বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/নবম পরিচ্ছেদ

বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৪

বাঘাউরা গ্রামে আবিষ্কৃত প্রথম মহীপালদেবের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুমূর্ত্তি


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৫

প্রথম মহীপালদেবের ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্কে লিখিত অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা

 
বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৬

প্রথম মহীপালের একাদশ রাজ্যাঙ্কে পুনর্নির্ম্মিত
নালন্দা মহাবিহারের দ্বারের ভগ্নাংশ


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৭

নয়পালের চতুর্দ্দশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত “পঞ্চরক্ষা”

 
বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৮


গয়ার নরসিংহ মন্দির মধ্যে আবিষ্কৃত নয়পালের পঞ্চদশ রাজ্যাঙ্কের শিলালিপি

বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৯

পাইকোরগ্রামে আবিষ্কৃত চেদী-রাজ কর্ণদেবের শিলাস্তম্ভ


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ২০

বিহারে আবিষ্কৃত তৃতীয় বিগ্রহপালের ত্রয়োদশ রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধমূর্ত্তি



নবম পরিচ্ছেদ।

দ্বিতীয় পাল-সাম্রাজ্য

 প্রথম মহীপালদেব—কাম্বোজ জাতি কর্ত্তৃক গৌড় অধিকার—মহীপাল কর্ত্তৃক পিতৃরাজ্যের উদ্ধারসাধন—দশম শতাব্দীর শেষার্দ্ধে উত্তরাপথের অবস্থা—ধঙ্গদেব কর্ত্তৃক অঙ্গ ও রাঢ় বিজয়—বাণগড়ের স্তম্ভলিপি—নালন্দায় লিখিত বৌদ্ধগ্রন্থ—বাণগড়ের তাম্রশাসন—নালন্দার শিলালিপি—রাজেন্দ্রচোলের দিগ্বিজয়—চালুক্যরাজ কর্ত্তৃক গৌড়রাজ্য আক্রমণ—গাঙ্গেয়দেব কর্ত্তৃক তীরভুক্তি আক্রমণ—মুসলমান বিজয়ের প্রারম্ভে উত্তরাপথের দুর্দ্দশা—বারাণসীতে মহীপালের কীর্ত্তি—নয়পালদেব—কর্ণদেব কর্ত্তৃক গৌড়রাজ্য আক্রমণ—দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বা অতীশ—নয়পালদেবের শিলালিপি—তৃতীয় বিগ্রহপাল—কর্ণদেবের সহিত যুদ্ধ—কৈবর্ত্তবিদ্রোহ—বিগ্রহপালের তাম্রশাসন।

 দ্বিতীয় বিগ্রহপালদেবের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র প্রথম মহীপালদেব পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দিনাজপুর জেলায় বাণগড়ে আবিষ্কৃত মহীপালদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “শ্রীমহীপালদেব রণক্ষেত্রে বাহুদর্পপ্রকাশে সকল বিপক্ষ-পক্ষ নিহত করিয়া ‘অনধিকৃতবিলুপ্ত’ পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করিয়া রাজগণের মস্তকে চরণপদ্ম সংস্থাপিত করিয়া অবনীপাল হইয়াছিলেন[১]।” “অনধিকৃত বিলুপ্ত” শব্দে অনধিকারী কর্ত্তৃক লুপ্ত, অর্থাৎ—শত্রু হস্তগত পিতৃরাজ্যই বুঝায়। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে স্বর্গীয় অধ্যাপক কিলহর্ণ[২] ও ১৩১৯ বঙ্গাব্দে শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়[৩] এই অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন। কেবল শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় এই তাম্রশাসন ব্যাখ্যাকালে উক্ত পদের বিশ্লেষণ করিয়া পরিত্যাগ করিয়াছেন[৪]; অন্তর্নিহিত ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের চেষ্টা করেন নাই। বাণগড়ের তাম্রশাসনে প্রথম মহীপালদেবের পরিচয়জ্ঞাপক দুইটি শ্লোক আছে। “সূর্য্যদেব হইতে যেমন কিরণ-কোটিবর্ষী চন্দ্রদেব উৎপন্ন হইয়াছেন, তাহা হইতেও সেইরূপ রত্নকোটিবর্ষী বিগ্রহপালদেব জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। নয়নানন্দদায়ক সুবিমল কলাময় সেই রাজকুমারের উদয়ে ত্রিভুবনে সন্তাপ বিদূরিত হইয়া গিয়াছিল। তদীয় অভ্রতুল্য সেনা-গজেন্দ্রগণ (প্রথমে) জলপ্রচুর পূর্ব্বাঞ্চলে স্বচ্ছ সলিল পান করিয়া, তাহার পর (তদনু) মলয়োপত্যকার চন্দন-বনে যথেচ্ছ বিচরণ করিয়া, ঘনীভূত-শীতল-শীকরোৎক্ষেপে তরুসমূহের জড়তা সম্পাদন করিয়া হিমালয়ের কটকদেশ উপভোগ করিয়াছিল[৫]।” এই শ্লোকদ্বয় ব্যাখ্যাকালে শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় বলিয়াছেন, “মহীপালদেবের পিতার কোনরূপ বীরকীর্ত্তির উল্লেখ নাই! তাঁহার সূর্য্য হইতে ‘চন্দ্র’রূপে উদ্ভূত বলিয়া এবং তজ্জন্য তাঁহাতে ‘কলাময়ত্বের’ আরোপ করিবার সুযোগ পাইয়া কবি ইঙ্গিতে তাঁহার ভাগ্যবিপর্য্যয়ের আভাস প্রদান করিয়া থাকিবেন। তাঁহার সেনা-গজেন্দ্রগণের (আশ্রয়স্থানাভাবে) নানা স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া, শিশির সংক্ষুদ্ধ হিমাচলের অধিত্যকায় আশ্রয় লাভের কথায় এবং মহীপালদেবের ‘অনধিকৃত্য-বিলুপ্ত’ পিতৃরাজ্য পুনঃ প্রাপ্তির কথায়, দ্বিতীয় বিগ্রহপালদেবের শাসনসময়েই পালসাম্রাজ্যের প্রথম ভাগ্যবিপর্য্যয়ের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে[৩]।” মৈত্রেয় মহাশয়ের উক্তি সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানসম্মত।

 প্রথম মহীপালদেব পাল-রাজবংশের দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। পূর্ব্ব অধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, মহীপালের পিতা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে বরেন্দ্রী বা উত্তর-বঙ্গ কাম্বোজ জাতি কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল, এবং সম্ভবতঃ চন্দেল্লবংশীয় যশোবর্ম্মার সাহায্যে গুর্জ্জর-রাজ মহীপাল মগধ পুনরধিকার করিয়াছিলেন। সুতরাং মহীপালদেব, পিতার মৃত্যুর পরে, রাঢ় ও বঙ্গদেশের কিয়দংশের অধিকার মাত্র, উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মহীপাল স্বয়ং বরেন্দ্রী, মগধ ও তীরভুক্তি, এমন কি, বারাণসী পর্য্যন্ত অধিকার করিয়াছিলেন। মহীপালদেবের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষের পূর্ব্বে বঙ্গ বা সমতট অধিকৃত হইয়াছিল[৬]। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, গৌড় হইতে তাড়িত হইয়া পালরাজগণ সমতটে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন[৭]। মহীপালদেবের ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্কের পূর্ব্বে মগধ অধিকৃত হইয়াছিল; কারণ উক্ত বর্ষে নালন্দায় লিখিত একখানি প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে[৮]। তাঁহার ৪৮শ রাজ্যাঙ্কের পূর্ব্বে তীরভুক্তি বা মিথিলা অধিকৃত হইয়াছিল; কারণ, উক্ত বর্ষে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি পিত্তল-মূর্ত্তি বর্ত্তমান তীরহুতে আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৯]। সারনাথে আবিষ্কৃত একটি বুদ্ধমূর্ত্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপির রচনা-রীতি দেখিয়া অনুমান হয় যে, এক সময়ে বারাণসীও মহীপালদেব কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল[১০]

 খৃষ্টিয় দশম শতাব্দীর শেষার্দ্ধের প্রারম্ভে মহীপালদেব রাঢ় অথবা বঙ্গের কোন নিভৃত কোণে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ক্রমে ক্রমে উত্তরাপথের রাজ্যসমূহের ও রাজন্যবর্গের পরিবর্ত্তন হইতেছিল। প্রথম ভোজদেব ও মহেন্দ্রপালদেবের সমুদ্র হইতে সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্য ক্যন্যকুব্জ নগরের দুর্গ-প্রকারে পর্য্যবসিত হইয়াছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ-বিজেতা রাষ্ট্রকূটবংশীয় ধ্রুব ধারাবর্ষ ও তৃতীয় গোবিন্দের বংশধরগণ ধীরে ধীরে স্বীয় অধিকারচ্যুত হইতেছিলেন। উত্তরাপথের রঙ্গমঞ্চে কাল-পরিবর্ত্তনের সহিত রাষ্ট্রীয় নাট্যে নব নব সূত্রধারের আবির্ভাব হইতেছিল। তখন আর গৌড়-রাজলক্ষ্মী হেলায় গুর্জ্জররাজের অঙ্কশায়িনী হইতেন না, গুর্জ্জর-রাজ প্রাচীন কান্যকুব্জ নগরে চন্দেল্ল-বংশজাত বর্ব্বর গণ্ডের পদাঘাত নীরবে সহ্য করিয়া[১১] মহোদয়শ্রী রক্ষায় অসমর্থ হইয়া মুসলমানের পদানত হইয়াছিলেন[১২]। ভোজদেবের বংশধর রাজ্যপাল আত্মরক্ষার জন্য একবার ধঙ্গের পুত্র গণ্ডের ও তাহার পরে গজনীর দিগ্বিজয়ী বীর মহ্‌মুদের শরণাগত হইয়াছিলেন। দক্ষিণপথে প্রাচীন চালুক্য-বংশের পুনরুত্থান আরব্ধ হইয়াছিল; মহীপাল যখন গৌড়েশ্বর, তখনই দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূট-রাজ্যের লোপ হইয়াছিল[১৩]। গৌড়ের পাল-রাজবংশের দুরবস্থার কথা পূর্ব্ব অধ্যায়েই বিবৃত হইয়াছে। এই সময়ে উত্তরাপথে কোকল্লের বংশধর গাঙ্গেয়দেব সহসা পরাক্রান্ত হইয়া উঠিলেন। গাঙ্গেয়দেবের পুত্র জগদ্বিজয়ী কর্ণদেব সপ্ততি বর্ষব্যাপী সুদীর্ঘ রাজ্যকালে সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করিয়াছিলেন। তাঁহার শতবর্ষব্যাপী জীবন, পশ্চিমে হূণ-রাজ্য হইতে পূর্ব্বে বঙ্গরাজ্য পর্য্যন্ত এবং উত্তরে কান্যকুব্জ হইতে দক্ষিণে পাণ্ড্য ও কেরল দেশ পর্য্যন্ত সমস্ত আর্য্যাবর্ত্ত ও দাক্ষিণাত্য-রাজগণের সহিত বিবাদে অতিবাহিত হইয়াছিল। গাঙ্গেয়দেব ও কর্ণদেবকে লইয়া দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ শেষ পর্য্যন্ত, শত বর্ষের ইতিহাস রচিত হইয়া থাকে। এই সময়ে গাঙ্গেয় ও কর্ণ ব্যতীত চোলবংশীয় রাজেন্দ্র চোল, কল্যাণের চালুক্যবংশীয় দ্বিতীয় জয়সিংহ প্রভৃতি দাক্ষিণাত্য-রাজগণ উত্তরাপথ আক্রমণ করিয়াছিলেন। এই রাষ্ট্র-বিপ্লবের যুগে মহীপালদেব পিতৃরাজ্য উদ্ধার করিয়া উত্তরাপথে যে নূতন সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, তাহাই তাঁহার অসামান্য প্রতিভার অদ্বিতীয় পরিচয়।

