বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/অষ্টম পরিচ্ছেদ

বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১০


বিষ্ণুপাদ-মন্দির-প্রাঙ্গণে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের সপ্তম রাজ্যাঙ্কের শিলালিপি

বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১১

প্রথম শূরপালের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধমূর্ত্তি


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১২

নারায়ণপালদেবের ৫৪ৎ রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত পার্ব্বতী মূর্ত্তি

 
বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ১৩

দ্বিতীয় গোপালের প্রথম রাজ্যাঙ্কে নালন্দায় প্রতিষ্ঠিত বাগীশ্বরী মূর্ত্তি

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

গুর্জ্জর-রাষ্ট্রকূট-দ্বন্দ্ব

 দেবপালদেব—বিন্ধ্যপর্ব্বতে ও হিমালয়ে যুদ্ধ—প্রথম অমোঘবর্ষ—রামভদ্রের পরাজয়—উৎকল ও কামরূপজয়—জয়পাল—দেবপালের তাম্রশাসন—নারায়ণের ছন্দোগ-পরিশিষ্টপ্রকাশ—বীরদেব—দর্ভপাণি—সোমেশ্বর—কেদারমিশ্র—ভোজদেব—গুর্জ্জরগণ কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ অধিকার—বিগ্রহপালের সম্বন্ধনির্ণয়—গুর্জ্জরগণ কর্ত্তৃক পালসাম্রাজ্য আক্রমণ—নারায়ণপাল—ভোজদেব কর্ত্তৃক মগধ অধিকার—কক্ক—মুদ্গগিরির যুদ্ধ—গুণাম্ভোধিদেব—উদ্দণ্ডপুরের মূর্ত্তি—নারায়ণপালের তাম্রশাসন—ভট্টগুরবমিশ্র—রাজ্যপাল—ভাগ্যদেবী—মহেন্দ্রপাল—দ্বিতীয় ভোজদেব—দ্বিতীয় কৃষ্ণ—মহীপাল—তৃতীয় ইন্দ্র—উত্তরাপথাভিযান—দ্বিতীয় গোপাল—চন্দেল্লবংশীয় যশোবর্ম্মা কর্ত্তৃক গৌড়াক্রমণ—কাম্বোজজাতি কর্ত্তৃক গৌড় অধিকার—গৌড়ীয় ভাস্কর শিল্প।

 ধর্ম্মপালদেব স্বর্গারোহণ করিলে তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র দেবপালদেব সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া গুর্জ্জরগণ বহুদিন উত্তরাপথ আক্রমণ করিতে ভরসা করে নাই। বিন্ধ্যপর্ব্বতের কোন স্থানে বোধ হয়, দেবপালদেবের সহিত রাষ্ট্রকূট অথবা গুর্জ্জর রাজগণের যুদ্ধ হইয়াছিল। কারণ, মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত দেবপালের তাম্রশাসনে এবং ভট্টগুরবমিশ্রের শিলাস্তম্ভ-লিপিতে তাঁহার বিন্ধ্যপর্ব্বতে গমনের উল্লেখ আছে। মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত দেবপালদেবের তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, “অপর নৃপতিবৃন্দের গর্ব্বখর্ব্বকারক সেই রাজার দিগ্বিজয়প্রসঙ্গে রণকুঞ্জরগণ ভ্রমণ করিতে করিতে বিন্ধ্যগিরিতে উপনীত হইয়া আনন্দাশ্রু-প্রবাহপ্লাবিত বন্ধুগণকে পুনরায় দর্শন করিয়াছিল এবং যুবক অশ্বগণও কাম্বোজ দেশে উপনীত হইয়া দীর্ঘ কালের পর স্বকীয় হর্ষসম্ভূত হ্রেষারব-মিশ্রিত হ্রেষারবকারী প্রিয়তমবৃন্দের দর্শন লাভ করিয়াছিল[১]।” দিনাজপুরে ভট্টগুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপি হইতে অবগত হওয়া যায়, “সেই দর্ভপাণির নীতিকৌশলে শ্রীদেবপাল নৃপতি মতঙ্গজমদাভিসিক্তশিলাসংহতিপূর্ণ রেবা নদীর জনক হইতে মহেশললাটশোভি ইন্দুকিরণশ্বেতায়মান গৌরীজনক পর্ব্বত পর্য্যন্ত, সূর্য্যোদয়াস্তকালে অরুণরাগরঞ্জিত জলরাশির আধার পূর্ব্বসমূদ্র এবং পশ্চিমসমুদ্র (মধ্যবর্ত্তী) সমগ্র ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন[২]।” গুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপি হইতে আরও অবগত হওয়া যায় যে, দেবপাল তাঁহার মন্ত্রী কেদারমিশ্রের বুদ্ধিবলের উপাসনা করিয়া উৎকলকুল উৎকীলিত করিয়া, হূণগর্ব্ব খর্ব্বীকৃত করিয়া এবং দ্রবিড়েশ্বর ও গুর্জ্জরনাথের দর্প চূর্ণীকৃত করিয়া দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত সমুদ্রমেখলাভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন[৩]। মুঙ্গেরের তাম্রশাসন এবং বাদালের শিলাস্তম্ভলিপি, এই উভয় খোদিতলিপিতেই দেবপালদেবের বিন্ধ্যপর্ব্বতে গমনের কথা আছে। বাদালের স্তম্ভলিপিতে দেবপাল কর্ত্তৃক গুর্জ্জরনাথ ও দ্রবিড়েশ্বরের দর্পচূর্ণের উল্লেখ আছে। বিন্ধ্যপর্ব্বত গুর্জ্জর-রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব্ব সীমায় ও দ্রবিড় বা রাষ্ট্রকূট-রাজ্যের উত্তর-পূর্ব্ব সীমায় অবস্থিত, সুতরাং সম্ভবতঃ বিন্ধ্যপর্ব্বতেরই কোন উপত্যকায় দ্রবিড়নাথ ও গুর্জ্জরেশ্বর পরাজিত হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র শর্ব্ব বা প্রথম অমোঘবর্ষ ষষ্টি বর্ষের অধিককাল মান্যখেতের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সুতরাং ইহাই সম্ভব যে, তিনি দেবপালদেবের সমসাময়িক এবং তৎকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। অমোঘবর্ষের দুইখানি শিলালিপিতে তাঁহার সহিত গৌড়েশ্বরের যুদ্ধের উল্লেখ আছে। সিরুর ও নীলগুণ্ডে আবিষ্কৃত শিলালিপিদ্বয় হইতে অবগত হওয়া যায় যে, অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, মালব ও বেঙ্গীর অধিপতিগণ প্রথম অমোঘবর্ষের অর্চ্চনা করিয়াছিলেন[৪]। অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ তখন স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল না এবং বঙ্গে স্বতন্ত্র রাজ্য থাকিলেও অঙ্গ ও মগধ পালরাজবংশের অধিকারকালে কখনই স্বাতন্ত্র্য লাভ করে নাই; সুতরাং “বঙ্গাঙ্গমগধ” পদদ্বারা গৌড়রাজ্যই বুঝাইতেছে।

