞ্চিৎ ভূমি বিক্রয় করিবার আদেশ প্রদত্ত হইয়াছিল। এই আদেশ কোন অজ্ঞাত বৎসরের ফাল্গুন মাসের পঞ্চদশ দিবসে প্রদত্ত হইয়াছিল[১১৩]। অদ্যাবধি বুধগুপ্তের কোনও সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নাই। প্রাচীন গুপ্ত-রাজবংশের যে আকারের এবং যে রূপের সুবর্ণমুদ্রা উত্তরাপথের সর্ব্বত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, বুধগুপ্তের সে জাতীয় মুদ্রা আবিষ্কৃত না হওয়ায় অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করিতেন যে, বুধগুপ্তের রাজ্য মালবদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল[১১৪] কিন্তু সম্প্রতি সারনাথের শিলালিপি ও দামোদরপুরের তাম্রলিপিদ্বয় আবিষ্কৃত হওয়ায় স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে যে, উত্তরাপথের পূর্ব্বাংশ তাঁহার অধিকারভুক্ত ছিল। বুধগুপ্তের মাত্র এক জাতীয় রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই জাতীয় মুদ্রা প্রথম কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের রাজ্যকালে মালব ও সৌরাষ্ট্রে প্রচলনের জন্য মুদ্রিত হইত। এই কারণে পূর্ব্বে ঐতিহাসিকগণ বুধগুপ্তকে মালব দেশের গুপ্তবংশীয় রাজা আখ্যায় অভিহিত করিতেন। বুধগুপ্তের যে কয়টি রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা ইংলণ্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত আছে। ভারতবর্ষের কোন সংগ্রহশালায় বুধগুপ্তের কোন রজতমুদ্রা রক্ষিত আছে কি না জানিতে পারা যায় নাই।
বুধগুপ্তের মৃত্যু অথবা সিংহাসনচ্যুতির পরে গুপ্তবংশীয় আর একজন রাজা সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। স্বর্গীয় ডাক্তার ফ্লীটের মতানুসারে ইঁহার নাম ভানুগুপ্ত। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক অনুমান করেন যে দামোদরপুরে আবিষ্কৃত একখানি তাম্রলিপিতে মহারাজাধিরাজ শ্রীভানুগুপ্তের নাম আছে। মধ্যপ্রদেশে ইরাণে আবিষ্কৃত একখানি শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে ১৯১ গৌপ্তাব্দে (৫১০ খৃঃ অব্দ), ভানুগুপ্ত নামক একজন রাজার অনুচর, রাজা মাধবের পুত্র গোপরাজের পত্নী পতির সহমৃতা হইয়াছিলেন[১১৫]। দামোদরপুরে আবিষ্কৃত পঞ্চম তাম্রলিপি হইতে জানিতে পারা যায় ষে ২১৪ গৌপ্তাব্দে (৫৩৩-৩৪ খৃঃ অব্দ) পরমদৈবত পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্রীভানুগুপ্তদেবের রাজ্যকালে রাজপুত্র দেবভট্টারক (নাম অস্পষ্ট), যখন পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির উপরিক-মহারাজ ছিলেন, তখন কোটীবর্ষ বিষয়ের বিষয়পতি স্বয়ম্ভূদেব তৎকর্ত্তৃক কোটীবর্ষ বিষয়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। এই সময়ে অযোধ্যাবাসী অমৃতদেব নামক এক কুলপুত্র, বিষয়পতি স্বয়ম্ভূদেব, আর্য্য নগরশ্রেষ্ঠী রিভুপাল, সার্থবাহ স্থাণুদত্ত, প্রথমকুলিক মতিদত্ত এবং প্রথমকায়স্থ স্কন্দপালকে এই দেশের বনে ভগবান শ্বেতবরাহস্বামীর মন্দির সংস্কারের জন্য এবং বলি, চরু, সত্ত্র, গব্য, ধূপ, পুষ্প, মধুপর্ক, দীপ প্রভৃতি উপযোগের জন্য এক কুল্যবাপ পরিমিত অপ্রদা খিল ভূমি, তিনদীনার মূল্যে ক্রয় করিবার জন্য আবেদন করিয়াছিলেন; তদনুসারে উক্ত অমৃতদেবের নিকট হইতে পঞ্চদশ দীনার মূল্য গ্রহণ করিয়া, স্বচ্ছন্দপাটক এবং লবঙ্গসিকায় দুইকুল্যবাপ বাস্তু, সাটু বনাশ্রমকে এককুল্যবাপ বাস্তু, পঞ্চকুল্যবাপকের উত্তরে এবং জম্বুনদীর পূর্ব্বে এককুল্যবাপ এবং পুরণ বৃন্দিকহরির পাটকের পূর্ব্বদিকে এককুল্যবাপ বাস্তুভূমি বিক্রয় করিবার আদেশ প্রদত্ত হইয়াছিল। এই আদেশ ২১৪ গৌপ্তাব্দে ভাদ্রমাসের পঞ্চম দিবসে প্রদত্ত বা লিপিবদ্ধ হইয়াছিল[১১৬] সুতরাং ইরাণের শিলালিপি এবং দামোদরপুরের তাম্রলিপি হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, ভানুগুপ্ত নামক একজন রাজা ১৯০ গৌপ্তাব্দ হইতে ২২৪ গৌপ্তাব্দ পর্য্যন্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাঁহার অধিকার গৌড়দেশের পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি হইতে মালবদেশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভানুগুপ্তের নাম দেখিয়া বোধ হয় যে তিনি গুপ্তরাজবংশজাত। তাঁহার সহিত প্রাচীন গুপ্তসম্রাটগণের কি সম্বন্ধ ছিল বা তাঁহার সহিত বুধগুপ্তের কি সম্বন্ধ ছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। ইরাণে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, ভানুগুপ্তের রাজ্যকালে গোপরাজ নামক এক রাজা তাঁহার সহিত সম্ভবতঃ মগধ হইতে মালবদেশে আসিয়াছিলেন এবং তথায় যুদ্ধে নিহত হইয়াছিলেন। ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, ভানুগুপ্ত ১৯১ গৌপ্তাব্দের (৫১০ খৃঃ অব্দ) শ্রাবণ মাসের পূর্ব্বে যুদ্ধযাত্রায় মগধ হইতে মালবে আসিয়াছিলেন। যুদ্ধের ফল বলিতে পার ষায় না। সম্ভবতঃ এই সময় হইতে মালবদেশ বার বার হূণগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া অবশেষে গুপ্তসাম্রাজ্য বিচ্যুত হইয়াছিল। ইহার প্রমাণ আর দুইখানি শিলালিপি হইতে পাওয়া যায়। ইরাণে আবিষ্কৃত আর একখানি শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, বুধগুপ্তের রাজ্যকালে সুরশ্মিচন্দ্র নামক একজন রাজা যমুনা ও নর্ম্মদার মধ্যবর্ত্তী ভূভাগের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। এই সময়ে অর্থাৎ ১৬৫ গৌপ্তাব্দে (৪৮৪ খৃঃ অব্দ) ইন্দ্রবিষ্ণুর প্রপৌত্র, বরুণবিষ্ণুর পৌত্র, হরিবিষ্ণুর পুত্র, মহারাজ মাতৃবিষ্ণু ও তাঁহার কনিষ্ঠভ্রাতা ধন্যবিষ্ণু, বিষ্ণুর ধ্বজস্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন[১১৭]। ইরাণে আবিষ্কৃত তৃতীয় শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, হূণরাজ মহারাজাধিরাজ শ্রীতোরমাণের রাজ্যের প্রথমবর্ষে, ফাল্গুনমাসের দশমদিবসে ইন্দ্রবিষ্ণুর প্রপৌত্র, বরুণবিষ্ণুর পৌত্র, হরিবিষ্ণুর পুত্র স্বর্গগত মহারাজ মাতৃবিষ্ণুর অনুজ ভ্রাতা ধন্যবিষ্ণু, ভগবান বরাহমূর্ত্তি অর্থাৎ নারায়ণের একটি শিলাপ্রাসাদ নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন[১১৮]। পিতৃকুলের পরিচয় হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, ১৬৫ গৌপ্তাব্দের শিলালিপির মহারাজ মাতৃবিষ্ণু ও তাঁহার কনিষ্ঠভ্রাতা ধন্যবিষ্ণু এবং হূণরাজ তোরমাণের রাজ্যের প্রথমবর্ষের ধন্যবিষ্ণু ও তাঁহার স্বর্গগত জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহারাজ মাতৃবিষ্ণু অভিন্ন। অতএব ইহা নিশ্চয় যে, ১৬৫ গৌপ্তাব্দের পরে পঞ্চবিংশ অথবা ত্রিংশতবর্ষ মধ্যে মালবদেশের ঐরকিণ (বর্ত্তমান ইরাণ) বিষয় গুপ্তসাম্রাজ্যবিচ্যুত হইয়া হূণরাজ তোরমাণের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। ইহা হইতে অনুমান করা যাইতে পারে, যে যুদ্ধে গোপরাজ নিহত হইয়াছিলেন তাহার অব্যবহিত পরেই মালবদেশ ভানুগুপ্তের অধিকারচ্যুত হইয়াছিল। কোন্ সময়ে মধ্যদেশ গুপ্তরাজগণের হস্তবিচ্যুত হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারা যায় না; তবে দামোদরপুরে আবিষ্কৃত তাম্রলিপি হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, ভানুগুপ্ত ২১৪ গৌপ্তাব্দ (৫৩৩ খৃঃ অব্দ) পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং এই সময় পর্য্যন্ত গৌড়দেশ তাঁহার অধিকারভুক্ত ছিল। ভানুগুপ্তের কোন মুদ্রা অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
ভানুগুপ্তের জীবিতকালে অথবা তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মালবরাজ যশোধর্ম্মদেব মগধ, গৌড় ও বঙ্গ অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহার মন্দশোরে আবিষ্কৃত থোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, হিমালয় হইতে মহেন্দ্রগিরি পর্য্যন্ত, লৌহিত্য বা ব্রহ্মপুত্রতীর হইতে পশ্চিমসমুদ্র পর্য্যন্ত তাঁহার অধিকার বিস্তৃত হইয়াছিল। যশোধর্ম্মদেবের যে শিলালিপিতে তাঁহার ব্রহ্মপুত্রতীর পর্য্যন্ত অধিকার বিস্তারের বর্ণনা আছে, তাহা ৫৮৯ বিক্রম সম্বৎসরে (৫৩২-৩৩ খৃঃ অব্দ) উৎকীর্ণ হইয়াছিল[১১৯] কিন্তু দামোদরপুরে আবিষ্কৃত ভানুগুপ্তের তাম্রলিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, তিনি ২১৪ গৌপ্তাব্দে (৫৩৩ খৃঃ অব্দ) জীবিত ছিলেন। মন্দশোরের শিলালিপি যে সময়ে উৎকীর্ণ হইয়াছিল, অবশ্য তাহার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বেই যশোধর্ম্মদেব মহেন্দ্রগিরি হইতে ব্রহ্মপুত্রতীর পর্য্যন্ত জয় করিয়াছিলেন সুতরাং যশোধর্ম্মদেবের এই দিগ্বিজয়ের সময়ে ভানুগুপ্ত জীবিত ছিলেন এবং সম্ভবতঃ তৎকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। ভানুগুপ্তের পরে গুপ্তবংশীয় রাজগণের কোন পরিচয় বা বিবরণ কোন শিলালিপি, তাম্রলিপি বা তাম্রশাসনে পাওয়া যায় না।
তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত, বিষ্ণুগুপ্ত ও জয়গুপ্ত প্রভৃতি রাজগণের নামাঙ্কিত বহু সুবর্ণমুদ্রা মগধে ও বঙ্গে আবিষ্কৃত হইয়াছে কিন্তু তাঁহাদিগের সহিত প্রাচীন-গুপ্তবংশের সম্বন্ধ নির্ণয় করিবার কোন উপায়ই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে কালীঘাটে যে সমস্ত সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তন্মধ্যে দ্বাদশাদিত্য উপাধিধারী তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও চন্দ্রাদিত্য উপাধিধারী বিষ্ণুগুপ্তের বহু মুদ্রা ছিল। কালীঘাটে আবিষ্কৃত তৃতীয় চন্দ্রগুপ্তের তিনটি ও বিষ্ণুগুপ্তের পঞ্চদশটি সুবর্ণমুদ্রা লগুনের ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত আছে[১২০]। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত রাঙ্গমাটী গ্রামে বিষ্ণুগুপ্তের একটি ও জয়গুপ্তের একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১২১]।
গুপ্তরাজবংশের অধিকারকালে উত্তরাপথে ভারতীয়-শিল্প উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইয়াছিল। খৃষ্টীয় চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর যে সমস্ত নিদর্শন উত্তরাপথে আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, এই যুগই ভারতীয়-শিল্পের চরম উন্নতির যুগ। গুপ্তাধিকারকালের বহু মন্দির, প্রাসাদ, ধাতু ও প্রস্তর-নির্ম্মিত মূর্ত্তি, স্তম্ভ ও খোদিত চিত্র (basrelief) আবিষ্কৃত হইয়াছে। মথুরায় ও বারাণসীতে গুপ্তাধিকারকালের শিল্প-নিদর্শন সর্ব্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে আবিষ্কৃত হইয়াছে। বঙ্গ ও মগধে আবিষ্কৃত নিদর্শনসমূহের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত অল্প হইলেও মূর্ত্তিগুলির শিল্প-চাতুর্য্য অতীব বিস্ময়জনক। গুপ্তাধিকারকালের একখানি প্রস্তরে খোদিত চিত্র (basrelief) ও একটি পিত্তল-নির্ম্মিত বুদ্ধমূর্ত্তির চিত্র প্রকাশিত হইল। প্রস্তরে খোদিত চিত্রটি পাটনা জেলার চণ্ডীমৌ গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহাতে “কিরাতার্জ্জুনীয়ের” দুইটি চিত্র আছে। প্রস্তরফলকের বামার্দ্ধে অর্জ্জুন যুদ্ধে পরাজিত হইয়া কিরাতরূপী মহাদেবের চরণ বন্দনা করিতেছেন ও দক্ষিণার্দ্ধে কিরাতরূপী মহাদেব সন্তুষ্ট হইয়া অর্জ্জুনকে আত্মস্বরূপ প্রদর্শন করিতেছেন, অর্জ্জুন কৈলাসপর্ব্বত-শিখরে আসীন হর-পার্ব্বতীকে দর্শন করিতেছেন। একটি স্তম্ভগাত্রে এই চিত্রটি উৎকীর্ণ আছে এবং সেই স্তম্ভের চারিদিকে চারিটি ফলকে (panel) কিরাতার্জ্জুনীয়ের আখ্যানক সম্পূর্ণরূপে চিত্রিত হইয়াছে। এই স্তম্ভটি এখন কলিকাতার চিত্রশালায় আছে। বুদ্ধ-মূর্ত্তিটি গয়া নগরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ভাগলপুরের প্রসিদ্ধ ভূম্যধিকারী স্বৰ্গীয় রায় সূর্য্যনারায়ণ সিংহ বাহাদুরের কনিষ্ঠ পুত্র ইহা বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে প্রদান করিয়াছেন। মূর্ত্তির নিম্নে একখানি খোদিতলিপিযুক্ত পিত্তলফলক সংলগ্ন ছিল। এই খোদিতলিপি ‘ভৈক্ষুকী লিপি’ নামক বৌদ্ধ-সঙ্ঘের গোপনীয় লিপিতে উৎকীর্ণ। কেম্ব্রিজের অধ্যাপক মৃত ডাক্তার বেণ্ডল নেপালে আবিষ্কৃত পুথি হইতে এই লিপির বর্ণমালার মূল্য নির্দ্ধারণ করিয়াছিলেন। খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, রাণক যক্ষপালিতের পুত্র আহবমল্ল কর্ত্তৃক এই মূর্ত্তিটি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল (বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ২০ ভাগ, পৃঃ ১৫৩-৫৬)।
পরিশিষ্ট (গ)
গুপ্তরাজবংশ:–
শ্রীগুপ্ত | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ঘটোৎকচগুপ্ত | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
(১) প্রথম চন্দ্রগুপ্ত | কুমারদেবী | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||