 ১০৫৯ বিক্রমাব্দে (১০০২ খৃষ্টাব্দ) যশোবর্ম্মদেবের পুত্র ধঙ্গদেব রাঢ় ও অঙ্গ বিজয় করিয়াছিলেন[১৪]। খজুরাহো গ্রামে বিশ্বনাথ-মন্দিরে আবিষ্কৃত ধঙ্গদেবের শিলালিপি হইতে এই কথা অবগত হওয়া যায়। এই শিলালিপি ১১৭৩ বিক্রমাব্দে (১১১৬ খৃষ্টাব্দে) জয়বর্ম্মদেবের আদেশে পুনরুৎকীর্ণ হইয়াছিল[১৫]। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যের শেষভাগে অথবা প্রথম মহীপালের রাজ্যারম্ভকালে রাঢ় ও অঙ্গ ধঙ্গদেব কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল বলিয়া অনুমান হয়। ধঙ্গদেব মহোবায় প্রত্যাবর্ত্তন করিলে বোধ হয় মহীপালদেব পিতৃরাজ্য উদ্ধার-সাধনে যত্নবান্ হইয়াছিলেন। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, মহীপালদেবের রাজ্যারম্ভের পূর্ব্বে বরেন্দ্রী বা উত্তর-বঙ্গ কাম্বোজ জাতি কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল। গৌড়ে কাম্বোজাধিকারের একটিমাত্র নিদর্শন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে। দিনাজপুর জেলায় বাণগড় নামক স্থানে বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ মধ্যে একটি বৃহৎ কৃষ্ণবর্ণ শিলানির্ম্মিত সুচারু-কারু-কার্য্য-শোভিত স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছিল। দিনাজপুরের স্বর্গীয় মহারাজা স্যর গিরিজানাথ রায়ের কোন পূর্ব্বপুরুষ ইহা বাণগড় হইতে আনয়ন করিয়া স্বীয় প্রাসাদে স্থাপন করিয়াছিলেন। তদবধি ইহা দিনাজপুর-রাজবাটীর প্রাঙ্গণে স্থাপিত আছে। এই স্তম্ভের মূলদেশে তিনছত্র একটি শিলালিপি আছে। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে স্বর্গীয় রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাহাদুর এই শিলালিপির অনুবাদ করিয়াছিলেন, দিনাজপুরের তৎকালীন কালেক্টর ওয়েষ্টমেকট এই অনুবাদ অবলম্বনে একটি প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। প্রবন্ধ অনুবাদ ও স্যর রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকরের প্রতিবাদ একত্র প্রকাশিত হইয়াছিল[১৬]। মিত্রজ মহাশয় প্রতিবাদের উত্তর দিয়াছিলেন[১৭]; এবং শ্রীযুক্ত ভাণ্ডারকর উত্তরের প্রত্যুত্তর প্রকাশ করিয়াছিলেন[১৮]। তাহার পরে প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌গণ এই শিলালিপির কথা বিস্মৃত হইয়াছিলেন। স্বর্গীয় ডাক্তার কিলহর্ণ বিরচিত উত্তরাপথের খোদিত-লিপিমালায় এই শিলালিপির উল্লেখ নাই[১৯]। স্বর্গীয় ডাক্তার ব্লক্ এই শিলালিপিতে “গৌড়পতি” স্থানে “সীদুপতি” পাঠ করায় ব্যাখ্যা-বিভ্রাট হইয়াছিল[২০]। ১৯১১ খৃষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ এই শিলালিপির প্রতিলিপি সংগ্রহ করিয়া এসিয়াটিক সোসাইটীর পত্রিকায় প্রকাশ করিয়াছিলেন[২১]। শিলালিপির শেষ পঙ্ক্তির “কুঞ্জরঘটাবর্ষেণ” শব্দের অর্থ লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ ও শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু[২২] “কুঞ্জর ঘটাবর্ষেণ” শব্দের, ৮৮৮ অর্থ করিয়াছেন, কিন্তু স্যর রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর ও মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী[২৩] এই অর্থ স্বীকার করেন না। নূতন আবিষ্কার না হইলে এই বিরোধের মীমাংসা হওয়া অসম্ভব। “কুঞ্জরঘটাবর্ষেণ” শব্দের অর্থ যদি ৮৮৮ হয়, তাহা হইলে ইহা শকাব্দের তারিখ এবং কাম্বোজবংশজাত গৌড়েশ্বরের শিবমন্দির, ৮৮৮ শকাব্দে, অর্থাৎ—৯৬৬ খৃষ্টাব্দে নির্ম্মিত হইয়াছিল। “কুঞ্জরঘটাবর্ষেণ” শব্দে যদি ৮৮৮ না বুঝায়, তাহা হইলেও এই শিলালিপির ঐতিহাসিক তথ্যনির্ণয়ের কোন বাধা দেখিতে পাওয়া যায় না। নারায়ণপালের রাজ্যকালে উৎকীর্ণ গরুড়স্তম্ভলিপি ও কুমিল্লা জেলায় বাঘাউরা গ্রামে আবিষ্কৃত বিষ্ণুমূর্ত্তির পাদপীঠস্থ খোদিতলিপির[২৪] অক্ষরগুলির সহিত বাণগড়ের স্তম্ভলিপির অক্ষরগুলির তুলনা করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, বাণগড়-লিপি গরুড়স্তম্ভলিপির পরে এবং বাঘাউরা লিপির পূর্ব্বে উৎকীর্ণ হইয়াছিল। অক্ষরতত্ত্ব হইতে বাঙ্গালার ইতিহাসে কাম্বোজজাতির আক্রমণের কাল স্থির নির্দ্দেশ করা যায়। যাঁহারা অক্ষরতত্ত্বের প্রামাণিকতা সম্বন্ধে সন্দিহান, তাঁহাদিগের সহিত বিশুদ্ধ প্রত্নবিদ্যামূলক ইতিহাসের মতদ্বৈধ বিচিত্র নহে। বাণগড়-স্তম্ভলিপিতে কাম্বোজজাতীয় গৌড়েশ্বরের নামোল্লেখ নাই। ইহা হইতে অনুমান হয় যে, বিদেশীয় ও বিজাতীয় গৌড়েশ্বর শিবোপাসক হইলেও গৌড়রাজ্যে তাঁহার নাম সুপরিচিত হয় নাই। কাম্বোজবংশীয় কয়জন গৌড়েশ্বর গৌড়-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, তাহা নির্ণয় করিবার কোন উপায় অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। এইমাত্র নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতে পারে যে, বাণগড়ের শিবমন্দিরনির্ম্মাতা কাম্বোজজাতীয় গৌড়েশ্বর প্রথম মহীপালদেবের পূর্ব্ববর্ত্তী; সুতরাং তিনিই মহীপালের পিতৃরাজ্যে অনধিকার-প্রবেশ করিয়াছিলেন এবং কাম্বোজবংশীয় গৌড়-রাজগণের নিকট হইতেই মহীপাল পিতৃভূমি বরেন্দ্রী অধিকার করিয়াছিলেন। মহীপালদেবের সুদীর্ঘ রাজ্যকালের প্রথম ভাগে সমতট তাঁহার অধিকারভুক্ত ছিল, কারণ, তাঁহার তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে লোকদত্ত নামক বৈষ্ণবমতাবলম্বী জনৈক বণিক্ সমতটে একটি নারায়ণমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। কিছু দিন পূর্ব্বে এই মূর্ত্তিটি ত্রিপুরা জেলায় আবিষ্কৃত হইয়াছে[২৫]। মহীপালদেবের পঞ্চম রাজ্যাঙ্কে একখানি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থ লিখিত হইয়াছিল। ইহা এখন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে। এই গ্রন্থের পুষ্পিকায় লিখিত আছে;—

 “পরমেশ্বরপরমভট্টারকপরমসৌগতশ্রীমন্মহীপালদেবপ্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যে সম্বৎ ৫ অশ্বিনি কৃষ্ণে[২৬]।”

 মহীপালদেবের ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্কে তাড়িবাড়ি মহাবিহারবাসী শাক্যাচার্য্য স্থবির সাধুগুপ্তের ব্যয়ে নালন্দবাসী কল্যাণমিত্র চিন্তামণি একখানি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থের অনুলিপি প্রস্তুত করিয়াছিলেন। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নেপালে এই গ্রন্থখানি আবিষ্কার করিয়া কলিকাতার এসিয়াটীক সোসাইটীতে আনয়ন করিয়াছেন। ইহার পুষ্পিকায় লিখিত আছে;—

 “দেয়ধর্ম্মেয়ং প্রবরমহাযানযায়িনঃ তাড়িবাড়িমহাবিহারীয় আবস্থিতেন শাক্যাচার্য্যস্থবির সাধুগুপ্তস্য যদত্র পুণ্যন্তদ্ভবত্যাচার্য্যোপাধ্যায়মাতাপিতৃপুরঙ্গমং কৃত্বা সকলসত্ত্বরাশেরনুত্তরজ্ঞানফলাবাপ্তয় ইতি। পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজপরমেশ্বরপরমসৌগত শ্রীমদ্বিগ্রহপালদেবপাদানুধ্যাত পরমভট্টারকমহারাজাধিরাজপরমেশ্বরপরমসৌগত শ্রীমন্মীহীপালদেবপ্রবর্দ্ধমানকল্যাণবিজয়রাজ্যে ষষ্ঠ সম্বৎসরে অভিলিখ্যমানে যত্রাঙ্কে সম্বৎ ৬ কার্ত্তিককৃষ্ণত্রয়োদশ্যান্তিথৌ মঙ্গলবারেণ ভট্টারিকা নিষ্পাদিতমিতি॥ শ্রীনালন্দাবস্থিতকল্যাণমিত্রচিন্তামণিকস্য লিখিত ইতি[২৭]।”

 বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিমন্দির প্রাঙ্গণে একটি আধুনিক মন্দিরে কয়েকটি বৌদ্ধমূর্ত্তি পঞ্চপাণ্ডবের মূর্ত্তিরূপে পূজিত হইতেছে। ইহার মধ্যে একটি বুদ্ধমূর্ত্তি মহীপালদেবের একাদশ রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। স্যর আলেকজাণ্ডার কনিংহাম্ এই মূর্ত্তির পাদপীঠের খোদিতলিপির তারিখের প্রথম অক্ষর দুইটি পাঠ করিতে না পারিয়া ইহাকে মহীপালের দশম রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত মূর্ত্তি বলিয়া গিয়াছেন[২৮]। এই মূর্ত্তির পাদপীঠস্থ খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বরপরমভট্টারক শ্রীমন্মহীপালদেবের প্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যের একাদশ সম্বৎসরে গন্ধকূটীদ্বয়ের সহিত এই বুদ্ধমূর্ত্তিটি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[২৯]। মহীপালদেবের একাদশ রাজ্যাঙ্কে তৈলাঢকবাসী বালাদিত্য নামক জনৈক ব্যক্তি নালন্দ মহাবিহারের জীর্ণ সংস্কার করিয়াছিলেন। নালন্দ মহাবিহারের প্রস্তরনির্ম্মিত দ্বারে উৎকীর্ণ শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া ষায় যে, মহাবিহার অগ্নিদাহে ধ্বংস হইলে কৌশাম্বীবিনির্গত হরদত্তের নপ্তা, গুরুদত্তের পুত্র, তৈলাঢকনিবাসী জ্যাবিষ বালাদিত্য কর্ত্তৃক পুনঃ সংস্কৃত হইয়াছিল[৩০]। মহীপালদেবের নবম রাজ্যাঙ্কে পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তঃপাতী কোটিবর্ষবিষয়ে গোকলিকামণ্ডলে চূটপল্লিকাবর্জ্জিত কুরটপল্লিকা গ্রাম মহাবিষুব সংক্রান্তিতে বুদ্ধ ভট্টারকের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণাদিত্যদেবশর্ম্মাকে প্রদত্ত হইয়াছিল[৩১]

 প্রথম মহীপালদেবের রাজ্যকালে গৌড়রাজ্য বারত্রয় বহিঃশত্রু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল। প্রথমে চোল-রাজ প্রথম রাজেন্দ্রচোল, কল্যাণের চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় জয়সিংহ ও পরে চেদি, কলচুরি বা হৈহয়-বংশীয় গাঙ্গেয়দেব পাল-সাম্রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। চোলরাজ রাজেন্দ্রচোল ১০১২ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার নবম রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ মেলপাডি-শিলালিপিতে তাঁহার উত্তরাপথবিজয়ের বর্ণনা নাই[৩২], কিন্তু তাঁহার ত্রয়োদশ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ তিরুমলৈ-শিলালিপিতে রাজেন্দ্রচোলদেবের উত্তরাপথাভিযানের নিম্নলিখিত বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়[৩৩]:—

