বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রত্নপ্রস্তর ও নব্য প্রস্তর যুগের অস্ত্র।
বাঙ্গালার ইতিহাস।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ।
যুগ বিভাগ—মানবের অস্তিত্বের সর্ব্বপ্রাচীন নিদর্শন—আদিম-মানব নিরামিষাশী—যুগবিপ্লব—আদিম মানবের স্বভাব পরিবর্ত্তন—মানবের প্রথম অস্ত্র—প্রস্তরের যুগ—প্রত্ন-প্রস্তরের যুগ—বাঙ্গালা দেশে আবিষ্কৃত নিদর্শন—বঙ্গবাসী ও মাদ্রাজবাসী আদিম মানব—নব্য-প্রস্তর যুগ—বাঙ্গালাদেশে আবিষ্কৃত নিদর্শন—ধাতু আবিষ্কার—তাম্রের যুগ—বাঙ্গালা দেশের তাম্র নির্ম্মিত অস্ত্র।
জগতে, সর্ব্বপ্রথমে, কোন্ যুগে কত কাল পূর্ব্বে, মানবের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা এখনও অজ্ঞাত রহিয়াছে। প্রাণিতত্ত্ববিদ্গণ স্থির করিয়াছেন যে, বর্ত্তমান সময়ের সকল জীবের পরে মানবের আবির্ভাব হইয়াছিল। ভূতত্ত্ববিদ্গণ বলিয়া থাকেন যে, নব্যজীবক যুগের শেষভাগে মানবের অস্তিত্বের চিহ্ন লক্ষিত হয়[১]। অন্ত্যাধুনিক উপযুগ হইতে ভূপৃষ্ঠে মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু ইহার পূর্ব্ববর্ত্তী দুইটি উপযুগে মানবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভূতত্ত্ববিদ্গণের মধ্যে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন যে, মধ্যাধুনিক ও বহ্বাধুনিক উপযুগে মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়; কিন্তু কেহ কেহ এই সকল নিদর্শনের সহিত মানবের সম্পর্ক স্বীকার করেন না[২]। কেহ কেহ বলেন যে, বহ্বাধুনিক উপযুগে মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন আবিষ্কৃত হইবে ইহা আশা করা যাইতে পারে, কিন্তু মধ্যাধুনিক যুগে মানবের অস্তিত্ব প্রমাণ করিবার কোন আশাই নাই। মাদ্রাজ প্রদেশে কর্ণুল নামক স্থানে একটি পর্ব্বতগুহায় জীবাশ্মের (Fossil) সহিত আদিম মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে। ভূতত্ত্ববিদ্গণ অনুমান করেন যে, এই সকল জীবাশ্ম বহ্বাধুনিকযুগের স্তন্যপায়ী জীবের অস্থি[৩]। ব্রহ্মদেশে বহ্বাধুনিকযুগের লুপ্ত স্তন্যপায়ী জীবের অস্থির সহিত আদিম মানব কর্ত্তৃক ব্যবহৃত প্রস্তরনির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে[৪]। অন্ত্যাধুনিক ও উপাধুনিক যুগে মানবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে মনীষিগণের মতদ্বৈধ নাই।
ভূতত্ত্ববিদ্ ও প্রাণিতত্ত্ববিদ্গণ স্থির করিয়াছেন যে, মানবজাতির শৈশবে আদিম মানবগণ উদ্ভিদ্ভোজী ছিলেন। মানবের জন্মের ইতিহাস এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন, সমগ্র মানবজাতির পূর্ব্বপুরুষগণ একই সময়ে একই স্থানে উৎপন্ন হইয়াছিলেন কি না তাহা বলিতে পারা যায় না, তবে ইহা স্থির যে, মানবজীবনের প্রারম্ভে আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ নিরামিষাশী ছিলেন। যুগপরিবর্ত্তনের ফলে, মানবের জন্মের বহুদিন পরে, গ্রীষ্মপ্রধান অথবা নাতিশীতোষ্ণদেশসমূহ ক্রমশঃ, অথবা সহসা, শীতপ্রধান হইয়াছিল। তাহার ফলে, আদিম মানবের লীলাক্ষেত্রসমূহে, জীবনধারণোপযোগী ফলমূলের অভাব হইয়াছিল। এই পরিবর্ত্তনের যুগে আদিম মানবকে বাধ্য হইয়া ফলমূলের পরিবর্ত্তে পশুমাংস-ভোজনে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছিল। জগতে মাংসাশী