(২) সমুদ্রগুপ্ত | দত্তদেবী | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||
কুবেরনাগা | (৩) দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাঙ্ক বা বিক্রমাদিত্য | ধ্রুবদেবী বা ধ্রুবস্বামিনী | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
রুদ্রসেন (বাকাটক বংশীয় রাজা) | প্রভাবতী | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||
দিবাকরসেন | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
? | (৪) প্রথম কুমারগুপ্ত | অনন্তদেবী | গোবিন্দগুপ্ত ইনি সম্ভবতঃ মগধের গুপ্তরাজবংশের আদিপুরুষ (পরিশিষ্ট ঘ) | ||||||||||||||||||||||||||||||||||
(৫) স্কন্দগুপ্ত বিক্রমাদিত্য | (৬) পুরগুপ্ত প্রকাশাদিত্য (?) | শ্রীবৎসদেবী | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
(৭) নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য | মহালক্ষ্মীদেবী | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||
(৮) দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
দ্বাদশাদিত্য | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বিষ্ণুগুপ্ত চন্দ্রাদিত্য | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
জয়গুপ্ত প্রকাণ্ডযশা | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||
গুপ্তবংশের সম্রাট্গণের অধিকাংশ খোদিতলিপি ডাক্তার ফ্লিটের Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহাতে নিম্নলিখিত অত্যাবশ্যকীয় খোদিতলিপির উদ্ধৃত পাঠ প্রকাশিত হইয়াছিল:—
- (১) এলাহাবাদে অশোক-স্তম্ভে উৎকীর্ণ হরিষেণ-রচিত সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তি।
- (২) ইরাণে আবিষ্কৃত সমুদ্রগুপ্তের খোদিতলিপি।:(৩) উদয়গিরি পর্ব্বতগুহায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের খোদিতলিপি—গৌপ্তাব্দ ৮২।:(৪) মথুরায় আবিষ্কৃত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি।:(৫) সাঞ্চীতে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি—গৌপ্তাব্দ ৯৩।:(৬) উদয়গিরি গুহায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি।:(৭) গঢ়োয়া গ্রামে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি—গৌপ্তাব্দ ৮৮।:(৮) গঢ়োয়া গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি।:(৯) গঢ়োয়া গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি—গৌপ্তাব্দ ৯৮।:(১০) বিলসড্ গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের শিলাস্তম্ভলিপি—গৌপ্তাব্দ ৯৬।:(১১) মনকুয়ার গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধমূর্ত্তির খোদিতলিপি—গৌপ্তাব্দ ১২৯।:(১২) বিহার নগরে আবিষ্কৃত স্কন্দগুপ্তের রাজ্যকালের শিলাস্তস্তলিপি।:(১৩) ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত স্কন্দগুপ্তের রাজ্যকালের শিলাস্তম্ভলিপি।:(১৪) জুনাগড়ে আবিষ্কৃত স্কন্দগুপ্তের রাজ্যকালের শিলালিপি—গৌপ্তাব্দ ১৩৬, ১৩৭, ১৩৮।:(১৫) কহায়ুং গ্রামে আবিষ্কৃত স্কন্দগুপ্তের রাজ্যকালের শিলাস্তম্ভলিপি—গৌপ্তাব্দ ১৪১।:(১৬) ইন্দ্রপুর বা ইন্দোর গ্রামে আবিষ্কৃত স্কন্দ্রগুপ্তের রাজ্যকালের তাম্রশাসন—গৌপ্তাব্দ ১৪৬।:(১৭) মন্দশোর গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের শিলালিপি—বিক্রমাব্দ ৪৯৩।
১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে ডাক্তার ফ্লিটের গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছিল; তাহার পরে গুপ্তবংশের সম্রাট্গণের নিম্নলিখিত খোদিতলিপিগুলি আবিষ্কৃত হইয়াছে;—
- (১৮) ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের রাজকীয় মুদ্রা—Journal of the Asiatic Society of Bengal. 1889, pt. I, p. 89.:(১৯) বৈশালীর ধ্বংসাবশেষমধ্যে আবিষ্কৃত সম্রাট্ প্রথম কুমারগুপ্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহারাজ গোবিন্দগুপ্তের মৃন্ময় মুদ্রা—Annual Report of the Archaeological Survey of India. 1903-4, pp. 101-22; Pls. XL—XLII. 89.:(২০) ভরডি ডিহ গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের খোদিতলিপি—গৌপ্তাব্দ ১১৭—J. A. S. B. Vol. V, 1909, p. 458.
