বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/সপ্তম পরিচ্ছেদ


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ৮


আশ্‌রফপুরে আবিষ্কৃত পিত্তলময় চৈত্য


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ৯


বুদ্ধগয়ায় আবিষ্কৃত কেশবের শিলালিপি।
ধর্ম্মপালের ২৬শ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

পাল-বংশের অভ্যুদয়।

 পালবংশের পরিচয়—সন্ধ্যাকরনন্দীর রামরচিত—হরিভদ্রের অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতাটীকা—বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন—ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গল—পালরাজগণের কায়স্থত্ব—মাৎস্যন্যায়-রাজনির্ব্বাচন সম্বন্ধে তারানাথের উপাখ্যান—পালরাজগণের পিতৃভূমি বরেন্দ্রী—প্রথম গোপালদেব—দেদ্দদেবী—গোপালদেবের রাজ্যকাল—ধর্ম্মপাল—ধর্ম্মপালের রাজ্যকাল—তৃতীয় গোবিন্দের রাজ্যকাল—কান্যকুব্জরাজ ইন্দ্রায়ুধের পরাজয়—চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসন-প্রদান—দ্বিতীয় নাগভটের সহিত যুদ্ধ—ধর্ম্মপালের পরাজয়—বাহুকধবল—তৃতীয় গোবিন্দের উত্তরাপথাভিযান—ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধের তৃতীয় গোবিন্দের নিকটে সাহায্য-প্রার্থনা—রণ্ণাদেবী—পরবল—ত্রিভুবনপাল—বুদ্ধগয়ার শিলালিপি—খালিমপুরের তাম্রশাসন—স্বর্ণরেখ—হরিচরিত কাব্য।

 বারবার পরাক্রান্ত বিদেশীয় রাজগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া গৌড়-বঙ্গ-মগধের অধিবাসিগণ একজন রাজা নির্ব্বাচন করিয়াছিল। তিব্বতদেশীয় লামা তারানাথ তাঁহার বৌদ্ধধর্ম্মের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, তৎকালে উড়িষ্যায়, বঙ্গে এবং পূর্ব্বদেশের অন্য পাঁচটি প্রদেশে প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ এরং বৈশ্য নিজ নিজ অধিকারে রাজা হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু সমগ্র দেশে কোন রাজা ছিলেন না[]। দেশের যখন এইরূপ অবস্থা, তখন প্রজাপুঞ্জ প্রবলের অত্যাচারে পীড়িত হইয়া অরাজকতা দূর করিবার জন্য রাজনির্ব্বাচন করিয়াছিল। প্রজাবৃন্দ যাঁহাকে গৌড়-বঙ্গ-মগধের সিংহাসন স্বেচ্ছায় প্রদান করিয়াছিল, তাঁহার নাম গোপালদেব। তাঁহার পিতা যুদ্ধ-বিদ্যা-বিশারদ ছিলেন[], এবং তাঁহার পিতামহ দয়িতবিষ্ণু সর্ব্ববিদ্যাবিৎ ছিলেন[]। দয়িতবিষ্ণুর পিতৃ-পিতামহের কোন সন্ধান অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। পালরাজবংশের যতগুলি শিলালিপি বা তাম্রশাসন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে মাত্র খালিমপুরে আবিষ্কৃত ধর্ম্মপালদেবের তাম্রশাসনে বপ্যট ও দয়িতবিষ্ণুর উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। দয়িতবিষ্ণুর বংশপরিচয় অদ্যাবধি কোন তাম্রশাসনে বা শিলালিপিতে আবিষ্কৃত হয় নাই। তাঁহার বংশধরগণ অন্যূন সার্দ্ধ চারি শত বৎসর গৌড়-মগধে রাজত্ব করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের বহু তাম্রশাসন ও শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে; কিন্তু পাল-রাজবংশের কোন খোদিত-লিপিতেই তাঁহাদিগের বংশ-পরিচয় প্রদত্ত হয় নাই। সন্ধ্যাকরনন্দী-বিরচিত “রামচরিতে” এবং ঘনরামের “ধর্ম্মমঙ্গলে” পালরাজগণের বংশ-পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত কুমারপালের সেনাপতি কামরূপরাজ বৈদ্যদেবের কমৌলী তাম্রশাসনে পালরাজগণের বংশ-পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। “রামচরিত” খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে লিখিত হইয়াছিল এবং বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনও ঐ সময়ে অথবা দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে প্রদত্ত হইয়াছিল। ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গল ইহার বহু পরে রচিত হইয়াছিল। গোপালদেবের পুত্র ধর্ম্মপালদেবের রাজত্বকালে হরিভদ্র ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার’ টীকায় বলিয়া গিয়াছেন যে, ধর্ম্মপাল “রাজভটাদিবংশপতিত[]।” হরিভদ্র ধর্ম্মপালদেবের সমসাময়িক ব্যক্তি; সুতরাং তাঁহার উক্তি সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিত, ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গল ও বৈদ্যদেবের কমৌলী তাম্রশাসনাপেক্ষা অধিকতর প্রামাণিক হওয়া উচিত। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসুর মতানুসারে ধর্ম্মপাল বঙ্গের খড়্গবংশীয় রাজা দেবখড়্গের পুত্র রাজরাজভট্টের বংশজাত। বসুজ মহাশয় বলিয়াছেন,—“এই কয়টি প্রমাণ দ্বারা আমরা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি যে, গোপাল ও ধর্ম্মপাল প্রথমতঃ গৌড়বাসী ছিলেন না, মূলতঃ বঙ্গবাসী ছিলেন এবং বঙ্গের রাজভটের বংশে উদ্ভূত হইয়াছিলেন[]।” চীনদেশীয় পরিব্রাজক সেঙ্গ-চি ৬৫০ হইতে ৬৫৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে রাজভটকে সমতট বা বঙ্গের সিংহাসনে দেখিয়াছিলেন। চীন-পরিব্রাজক ই-চিং ৬৭৩ খৃষ্টাব্দে তাম্রলিপ্তি নগরে আগমন করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, তৎপূর্ব্বে সেঙ্গ-চি নামক তাঁহার একজন স্বদেশবাসী জলপথে সমতটে আগমন করিয়াছিলেন[]। বসুজ মহাশয় স্থির করিয়াছেন যে, খড়্গবংশীয় দেবখড়্গের পুত্র রাজরাজভট্ট এবং চীন-পরিব্রাজক-বর্ণিত সমতটরাজ রাজভট একই ব্যক্তি। এই প্রসঙ্গে বসুজ মহাশয় বলিয়াছেন, “কেহ কেহ এই রাজভটের পিতার তাম্রশাসনলিপির আলোচনা করিয়া তাঁহাকে খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর লোক বলিতে চান। কিন্তু অক্ষর দেখিয়া ইহার কাল-নির্ণয় সমীচীন হয় নাই[]।” দেবখড়্গের কাল-নির্ণয়-প্রসঙ্গে যথাস্থানে অক্ষর-তত্ত্বের প্রমাণের মূল্য আলোচিত হইবে। এইস্থানে এইমাত্র বলা যাইতে পারে যে, অক্ষর-তত্ত্বের প্রমাণানুসারে দেবখড়্গ ধর্ম্মপালদেবের পূর্ব্ববর্ত্তী নহেন, সুতরাং দেবখড়্গের পুত্র রাজভট বা রাজরাজভট্ট কখনই ধর্ম্মপালদেবের পিতা গোপালদেবের পূর্ব্বপুরুষ হইতে পারেন না। দেবখড়্গের পুত্র রাজরাজভট্ট কখনই খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর ব্যক্তি হইতে পারেন না, সুতরাং সেঙ্গ-চি-বর্ণিত রাজভট স্বতন্ত্র ব্যক্তি। হরিভদ্রের অষ্টসাহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতার টীকার ‘রাজভটাদিবংশপতিত’ শব্দের যে ‘রাজভটের বংশপ্রসূত’ অর্থ হইবে, ইহার কিছু নিশ্চয়তা নাই। ‘রাজভট-বংশপতিত’ শব্দে রাজভৃত্যবংশোদ্ভব বুঝাইলেও বুঝাইতে পারে। গোপালদেব যদি সমতট বা বঙ্গের বিখ্যাত রাজবংশপ্রসূত হইতেন, তাহা হইলে তাঁহার পুত্রের এবং বংশধরগণের প্রশস্তি-রচয়িতৃগণ উচ্চকণ্ঠে বহু শব্দাড়ম্বরের সহিত পালবংশের পূর্ব্ব-গৌরব কীর্ত্তন করিতেন। ভারতের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নহে। বাতাপীপুরের চালুক্যবংশের সাম্রাজ্য ৬৫৩ খৃষ্টাব্দে রাষ্ট্রকূটরাজ দন্তিদুর্গ কর্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল[]। দন্তিদুর্গ হইতে দ্বিতীয় কর্কের রাজ্যকাল পর্য্যন্ত চালুক্যরাজগণ সামান্য সামন্তে পরিণত হইয়াছিলেন, কিন্তু কল্যাণের চালুক্যবংশীয় দ্বিতীয় তৈল পিতৃরাজ্যোদ্ধার করিয়াছিলেন[]। কৌঠেম গ্রামে আবিষ্কৃত তাঁহার বংশধর পঞ্চম বিক্রমাদিত্য ত্রিভুবনমল্লের তাম্রশাসনে প্রাচীন চালুক্য-বংশের সুদীর্ঘ পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে[১০]। ধর্ম্মপাল, দেবপাল প্রভৃতি পালবংশীয় সম্রাট্‌গণের তাম্রশাসনসমূহে দেবখড়্গাদির উল্লেখের অভাব দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, খড়্গবংশের সহিত পালবংশের কোনই সম্পর্ক ছিল না। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু বলেন যে, “শ্রিয় ইব সুভগায়াঃ সম্ভবো বারিরাশিঃ”[১১] এবং “শ্লাঘা পতিব্রতাসৌ মুক্তারত্নং সমুদ্রসূক্তিরিব”[১২] প্রভৃতি শ্লোকে পালবংশের সিন্ধু হইতে উৎপত্তির ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে। পালরাজ-বংশের তাম্রশাসনসমূহ শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় কর্ত্তৃক বঙ্গভাষায় অনূদিত হইয়াছে; মৈত্রেয় মহাশয়-কৃত পূর্ব্বোক্ত শ্লোকদ্বয়ের অনুবাদে পালবংশের সমুদ্র হইতে উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন কথাই নাই। প্রথম শ্লোকাংশটি খালিমপুরে আবিষ্কৃত ধর্ম্মপালদেবের তাম্রশাসনের দ্বিতীয় শ্লোকের অংশ। ইহার বঙ্গানুবাদে দেখিতে পাওয়া যায় যে, চন্দ্র ও লক্ষ্মীর উৎপত্তিস্থান সমুদ্রের সহিত পাল-বংশের বীজি পুরুষ দয়িতবিষ্ণুর তুলনা করা হইয়াছে।[১৩] দ্বিতীয় শ্লোকাংশটি মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত দেবপালদেবের তাম্রশাসনের একাদশ শ্লোক। মৈত্রেয় মহাশয়ের অনুবাদে দেখিতে পাওয়া যায় যে, দেবপালদেবের মাতা রণ্ণা দেবীর সহিত মুক্তাপ্রসবকারী সমুদ্র-জাত সূক্তির তুলনা করা হইয়াছে[১৪]; সুতরাং এইস্থানে অর্থাৎ গোপাল ও ধর্ম্মপালের ঘটনার পরে পালবংশের উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন কথাই থাকিতে পারে না।

 সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিতে সিন্ধু বা সমুদ্র হইতে ধর্ম্মপালের উৎপত্তির উল্লেখ আছে। রামচরিতের শ্লোকগুলি দ্ব্যর্থবাচক, এইজন্য রামচরিতের যে অংশের টীকা আছে, তাহাতে রামপক্ষে এবং অপর পক্ষে উভয় প্রকারের ব্যাখ্যাই প্রদত্ত হইয়াছে,—

শ্রিয়মুন্মুদ্রিতলক্ষ্মীযুগলং কমলানামিনঃ স বস্তনুতাং।
কৃত্বালোকাহরণং মহাক্ষয়ে যং বিধুর্বিশতি॥
—রাম-চরিত, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৩য় শ্লোক।

টীকাকার সমুদ্র পক্ষে ইহার নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন;—

 “সমুদ্রপক্ষে। কমলানামিনঃ পতিঃ সমুদ্রঃ শ্রিয়ং বঃ তনুতাং ইত এব লক্ষ্মীপ্রাদুর্ভাবাৎ উন্মুদ্রিতলক্ষ্মীকঃ। মহাক্ষয়ে মহাপ্রলয়ে লোকাহরণং কৃত্বা লোকান্ কুক্ষৌ নিক্ষিপ্য যং সমুদ্রং বিধু র্বাসুদেবো বিশতি[১৫]॥৩॥”