 “পরকেশরীবর্ম্মা বা শ্রীরাজেন্দ্রচোলদেবের (রাজত্বের) ত্রয়োদশ বৎসরে—যিনি......তাঁহার মহান্ সমরপটু সেনাদ্বারা (নিম্নোক্ত দেশসকল) অধিকার করিয়াছেন—দুর্গম ওড্ড-বিষয়, (যাহা তিনি) প্রবল যুদ্ধে (পদানত করিয়াছিলেন); মনোরম কোশলনাডু, যেখানে ব্রাহ্মণগণ মিলিত হইয়াছিল। মধুকর-নিকর-পরিপূর্ণ-উদ্যান-বিশিষ্ট তন্দবুত্তি, ভীষণ যুদ্ধে ধর্ম্মপালকে নিহত করিয়া তিনি যে দেশ অধিকার করিয়াছিলেন; সকল দিকে প্রসিদ্ধ তক্কণলাড়ম্, সবেগে রণশূরকে আক্রমণ করিয়া তিনি যে দেশ অধিকার করিয়াছিলেন; বাঙ্গালাদেশ, যেখানে ঝড় বৃষ্টির কখনও বিরাম নাই, এবং গজ-পৃষ্ঠ হইতে নামিয়া যেখান হইতে গোবিন্দচন্দ্র পলায়ন করিয়াছিলেন; কর্ণভূষণ, চর্ম্মপাদুকা এবং বলয়বিভূষিত মহীপালকে ভীষণ সমরক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য করিয়া যিনি তাঁহার অদ্ভুত বলশালী করিসমূহ এবং রত্নোপমা রমণীগণকে হস্তগত করিয়াছিলেন; সাগরের ন্যায় রত্নসম্পন্ন উত্তিরলাড়ম্; বালুকাময় তীর্থ-ধৌতকারিণী গঙ্গা[৩৪]।” তিরুমলৈ-শিলালিপি অনুসারে রাজেন্দ্রচোল তাঁহার দ্বাদশ রাজ্যাঙ্কের পূর্ব্বে এই সকল দেশ হস্তগত করিয়াছিলেন। ‘ওড্ড-বিষয়’ বর্ত্তমান উড়িষ্যা, বহু তাম্রশাসনে ইহা ‘ওড্র-বিষয়’ নামে উল্লিখিত হইয়াছে। ‘কোশলৈনাডু’ কলিঙ্গের নিকটে অবস্থিত দক্ষিণ-কোশল বা মহাকোশল, বর্ত্তমান বিলাসপুর প্রভৃতি উড়িষ্যার পশ্চিমস্থিত প্রদেশগুলির প্রাচীন নাম। তন্দবুত্তি বা দণ্ডভুক্তি বর্ত্তমান মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণাংশের নাম। সম্ভবতঃ বর্ত্তমান দাঁতন গ্রামই প্রাচীন দণ্ডভুক্তি। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলিয়াছেন, দণ্ডভুক্তির বর্ত্তমান নাম বিহার[৩৫]। কারণ, তিব্বতীয় ইতিহাসে ‘বিহার’ ওতন্তপুর বা ওতন্তপুরী নামে উল্লিখিত হইয়াছে[৩৬]। ওতন্তপুর সংস্কৃত উদ্দণ্ডপুরের অপভ্রংশ এবং উদ্দণ্ডপুর, বিহার নগরের প্রাচীন নাম,—বিহারের আবিষ্কৃত বহু খোদিতলিপি হইতে ইহা প্রমাণ হইয়াছে। সুতরাং বিহার কখনই দণ্ডভুক্তি হইতে পারে না। দণ্ডভুক্তি কোশল দেশের পরে ও দক্ষিণ-রাঢ়ের পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে; সুতরাং ইহা মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত কোনও স্থান হওয়াই সম্ভব। দণ্ডভুক্তির সহিত দাঁতনের সম্পর্ক আমি, ১৯১১ খৃষ্টাব্দে লিখিত “Palas of Bengal” প্রবন্ধে নির্ণয় করিয়াছিলাম। আমার প্রবন্ধ পাঠের পরে ইহা বসুজ মহাশয়ের গ্রন্থমধ্যে স্থান লাভ করিয়াছে[৩৭]। রাজেন্দ্রচোল ভীষণ যুদ্ধে ধর্ম্মপালকে ধ্বংস করিয়া দক্ষিণ-রাঢ়ে আসিয়াছিলেন। দণ্ডভুক্তির অধিপতি ধর্ম্মপাল কে, তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। তাঁহার সহিত পাল-রাজবংশের সম্পর্কজ্ঞাপক কোন প্রমাণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু এই ধর্ম্মপালকে মহীপালের ‘কোন আত্মীয়’ রূপে বর্ণনা করিয়াছেন[৩৮]; কিন্তু দণ্ডভুক্তি-রাজ ধর্ম্মপালের সহিত গৌড়েশ্বর মহীপালের সম্পর্কসূচক কোন প্রমাণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বসুজ মহাশয় তাঁহার গ্রন্থের স্থানে স্থানে ‘দণ্ডভুক্তি’ স্থানে ‘দন্তভুক্তি’ লিখিয়াছেন[৩৯]। কিন্তু এই স্থানের প্রকৃত নাম ‘দণ্ডভুক্তি’; কারণ, সন্ধ্যাকরনন্দী প্রণীত ‘রামচরিতে’ দণ্ডভুক্তির অধিপতি জয়সিংহের নাম আছে[৪০]। রামচরিতের টীকায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, জয়সিংহ উৎকল-রাজ কর্ণকেশরীকে পরাজিত করিয়াছিলেন। ইহা দণ্ডভুক্তির অবস্থান-নির্ণয়ের আর একটি প্রমাণ; কারণ, উৎকল-রাজের সহিত দক্ষিণ-মগধের অধিপতি অপেক্ষা উৎকল-রাজ্যের উত্তর সীমায় অবস্থিত প্রদেশাধিপতির যুদ্ধ হওয়াই অধিকতর সম্ভব। বসুজ মহাশয় বলিয়াছেন যে, ধর্ম্মপাল প্রথমে রঙ্গপুর জেলায় রাজত্ব করিতেন, কিন্তু পরে মধ্য-রাঢ়ে আসিয়া বাস করিয়াছিলেন[৩৯]। অদ্যাবধি এমন কোন প্রমাণ আবিষ্কৃত হয় নাই, যদ্দ্বারা এই উক্তি সমর্থিত হইতে পারে। রাজেন্দ্রচোল যখন দক্ষিণ-রাঢ় আক্রমণ করিয়াছিলেন, তখন রণশূর দক্ষিণ-রাঢ়ের অধিপতি। শূরবংশীয় নরপতিগণের মধ্যে রণশূরের নামই সর্ব্বপ্রথমে খোদিতলিপিতে দেখিতে পাওয়া যায়। রাজেন্দ্রচোল রণশূরকে পরাজিত করিয়া বঙ্গদেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। বঙ্গদেশের অধিপতি গোবিন্দচন্দ্র হস্তিপৃষ্ঠ হইতে নামিয়া পলায়ন করিয়াছিলেন। রাজেন্দ্রচোল বঙ্গদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়া উত্তর-রাঢ়ের মহীপালকে পরাজিত করিয়াছিলেন। দক্ষিণ-রাঢ় ও উত্তর-রাঢ় তিরুমলৈ-শিলালিপিতে ‘তক্কণলাডং’ ও উত্তিরলাডং’ রূপে উল্লিখিত হইয়াছে। স্বর্গীয় ডাঃ কিলহর্ণ এই নামদ্বয় ‘উত্তর-লাট’, অর্থাৎ—উত্তর-গুজরাট এবং ‘দক্ষিণ-লাট’, অর্থাৎ—দক্ষিণ-গুজরাট মনে করিয়াছিলেন[৪১]। তিরুমলৈ-শিলালিপি পুনঃ সম্পাদন কালে ডাক্তার হুলজ্ ও স্বর্গগত পণ্ডিত বেঙ্কয় স্থির করিয়াছিলেন যে, পূর্ব্বোক্ত শব্দদ্বয়দ্বারা উত্তর-বিরাট ও দক্ষিণ-বিরাট সূচিত হইতেছে[৪২]। স্বর্গগত পণ্ডিত বেঙ্কয় বলিয়াছিলেন যে, “ইলাড” শব্দদ্বারা সংস্কৃত “বিরাট” বুঝাইতে পারে, “লাট” বুঝায় না[৪৩]। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ[৪৪] ও শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু বলেন[৪৫], “তক্কণলাডম্” ও “উত্তিরলাডম্” শব্দদ্বয়দ্বারা দক্ষিণ-রাঢ় ও উত্তর-রাঢ় সূচিত হইতেছে, কিন্তু তাঁহাদিগের মধ্যে কেহই এই প্রদেশদ্বয়ের অবস্থান নির্ণয়ের কারণ নির্দ্দেশ করা আবশ্যক মনে করেন নাই। কোশল বা দণ্ডভুক্তি জয় করিয়া দক্ষিণ-লাট বা দক্ষিণ-বিরাটে যুদ্ধযাত্রা করা, দক্ষিণ-লাট বা দক্ষিণ-বিরাট হইতে যুদ্ধার্থ বঙ্গদেশে আগমন, বঙ্গদেশ হইতে উত্তর-লাট বা উত্তর-বিরাট জয়ার্থ গমন এবং উত্তর-লাট বা উত্তর-বিরাট হইতে গঙ্গাতীরে প্রত্যাবর্ত্তন অসম্ভব; সুতরাং শব্দগত সাদৃশ্য অনুসারে “দক্ষিণলাডম্” “দক্ষিণ-রাঢ়” এবং “উত্তিরলাডম্‌” “উত্তর-রাঢ়” রূপে গ্রহণ করাই সুসঙ্গত। রাজেন্দ্রচোল গঙ্গাতীর হইতে স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিলেন এবং গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত দিগ্বিজয়ের জন্য স্বদেশে “গঙ্গেগোণ্ডা”, অর্থাৎ—“গঙ্গাবিজয়ী” নামে পরিচিত হইয়াছিলেন।

 প্রথম মহীপালদেবের রাজত্বকালে কোন সময়ে কর্ণাটদেশীয় কোন রাজা গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। আর্য্য ক্ষেমীশ্বর-বিরচিত “চণ্ডকৌশিক” নামক একখানি নাটকে এই ঘটনার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল হইতে চণ্ডকৌশিকের একখানি পুথি আনয়ন করিয়াছিলেন[৪৬]। ইহাতে প্রথম মহীপাল চন্দ্রগুপ্তের সহিত এবং কর্ণাটগণ নবনন্দের সহিত তুলিত হইয়াছেন[৪৭]। এই নাটকখানি মহীপালদেবের বিজয়োৎসব উপলক্ষে রচিত ও অভিনীত হইয়াছিল। এই সমসাময়িক গ্রন্থ হইতে কর্ণাটগণের আক্রমণ ও পরাভবের কথা অবগত হওয়া যায়। মহীপালদেব কর্ত্তৃক পরাজিত কর্ণাটগণ কোন্ দেশের অধিবাসী? শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন যে, কর্ণাট বলিতে কল্যাণ প্রদেশ বুঝায়, সুতরাং এই সময়ের কর্ণাট-রাজগণ চালুক্য-রাজবংশ-সম্ভূত[৪৮]। মহীপালদেবের রাজ্যকালে চালুক্য-রাজবংশীয় দ্বিতীয় তৈল, প্রথম সত্যাশ্রয়, পঞ্চম বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় জয়সিংহ কল্যাণের সিংহাসনে আসীন ছিলেন[৪৯]। কিন্তু ইঁহাদিগের মধ্যে কাহারও খোদিতলিপিতে গৌড়-যুদ্ধের উল্লেখ নাই। সম্ভবতঃ কর্ণাট-রাজগণ পরাজিত হইয়াছিলেন বলিয়া প্রশস্তিকারগণ গৌড়-যুদ্ধের উল্লেখ করেন নাই। দিগ্বিজয়ী বীর প্রথম রাজেন্দ্রচোল উত্তর-রাঢ়ে মহীপালদেবকে পরাজিত করিয়া গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত অগ্রসব হইয়াছিলেন, কিন্তু তিনি উত্তরবঙ্গ আক্রমণ করেন নাই। হয়ত গঙ্গাতীরে প্রথম রাজেন্দ্রচোল, মহীপাল কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া প্রত্যাবর্ত্তন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন এবং চণ্ডকৌশিক নাটকে চোলরাজই কর্ণাট-রাজরূপে উল্লিখিত হইয়াছেন[৫০]

 মহীপালদেবের রাজ্যকালে কোন সময়ে কলচুরি বা চেদিবংশীয় গাঙ্গেয়দেব গৌড়-রাজ্য আক্রমণ করিয়া মিথিলা অধিকার করিয়াছিলেন। গাঙ্গেয়দেবের অধিকারকালে তীরভুক্তিতে লিখিত একখানি রামায়ণ গ্রন্থ মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্ত্তৃক নেপালে আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই গ্রন্থের পুষ্পিকা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “গৌড়ধ্বজ” উপাধিধারী গাঙ্গেয়দেব ১০৭৬ বিক্রমাব্দে তীরভুক্তির অধিপতি ছিলেন[৫১]। এই গাঙ্গেয়দেব যে কলচুরিবংশীয় প্রসিদ্ধ বীর কর্ণদেবের পিতা, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। শ্রীযুক্ত রামপ্রসাদ চন্দ এই বিষয়ে অযথা আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন[৫২]। কর্ণদেবের পিতা গাঙ্গেয়দেব ৭৮৯ কলচুরি অব্দে (১০৩৭ খৃষ্টাব্দে) জীবিত ছিলেন[৫৩]সুতরাং তাঁহার সহিত ১০১৯ খৃষ্টাব্দে গৌড়েশ্বরের সহিত যুদ্ধ অসম্ভব নহে। প্রথম মহীপালের রাজ্যকালে বারাণসীতে বহু মন্দির চৈত্যাদি নির্ম্মিত হইয়াছিল। স্থিরপাল ও বসন্তপাল নামক ব্যক্তিদ্বয় গৌড়েশ্বরের আদেশে বারাণসীতে “ধর্ম্মরাজিকা” ও “সাঙ্গধর্ম্মচক্রের” জীর্ণসংস্কার এবং “অষ্টমহাস্থানশৈল-বিনির্ম্মিত-গন্ধকূটী” নূতন করিয়া নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন[৫৪]। অনুমান হয় যে, স্থিরপাল ও বসন্তপাল রাজবংশসম্ভূত ছিলেন।