 এই সমস্ত খোদিতলিপি হইতে দেবপালদেবের রাজ্যকালের নিম্নলিখিত ইতিহাস অবগত হওয়া যায়। দেবপালদেব যুদ্ধাভিযানের সময়ে বিন্ধ্যপর্ব্বতে গমন করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ এইস্থানে তাঁহার সহিত দক্ষিণাপথেশ্বর প্রথম অমোঘবর্ষের যুদ্ধ হইয়াছিল, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই জয় ঘোষণা করিয়াছিলেন[৫]। যুদ্ধাভিযানকালে দেবপাল সসৈন্য হিমালয় পর্ব্বতে গমন করিয়াছিলেন এবং কাম্বোজ জাতিকে পরাজিত করিয়াছিলেন। দেবপালের মুঙ্গেরের ও নালন্দার তাম্রশাসনের ১৩শ শ্লোকের প্রথম চরণে বিন্ধ্যপর্ব্বতের নাম, তৃতীয় চরণে কাম্বোজ জাতির নাম আছে; কিন্তু ভট্টগুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপিতে পঞ্চম শ্লোকের প্রথম চরণে বিন্ধ্যপর্ব্বতের নাম ও দ্বিতীয় চরণে হিমালয় পর্ব্বতের নাম আছে। এই শ্লোকদ্বয় দেবপালদেবের বিজয়-যাত্রার উত্তর ও দক্ষিণসীমা-নির্দ্দেশক। সুতরাং ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, দেবপাল উত্তরে হিমালয় পর্ব্বতে কাম্বোজ জাতিকে পরাজিত করিয়াছিলেন। ভট্টগুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপির ১৩শ শ্লোক হইতে অবগত হওয়া যায় যে, দেবপালদেব উৎকলগণকে, হূণগণকে এবং দ্রবিড়েশ্বর ও গুর্জ্জরনাথকে পরাজিত করিয়াছিলেন। দ্রবিড়েশ্বর বলিতে দক্ষিণাপথেশ্বর রাষ্ট্রকূটবংশীয় প্রথম অমোঘবর্ষকে বুঝাইতেছে। গুর্জ্জরনাথ শব্দে দ্বিতীয় নাগভটের পুত্র রামভদ্রদেবকে বুঝাইতেছে। পূর্ব্বে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, দ্বিতীয় নাগভট ধর্ম্মপালদেবের সমসাময়িক; সুতরাং ধর্ম্মপালের পুত্র দ্বিতীয় নাগভটের পুত্রের সমসাময়িক হওয়াই সম্ভব। দ্বিতীয় নাগভটের পুত্র রামভদ্র বোধ হয়, দেবপালদেব কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন; কারণ, তাঁহার পুত্র প্রথম ভোজদেবের সাগরতাল-শিলালিপিতে তৎকর্ত্তৃক গৌড় বা অপর কোন দেশের রাজার পরাজয়ের উল্লেখ নাই[৬]। দেবপালের রাজ্যকালে তাঁহার খুল্লতাত-পুত্র জয়পাল উৎকলরাজকে স্বীয় রাজধানী পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন[৭]। ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসনের এই উক্তির দ্বারা গুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপির উক্তি সমর্থিত হইতেছে। নারায়ণপালের তাম্রশাসন হইতে আরও অবগত হওয়া যায় যে, জয়পাল প্রাগ্জ্যোতিষপুরের অধীশ্বরকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৮]। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন, “ভগদত্ত-বংশীয় প্রলম্বের প্রপৌত্র জয়মাল-বীরবাহু সম্ভবতঃ এই সময়ে প্রাগ্জ্যোতিষের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন[৯]।” খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে গৌড় দেশ কাম্বোজ জাতি কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল, দিনাজপুরে বাণগড় নামক স্থানে কাম্বোজ-বংশজাত জনৈক গৌড়পতির উল্লেখ আছে[১০]। দেবপালদেবের রাজ্যকালে কাম্বোজগণ বোধ হয়, হিমালয় হইতে অবতরণ করিয়া গৌড়দেশ অধিকার করিবার চেষ্টা করিয়াছিল এবং সেই সময়ে দেবপাল বোধ হয়, তাহাদিগকে পরাজিত করিয়াছিলেন। মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, দেবপাল “একদিকে হিমালয়, অপর দিকে শ্রীরামচন্দ্রের কীর্ত্তিচিহ্ন সেতুবন্ধ, একদিকে বরুণ-নিকেতন, অপর দিকে লক্ষ্মীর জন্মনিকেতন [ক্ষীরোদ সমুদ্র,]—এই চতুঃসীমাবচ্ছিন্ন সমগ্র ভূমণ্ডল নিঃসপত্নভাবে উপভোগ করিয়াছেন[১১]।” অদ্যাবধি দেবপালের রাজত্বকালের একখানি শিলালিপি ও দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। প্রথম তাম্রশাসনখানি মুদ্গগিরি অর্থাৎ মুঙ্গের হইতে দেবপালের ৩৩ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত হইয়াছিল। এতদ্বারা শ্রীনগরভুক্তির (অর্থাৎ পাটলিপুত্রের) ক্রিমিলা বিষয়ান্তঃপাতী মেষিকা গ্রাম ভট্ট বিশ্বরাতের পৌত্র ভট্ট বরাহরাতের পুত্র ভট্টপ্রবর শ্রীবীহেকরাত মিশ্রকে প্রদত্ত হইয়াছিল। দেবপালের একমাত্র পুত্র রাজ্যপাল এই তাম্রশাসনের দূতক[১২]। দ্বিতীয় তাম্রশাসনখানি পাটনা জিলায় অবস্থিত বড়গাঁও গ্রামে নালন্দ ব নালন্দার ধ্বংসাবশেষ-খননকালে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মধ্যচক্রের অধ্যক্ষ বন্ধুবর পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হীরানন্দ শাস্ত্রী ইহার পাঠ উদ্ধার করিয়াছেন। এই তাম্রশাসনখানিও মুদ্গগিরি-সমাবাসিত জয়স্কন্ধাবার হইতে প্রদত্ত হইয়াছিল এরং ইহা দেবপালদেবের ৩৮ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত হইয়াছিল। এতদ্বারা দেবপালদেব শ্রীনগরভুক্তির (অর্থাৎ পাটলীপুত্রভুক্তির বা Division-এর) রাজগৃহবিষয়ের (বর্ত্তমান রাজগির বিষয়ের) অন্তঃপাতী অজপুরনয়প্রতিবদ্ধ নন্দিবনাক ও মনিবায়ক গ্রাম, পিলিপ্পিঙ্কানয়প্রতিবদ্ধ নয়িকাগ্রাম, অচলায়তনপ্রতিবদ্ধ হস্তি গ্রাম এবং গয়াবিষয়ের অন্তঃপাতী কুমুদসূত্রবীথীপ্রতিবদ্ধ পালামবগ্রাম, সুবর্ণদ্বীপ বা যবদ্বীপের রাজা শ্রীবালপুত্রদেব কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়া তন্নির্ম্মিত নালন্দাবস্থিত বিহারে প্রতিষ্ঠিত ভগবান বুদ্ধ ভট্টারকের সেবার জন্য এবং আর্য্য ভিক্ষু-সঙ্ঘের বলি, চরূ, সত্ত্র, চীবর, পিণ্ড, শয়ন, আসন এবং ঔষধার্থে; ধর্ম্মরত্নের (ধর্ম্মগ্রন্থের) লেখনের জন্য ও বিহার ভগ্ন হইলে তাহার সংস্কারের জন্য প্রদান করিয়াছিলেন। ব্যাঘ্রতটী মণ্ডলাধিপতি শ্রীবলবর্ম্মা এই তাম্রশাসনের দূতক এবং ইহা দেবপালদেবের রাজ্যের আটত্রিশ বর্ষের কার্ত্তিক মাসের একবিংশ দিবসে সম্পাদিত হইয়াছিল। তাম্রশাসনের শেষে সুবর্ণদ্বীপ বা যবদ্বীপের অধিপতি শ্রীবালপুত্রদেবের বংশ-পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। ইনি শৈলেন্দ্র-বংশসম্ভূত যবভূমি বা যবদ্বীপের অধিপতি শ্রীবীর নামক রাজার বংশসম্ভূত। বালপুত্রদেব নালন্দা নামক বৌদ্ধতীর্থের খ্যাতি শ্রবণ করিয়া তথায় বৌদ্ধবিহার নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন এবং নালন্দা পালবংশীয় সম্রাট্ দেবপালদেবের রাজ্যভুক্ত থাকায় দূত প্রেরণ করিয়া দেবপালদেবকে বুদ্ধমূর্ত্তির পূজা ও বিহারে সমাগত বৌদ্ধ-ভিক্ষুসঙ্ঘের অশন-বসন ও চিকিৎসার ব্যয়নির্ব্বাহের জন্য পূর্ব্বোক্ত গ্রামপঞ্চ দান করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। যবদ্বীপের বা সুবর্ণদ্বীপের রাজা বালপুত্রদেবের অনুরোধে দেবপালদেব কর্ত্তৃক এই গ্রামপঞ্চ দেবত্র স্বরূপ বৌদ্ধবিহারে প্রদত্ত হইয়াছিল। সম্ভবতঃ এই পঞ্চগ্রামের মূল্য বালপুত্রদেব কর্ত্তৃক গৌড়রাজ দেবপালদেবকে প্রদত্ত হইয়াছিল, কারণ দানধর্ম্মানুসারে মূল্য প্রদত্ত না হইলে বালপুত্রদেবের মন্দির-প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয় না[১৩]। দেবপালদেবের খুল্লতাত-পুত্র জয়পাল সম্ভবতঃ তাঁহার পিতা বাক্‌পালদেবের শ্রাদ্ধকালে শ্রাদ্ধের মহাদান উমাপতি নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন। উমাপতির উত্তরপুরুষ নারায়ণ তদ্‌রচিত ছন্দোগপরিশিষ্টপ্রকাশ নামক গ্রন্থে এই কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন[১৪]

 দেবপালদেবের একটিমাত্র পুত্রের নাম আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইঁহার নাম রাজ্যপাল এবং ইনি পিতার রাজ্যকালে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন[১৫]। রাজ্যপাল বোধ হয়, দেবপালের জীবনকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন। কারণ, দেবপালের পরে জয়পালের পুত্র প্রথম বিগ্রহপাল বা প্রথম শূরপাল গৌড়-বঙ্গ-মগধের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দেবপালদেবের রাজ্যকালে নগরহার নগরের (বর্ত্তমান নাম নিংরাহার, ইহা আফগানিস্তানের আমীরের রাজ্যে খাইবার গিরিসঙ্কটের অনতিদূরে অবস্থিত) অধিবাসী ইন্দ্রগুপ্তের পুত্র বীরদেব মগধে আসিয়া যশোবর্ম্মপুরে দুইটি চৈত্য ও একটি বজ্রাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বীরদেব যে বজ্রাসন নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন, তাহার একখণ্ড প্রস্তর পাটনা জেলার অন্তর্গত ঘোষরাঁবা গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তিনি বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন সমাপ্ত করিয়া, বৌদ্ধ-মতের অনুরাগী হইয়া অধ্যয়নার্থ কণিষ্কবিহারে গমন করিয়াছিলেন[১৬]। কণিষ্কবিহার প্রাচীন পুরুষপুর (বর্ত্তমান পেশাবর) নগরে অবস্থিত ছিল[১৭]। বীরদেব কণিষ্কবিহারে সর্ব্বজ্ঞশান্তি নামক জনৈক বৌদ্ধাচার্য্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তীর্থযাত্রা উপলক্ষে মগধে আসিয়াছিলেন[১৮]। তিনি মহাবোধি দর্শন করিয়া যশোবর্ম্মপুর (বর্ত্তমান নাম ঘোষরাঁবা) বিহারে আগমন করিলে দেবপালদেব তাঁহাকে পূজা করিয়াছিলেন[১৯]। দেবপাল তাঁহাকে নালন্দা মহাবিহারের সঙ্ঘস্থবির নিযুক্ত করিয়াছিলেন[২০]। নালন্দায় অবস্থানকালে বীরদের ইন্দ্রশিলা পর্ব্বতে[২১] দুইটি চৈত্য নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন[২২]। বীরদেবের শিলালিপিখানি এখন কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে, কিন্তু মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত দেবপালের তাম্রশাসনের এখন আর কোনই সন্ধান পাওয়া যায় না[২৩]। নালন্দার তাম্রশাসন দেবপালদেবের ৩৮শ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত হইয়াছিল, সুতরাং দেবপালদেব প্রায় চত্বারিংশৎ বর্ষকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপালদেবের রাজ্যকালে শাণ্ডিল্যবংশীয় গর্গদেব তাঁহার প্রধান অমাত্য ছিলেন। ধর্ম্মপালদেবের রাজ্যের শেষভাগে গর্গদেবের পুত্র দর্ভপাণি গৌড়েশ্বরের প্রধান অমাত্য হইয়াছিলেন। দর্ভপাণির প্রপৌত্র গুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, দেবপাল দর্ভপাণিকে অত্যন্ত সম্মান করিতেন। কথিত আছে যে, “দর্ভপাণির নীতিকৌশলে শ্রীদেবপাল [নামক] নৃপতি মতঙ্গজ-মদাভিষিক্ত-শিলাসংহতিপূর্ণ রেবা (নর্ম্মদা] নদীর জনক [উৎপত্তিস্থান বিন্ধ্যপর্ব্বত] হইতে [আরম্ভ করিয়া] মহেশললাট-শোভি-ইন্দুকিরণ-শ্বেতায়মান গৌরীজনক [হিমালয়] পর্ব্বত পর্য্যন্ত, সূর্য্যোদয়াস্তকালে অরুণরাগ-রঞ্জিত [উভয়] জলরাশির আধার পূর্ব্বসমুদ্র এবং পশ্চিম-সমুদ্র [মধ্যবর্ত্তী] সমগ্র ভূভাগ কর-প্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।”

“নানা-মদমত্ত-মতঙ্গজ-মদবারি-নিষিক্ত-ধরণীতল-বিসর্পি-ধূলিপটলে দিগন্তরাল সমাচ্ছন্ন করিয়া, দিক্‌চক্রাগত-ভূপালবৃন্দের চিরসঞ্চরমাণ সেনাসমূহ যাঁহাকে নিরন্তর দুর্ব্বিলোক করিয়া রাখিত, সেই দেবপাল [নামক] নরপাল [উপদেশ গ্রহণের জন্য] দর্ভপাণির অবসরের অপেক্ষায়, তাঁহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিতেন।”