 ইহার পরের শ্লোকে দেখিতে পাওয়া যায় যে, সেই সমুদ্রের বংশে রাজা ধর্ম্মপাল জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন;—

“তৎকুলদীপো নৃপতিরভূ [ৎ] ধর্ম্মো ধামবানিবেক্ষ্বাকুঃ।
যস্যাব্ধিং তীর্ণাগ্রাবনৌ ররাজাপি কীর্ত্তিরবদাতা॥
—রামচরিত, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৪র্থ শ্লোক।

 অন্যত্র সমুদ্রকুলদীপো ধর্ম্মঃ ধর্ম্মনামা ধর্ম্মপাল ইতি যাবৎ। নৃপতিরভূৎ। একদেশেন সমুদায়ঃ, যথা ভীমো ভীমসেন ইতি। ধামবান্ তেজস্বী ইব যথা ইক্ষ্বাকুঃ কটুতুম্বী উৎপ্লবতে, তথা যস্য গ্রাবনৌঃ শিলানৌকা, অব্ধিং তীর্ণা সমুদ্রপ্রাসাদাদন্তরীক্ষমিব তীর্ণবতী ররাজ, অপি শব্দাৎ কীর্ত্তিরপি সমুদ্রং তীর্ণা ররাজ॥৪।”

 ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গলে সমুদ্র হইতে পালরাজবংশের উৎপত্তির কিঞ্চিৎ আভাষ দেখিতে পাওয়া যায়। ধর্ম্মপালদেবের পুত্র দেবপালদেবের মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, ধর্ম্মপালের পত্নীর নাম রণ্ণাদেবী[১৬]; কিন্তু ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গলানুসারে তাঁহার পত্নীর নাম বল্লভা[১৭]। ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গলানুসারে ধর্ম্মপাল অপুত্রক। নির্ব্বাসিতা বল্লভার গর্ভে সমুদ্রের ঔরসে এক পুত্র উৎপন্ন হইয়াছিল, ঘনরাম গ্রন্থমধ্যে তাঁহার নাম উল্লেখ করেন নাই[১৮]। ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গলের এই কাহিনী সম্পূর্ণ সত্য নহে, কারণ পালরাজগণের তাম্রশাসন-সমূহে দেখিতে পাওয়া যায় যে, দেবপাল ধর্ম্মপালের পুত্র। এতদ্ব্যতীত ত্রিভুবনপাল নামক ধর্ম্মপালের আর এক পুত্র ছিল[১৯]

 ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গলে সমুদ্রের ঔরসে ধর্ম্মপালের পত্নী বল্লভাদেবীর গর্ভে অজ্ঞাতনামা পুত্রের উৎপত্তি কাহিনী দেখিয়া বোধ হয় যে, ঘনরাম কর্ত্তৃক ধর্ম্মমঙ্গল-রচনাকালে সমুদ্রকুলে পালরাজগণের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিকৃত জনশ্রুতি বা প্রবাদ প্রচলিত ছিল। সন্ধ্যাকরনন্দী-বিরচিত রামচরিতে সমুদ্রকুলে ধর্ম্মপালের উৎপত্তির কথা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত না থাকিলে কেবল ঘনরামের উপরে বিশ্বাস করিয়া পালবংশের উৎপত্তি-বর্ণনা বিজ্ঞান-সম্মত হইত না; কিন্তু খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে রচিত গ্রন্থে এবং অন্যূন সপ্তশত বর্ষের পুরাতন পুথিতে যখন এই কথার উল্লেখ পাওয়া যায়, তখন সমুদ্রকুলে পালরাজগণের উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহই থাকিতে পারে না। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, রামপালদেবের পুত্র কুমারপালদেবের মন্ত্রী ও সেনাপতি কামরূপরাজ বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে সূর্য্যবংশে পালরাজগণের উৎপত্তি-কথা দেখিতে পাওয়া যায়[২০]বৈদ্যদেবের প্রশস্তিকার বোধ হয় পালরাজগণের পূর্ব্বপরিচয় সম্যক্‌রূপে অবগত ছিলেন না, এবং হয়ত পালরাজগণের সমুদ্রকুলে উৎপত্তির কথা কখনও তাঁহার শ্রুতিগোচর হয় নাই। সন্ধ্যাকরনন্দী গৌড়বাসী এবং পালরাজগণের বেতনভোগী কর্ম্মচারীর পুত্র, সুতরাং পালরাজবংশের প্রকৃত পরিচয় তাঁহারই জানা সম্ভব। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে পালরাজগণের সূর্য্যবংশে উৎপত্তির বিবরণ নিঃসন্দেহ বৈদ্যদেবের প্রশস্তিরচয়িতা মনোরথের অজ্ঞতার ফল। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন ও সন্ধ্যাকরনন্দীর “রামচরিত” প্রায় তুল্য কালের রচনা। সমসাময়িক রচনায় এইরূপ মতদ্বৈধ নিশ্চয়ই একজন রচয়িতার অজ্ঞতা অথবা ভ্রমের ফল। এইস্থানে সন্ধ্যাকরনন্দীর সহিত মনোরথের তুলনা করিয়া সন্ধ্যাকরনন্দীকে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া স্বীকার করিতে হয়, কারণ তিনি পৌণ্ড্রবর্দ্ধনপুরের অধিবাসী ছিলেন এবং তাঁহার পিতৃপুরুষগণ পালসাম্রাজ্যে উচ্চ রাজপদের অধিকারী ছিলেন। আকবরের সুহৃদ ইতিহাসবেত্তা আবুল-ফজলের উক্তির উপরে সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করিয়া কেহ কেহ গৌড়-বঙ্গ-মগধের পালরাজগণকে কায়স্থ অনুমান করিয়া বিষম ভ্রমে পতিত হইয়াছেন[২১]। আবুল-ফজলের উক্তি, বিশেষতঃ প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে, অতি সাবধানে গ্রহণ করা উচিত। তিনি আকবরের সমসাময়িক ব্যক্তি, কিন্তু তৎসত্ত্বেও আকবরের সম্বন্ধে তাঁহার সমস্ত উক্তিগুলি প্রকৃত ইতিহাসরূপে পরিগণিত হইবার যোগ্য নহে। তিনি পালবংশীয় দশজন রাজার নাম করিয়াছেন, কিন্তু তন্মধ্যে দেবপাল ও রাজ্যপাল ব্যতীত অপর কাহারও নাম পালরাজগণের খোদিতলিপিমালায় দেখিতে পাওয়া যায় না[২২]

 দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র, রণনীতিকুশল বপ্যটের পুত্র গোপাল, প্রজাবৃন্দ-কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিত হইয়া গৌড়-মগধের সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। ইনি ইতিহাসে প্রথম গোপালদেব নামে বিখ্যাত। গোপালদেবের পুত্র ধর্ম্মপালদেবের খালিমপুরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, “মাৎস্যন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে, প্রকৃতিপুঞ্জ যাঁহাকে রাজলক্ষ্মীর করগ্রহণ করাইয়াছিল, পূর্ণিমা রজনীর জ্যোৎস্নারাশির অতিমাত্র ধবলতাই যাঁহার স্থায়ী যশোরাশির অনুকরণ করিতে পারিত, নরপাল-কুলচূড়ামণি গোপাল নামক সেই প্রসিদ্ধ রাজা বপ্যট হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন[২৩]।” ‘মাৎস্যন্যায়’ বলিতে অরাজকতা বুঝায়। মৌর্য্যবংশীয় প্রথম সম্রাট্ চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্য তাঁহার “অর্থশাস্ত্র” নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে মাৎস্যন্যায়ের নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন:—

 “অপ্রণীতো হি মাৎস্যন্যায়মুদ্ভাবয়তি বলীয়ানবলং হি গ্রসতে দণ্ডধরাভাবে, তেন গুপ্তঃ প্রভবতীতি[২৪]।”

 “যখন দণ্ড (রাজশক্তি) অপ্রণীত থাকে তখন মাৎস্যন্যায়ের প্রভাব হয়, উপযুক্ত দণ্ডধরের অভাবে প্রবল দুর্ব্বলকে গ্রাস করিয়া থাকে। সেই কারণেই গুপ্তগণের প্রভাবের উৎপত্তি হইয়াছে।” গুপ্ত শব্দের অর্থ লইয়া মতভেদ আছে; কেহ বলেন গুপ্ত অর্থে প্রচ্ছন্ন, কাহারও মতে ইহার অর্থ রক্ষিত অর্থাৎ সহায়-সম্পন্ন, কেহ কেহ বলেন গুপ্ত শব্দে চন্দ্রগুপ্তের নাম করা হইয়াছে। অর্থশাস্ত্রের প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিয়াছেন, “মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং” শব্দের অর্থ ‘অন্যরাজ্যভুক্ত হইবার আশঙ্কা দূর করিবার জন্য, অথবা মৎস্যের ন্যায় (অপর মৎস্যের) উদরগ্রস্ত হইবার ভয় দূর করিবার জন্য[২৫]।” পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল অনুমান করেন যে, মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে ‘মাৎস্যন্যায়ের’ প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে[২৬]। উদাসীন রঘুনাথ বর্ম্মা-বিরচিত “লৌকিক ন্যায় সংগ্রহ” নামক গ্রন্থে ‘মাৎস্যন্যায়ের পূর্ব্ববৎ ব্যাখ্যাই প্রদত্ত হইয়াছে[২৭]। স্বর্গগত অধ্যাপক বোঠলিঙ্ক, ‘মাৎস্যন্যায়’ সম্বন্ধে তাঁহার “ভারতবর্ষীয় ভাষা” নামক গ্রন্থে একটি শ্লোক উল্লেখ করিয়াছিলেন[২৮]

 মগধের গুপ্তরাজবংশীয় সম্রাট্ দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের মৃত্যুর পরে, গৌড়-মগধ-বঙ্গে যে ‘মাৎস্যন্যায়’ বা অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। কান্যকুব্জরাজ যশোবর্ম্মা, কামরূপপতি হর্ষদেব, গুর্জ্জরেশ্বর বৎসরাজ ও রাষ্ট্রকূট-বংশীয় সম্রাট্ ধ্রুবধারাবর্ষ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া গৌড়ীয় প্রজাবৃন্দ অবশেষে একজন রাজা নির্ব্বাচন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। বৌদ্ধধর্ম্মের ইতিহাসকার লামা তারানাথ গোপালদেবের রাজ্যলাভের অব্যবহিত পূর্ব্বে গৌড়বঙ্গের অবস্থা সম্বন্ধে একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন; “প্রতিদিন এক একজন রাজা নির্ব্বাচিত হইতেন, কিন্তু ভূতপূর্ব্ব রাজার পত্নী রাত্রিতে তাঁহাদিগকে সংহার করিতেন। কিছুদিন পরে গোপালদেব রাজপদ লাভ করিয়া, রাজ্ঞীর হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিয়া, আমরণ সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন[২৯]।” তারানাথের ইতিহাস বিশ্বাসযোগ্য নহে, কিন্তু ধর্ম্মপালদেবের তাম্রশাসনে যখন গোপালদেবের নির্ব্বাচনের কথা আছে, তখন তাঁহার উক্তির এই অংশমাত্র গ্রহণ করা যাইতে পারে যে, গোপালদেবের পূর্ব্বে ভূতপূর্ব্ব রাজপত্নীর অত্যাচারে দেশে অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল। তারানাথ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, গোপালদেব প্রথমে বঙ্গদেশের রাজ্য এবং পরে মগধরাজ্য লাভ করিয়াছিলেন। সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিতে এবং বৈদ্যদেবের কমৌলী তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, রামপাল ভীমনামক কৈবর্ত্তরাজকে পরাজিত ও নিহত করিয়া পিতৃভূমি বরেন্দ্রী উদ্ধার করিয়াছিলেন। সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিতে দুইস্থানে রামপালের পিতৃভূমির কথা আছে:—

১। মাংসভুজোচ্চৈর্দশকেন জনকভূর্দস্যুনোপধিব্রতিনা।
দিব্যাহ্বয়েন সীতা বাসালংকৃতির (রা)হারি কান্তাস্য॥[৩০]

২। ইতি কৃত্বাজ্ঞামাগত্য চিতাং(তাতা)ভূমিং স জানকীং নিজভর্ত্ত্রে।
অক্ষান্তকরঃ প্রথিতাভিজ্ঞোঽচকথন্মিথস্তথাভূতাং দশাং॥

প্রথম শ্লোকে রামপালপক্ষে টীকায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই পিতৃভূমি বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্রভূমি[৩১]। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনেও কথিত হইয়াছে যে, “রামচন্দ্র যেমন অর্ণব লঙ্ঘন করিয়া, রাবণ বধান্তে জনকনন্দিনী লাভ করিয়াছিলেন; রামপালদেবও [যথাবৎ] সেইরূপ যুদ্ধার্ণব সমুত্তীর্ণ হইয়া, ভীম নামক ক্ষৌণীনায়কের বধসাধন করিয়া, জনকভূমি [বরেন্দ্রী] লাভে, ত্রিজগতে [শ্রীরামচন্দ্রের ন্যায়] আত্মযশঃ বিস্তৃত করিয়াছিলেন”[৩২]। শ্লোকদ্বয় ও রামচরিতের টীকার উপরে নির্ভর করিয়া গোপালদেবের পূর্ব্বনিবাস সম্বন্ধে তারানাথের উক্তি গ্রহণ করা যাইতে পারে।