 মহীপালদেব যখন গৌড়েশ্বর, তখন আর্য্যাবর্ত্তের ইতিহাসের একটি নূতন অধ্যায় আরব্ধ হইতেছিল। হূণ-প্লাবনের পঞ্চশত বর্ষ পরে আর্য্যাবর্ত্ত পুনরায় বহিঃশত্রু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল। হূণ-যুদ্ধের পর হইতে পঞ্চশতাব্দী কাল যাবৎ আর্য্যাবর্ত্তের নরনাথগণ গৃহ-বিবাদে বলক্ষয় করিয়া আর্য্যাবর্ত্তের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করিতেছিলেন। পারস্যে আর্দাশিরবাবেকানের বংশজাত শেষ রাজা যখন নূতন ধর্ম্মাবলম্বী আরবগণের নিকটে পরাজিত হইয়া নিহত হইয়াছিলেন, তখনও আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণ জগতে নূতন রাষ্ট্রীয় শক্তি উন্মেষের সংবাদ অবগত হন নাই। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমান বীরগণ যখন সিন্ধুদেশ আক্রমণ করিয়া উহা অধিকার করিয়াছিলেন, তখনও আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণের চৈতন্য উদয় হয় নাই। তখনও প্রাচীন পারসীক-সাম্রাজ্যের ধ্বংসের সংবাদ অবগত হইয়াও, আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণ গৃহ-বিবাদে ব্যাপৃত ছিলেন; তখনও গুর্জ্জরপ্রতীহার-রাজগণের ভয়ে রাষ্ট্রকূট-রাজগণ গুর্জ্জরের বিরুদ্ধে তাজিক নামে পরিচিত সিন্ধুদেশবাসী মুসলমানগণের সহিত সন্ধি-বন্ধনে আবদ্ধ হইতেন। প্রাচীন পারসীকসাম্রাজ্য ধ্বংসের পরে প্রাচীন পারসীক জাতিকে নবধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া মুসলমানগণ যখন বাহ্লীক (বলখ্), কপিশা (কাবুল) ও গান্ধারের দিকে অগ্রসর হইলেন, আর্য্যাবর্ত্ত তখনও সুষুপ্তিমগ্ন। বাহ্লীক ও কপিশা অধিকৃত হইল, আফগানিস্থানের পার্ব্বত্য উপত্যকাসমূহে মহারাজাধিরাজ কণিষ্কের বংশধরগণের অধিকার লুপ্ত হইল। শত শত বৌদ্ধকীর্ত্তিসুশোভিত শস্যশ্যামল গান্ধার ও কপিশা মরুভূমিতে পরিণত হইল, কিন্তু তখনও বৎসরাজ গৌড়বিজয়ে উন্মত্ত, ধ্রুব ধারাবর্ষ ও তৃতীয় গোবিন্দ গুর্জ্জর-দলনে ব্যাপৃত। প্রাচীন ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায় যে, ইহাই ধ্বংসোন্মুখ জাতির লক্ষণ। খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে কুষাণবংশীয় ষাহি উপাধিধারী শেষ রাজার মন্ত্রী প্রভুকে পদচ্যুত করিয়া কপিশার সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন[৫৫]। লল্লীয়, বাহ্লীক বিজিত হইলে কপিশায় অবস্থান অসম্ভব দেখিয়া সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরবর্ত্তী উদভাণ্ডপুরে (বর্ত্তমান উণ্ড্) স্বীয় রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। ২৫৬ হিজিরাব্দে সিজিস্থানের অধিপতি ইয়াকুব লাইস্, গজনীপ্রদেশ অধিকার করিয়াছিলেন[৫৬]। তুর্কিস্থানের সামানীবংশীয় রাজা ইসমাইল্, গজনী সামানী-রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন। খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর তৃতীয় পাদে সামানী-রাজ-সেনানায়ক আলপ্তিগীন্ প্রভুর ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হইয়া গজনীতে আসিয়া একটি স্বতন্ত্র রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। আলপ্তিগীনের মৃত্যুর পরে তাঁহার তুরস্কজাতীয় ক্রীতদাস সবুক্তিগীন্ গজনীর সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। সবুক্তিগীন্ তাঁহার দশম রাজ্যাঙ্কে, ৯২৭ খৃষ্টাব্দে, উত্তরাপথের সিংহদ্বারে উপস্থিত হইয়াছিলেন। তখন ষাহি জয়পাল উদভাণ্ডপুরের সিংহাসনে আসীন। সবুক্তিগীন্ ৯৯৯ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করিলে তাঁহার পুত্র মহ্‌মূদ্ বারম্বার আক্রমণ করিয়া প্রাচীন ষাহি-রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। মহ্‌মূদের গতিরোধ করিবার জন্য কাশ্মীর, কান্যকুব্জ ও কলঞ্জরের অধিপতিগণ প্রাণপণে জয়পালকে সাহায্য করিয়াছিলেন। জয়পাল, তৎপুত্র অনঙ্গপাল ও তৎপুত্র ত্রিলোচনপাল আর্য্যাবর্ত্ত রক্ষার জন্য প্রাণবিসর্জ্জন করিলে ষাহিরাজ্য মহ্‌মূদের অধীন হইয়াছিল। শেষ মুহূর্ত্তে আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণের চৈতন্য হইলে প্রতীহার, চন্দেল্ল ও লোহরবংশীয় রাজগণ, যখন ষাহিগণকে যথাসাধ্য সাহায্য করিয়াছিলেন, তখনও গৌড়েশ্বর আর্য্যাবর্ত্ত রক্ষার জন্য স্বদেশীয় রাজবৃন্দের সহিত এই মহাযুদ্ধে যোগদান করেন নাই। মুসলমান ঐতিহাসিকগণ যুদ্ধার্থে সমবেত আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণের মধ্যে গৌড়েশ্বরের নাম করেন নাই, সুতরাং ইহা স্থির যে, গৌড়েশ্বর ষাহি-রাজগণের সাহায্যার্থ অগ্রসর হন নাই। মগধে গোবিন্দপাল ও বঙ্গে লক্ষণসেনের পুত্ত্রগণ দ্বিশতবর্ষ পরে মহীপালের কৃতপাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন, “কলিঙ্গ জয়ের পর, মৌর্য্য অশোকের ন্যায়, কাম্বোজান্বয়জ গৌড়পতির কবল হইতে বরেন্দ্র উদ্ধার করিয়া, মহীপালেরও বৈরাগ্য উপস্থিত হইয়াছিল এবং অশোকের ন্যায় মহীপালও যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিত্যাগ করিয়া, পরহিতকর এবং পারত্রিক কল্যাণকর কর্ম্মানুষ্ঠানে জীবন উৎসর্গ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন[৫৭]।” চন্দ মহাশয়ের উক্তি সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু বলিয়াছেন, “বাস্তবিক তখন মহীপালের বৈরাগ্যের উপযুক্ত কাল উপস্থিত হয় নাই।..... যে কলঞ্জরপতি তাঁহার পিতামাতাকে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত মিত্রতা ও একতা স্থাপন করিয়া বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ হইতে উত্তরাপথ রক্ষা করিতে যাওয়া কখনই তিনি উপযুক্ত মনে করেন নাই[৫৮]।” চন্দজ মহাশয় বৈরাগ্যের যুক্তি দেখাইয়া মহীপালের কাপুরুষতা ও সঙ্কীর্ণচিত্ততা গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বস্তুতঃ মহীপালের ঔদাসীন্যের কোনই উপযুক্ত কারণ দেখিতে পাওয়া যায় না, ধর্ম্মবিদ্বেষ ও ঈর্ষাই যে মহীপালের ধর্ম্ম-যুদ্ধের প্রতি ঔদাসীন্যের প্রধান কারণ, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই।

 প্রাচীন ষাহি-রাজ্য ধ্বংস করিয়া সুলতান মহ্‌মূদ্ যখন উত্তরাপথের প্রসিদ্ধ নগরসমূহ ধ্বংস করিতেছিলেন, শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন যে, গৌড়েশ্বর তখন “বারাণসীধামকে কীর্ত্তিরত্নে সজ্জিত করিতে গিয়া...তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলেন[৫৯]।” স্থাণ্বীশ্বর, মথুরা, কান্যকুব্জ, গোপাদ্রি, কলঞ্জর, সোমনাথ প্রভৃতি নগর, দুর্গ ও পবিত্র তীর্থসমূহ যখন ধ্বংস হইতেছিল, তখন উত্তরাপথের পূর্ব্বার্দ্ধের অধীশ্বর পরম নিশ্চিন্তমনে “কর্ম্মানুষ্ঠান” করিতেছিলেন। দুর্জ্জেয় গোপাদ্রিদুর্গ অধিকৃত হইল; প্রাচীন কান্যকুব্জ নগরে বৎসরাজ, নাগভট ও ভোজদেবের বংশধর রাজ্যপালদেব আত্মরক্ষায় অসমর্থ হইয়া মহ্‌মূদের শরণাগত হইলেন। মহ্‌মূদ তাহাকে আশ্রয় দিয়া রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিলে চন্দেল্ল-রাজ গণ্ডের পুত্র বিদ্যাধরের আদেশে কচ্ছপঘাতবংশীয় অর্জ্জুন রাজ্যপালের মস্তকচ্ছেদন করিয়াছিলেন[৬০]। তখনও কি গৌড়েশ্বর বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়াছিলেন?

 মজঃফরপুর জেলায় ইমাদপুর গ্রামে আবিষ্কৃত কতকগুলি পিত্তলমূর্ত্তি মহীপালদেবের ৪৮শ রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[৬১]। তিব্বতীয় ইতিহাসকার লামা তারানাথ বলেন যে, মহীপালদেব বায়ান্ন বৎসর কাল রাজত্ব করিয়াছিলেন[৬২]। ইমাদপুরের মূর্ত্তিগুলির খোদিতলিপির উপরে নির্ভর করিয়া তারানাথের উক্তি, ঐতিহাসিক সত্যরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। প্রথম মহীপালদেবের মৃত্যুর পরে তৎপুত্র নয়পালদেব গৌড়-মগধ-বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন[৬৩]। বাণগড়ে আবিষ্কৃত মহীপালদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বামনভট্ট মহীপালদেবের মন্ত্রী ছিলেন। এই বামনভট্টই বাণগড় তাম্রশাসনের দূতক[৬৪]

 স্থিরপাল ও বসন্তপালের সারনাথলিপি যে সময়ে উৎকীর্ণ হইয়াছিল, সে সময়ে প্রথম মহীপালদেবের মৃত্যু হইয়াছিল বলিয়া অনুমান হয়; কারণ, প্রথমতঃ সারনাথ-লিপিতে, ‘প্রবর্দ্ধমানবিজয়রাজ্যে’ অথবা ‘কল্যাণ-বিজয়-রাজ্যে’ ইত্যাদি কোন পদ ব্যবহৃত হয় নাই। সারনাথ-লিপিতে ‘অকারয়ৎ’ পদ ব্যবহৃত হইয়াছে, ইহা হইতে অনুমান হয় যে, মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠাকালে মহীপালদেবের দেহাবসান হইয়াছিল। সারনাথ-লিপি পদ্যে লিখিত, সুতরাং নিশ্চয় করিয়া কোন কথা বলিতে পারা যায় না। অনুমান হয় যে, সারনাথ-লিপির তারিখের এক বৎসর পূর্ব্বে, অর্থাৎ ১০২৫ খৃষ্টাব্দে প্রথম মহীপালদেবের মৃত্যু হইয়াছিল এবং নয়পালদেব সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। নয়পালদেবের রাজ্যকালে জগদ্বিজয়ী বীর কর্ণদেব গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, মহীপালদেবের রাজ্যকালে গাঙ্গেয়দেব তীরভুক্তি অধিকার করিয়াছিলেন, সুতরাং তৎপূর্ব্বে অবশ্যই বারাণসী অধিকৃত হইয়াছিল। কর্ণদেব সিংহাসনে আরোহণ করিয়া সমস্ত উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথ বিজয় করিয়াছিলেন। নাগপুরে আবিষ্কৃত পরমার উদয়াদিত্যের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, যে কর্ণদেব কর্ণাটদিগের সহিত মিলিত হইয়া সমগ্র পৃথিবী অধিকার করিয়াছিলেন, উদয়াদিত্য তাঁহাকে পরাজিত করিয়া রাজ্যোদ্ধার করিয়াছিলেন[৬৫]। কর্ণের পৌত্র গয়কর্ণদেবের পত্নী অহ্লণদেবীর ভেড়াঘাটে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, কর্ণদেবের বিক্রম দর্শনে পাণ্ড্যরাজ চণ্ডতা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, মুরল (কেরল)-রাজ গর্ব্ব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, কুঙ্গরাজ সৎপথে আগমন করিয়াছিলেন, বঙ্গ-রাজ কলিঙ্গ-রাজের সহিত ভয়ে কম্পিত হইয়াছিলেন, কীর-রাজ পিঞ্জরাবদ্ধ শুকপক্ষীর ন্যায় গৃহে অবস্থান করিতেছিলেন এবং হূণ-রাজ হর্ষ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন[৬৬]। করণবেলে আবিষ্কৃত কর্ণদেবের প্রপৌত্র জয়সিংহদেবের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, চোল, কুঙ্গ, হূণ, গৌড়, গুর্জ্জর এবং কীর দেশের অধিপতিগণ, কর্ণদেব কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন[৬৭]। ১৩১৭ বিক্রমাব্দে উৎকীর্ণ চন্দেল্লবংশীয় বীরবর্ম্মার শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, অগস্ত্য যেমন সমুদ্র পান করিয়াছিলেন; কীর্ত্তিবর্ম্মাও সেইরূপ পয়োধিরূপ কর্ণকে পান করিয়াছিলেন[৬৮]। মহোবায় আবিষ্কৃত চন্দেল্লবংশের একখানি শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বিষ্ণু যেমন মন্দরপর্ব্বতদ্বারা বহুপর্ব্বতগ্রাসী সমুদ্রকে মন্থন করিয়া অমৃতের উৎপত্তি করাইয়াছিলেন, তেমনই কীর্ত্তিবর্ম্মা বহুরাজ্যগ্রাসী কর্ণের সেনাদলকে পরাজিত করিয়া যশঃ ও হস্তী লাভ করিয়াছিলেন[৬৯]। কৃষ্ণমিশ্র-প্রণীত “প্রবোধচন্দ্রোদয়ে”র সূচনা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, গোপাল নামক কীর্ত্তিবর্ম্মার জনৈক ব্রাহ্মণজাতীয় সেনাপতি চেদি-রাজ কর্ণদেবকে পরাজিত করিয়া কীর্ত্তিবর্ম্মাকে সিংহাসনে পুনঃ স্থাপন করিয়াছিলেন। “প্রবোধচন্দ্রোদয়ে”র সূচনায় তিন স্থানে গোপাল কর্ত্তৃক কর্ণদেবের পরাজয়ের উল্লেখ আছে। এক স্থানে কথিত আছে যে, গোপাল কর্ণদেব কর্ত্তৃক উন্মূলিত সাম্রাজ্যে কীর্ত্তিবর্ম্মাকে পুনঃ স্থাপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন[৭০]। আর এক স্থানে দেখিতে পাওয়া যায় যে, গোপাল বলবান্ কর্ণদেবকে পরাজিত করিয়া কীর্ত্তিবর্ম্মার উন্নতির কারণ হইয়াছিলেন[৭১]। তৃতীয় স্থানে কর্ণদেবকে মধুমথনকারী বিষ্ণুর সহিত তুলনা করা হইয়াছে[৭২]। জৈনাচার্য্য হেমচন্দ্র সূরি-যুদ্ধে কর্ণকে পরাজিত করণের জন্য অনহিলপাটকের প্রথম ভীমদেবকে প্রশংসা করিয়াছিলেন[৭৩]। বিহ্লন-রচিত “বিক্রমাঙ্কচরিত” হইতে অবগত হওয়া যায় যে, কর্ণদেব কলঞ্জরপর্ব্বতাধিপতির (অর্থাৎ চন্দেল্ল-রাজের) যমস্বরূপ ছিলেন[৭৪]। জয়সিংহদেব ও অহ্লণদেবীর শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, গৌড়ীয়গণ কর্ণদেব কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিল। তিব্বতীয় সাহিত্যে কর্ণদেবের সহিত গৌড়েশ্বরের যুদ্ধ-বিগ্রহের উল্লেখ আছে। রায় শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র দাস বাহাদুর-সম্পাদিত বুদ্ধিষ্ট টেক্সট্ সোসাইটীর পত্রিকায় গৌড়েশ্বরের সহিত কর্ণদেবের যুদ্ধের বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে। “দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যখন বজ্রাসনে, অর্থাৎ—মহাবোধিতে বাস করিতেছিলেন, সেই সময়ে মগধ-রাজ নয়পালের সহিত তীর্থিকধর্ম্মাবলম্বী কর্ণ্য-রাজের বিবাদ হইয়াছিল। কর্ণ্য-রাজ মগধ আক্রমণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি নগর অধিকার করিতে না পারিয়া কতকগুলি বৌদ্ধ বিহার মন্দিরাদি ধ্বংস করিয়াছিলেন। পরে নয়পালের সেনা জয়লাভ করিলে কর্ণ্য-রাজের সেনাগণ যখন নিহত হইতেছিল তখন শ্রীজ্ঞান তাহাদিগকে আশ্রয় প্রদান করিয়া রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টায় যুদ্ধ স্থগিত হইয়া সন্ধি স্থাপিত হইয়াছিল[৭৫]।” তিব্বতীয় সাহিত্যের কর্ণ্য-রাজ যে চেদিরাজ কর্ণ, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। শ্রীযুক্ত মনোমোহন চক্রবর্ত্তী সর্ব্বপ্রথমে এই মত প্রকাশ করিয়াছিলেন[৭৬]। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ তাহা সমর্থন করিয়াছেন[৭৭]; শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসুও এই মতাবলম্বী[৭৮]। নয়পালের সহিত কর্ণের সন্ধি স্থাপিত হইলে নয়পালের পুত্র বিগ্রহপালের সহিত কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীর বিবাহ হইয়াছিল।