 “সুররাজকল্প [দেবপাল] নরপতি [সেই মন্ত্রিবরকে] অগ্রে চন্দ্রবিম্বানুকারী [মহার্হ] আসন প্রদান করিয়া, নানা-নরেন্দ্র-মুকুটাঙ্কিত-পাদপাংশু হইয়াও, স্বয়ং সচকিতভাবেই সিংহাসনে উপবেশন করিতেন”[২৪]। দর্ভপাণির পুত্রের নাম সোমেশ্বর। তিনি বোধ হয়, দেবপালের সেনাপতি ছিলেন; কারণ, তাঁহাকে ধনঞ্জয়ের সহিত তুলনা করা হইয়াছে[২৫]। সোমেশ্বরের পুত্র কেদারমিশ্র তাঁহার পিতামহ দর্ভপাণির পরে গৌড়েশ্বরের প্রধান অমাত্য নিযুক্ত হইয়াছিলেন। কথিত আছে, কেদারমিশ্রের “বুদ্ধি-বলের উপাসনা করিয়া, গৌড়েশ্বর [দেবপালদেব] উৎকলকুল উৎকীলিত করিয়া, হূণগর্ব্ব খর্ব্বীকৃত করিয়া এবং দ্রবিড়গুর্জ্জর-নাথ-দর্প চূর্ণীকৃত করিয়া, দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত সমুদ্র-মেখলাভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন[২৬]।” দর্ভপাণি, সোমেশ্বর এবং কেদারমিশ্র, এই তিন পুরুষ যখন দেবপালদেবের সমসাময়িক ছিলেন, তখন ইহা অবশ্যস্বীকার্য্য যে, দেবপালদেব দীর্ঘকাল গৌড়-বঙ্গ-মগধের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। দেবপালের প্রথম মন্ত্রী দর্ভপাণি ধর্ম্মপালের রাজ্যের শেষাংশে তাঁহার সমসাময়িক ছিলেন এবং দেবপালের দ্বিতীয় মন্ত্রী তাঁহার উত্তরাধিকারী প্রথম বিগ্রহপাল বা প্রথম শূরপালের অমাত্য ছিলেন। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ ধর্ম্মপালকে গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশীয় প্রথম ভোজদেবের সমসাময়িক ধরিয়া লইয়া দেবপালকে প্রথম অমোঘবর্ষের পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণের সমসাময়িক ব্যক্তি স্থির করিয়াছেন[২৭]। পূর্ব্ব-পরিচ্ছেদে দর্শিত হইয়াছে যে, ধর্ম্মপাল দ্বিতীয় নাগভটের ও তৃতীয় গোবিন্দের সমসাময়িক ব্যক্তি; সুতরাং ধর্ম্মপালের পুত্র কখনই দ্বিতীয় নাগভটের পৌত্র অথবা বৃদ্ধপ্রপৌত্র (প্রথম ভোজ পৌত্র এবং দ্বিতীয় ভোজ বৃদ্ধপ্রপৌত্র) এবং তৃতীয় গোবিন্দের পুত্রের সমসাময়িক ব্যক্তি বলা যাইতে পারে না। চন্দ মহাশয় কর্ণের তাম্রশাসন ও বিলহরির তাম্রশাসন হইতে যে দুইটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা প্রথম ভোজদেবের প্রতি প্রযুক্ত হইতে পারে না[২৮]। দেবপালদেবের পত্নীর নাম অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। অনুমান হয়, দেবপালদেব ৮২০ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়া ৮৬০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁহার রাজ্যের শেষভাগে প্রতীহার-রাজ রামভদ্রের পুত্র প্রথম ভোজ, মহোদয় বা কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন। যোধপুর রাজ্যে দৌলতপুরায় আবিষ্কৃত ৯০০ বিক্রমাব্দে সম্পাদিত একখানি তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, উক্ত তাম্রশাসন মহোদয় বা কান্যকুব্জ হইতে প্রদত্ত হইয়াছিল[২৯]। সুতরাং ৯০০ বিক্রমাব্দের (৮৪৩ খৃষ্টাব্দে) পূর্ব্বে কান্যকুব্জ প্রথম ভোজ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল। দেবপালদেবের মৃত্যুর পরে ধর্ম্মপালের বংশে কেহ উত্তরাধিকারী না থাকায় প্রথম গোপালদেবের দ্বিতীয় পুত্র বাক্‌পালের পৌত্র প্রথম বিগ্রহপাল বা প্রথম শূরপাল গৌড়-বঙ্গ মগধের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন।

 দেবপালের সহিত বিগ্রহপালের সম্বন্ধ-নির্ণয় লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। স্বর্গীয় ডাঃ কীল্‌হর্ণের মতানুসারে বিগ্রহপাল বা শূরপাল প্রথম গোপালদেবের দ্বিতীয় পুত্র বাক্‌পালের পৌত্র এবং জয়পালের পুত্র[৩০]। ডাঃ হর্ণলি ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে বলিয়াছিলেন,—“তৃতীয় বিগ্রহপালের তাম্রশাসন দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, বিগ্রহপাল দেবপালের ভ্রাতুষ্পুত্র নহেন, তাঁহার পুত্র[৩১]।” শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এই মত সমর্থন করিয়া বলিয়াছেন,—“রচনারীতির প্রতি লক্ষ্য করিলে প্রথম বিগ্রহপালদেবকে দেবপালদেবের পুত্র বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। দেবপালদেবও অপুত্রক ছিলেন না। তাঁহার [মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [৫১—৫২ পংক্তিতে] রাজ্যপাল নামক তদীয় পুত্র যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত থাকিবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি যে পিতার জীবিতকালেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণাভাব। গরুড়স্তম্ভ-লিপিতে [১৬ শ্লোকে] দেবপালের পরবর্ত্তী নরপাল শূরপাল নামে উল্লিখিত। সকলেই তাঁহাকে প্রথম বিগ্রহপাল বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছেন। প্রথম বিগ্রহপালের একাধিক নামের এইরূপ পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া, যুবরাজ রাজ্যপালকে, শূরপালকে এবং প্রথম বিগ্রহপালকে অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়াই গ্রহণ করিতে ইচ্ছা হয়। এই সিদ্ধান্ত সমীচীন বলিয়া গৃহীত হইলে, পালবংশীয় নরপালগণের প্রচলিত বংশাবলীর ভ্রম সংশোধন করিতে হইবে[৩২]।” মৈত্রেয় মহাশয়ের যুক্তি সমীচীন বলিয়া বোধ হয় না; কারণ, খালিমপুরে আবিষ্কৃত ধর্ম্মপালের তাম্রশাসনে যুবরাজ ত্রিভুবনপালের নাম দেখিতে পাওয়া যায়[৩৩]। কিন্তু প্রশস্তিমধ্যে অথবা অপর কোনও খোদিতলিপিতে ধর্ম্মপালের জীবিতকালে ত্রিভুবনপালের মৃত্যুর কথা উল্লিখিত নাই। ইহা হইতে কি প্রমাণ হইবে যে, ত্রিভুবনপাল ও দেবপাল অভিন্ন ব্যক্তি? রামপালচরিতে প্রথম পরিচ্ছেদে ২৩শ শ্লোকের টীকায় রামপালের পুত্র রাজ্যপালের উল্লেখ আছে[৩৪]; কিন্তু মনহলিতে আবিষ্কৃত মদনপালদেবের তাম্রশাসনে রাজ্যপালের নাম নাই[৩৫]। ইহা হইতে কি প্রমাণ হইবে যে, রাজ্যপাল, কুমারপাল বা মদনপালের নামান্তর? প্রথম বিগ্রহপাল এবং প্রথম শূরপালের একত্বের প্রমাণ অন্যবিধ। নারায়ণপাল, প্রথম মহীপাল, তৃতীয় বিগ্রহপাল ও মদনপালের তাম্রশাসনে নারায়ণপালের পিতার নাম বিগ্রহপাল[৩৬], কিন্তু ভট্টগুরুবমিশ্রের গরুড়-স্তম্ভলিপিতে দেরপালদেবের পরে ও নারায়ণপালদেবের পূর্ব্বে শূরপালের নাম উল্লিখিত আছে[৩৭]। ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, শূরপাল প্রথম বিগ্রহপালের নামান্তর। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রথম বিগ্রহপালকে ডাঃ কীল্‌হর্ণের মতানুসারে বাক্‌পালের পৌত্র ও জয়পালের পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া, শূরপালকে দেবপালের দ্বিতীয় পুত্র ঠিক করিয়াছেন[৩৮]। ইহা কখনই সম্ভব নহে। কারণ, গুরুবমিশ্র নারায়ণপালের প্রধান অমাত্য, তিনি যে নারায়ণপালের পিতার নাম উল্লেখ না করিয়া, নারায়ণপালের পূর্ব্বে দেবপালের পুত্রের নামোল্লেখ করিবেন, ইহা কখনই সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয় না। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের মতানুসারে জয়পাল ধর্ম্মপালের পুত্র[৩৯]; কারণ, নারায়ণপালের তাম্রশাসনে দেবপালকে জয়পালের ‘পূর্ব্বজ’ বলা হইয়াছে। নারায়ণপালের তাম্রশাসনের “রচনারীতি” লক্ষ্য করিলে জয়পালকে বাক্‌পালের পুত্র বলিয়াই বোধ হয়। কারণ, উক্ত তাম্রশাসনের চতুর্থ শ্লোকে ধর্ম্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাক্‌পালের গুণকীর্ত্তন করা হইয়াছে এবং তাহার পরের শ্লোকেই জয়পালের গুণকীর্ত্তন আছে। এই স্থানে কেবল ‘পূর্ব্বজ’ শব্দের উপরে নির্ভর করিয়া জয়পালকে ধর্ম্মপালের পুত্র বলা বিজ্ঞানসম্মত প্রণালী-অনুমোদিত নহে। ধর্ম্মপালের অথবা দেবপালের তাম্রশাসনে বাক্‌পাল বা জয়পালের নাম নাই। প্রথম বিগ্রহপাল এবং তদ্বংশীয় নরপতিগণের তাম্রশাসনসমূহে বাক্‌পাল ও জয়পালের উল্লেখ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝা যায় যে, প্রশস্তিকারগণ নারায়ণপাল, দেবপালের বংশসম্ভূত নহেন বলিয়াই, নারায়ণপালের পিতা প্রথম বিগ্রহপালের পিতৃপিতামহের নামোল্লেখ করিয়াছেন। এই মত সমীচীন বলিয়া স্বীকার না করিলে নারায়ণপাল এবং তদ্বংশজাত নরপতিগণের তাম্রশাসনসমূহে বাক্‌পাল ও জয়পালের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। প্রথম বিগ্রহপাল যে জয়পালের পুত্র, বাক্‌পালের পৌত্র এবং তাঁহার নামান্তর যে শূরপাল, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই।