- (২১) ধানাইদহে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের তাম্রশাসন—গৌপ্তাব্দ ১১৩—J. A. S. B, Vol. V, 1901, p. 459. বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৬শ ভাগ, পৃঃ ১১২।:(২২) দামোদরপুরে আবিষ্কৃত কুমারগুপ্তের শিলালিপি—গৌপ্তাব্দ ১২৪, E. I. Vol. XV, pp. 130-31.:(২৩) দামোদরপুরে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্তের ২য় তাম্রলিপি-গৌপ্তাব্দ ১২৯, E. I. Vol. XV. pp. 133-34.:(২৪) দামোদরপুরে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তদেবের রাজ্যকালের তাম্রলিপি—গৌপ্তাব্দ ১৬৩, E. I. Vol. XV. pp. 135-36.:(২৫) দামোদরপুরে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তদেবের রাজ্যকালের দ্বিতীয় তাম্রলিপি, ইহাতে তারিখ নাই। E. I. Vol. XV. pp. 138-39.:(২৬) দামোদরপুরে আবিষ্কৃত ভানুগুপ্তদেবের রাজ্যকালের তাম্রলিপি—গৌপ্তাব্দ ২১৪, E. I. Vol. XV. pp. 142-43.:(২৭) তুমৈনগ্রামে আবিষ্কৃত ঘটোৎকচগুপ্তের শিলালিপি—গৌপ্তাব্দ ১১৬, Indian Antiquary Vol. XLIX, 1920. pp. 114-15. এই ঘটোৎকচগুপ্ত সম্ভবতঃ প্রথম কুমারগুপ্তের পুত্র।:(২৮) পুনায় আবিষ্কৃত বাকাটক বংশের রাজ্ঞী প্রভাবতীগুপ্তার তাম্রশাসন। এই তাম্রশাসন হইতে জানিতে পারা যায় যে, সমুদ্রগুপ্তের পৌত্রী এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার সহিত বাকাটকগণের মহারাজা রুদ্রসেনের বিবাহ হইয়াছিল। প্রভাবতীগুপ্তা মহারাজ রুদ্রসেনের প্রধানা মহিষী ছিলেন এবং তাঁহার পুত্র শ্রীদিবাকর সেন যুবরাজ পদবী লাভ করিয়াছিলেন। E. I. Vol. XV. pp. 41-42.:(২৯) সারনাথে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের রাজ্যকালের শিলালিপি—গৌপ্তাব্দ ১৫৪। Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1914-15, p. 124.:(৩০) সারনাথে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তের রাজ্যকালের শিলালিপি—গৌপ্তাব্দ ১৫৭। Ibid. p. 125.