 নয়পালদেবের রাজ্যের দুইখানি শিলালিপি ও একখানি প্রাচীন গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে। গয়ানগরে কৃষ্ণদ্বারিকা মন্দিরে আবিষ্কৃত একখানি শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, পরিতোষের পৌত্র, শূদ্রকের পুত্র, বিশ্বাদিত্য, নয়পালদেবের পঞ্চদশ রাজ্যাঙ্কে জনার্দ্দনের একটি মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন[৭৯]। এই বিশ্বাদিত্য বা বিশ্বরূপ উক্ত বর্ষে গদাধরের জন্য আর একটি মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। বর্ত্তমান গদাধর-মন্দিরের প্রাঙ্গণে অবস্থিত নরসিংহদেবের মন্দিরমধ্যে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে এই কথা অবগত হওয়া যায়[৮০]। নয়পালদেবের চতুর্দ্দশ রাজ্যাঙ্কে রাজ্ঞী উদ্দাকার ব্যয়ে লিখিত একখানি “পঞ্চরক্ষা” গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা এক্ষণে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তকাগারে রক্ষিত আছে। ইহার পুষ্পিকায় লিখিত আছে;—“দেয়ধর্ম্মোয়ং প্রবরমহাযানযায়িন্যা পরমোপাসিকারাজ্ঞীউদ্দাকায়া যদত্রপুণ্যন্তদ্ভবত্বাচার্য্যোপাধ্যায়মাতাপিতৃপূর্ব্বংগমং কৃত্বা সকল সত্ত্বরাশেরনুত্তরজ্ঞানাবাপ্তয় ইতি॥ পরমসৌগতমহারাজাধিরাজপরমেশ্বরশ্রীমন্নয়পালদেব-প্রবর্দ্ধমানবিজয়রাজ্যে সম্বৎ ১৪ চৈত্রদিনে ২৭ লিখিতেয়ং ভট্টারিকা ইতি[৮১]।” অনুমান হয় যে, নয়পালদেব বিংশতিবর্ষকাল গৌড়-সিংহাসনে আসীন ছিলেন এবং ১০৪৫ খৃষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল। নয়পালদেবের রাজ্যকালে বৈদ্যজাতির প্রভূত উন্নতি হইয়াছিল; বৈদ্য-গ্রন্থকার চক্রপাণিদত্তের পিতা নারায়ণ, নয়পালদেবের রন্ধনশালার অধ্যক্ষ ছিলেন[৮২]। জনার্দ্দন-মন্দিরের প্রশস্তি বাজীবৈদ্যসহদেব[৮৩] কর্ত্তৃক এবং গদাধর-মন্দিরের প্রশস্তি বৈদ্যবজ্রপাণি[৮৪] কর্ত্তৃক রচিত হইয়াছিল। এই খোদিতলিপিদ্বয়ে শিল্পীর অনবধানতাপ্রযুক্ত বহু ভ্রম সত্বেও রচয়িতৃগণের বিদ্যার ও রচনাকৌশলের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। নয়পালদেবের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল গৌড়-মগধ-বঙ্গের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন[৮৫]। নয়পালদেবের রাজ্যকালে বিক্রমপুরবাসী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নালন্দ মহাবিহারের সঙ্ঘস্থবির নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তিব্বত-রাজের অনুরোধে শ্রীজ্ঞান তথায় গমন করিয়াছিলেন[৮৬]

 তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের রাজ্যকাল হইতে পাল-সাম্রাজ্যের অধঃপতন আরম্ভ হইয়াছিল। খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষপাদে উত্তরাপথে প্রবল রাজ-শক্তির একান্ত অভাব হইয়াছিল। আর্য্যাবর্ত্তের এই ঘোর দুর্দ্দিনে মুসলমান সেনাপতি আহমদ্ নিয়াল্-তিগীন্ অনায়াসে বিস্তৃত মধ্যদেশ অতিক্রম করিয়া পবিত্র বারাণসী নগরী লুণ্ঠন করিয়াছিলেন[৮৭]। বিশাল আর্য্যাবর্ত্তের অসংখ্য রাজন্যগণের মধ্যে কেহই তাঁহাকে বাধা দিতে অগ্রসর হন নাই। গুর্জ্জরেশ্বর প্রয়াগে প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র দুর্গে আত্মরক্ষার চিন্তায় ব্যাপৃত ছিলেন। অন্তর্ব্বিদ্রোহ দমন ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে রাজ্যরক্ষা-কার্য্যে তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকাল অতিবাহিত হইয়াছিল। চেদিবংশীয় কর্ণদেব ও কল্যাণের চালুক্যবংশীয় আহবমল্লের পুত্র বিক্রমাদিত্য[৮৮] তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। কর্ণদেব পরাজিত হইয়া তাঁহার যৌবনশ্রী নাম্নী কন্যার সহিত বিগ্রহপালদেবের বিবাহ দিয়াছিলেন[৮৯]। চালুক্যরাজ আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বার্দ্ধ বিজয় করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন। এই সময়ে উত্তরবঙ্গে কৈবর্ত্ত জাতি বিদ্রোহী হইয়াছিল এবং তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের রাজত্বের শেষভাগ বিদ্রোহদমনে অতিবাহিত হইয়াছিল। তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের একখানি তাম্রশাসন ও একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাম্রশাসনখানি বিগ্রহপালদেবের দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত হইয়াছিল এবং এতদ্দ্বারা বিগ্রহপালদেব পৌণ্ড্রবর্দ্ধন-ভুক্তির কোটিবর্ষ-বিষয়ে অবস্থিত ব্রাহ্মণী গ্রামে খোদ্ধোতদেবশর্ম্মা নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে প্রদান করিয়াছিলেন[৯০]। শিলালিপিখানি গয়ায় অক্ষয়-বটের পাদমূলে সংলগ্ন আছে। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বিগ্রহপালদেবের পঞ্চম রাজ্যাঙ্কে বিশ্বাদিত্য গয়া নগরে বটেশ ও প্রপিতামহেশ্বর নামক শিবলিঙ্গদ্বয় স্থাপন করিয়া দুইটি মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেনে[৯১]

 বিগ্রহপালদেবের ত্রয়োদশ রাজ্যাঙ্কে সুবর্ণকার সাহের পুত্র দেহেক একটি বুদ্ধমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৯২]। এই মূর্ত্তিটি বিহার নগরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল এবং ইহা এক্ষণে কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রী ব্যতীত তৃতীয় বিগ্রহপাল এক রাষ্ট্রকূট-বংশীয়া মহিলার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, ইঁহার নাম অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বিগ্রহপালদেবের তিন পুত্রের নাম আবিষ্কৃত হইআছে;—মহীপাল, শূরপাল ও রামপাল। রামপাল রাষ্ট্রকূটবংশীয়া মহিষীর গর্ভজাত। ইঁহারা সকলেই একে একে গৌড়-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। বিগ্রহপালদেবের মৃত্যুর পরে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় মহীপালদেব গৌড়-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।

 বীরভূম জেলায় পাইকোর গ্রামে শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় চেদী-রাজ শ্রীকর্ণদেবের শিলালিপিযুক্ত একটি পাষাণস্তম্ভ আবিষ্কার করিয়াছেন। এই খোদিতলিপিতে শ্রীকর্ণদেবের নাম ও তাঁহার বংশপরিচয় স্পষ্ট পাঠ করা যায় কিন্তু খোদিতলিপি ক্ষয় হইয়া যাওয়ায় উক্ত স্তম্ভ কি জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা বুঝিতে পারা যায় না। বঙ্গদেশের কেন্দ্রস্থলে রাঢ় ভূভাগের মধ্যদেশে অবস্থিত পাইকোর গ্রামে এই স্তম্ভ আবিষ্কৃত হওয়ায় অনুমান হইতেছে যে, কর্ণদেব স্বয়ং এই পাইকোর গ্রামে আসিয়া একটি মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন, অথবা একটি জয়স্তম্ভ স্থাপন করাইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় যে স্তম্ভটি আবিষ্কার করিয়াছেন তাহা হয় কর্ণদেবের জয়স্তম্ভ, না হয় কর্ণদেব নির্ম্মিত মন্দিরের মণ্ডপ বা অর্দ্ধমণ্ডপের স্তম্ভ[৯৩]। কর্ণদেব নির্ম্মিত মন্দির রেবারাজ্যে অমর-কণ্টকনামক তীর্থে আবিষ্কৃত হইয়াছে। পাইকোরের ধ্বংসাবশেষ খনন করিলে নূতন তথ্য আবিষ্কার হইতে পারে। কর্ণদেব হয়ত যুদ্ধযাত্রায় গৌড়দেশে আসিয়া দ্বিতীয় অভিযানে গৌড়াধিপ তৃতীয় বিগ্রহপালকে পরাজিত করিয়া এই জয়স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন, অথবা তাঁহার কন্যা যৌবনশ্রীর সহিত তৃতীয় বিগ্রহপালের বিবাহ দিয়া পাইকোর গ্রামে একটি মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন।

 তৃতীয় বিগ্রহপালদেবই বোধ হয় বহু রজত মুদ্রার প্রচলন করিয়াছিলেন। এই জাতীয় মুদ্রা পাটনা জেলায় ঘোষরাবাঁ গ্রামে, বীরদেব নির্ম্মিত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ মধ্যে আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৯৪]

পরিশিষ্ট (জ)