 প্রথম বিগ্রহপালদেব যে সময়ে গৌড়-বঙ্গ-মগধের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, সে সময়ে গুর্জ্জরজাতি প্রথম ভোজদেবের অধীনে উত্তরাপথ-জয়ে ব্যাপৃত। ভোজদেব মিহির, আদিবরাহ, প্রভাস প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রাচীন খোদিত-লিপিমালায় পরিচিত। তিনি পঞ্চাশৎবর্ষের অধিক কাল কান্যকুব্জের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ৮৪৩ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বেই কান্যকুব্জ তাঁহার হস্তগত হইয়াছিল। কারণ, উক্ত বর্ষে তিনি একখানি তাম্রশাসন দ্বারা ‘গুর্জ্জরত্রাভূমিতে’ একখানি গ্রাম জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন[৪০]। ৯৩২ বিক্রমাব্দে (৮৭৫ খৃঃ অঃ) ভোজদেব কর্ত্তৃক নিযুক্ত গোপাদ্রির (Gwalior) শাসনকর্ত্তা অল্ল একটি মন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন[৪১]। ২৭৬ শ্রীহর্ষাব্দে (৮৯২ খৃঃ অঃ) পঞ্চনদ প্রদেশের প্রাচীন পৃথূদক (বর্ত্তমান পেহোবা) নগরও ভোজদেবের রাজ্যভুক্ত ছিল[৪২]। প্রাচীন সৌরাষ্ট্রদেশ ভোজদেবের পুত্র মহেন্দ্রপালের রাজ্যভুক্ত ছিল[৪৩]। ইহা হইতে ভিন্সেণ্ট স্মিথ অনুমান করেন যে, সৌরাষ্ট্র দেশ ভোজদেব কর্ত্তৃকই বিজিত হইয়াছিল[৪৪]। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইন্দ্রের প্রপৌত্র ধ্রুবরাজদেব (দ্বিতীয় ধ্রুব) ৭৮৯ শকাব্দে (৮৬৭ খৃঃ অঃ) মিহির বা ভোজদেবকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৪৫]। ভোজদেব যে সময়ে সৌরাষ্ট্র আক্রমণ করিয়াছিলেন, সেই সময়ে দক্ষিণ-পথেশ্বর প্রথম অমোঘবর্ষের আদেশে দ্বিতীয় ধ্রুব বা ধ্রুবরাজদেব তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া পরাজিত করিয়াছিলেন। এই সময়ে গুর্জ্জরগণের প্রতাপে ভীত হইয়া রাষ্ট্রকূটরাজগণ সিন্ধুদেশের মুসলমান শাসনকর্ত্তৃগণের সহিত সন্ধিবন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। কান্যকুব্জ বিজিত হইলে ভোজদেব পাল-সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা আক্রমণ করিয়াছিলেন। দেবপালদেবের রাজ্যের শেষভাগ বোধ হয়, প্রথম ভোজদেবের সহিত যুদ্ধে ব্যয় হইয়াছিল। প্রথম বিগ্রহপাল ও নারায়ণপাল ভোজদেবের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছিলেন এবং নারায়ণপালের রাজ্যকালে পাল-রাজগণ মগধ ও তীরভুক্তির অধিকাংশ ভোজদেবকে প্রদান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। প্রথম বিগ্রহপালের রাজত্বকালে ধর্ম্মপালের সাম্রাজ্যের কি অবস্থা হইয়াছিল, তাহা অবগত হইবার কোন উপায়ই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বিগ্রহপাল হৈহয় (অর্থাৎ চেদী বা কলচুরি) রাজবংশের কন্যা লজ্জাদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। ভট্টগুরবমিশ্রের পিতা কেদারমিশ্র শূরপালের মন্ত্রী ছিলেন। গুরবমিশ্রের গরুড়স্তম্ভলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “সেই বৃহস্পতি-প্রতিকৃতি (কেদারমিশ্রের) যজ্ঞস্থলে, সাক্ষাৎ ইন্দ্রতুল্য শত্রুসংহারকারী নানা সাগর-মেখলাভরণা বসুন্ধরার চিরকল্যাণকামী শ্রীশূরপাল (নামক) নরপাল স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, অনেকবার শ্রদ্ধাসলিলাপ্লুতহৃদয়ে, নতশিরে, পবিত্র (শান্তি)-বারি গ্রহণ করিয়াছিলেন[৪৬]।” প্রথম বিগ্রহপাল বা প্রথম শূরপালদেবের পুত্র নারায়ণপালদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, জয়পালের “অজাতশত্রুর ন্যায় শ্রীমান্ বিগ্রহপাল নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার (বিমল জলধারার ন্যায়) বিমলঃ অসিধারায় শত্রুবনিতাবর্গের (সধবাজনোচিত) অঙ্গরাগ বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। তিনি শত্রুবর্গকে গুরুতর বিপদ্‌ভোগের পাত্র এবং সুহৃদ্‌বর্গকে যাবজ্জীবন সম্পৎসম্ভোগের পাত্র করিয়াছিলেন[৪৭]।” প্রথম বিগ্রহপাল বা প্রথম শূরপালদেবের দুইখানি মাত্র শিলালিপি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই লিপিদ্বয় দুইটি বুদ্ধমূর্ত্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ আছে। এই মূর্ত্তিদ্বয় সম্ভবতঃ পাটনা জিলার বিহার নগরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল; কারণ, উভয় খোদিতলিপিতেই উদ্দণ্ডপুরের উল্লেখ আছে। উদ্দণ্ডপুর, বিহার নগরের প্রাচীন নাম। এই খোদিতলিপিদ্বয়ে প্রথম বিগ্রহপাল শূরপাল নামে উল্লিখিত হইয়াছেন এবং এইগুলি তাঁহার তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। পূর্ণদাস নামক সিন্ধুদেশীয় জনৈক বৌদ্ধ-ভিক্ষু এই মূর্ত্তিদ্বয় প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৪৮]। প্রথম বিগ্রহপালদেব বোধ হয়, অতি অল্পকাল রাজ্য ভোগ করিয়া পরলোকগত হইয়াছিলেন।

 প্রথম বিগ্রহপালের পরে হৈহয়বংশীয়া-রাজকুমারী লজ্জাদেবীর গর্ভজাত নারায়ণপালদেব গৌড়-বঙ্গ-মগধের সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। নারায়ণপাল অর্দ্ধ শতাব্দীর অধিক কাল গৌড়ের সিংহাসনে আসীন ছিলেন এবং তাঁহার সময়েই পালরাজবংশের অধিকার পরহস্তগত হইয়াছিল। নারায়ণপাল, ভোজদেবের অর্দ্ধশতাব্দীব্যাপী রাজত্বকালের শেষার্দ্ধের সময়ে, তাঁহার সমসাময়িক ছিলেন, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না। গুর্জ্জর-রাজ প্রথম ভোজদেব বারাণসী অধিকার করিয়া মগধ আক্রমণ করিয়াছিলেন। ভোজদেবের সাগরতালে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, ভোজদেব তাঁহার প্রবল শক্র বঙ্গদিগকে তাঁহার কোপ-বহ্নিতে দগ্ধ করিয়াছিলেন[৪৯]। ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসনে কিন্তু এমন কোন কথা নাই, যদ্দ্বারা তৎকর্ত্তৃক গুর্জ্জর-রাজের পরাজয় সূচিত হইতে পারে। সুতরাং এতদ্দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে যে, নারায়ণপালই গুর্জ্জররাজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। ভোজদেব যে সমস্ত সামন্ত-রাজগণের সহিত গৌড়-রাজ্য আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে দুইজনের বংশধরগণের খোদিতলিপিতে গৌড়াভিযানের কথা উল্লিখিত হইয়াছে। প্রাচীন মাণ্ডব্যপুরের (বর্ত্তমান মাণ্ডোর, যোধপুর-রাজ্য) প্রতীহার-বংশীয় অধিপতি কক্ক গৌড়-যুদ্ধে মুদ্গগিরিতে, অর্থাৎ মুঙ্গেরে, যশোলাভ করিয়াছিলেন[৫০]। কক্কের পুত্র বাউকের একখানি শিলালিপি যোধপুরে আবিষ্কৃত হইয়াছে; ইহাতে এই ঘটনার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। যোধপুরের শিলালিপি ডাঃ বুলারের মতানুসারে বাউকের চতুর্থ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৫১]। কিন্তু পণ্ডিত দেবীপ্রসাদের মতানুসারে উহা ৯৪০ বিক্রমাব্দে (৮৮৩ খৃঃ অঃ) উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৫২]। কক্কের অপর পুত্র কক্কুকের একখানি শিলালিপি যোধপুর-রাজ্যের ঘটিয়ালা গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছে; কিন্তু ইহাতে কক্কের গৌড়-যুদ্ধের কোনই উল্লেখ নাই। এই শিলালিপি ৯১৮ বিক্রমাব্দে (৮৬১ খৃঃ অঃ) উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৫৩]। সুতরাং ইহা স্থির যে, ৯১৮ হইতে ৯৪০ বিক্রমাব্দের মধ্যে কোন সময়ে কক্ক মুদ্গগিরিতে গৌড়েশ্বরের সহিত যুদ্ধে যশোলাভ করিয়াছিলেন। কল-চুরীবংশীয় প্রথম শঙ্করগণের পুত্র প্রথম গুণাম্ভোধিদেব ভোজদেবের সহিত মিলিত হইয়া অথবা তাঁহার সামন্তরূপে গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। প্রথম গুণাম্ভোধিদেবের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ সোঢ়দেব ১১৩৪ বিক্রমাব্দে (১০৭৯ খৃঃ অঃ) সরযূ-পারের অধিপতি ছিলেন। গোরখপুর জেলায় কাহ্লা গ্রামে আবিষ্কৃত তাঁহার তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, প্রথম গুণাম্ভোধিদেব গৌড়রাজ-লক্ষ্মী হরণ করিয়াছিলেন[৫৪]

 নারায়ণপালদেবের রাজ্যের প্রথমাংশে সমগ্র মগধ তাঁহার অধীন ছিল। কারণ, তাঁহার সপ্তম রাজ্যাঙ্কে ভাণ্ডদেব নামক জনৈক ব্যক্তি গয়া নগরে একটি আশ্রম স্থাপন করিয়াছিলেন। গয়ায় বিষ্ণুপদ-মন্দিরের প্রাঙ্গণে ভাণ্ডদেবের শিলালিপি অদ্যাপি বিদ্যমান আছে[৫৫]। নারায়ণপালের নবম রাজ্যাঙ্কে অন্ধ্রবিষয়ের অধিবাসী ধর্ম্মমিত্র নামক জনৈক ভিক্ষু মগধের কোন স্থানে (সম্ভবতঃ উদ্দণ্ডপুর নগরে) একটি মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৫৬]। এই শিলালিপি এখন কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। নারায়ণপালদেবের সপ্তদশ রাজ্যাঙ্কে তিনি মুদ্গগিরিসমাবাসিত জয়স্কন্ধাবার হইতে তীরভুক্তি (তীরহুত) কক্ষবিষয়ে অবস্থিত মকুতিকা গ্রাম কলশপোতে স্বনির্ম্মিত সহস্র মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মহাদেবের এবং পাশুপত আচার্য্যপরিষদের ব্যবহারার্থ প্রদান করিয়াছিলেন[৫৭]। ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, নারায়ণপালের সপ্তদশ রাজ্যাঙ্ক পর্য্যন্ত মুদ্গগিরি বা মুঙ্গের এবং তীরভুক্তি বা তীরহুত তাঁহার অধীন ছিল। অনুমান হয় ইহার পরেই মগধ, তীরভুক্তি ও অঙ্গ ভোজদেব কর্ত্তৃক বিজিত হইয়াছিল। নারায়ণপালদেবের ৫৪ রাজ্যাঙ্কে উদ্দণ্ডপুরে জনৈক বণিক্ একটি পিত্তলময়ী পার্ব্বতী-মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই মূর্ত্তিটি শ্রীযুক্ত চিরসুখ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ছিল এবং ইহা বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় প্রদত্ত হইয়াছে[৫৮]। কেদারমিশ্র ও তাঁহার পুত্র গুরবমিশ্র নারায়ণপালের মন্ত্রী ছিলেন[৫৯]। ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসনে গুরবমিশ্রই দূতকরূপে উল্লিখিত হইয়াছিলেন। নারায়ণপালের একমাত্র পুত্রের নাম আবিষ্কৃত হইয়াছে[৬০]। তাঁহার নাম রাজ্যপাল। নারায়ণপাল সম্ভবতঃ পঞ্চান্ন বৎসর রাজত্ব করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছিলেন।