জীবসমূহের জন্মকাল হইতে যেরূপ তীক্ষ্ণনখদন্ত থাকে, কোন অবস্থাতেই মানবের তাহা ছিল না, এই কারণে আদিম মানবকে জীবনযাত্রানির্ব্বাহের জন্য পশুহত্যার উপযোগী আয়ুধ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছিল। আদিম মানব তখনও কৃত্রিম উপায়ে অগ্ন্যুৎপাদন করিতে শিক্ষা করে নাই, সুতরাং ধাতুর ব্যবহার অজ্ঞাত ছিল। এই যুগবিপ্লবের সময়ে, আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ যে আয়ুধ বা প্রহরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা তীক্ষ্ণধার প্রস্তরখণ্ড মাত্র।
মানবজাতির সর্ব্বপ্রাচীন অস্ত্র, ভূপৃষ্ঠে অন্বেষণলব্ধ, প্রস্তরখণ্ডের বর্ত্তমান নাম প্রাগায়ুধ (Eolith)[৫]। ইহাতে মানবের শিল্পের কোন নিদর্শন নাই, এই জন্য কোন কোন ভূতত্ত্ববিদ্ ইহা আদিম মানব কর্ত্তৃক ব্যবহৃত অস্ত্র নহে বলিয়া সন্দেহ করেন। আদিম মানবগণ প্রাগায়ুধ হস্তে ধারণ করিয়া মৃগয়ায় প্রবৃত্ত হইতেন এবং আমমাংস ভক্ষণ করিয়া জঠরজ্বালা নিবৃত্তি করিতেন। ক্রমশঃ জ্ঞানবৃদ্ধির সহিত ভল্ল বা বর্ষার ব্যবহার আরম্ভ হয়। যুগবিপ্লবের বহুকাল পরে, আদিম মানবগণ ভূপৃষ্ঠলব্ধ প্রস্তরখণ্ডের অগ্রভাগ, দ্বিতীয় প্রস্তরের আঘাতে তীক্ষ্ণতর করিয়া, তাহা দণ্ডের অগ্রভাগে, বনজাত লতায় বন্ধনপূর্ব্বক ভল্ল বা বর্ষার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কৃত্রিম উপায়ে অগ্ন্যুৎপাদন মানবজাতির দ্বিতীয় আবিষ্কার। নবাবিষ্কৃত অগ্নি ও ভল্লের সাহায্যে আদিম মানবগণ সেই প্রাচীনযুগের অতিকায় ভীষণ হিংস্ৰজন্তুসমূহের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, এবং ক্রমশঃ সমগ্র জীবজগতের উপরে স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। মানবজাতির শৈশবে, অগ্ন্যুৎপাদনের উপায় আবিষ্কৃত হইলেও, আদিম মানবসমাজে বহুকালযাবৎ ধাতুর ব্যবহার অজ্ঞাত ছিল। ধাতব অস্ত্রনির্ম্মাণপদ্ধতির আবিষ্কারকালপর্য্যন্ত, তীক্ষ্ণধার পাষাণখণ্ডই আদিম মানবের একমাত্র প্রহরণ ছিল। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ, ধাতবঅস্ত্রনির্ম্মাণকালপর্য্যন্ত সময়ের, প্রস্তরের যুগ (Stone Age) নাম দিয়াছেন। জগদ্বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ্ লবক্ (Sir John Lubbock, Lord Avebury) প্রস্তরের যুগকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়াছেন; প্রস্তরযুগের প্রথম ভাগের নাম প্রত্ন-প্রস্তরের যুগ (Palæolithic Age) ও দ্বিতীয় ভাগের নাম নব্য-প্রস্তরের যুগ (Neolithic Age)। আদিম মানবের যে সমস্ত প্রহরণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা সাধারণতঃ দুইভাগে বিভক্ত হইতে পারে; (ক) প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্র—ইহাতে মানবের শিল্পচাতুর্য্যের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না। ইহা দেখিয়া এইমাত্র বুঝিতে পারা যায় যে, ইহা ভূপৃষ্ঠে অন্বেষণলব্ধ প্রস্তরখণ্ড মাত্র নহে; (খ) নব্যপ্রস্তরযুগের অস্ত্র—নব্যপ্রস্তরের যুগে বর্ষাফলক, শরফলক, কুঠারফলক, ছুরিকা প্রভৃতি নানাবিধ সুদৃশ্য ও সযত্ননির্ম্মিত অস্ত্র দেখিতে পাওয়া যায়; এই যুগের অস্ত্র দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, আদিম মানব সেই সময়ে শিলাখণ্ড হইতে অস্ত্রনির্ম্মাণে অভ্যস্ত হইয়াছিল।
ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, মানবজাতির পরিবর্ত্তন আরব্ধ হইয়াছে; পৃথিবীর কোন্ ভাগে, কোন্ সময়ে, যুগবিপ্লবের ফলে, নিরামিষাশী আদিম মানবকে মাংসাশী হইতে হইয়াছিল, এবং তীক্ষ্ণনখদন্তের অভাবে, মৃগয়োপযোগী অস্ত্রান্বেষণে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছিল, তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই। বর্ত্তমান সময়ে এই মাত্র বলা যাইতে পারে যে, পৃথিবীর সর্ব্বত্র একই সময়ে যুগবিপ্লব হয় নাই। ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় মানব এখনও সমান অবস্থায় উন্নীত হইতে পারে নাই। অদ্যাপি জগতে এমন মনুষ্য আছে, যাহারা ধাতুর ব্যবহার জানে না। ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জ্ঞানের উন্নতির সহিত, মানবজাতির উন্নতি হইয়াছে, এবং প্রত্ন-প্রস্তরের যুগ আরম্ভ হইয়াছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, ইউরোপখণ্ডে এই যুগ খৃষ্টের জন্মের পঞ্চদশ লক্ষ বৎসর পূর্ব্বে আরম্ভ হইয়াছিল। ভূতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিত কগিন্ ব্রাউন অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষের প্রাচীন প্রস্তরের যুগ ইউরোপের প্রত্ন-প্রস্তরযুগের সমসাময়িক হইলেও হইতে পারে[৬]।
বাঙ্গালাদেশে প্রত্ন-প্রস্তরযুগে যে কয়টি শিলানির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার সকলগুলিই দেশের ভিন্ন ভিন্ন সীমান্তে পাওয়া গিয়াছে। বাঙ্গালা দেশ পলিমাটীর দেশ; ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইহা বয়সে নবীন। কিন্তু এই নবীন দেশের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণপূর্ব্ব সীমান্তে অতি প্রাচীন ভূমি আছে; এই সকল প্রদেশেই বাঙ্গালাদেশের প্রত্ন-প্রস্তরযুগের পাষাণনির্ম্মিত আয়ুধ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দক্ষিণ-পূর্ব্ব সীমান্তে, চট্টগ্রামের পার্ব্বত্য-প্রদেশে, যে সমস্ত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা আকারে প্রত্ন-প্রস্তরযুগের ন্যায় হইলেও, ভূতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিতগণের মতানুসারে অপেক্ষাকৃত আধুনিক। আর্য্যাবর্ত্তের উত্তরসীমান্তে হিমালয়ের পাদমূলে ও পার্ব্বত্য উপত্যকা সমূহে, আদিম মানবের বাসের কোন চিহ্নই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তস্থিত পার্ব্বত্যপ্রদেশে দুইটি মাত্র প্রত্ন-প্রস্তরযুগের শিলানির্ম্মিত আয়ুধ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত এই জাতীয় আর একটি অস্ত্র প্রায় পঞ্চাশৎ বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গদেশের সমতলক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে ভূতত্ত্ববিদ্ বল্ হুগলী-জেলার গোবিন্দপুর গ্রামের এগার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কুণ্কুণে গ্রামে একটি হরিতাভ প্রস্তরনির্ম্মিত কুঠারফলক (Boucher or celt) আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই সময়ে রাণীগঞ্জের নিকট বোখারোর কয়লার খনিতে এই জাতীয় আর একটি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৭]। ইহার দুই বৎসর পরে সীতারামপুরের নিকটবর্ত্তী