ডাক্তার ফ্লিট্ ও অধ্যাপক বুলার গণনা করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে, গৌপ্তাব্দ ৩১৯ খৃষ্টাব্দে আরম্ভ হইয়াছিল। সম্রাট্ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যাভিষেক অথবা গুপ্তবংশের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় হইতে এই অব্দ গণিত হইয়া আসিতেছে। প্রাচীন গুপ্ত-সাম্রাজ্য ধ্বংস হইলে গৌপ্তাব্দ বহুকাল যাবৎ উত্তরাপথে প্রচলিত ছিল; আসামে খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে হর্জ্জরবর্ম্মার খোদিতলিপিতে এই অব্দের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। নেপালে খৃষ্টীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে গৌপ্তাব্দের ব্যবহার ছিল এবং প্রাচীন সৌরাষ্ট্রে খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগেও এই অব্দ ব্যবহৃত হইত।
প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ অনুমান করেন যে, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পিতা ও পিতামহ সামান্য ভূস্বামী ছিলেন, কারণ গুপ্তবংশীয় সম্রাট্গণের খোদিতলিপিসমূহে শ্রীগুপ্ত বা ঘটোৎকচ গুপ্তের মহারাজাধিরাজ উপাধি দেখিতে পাওয়া যায় না। গুপ্ত বা শ্রীগুপ্তের নামাঙ্কিত কোন মুদ্রা অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই, কিন্তু ঘটোৎকচগুপ্তের নামাঙ্কিত একটি মৃন্ময় মুদ্রা প্রাচীন বৈশালী নগরের ধ্বংসাবশেষ খননকালে আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১২২]। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, এই মুদ্রা সমুদ্রগুপ্তের পিতামহ ঘটোৎকচগুপ্তের মুদ্রা নহে; কারণ, ইহাতে রাজপদজ্ঞাপক কোন উপাধি নাই[১২৩]। রুশিয়াদেশে পেট্রোগ্রাড নগরের চিত্রশালায় ঘটোৎকচগুপ্তের নামাঙ্কিত একটি মুদ্রা আছে[১২৪] কিন্তু পণ্ডিতপ্রবর জন আলান অনুমান করেন যে, এই মুদ্রাটি পরবর্ত্তিকালের ঘটোৎকচ নামধেয় কোন রাজার মুদ্রা[১২৫]। ইহা সম্ভবতঃ প্রথম কুমারগুপ্তের পুত্র ঘটোৎকচগুপ্তের মুদ্রা।
তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত দ্বাদশাদিত্য, বিষ্ণুগুপ্ত, চন্দ্রাদিত্য ও জয়গুপ্ত প্রকাণ্ডযশের সহিত প্রাচীন গুপ্তরাজবংশের সম্বন্ধ অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই। শতাধিক বর্ষ পূর্ব্বে কালীঘাটে তৃতীয় চন্দ্রগুপ্তের কতকগুলি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত ভারতবর্ষের অন্য কোন স্থানে অদ্যপি ইহার কোন মুদ্রা বা খোদিতলিপি আবিষ্কৃত হয় নাই। কালীঘাটে এই সময়ে বিষ্ণুগুপ্তেরও কতকগুলি সুবর্ণমুদ্রাও আবিষ্কৃত হইয়াছিল। মুর্শিদাবাদ জেলায় রাঙ্গামাটী গ্রামে বিষ্ণুগুপ্তের আর একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই স্থানে জয়গুপ্তের একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল। কুমারগুপ্ত নামধারী দুইজন রাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। প্রথম জয়গুপ্তের একটি মাত্র তাম্রমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহা এখন কলিকাতার সরকারী চিত্রশালায় আছে[১২৬]। মুদ্রার আবিষ্কার-স্থান দেখিয়া অনুমান হয় ষে, তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত, বিষ্ণুগুপ্ত ও দ্বিতীর জয়গুপ্ত মগধ ও গৌড়দেশের অধিপতি ছিলেন। জন আলান অনুমান করেন যে, ইঁহারা স্কন্দগুপ্তের বংশধর কিন্তু স্কন্দগুপ্তের পুত্রপৌত্রাদির অস্তিত্বের কোন প্রমাণই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। এই কারণে অনুমান হয় যে, ইঁহারা দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের বংশজাত।
ঢাকা চিত্রশালার অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকা রিভিউ-পত্রে প্রাচীন গুপ্তরাজবংশের শেষ কয়জন রাজার ষে কালপঞ্জী[১২৭] প্রকাশ করিয়াছেন এবং অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক[১২৮] দামোদরপুরে আবিষ্কৃত তাম্রলিপিগুলি প্রকাশকালে এই সম্বন্ধে যে মত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা উপযুক্ত প্রমাণাভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয় নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শাস্ত্রের অধ্যাপক ডাক্তার শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার পূর্ব্বোক্ত লেখকদ্বয়ের মতের বিস্তৃত সমালোচনা করিয়া যে প্রবন্ধ লিখিয়াছেন (The Successors of Kumara Gupta I)[১২৯] তাহা প্রকাশিত হইবার পরে এ সম্বন্ধে বাদানুবাদ নিষ্প্রয়োজন।
- ↑ ব্রিটিশ মিউজিয়ম মুদ্রা বিভাগের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত জন আলান (John Allan) অনুমান করেন যে, চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর মূর্ত্তিযুক্ত সুবর্ণ মুদ্রাগুলি সমুদ্র গুপ্ত কর্ত্তৃক পিতামাতার স্মরণার্থ মুদ্রিত হইয়াছিল—British Museum Catalogue of Indian Coins—Gupta dynasties, p. lxv. 8.
- ↑ Journal of the Royal Asiatic Society. 1889. p. 63.
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum. Vol. III. р. 8.
- ↑ Ibid, pp. 6-8.
- ↑ Journal of the Royal Asiatic Society, 1893, plate facing page 148.