 গোপালদেব সিংহাসনে আরোহণ করিয়া সর্ব্বপ্রথমে বোধ হয় আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। বারংবার বিদেশীয় রাজগণকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া গৌড়-মগধ-বঙ্গ নিশ্চয়ই অত্যন্ত হীনবল হইয়া পড়িয়াছিল। কিছুদিন প্রজাবৃন্দকে অরাজকতা ও বিদেশীয় আক্রমণ হইতে রক্ষা করাই বোধ হয় প্রথমে গোপালদেবের রাজ্যকালের প্রধান কর্ত্তব্য হইয়াছিল। গোপালদেবের রাজ্যকালের কোন ঘটনার বিবরণই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই; এখনও পর্য্যন্ত তাঁহার কোন শিলালিপি, তাম্রশাসন অথবা প্রাচীন মুদ্রা ভারতবর্ষের কোন স্থানেই আবিষ্কৃত হয় নাই। তাঁহার পৌত্র দেবপালদেবের মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “তাঁহার অসংখ্য সেনাদল যুদ্ধার্থ প্রচলিত হইলে, সেনাপদাঘাতোত্থিত ধূলিপটলে পরিব্যাপ্ত হইয়া, গগনমণ্ডল দীর্ঘকালের জন্য বিহঙ্গমগণের বিচরণোপযোগী পদপ্রচারক্ষম অবস্থা প্রাপ্ত হইত বলিয়া প্রতিভাত হইত। তিনি সমুদ্র পর্য্যন্ত ধরণীমণ্ডল জয় করিবার পর, আর যুদ্ধোদ্যমের প্রয়োজন নাই বলিয়া, মদমত্ত রণকুঞ্জরগণকে বন্ধন হইতে মুক্তিদান করিলে, তাহারা স্বাধীনভাবে বনগমন করিয়া আনন্দাশ্রুপূর্ণলোচনে বন্ধুগণকে পুনরায় দর্শন করিয়াছিল[৩৩]।” ‘সমুদ্র পর্য্যন্ত জয়ের’ অর্থ বোধ হয় যে, তিনি দক্ষিণ রাঢ় এবং ‘ব’দ্বীপের শেষ সীমা পর্য্যন্ত স্বীয় অধিকার বিস্তার করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপালদেবের খালিমপুরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, গোপালদেবের পত্নীর নাম “দেদ্দদেবী”[৩৪]। স্বর্গীয় অধ্যাপক কিলহর্ণের মতানুসারে ‘দেদ্দদেবী’ ভদ্র নামক রাজার কন্যা; কিন্তু শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বলিয়াছেন, “অধ্যাপক কিলহর্ণ ‘দেদ্দদেবীকে’ ভদ্র নামক এক রাজার কন্যা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন, তিনি তাহার কোনরূপ প্রমাণের উল্লেখ করেন নাই। এক্ষণে কোন ঐতিহাসিক তথ্য প্রকটিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না, এখানে কেবল পৌরাণিক আখ্যায়িকাই সূচিত হইয়াছে[৩৫]।” গোপালদেবের বৃদ্ধ-প্রপৌত্র নারায়ণপালদেবের এবং তাঁহার বংশধরগণের তাম্রশাসনে গোপালদেবের নিম্নলিখিত পরিচয় পাওয়া যায়;—“যিনি কারুণ্যরত্নপ্রমুদিতহৃদয়ে মৈত্রীকে প্রিয়তমারূপে ধারণ করিয়াছিলেন, যিনি তত্ত্বজ্ঞান-তরঙ্গিণীর সুবিমল সলিলধারায় অজ্ঞান-পঙ্ক প্রক্ষালিত করিয়াছিলেন, যিনি কামক অরির পরাক্রমসঞ্জাত আক্রমণ পরাভূত করিয়া, শাশ্বতী শান্তিলাভ করিয়াছিলেন; সেই শ্রীমান্ দশবল লোকনাথের জয় হউক; এবং যিনি করুণারত্নোদ্ভাসিত বক্ষে প্রজাবর্গের মিত্রতা ধারণ করিয়া সম্যক্-সম্বোধ-প্রদায়িনী জ্ঞানতরঙ্গিণীর সুবিমল সলিলধারায় লোক-সমাজের অজ্ঞান-পঙ্ক প্রক্ষালিত করিয়া, দুর্ব্বলের প্রতি অত্যাচারপরায়ণ স্বেচ্ছাচারী কামকারিগণের আক্রমণ পরাভূত করিয়া রাজ্যমধ্যে চিরশান্তি সংস্থাপিত করিয়াছিলেন, সেই শ্রীমান্ গোপালদেব নামক অপর রাজাধিরাজ লোকনাথেরও জয় হউক[৩৬]।” গোপালদেবের একমাত্র পুত্রের নাম আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইনি ইতিহাস-বিশ্রুত ধর্ম্মপালদেব। গোপালদেবের মৃত্যুকাল অথবা রাজ্যকাল-নির্ণয়ের কোন উপায়ই অদ্যাবধি আবিষ্কার হয় নাই। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ৺ভিন্সেণ্ট স্মিথ অনুমান করেন যে, গোপালদেব ৭৩০ হইতে ৭৪০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন এবং ৮০০ খৃষ্টাব্দে তাঁহার দেহাবসান হইয়াছিল[৩৭]। রে সময়ে গোড়মগধবাসী রাষ্ট্রকূট, গুর্জ্জর প্রভৃতি পরাক্রান্ত রাজগণের আক্রমণে দীর্ণ, সে সময়ে গোপালদেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। গোপালদেব পালবংশের প্রথম রাজা। গুর্জ্জরেশ্বর দ্বিতীয় নাগভট ও রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব ধারাবর্ষের ভীষণ আক্রমণ সহ্য করিতে হইলে নব-প্রতিষ্ঠিত পালবংশের অধিকার বোধ হয় গোপালদেবের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হইত। তাহা হইলে গোপালদেবের পুত্র ধর্ম্মপাল কখনই সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত জয় করিয়া চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রদান করিতে পারিতেন না। শত্রুদীর্ণ নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের অধীশ্বরগণ কখনই এক পুরুষের মধ্যে মহারাজ রাজচক্রবর্ত্তী পদলাভ করিতে পারিতেন না। এই কারণে অনুমান হয় যে, বিদেশীয় রাজগণের আক্রমণ শেষ হইলে গোপালদেব গৌড়-মগধ-বঙ্গের সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন[৩৮]; গুর্জ্জররাজ বৎসরাজ ৭৮৩ খৃষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন বটে, কিন্তু তখন বোধ হয় তিনি ধ্রুব ধারাবর্ষ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া মরুভূমিতে আশ্রয়গ্রহণ করিয়াছেন। অনুমান হয়, গোপালদেব ৭৮৫—৭৯০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে রাজা নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন। তারানাথ বলিয়াছেন যে, গোপালদেব পঁয়তাল্লিশ বৎসরকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন[৩৯] এবং ভিন্সেণ্ট স্মিথ এই উক্তি সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন[৪০]। রণনীতিকুশল না হইলে অত্যাচার-পীড়িত গৌড়ীয় প্রজাবৃন্দ কখনই গোপালদেবকে নরপতি পদে বরণ করিত না। এই কারণে অনুমান হয় যে, গোপালদেব প্রৌঢ় বয়সে সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন এবং অতি অল্পকাল রাজ্য শাসন করিয়া পরলোকগমন করিয়াছিলেন। গোপালদেব ৭৯০—৭৯৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে দেহত্যাগ করিয়াছিলেন।

 গোপালদেবের মৃত্যুর পরে দেদ্দদেবীর গর্ভজাত তাঁহার পুত্র ধর্ম্মপালদেব গৌড়-বঙ্গের সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। পালরাজগণের মধ্যে ধর্ম্মপালের আবির্ভাবকালই সর্ব্বপ্রথমে নিণীত হইয়াছিল এবং ধর্ম্মপালদেবই উত্তরপথে পালবংশের অধিকারের প্রথম স্থাপয়িতা। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে এবং নবম শতাব্দীর প্রথমভাগে গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপালদেবই উত্তরাপথের ইতিহাসে প্রধান নায়ক। গোপালদেবের সময়ে গৌড়-মগধের প্রজাবৃন্দ বোধ হয় কিয়ৎকাল শান্তিভোগ করিয়াছিল; সেইজন্যই ধর্ম্মপাল রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পরে উত্তরাপথ-জয়ের আশা মনে স্থান দিতে পারিয়ছিলেন। ধর্ম্মপালের কাল-নির্ণয় সম্বন্ধে অতি অল্পদিন পূর্ব্বেও বহু ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত ছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্থাপয়িতা বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিৎ সার আলেকজাণ্ডার কনিংহাম স্থির করিয়াছিলেন যে, ধর্ম্মপাল ৮৩১ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন[৪১]। কাম্বে নগরে আবিষ্কৃত, রাষ্ট্রকূটবংশীয় তৃতীয় গোবিন্দের তাম্রশাসন প্রকাশকালে শ্রীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর স্থির করিয়াছিলেন যে, ধর্ম্মপালদেব খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন[৪২]। ধর্ম্মপালের কাল-নির্ণয় সম্বন্ধে রাজেন্দ্রলাল, কনিংহাম, হর্ণলি, ভাণ্ডারকর প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিতগণের মত এখন অসার প্রতিপন্ন হইয়াছে। কতকগুলি নূতন খোদিতলিপি আবিষ্কৃত হইয়া গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপালদেবের প্রকৃত কাল-নির্ণয় সম্ভব হইয়াছে। ১৯০৮ খৃষ্টাব্দে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট স্মিথ স্বীকার করিয়াছেন যে, ধর্ম্মপালদেব খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন[৪৩]। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন যে, ধর্ম্মপাল, গুর্জ্জর-প্রতীহাররাজ দ্বিতীয় নাগভট ও রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন[৪৪]