ঝরিয়ার কয়লার খনিতে আর একটি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহাই এখন কলিকাতা মিউজিয়ামে দেখিতে পাওয়া যায়[৮]। পূর্ব্বোক্ত অস্ত্রদ্বয় বোধ হয় ইংলণ্ডে প্রেরিত হইয়াছে। প্রত্ন-প্রস্তরযুগের এই তিনটি প্রহরণ ব্যতীত উত্তরাপথের পূর্ব্বখণ্ডে আর চারিটি মাত্র শিলানির্ম্মিত প্রাচীন অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই চারিটি অস্ত্র উড়িষ্যা-প্রদেশের ঢেঁকানাল, আঙ্গুল, তালচের ও সম্বলপুরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। সুবিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিত ভিন্সেণ্ট্ বল্ মাদ্রাজে আবিষ্কৃত প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্রসমূহের সহিত বঙ্গদেশের ও উড়িষ্যার এই যুগের নিদর্শনসমূহের তুলনা করিয়া দেখাইয়াছেন যে, এই উভয় প্রদেশের প্রাচীন শিলানির্ম্মিত প্রহরণের মধ্যে বিশেষ সাদৃশ্য আছে। ইহা হইতে তিনি অনুমান করেন যে, দক্ষিণপথবাসী আদিম মানবগণের সহিত উত্তরাপথবাসী প্রাচীন মানবজাতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মাদ্রাজে ও বাঙ্গালায় আবিষ্কৃত প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্রসমূহের সাদৃশ্য কেবল আকারগত নহে, অনেক সময়ে উভয় দেশে আবিষ্কৃত অস্ত্রের পাষাণ একই জাতীয়। যে স্থানে এই জাতীয় প্রস্তর পাওয়া যায়, সে স্থান বাঙ্গালাদেশ হইতে শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থিত। ভিন্সেণ্ট্ বল্ অনুমান করেন যে আদিম মানবগণ প্রত্ন-প্রস্তরযুগে এই সকল প্রাচীন অস্ত্র দক্ষিণাপথ হইতে উত্তরাপথের পূর্ব্বখণ্ডে আনয়ন করিয়াছিলেন[৯]।
লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া পাষাণখণ্ড হইতে অস্ত্র নির্ম্মাণ করিয়া আদিম মানব, যে যুগে এই জাতীয় অস্ত্রনির্ম্মাণে পারদর্শী হইয়া উঠিল, সেই যুগের নাম নব্য-প্রস্তরযুগ। এই যুগে দূর হইতে অস্ত্র বর্ষণ করিবার উপায় আবিস্কার করিয়া মানবজাতি জীবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিলেন। ধনুর সাহায্যে গুটিকা বা শর নিক্ষেপের কৌশল আবিষ্কার করিয়া, আদিম মানবগণ অযথা বলক্ষয় বা শোণিতস্রাব না করিয়াও শত্রু নিপাত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। নূতন শক্তিলাভ করিয়া তাঁহারা প্রাচীন জগতের অতিকায় দুর্জ্জেয়, হিংস্র জীবসমূহের ধ্বংসসাধন করিয়া পৃথিবী মানবের বাসোপযোগী করিয়াছিলেন; বস্তুতঃ এই যুগ হইতেই মানবের সভ্যতা আরব্ধ হইয়াছে। নব্য-প্রস্তরযুগের আয়ুধসমূহ, প্রত্ন-প্রস্তরযুগের তুলনায় সংখ্যায় অধিক, কলানৈপুণ্যের পরিচায়ক এবং আকারে ও প্রকারে বহুবিধ। বঙ্গদেশের যে প্রদেশে প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, সেই প্রদেশেই নব্য-প্রস্তরযুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়াছে। সর্ব্বপ্রথমে সিংহভূম জেলায় চাইবাসা নগরে নব্য-প্রস্তরযুগের অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে কাপ্তেন বীচিং (Captain Beeching) সিংহভূম জেলায় চাইবাসা নগরে ও চক্রধরপুরের আট ক্রোশ দুরবর্ত্তী একটি নদীতীরে প্রস্তরনির্ম্মিত ছুরিকা আবিষ্কার করিয়াছিলেন[১০]। ভিন্সেণ্ট্ বল্ এই সমস্ত স্থান পরীক্ষা করিয়া স্থির করেন যে, আবিষ্কৃত পাষাণখণ্ডগুলি মানব কর্ত্তৃক নির্ম্মিত ও ব্যবহৃত অস্ত্র[১১]।