 নারায়ণপালের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র রাজ্যপাল গৌড়-বঙ্গের সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত বাণগড়ে আবিষ্কৃত প্রথম মহীপালদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, রাজ্যপাল বহু গভীর জলাশয় এবং উচ্চদেবালয় নির্ম্মাণ করিয়া কীর্ত্তিলাভ করিয়াছিলেন[৬১]। রাজ্যপাল রাষ্ট্রকূটবংশীয় তুঙ্গ নামক জনৈক নরপতির কন্যা ভাগ্যদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন[৬২]। নালন্দার ধ্বংসাবশেষ মধ্যে রাজ্যপালের ২৪ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ খোদিতলিপিযুক্ত একটি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে, এই স্তম্ভটি বড়গাঁও গ্রামে একটি আধুনিক জৈন-মন্দিরে রক্ষিত আছে[৬৩]। তাঁহার একমাত্র পুত্রের নাম আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইনিই দ্বিতীয় গোপালদেব। রাজ্যপালের শ্বশুরের প্রকৃত পরিচয় অদ্যাপি স্থির হয় নাই। স্বর্গীয় ডাঃ কিল্‌হর্ণ অনুমান করিয়াছিলেন যে, রাষ্ট্রকূট-রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগত্তুঙ্গই রাজ্যপালের শ্বশুর[৬৪]। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু অনুমান করেন যে, শুভতুঙ্গ উপাধিধারী দ্বিতীয় কৃষ্ণই রাজ্যপালদেবের শ্বশুর[৬৫]। তুঙ্গধর্ম্মাবলোক নামক জনৈক রাজার একখানি শিলালিপি বহুকাল পূর্ব্বে বুদ্ধগয়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল। স্বর্গীয় রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই শিলালিপির পাঠোদ্ধার করিয়াছিলেন[৬৬]। সম্ভবতঃ ইনিই রাজ্যপালদেবের শ্বশুর।

 প্রথম ভোজদেবের পুত্র, মহেন্দ্রপাল, পিতার মৃত্যুর পরে প্রতীহার-বংশের বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মহেন্দ্রপালদেবের রাজ্যকালে তীরভুক্তি ও মগধ পাল-রাজগণের হস্তচ্যুত হইয়া প্রতীহার সাম্রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। এই প্রদেশদ্বয়ে মহেন্দ্রপালদেবের অধিকারসূচক একখানি তাম্রশাসন ও কয়েকখানি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। মহেন্দ্রপালদেবের অষ্টম রাজ্যাঙ্কে গয়ার নিকটে ফল্গু নদীর অপর পারে রামগয়ায় সহদেব নামক এক ব্যক্তি বিষ্ণুর দশাবতারের একটি প্রস্তর-মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৬৭]। ৯৫৫ বিক্রমাব্দে (৮৯৮ খৃঃ অঃ) মহেন্দ্রপালদেব শ্রাবস্তিভুক্তির অন্তর্গত শ্রাবস্তিবিষয়ে একখানি গ্রাম জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন[৬৮]। গয়া জেলায় গুণেরীয়া গ্রামে মহেন্দ্রপালের নবম রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রস্তরমূর্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে[৬৭]। তাঁহার নবম রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত একটি মূর্ত্তির খোদিতলিপির চিত্র হইতে তাহার পাঠোদ্ধার সম্পন্ন হইয়াছে। অপর মূর্ত্তিটি স্বর্গীয় কাপ্তেন কিটো (Kittoe) দর্শন করিয়াছিলেন[৬৯], কিন্তু ইহার খোদিতলিপির কোন চিত্র বা প্রতিলিপি প্রকাশিত হয় নাই। সম্প্রতি হাজারিবাগ জেলায় ইটখৌরী গ্রামে মহেন্দ্রপালের রাজ্যকালে প্রতিষ্ঠিত আর একটি প্রস্তর মূর্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে[৭০]। মহেন্দ্রপালদেব বোধ হয় বৃদ্ধাবস্থায় কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন এবং অধিক দিন রাজ্যভোগ করিতে পারেন নাই[৭১]। তাঁহার মৃত্যুর পরে প্রথমা মহিষী দেহনাগাদেবীর গর্ভজাত পুত্র দ্বিতীয় ভোজদেব কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন[৭২]। দ্বিতীয় ভোজদেব বোধ হয় নির্ব্বিবাদে কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রাপ্ত হন নাই। চেদীবংশীয় প্রথম কোকল্লদেব তাঁহাকে সাহায্য করিয়া পিতৃ-সিংহাসনে উপবেশন করাইয়াছিলেন। বিলহরিতে আবিষ্কৃত চেদিবংশীয় রাজগণের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, প্রথম কোকল্ল পৃথিবীতে দুইটি অপূর্ব্ব কীর্ত্তিস্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন; উত্তরে প্রথম কীর্ত্তিস্তম্ভ ভোজদেব ও দক্ষিণে দ্বিতীয় কীর্ত্তিস্তম্ভ দ্বিতীয় কৃষ্ণ বা অকালবর্ষ[৭৩]। কোকল্লদেবের উত্তরপুরুষ প্রসিদ্ধ বীর, সম্রাট্ কর্ণদেবের বারাণসীতে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, কোকল্লদেব ভোজ, বল্লভরাজ, চিত্রকূট-ভূপাল এবং শঙ্করগণকে অভয় প্রদান করিয়াছিলেন[৭৪]। বল্লভরাজ অর্থে দ্বিতীয় কৃষ্ণ এবং চিত্রকূট-ভূপাল বলিতে চন্দেল্লরাজ হর্ষদেবকে বুঝায়[৭৫]। হর্ষ ও দ্বিতীয় কৃষ্ণ যাঁহার সমসাময়িক ব্যক্তি তিনি কখনই প্রথম ভোজদেবের সমকালীন হইতে পারেন না। সুতরাং কর্ণদেবের তাম্রশাসনে উল্লিখিত ‘ভোজ’, গুর্জ্জরবংশীয় দ্বিতীয় ভোজদেব। দ্বিতীয় কৃষ্ণ কোকল্লদেবের এক কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন[৭৬]। তিনি কোন এক গুর্জ্জর-রাজকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া গৌড় বঙ্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন। তাঁহার উত্তরপুরুষগণের তাম্রশাসনে তাঁহাকে ‘গৌড়ানাং বিনয়ব্রতাপর্ণগুরু’ উপাধিতে ভূষিত দেখিতে পাওয়া যায়[৭৭]। দ্বিতীয় কৃষ্ণ কর্ত্তৃক পরাজিত গুর্জ্জর-রাজ বোধ হয়, দ্বিতীয় ভোজদেব অথবা তাঁহার ভ্রাতা মহীপালদেব এবং রাজ্যপালই বোধ হয়, তাঁহার আক্রমণের সময়ে গৌড়ের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। গুর্জ্জরবংশীয় দ্বিতীয় ভোজদেব অতি অল্পকাল রাজত্ব করিয়া পরলোকগত হইলে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহীপালদেব গুর্জ্জর-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন[৭৮]। মহীপালের সময় হইতে প্রতীহার-গুর্জ্জর-সাম্রাজ্যের ধ্বংস আরম্ভ হয়। তাঁহার অভিষেকের অতি অল্পকাল পরে দ্বিতীয় কৃষ্ণের পৌত্র তৃতীয় ইন্দ্র উত্তরাপথ আক্রমণ করিয়া গুর্জ্জর-রাজধানী কান্যকুব্জ ধ্বংস করিয়াছিলেন[৭৯]। তৃতীয় ইন্দ্রের নরসিংহ নামধেয় জনৈক সামন্ত যমুনা পার হইয়া পলায়নপর মহীপালের অনুসরণ করিতে করিতে সাগর-সঙ্গমে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে তাঁহার অশ্বকে স্নান করাইয়াছিলেন।[৮০]

 রাজ্যপালদেবের মৃত্যুর পরে, তৎপুত্র দ্বিতীয় গোপাল গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় গোপালদেব যখন গৌড়েশ্বর, তখন মহীপালদেব গুর্জ্জর-সাম্রাজ্যের অধিপতি। রাষ্ট্রকূট-বংশীয় তৃতীয় ইন্দ্র যখন উত্তরাপথ আক্রমণ করিয়াছিলেন, সেই সময়ে বোধ হয়, গোপালদের অপহৃত পিতৃরাজ্যের কিয়দংশ উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন; কারণ মগধে তাঁহার রাজ্যকালে প্রতিষ্ঠিত দুইটি মূর্ত্তি ও তাঁহার রাজ্যকালে মগধে লিখিত একখানি বৌদ্ধগ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দ্বিতীয় গোপালদেবের প্রথম রাজ্যাঙ্কে নালন্দ নগরে একটি বাগেশ্বরী মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[৮১]। তাঁহার রাজ্যকালে কোন সময়ে শক্রসেন নামক এক ব্যক্তি বুদ্ধগয়ায় একটি বুদ্ধ-প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই মূর্ত্তির পাদপীঠমাত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে[৮২]তাঁহার পঞ্চদশ রাজ্যাঙ্কে মগধে বিক্রমশিলা-বিহারে একখানি ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা লিখিত হইয়াছিল[৮৩]। দ্বিতীয় গোপালদেবের মৃত্যুর পরে তৎপুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় গোপালদেবের রাজ্যের শেষভাগে অথবা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে চন্দেল্লবংশীয় যশোবর্ম্মা গৌড়দেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। খজুরাহো গ্রামে আবিষ্কৃত যশোবর্ম্মদেবের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তিনি ১০১১ বিক্রমাব্দের (৯৫৪ খৃঃ অঃ) পূর্ব্বে গৌড়, কোশল, কাশ্মীর, মিথিলা, মালব, চেদী, কুরু ও গুর্জ্জর-রাজগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৮৪]। অনুমান হয় দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালেই পালবংশীয় রাজগণ গৌড়দেশের অধিকারচ্যুত হইয়াছিলেন। কারণ, ৮৮৮ শকাব্দে (অর্থাৎ ৯৬৬ খৃঃ অঃ) কাম্বোজবংশীয় জনৈক নরপতি কর্ত্তৃক একটি শিবমন্দির নির্ম্মিত হইয়াছিল[৮৫]। ইতিপূর্ব্বে দেবপালদেবের রাজ্যকালে গৌড়রাজ্য একবার কাম্বোজ জাতি কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল[৮৬]। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন যে, খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে হিমালয় পর্ব্বতবাসী কাম্বোজ জাতি উত্তর-বঙ্গ আক্রমণ করিয়াছিল এবং উত্তরবঙ্গের বর্ত্তমান অধিবাসী কোচ, মেচ ও পলিয়া জাতি সেই কাম্বোজগণের বংশধর[৮৭]। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু কাম্বোজজাতীয় গৌড়রাজগণের উৎপত্তি সম্বন্ধে আলোচনাকালে বলিয়াছেন যে, কাম্বোজজাতীয় রাজবংশ বোম্বাই প্রদেশের কম্বায় বা খম্বায়ৎ নগরের অধিবাসী[৮৮]! কাম্বোজবংশীয় গৌড়-রাজগণ যে বিদেশীয় ছিলেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। দ্বিতীয় বিগ্রহপাল গৌড়দেশ হারাইয়া বোধ হয় রাঢ়ে অথবা বঙ্গদেশে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার ২৬শ রাজ্যাঙ্কে লিখিত একখানি ‘পঞ্চরক্ষা’ গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে[৮৯], এতদ্ব্যতীত দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালের কোন নিদর্শনই অদ্যাবধি আবিষ্কার হয় নাই। গুর্জ্জর-রাজ মহীপাল বোধ হয় এই সময়ে চন্দেল্লবংশীয় যশোবর্ম্মদেবের সাহায্যে মগধ ও অঙ্গ পুনরধিকার করিয়াছিলেন।