- ↑ দুইটি মুদ্রা গয়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তন্মধ্যে একটি বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। অপরটি রঙ্গপুর সদ্যপুষ্করিণীর জমিদার রায় শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় রায় চৌধুরী বাহাদুরের নিকট আছে। মগধে আবিষ্কৃত তৃতীয় মুদ্রাটি কলিকাতার শ্রীযুক্ত প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের গৃহে আছে। মুরশিদাবাদ আজিমগঞ্জের জমিদার রায় মণিলাল নাহার বাহাদুর ও তাঁহার ভ্রাতা শ্রীযুক্ত পূরণচাঁদ নাহারের নিকটে আরও দুইটি অশ্বমেধের সুবর্ণমুদ্রা আছে।
- ↑ শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী কুমিল্লায় আবিষ্কৃত নর্ত্তেশ্বর মূর্ত্তির খোদিতলিপি এবং বাঘাউরা গ্রামে আবিষ্কত বিষ্ণুমূর্ত্তির খোদিতলিপি হইতে, সমতট বর্ত্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম ইহা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। নর্ত্তেশ্বর মূর্ত্তি লহরচন্দ্র বা লডহচন্দ্র নামক জনৈক রাজার রাজ্যকালে নির্ম্মিত হইয়াছিল—Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. X. pp. 85-91. বাঘাউরা গ্রামে আবিষ্কৃত বিষ্ণুমূর্ত্তি পালবংশীয় প্রথম মহীপালদেবের ৩য় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলনী, ১৯১৪, পৃঃ ৫৩।
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1894. p. 57.
- ↑ Epigraphia Indica Vol. II. p. 143.
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 6; p. 20.
- ↑ Ibid, p. 256. এই তাম্রশাসনখানি সমুদ্রগুপ্তের নবম রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত হইয়াছিল। ইহা গয়া জেলার কোন স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছিল।
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 25.
- ↑ V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition. p. 289.
- ↑ Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, p. 31-32.
- ↑ Ibid, p. 35.
- ↑ কৃৎস্ন-পৃথ্বী-জয়ার্ত্থেন রাজ্ঞৈবেহ সহাগতঃ।
ভক্ত্যা ভগবতশ্-শম্ভোর্গুহামেতমকারয়ৎ॥
–Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, p. 35. - ↑ V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 291.
- ↑ E. J. Rapson, British Museum Catalogue of Indian Coins; Coins of the Andhras and Western Ksatrapas. pp. cxlix, cli 192-4.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. 49.
- ↑ V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 292.
- ↑ ভিন্সেণ্ট স্মিথ বলেন যে, ৩০৬-৩৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে সুসভ্য প্রতীচ্য জগতের প্রথম দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হইয়াছিল। বর্ত্তমান ইউরোপখণ্ডের সর্ব্ব প্রাচীন দাতব্য চিকিৎসালয় খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে পারী নগরে স্থাপিত হইয়াছিল, ইহার নাম দেবগৃহ (Maison Dieu)—V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 296. note 2.
- ↑ সমসাময়িক ভারত, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৮-১২৪।
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, p. 43.
- ↑ Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1903-4, p. 107 pl. XLI. 14.
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 35.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V. 1909. p. 459.
- ↑ Annual Report of the Archaeological Survey, Eastern Circle, 1912-13, p. 61.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, XXI, p. 401.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1894, p.57.
- ↑ Descriptive List of Sculptures & Coins in the Museum of the Bangiya Sahitya Parishad, p. 20.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1883, P. 122; 1884, p. 18.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1884, Pt. I. p. 150, British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. lxxx.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. XXI, p. 40.
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol, III, p. 44.
- ↑ Ibid p. 38.
- ↑ Ibid, p. 258.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. II, p. 210. No. X.
- ↑ বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা, ১৬শ ভাগ, পৃঃ ১১২; Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, 1909, p. 460.
- ↑ সাহিত্য, ১৩২৩; পৃঃ ৮২৭-২৮। এই প্রবন্ধে অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক ধানাইদহ তাম্রশাসনের নূতন পাঠ প্রকাশ করিয়াছেন।
- ↑ Ibid, p. 458; Epigraphia Indica, Vol. X. p. 72.
- ↑ Epigraphia Indica Vol. XV. pp. 130-31.
- ↑ Fleet's Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 46.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. XV. pp. 133-34.
- ↑ Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New series, Vol. X. p. 103.
- ↑ Ibid, p. 261.
- ↑ Ibid, pp. 53-54.
- ↑ V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 308.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. 87; Jonrnal of the Royal Asiatic Society, 1889, p. 109.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasities, p. 1.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. VIII. Appendix I, p. 10.
- ↑ Ibid.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins I, Gupta dynasties, p. xliii.
- ↑ Ibid, p. 68.
- ↑ Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal Vol. I, 1905, pp. 253 ff.
- ↑ Indian Antiquary, 1911, p. 170.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. xlii, note 3.
- ↑ Ibid, p. xcvi.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1884, p. 152.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1882, p. 91; Journal of the Royal Asiatic Society, 1893. p. 116.
- ↑ Ibid, 1889. p. 97.
- ↑ এই মুদ্রাটিও নিকৃষ্ট সুবর্ণের, Ariana Antiqua pl. XVIII. 23; Cunningham, Archaeological Survey Reports, Vol III. p. 137; Journal of the Royal Asiatic Society, 1889, p. 97.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1884, p. 152; Journal of the Royal Asiatic Society, 1881, pp. 101-2.