এই সময়ে বল্ ছোটনাগপুরের বুড়াডিহ গ্রামে একটি সুন্দর, সুগঠিত ছেদনাস্ত্র (celt) আবিষ্কার করিয়াছিলেন। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে, তিনি পার্শ্বনাথপর্ব্বতের পাদমূলে আর একখানি ছেদনাস্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন[১২]। ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে মানভূম জেলার বরাহভূম পরগণায়, ধাদ্কা কয়লার খনির নিকটে দেওঘা গ্রামে একখানি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১৩]। ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রামের নিকট সীতাকুণ্ডপর্ব্বতে অশ্মীভূত কাষ্ঠ (Petrified or fossilized wood) নির্ম্মিত একখানি কৃপাণ আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১৪]। ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে রাঁচি জেলায় শত শত প্রস্তরনির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই স্থানে অস্ত্র তীক্ষ্ণ করিবার প্রস্তর (Polishing stone), গদাফলক (ring stone) কুঠার ফলক বা ছেদনাস্ত্র (Boucher or celt), ছুরিকা (flake), মুষল (core), চক্র (disc) প্রভৃতি অস্ত্র ও শস্যপেষণের মুষল (grinder) আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১৫]। ১৯১০ খৃষ্টাব্দে হাজারীবাগের শ্রীযুক্ত নবীনচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয় পার্শ্বনাথপর্ব্বতের নিকটে ও হাজারীবাগের অন্যান্য স্থানে পাঁচটি নব্য-প্রস্তরযুগের অস্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন[১৬]।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক, শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র দাশগুপ্ত এম্ এ, আসামে আবিষ্কৃত নূতন প্রকারের দুইটি কুঠারফলকের বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন[১৭]। ভিন্সেণ্ট্ বল্ ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে, সিংহভূম জেলার ধলভূম পরগণায়, এই জাতীয় কুঠারফলক আবিষ্কার করিয়াছিলেন[১৮]। সম্প্রতি শ্রীযুক্ত কগিন্ ব্রাউন আসামে এক নূতন ধরণের বুষলের (Grooved hammer) বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন[১৯]।
নব্য-প্রস্তরের যুগে আদিম মানবগণ ধাতুর ব্যবহার জানিতেন না। ধাতু আবিষ্কৃত হইলে, মানবগণ যখন জানিতে পারিলেন যে, ধাতুর অস্ত্র পাষাণনির্ম্মিত অস্ত্রাপেক্ষা তীক্ষ্ণধার, তখন তাঁহারা ক্রমশঃ শিলানির্ম্মিত আয়ুধ পরিত্যাগ করিয়া ধাতুনির্ম্মিত অস্ত্র ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন। সুধীগণ অনুমান করেন যে, আদিম মানবগণ সুবর্ণের সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হইয়া সর্ব্বপ্রথমে এই ধাতু সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুবর্ণের পরে তাম্র আবিষ্কৃত হইয়াছিল। মানবজাতির সর্ব্বপ্রাচীন ধাতব অস্ত্রসমূহ তাম্রনির্ম্মিত। তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রশস্ত্র তীক্ষ্ণধার, কিন্তু সুকঠিন নহে। টিন আবিষ্কৃত হইবার পরে, তাম্রনির্ম্মিত দ্রব্যাদি কঠিন করিবার জন্য নয়ভাগ তাম্রের সহিত একভাগ টিন মিশ্রিত হইত, এই মিশ্রধাতুর নাম