 স্বর্গীয় ডাক্তার কীলহর্ণ ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে, ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালদেবের তাম্রশাসনের একটি শ্লোক সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছিলেন। সেই শ্লোক হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ধর্ম্মপাল ইন্দ্ররাজ প্রভৃতি রাজগণকে জয় করিয়া কান্যকুব্জের রাজলক্ষ্মী লাভ করিয়াছিলেন এবং তাহা চক্রায়ুধকে প্রদান করিয়াছিলেন[৪৫]। তৎকালে ডাঃ কীলহর্ণ প্রশ্ন করিয়াছিলেন, “এই চক্রায়ুধ কে?”[৪৬] বহুকাল এই প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জৈন হরিবংশ পুরাণে একটি শ্লোকে ইন্দ্রায়ুধ নামক উত্তর দিকের অধিপতির নাম পাওয়া গিয়াছিল[৪৭]। পণ্ডিতগণ অনুমান করিতেন যে, ভাগলপুর তাম্রশাসনের ‘ইন্দ্ররাজ’ ও ‘ইন্দ্রায়ুধ’ একই ব্যক্তি। অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে একখানি শিলালিপি ও একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়া ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধের সম্বন্ধ এবং কালনির্ণয়ের পথ প্রশস্ত করিয়াছে। ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দের নবেম্বর মাসে গোয়ালিয়র নগরের প্রান্তে সাগরতাল নামক স্থানে কতকগুলি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ-খননকালে একখানি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হীরানন্দ শাস্ত্রী প্রত্নতত্ত্ব-বিভাগের সর্ব্বাধ্যক্ষ কর্ত্তৃক গোয়ালিয়র নগরের চিত্রশালায় রক্ষিত কতকগুলি শিলালিপি পরীক্ষা করিতে প্রেরিত হইয়াছিলেন। সেই সময়ে তিনি গোয়ালিয়রের চিত্রশালায় এই শিলালিপি দেখিতে পাইয়াছিলেন। এই শিলালিপির একখানি প্রতিলিপি ডাঃ হর্ণলি ডাঃ কীলহর্ণকে প্রদান করিয়াছিলেন। ডাঃ হর্ণলি প্রদত্ত অস্পষ্ট প্রতিলিপি হইতে, ডাঃ কীলহর্ণ গোয়ালিয়র শিলালিপির আংশিক পাঠোদ্ধার করিয়া, প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, ইহাতে গুর্জ্জরপ্রতীহার বংশীয় বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট কর্ত্তৃক চক্রায়ুধ নামক এক রাজা পরাজিত হইয়াছিলেন[৪৮]। এই সময়ে পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হীরানন্দ শাস্ত্রী এই শিলালিপির সম্পূর্ণ উদ্ধৃত পাঠ ও প্রতিলিপি প্রকাশ করিয়াছিলেন। সাগরতালের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, প্রতীহার বংশে নাগভট নামক এক রাজা জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন; কক্কুক এরং দেবরাজ নামক তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রদ্বয় তাঁহার পরে সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। দেবরাজের পুত্র বৎসরাজ প্রতীহার-রাজ্যের অধিকার লাভ করিয়া ভণ্ডির বংশের সাম্রাজ্য লোপ করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় নাগভট অন্ধ্র, সিন্ধু, বিদর্ভ ও কলিঙ্গদেশের রাজগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন। অপরের আশ্রয়গ্রহণের জন্য যাঁহার নীচভাব প্রকাশ হইয়াছিল, দ্বিতীয় নাগভট সেই চক্রায়ুধকে এবং বহু হস্ত্যশ্বরথের অধিপতি বঙ্গপতিকেও পরাজিত করিয়াছিলেন। তিনি আনর্ত্ত, মালব, কিরাত, তুরুস্ক, বৎস এবং মংস্যদেশের রাজগণের গিরিদুর্গ-সমূহ অধিকার করিয়াছিলেন[৪৯]। গোয়ালিয়র শিলালিপির চক্রায়ুধ যে ভাগলপুর তাম্রশাসনের চক্রায়ুধ, সে বিষয়ে পণ্ডিতগণের কোন সন্দেহই রহিল না। ইতিমধ্যে আর একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় ভাগলপুর তাম্রশাসনের চক্রায়ুধ ও গোয়ালিয়র শিলালিপির চক্রায়ুধের একত্ব সম্বন্ধে বিশ্বাস অধিকতর দৃঢ় হইল। ১৯০৮ খৃষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর, বরদা রাজ্যের চিত্রশালায় রক্ষিত রাষ্ট্রকূটবংশীয় তৃতীয় ইন্দ্রের দুইখানি তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধারকালে প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অধ্যাপক ৺শ্রীধর রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের নিকটে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র, প্রথম অমোঘবর্ষের একখানি অপ্রকাশিত তাম্রশাসন রক্ষিত আছে। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তৃতীয় গোবিন্দ যখন দিগ্বিজয় উপলক্ষে হিমালয় পর্ব্বতে গমন করিয়াছিলেন, তখন ধর্ম্ম ও চক্রায়ুধ নামক রাজদ্বয় তাঁহার নিকটে গিয়াছিলেন[৫০]। অধ্যাপক ৺শ্রীধর রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর এই তাম্রশাসনের কিয়দংশের পাঠোদ্ধার করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তৃতীয় গোবিন্দ নাগভট নামক একজন রাজাকে পরাজিত করিয়াছিলেন এবং ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধ স্বয়ং আসিয়া তাঁহার নিকটে নতশির হইয়াছিলেন[৫১]। ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসন, সাগরতলের শিলালিপি ও প্রথম অমোঘবর্ষের তাম্রশাসন হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপাল, কান্যকুব্জপতি চক্রায়ুধ, গুর্জ্জর-প্রতীহার বংশের দ্বিতীয় নাগভট ও দাক্ষিণাত্যরাজ তৃতীয় গোবিন্দ সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। দ্বিতীয় নাগভটের একখানি শিলালিপি যোধপুর-রাজ্যের ‘বিলাডা’ জিলায় ‘বুচকলা’ গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ৮৭২ বিক্রমাব্দের চৈত্র মাসের শুক্লাপঞ্চমীতে মহারাজাধিরাজ পরম ভট্টারক পরমেশ্বর শ্রীনাগভটদেবের রাজ্যে ‘রাজ্যঘঙ্গক’ গ্রামে রাজ্ঞী জয়াবলী কর্ত্তৃক একটি দেবগৃহ নির্ম্মিত হইয়াছিল[৫২]। এই নাগভট যে দ্বিতীয় নাগভট সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নাই, কারণ বুচকলা লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে, নাগভট মহারাজাধিরাজ বৎসরাজদেবের উত্তরাধিকারী[৫৩]। রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দ ধ্রুব ধারাবর্ষের পুত্র। তিনি ৭১৬ শকাব্দের (৭৯৪ খৃষ্টাব্দের) পূর্ব্বে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, কারণ উক্ত বর্ষে তিনি দাক্ষিণাত্যস্থিত প্রতিষ্ঠান নগরী হইতে গোদাবরী নদীতে স্নান করিয়া বৈশাখ মাসের অমাবস্যা তিথিতে সূর্য্যগ্রহণোপলক্ষে কয়েকজন ব্রাহ্মণকে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[৫৪]। ইহার দশ বৎসর পরে গোবিন্দ কাঞ্চীরাজ পল্লব-বংশীয় দন্তিগকে পরাজিত করিয়া রাজস্ব সংগ্রহের জন্য তুঙ্গভদ্রাতীরে রামেশ্বরতীর্থে গমন করিয়াছিলেন এবং সেই সময় শিবধারী নামক একজন “গোরব” বা পুরোহিতকে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[৫৫]। ৭৩০ শকাব্দে (৮০৮ খৃষ্টাব্দে) গোবিন্দ নাসিক প্রদেশের একখানি গ্রাম বৈশাখ মাসে চন্দ্রগ্রহণোপলক্ষে এক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসন হইতে জানিতে পারা যায় যে, গঙ্গবংশীয় কোন রাজা তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন। কারামুক্ত হইয়া তিনি পুনরায় বিদ্রোহী হইয়াছিলেন এবং গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। মালবরাজ গোবিন্দের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি বিন্ধ্যপর্ব্বতে কটকনিবেশ করিয়াছেন শুনিয়া মারশর্ব্ব নামক জনৈক রাজা তাঁহার শরণাগত হইয়াছিলেন। ইহার পরে গোবিন্দ তুঙ্গভদ্রাতীরে গমন করিয়া পল্লবগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৫৬]। উক্ত বৎসরে শ্রাবণ মাসে অমাবস্যায় সূর্য্যগ্রহণোপলক্ষে গোবিন্দ ময়ূরখণ্ডী নামক স্থান হইতে জনৈক ব্রাহ্মণকে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, গুর্জ্জররাজ, গোবিন্দকে ধনুর্ব্বাণ-হস্তে অগ্রসর হইতে দেখিয়া, ভয়ে রণস্থল পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছিলেন এবং বেঙ্গীরাজ দূতমুখে গোবিন্দের তুঙ্গভদ্রাতীরে আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া তাঁহার জন্য উচ্চ বাহ্যালী-পরিবেষ্টিত শিবির রচনা করিয়াছিলেন[৫৭]। ৭৩৫ শকাব্দে তৃতীয় গোবিন্দের সামন্ত গঙ্গবংশীয় চাকিরাজ, অর্ককীর্ত্তি নামক জনৈক জৈনমুনিকে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[৫৮]। উক্ত বর্ষের পৌষ মাসের শুক্লা সপ্তমী পর্য্যন্ত তৃতীয় গোবিন্দ জীবিত ছিলেন, কারণ পূর্ব্বোক্ত দিবসে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র সৌরাষ্ট্রের সামন্ত গোবিন্দরাজের সেনানায়ক, মহাসামন্ত বুদ্ধবরস একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন।

 ৭৩৬ শকাব্দে তৃতীয় গোবিন্দের দেহান্ত হইয়াছিল; কারণ, ৭৩৬ শকাব্দ (৮১৫ খৃষ্টাব্দ) তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষের রাজ্যের প্রথম বৎসর। বোম্বাই প্রদেশে ধারবাড জেলায় সিরুর গ্রামে আবিষ্কৃত একখানি শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ৭৮৮ শকাব্দ অমোঘবর্ষের রাজ্যের দ্বিপঞ্চাশত্তম বর্ষ গণিত হইত[৫৯]। সুতরাং ইহা প্রমাণ হইতেছে যে, ৭৯৪ হইতে ৮১৪ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত তৃতীয় গোবিন্দ জীবিত ছিলেন। অতএব ধর্ম্মপাল খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষপাদে জীবিত ছিলেন এবং ৮১৪ খৃষ্টাব্দের বহু পূর্ব্বে ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করিয়া চক্রায়ুধকে মহোদয় বা কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রদান করিয়াছিলেন এবং গুর্জ্জরবংশীয় দ্বিতীয় নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া দিগ্বিজয়ী তৃতীয় গোবিন্দের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহা সত্ত্বেও কেহ কেহ অনুমান করিয়া থাকেন যে, ধর্ম্মপাল ৮১৫ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ বলিয়াছেন,—“অনেকে মনে করেন যে, ৮১৭ খৃষ্টাব্দের ২৩ বৎসর পূর্ব্বে, তৃতীয় গোবিন্দ পরলোকগমন করিয়াছিলেন এবং অমোঘবর্ষ পিতৃরাজ্য লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু যাঁহার রাজত্ব সুদীর্ঘ ৬১ বৎসরকাল স্থায়ী হওয়ার বিশিষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান আছে, তাঁহার রাজ্যাভিষেক-কাল আরও পিছাইয়া ধরিয়া, ৬১ বৎসরেরও অধিক কালব্যাপী রাজত্ব কল্পনা অসঙ্গত”[৬০]। যিনি বলিয়াছেন যে, প্রথম অমোঘবর্ষ ৮১৭ হইতে ৮৭৭ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন, তিনি প্রত্নবিদ্যাবিদ্‌গণের শ্রেষ্ঠ; তাঁহার নাম ডাঃ ফ্রাঞ্জ কীলহর্ণ (Dr. Franz Kielhorn)। তিনি কখনও উপযুক্ত বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ না পাইলে কোন কথা লিপিবদ্ধ করিতেন না। সিরুর ও নীলগুণ্ড[৬১] এই দুইটি স্থানের দুইখানি শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ৭৮৭ শকাব্দে (৮৬৬ খৃঃ অঃ) প্রথম অমোঘবর্ষের ৫২ রাজ্যাঙ্ক পতিত হইয়াছিল। অতএব ইহা নিশ্চয় যে, ৭৩৬ শকাব্দে (৮১৪-১৫ খৃঃ অঃ) প্রথম অমোঘবর্ষ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ডাঃ কীলহর্ণ শকাব্দের অতীতবর্ষ ও প্রচলিত বর্ষ গণনা করিয়া স্থির করিয়াছিলেন যে, ৮১৭ খৃষ্টাব্দের পরে প্রথম অমোঘবর্ষের প্রথম রাজ্যাঙ্ক পতিত হইতে পারে না; কিন্তু তাহার পূর্ব্বে দুই বৎসরের মধ্যে অর্থাৎ ৮১৫ অথবা ৮১৬ খৃষ্টাব্দে পতিত হইতে পারে[৬২]। সুতরাং তাঁহার অনুমান বা তারিখ-নির্দ্ধারণ অসঙ্গত বলা ন্যায়সঙ্গত কার্য্য হয় নাই। তোরখেডে গ্রামে আবিষ্কৃত তৃতীয় গোবিন্দের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তিনি ৮১৩ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জীবিত ছিলেন[৬৩]। সিরুর ও নীলগুণ্ডের শিলালিপিদ্বয় হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষ ৮১৫ হইতে ৮১৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন; ইহা সত্ত্বেও শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করিয়াছেন যে, ধর্ম্মপালদেব ৮১৫ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন[৬৪]। সুতরাং গৌড়রাজমালায় ধর্ম্মপালদেবের সিংহাসনারোহণকাল সম্বন্ধে যাহা উক্ত হইয়াছে, তাহা বিশ্বাসযোগ্য নহে।