শূর-রাজবংশ


 বাঙ্গালা দেশে শূর উপাধিধারী রাজ-বংশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রবল জনশ্রুতি আছে। কথিত আছে যে, আদিশূর নামক কোন রাজা ভারতবর্ষের অন্য কোন স্থান হইতে বাঙ্গালা দেশে ব্রাহ্মণ আনয়ন করিয়াছিলেন। যে জাতীয় প্রমাণ, বিজ্ঞান-সম্মত প্রণালীতে রচিত ইতিহাসে গৃহীত হইতে পারে, তদনুসারে শূরবংশীয় দুইজন নরপতির নাম মাত্র অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে। প্রথমের নাম রণশূর। প্রথম রাজেন্দ্রচোলদেব যখন দিগ্বিজয় উপলক্ষে উত্তরাপথে আসিয়াছিলেন, তখন রণশূর দক্ষিণ-রাঢ়ের অধিপতি ছিলেন। এতদ্ব্যতীত সান্ধ্যকরনন্দী-বিরচিত রামচরিতে লক্ষ্মীশূর নামক অপর মন্দারের অধিপতির নাম পাওয়া যায়। রামপালের সহিত কৈবর্ত্ত-রাজ ভীমের যুদ্ধকালে লক্ষ্মীশূর রামপালের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন। রণশূরের সহিত লক্ষ্মীশূরের কি সম্পর্ক এবং তাঁহারা একবংশজাত কি না, তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। রাজশাহী জেলায় মান্দাগ্রামে আবিষ্কৃত তৃতীয় গোপালদেবের শিলালিপিতে বোধ হয়, দামশূর নামক এক ব্যক্তির উল্লেখ আছে। লক্ষ্মীশূর ও দামশূরের প্রসঙ্গ যথাস্থানে উথাপিত হইবে। বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত কুলগ্রন্থসমূহে দেখিতে পাওয়া যায় যে, আদিশূর নামক একজন রাজা ভারতবর্ষের অন্য কোন স্থান হইতে যজ্ঞ করাইবার জন্য বাঙ্গালা দেশে পঞ্চজন ব্রাহ্মণ আনয়ন করাইয়াছিলেন। কুলশাস্ত্র ভিন্ন অনা কোন জাতীয় গ্রন্থে আদিশূরের পরিচয় পাওয়া যায় না। এখন যে সমস্ত কুলগ্রন্থ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাদিগের মধ্যে দুই একখানি ব্যতীত অপর সমস্তই গত দুই শতাব্দীর মধ্যে রচিত। যে দুই একখানি কুলগ্রন্থ অতি প্রাচীন বলিয়া পরিচিত, তাহারও কোন পুরাতন পুঁথি আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। বঙ্গদেশীয় কুলশাস্ত্র-গ্রন্থসমূহ যতই প্রাচীন হউক, তাহা আদিশূরের আনুমানিক আবির্ভাব-কালের বহু পরে রচিত; সুতরাং তৎসমুদয় বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে রচিত ইতিহাসের উপাদানস্বরূপ গ্রহণ করিতে হইলে অপর প্রমাণের সমর্থন আবশ্যক। অদ্যাবধি কোন তাম্রশাসনে বা খোদিতলিপিতে কুলশাস্ত্রের উক্তি সমর্থনকারী প্রমাণ আবিষ্কৃত হয় নাই। কুলশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণের মূল্য পূর্ব্বে আলোচিত হইয়াছে (পৃঃ ৫২)। আদিশূর সম্বন্ধে কুলশাস্ত্রের প্রমাণ ব্যতীত যখন অন্য কোন জাতীয় প্রমাণ আবিষ্কৃত হয় নাই, তখন আদিশূর সম্বন্ধীয় কুলগ্রন্থের প্রমাণ বিশ্লেষণ করা নিতান্ত আবশ্যক। আদিশূর সম্বন্ধে ১৩১৯ বঙ্গাব্দ পর্য্যন্ত কুলশাস্ত্রের যত প্রমাণ আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহা শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ কর্ত্তৃক “গৌড়রাজমালা”য় সঙ্কলিত হইয়াছে।

 শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ বলিয়াছেন,—“রাটীয় কুলজ্ঞগণের মধ্যে প্রচলিত আদিশূর সম্বন্ধীয় জনশ্রুতি নিম্নোক্ত শ্লোকটিতে বিনিবদ্ধ আছে,—

আসীৎ পুরা মহারাজ আদিশূর প্রতাপবান্।
আনীতবান্ দ্বিজান্ পঞ্চ পঞ্চগোত্রসমুদ্ভবান্॥

 ...বারেন্দ্র কুলজ্ঞগণের গ্রন্থে আরও কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁহারা আদিশূরের এবং বল্লালসেনের সম্বন্ধ নিরূপণ করিয়াছেন। যথা,—

 “জাতো বল্লালসেনো গুণিগণগণিতস্তস্য দৌহিত্রবংশে।”—আদিশূর রাজা পঞ্চগোত্রের পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়ন করিলেন......এহি পঞ্চগোত্রে পঞ্চ ব্রাহ্মণ সংস্থাপন করিয়া আদিশূর রাজার সর্গারোহণ।...বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকার ঐতিহাসিক অংশ ‘আদিশূর রাজার ব্যাখ্যা’ নামে পরিচিত। লালোরনিবাসী শ্রীযুক্ত মনোমোহন মুকুটমণির, মাঝগ্রামের শ্রীযুক্ত জানকীনাথ সার্ব্বভৌমের এবং রামপুর বোয়ালিয়ার শ্রীযুক্ত নৃত্যগোপাল রায় মহাশয়-সংগৃহীত পুঠিয়ানিবাসী ৺মহেশচন্দ্র শিরোমণির ঘরের পুস্তকমধ্যে পাঁচ প্রকার আদিশূর রাজার ব্যাখ্যার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তন্মধ্যে দুইখানিতে বল্লালসেন আদিশূরের দৌহিত্রবংশোদ্ভব বলিয়া কথিত।......“গৌড়ে ব্রাহ্মণ” গ্রন্থে (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৬ পৃঃ) উদ্ধৃত একটি শ্লোকে কথিত হইয়াছে—রাজা শ্রীধর্ম্মপাল ভট্টনারায়ণের পুত্র আদিগাঞিকে যজ্ঞান্তে দক্ষিণা দানার্থ ধামসার গ্রাম দান করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসুর মতানুসারে, এই ধর্ম্মপালকে যদি পালবংশীয় ধর্ম্মপাল মনে করা যায়, তবে আদিশূরকে ধর্ম্মপালের পিতা গোপালের তুল্যকালীন বিবেচনা করিতে হয়। এইরূপ সিদ্ধান্ত ‘গৌড়ে ব্রাহ্মণে’ধৃত (৮৩ পৃঃ) ‘ভাদুড়ীকুলের বংশাবলীর নিম্নোক্ত বচনের বিরোধী=

তত্রাদিশূরঃ শূরবংশসিংহো বিজিত্য বৌদ্ধং নৃপপালবংশং।
শশাস গৌড়” ইত্যাদি।

 ‘গৌড়ে ব্রাহ্মণ’ধৃত এই শেষোক্ত বচন আবার শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু কর্ত্তৃক ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’ধৃত “শাকে বেদকলম্বষট্‌কবিনিতে রাজাদিশূর স চ” (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, প্রথম ভাগ, ৮৩ পৃঃ) এই বচনের, অর্থাৎ—আদিশূর ৬৫৪ শকাব্দে বর্ত্তমান ছিলেন, এই মতের বিরোধী। যে যে কুলজ্ঞগণের সহিত আলাপ করিয়াছি, তাঁহারা এ সকল বচনের কোনটির বিষয়েই অবগত নহেন। সুতরাং এই সকল বচন প্রবল জনশ্রুতিমূলক বলিয়া স্বীকার করা যায় না......‘লঘুভারত’কারও আদিশূর কর্ত্তৃক গৌড়ের পাল-বংশ উচ্ছেদের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন (গৌড়ে ব্রাহ্মণ, ৩২ পৃঃ, ৪ নং টীকা)।”—গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৫৭-৫৮।

 শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ-সংগৃহীত আদিশূর সম্বন্ধীয় কুলশাস্ত্রের প্রমাণ পর্য্যালোচনা করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ১৩১৯ বঙ্গাব্দের পূর্ব্বে আবিষ্কৃত কুলশাস্ত্রসমূহে আদিশূরের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে দুইটি ভিন্ন মত ছিল। প্রথম মতানুসারে আদিশূর পাল-রাজবংশের পূর্ব্ববর্ত্তী, তিনি ৬৫৪ শকে আবির্ভূত হইয়াছিলেন এবং আদিশূর প্রথম গোপালদেবের সমসাময়িক ব্যক্তি। দ্বিতীয় মতানুসারে আদিশূর পাল-রাজগণকে পরাজিত করিয়া গৌড়ের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন; ‘ভাদুড়ীকুলের বংশাবলীতে ও ‘লঘুভারতে’ এই মত দেখিতে পাওয়া যায়।

 জয়ন্ত ও আদিশূরের একত্ব সম্বন্ধে যে সমস্ত প্রমাণ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তৎসমুদয় পূর্ব্বে (১৩২-৩৩ পৃঃ) আলোচিত হইয়াছে। ১২৩১ বঙ্গাদে প্রকাশিত ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস,’ রাজন্যকাণ্ডে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু কতকগুলি নূতন মত প্রকাশ করিয়াছেন:—

 (১) “রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরীতে বর্ণিত হইয়াছে, ৬৫৪ শকে, অর্থাৎ ৭৩২ খৃষ্টাব্দে আদিশূর রাজা হন এবং ৬৬৮ শকে বা ৭৪৬ খৃষ্টাব্দে সাগ্নিক বিপ্রগণ গৌড়ে আগমন করেন।” পৃঃ ৯২

 (২) “সুপ্রসিদ্ধ রাঢ়ীয় কুলাচার্য্য বাচস্পতিমিশ্রের মতে ৬৫৪ শকেই (৭৩২ খৃষ্টাব্দে) বিপ্রগণ গৌড়ে সমাগত হন।”

 (৩) “বারেন্দ্র কুলপঞ্জীর মতে......৬৫৪ শকে......কান্যকুব্জোদ্ভব সমুজ্জ্বলকান্তিবিশিষ্ট পঞ্চগোত্রের পঞ্চজন বেদবিদ্ ব্রাহ্মণকে আনিবার জন্য যত্নবান্ হইয়াছিলেন।” পৃঃ ৯৩

 (৪) আমরা নানা গ্রন্থ আলোচনা করিয়া বুঝিয়াছি যে, “আদিশূর, ব্যক্তিবিশেষের নাম নহে। মুসলমান-আগমনের পূর্ব্বে বিভিন্ন সময়ে যে যে হিন্দু-নৃপতি হিন্দু-সমাজ-সংস্কারে মনোযোগী হইয়াছেন, কুল-গ্রন্থকারগণ সেই সেই নৃপতিকেই ‘আদিশূর’ নাম দিয়া গৌরবান্বিত করিয়াছেন। তন্মধ্যে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের বীজপুরুষ ক্ষিতীশ, তিথিমেধা, বীতরাগ, সুধানিধি ও সৌভরি—পঞ্চগোত্রীয় এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ যাঁহার যজ্ঞ করিতে আসেন, তিনি প্রথম আদিশূর।”—পৃং ১০৬।

 (৫) “সারস্বত, কান্যকুব্জ, গৌড়, মৈথিল ও উৎকলদিগের বাসভূমিই পঞ্চগৌড়। এরূপ স্থলে কান্যকুব্জও গৌড়াধিপের অধিকারভুক্ত হইয়াছিল। খুব সম্ভব তিনিই পুরুবংশমধ্যে প্রথম পঞ্চগৌড়ের অধীশ্বর হইয়াছিলেন বলিয়া পরবর্ত্তী কালে আদিশূর নামেই প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন।”

 (৬) “ভগবান্ বিষ্ণু যেমন বরাহ অবতারে জল হইতে পৃথিবী উদ্ধার করেন, ভোজদেবও সেইরূপ পৈতৃক সাম্রাজ্য উদ্ধার করিয়া ‘আদিবরাহ’ উপাধি ধারণ করেন। উত্তররাঢ়ীয় কায়স্থ-কুলগ্রন্থে ইনিই কান্যকুব্জাধিপ ‘আদিশূর’ বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন।”

 (৭) “মহারাজ যশোবর্ম্মার প্রেরণায় গৌড়মণ্ডলে যে সকল ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদিক ধর্ম্মপ্রচারে মনোযোগী হইয়াছিলেন, আদিশূরের পিতা মাধবকে আমরা তাঁহাদের অন্যতম মনে করি। পৃঃ ১০৮

 (৮) “পূর্ব্বেই লিখিয়াছি যে, আদিশূরের যজ্ঞ করিবার জন্য ৬৫৪ শকে পঞ্চ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ আগমন করেন। এ সময়ে আদিশূরের সভায় ব্রাহ্মণসহ কায়স্থগণের আগমনের কথাও কোন কোন গ্রন্থে বিবৃত হইয়াছে; কিন্তু হরিমিশ্র, বাচস্পতিমিশ্র, মহেশমিশ্র, শ্যামচতুরানন প্রভৃতির প্রাচীন ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহে কোথাও এ কথা লিখিত হয় নাই।”—পৃঃ ১১২।

 একই ব্যক্তির রচিত একই গ্রন্থে প্রকাশিত মতগুলি পরস্পরের বিরোধী। ৬৫৪ অথবা ৬৬৮ শকে ব্রাহ্মণ আগমন এবং পঞ্চ গৌড়ে আদিশূরের সাম্রাজ্য স্থাপন ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ নামক গ্রন্থমালার মূলমন্ত্র। এই মত প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়কে বহু কুলগ্রন্থের অবতারণা করিতে হইয়াছে; কিন্তু অবতারণাকালে উক্তিসমূহে পরস্পরের সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় নাই। যে আদিশূর ৬৫৪ শকাব্দে সম্রাট্ পদবী লাভ করিয়াছিলেন, তিনি কখনই ভোজদেব হইতে পারেন না; কারণ, গুর্জ্জর-প্রতীহারবংশীয় ভোজদেব খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে সিংহাসনে আরোহন করিয়াছিলেন। বসুজ মহাশয় গ্রন্থমধ্যে ঈঙ্গিতে একাধিক আদিশূরের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াছেন বটে, কিন্তু অদ্যাবধি ইতিহাসে শূরবংশে আদিশূর নাম কিম্বা উপাধিধারী দুইজন রাজার অস্তিত্বের কথার উল্লেখ পাওয়া যায় নাই।