- ↑ V. A. Smith, Catalogue of Coins in the Indian Museum, Vol. I, p. 113, No. 28.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1882, p. 112; Journal of the Royal Asiatic Society, 1893, p. 121.
- ↑ Journal of the Royal Asiatic Society, 1893, p. 107.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1882, pp. 91, 104; Catalogue of Coins in the Indian Museum, Vol I, p. 115, No. 38, and note 1.
- ↑ Descriptive List of Sculptures and Coins in the Museum of the Bangiya Sahitya Parishad, p. 21. No. 6.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol XXI, p. 401.
- ↑ Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol III, p. 82.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol X. p. 72; Journal and proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V. p. 458; বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা ১৬শ ভাগ, পৃঃ ১১১।
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. I, p. 239.
- ↑ Ibid, Vol, VIII, p. 36 ff.
- ↑ Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum. Vol. III. p. 58.
- ↑ Ibid, p. 67.
- ↑ Ibid, p. 70.
- ↑ Beal’s Buddhist Records of the Western World, Vol. I. p. xci and c.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. xcix, 116.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, p. 89.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. xlviii; V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 311.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1882, p. 91; Journal of the Royal Asiatic Society, 1889. p. 112.
- ↑ Ibid.
- ↑ Catalogue of Coins in the Indian Museum, p. 127. no 7.
- ↑ গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৫।
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. XXI. p. 401.
- ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. cxxxviii; Journal of the Royal Asiatic Society, 1889, p. 134.
- ↑ Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1914-15, pp. 124.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, р. 89.
- ↑ Indian Antiquary; Vol, XLVII, 1918, pp. 16-20.
- ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. 134.
- ↑ Indian Antiquary, Vol. XLVII, 1918, pp. 164-65.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, р. 89.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, PP 93-94; Indian Antiquary, 1902, p. 263; Smith’s Early History of India, 3rd Edition, p. 311.
- ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. lii.
- ↑ Smith’s; Early History of India, 3rd Edition; p. 320.
- ↑ Watters-on-Yuan-Chwang, Vol. I, pp. 288-89.
- ↑ Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 96 ff.
- ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. lx.
- ↑ Fleet’s Gupta Inscriptions, p. 152.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. V. App. p. 3. No. 4.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, р. 89.
- ↑ Ibid, p. 202.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1886, p. 65.
- ↑ Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, p. 89.
- ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, pp. 142-43.
- ↑ Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1914-15, pp. 124-25.
- ↑ Fleet’s Gupta Inscriptions, p. 89.
- ↑ Epigraphia Indica, pp. 114-15.
- ↑ Ain-i-Akbari, Vol. II, pp. 182-209
- ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. 153.
- ↑ Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1914-15 p. 124.
- ↑ Ibid, p. 125.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol XV. pp. 135-36.
- ↑ Ibid, pp. 138-39.
- ↑ Catalogue of Indian coins, Gupta dynasties p. lxii.
- ↑ Fleet’s Gupta Inscriptions, pp. 92-93.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. XV, pp. 142-43.
- ↑ Fleet’s Gupta Inscriptions, p. 89.
- ↑ Ibid. pp. 159-60.
- ↑
আলৌহিত্যোপকণ্ঠাত্তলবনগহনোপত্যকাদামহেন্দ্রা-
দাগঙ্গাশ্লিষ্টসানোস্তুহিনশিখরিণঃ পশ্চিমাদাপয়োধেঃ।
সামন্তৈর্যস্য বাহুদ্রবিণহৃতমদৈঃ পাদয়োরানমদ্ভি-
শ্চূড়ারত্নাংশুরাজিব্যতিকরশবলা ভূমিভাগাঃ ক্রিয়ন্তে॥
—Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 146. - ↑ Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, pp. 144-6.
- ↑ শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়-প্রণীত, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, ১ম সংস্করণ, পৃঃ ১০০। বিশ্বকোষসম্পাদক শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু তৎকালে বলিয়াছিলেন যে, এই মুদ্রাদ্বয়ের একটি রবিগুপ্তের মুদ্রা ও দ্বিতীয়টিতে “জয় মহারাজ” লিখিত আছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রথম মুদ্রাটি বিষ্ণুগুপ্তের ও দ্বিতীয়টি “প্রকাণ্ডযশা” উপাধিধারী জয়গুপ্তের। জন্ আলান প্রণীত Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, pp. 145. 150. দ্রষ্টব্য।
- ↑ Annual Report of the Archæological Survey of India, 1903-04, p. 107. No. 2.
- ↑ British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties. p. xvii.
- ↑ Ibid, p. 149. pl. XXIV. 3.
- ↑ Ibid, p. liv.
- ↑ Catalogue of Coins in the Indian Museum, Vol. I, p. 121.
- ↑ Dacca Review Vol. 10, pp. 56-57.
- ↑ Epigraphia Indica Vol. XV. pp. 118-27.
- ↑ Journal and proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. XVII. pp. 249-55.