ব্রঞ্জ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইতিহাসে নব্য প্রস্তরের যুগের পরবর্ত্তিকালকে তাম্রের যুগ (Copper age) আখ্যা প্রদান করা হইয়াছে। তাম্রের যুগের শেষভাগের নাম ব্রঞ্জের যুগ। উত্তরাপথে বা দক্ষিণাপথে অদ্যাবধি এই নূতন মিশ্রধাতু-নির্ম্মিত কোন অস্ত্র আবিষ্কৃত হয় নাই এবং এই জন্য পণ্ডিতগণ অনুমান করিয়া থাকেন যে, ভারতবাসী আদিম মানবগণ মিশ্রধাতুর ব্যবহার জানিতেন না। নব্য-প্রস্তরের যুগ ও তাম্রের যুগের মধ্যে সীমা নির্দ্দেশ করা কঠিন। পৃথিবীর সর্ব্বত্র তাম্রের যুগে, এমন কি লৌহের যুগে (Iron age) পর্য্যন্ত শিলানির্ম্মিত অস্ত্রের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়[২০]।
ভারতবর্ষের নানা স্থানে নানাবিধ তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাম্রনির্ম্মিত কুঠার বা পরশু, তরবারি, ছুরিকা বা কৃপাণ, ভল্ল বা বর্ষার শীর্ষ বক্রদন্তযুক্ত ভল্ল (Harpoon) এবং নানাবিধ ছেদনাস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। কলিকাতা মিউজিয়ামে কাণপুরের নিকটস্থিত বিঠুর, আগ্রার নিকটস্থিত মৈনপুরী, ফরক্কাবাদের নিকটস্থিত ফতেপুর এবং মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট জেলায় অবস্থিত গঙ্গেরিয়া প্রভৃতি নানা স্থানের নানাবিধ তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্র আছে। বাঙ্গালা দেশে মাত্র তিন স্থানের তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে হাজারীবাগ জেলার পচম্বা মহকুমার একটি গিরিশীর্ষে কতকগুলি অসম্পূর্ণ কুঠার বা পরশুফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল[২১]। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে, মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে ঝাটিবনি পরগণায় তামাজুরী গ্রামে একখানি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল[২২]। ত্রিশ বৎসরের অধিককাল পূর্ব্বে ডাঃ সইস্ (Dr. Saise) বারাগুণ্ডা তামার খনির নিকটে বহু তাম্রনির্ম্মিত অলঙ্কার ও অস্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন; ইহার মধ্যে একখানি বৃহৎ কুঠার বা পরশুফলক এবং একখানি কঙ্কণ মাদ্রাজের চিত্রশালায় আছে।
ধাতু আবিষ্কার করিয়া আদিম মানবগণ ক্রমশঃ অনাবশ্যক আড়ম্বরের বশবর্ত্তী হইয়াছিলেন। এই সময় হইতে মানবসমাজে জীবনযাত্রা-নির্ব্বাহে অনাবশ্যক অলঙ্কার ও আভরণের ব্যবহার আরব্ধ হয়। তাম্রনির্ম্মিত কঙ্কণবলয়ই মানবজাতির শৈশবে ললনাগণের সর্ব্বাপেক্ষা বহুমূল্য আভরণ ছিল। ভারতে বহুবিধ তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্র ও আভরণ আবিষ্কৃত হইয়াছে; ইহা হইতে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, এতদ্দেশে বহুকাল যাবৎ তাম্রের ব্যবহার ছিল। ভারতে কোন্ সময়ে তাম্রের যুগ আরম্ভ হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারা যায় না; তবে অনুমান হয় যে, আর্য্যবিজয়ের সময়ে অথবা তাহার অব্যবহিত পরে লৌহের ব্যবহার আরম্ভ হয় এবং ক্রমশঃ তাম্রের ব্যবহার উঠিয়া যায়[২৩]।
- ↑ ভূতত্ত্ববিদ্গণ পৃথিবীর বয়সকে প্রথমতঃ প্রত্নজীবক, মধ্যজীবক ও নব্যজীবক এই তিন যুগে বিভক্ত করিয়াছেন। প্রত্যেক যুগ তিন বা ততোধিক উপযুগে বিভক্ত হইয়াছে:—
(ক) প্রত্নজীবক (Paleozoic). আদিম (Archaean).