 কান্যকুব্জ-রাজ যশোবর্ম্মার রাজ্যকালে আদিশূরের সাম্রাজ্য স্থাপিত হইয়াছিল, ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসে’ বসুজ মহাশয় ইহাই প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু যশোবর্ম্মার রাজত্বকালে কোন্ গৌড়েশ্বর কান্যকুব্জ বিজয় বা অধিকার করিয়াছিলেন, ইহা ঐতিহাসিক সত্যরূপে গৃহীত হইতে পারে না। বস্তুতঃ শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত, ধর্ম্মপাল ও দেবপাল ব্যতীত অন্য কোন গৌড়-রাজের পক্ষে কান্যকুব্জ জয় বা অধিকার অসম্ভব ছিল। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমাণ করিরাছেন যে—

বেদবাণাঙ্গশাকে তু নৃপোঽভূচ্চাদিশূরকঃ।
বসুকর্ম্মাঙ্গকে শাকে গৌড়ে বিপ্রাঃ সমাগতাঃ॥

এই শ্লোকটি ৺বংশীবদন বিদ্যারত্ন-সংগৃহীত কোনও কুলগ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় না, পরন্তু ‘কুলদোষ’ নামক গ্রন্থে নিম্নলিখিত লোকটি লিখিত আছে।

ক্ষত্রিয়বংশে সমুৎপন্নো মাধবো কুলসম্ভবঃ।
বসু ধর্ম্মাষ্টকে শকে নৃপ (পো) ভু (ভূ)চ্চাদিশূরকঃ॥

সুতরাং অদ্যাবধি কুলশাস্ত্রোল্লিখিত যে সমস্ত প্রমাণ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার উপরে নির্ভর করিয়া কান্যকুব্জ-রাজ যশোবর্ম্মার রাজত্বকালে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে আদিশূরের আবির্ভাবকাল নির্ণয় করা অথবা গৌড়ে একাধিক আদিশূরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যাইতে পারে না।

 কোন্ দেশ হইতে বঙ্গে ব্রাহ্মণ আগমন করিয়াছিল, সে সম্বন্ধেও কুলশাস্ত্রে মতদ্বৈধ আছে,—

 (১) রাঢ়ীয় প্রাচীন কুলাচার্য্য হরিমিশ্র লিখিয়াছেন—“মহারাজ আদিশূর পঞ্চ-গৌড়ের অধিপতি ছিলেন, কাশীশ্বরের সঙ্গে তাঁহার স্পর্দ্ধা ছিল। তাঁহার সম্মান ও দানশক্তি দেখিয়া কাশী-রাজকেও লজ্জিত হইতে হইয়াছিল। কিন্তু মহারাজ আদিশূরের সভায় সাগ্নিক ব্রাহ্মণ ছিলেন না। এ জন্য তিনি ব্রাহ্মণ কর্ত্তৃক নিন্দিত স্বরাজ্যে সাগ্নিক ব্রাহ্মণ আনয়ন করিতে অভিলাষী ছিলেন, তাহাতে কোলাঞ্চ দেশ হইতে জ্ঞানী ও তপোনিরত ক্ষিতীশ, মেধাতিথি, বীতরাগ, সুধানিধি ও সৌভরি, এই পাঁচজন ধর্ম্মাত্মা গৌড়মণ্ডলে আগমন করিয়াছিলেন।—পৃঃ ৯৫।

 (২) “বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকায় লিখিত আছে, পুরাকালে সজ্জন ও পুণ্যবানের আশ্রয় কান্যকুব্জবাসী নৃপতিশ্রেষ্ঠ চন্দ্রকেতুর চন্দ্রমুখী নামে এক পুণ্যশীলা কন্যা ছিলেন। সেই চতুরা চান্দ্রায়ণব্রতচারিণী রাজকন্যা মহাপ্রতাপশাশী বিখ্যাত পৃথিবীপতি আদিশূরের মহিষী।......রাজপত্নী তাঁহাদের কথা শুনিয়া অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, ‘পিতার ইচ্ছা হইলেও ব্রাহ্মণহীন দেশে কিরূপে বাস করিব? তখন রাজা আদিশূর কান্যকুব্জ হইতে বেদবিদ্ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ আনিয়া স্ত্রীর ক্রোধ শান্তি করিলেন।”—৯৬-৭।

 (৩) “এ দেশে কোলাঞ্চ বলিলে সাধারণতঃ সকলেই কান্যকুব্জ মনে করিয়া থাকেন, কিন্তু প্রাচীন কোন্ সাহিত্যের কোষগ্রন্থে অথবা শিলালিপি বা তাম্রশাসনে কান্যকুব্জের নামান্তর যে কোলাঞ্চ, সে প্রসঙ্গ আদৌ নাই। ‘শব্দরত্নাবলী’ অভিধানে কোলাঞ্চ দেশবিশেষ বলিয়া লিখিত আছে, অথচ কান্যকুব্জের স্বতন্ত্র উল্লেখ ও তাহার পর্য্যায় মহোদয়, কান্যকুব্জ, গাধিপূর, কোশ ও কুশস্থলের উল্লেখ থাকিলেও ইহার মধ্যে কোলাঞ্চ শব্দই নাই। এরূপ স্থলে কোলাঞ্চ বলিলে কিরূপে কান্যকুব্জ স্বীকার করা যায়? বামন শিবরাম আপ্তে তাঁহার সংস্কৃত অভিধানে কোলাঞ্চের Name of the country of the Kalingas এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। মনিয়র উইলিয়ম তাঁহার বৃহৎ ইংরাজী-সংস্কৃত অভিধানে Small of Kalinga, the Coromondal coast from Cuttack to Madras; but according to some, this place is in Gangetic Hindusthan, with Kanauj for the gapital,’ অর্থাৎ—কোলাঞ্চ বলিলে কলিঙ্গদেশ, কটক হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত করমণ্ডল উপকূলভাগ, কিন্তু কাহারও কাহারও মতে কনৌজ-রাজধানীসমন্বিত গঙ্গাপ্রবাহিত হিন্দুস্থানমধ্যে অবস্থিত।”—পৃঃ ১৩০।

 “আমরা মনে করি, কোলাঞ্চল বা কোলাচল শব্দই সংক্ষেপে প্রাচীন কুলগ্রন্থসমূহে কোলাঞ্চলরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেখানে কোলগণের বাস, তাহাই কোলাঞ্চ।...কোলাঞ্চ ভাগবতে কোল্লক (৫, ১৯, ১৬) এবং মহাভারতে কোল্লগিরি (২।৩১।৬৮) ও কোল্লগিরেয় (১৪।৮৩।১১) নামে উল্লিখিত হইয়াছে। ‘... এরূপ স্থলে কোল্লগিরেয় বা হরিবংশবর্ণিত কোল জনপদ সুরাষ্ট্রের দক্ষিণে হইতেছে।”

 বসুজ মহাশয় যখন স্পষ্ট স্বীকার করিয়া লইয়াছেন যে, কোলাঞ্চ কান্যকুব্জ নহে, তখন কান্যকুব্জ হইতে ব্রাহ্মণ আগমন কিরূপে স্বীকার করা যাইতে পারে? অথচ অধিকাংশ কুলগ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় যে, আদিশূর কান্যকুব্জ হইতেই ব্রাহ্মণ আনয়ন করিয়াছিলেন। পরস্পরের বিরোধী উক্তিসমূহের উপরে নির্ভর করিয়া আদিশূরের কাল নির্ণয় করা অসম্ভব এবং সেই জন্যই গ্রন্থমধ্যে আদিশূরের নাম ও বিবরণ নিবিষ্ট হইল না। কেহই আদিশূরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন না। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ এই মত সমর্থন করিয়াছেন (মানসী, মাঘ, ১৩২১)। আদিশূর নামক কোন রাজার রাজ্যকালে বঙ্গে ব্রাহ্মণ আগমন ঘটিয়াছিল, এই প্রবাদের উপরে নির্ভর করিয়া কুলাচার্য্যগণ গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। এই প্রবাদের মূলে সত্য নিহিত আছে বলিয়াই বোধ হয়; কারণ, শ্যামলবর্ম্মার প্রসঙ্গে দৃষ্ট হইয়াছে যে, কুলশাস্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় সত্যের উপরে স্থাপিত। ভোজবর্ম্মার তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়া প্রমাণ হইয়াছে যে, শ্যামলবর্ম্মা বিজয়সেনের পুত্র নহেন বটে, কিন্তু শ্যামলবর্ম্মা নামে বঙ্গদেশে একজন প্রকৃত রাজা ছিলেন। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস,’ রাজন্যকাণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু যে সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা বা রাজগণের নাম উল্লেখ করিয়াছেন, উপযুক্ত প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত না হওয়ায় তৎসমুদয় গ্রন্থমধ্যে গৃহীত হইল না।


 যুক্ত প্রদেশের এলাহাবাদ জেলায় গোহারবা গ্রামে আবিষ্কৃত, কর্ণদেবের সপ্তম রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, কর্ণদেবের পিতা গাঙ্গেয়দেব, কীর, অঙ্গ, কুন্তল ও উৎকল-রাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন।

কারাপংজরবদ্ধকীরনৃপতির্দীপ্তোঙ্গলক্ষ্মীচয়ৈঃ
স্তস্মাৎকুন্তলভঙ্গভঙ্গিরসিকোগাঙ্গেয়দেবোভবৎ।
যেনাকারি করীন্দ্রকুম্ভদলনব্যাপারসারাত্মনা
নির্জ্জিত্যোৎকলমবধিসীম্নি জয়স্তম্ভঃ স্বকীয়োভুজঃ॥ ১৭
—Epigraphia Indica, Vol. XI, p. 143.

 সুতরাং নয়পালের রাজ্যকালে গাঙ্গেয়দেবই যে তীরভুক্তি অধিকার করিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই।

 জয়পালদেব অথবা তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে বরেন্দ্রভূমির শীয়ম্বগ্রামে প্রহাস নামে একজন ব্রাহ্মণ দুইটি মন্দির সংস্কার করাইয়াছিলেন, তাঁহার পিতার নামে ত্রিবিক্রম অথবা বিষ্ণুর একটি মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করাইয়াছিলেন এবং একটি দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন। প্রহাস শ্রাবস্তীভুক্তির তর্কারিকা গ্রাম বিনির্গত ব্রাহ্মণ-বংশজাত এবং আঙ্গীরস গোত্রদ্ভব। তিনি যে সমস্ত পুণ্যকার্য্য করিয়াছিলেন তাহার তালিকা বগুড়া জেলার শিলিমপুর গ্রামে আবিষ্কৃত একটি শিলালেখে প্রদত্ত আছে (Epigraphia Indica, Vol. XII, pp. 283-95.) শিলিমপুরে আবিষ্কৃত এই শিলালেখ এখন রাজসাহীতে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। এই শিলালেখে কোন রাজার নাম বা তারিখ নাই। এ শিলালেখের দ্বাবিংশতিতম শ্লোক হইতে জানিতে পারা যায় যে, প্রহাস কামরূপ-রাজ জয়পালদেবের নিকট হইতে নয়শত সুবর্ণমুদ্রা এবং কিঞ্চিৎ ভূমি দানস্বরূপ গ্রহণ করেন নাই (Epigraphia Indica, Vol. XII, p. 292)। কামরূপ-রাজ জয়পালদেবের সময়নির্দ্দেশ করিবার কোন উপায় এখনও পর্য্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই (এই জয়পাল এবং কামরূপ-রাজ হর্জ্জর বর্ম্মার পৌত্ত্র জয়পাল এক ব্যক্তি নহেন। Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXVI, p. 289 ff; Epigraphia Indica, Vol. V, App. no. 714, p. 96.)

 শিলিমপুরের শিলালেখের অক্ষর নয়পালদেবের পঞ্চদশ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ গয়ানগরের কৃষ্ণদ্বারিকা মন্দিরের (গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১১১-১৫) এবং নরসিংহ মন্দিরের (Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 78.) শিলালেখ দ্বয়ের অনুরূপ; অতএব প্রহাসকে খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধের লোক বলা যাইতে পারে। শিলালেখে পালরাজগণের নামের উল্লেখ না থাকিবার কারণ বুরিতে পারা যায় না।

  1. হতসকলবিপক্ষঃ সঙ্গরে বাহুদর্পাদনধিকৃতবিলুপ্তং রাজ্যমাসাদ্য পিত্র্যং।
    নিহিতচরণপদ্মো ভূভৃতাং মূর্ধ্নি তস্মাদভবদবনিপালঃ শ্রীমহীপালদেবঃ॥ ১২
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৫।

  2. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1892, pt. I, p. 81.
  3. ৩.০ ৩.১ গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১০০, পাদটীকা।
  4. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৫ম ভাগ, পৃঃ ১৩৯ ও বিশ্বকোষ, “মহীপাল” শব্দ।
  5. তস্মাদ্বভূব সবিতুর্ব্বসুকোটিবর্ষী কালেন চন্দ্র ইব বিগ্রহপালদেবঃ।
    নেত্রপ্রিয়েণ বিমলেন কলাময়েন যেনোদিতেন দলিতো ভুবনস্য তাপঃ॥ ১০
    দেশে প্রাচি প্রচুর-পয়সি স্বচ্ছমাপীয় তোয়ং স্বৈরং ভ্রান্ত্বা তদনুমলয়োপত্যকা-চন্দনেষু।
    কৃত্বা সান্দ্রৈস্তরুষু জড়তাং শীকরৈরভ্রতুল্যাঃ প্রালেয়াদ্রেঃ কটকমভজন্ যস্য সেনা-গজেন্দ্রাঃ॥ ১১
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৫।

  6. Dacca Review, May, 1914, p. 55.
  7. শ্রীযুক্ত ষ্টেপলটন একটি অপ্রকাশিত প্রবন্ধের প্রুফ আমাকে অনুগ্রহ করিয়া দেখিতে দিয়াছিলেন। তাহা প্রকাশিত হইয়াছে কি না জানিতে পারি নাই।
  8. Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1899, p. 69.
  9. Indian Antiquary, Vol. XIV, p. 165, note 17.
  10. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১০৭-৮।
  11. V. A. Smith, Early History of India, 3rd. Edition, p. 383.
  12. Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 278.
  13. R. G. Bhandarkar’s Early History of Dekkan, p. 79.
  14. কারাগারে সজলনয়নেন্দীবরাণাং বভূবুঃ॥ ৪৬কা ত্বং কাংচীনৃপতিবনিতা কা ত্বমন্ধ্রাধিপ-স্ত্রী
    কা ত্বং রাঢ়া-পরিবৃঢ়বধূঃ কা ত্বমঙ্গেন্দ্র-পত্নী।

    ইত্যালাপাঃ সমরজয়িনো যস্য বৈরি-প্রিয়াণাং
    কারাগারে সজলনয়নেন্দীবরাণাং বভূবুঃ॥ ৪৬
    —Epigraphia Indica, Vol. I, p. 145.