 ধর্ম্মপাল ও দেবপালদেবের রাজ্যকালে গৌড়-মগধ-বঙ্গে শিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল। মগধ ও গৌড় প্রস্তর-শিল্পের জন্য সমগ্র ভারতবর্ষে বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধ, বহুবিধ ধাতু ও প্রস্তরনির্ম্মিত মূর্ত্তি এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। নারায়ণপালের পরে পালরাজবংশের অবনতির সহিত গৌড়ীয় শিল্পেরও অবনতি আরব্ধ হইয়াছিল। পাল-রাজবংশের অবনতির সময়ে বঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হইয়াছিল। অনুমান হয় যে, দেবপালের রাজ্যের শেষভাগে খড়্গোদ্যম এই রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। খড়্গোদ্যমের পরে তাঁহার পুত্র জাতখড়্গ ও পৌত্র দেবখড়্গ বঙ্গের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন। দেবখড়্গের ত্রয়োদশ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ দুইখানি তাম্রশাসন হইতে এই রাজবংশের বিবরণ অবগত হওয়া যায়[৯০]। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু দেবখড়্গকে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক বলিয়া বিষম ভ্রমে পতিত হইয়াছেন[৯১]। দেবখড়্গের তাম্রশাসনদ্বয়ের অক্ষর দেখিয়া তাঁহাকে খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর পূর্ব্বের লোক বলিতে ভরসা হয় না।

 খড়্গবংশের অধঃপতনের পরে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী চন্দ্রবংশীয় রাজগণ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিলেন। এই বংশের আদিপুরুষ রোহিতগিরি বা রোহিতাশ্ব (রোহ্‌তাস্ গড়) পর্ব্বতের অধিপতি ছিলেন। তাঁহার নাম পূর্ণচন্দ্র। পূর্ণচন্দ্রের পুত্র সুবর্ণচন্দ্রও রাজা বলিয়া উল্লিখিত হন নাই। সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র ত্রৈলোক্যচন্দ্র পূর্ব্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে (হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপে) রাজ্যস্থাপন করিয়াছিলেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র শ্রীচন্দ্রদেবের অন্ততঃ তিনখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। শ্রীচন্দ্রদেবের মাতার নাম কাঞ্চনা এবং বিক্রমপুরে তাঁহার রাজধানী ছিল। প্রথম তাম্রশাসন দ্বারা শ্রীচন্দ্রদেব পৌণ্ড্রভুক্তিতে নান্যমণ্ডলে নেহকাষ্ঠিগ্রামে এক পাটক ভূমি শাণ্ডিল্যগোত্রীয়, মক্করগুপ্তের প্রপৌত্র, বরাহগুপ্তের পৌত্র, সুমঙ্গলগুপ্তের পুত্র কোটিহোমিক শান্তিবারিকপীতবাসগুপ্তশর্ম্মাকে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশে দান করিয়াছিলেন[৯২]। এই তাম্রশাসনখানি ঢাকা জেলার অন্তর্গত রামপাল গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। দ্বিতীয় তাম্রশাসনখানি স্বর্গীয় গঙ্গামোহন লস্কর কর্ত্তৃক ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর পরগণার কোন গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল এবং ঢাকা রিভিউ পত্রে ঢাকার ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীযুক্ত র‍্যাঙ্কিন (J. T. Rankin, I.C.S.) এই তাম্রশাসন সম্বন্ধে ৺গঙ্গামোহন লস্কর লিখিত একটি ক্ষুত্র প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছিলেন[৯৩]। তদনুসারে শ্রীচন্দ্রদেব সতটপদ্মাবাটী বিষয়ে কমার তালকমণ্ডলে লেলিয়াগ্রামে কিঞ্চিৎ ভূমি দান করিয়াছিলেন। তৃতীয় তাম্রশাসনখানি ফরিদপুর জেলায় মাদারিপুর মহকুমায় কেদারপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা প্রদত্ত হয় নাই, রাজকার্য্যালয়ে ভূমিদান সম্বন্ধে রাজাদেশে প্রদত্তভূমির আদেশ লিপিবদ্ধ করিবার জন্যই প্রস্তুত করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেই জন্য ইহাতে কেবল রাজার বংশ-পরিচয়মাত্র উৎকীর্ণ আছে[৯৪]। এই শ্রীচন্দ্রের বংশধরগণ পরে পাল রাজগণের অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন এবং গোবিন্দচন্দ্র নামক একজন পরবর্ত্তী রাজা প্রথম রাজেন্দ্র চোল কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। এই গোবিন্দচন্দ্র প্রথম মহীপাল দেবের সমসাময়িক।


পরিশিষ্ট (ছ)

 শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু একখানি কুলশাস্ত্রে দেবপালের উল্লেখ পাইয়াছেন; কিন্তু এই শ্লোকটি কুলশাস্ত্রের বচন বলিয়া গ্রন্থমধ্যে উল্লিখিত হইল না:—

ক্ষ্মাপালপ্রতিভূর্ভুবঃ পতিরভূদ্‌গৌড়ে চ রাষ্ট্রে ততঃ।
রাজাভূৎ প্রবলঃ সদৈব শরণঃ শ্রীদেবপালস্ততঃ॥
—Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896, pt. I, p. 21. 

গৌড় রাজ্যের অমাত্যবংশ:—

 গর্গদেবইচ্ছা
 দর্ভপাণিশর্করাদেবী
 সোমেশ্বররল্লাদেবী
 ভট্ট গুরবমিশ্র

বঙ্গের খড়্গরাজবংশ:—

 
খড়্গোদ্যম
 
 
 
 
 
 
 
জাতখড়্গ
 
 
 
 
 
 
 
দেবখড়্গ
 
 
 
 
 
 
 
রাজরাজভট্ট
(যুবরাজ)
 
 

বঙ্গের চন্দ্রবংশ:—

 
পূর্ণচন্দ্র
 
 
 
 
 
 
 
সুবর্ণচন্দ্র
 
 
 
 
 
 
 
ত্রৈলোক্যচন্দ্র
 
কাঞ্চনা
 
 
 
 
 
 
 
 
শ্রীচন্দ্র
 
 
 
 
 
 
 
গোবিন্দচন্দ্র
 
 
 হরিকেল পূর্ব্ববঙ্গের প্রাচীন নাম। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ ভাগে চীন দেশীয় পরিব্রাজক ই-চিং হরিকেল দেশে এক বৎসর অবস্থান করিয়াছিলেন[৯৫]। তিনি লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, হরিকেল পূর্ব্ব ভারতের পূর্ব্ব সীমায় অবস্থিত। হরিকেল একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধতীর্থ ছিল। হরিকেলের শিললোকনাথ খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতেও এতদূর প্রতিপত্তিশালী ছিলেন যে, বহু বৌদ্ধ গ্রন্থে তাঁহার চিত্র অঙ্কিত থাকিত। ফরাসী পণ্ডিত ফুসে এইরূপ একখানি চিত্রের বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন[৯৬]। চন্দ্রদ্বীপ সরকার বাকলার প্রাচীন নাম[৯৭]। পূর্ব্বে বঙ্গদেশের ঐতিহাসিকগণ মনে করিতেন যে, চন্দ্রদ্বীপের পঞ্চদশ শতাব্দীর রাজা দনুজমর্দ্দনের গুরুর নামানুসারে চন্দ্রদ্বীপের নামকরণ হইয়াছে[৯৮]। শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়া এই কুলশাস্ত্রমূলক ভ্রান্ত বিশ্বাস দূরীভূত হইয়াছে। চন্দ্রদ্বীপও একটি প্রাচীন বৌদ্ধতীর্থ। অধ্যাপক ফুসে চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন বৌদ্ধদেবতা ভগবতীতারার চিত্র প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে আবিষ্কার করিয়াছেন[৯৯]



  1. ভ্রাম্যদ্ভির্বিজয়ক্রমেণ করিভি [ঃস্বা] মেব বিন্ধ্যাটবী-
    মুদ্দামপ্লবমানবাষ্পপয়সো দৃষ্টাঃ পুনর্বান্ধবাঃ।
    কম্বোজেষু চ যস্য বাজি যুবভির্ধ্বস্তান্যরাজৌজসো
    হ্রেষামিশ্রিতহারিহেষিতরবাঃ কান্তাশ্চিরং বীক্ষিতাঃ॥
     মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত দেবপালদেবের তাম্রশাসন; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৭।

  2. আরেবাজনকান্মতঙ্গজমদস্তি ম্যচ্ছিলাসংহতে-
    রাগৌরীপিতুরীশ্বরেন্দুকিরণৈঃ পুষ্যৎসিতিম্নো গিরেঃ।
    মার্ত্তণ্ডাস্তময়োদয়ারুণজলাদাবারিরাশিদ্বয়াৎ।
    নীত্যা যস্য ভুবং চকার করদাং শ্রীদেবপালো নৃপঃ॥
     —ভট্টগুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপি; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭২।

  3. উৎকীলিতোৎকলকুলং হৃত-হূণগর্ব্বং খর্ব্বীকৃতদ্রবিড়গুর্জ্জর দীনাথদর্পং।
    ভূপীঠমব্ধিরশনাভরণম্বুভোজ গৌড়েশ্বরশ্চিরমুপাস্যধিয়ং যদীয়াং॥
     —ভট্টগুরবমিশ্রের স্তম্ভলিপি; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭৪।

  4. অরিনৃপতিমকুটঘট্টিতচরণস্ সকলভুবনবন্দিতশৌর্য্যঃ।
    বঙ্গাঙ্গমগধ-মালব-বেঙ্গীশৈরর্চ্চিতোঽতিশয়ধবলঃ॥
    —নীলগুণ্ড ও সিরুরের শিলালিপি; Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 103; Indian Antiquary, Vol. XII, p. 218. 