 তৃতীয় গোবিন্দের তাম্রশাসনসমূহ পরীক্ষা করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ৭৩০ শকাব্দের শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার পূর্ব্বে তৎকর্ত্তৃক গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশীয় দ্বিতীয় নাগভট পরাজিত হইয়াছিলেন। রাধনপুরে আবিষ্কৃত তৃতীয় গোবিন্দের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ৭৩০ শকাব্দের শ্রাবণের অমাবস্যার (২৭শে জুলাই, ৮০৮ খৃষ্টাব্দ) পূর্ব্বে তৎকর্ত্তৃক গুর্জ্জর-বংশীয় কোন রাজা পরাজিত হইয়াছিলেন[৬৫]। অধ্যাপক ৺শ্রীধর রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের নিকটে প্রথম অমোঘবর্ষের যে অপ্রকাশিত তাম্রশাসনখানি ছিল, তাহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত গুর্জ্জর-রাজের নাম ‘নাগভট’[৬৬]। অতএব ইহা স্থির যে, গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশীয় দ্বিতীয় নাগভট ৮০৮ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে কোন সময়ে তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। প্রথম অমোঘবর্ষের এই অপ্রকাশিত তাম্রশাসন হইতে আরও অবগত হওয়া যায় যে, তৃতীয় গোবিন্দ যখন দিগ্বিজয় উপলক্ষে হিমালয় গমন করিয়াছিলেন, তখন ধর্ম্ম ও চক্রায়ুধ নামক নরপতিদ্বয় স্বেচ্ছায় তাঁহার নিকট আসিয়া নতশীর্ষ হইয়াছিলেন[৬৭]। ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ধর্ম্মপালদেব ইন্দ্রায়ুধ নামক কোন রাজার নিকট হইতে কান্যকুব্জ গ্রহণ করিয়া, চক্রায়ুধ নামক অপর একজন রাজাকে প্রদান করিয়াছিলেন[৬৮]। অতএব প্রথম অমোঘবর্ষের অপ্রকাশিত তাম্রশাসনের ধর্ম্ম ও চক্রায়ুধ, গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপালদেব ও কান্যকুব্জরাজ চক্রায়ুদ্ধ অভিন্ন। পূর্ব্বে লিখিত হইয়াছে অমোঘবর্ষের অপ্রকাশিত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তৎকর্ত্তৃক গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশীয় জনৈক রাজা পরাজিত হইয়াছিলেন এবং সেই রাজাই দ্বিতীয় নাগভট। সাগরতালে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় নাগভটের পুত্র প্রথম ভোজদেবের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, নাগভট ‘পরাশ্রয়কৃত স্ফুটনীচভাব’ চক্রায়ুধ নামক একজন রাজাকে পরাজিত করিয়াছিলেন এবং বঙ্গদেশের নরপতিকেও পরাস্ত করিয়াছিলেন[৬৯]। তৃতীয় গোবিন্দ যখন দিগ্বিজয় উপলক্ষে হিমালয়ে আসিয়াছিলেন, তখন ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধ কি কারণে স্বেচ্ছায় তাঁহার সমীপে গমন করিয়া নতশীর্ষ হইয়াছিলেন, তাহা বিবেচ্য। প্রথম অমোঘবর্ষের অপ্রকাশিত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া গিয়াছে যে, তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক দ্বিতীয় নাগভট পরাজিত হইলে, ধর্ম্ম ও চক্রায়ুধ গোবিন্দের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহা হইতেই স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে যে, দ্বিতীয় নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া, উপায়ান্তর না দেখিয়া, গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপাল ও কান্যকুব্জরাজ চক্রায়ুধ, গুর্জ্জর-বিজয়ী তৃতীয় গোবিন্দের শরণাগত হইয়াছিলেন। তৃতীয় গোবিন্দের পিতা ধ্রুব ধারাবর্ষ ইতিপূর্ব্বে দ্বিতীয় নাগভটের পিতা বৎসরাজকে পরাজিত করিয়া গৌড়রাষ্ট্র গুর্জ্জর-কবলমুক্ত করিয়াছিলেন এবং বৎসরাজকে মরুভূমিতে তাড়িত করিয়াছিলেন। অনুমান হয় যে, দ্বিতীয় নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধ দক্ষিণাপথেশ্বর তৃতীয় গোবিন্দের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদেরই আহ্বানে গোবিন্দ উত্তরাপথ আক্রমণ করিয়া নাগভটকে পরাজিত করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপাল ইন্দ্ররাজের নিকট হইতে বলপূর্ব্বক কান্যকুব্জ গ্রহণ করিয়া তাহা চক্রায়ুধকে প্রদান করিয়াছিলেন, এইজন্যই প্রথম ভোজদেবের সাগরতল শিলালিপিতে চক্রায়ুধকে ‘পরাশ্রয়কৃত-স্ফুটনীচভাব’ বিশেষণে অভিহিত করা হইয়াছে। সুতরাং নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইবার পূর্ব্বে, চক্রায়ুধ ধর্ম্মপালের সাহায্যে কান্যকুব্জ-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন এবং ইন্দ্রায়ুধের সিংহাসন চক্রায়ুধকে প্রদান করিবার পূর্ব্বে ধর্ম্মপাল গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ৮০৮ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে তৃতীয় গোবিন্দ, দ্বিতীয় নাগভটকে পরাজিত করিয়াছিলেন; তৎপূর্ব্বে দ্বিতীয় নাগভট চক্রায়ুধকে পরাজিত করিয়াছিলেন, তৎপূর্ব্বে ধর্ম্মপাল ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করিয়া চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রদান করিয়াছিলেন এবং তাহারও পূর্ব্বে ধর্ম্মপাল গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন; সুতরাং ৭৯০ হইতে ৭৯৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ধর্ম্মপালের অভিষেক-কালনির্ণয় অন্যায় হয় নাই। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ আর একটি উপায়ে ধর্ম্মপালদেবের অভিষেককাল নির্দ্ধারণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। দ্বিতীয় নাগভটের পৌত্র ভোজদেবের পুত্র মহেন্দ্রপাল বা মহেন্দ্রায়ুধের রাজ্যকালে বলবর্ম্মা এবং তাঁহার পুত্র অবনীবর্ম্মা, দুইখানি তাম্রশাসন দ্বারা দুইখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসনদ্বয় বোম্বাই প্রদেশের কাঠিয়াবাড়ের অন্তর্গত উনানগরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। প্রথম তাম্রশাসনখানি বলবর্ম্মার; ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বলবর্ম্মা ৫৭৪ বলভী-সম্বৎসরে অর্থাৎ গৌপ্তাব্দে (৮৯৩ খৃষ্টাব্দে) জীবিত ছিলেন। দ্বিতীয় তাম্রশাসনখানি বলবর্ম্মার পুত্র দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মা কর্ত্তৃক প্রদত্ত হইয়াছিল। ইহা ৯৫৬ বিক্রম-সম্বৎসরে (৮৯৯ খৃষ্টাব্দে) উৎকীর্ণ হইয়াছিল। এই তাম্রশাসনে বলবর্ম্মার পিতামহ বাহুকধবল সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে যে, তিনি ধর্ম্ম নামক জনৈক নরপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন[৭০], বহু রাজাধিরাজ পরমেশ্বরকে জয় করিয়াছিলেন এবং কর্ণাটদেশীয় সেনাসমূহ ছত্রভঙ্গ করিয়াছিলেন। ইহা হইতে স্বর্গীয় ডাক্তার কীলহর্ণ অনুমান করিয়াছিলেন যে, বলবর্ম্মা যখন ৮৯৩ খৃষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন, তখন তাঁহার পিতামহ বাহুকধবল নিশ্চয়ই খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে বিদ্যমান ছিলেন[৭১]। তখনও পাশ্চাত্য বিদ্বন্মণ্ডলীর নিকট ধর্ম্মপালের কাল-নির্ণয়ের সংবাদ প্রচারিত হয় নাই, সেই জন্যই স্বর্গগত ডাক্তার কীল্‌হর্ণ বলবর্ম্মার পিতামহ বাহুকধবলকে খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক বলিয়াছিলেন। ডাক্তার কীলহর্ণের উক্তি অবলম্বন করিয়া শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করিয়াছেন যে, ধর্ম্মপাল প্রথম ভোজদেব ও বাহুকধবলের সমসাময়িক ব্যক্তি[৭২]। বলবর্ম্মা মহেন্দ্রপালের রাজত্বের প্রারম্ভে জীবিত ছিলেন, কিন্তু মহেন্দ্রপালের রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পরে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল; কারণ, ৮৯৯ খৃষ্টাব্দে তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মা পিতৃসিংহাসনে আরূঢ় ছিলেন। সুতরাং বলবর্ম্মা মহেন্দ্রপালের রাজ্যাভিষেককালে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, ইহা অনুমান করা ন্যায়সঙ্গত। অতএব বলবর্ম্মাকে ভোজদেবের সমসাময়িক ব্যক্তি বলা উচিত এবং তদনুসারে বলবর্ম্মার পিতামহ বাহুকধবলকে প্রথম ভোজদেবের পিতামহ দ্বিতীয় নাগভটের সমসাময়িক ব্যক্তি বলা উচিত।

 সিংহাসনে আরোহণ করিয়া ধর্ম্মপালদেব সর্ব্বপ্রথমে কান্যকুব্জ আক্রমণ করিয়া উহা অধিকার করিয়াছিলেন এবং ইন্দ্ররাজ বা ইন্দ্রায়ুধের পরিবর্ত্তে চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রদান করিয়াছিলেন। তাঁহার খালিমপুরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “তিনি মনোহর ভ্রূভঙ্গি-বিকাশে (ইঙ্গিত মাত্রে) ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার এবং কীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের নরপালগণকে প্রণতি-পরায়ণ-চঞ্চলাবনত-মস্তকে সাধু সাধু বলিয়া কীর্ত্তন করাইতে করাইতে, হৃষ্টচিত্ত পাঞ্চালবৃদ্ধ কর্ত্তৃক মস্তকোপরি আত্মাভিষেকের স্বর্ণকলস উদ্ধৃত করাইয়া কান্যকুব্জকে রাজশ্রী প্রদান করিয়াছিলেন[৭৩]।” কান্যকুব্জ নগর পাঞ্চালদেশে অবস্থিত[৭৪]। পূর্ব্বোক্ত শ্লোক হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ভোজ, মৎস্য, কুরু, যদু, যবনাদি দেশসমূহের রাজগণ কান্যকুব্জরাজের অভিষেককালে বাধ্য হইয়া সাধুবাদ করিয়াছিলেন অর্থাৎ তাঁহারা ধর্ম্মপালদেব কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া ইন্দ্ররাজের পরিবর্ত্তে চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের অধিপতি বলিয়া স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ভোজদেশ ও মৎস্যদেশ বর্ত্তমান রাজপুতানার অংশবিশেষের নাম। কুরু ও যদু বর্ত্তমান পঞ্জাবের প্রাচীন নাম। গন্ধার ও যবন সিন্ধু নদের উভয় পারস্থিত প্রদেশদ্বয়ের নাম। কীর বর্ত্তমান কাঙ্গড়া বা জালামুখী প্রদেশের নাম[৭৫] এবং অবন্তি বা উজ্জয়িনী মালবদেশের রাজধানী। সুতরাং চক্রায়ুধকে ইন্দ্রায়ুধের সিংহাসনে স্থাপন করিবার জন্য ধর্ম্মপালদেবকে যে পঞ্চনদ, রাজপুতানা ও মালবের রাজগণকে পরাজিত করিতে হইয়াছিল, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পরে উত্তরাপথে গুর্জ্জরগণের যেরূপ বিস্তৃত প্রভাবের নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইতে অনুমান হয় যে, ধর্ম্মপাল কর্ত্তৃক পরাজিত কুরু, যদু, যবনাদি দেশের রাজগণ গুর্জ্জর-জাতীয় ছিলেন। এই সময়ে ভিল্লমালের অধিপতিগণ গুর্জ্জররাজচক্রের মণ্ডলেশ্বর ছিলেন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুর্জ্জর-রাজ্যের সহিত গৌড়েশ্বরের বিবাদ উপস্থিত হওয়ায় বোধ হয়, তিনি তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপাল গুর্জ্জররাজ দ্বিতীয় নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন[৭৬]। সাগরতালের শিলালিপিতে প্রথমে চক্রায়ুধের ও পরে বঙ্গেশ্বরের পরাজয়ের উল্লেখ আছে। অনুমান হয়, চক্রায়ুধ নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইলে ধর্ম্মপাল তাঁহার সাহায্যার্থ অগ্রসর হইয়াছিলেন, কিন্তু তিনিও পরাজিত হইয়াছিলেন। ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধ বোধ হয়, বারবার নাগভট কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া অবশেষে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্য ভিক্ষা করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নাগভটের পিতা বৎসরাজ যখন পঞ্চনদ হইতে গৌড় পর্য্যন্ত সমস্ত উত্তরাপথ অধিকার করিয়াছিলেন, তখন তৃতীয় গোবিন্দের পিতা ধ্রুব ধারাবর্ষই তাঁহাকে মরুভূমিতে তাড়িত করিয়া উত্তরাপথ-রাজগণের উদ্ধার সাধন করিয়াছিলেন। সেইজন্যই বোধ হয়, ধর্ম্মপাল ও চক্রায়ুধ গুর্জ্জরগণের বিরুদ্ধে ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় নাগভট তৃতীয় গোবিন্দের নিকট পরাজিত হইয়াছিলেন। গোবিন্দ যখন সমস্ত উত্তরাপথ বিজয় করিয়া হিমালয়-পর্ব্বতে উপস্থিত হইয়াছিলেন, তখন কৃতজ্ঞ গৌড়েশ্বর ও কান্যকুব্জরাজ নতশীর্ষে তাঁহার সমীপে আগমন করিয়াছিলেন। ইহার পরে বোধ হয়, কোন কারণে গোবিন্দের সহিত ধর্ম্মপালের বিবাদ হইয়াছিল। কারণ, গোবিন্দের পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষের সিরুর ও নীলগুণ্ডের শিললিপিদ্বয় হইতে অবগত হওয়া যায় যে, গোবিন্দ গৌড়গণকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৭৭]। নাগভট গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া তাঁহার পিতা বৎসরাজের ন্যায় মরুভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। গুর্জ্জরগণকে বারবার উত্তরাপথ-আক্রমণে উদ্যত দেখিয়া তৃতীয় গোবিন্দ তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র কক্ককে গুর্জ্জর-রাজ্যের রুদ্ধ দ্বারের অর্গলস্বরূপ গুজরাটের সামন্ত-পদে স্থাপন করিয়াছিলেন[৭৮]। তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া গুর্জ্জর-রাজগণ কিছুকাল শান্তভাবে জীবন-যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নাগভট আর কখনও উত্তরাপথে প্রবেশলাভ করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না এবং তাঁহার পুত্র রামভদ্র কখনও আর্য্যাবর্ত্ত-অধিকারের উদ্যম করেন নাই।