  15. Ibid, Vol. I, p. 147.
  16. Indian Antiquary, Vol. I, pp. 127-28.
  17. Ibid, p. 195.
  18. Ibid, p. 227.
  19. Epigraphia Indica, Vol. V, app. pp. 1-96.
  20. Annual Report, Archaeological Survey, Bengal Circle, 1900-01, p. vii.
  21. Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New series, Vol. VII, p. 619.
  22. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৭০।
  23. মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন যে, ‘কুঞ্জরঘটা’ শব্দের অর্থ অন্যরূপ।
  24. Dacca Review, 1914, p. 55 and pl.
  25. ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন, ১৯১৪, পৃঃ ৫৫।
  26. Bendal’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the University Library, Cambridge, p. 101.
  27. Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1899, p. 69.
  28. Cunningham’s Archaeological Survey Reports, Vol. III, p. 122, no. 9.
  29. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 75.
  30. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১০২।
  31. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৭।
  32. South Indian Inscriptions, Vol. III, p. 27, No. 18.
  33. Epigraphia Indica, Vol. IX, pp. 232-233.
  34. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৩৯।
  35. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. III, p. 10.
  36. Ibid, Vol. V, p. 71.
  37. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৭৩, পাদটীকা ৯০।
  38. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৭৯।
  39. ৩৯.০ ৩৯.১ বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৮০।
  40. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. III, p. 36.
    সিংহ ইতি দণ্ডভুক্তিভূপতিরদ্ভুতপ্রভাবাকরকরকমলমুকুলতুলিতোৎকলেশকর্ণকেশরীসরিদ্বল্লভঃকুম্ভসম্ভবো।—রামচরিত। ২।৫ টীকা।
  41. Epigraphia Indica, Vol. VII, App, p. 120, no. 733.
  42. Ibid, Vol. IХ, p. 231.
  43. Annual Report on Epigraphy, Madras, 1906-7, p. 87.
  44. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪০।
  45. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৭৩, পাদটীকা ৯০।
  46. Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXII, 1893, pt. I, p. 250.
  47. যঃ সংশ্রিত্য প্রকৃতিগহনামার্য্যচাণক্যনীতিং
    জিত্বা নন্দান্ কুসুমনগরং চন্দ্রগুপ্তো জিগায়।
    কর্ণাটত্বং ধ্রুবমুপগতানদ্য তানেব হন্তুং
    দোর্দ্দর্পাঢ্যঃ স পুনরভবৎ শ্রীমহীপালদেবঃ॥
    —Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1893, pt. I, p. 251. 

  48. গৌড়রাজমালা, পৃঃ॥৶৹।
  49. Epigraphia Indica, Vol. VIII, App. II, p. 7.
  50. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 73.
  51. সংবৎ ১০৭৬ আষাঢ় বদি ৪ মহারাজাধিরাজ পুণ্যাবলোক সোমবংশোদ্ভব গৌড়ধ্বজ শ্রীমদ্‌গাঙ্গেয়দেবভুজ্যমানতীরভুক্তৌ কল্যাণবিজয়রাজ্যে।
     —Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXXII, 1903, pt. I, p. 18.
  52. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪১, পাদটীকা।
  53. Cunningham’s Archaeological Survey Report, Vol. XXI, p. 113, pt. XXVII.
  54. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১০৭-৮।
  55. Sachau’s Al-Beruni, Vol. II, p. 13.
  56. Tabaqat-i-Nasiri. (Raverty’s Trans.) pp. 21-22.
  57. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪১।
  58. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১০৬।
  59. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪৩।
  60. স্ত্রৈলোক্যং সকলং যশোভিরচলৈর্যোজস্রমাপুরয়ৎ॥শ্রীবিদ্যাধরদেবকার্য্যনিরতঃ শ্রীরাজ্যপালং হঠাৎ
    কণ্ঠাস্থিচ্ছিদনেকবাণনিবহৈর্হত্বা মহত্যাহবে।

    ডিংডীরাবলিচংদ্রমংডলমিলন্মুক্তাকলাপোজ্জ্বলৈ-
    স্ত্রৈলোক্যং সকলং যশোভিরচলৈর্যোজস্রমাপূরয়ৎ॥
    —দুবকুণ্ডে আবিষ্কৃত বিক্রমসিংহের শিলালিপি।
     —Epigraphia lndica, Vol. II, p. 237.

  61. Indian Antiquary, Vol. XIV, p. 165, note, 17.
  62. Ibid, Vol. IV, p. 366.
  63. ত্যজন্ দোষাসঙ্গং শিরসি কৃতপাদঃ ক্ষিতিভৃতাং
    বিতন্বন্ সর্ব্বাশাঃ প্রসভমুদয়াদ্রেরিব রবিঃ।
    হতধ্বান্ত-স্নিগ্ধপ্রকৃতিরনুরাগৈকবসতি
    স্ততো ধন্যঃ পুণ্যৈরজনি নয়পালো নরপতিঃ॥ ১২
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২৫।

  64. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৯।
  65. তস্মিন্বাসববন্ধুতামুপগতে রাজ্যে চ কুল্যাকুলে
    মগ্নস্বামিনি তস্য বন্ধুরুদয়াদিত্যোভবদ্ভূপতিঃ।
    যেনোদ্ধৃত্য মহার্ণবোপমমিলৎকর্ণ্ণাটকর্ণ্ণপ্রভু-
    মুর্ব্বীপালকদর্থিতাং ভুবমিমাং শ্রীমদ্বরাহায়িতং॥ ৩২
    —নাগপুরের শিলালিপি—Epigraphia Indica, Vol. II, p. 185.

  66. পাণ্ড্যশ্চণ্ডিমতাম্মুমোচ মুরলস্তত্যাজ গর্ব্বগ্রহং
    কুঙ্গঃ সদ্গতিমাজগাম চকপে বঙ্গঃ কলিঙ্গৈঃ সহ।
    কীরঃ কীরবদাস পঞ্জরগৃহে হূণঃ প্রহর্ষং জহৌ
    যস্মিন্ রাজনি শৌর্য্যবিভ্রমভরং বিভ্রত্যপূর্ব্বপ্রভে॥ ১২
    —ভেড়া ঘাটের শিলালিপি; Ibid, p. 11.

  67. নীচৈঃ সঞ্চর চোড়-কুঙ্গ-কিমিদং ফল্গু ত্বয়া বল্গ্যতে
    হূণৈবং রণিতুং ন যুক্তমিহ তে ত্বাং গৌড় গর্ব্বং ত্যজ।
    মৈবং গুর্জ্জর গর্জ্জ কীর নিভৃতো বর্ত্তস্ব সেবাগতান্-
    ইত্থং যস্য মিথোবিরোধিনৃপতীন্ দ্বাঃস্থো বিনিন্যে জনাঃ॥
    —করণবেলের শিলালিপি; Indian Antiquary, Vol. XVII, p. 217. 

  68. কুম্ভোদ্ভবঃ কর্ণপয়োধিপানে প্রজেশ্বরো নূতনরাজ্যসৃষ্টৌ।
    তত্রাস বিদ্যাধরগীতকীর্ত্তিঃ শ্রীকীর্ত্তিবর্ম্মক্ষিতিপো জগত্যাং॥ ৩
    —অজয়গড়ের শিলালিপি; Epigraphia Indica, Vol. I, p. 327.

  69. তস্মাদ্বভূব ভরতস্য গুণৈঃ সমগ্রৈঃ শ্রীকীর্ত্তিবর্ম্ম... গ্রস্তানেক
    ক্ষমাভৃতমুচ্চকৈর্ব্বললহরিভির্লক্ষ্মীকর্ণং মহার্ণবমুগ্ধতম্
    অচলমহসা দোর্দ্দণ্ডেন প্রমথ্য যশঃসুধাং
    য ইহ করিভির্লক্ষ্মীং লেভেপরঃ পুরুষোত্তমঃ॥ ২৩
    —মহোবার শিলালিপি; Epigraphia Indica, Vol. I, p. 222.

  70. সকলভূপালকুলপ্রলয়কালাগ্নিরুদ্রেন চেদিপতিনা সমুন্মূলিতং
    চন্দ্রান্বয়পার্থিবানাং পৃথিব্যামাধিপত্যং স্থিরীকর্ত্তুময়মস্য সংরম্ভঃ।
    —প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক, পৃঃ ১২।

  71. যেন চ বিবেকেনেব নির্জ্জিত্য কর্ণং মোহবিবর্জ্জিতং।
    শ্রীকীর্ত্তিবর্ম্মনৃপতের্বোধস্যেবোদয়ঃ কৃতঃ॥
    —প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক, পৃঃ ১৪।

  72. যেন কর্ণ সৈন্যসাগরং নির্ম্মথ্য মধুমথনেনেব ক্ষীরসমুদ্রং
    সমাসাদিতা সমরবিজয়লক্ষ্মীঃ।
    —প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক, পৃঃ ১১।

  73. Ueber das Leben der Jaina monchs Hemchandra, by Georg Buhler, p, 69.
  74. বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, ১।১০২-৩; ১৮।৯৩।
  75. Journal of the Buddhist Text Society, Vol. I, p. 9.
  76. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1900, pt. I, p. 192.
  77. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪৫।
  78. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১২৫, পাদটীকা, ১৯।
  79. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১১১-১৫।
  80. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 78.
  81. Bendall’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the University Library, Cambridge, p, 175, No. Add. 1688.
  82. চক্রদত্ত, ১৩০২ সাল, পৃঃ ৪০৭।
  83. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২০।
  84. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 78.
  85. পীতঃ সজ্জন-লোচনৈঃ স্মররিপোঃ পূজা [নুরক্তঃ সদা]
    সংগ্রামে [চতুরো] ঽধিক [ঞ্চ] হরিতঃ কালঃ কুলে বিদ্বিষাং।
    চাতুর্ব্বর্ণ্য-সমাশ্রয়ঃ সিতযশ [ঃ পুঞ্জৈ] র্জ্জগদ্রঞ্জয়ন্
    শ্রীমদ্বিগ্রহপালদেব-নৃপতি-[র্জজ্ঞে ততো ধামভৃৎ?]॥ ১৩
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২৫।

  86. Indian Pandits in the land of Snow, by Rai Sarat Chandra Das Bahadur, C. I. E, pp. 51-71.
  87. Farikh-i-Baihaki (Bibliotheca Indica), p. 497.
  88. গায়ন্তিস্ম গৃহীত-গৌড়-বিজয়-স্তম্বেরমস্যাহবে
    তস্যোন্মূলিত-কামরূপ-নৃপতি-প্রাজ্য-প্রতাপশ্রিয়ঃ।
    ভানুস্যন্দন-চক্র-ঘোষমুষিতপ্রত্যূষনিদ্রারসাঃ
    পূর্ব্বাদ্রেঃ কটকেষু সিদ্ধবনিতাঃ প্রালেয়শুদ্ধং যশঃ॥
    —বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, ৩-৭৪।

  89. যো বিগ্রহপালো যৌবনশ্রিয়া কর্ণস্য রাজ্ঞঃ সুতয়া সহ ক্ষৌণীমুদূঢ়বান্। সহসা বলেনাবিতো রক্ষিতো রণজিতঃ সংগ্রামজিতঃ কর্ণো দাহলাধিপতির্যেন। রণজিৎ এব পরন্তু রক্ষিতো ন উন্মূলিতঃ।
     —রামচরিত, ১।৯ টীকা; Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. III, p. 22.
  90. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২২; Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 80. Epigraphia Indica, Vol. XV, pp. 293-301.
  91. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, pp. 81-82.
  92. Ibid, p. 112.
  93. পাইকোরের স্তস্তলিপির বিবরণ শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্ত্তৃক “বীরভূম বিবরণ” নামক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে (পৃঃ ৯)। প্রত্নতত্ত্ববিভাগের পূর্ব্বচক্রের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত কাশীনাথ নারায়ণ দীক্ষিত আমাকে এই খোদিত লিপির প্রতিলিপি, উদ্ধৃত পাঠ ও স্তম্ভের চিত্র প্রদান করিয়া বাধিত করিয়াছেন।
  94. Catalogue of Coins in the Indian Museum, Vol. I, p. 233, 239.