  5. শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু বলেন,—“১ম অমোঘবর্ষের নীলগুণ্ডলিপির ১১শ শ্লোকে এরূপ পরিচয় (বঙ্গাঙ্গ মগধ মালব বেঙ্গী রাজগণ কর্ত্তৃক অতিশয়ধবল বা ১ম অমোঘবর্ষের অর্চ্চনা) থাকায় কেহ কেহ মনে করেন, অমোঘবর্ষের নিকট দেবপাল পরাজয় স্বীকার করেন। কিন্তু উপরে লিখিয়াছি, প্রথম অমোঘবর্ষ দেবপালের মাতুল ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ভাগিনেয় কর্ত্তৃক মাতুলের অর্চ্চনা স্বাভাবিক, ইহা খর্ব্বতাপ্রকাশক নহে।”
    —(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৫৮, পাদটীকা ৪৭)।

     বলা বাহুল্য, ১ম অমোঘবর্ষের সহিত দেবপালদেবের সম্বন্ধজ্ঞাপক কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। পূর্ব্বে দেবপালের মাতুল-বংশের পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। প্রথম অমোঘবর্ষ দেবপালের মাতুল ছিলেন, এই কথা বসুজ মহাশয়ের কল্পনাপ্রসূত, প্রমণাভাবে ইহা ঐতিহাসিক সত্যরূপে গৃহীত হইল না।

  6. তজ্জন্মা রামনামা প্রবরহরিবলন্যস্তভূভৃৎ প্রবন্ধৈ-
    রাবধ্নন্বাহিনীনাং প্রসভমধিপতীনুদ্ধতক্রূরসত্বান্।
    পাপাচারান্তরায়প্রমথনরুচিরঃ সঙ্গতঃ কীর্ত্তিদারৈ-
    স্ত্রাতা ধর্ম্মস্য তৈস্তৈস্সমুচিতচরিতৈঃ পূর্ব্ববন্নির্ব্বভাসে॥ ১২
    অনন্যসাধনাধীনপ্রতাপাক্রান্তদিঙ্মুখঃ।
    উপায়ৈস্সম্পদাং স্বামী যঃ সব্রীড়মুপাস্যত॥ ১৩
    অর্থিভির্ব্বিনিযুক্তানাং সম্পদাং জন্ম কেবলং।
    যস্যাভূৎ কৃতিণঃ প্রীত্যৈ নাত্মেচ্ছাবিনিযোগতঃ॥ ১৪
    —সাগরতালের শিলালিপি, Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1903-4, p. 281. 

  7. তস্মাদুপেন্দ্রচরিতৈর্জ্জগতীং পুনানঃ
    পুত্রো বভূব বিজয়ী জয়পালনামা।
    ধর্মদ্বিষাং শময়িতা যুধি দেবপালে
    যঃ পূর্ব্বজে ভুবনরাজ্য-সুখান্যনৈষীৎ॥ ৫
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৭।

  8. যস্মিন্ ভ্রাতুর্ন্নিদেশাদ্বলবতি পরিতঃ প্রস্থিতে জেতুমাশাঃ
    সীদন্নাম্নৈব দূরান্নিজপুরমজহাদুৎকলানামধীশঃ।
    আসাঞ্চক্রে চিরায় প্রণয়ি-পরিবৃতো বিভ্রদুচ্চেন মূর্ধ্না
    রাজা প্রাগ্‌জ্যোতিষাণামুপশমিতসমিৎসংকথাং যস্য চাজ্ঞাং॥ ৬
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৮।

  9. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ২৯।
  10. Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. VII, p. 619.
  11. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৪৪। এই শ্লোক নবাবিষ্কৃত নালন্দার তাম্রশাসনেও আছে।
  12. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৮-৪০।
  13. প্রত্নতত্ত্ববিভাগের সর্ব্বাধ্যক্ষ (Director-General of Archaeology in India) স্যর জন মার্শেলের (Sir John Marshall) অনুমতি অনুসারে আমার অনুরোধে বন্ধুবর পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হীরানন্দ শাস্ত্রী এই তাম্রশাসনের উদ্ধৃত পাঠ ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগ (Cambridge History of India, Voll. I) সঙ্কলনের জন্য আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন। এই নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনের পাঠ অদ্যাপি প্রকাশিত হয় নাই। পণ্ডিত হীরানন্দ শাস্ত্রী ইহার পাঠ Epigraphia Indica পত্রে প্রকাশ করিবেন। শাস্ত্রী মহাশয়ের সৌজন্যে এই নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনের সারাংশ এই গ্রন্থের জন্য সঙ্কলিত হইল। এতদ্ব্যতীত দেবপালদেবের রাজ্যকালে প্রতিষ্ঠিত একটি মূর্ত্তি নালন্দায় আবিষ্কৃত হইয়াছে। কিন্তু খোদিত লিপির পাঠ অদ্যাপি প্রকাশিত হয় নাই।—Annual Report of the Archaeological Survey of India, Central Circle, 1920-21, pp. 37-38.
  14. তস্মাদ্‌ভূষিতসাব্ধিভূমিবলয়ঃ শিষ্যোপশিষ্যব্রজৈ-
    র্বিদ্বন্মৌলিরভূদুমাপতিরিতি প্রভাকরগ্রামণীঃ।
    ক্ষ্মাপালাজ্জয়পালতঃ স হি মহাশ্রাদ্ধং প্রভূতং মহা-
    দানং চার্থিগণার্হণার্দ্রহৃদয়ঃ প্রত্যগ্রহীৎ পুণ্যবান্॥
    —ছন্দোগপরিশিষ্ট-প্রকাশ; Eggeling’s Catalogue of Sanskrit Manuscripts in the India Office Library. White Hall, London, part I, pp. 92-93. 

  15. শ্রেয়োবিধাবুভয় [ব]ংশ-বিশুদ্ধিভাজং
    রাজাকরোদধিগতাত্মগুণং গুণজ্ঞঃ।
    আত্মানুরূপচরিতং স্থিরযৌবরাজ্যং
    শ্রীরাজ্যপালমিহ দূতকমাত্মপুত্রং॥
    —গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪০।

  16. বেদানধীত্য সকলান্ কৃতশাস্ত্রচিন্তঃ
    শ্রীমৎকণিষ্কমুপগম্য মহাবিহারম্।
    আচার্য্যবর্য্যমথ স প্রশম-প্রশস্যং
    সর্ব্বজ্ঞশান্তিমনুগম্য তপশ্চচার॥ ৬
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৪৮।

  17. পরিব্রাজক ইউয়ান্-চোয়াং পুরুষপুর নগরের উপকণ্ঠে কণিষ্কের মহাবিহার দর্শন করিয়াছিলেন—Watters’s On—Yuan Chwang, Vol. I, p. 208.
  18. বজ্রাসনং বন্দিতুমেকদাঽথ
    শ্রীমন্মহাবোধিমুপাগতোঽসৌ।
    দ্রষ্টুং ততোঽগাৎ সহ দেশি-ভিক্ষূন্
    শ্রীমৎযশোবর্ম্মপুরং বিহারম্॥ ৮
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৪৮।

  19. তিষ্ঠন্নথেহ সুচিরং প্রতিপত্তিসারঃ
    শ্রীদেবপাল-ভুবনাধিপলব্ধ-পূজঃ।
    প্রাপ্ত-প্রভঃ প্রতিদিনোদয়-পূরিতাশঃ
    পূষেব দারিততমঃপ্রসরো ররাজ॥ ৯
    —গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৪৮।

  20. ভিক্ষোরাত্মসমঃ সুহৃদ্ভুজ ইব শ্রীসত্যবোধের্নিজো
    নালন্দা পরিপালনায় নিয়তঃ সংঘস্থিতের্য স্থিতঃ।
    যেনৈতৌ স্ফুটমিন্দ্রশৈলমুকুট-শ্রীচৈত্য-চূড়ামণী
    শ্রামণ্যব্রত-সম্বৃতেন জগতঃ শ্রেয়োঽর্থমুত্থাপিতৌ॥ ১০
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৪৮-৪৯।

  21. ইন্দ্রশিলা পর্ব্বতের বর্ত্তমান নাম গিরিয়েক। ইহা পাটনা জিলায়, বিহার মহকুমায় প্রাচীন রাজগৃহ হইতে পাঁচ ক্রোশ দূরে অবস্থিত।
  22. গিরিয়েক পর্ব্বতশীর্ষে দুইটি বৃহৎ ইষ্টকনির্ম্মিত চৈত্যের ধংসাবশেষ অদ্যাপি বিদ্যমান আছে, সম্ভবতঃ এই দুইটি চৈত্যই বীরদেব কর্ত্তৃক নির্ম্মিত হইয়াছিল।
  23. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৩৩। (উইকিসংকলন টীকা: তাম্রশাসনটি পরে পাওয়া যায় এবং ১৯২৫ সালে এর সঠিক পাঠ ছবিসহ প্রকাশিত হয়। এখানে দেখুন।)
  24. গরুড়স্তম্ভলিপি, ৫-৭ শ্লোক; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭৮-৭৯। (উইকিসংকলন টীকা: সপ্তম শ্লোকটি বর্তমান মতে দেবপাল-পুত্র মহেন্দ্রপাল সম্পর্কে প্রযোজ্য; এখানে পৃঃ ৭৫ দেখুন।)
  25. ন ভ্রান্তং বিকটং ধনঞ্জয়তুলামারুহ্য বিক্রামতা
    বিত্যান্যর্থিষু বর্ষতা স্তুতি-গিরো নোদ্‌গর্ব্বমাকর্ণিতাঃ।
    নৈবোক্তা মধুরং বহু-প্রণয়িনঃ সম্বল্গিতাশ্চ শ্রিয়া
    যেনৈবং স্বগুণৈর্জ্জগদ্বিসদৃশৈশ্চক্রে সতাং বিস্ময়ঃ॥ ৯
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭৩।

  26. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৮১। (উইকিসংকলন টীকা: এই শ্লোকটি বর্তমান মতে দেবপাল-পুত্র মহেন্দ্রপাল সম্পর্কে প্রযোজ্য; এখানে পৃঃ ৭৬ দেখুন।)
  27. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৩০।
  28. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৩০-৩১।
  29. Epigraphia Indica, Vol. V. p. 311.
  30. Epigraphia Indica, Vol. VIII, Appendix I. p. 17.
  31. “It seems clear from this grant that Vigrahapala was not a nephew, but a son of Devapala; for the pronoun “his son” (tat-sunuh) must refer to the nearest preceding noun, which is Devapala. In the Bhagalpur grant this reference is obscured through the interpolation of an intermediate verse in praise of Jayapala, which makes to appear as if Vigrahapala were a son of Jayapala.—Centenary Review of the Asiatic Society of Bengal, Appendix II, p. 206.
  32. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৭, পাদটীকা।
  33. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৬।
  34. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. III, p. 26.
  35. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৫২।
  36. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৮, ৯৩-৯৪, ১২৪, ১৪৯।
  37. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭৪-৭৫।
  38. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ২১৬।
  39. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৬৫, পাদটীকা।
  40. Epigraphia Indica, Vol. V, p. 211.
  41. Ibid. Vol. I, p. 156.
  42. Ibid, p. 186.
  43. Ibid. Vol. IX. p. 3
  44. V. A. Smith’s Early History of India (3rd edition) p. 379.
  45. ধারাবর্ষসমুন্নতিং গুরুতরামালোক্য লক্ষ্ম্যা যুতো ধামব্যাপ্তদিগন্তরোপি মিহিরঃ সদ্বশ্যবাহান্বিতঃ।
    যাতঃ সোপি শমং পরাভবতমোব্যাপ্তাননঃ কিং যুনর্যেতীবামলতেজসা বিরহিতা হীনাশ্চ দীনা ভুবি॥ ৪১
    —Indian Antiquary, Vol. XII, p. 184.