 তৃতীয় গোবিন্দ দক্ষিণাপথে প্রত্যাবর্ত্তন করিলে চক্রায়ুধ বোধ হয়, ধর্ম্মপালের সামন্তরূপে কান্যকুব্জ-রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন এবং ধর্ম্মপাল আজীবন সমগ্র উত্তরাপথের মণ্ডলেশ্বর-পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত দেবপালদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “দিগ্বিজয়প্রবৃত্ত সেই নরপতির (ধর্ম্মপালের) ভৃত্যবর্গ কেদারতীর্থে যথাবিধি জলক্রিয়া সম্পন্ন করিয়াছিলেন এবং গঙ্গাসাগরসঙ্গমে, তথা গোকর্ণ প্রভৃতি তীর্থেও ধর্ম্ম্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন[৭৯]। কেদার হিমালয়-পর্ব্বতমালার পশ্চিম ভাগে অবস্থিত এবং গোকর্ণ বোম্বাই প্রদেশে অবস্থিত[৮০]; সুতরাং এতদ্দ্বারা ধর্ম্মপালদেবের দিগ্বিজয়ের উত্তর ও দক্ষিণ সীমা নির্দ্দিষ্ট হইতে পারে। ধর্ম্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাক্‌পাল “জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার শাসনে অবস্থিত থাকিয়া, একচ্ছত্র শাসন-সংস্থিত দশদিক্ শত্রু-পতাকিনীশূন্য করিয়াছিলেন[৮১]।” ধর্ম্মপালদেব রাষ্ট্রকূটবংশীয় পরবলের কন্যা রণ্ণাদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন[৮২]। মধ্যভারতে পথারি নামক স্থানে পরবলের একখানি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, পরবলের পিতার নাম কক্করাজ এবং তাঁহার পিতামহের নাম জেজ্জ। জেজ্জের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সহস্র সহস্র কর্ণাট-সৈন্যকে পরাজিত করিয়া লাট বা গুজরাট দেশ অধিকার করিয়াছিলেন। কক্করাজ নাগাবলোক নামক জনৈক রাজাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। এই খোদিতলিপি পরবলের রাজ্যকালে, ৯১৭ বিক্রমাব্দে (৮৬১ খৃষ্টাব্দে) উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৮৩]। ধর্ম্মপাল খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর প্রথম ভাগে সিংহাসনে আসীন ছিলেন এবং পরবল নবম শতাব্দীর তৃতীয় পাদেও জীবিত ছিলেন। ইহা দেখিয়া শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করিয়াছেন যে, ধর্ম্মপাল “সম্ভবতঃ প্রৌঢ়াবস্থায় রণ্ণাদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন[৮৪]। ৮১৩ বিক্রমাব্দে (৭৫৬ খৃষ্টাব্দে) নাগাবলোক জীবিত ছিলেন। কারণ, উক্ত বর্ষে চাহমান-(চৌহান) বংশীয় জনৈক মহাসামন্তাধিপতি কর্ত্তৃক শ্রীনাগাবলোকের প্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যে সম্পাদিত একখানি তাম্রশাসন, আজমীর চিত্রশালার অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা কর্ত্তৃক কিয়ৎকাল পূর্ব্বে আবিষ্কৃত হইয়াছে[৮৫]। স্বর্গীয় ডাক্তার কীলহর্ণ অনুমান করেন যে, এই নাগাবলোকই পরবলের পিতা কক্করাজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। সুতরাং ইহা অবশ্য-স্বীকার্য্য যে, কক্করাজ খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষার্দ্ধে জীবিত ছিলেন। কক্করাজের পুত্র পরবল যখন নবম শতাব্দীর তৃতীয় পাদে জীবিত ছিলেন, তখন ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, কক্করাজ ও পরবল দীর্ঘায়ু পুরুষ ছিলেন। সুতরাং ধর্ম্মপালদেবের যৌবনে পরবল-দুহিত রণ্ণাদেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ হওয়াই অধিক সম্ভব। পরবল যখন অতিবৃদ্ধ এবং ধর্ম্মপালদেব যখন বহু পূর্ব্বে স্বর্গারোহণ করিয়াছেন, তখনই বোধ হয়, পথারির শিলাস্তম্ভলিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল। পরবল-দুহিতা রণ্ণাদেবীর সহিত ধর্ম্মপালদেবের বিবাহ-সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু এক অদ্ভুত মত প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, “রাষ্ট্রকূট-সম্রাট্ ৩য় গোবিন্দ অনুজ ইন্দ্ররাজকে লাটের আধিপত্য প্রদান করেন। কক্করাজ সেই ইন্দ্ররাজের পুত্র, সুতরাং রণ্ণাদেবী হইতেছেন রাষ্ট্রকূট-সম্রাট্ ৩য় গোবিন্দের ভ্রাতুষ্পুত্রের পৌত্রী, অর্থাৎ—রাষ্ট্রকূট-সম্রাটের ৪র্থ পুরুষ অধস্তন। এদিকে ধর্ম্মপাল ৩য় গোবিন্দের সমসাময়িক। এরূপ স্থলে তাঁহার সহিত কক্করাজের পৌত্রীর বিবাহ কখনই সম্ভবপর নহে। ডাক্তার ফ্লিট্ পরবল ৩য় গোবিন্দেরই একটি নামান্তর পাইয়াছেন। তাঁহার মতে এই তৃতীয় গোবিন্দই রণ্ণাদেবীর পিতা, সুতরাং ধর্ম্মপালের শ্বশুর[৮৬]।” এই মতই সমীচীন। তৃতীয় গোবিন্দ তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইন্দ্ররাজকে লাটের আধিপত্য প্রদান করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু পরবলের পিতা কক্করাজ গোবিন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র নহে। ইন্দ্ররাজের পুত্র কক্করাজ ও পরবলের পিতা কক্করাজকে অভিন্ন মনে করিয়া প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব বিষম ভ্রমে পতিত হইয়াছেন। প্রথমতঃ পথারি-শিলাস্তম্ভ-লিপি অনুসারে পরবলের পিতামহের নাম জেজ্জ; কিন্তু গোবিন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র কক্কের পিতার নাম ইন্দ্ররাজ; দ্বিতীয়তঃ ইন্দ্ররাজের পুত্র কক্ক ৭৩৪ হইতে ৭৪৩ শকাব্দ (৮১২-৮২১ খৃঃ অঃ) পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু পরবলের পিতা কক্করাজ নাগাবলোকের সমসাময়িক এবং নাগাবলোক খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে জীবিত ছিলেন। পরবল যদি ধ্রুব ধারাবর্ষের কনিষ্ঠ পুত্র ইন্দ্ররাজের বংশজাত হইতেন, তাহা হইলে তাঁহার পথারি-লিপিতে নিশ্চয়ই কৃষ্ণরাজ ধ্রুব প্রভৃতি রাষ্ট্রকূটবংশীয় সম্রাট্‌গণের গুণকীর্ত্তন দেখিতে পাওয়া যাইত। বসুজ মহাশয় বলিয়াছেন যে, “ডাক্তার ফ্লিট্ পরবল ৩য় গোবিন্দেরই একটি বিরুদ পাইয়াছেন।” অদ্যাবধি কোন স্থানে পরবল নামটি তৃতীয় গোবিন্দের বিরুদরূপে ব্যবহৃত হয় নাই। পথারি-শিলাস্তম্ভ-লিপির পাঠোদ্ধার হইবার পূর্ব্বে প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌গণ অনুমান করিতেন যে, “পরবল” রাষ্ট্রকূট-বংশীয় তৃতীয় গোবিন্দ অথবা প্রথম অমোঘবর্ষের নামান্তর মাত্র[৮৭]

 ধর্ম্মপালদেবের দুই পুত্রের নাম অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাঁহার ৩২শ রাজ্যাঙ্কে একখানি তাম্রশাসন সম্পাদিত হইয়াছিল, ইহা গৌড়ের নিকটে খালিমপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তাঁহার জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম ত্রিভুবনপাল[৮৮]। যুবরাজ ত্রিভুবনপালদেব ধর্ম্মপালের রাজ্যকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন। কারণ, কনিষ্ঠ দেবপালদেব পিতার মৃত্যুর পরে গৌড়-বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। এইজন্যই খালিমপুরের তাম্রশাসন ব্যতীত পাল-রাজবংশের অন্য কোন তাম্রশাসনে ত্রিভুবনপালের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ধর্ম্মপালদেবের ২৬শ রাজ্যাঙ্কে ভাস্কর উজ্জ্বলের পুত্র, কেশব নামক একব্যক্তি মহাবোধিতে তিন সহস্র (৩০০০) দ্রম্ম অর্থাৎ রৌপ্য মুদ্রা ব্যয় করিয়া একটি পুষ্করিণী খনন করাইয়াছিলেন এবং একটি চতুর্ম্মুখ মহাদেব প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[৮৯]। তাঁহার ৩২শ রাজ্যাঙ্কে ধর্ম্মপালদেব ব্যাঘ্রতটীমণ্ডলে, মহন্তাপ্রকাশবিষয়ে অবস্থিত ক্রৌঞ্চশ্বভ্র, মাঢাসাম্মলী ও পালিতক নামক গ্রাম্যত্রয় এবং আম্রষণ্ডিকামণ্ডলে স্থালীক্কটবিষয়ে গোপিপ্পলীগ্রাম মহাসামন্তাধিপতি নারায়ণবর্ম্মার প্রার্থনাক্রমে, নারায়ণবর্ম্মা কর্তৃক শুভস্থলীতে নির্ম্মিত মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ভগবান্ নন্ননারায়ণের এবং তাঁহার সেবক লাটদেশীয় ব্রাহ্মণগণের ব্যবহারার্থ দান করিয়াছিলেন। স্বয়ং যুবরাজ ত্রিভুবনপালদেব এই তাম্রশাসনের দূতক[৯০]। এই তাম্রশাসনখানি মালদহের ভূতপূর্ব্ব ম্যাজিষ্ট্রেট ৺উমেশচন্দ্র বটব্যাল ক্রয় করিয়া আনিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় বলিয়াছেন যে, ইহা কলিকাতায় এসিয়াটিক সোসাইটি কর্ত্তৃক রক্ষিত হইতেছে[৯১]। কিন্তু ইহা এসিয়াটিক্ সোসাইটিতে বা অপর কোন চিত্রশালায় রক্ষিত নাই। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছি যে, ইহা রাজশাহীতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান-সমিতির চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। খালিমপুরের তাম্রশাসন ধর্ম্মপালদেবের ৩২শ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত হইয়াছিল। তিব্বতদেশীয় ইতিহাসকার লামা তারানাথ বলেন যে, ধর্ম্মপাল চৌষট্টি (৬৪) বৎসর কাল রাজত্ব করিয়াছিলেন[৯২]। তারানাথ পালবংশের প্রথম নরপতিত্রয়েরই সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে পারেন নাই, সুতরাং তাঁহার জনশ্রুতি-অবলম্বনে লিখিত ইতিহাসের কথা, সমর্থক অপর প্রমাণ আবিষ্কার না হওয়া পর্য্যন্ত ঐতিহাসিক প্রমাণরূপে গৃহীত হইতে পারে না। অনুমান হয়, ধর্ম্মপালদেব পঞ্চত্রিংশদ্বর্ষকাল গৌড়ের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ধর্ম্মপালদেবের রাজ্যকালে স্বর্ণরেখ নামক জনৈক ব্রাহ্মণ গৌড়েশ্বরের নিকট হইতে বরেন্দ্রভূমির করঞ্জ নামক একখানি গ্রাম শাসনস্বরূপ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। স্বর্ণরেখের উত্তরপুরুষ চতুর্ভুজ হরিচরিত নামক একখানি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী হরিচরিত কাব্যের একখানি পুঁথি নেপালে নেপাল-রাজের গ্রন্থাগারে আবিষ্কার করিয়াছেন, এই গ্রন্থের পুষ্পিকায় স্বর্ণরেখের পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে[৯৩]




পরিশিষ্ট (চ)

রাষ্ট্রকূট-রাজবংশ:—

দন্তিবর্ম্মা
১ম ইন্দ্র
১ম কক্ক
২য় ইন্দ্রধ্রুবকৃষ্ণ
দন্তিদুর্গগোবিন্দ২য় গোবিন্দ ধ্রুব
বা ধারাবর্ষ
দন্তিবর্ম্মা২য় কক্ক
৩য় গোবিন্দ ইন্দ্র
(গুজরাটের সামন্ত-বংশের প্রতিষ্ঠাতা)
শর্ব্ব
(১ম অমোঘবর্ষ)
কক্কগোবিন্দ
২য় কৃষ্ণ(প্রভূতবর্ষ)
(অকালবর্ষ)দন্তিবর্ম্মাধ্রুব ধারাবর্ষ
জগত্তুঙ্গঅকালবর্ষঅকালবর্ষ
(শুভতুঙ্গ)
৩য় ইন্দ্র
(নিত্যবর্ষ)
বড্ডিগ
(৩য় অমোঘবর্ষ)
২য় ধ্রুব
২য় অমোঘবর্ষ৪র্থ গোবিন্দ
৩য় কৃষ্ণখোট্টিকনিরুপম
(অকালবর্ষ)
 কক্ক
 বা
 (৪র্থ অমোঘবর্ষ)
ভিল্লমাল ও কান্যকুব্জের গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশ:—
প্রতীহার
১ম নাগভট (?)
ককুস্থদেবশক্তি
বৎসরাজ
২য় নাগভট
রামভদ্র
১ম ভোজ
(মিহির, প্রভাস বা আদিবরাহ)
মহেন্দ্রপাল
 ২য় ভোজ মহীপাল
 দেবপাল
 বিজয়পাল
 রাজ্যপাল
 ত্রিলোচনপাল

গৌড়-বঙ্গের পাল-রাজবংশ:—

দয়িতবিষ্ণু
বপ্যট
(১) ১ম গোপালদেদ্দদেবী
(২) ধর্ম্মপালরণ্ণাদেবী বাকপাল
ত্রিভুবনপাল(৩) দেবপালজয়পাল
রাজ্যপাল(৪) ১ম শূরপাললজ্জাদেবী
বা
১ম বিগ্রহপাল
(৫) নারায়ণপাল
(৬) রাজ্যপালভাগ্যদেবী
(৭) ২য় গোপাল
(৮) ২য় বিগ্রহপাল
(৯) ১ম মহীপাল
(১০) নয়পালস্থিরপালবসন্তপাল
(১১) ৩য় বিগ্রহপালযৌবনশ্রী 
(১২) ২য় মহীপাল(১৩) ২য় শূরপাল(১৪) রামপাল
রাজ্যপাল(১৫) কুমারপাল(১৭) মদনপালচিত্রমতিকাদেবী
(১৬) ৩য় গোপাল
(১৮) গোবিন্দপাল

 বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত কতকগুলি কুলশাস্ত্র হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ধর্ম্মপাল ভট্টনারায়ণের পুত্র আদিগাঞি ওঝাকে গঙ্গাতীরে ধামসার নামক একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন।

রাজা শ্রীধর্ম্মপালঃ সুখমসরধুনীতীরদেশে বিধাতুং
নাম্নাদিগাঞিবিপ্রং গুণযুততনয়ং ভট্টনারায়ণস্য।
যজ্ঞান্তে দক্ষিণার্থং সকনকরজতৈর্ধামসারাভিধানং
গ্রামং তস্মৈ বিচিত্রং সুরপুরসদৃশং প্রাদদৎ পুণ্যকামঃ॥
—বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ১৫৬, পাদটীকা ৪১।



  1. In Odivisa, in Bengal and the other five provinces of the East, each Kshatriya, Brahman and merchant, constituted himself a king of his surroundings, but there was no king ruling the country.—Indian Antiquary, Vol. IV, pp. 365-6.
  2. আসীদাসাগরাদুর্ব্বীং গুর্ব্বীভিঃ কীর্ত্তিভিঃ কৃতী।
    মণ্ডয়ন্ খণ্ডিতারাতিঃ শ্লাঘ্যঃ শ্রীবপ্যটস্ততঃ॥
    —ধর্ম্মপালদেবের খালিমপুরের তাম্রশাসন; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১১-১২।

  3. শ্রিয়ঃ ইব সুভগায়াঃ সম্ভবো বারিরাশিশ্‌শশধর ইব ভাসো বিশ্বমাহ্লাদয়ন্ত্যাঃ।
    প্রকৃতিরবনিপানাং সন্ততেরুত্তমায়া অজনি দয়িতবিষ্ণুঃ সর্ব্ববিদ্যাবদাতঃ॥
     —ধর্ম্মপালদেবের খালিমপুরের তাম্রশাসন; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১১।

  4. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৪৭। হরিভদ্রের ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা-টীকায়’ ধর্ম্মপালদেব সম্বন্ধে ‘রাজভটবংশপতিত’ শব্দটি আছে, এই সংবাদ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নিকট পাইয়াছিলেন। নেপালে কাঠমণ্ডু নগরে ‘বীর লাইব্রেরী’ নামক গ্রন্থাগারে হরিভদ্র-বিরচিত ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা-টীকার’ একখানি প্রাচীন পুথি আছে, পুথিখানি তালপত্রে লিখিত এবং মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতানুসারে পুথিখানির বয়স সাত আট শত বৎসর হইবে। এই গ্রন্থের দ্বাত্রিংশ অধ্যায়ের শেষে নিম্নলিখিত শ্লোকটি লিখিত আছে;—

    রাজ্যে রাজভটাদিবংশপতিত শ্রীধর্ম্মপালস্য বৈ।
    তত্ত্বালোকবিধায়িনী বিরচিতা সৎপঞ্জিকেয়ং ময়া॥

    এই গ্রন্থের পুষ্পিকা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, টীকাটি হরিভদ্র-বিরচিত,—

     অভিসময়ালঙ্কারাবলোকেত্যষ্টসাহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতা ব্যাখ্যা সমাপ্তা। কৃতিরিয়ং আচার্য্যহরিভদ্রপাদানাং।

     মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অনুমান করেন যে, ‘রাজভটাদিবংশপতিত’ শব্দে রাজভট প্রভৃতির সহিত পালবংশের অতি দূর-সম্পর্ক সূচিত হয়। কিন্তু ইহার অর্থে গোপাল বা ধর্ম্মপালকে রাজভটের বংশধর বলা যাইতে পারে না। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রামচরিত সম্পাদনকালে বলিয়াছেন যে, পালরাজগণ সম্ভবতঃ রাজভটের কোন সেনাপতির বংশজাত; Dharmapala is described by Haribhadra as belonging to the family of a military officer of the same king.—Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. III, p. 6.

  5. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৪৭।
  6. Jyan Takakusuʼs I-tsing, শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু কর্ত্তৃক ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, রাজন্যকাণ্ড, ৭৬ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত; বসুজ মহাশয় পাদটীকায় পত্রাঙ্ক প্রদান করেন নাই।
  7. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৪৭, পাদটীকা ৭।
  8. Bhandarkar’s Early History of the Dekkan, p. 62.
  9. Ibid, p. 79.
  10. কৌঠেম গ্রামে আবিষ্কৃত চালুক্যরাজ পঞ্চম বিক্রমাদিত্য ত্রিভুবনমল্লের তাম্রশাসন।—Indian Antiquary, Vol. XVI, 21.
  11. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১১।
  12. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৭।
  13. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৮।
  14. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৪৩।
  15. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. III, p. 20.
  16. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৪৩।
  17. ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গল, পৃঃ ১৫০।
  18. ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গল, ‘কাঙুর যাত্রা পালা’—

    ধর্ম্মশীলা রাণী তার ভ(ব)ল্লভা সুন্দরী॥ধার্ম্মিক ধরণীতলে ধর্ম্মপাল রাজা।
    প্রিয়পুত্র প্রায় পালে পৃথিবীর প্রজা॥

    অপুত্রক মহারাজ অখিলে প্রকাশ।
    বিশেষ ব্রাহ্মণ বিষ্ণু বৈষ্ণবের দাস॥
    পূর্ব্বাপর পাটে রাজা ঐ গৌড় পুরী।
    ধর্ম্মশীলা রাণী তার ভ(ব)ল্লভা সুন্দরী॥
    বনবাসে তখন আছিল সেই সতী।
    তার সঙ্গে সমুদ্র সম্ভোগ কৈল রতি॥
    গৌড়পতি তোমার জনম নিলা হায়।

  19. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ২৬।
  20. এতস্য দক্ষিণদৃশো বংশে মিহিরস্য জাতবান্ পূর্ব্বং।
    বিগ্রহপালোনৃপতিঃ সর্ব্বাকারর্দ্ধি সংসিদ্ধঃ॥
    —বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসন, ২য় শ্লোক,—গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২৮।

  21. শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় তাঁহার “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস”, রাজন্যকাণ্ডে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন,—বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৫১।
  22. Col. H. S. Jarrett’s Translation of the Ain-i-Akbari, (Bibliotheca Indica), Vol. II, p. 145.
  23. মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং প্রকৃতিভির্লক্ষ্ম্যাঃ করং গ্রাহিতঃ
     শ্রীগোপাল ইতি ক্ষিতীশ-শিরসাং চূড়ামণিস্তৎসুতঃ।
    যস্যানুক্রিয়তে সনাতন-যশোরাশির্দিশামাশয়ে
     শ্বেতিম্না যদি পৌর্ণমাস-রজনী জ্যোৎস্নাতিভারশ্রিয়া॥৪॥
     —ধর্ম্মপালের খালিমপুরের তাম্রশাসন,—গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২।

  24. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র—১।৪, শ্যামশাস্ত্রীর সংস্করণ, পৃঃ ৯।
  25. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal. Vol. III, p. 3.

    শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শাস্ত্রী মহাশয়ের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে বিদ্রূপ করিয়া লিখিয়াছেন, ‘মাৎস্যন্যায়ের’ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া, “রামচরিতের” ভূমিকায় মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এম্-এ, লিখিয়াছেন—“to escape from being absorbed into anothor kingdom or to avoid being swallowed up like a fish.”—গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৯, পাদটীকা।

  26. যদি ন প্রণয়েদ্রাজা দণ্ডং দণ্ডেষ্বতন্দ্রিতঃ।
    শূলে মৎস্যানিবাপক্ষ্যন্ দুর্ব্বলান্ বলবত্তরাঃ॥
    —মনুসংহিতা, সপ্তম অধ্যায়, ২০ শ্লোক।

  27. “প্রবল-নির্বল-বিরোধে সবলেন নির্বল-বাধবিবক্ষায়াং তু মাৎস্যন্যায়াবতারঃ। অয়ং প্রায়ঃ ইতিহাস-পুরাণাদিষু দৃশ্যতে, যথাহি বাশিষ্ঠে প্রহ্লাদাখ্যানে তৎসমাধিং প্রস্তুত্যেবক্তম্—

    এতাবতাথ কালেন তদ্রসাতল-মণ্ডলং।
    বভূবারাজকং তীক্ষ্ণং মাৎস্যন্যায়-কদর্থিতম্॥

    যথা—প্রবলা মৎস্যা নির্ব্বলাং স্তান্নাশয়ন্তিস্মেতি ন্যায়ার্থঃ।”
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৯, পাদটীকা।
  28. “পরম্পরামিষতয়া জগতে ভিন্নবর্ত্তনঃ।
    দণ্ডাভাবে পরিধ্বংসী মাৎস্যো ন্যায়ঃ প্রবর্ত্ততে॥”
    —Bohtlingk’s Indische Spruche, second part.