  46. যস্যেজ্যাসু বৃহস্পতিপ্রতিকৃতেঃ শ্রীশূরপালো নৃপঃ
    সাক্ষাদিন্দ্র ইব ক্ষতাপ্রিয়বলো গত্বৈব ভূয়ঃ স্বয়ং।
    নানাম্ভোনিধিমেখলস্য জগতঃ কল্যাণসঙ্গী (?) চিরং
    শ্রদ্ধাম্ভঃপ্লুতমানসো নতশিরা জগ্রাহ পূতম্পয়ঃ॥ ১৫
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৭৪।

  47. শ্রীমান্ বিগ্রহপালস্তৎসূনুরজাতশত্রুরিব জাতঃ।
    শত্রুবনিতাপ্রসাধন-বিলোপিবিমলাসি-জলধারঃ॥ ৭
    রিপবো যেন গুর্ব্বীণাং বিপদামাস্পদীকৃতাঃ।
    পুরুষায়ুষ-দীর্ঘাণাং সুহৃদঃ সম্পদামপি॥ ৮
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৮।

  48. বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা, ১৫শ ভাগ, পৃঃ ১২।
  49. যস্য বৈরিবৃহদ্বঙ্গান্ দহতঃ কোপবহ্নিনা।
    প্রতাপাদর্ণ্ণসাং রাশীন্ পাতুর্ব্বৈতৃষ্ণামাবভৌ॥” ২১
    —Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1903-4, pp. 282-84.

  50. ততোঽপি শ্রীযুতঃ কক্কঃ পুত্রো জাতো মহামতিঃ।
    যশো মুদ্গগিরৌ লব্ধং যেন গৌড়ৈ[ঃ]সমং রণে॥
    —Journal of the Royal Asiatic Society, 1894, p. 7.

  51. Ibid—p. 3.
  52. Ibid., 1895, p. 514.
  53. Ibid, p. 518.
  54. তৎসূনুর্দ্ধাম ধাম্নাং নিধিরধিকধিয়াং ভোজদেবাপ্তভূমিঃ
    প্রত্যাবৃত্যপ্রকারঃ প্রথিতপৃথুযশাঃ শ্রীগুণাম্ভোধিদেবঃ।
    যেনোদ্দামৈকদর্পদ্বিপঘটিতঘটাঘাতসংসক্তমুক্তা-
    সোপানোদ্দন্তুরাসিপ্রকটপৃথুপতেনাহিতা গৌড়লক্ষ্মীঃ॥ ৯
    —Epigraphia Indica, Vol. VII, p. 89.

  55. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, pp. 60-61.
  56. Ibid, p. 62; বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা, ১৫শ ভাগ, পৃঃ ১৩।
  57. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৬০-৬১।
  58. এই খোদিতলিপি একটি পিত্তলমূর্ত্তির পশ্চাদ্ভাগে উৎকীর্ণ আছে।

     “ওঁ দেয় [ধর্ম্মে]য়ং শ্রীনারায়ণপাল দেবরাজ্যে সম্বৎ ৫৪, শ্রীউদণ্ডপু[র]বাস্তব্য রাণক উছপুত্র ঠারুকস্য।”

     পরমশ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় আমাকে এই মূর্ত্তির চিত্র ও খোদিতলিপি ব্যবহার করিবার অনুমতি দিয়া বাধিত করিয়াছেন। বন্ধুবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ এই খোদিতলিপির অধিকাংশের পাঠোদ্ধার করিয়াছেন।

  59. কুশলো গুণবান্ বিবেক্তুং বিজিগীষুর্যন্নৃপশ্চ বহুমেনে।
    শ্রীনারায়ণপালঃ প্রশস্তিরপরাস্তু কা তস্য॥ ১৯
    —গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৭৫।

  60. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৪।
  61. তোয়া[শ]য়ৈর্জ্জলধি[মূল]-গভীরগর্ভৈ-
    র্দ্দেবালয়ৈশ্চ কুলভূধরতুল্য-কক্ষৈঃ।
    বিখ্যাতকীর্তির[ভব]ত্তনয়শ্চ তস্য
    শ্রীরাজ্যপাল ইতি মধ্যমলোক-পালঃ॥ ৭
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৪।

  62. তস্মাৎ পূর্ব্বক্ষিতিধ্রান্নিধিরিব মহসাং[রাষ্ট্র]কূটা[ন্ব]য়েন্দো-
    স্তুঙ্গস্যোত্তুঙ্গমৌলের্দ্দুহিতরি তনয়ো ভাগ্যদেব্যাং প্রসূতঃ।
    শ্রীমান্ গোপালদেবশ্চিরতরম[বনেরেক]পত্ন্যা ইবৈকো
    ভর্ত্তাভূন্নৈক-[রত্নদ্যু]তি-খচিত-চতুঃসিন্ধুচিত্রাশুংকায়াঃ॥ ৮
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৯৪।

  63. Indian Antiquary, 1917, Vol. XLVII, p. 111.
  64. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1892. pt. I, p. 80.
  65. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১২৮।
  66. Buddha-Gaya. p, 195. pl. XL.
  67. ৬৭.০ ৬৭.১ Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 64. (উইকিসংকলন টীকা: প্রকৃতপক্ষে এই মহেন্দ্রপাল পালবংশীয় এবং দেবপালের পুত্র।)
  68. Indian Antiquary, Vol. XV, pp. 306-7.
  69. One mentions the fact of the party having apostatized, and again returned to the worship of the Sákya, in the 19th year of the reign of Sri Mahendrapáladeva. Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. XVII, 1848, p. 234. মগধে আবিষ্কৃত মহেন্দ্রপালের রাজাকালে প্রতিষ্ঠিত দুইটি মূর্ত্তি লণ্ডনের ব্রিটিস মিউজিয়মে রক্ষিত আছে।—Nachrichten von der Koniglichen Gesselschaft der Wissenschaften zu Gottingen, Philologische-historische klasse, 1904, p. 210-11.
  70. Annual Report of the Patna Museum. 1920-21, p. 44.
  71. Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 265.
  72. Indian Antiquary, Vol. XV, p. 140.
  73. জিত্বা কৃৎস্নাং যেন পৃথ্বীমপূর্ব্বঙ্কীর্ত্তিস্তম্ভ-দ্বন্দ্বমারোপ্যতে স্ম।
    কৌম্ভোদ্ভব্যান্দিশ্যসৌ কৃষ্ণরাজঃ কৌবের্যাঞ্চ শ্রীনিধির্ভোজদেবঃ॥ ১৭
    Epigraphia Indica, Vol. I, p. 256.

  74. ভোজে বল্লভরাজে শ্রীহর্ষে চিত্রকূট-ভূপালে।
    শঙ্করগণে চ রাজনি যস্যাসীদভয়দঃ পাণিঃ॥ ৭
    —Epigraphia Indica, Vol. II, p. 306.

  75. Ibid, p. 300.
  76. সহস্রার্জুনবংশস্য ভূষণং কোক্কলাত্মজা।
    তস্যাভবন্মহাদেবী জগত্তুঙ্গস্ততোজনি॥ ১৪
     —কম্বায় নগরে আবিষ্কৃত চতুর্থ গোবিন্দের তাম্রশাসন। Epigraphia Indica, Vol. VII, p. 38.

  77. তস্যোত্তর্জ্জিতগূর্জ্জরো হৃতহটল্লাটোদ্ভটশ্রীমদো
    গৌড়ানাং বিনয়ব্রতার্পণগুরুস্সামুদ্রনিদ্রাহরঃ।
    দ্বারস্থাঙ্গকলিঙ্গগাঙ্গমগধৈরভ্যর্চ্চিতাজ্ঞশ্চিরং
    সূনুস্সূনৃতবাগ্ভুবঃ পরিবৃঢ়ঃ শ্রীকৃষ্ণরাজোভবৎ॥ ১৩
     —দেউলীতে আবিষ্কৃত ৩য় কৃষ্ণের তাম্রশাসন—Epigraphia Indica, Vol. V, p. 193.

  78. Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 269.
  79. যম্মাদ্যদ্দ্বিপদন্তঘাতবিষমং কালপ্রিয়প্রাঙ্গণং
    তীর্ণ্ণা যত্তুরগৈরগাধযমুনা সিন্ধুপ্রতিস্পর্দ্ধিনী।
    যেনেদং হি মহোদয়ারিনগরং নির্ম্মূলমুন্মূলিতং
    নাম্নাদ্যাপি জনৈঃ কুশস্থলমিতি খ্যাতিং পরাং নীয়তে॥ ১৯
     —কম্বায় নগরে আবিষ্কৃত চতুর্থ গোবিন্দের তাম্রশাসন।
     Epigraphia Indica, Vol. VII, p. 38.

  80. কাণাডা ভাষায় পম্পরাজ-রচিত ‘কর্ণাটকশব্দানুশাসন’ (Edited by Lewis Rice) পৃঃ ২৬।
  81. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৮৭।
  82. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৮৯।
  83. পরমেশ্বরপরমভট্টারকপরমসৌগত মহারাজাধিরাজশ্রীমদ্গোপালদেব প্রবর্দ্ধমানকল্যাণবিজয়রাজ্যেত্যাদি সম্বৎ ১৫ অস্মিনে দিনে ৪ শ্রীমদ্বিক্রমশীলদেববিহারে লিখিতেয়ং ভগবতী।
     —Journal of the Royal Asiatic Society, 1910, pp. 150-51.
  84. গৌড়ক্রীড়ালতাসিস্তুলিতখসবলঃ কোশলঃ কোশলানাং
    নশ্যৎকাশ্মীরবীরঃ শিথিলিতমিথিলঃ কালবন্মালবানাং।
    সীদৎসাবদ্যচেদিঃ কুরুতরুষু মরুৎসংজ্বরো গূর্জ্জরাণাং
    তস্মাত্তস্যাং স যজ্ঞে নৃপকুলতিলকঃ শ্রীযশোবর্ম্মরাজঃ॥ ২৩
    —খজুরাহো গ্রামে লক্ষ্মণজি মন্দিরের শিলালিপি,—Epigraphia Indica, Vol. I. p. 126.

  85. Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. VII, p. 690.
  86. ২০৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
  87. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৩৭।
  88. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৭২।
  89. পরমেশ্বরপরমভট্টারকপরমসৌগত মহারাজাধিরাজ শ্রীমদ্বিগ্রহপালদেবস্য প্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যে ......... সম্বৎ ২৬ আষাঢ় দিনে ২৪।
     —Bendall, Catalogue of the Sanskrit Manuscripts in the British Museum, p. 232; Journal of the Royal Asiatic Society, 1910, p. 151.
  90. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, vol. I, pp. 85-91.
  91. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৪৭, পাদটীকা ৭।
  92. Epigraphia Indica, Vol. XII, pp. 136-42.
  93. Dacca Review, October, l912.
  94. বন্ধুবর শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী এম. এ. এই তাম্রশাসনের উদ্ধৃত পাঠ Epigraphia Indica পত্রে প্রকাশ করিতেছেন। তিনি তাঁহার প্রবন্ধ মুদ্রিত হইবার পূর্ব্বে বাঙ্গালার ইতিহাসে ব্যবহার করিতে অনুমতি দিয়াছেন।
  95. Jyan Takakusu’s I-Tsing, p. XLVI.
  96. Etude sur L’Iconographie Bouddhique de L’Inde, premier partie, p. 200.
  97. Ain-i-Akbari (Jarret’s Trans.) Vol. II. p. 134.
  98. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ২৩৬, পাদটীকা ৯।
  99. Etude sur L’Iconographie Bouddhique de L’Inde, premier partie, p. 192.