  29. Indian Antiquary, Vol. IV, p. 366.
  30. রামচরিত, ১ম পরিচ্ছেদ, ৩৮ শ্লোক—Memoirs of the Asiatic society of Bengal, Vol. III, p. 31. দ্বিতীয় শ্লোকটি রামচরিতের প্রথম পরিচ্ছেদের পঞ্চাশত্তম শ্লোক।—Ibid, p. 34.
  31. Ibid.
  32. তস্যোর্জ্জস্বল-পৌরুষস্য নৃপতেঃ শ্রীরামপালোঽভবৎ পুত্রঃ পালকুলাব্ধি-শীতকিরণঃ সাম্রাজ্য-বিখ্যাতিভাক্।
    তেনে যেন জগত্ত্রয়ে জনকভূ-লাভাদ্ যথাবদ্যশঃ ক্ষৌণী-নায়ক-ভীম-রাবণ-বধাদ্যুদ্ধার্ণ্ণবোল্লংঘনাৎ॥
    —বৈদ্যদেবের কমৌলী তাম্রশাসন, ৪র্থ শ্লোক—গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১২৯, ১৩৮। 

  33. বিজিত্য যেনাজলধের্বসুন্ধরাং বিমোচিতামোঘ-পরিগ্রহা ইতি।
    সবাষ্পমুদ্বাষ্প-বিলোচনান্ পুনর্ব্বনেষু বন্ধূন্ দদৃ[শু]র্মতঙ্গজাঃ॥
    চলৎস্বনন্তেষু বলেষু যস্য বিশ্বম্ভরায়া নিচিতং রজোভিঃ।
    পাদপ্রচার-ক্ষমমন্তরীক্ষং বিহঙ্গমানাং সুচিরং বভূব॥
    —দেবপালদেবের মুঙ্গের তাম্রশাসন, ৩য় ও ৪র্থ শ্লোক; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৫-৩৬, ৪১-৪২। 

  34. শীতাংশোরিব রোহিণী হুতভুজঃ স্বাহেব তেজোনিধেঃ
    সর্ব্বাণীব শিবস্য গুহ্যকপতে র্ভদ্রেব ভদ্রাত্মজা।
    পৌলোমীব পুরন্দরস্য দয়িতা শ্রীদেদ্দদেবীত্যভূৎ
    দেবী তস্য বিনোদভূর্মুররিপোর্লক্ষ্মীরিব ক্ষ্মাপতেঃ॥
    —ধর্ম্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন, ৫ম শ্লোক; গৌড়লেখমালা, পৃ: ১২।

  35. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ২০, পাদটীকা।
  36. মৈত্রীং কারুণ্যরত্ন-প্রমুদিতহৃদয়ঃ প্রেয়সীং সন্দধানঃ
    সম্যক্-সম্বোধিবিদ্যাসরিদমলজলক্ষালিতাজ্ঞানপঙ্কঃ।
    জিত্বা যঃ কামকারি-প্রভবমভিভবং শাশ্বতীং প্রাপ শান্তিং
    স শ্রীমান্ লোকনাথো জয়তি দশবলোঽন্যশ্চ গোপালদেবঃ॥
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৬, ৯২, ১২৩, ১৪৮।

  37. V. A. Smith, Early History of India, 3rd edition, pp. 397-98.
  38. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 47.
  39. Indian Antiquary, Vol. IV. p. 366.
  40. V. A. Smith, Early History of India, 3rd. edition, p. 378. ভিন্সেণ্ট স্মিথ অনুমান করেন যে, গোপালদেবের নিকট হইতেই গুর্জ্জরেশ্বর বৎসরাজ গৌড়বঙ্গের শ্বেত রাজছত্রদ্বয় অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, ইহা সত্য হইলে ধর্ম্মপাল কখনই উত্তরাপথ বিজয় করিয়া চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রদান করিতে পারিতেন না।
  41. Sir Alexander Cunningham’s Archaeological Survey Report, Vol. XV, p. 150.
  42. Epigraphia Indica, Vol. VII, p. 33.
  43. Early History of India, 3rd edition, p. 398.
  44. Epigraphia Indica, Vol. IX. p. 26. Note 4.
  45. জিত্বেন্দ্ররাজ-প্রভৃতীনরাতীনুপার্জ্জিতা যেন মহোদয়-শ্রীঃ।
    দত্তা পুনঃ সা বলিনার্থয়িত্রে চক্রায়ুধায়ানতি বামনায়॥
    —ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসন, ৩য় শ্লোক, গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৭। 

     স্বর্গীয় রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই শ্লোকের চতুর্থপাদে বলিনার্থয়িত্রে স্থানে বলিনাথপিত্রে পাঠ করিয়াছিলেন। তদনুসারে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু অদ্যাবধি চক্রায়ুধকে ইন্দ্রায়ুধের পিতা বলিয়া লিপিবদ্ধ করিতেছেন। (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৫৩)।
  46. Indian Antiquary, Vol. XX, pp. 187-88.
  47. শাকেষ্বব্দশতেষু সপ্তসু দিশং পঞ্চোত্তরেষূত্তরাং
    পাতীন্দ্রায়ুধনাম্নি কৃষ্ণনৃপজে শ্রীবল্লভে দক্ষিণাং।
    পূর্ব্বাং শ্রীমদবন্তিভূভৃতি নৃপে বৎসাধিরাজেপরাং
    সৌর্যাণামধিমণ্ডলং জয়যুতে বীরে বরাহেবতি॥
    —Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 253. 

  48. Nachrichten von der Koniglichen Gesellschaft der Wissenschaften zu Gottingen, Philologische-historische Klasse, 1905, p. 301.
  49. Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1903-4, pp. 280-81.
  50. Epigraphia Indica, Vol. IX. p. 26, Note 4.
  51. Journal of the Bombay Branch of the Royal Asiatic Society, Vol. XXII, p. 118.
  52. Epigraphia Indica, Vol. IX, pp. 199-200.
  53. Ibid, p. 200.
  54. Ibid, Vol III, p. 105.
  55. Indian Antiquary, Vol. XI. p. 126.
  56. Ibid, pp. 861-62.
  57. Epigraphia Indica, Vol. VI, pp. 150-57.
  58. Ibid, Vol. IV. p. 333.
  59. Ibid, Vol. VII, pp. 104-5.
  60. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ২৩।
  61. Epigraphia Indica, Vol. IV, p. 210.
  62. Ibid, Vol. VIII. Appendix II., p. 3.
  63. Ibid, Vol. III., p. 54; Vol. VII. Appendix, p. 12, No. 67.
  64. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ২৪।
  65. সংধায়াশু শিলীমুখাং স্বসময়াং বাণাসনস্যোপরি
    প্রাপ্তং বর্দ্ধিতবংধুজীববিভবং পদ্মাভিবৃদ্ধ্যন্বিতং।
    সন্নক্ষত্রমুদীক্ষ্য যং শরদৃতুং পর্জ্জন্যবদ্‌গুর্জ্জরো
    নষ্টঃ ক্বাপি ভয়াত্তথা ন সময়ং স্বপ্নেপি পশ্যেদ্যথা॥১৫॥
    —Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 244.

  66. স নাগভটচন্দ্রগুপ্তনৃপয়োর্যশোর্যং (?) রণে
    স্বহার্য্যমপহার্য্য ধৈর্য্যবিকলানথোন্মূলয়ন্।
    যশোর্জ্জনপরো নৃপান্ স্বভুবি শালিসস্যানিব
    পুনঃ পুনরতিষ্ঠিপৎ স্বপদ এব চান্যানপি॥২২॥
     —Journal of the Bombay Branch of the Royal Asiatic Society, Vol. XXII, part LXI, p. 118.

  67. হিমবান্ কীর্ত্তিস্বরূপতামুপগতস্তৎ কীর্ত্তিনারায়ণঃ॥২৩॥হিমবৎপর্ব্বতনির্ঝরাম্বু-তুরগৈঃ পীতঞ্চ গাঢ়ঙ্গজৈ
    র্দ্ধনিতং মজ্জন্ তূর্যকৈর্দ্বিগুণিতং ভূয়োপি তৎকন্দরে।

    স্বয়মেবোপনতৌ চ যস্য মহতস্তৌ ধর্ম্মচক্রায়ুধৌ।
    হিমবান্ কীর্ত্তিস্বরূপতামুপগতস্তৎ কীর্ত্তিনারায়ণঃ॥২৩॥
    Ibid.

  68. জিত্বেন্দ্ররাজপ্রভৃতীনরাতীনুপার্জিতা যেন মহোদয়শ্রীঃ।
    দত্ত্বা পুনঃ সা বলিনার্থয়িত্রে চক্রায়ুধায়ানতি-বামনায়॥৩॥
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৭।

  69. ত্রয্যাস্পদস্য সুকৃতস্য সমৃদ্ধিমিচ্ছুর্যঃ ক্ষত্ত্রধাম-বিধিবদ্ধ-বলি-প্রবন্ধঃ।
    জিত্বা পরাশ্রয়কৃত-স্ফুটনীচভাবং চক্রায়ুধং বিনয়নম্র-বপুর্ব্ব্যরাজৎ॥৯॥
     Annual Report, Archaeological Survey, 1903-4, p. 281.

  70. অজনি ততোঽপি শ্রীমাং বাহুকধবলো মহানুভাবো যঃ।
    ধর্ম্মমবন্নপি নিত্যং রণোদ্যতো নিনশাদ্ ধর্ম্মং॥৯॥
    Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 7.

  71. Ibid, p. 3.
  72. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ২৭।
  73. ভোজৈর্ম্মৎস্যৈঃ সমদ্রৈঃ কুরু-যদু-যবনাবন্তি-গন্ধার-কীরৈ-
    র্ভূপৈর্ব্যালোলমৌলি-প্রণতি-পরিণতৈঃ সাধু-সঙ্গীর্য্যমাণঃ।
    হৃষ্যৎ-পঞ্চালবৃদ্ধোদ্ধৃত-কনকময়-স্বাভিষেকোদকুম্ভো
    দত্তঃ শ্রীকন্যকুব্জস্সললিত-চলিত-ভ্রূলতা-লক্ষ্ম যেন॥১২॥
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৪।

  74. Epigraphia Indica, Vol. IV. p. 246.
  75. Baijnath Inscription of Lakshmanachandra of Kiragrama, Epigraphia Indica, Vol. I, p. 104.
  76. দুর্ব্বারবৈরিবরবারণবাজিবারয়াণৌঘসংঘটনঘোরঘনান্ধকারং।
    নির্জ্জিত্য বঙ্গপতিমাবিরভূদ্বিবস্বানুদ্যন্নিব ত্রিজগদেকবিকাশকোষঃ॥১০
    —Annual Report, Archaeological Survey of India, 1903-4, p. 281. 

  77. কেরল-মালব-গৌড়ান্‌ সগুর্জ্জরাংশ্চিত্রকূটগিরিদুর্গস্থান্।
    বদ্ধা কাঞ্চীশানথ স কীর্ত্তিনারায়ণো জাতঃ॥
    —Epigraphia Indica, Vol. VI, pp. 102-3

  78. “গৌড়েন্দ্র-বঙ্গপতি-নির্জ্জয়-দুর্বিদগ্ধ-সদ্‌গুর্জ্জরেশ্বরদিগর্গলতাং চ যস্য।
    নীত্বা ভুজং বিহতমালবরক্ষণার্থং স্বামী তথান্যমপি রাজ্যফলানি ভুঙ্ক্তে॥”
    —Indian Antiquary, Vol. XII, p. 160, ll. 39-40.

  79. কেদারে বিধিনোপযুক্তপয়সাং গঙ্গাসমেতাম্বুধৌ
    গোকর্ণাদিষু চাপ্যনুষ্ঠিতবতাং তীর্থেষু ধর্ম্ম্যাঃ ক্রিয়াঃ।
    ভৃত্যানাং সুখমেব যস্য সকলানুদ্ধৃত্য দুষ্টানিমান্
    লোকান্ সাধয়তোনুষঙ্গজনিতা সিদ্ধিঃ পরত্রাপ্যভূৎ॥৭॥
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৬।

  80. Indian Antiquary, Vol. XXI, p. 25.
  81. রামস্যেব গৃহীত-সত্যতপসস্তস্যানুরূপো গুণৈঃ
    সৌমিত্রেরূদপাদি তুল্য-মহিমা বাক্‌পালনামানুজঃ।
    যঃ শ্রীমান্নয়-বিক্রমৈক-বসতির্ভ্রাতুঃ স্থিতঃ শাসনে
    শূন্যাঃ শত্রু-পতাকিনীভিরকরোদেকাতপত্রা দিশঃ॥৪॥
    —ভাগলপুরে আবিষ্কৃত নারায়ণপালের তাম্রশাসন; গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৫৭। 

  82. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩৬।
  83. Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 256.
  84. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ২৪।
  85. Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 241.
  86. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ১৫৫, পাদটীকা, ৩১।
  87. As the name Parabala could not be traced in any subsequent inscription, scholars conjectured that it was a biruda of one of the Rashtrakutas of Malkhed, perhaps of Govindaraja III. or Amoghavarsa I., according to the notions which they had formed regarding the time of Dharmap.
    —Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 251.
  88. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৬।
  89. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৩১-৩২।
  90. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৬।
  91. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১১।
  92. Pag-samjon Zang, p. 111.
  93. “গ্রামোত্তমোঽস্ত্যমলমঞ্জুগুণৈকপুঞ্জঃ শ্রীমান্ করঞ্জ ইতি বন্দ্যতমো বরেন্দ্র্যাম্।
    যত্র শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ-পদ-প্রবীণাঃ সচ্ছাস্ত্রকাব্যনিপুণা স্ম বসন্তি বিপ্রাঃ॥
    কীর্ণঃ প্রজাপতিগুণৈঃ পরিপূর্ণকামঃ শ্রীস্বর্ণরেখ ইতি বিপ্রবরোঽবতীর্ণঃ।
    তং গ্রামমগ্রগণনীয়গুণং সমগ্রং জগ্রাহ শাসনবরং নৃপধর্ম্মপালাৎ॥”
    —Catalogue of Palmleaf & selected paper MSS., Durbar Library Nepal by Mahamahopadhyaya Haraprasad Shastri, p. 134.