কাম্ব্রিক (Cambrian).
অর্দোভিসীয় (Ordovician).
সিলিউরিক (Silurian).
ডিভোনিক (Devonian).
অঙ্গারবহ (Carboniferous).
পার্মিক (Permian).(খ) মধ্যজীবক (Mesozoic). ত্রায়াসিক (Triassic).
জুরাসিক (Jurassic).
খটিক (Cretaceous).(গ) নব্যজীবক (Cainozoic). প্রাগাধুনিক (Eocene).
অল্পাধুনিক (Oligocene).
মধ্যাধুনিক (Miocene).
বহ্বাধুনিক (Pliocene).
অন্ত্যাধুনিক (Pleistocene).
উপাধুনিক (Sub-holocene).
আধুনিক (Holocene). - ↑ That man existed in Western Europe during the period of the Mammoth and the Rhinoceros, Tichorhinus, no longer, I think admits of a doubt; but when we come to Pliocene and still more to Miocene times, the evidence is less conclusive:—Pre-historic Times, p. 399.
- ↑ Records of the Geological Survey of India, Vol. XVII. pp. 201, 203, 205.
- ↑ Noetling—Memoirs of the Geological Survey of India, Vol. XXVIII. 1894. Pre-historic Times, p. 402.
হায়দরাবাদে নিজামের রাজ্যে গোদাবরী নদীর উপত্যকায় অধুনা লুপ্ত অতিকায় জীবের অস্থির সহিত একখানি বহুমূল্য এগেট (agate) প্রস্তুর নির্ম্মিত ছুরিকা (Flake) আবিষ্কৃত হইয়াছিল—Memoirs of the Geological Survey of India, Vol. I, p. 65. প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয় এই সংবাদ সংগ্রহ করিয়া দিয়াছেন। - ↑ “Eolith means an instrument not chipped into any intentional form, but only natural forms utilised at once. Nature, Aug. 31st. 1905.”
- ↑ It is not, however, safe in the present stage of knowledge to argue that the chipped implements of Bengal are of such a high antiquity, though it is within the bounds of possibility that they may be.—J. Coggin Brown—Note Supplied for the Author’s use.
- ↑ V. Ball—Stone implements found in Bengal, Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1865, pp. 127–28.
- ↑ Ibid, 1867, p. 143; Catalogue Raisonne of the Pre-historic Antiquities in the Indian Museum by J. Coggin Brown, M. Sc. F. G. S. p. 46. চিত্র ১।ক।
- ↑ Proceedings of the Royal Irish Academy, 2nd series. Vol. I. p. 394.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1868, p. 177.
- ↑ Ibid. 1870, p. 268.
- ↑ Ibid, 1878, p. 125; Proceedings of the Royal Academy, 2nd Series. Vol. I. p. 3945. pl. XV. fig. 9.
- ↑ Catalogue Raisonne of the Pre-historic Antiquities in the Indian Museum p. 160, No C. 67; চিত্র ১।খ।
- ↑ Ibid. p. 161, No. 2618; চিত্র ২।খ।
- ↑ Ibid, pp. 158–59 Nos. 3292, 3345 and 3353; চিত্র ১।গ—ঙ।
- ↑ Ibid, p. 160, No. 6316; চিত্র ২।ক।
- ↑ Journal and Proceedings, Asiatic Society of Bengal, New series, vol. IX, p. 291.
- ↑ Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1875, pp. 118–122.
- ↑ Journal and Proceedings, Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. X, p. 107.
- ↑ Stone weapons, however, of many kinds were still in use during the Age of Bronze, and lingered on even into that of Iron—Pre-historic Times, p. 3.
- ↑ Proceedings, Asiatic Society of Bengal, 1871, pp. 232-4, চিত্র ২।গ
- ↑ Catalogue and Hand-book of the Archaeological Collections in the Indian Museum, part II, p. 485. চিত্র ২।ঘ
- ↑ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সহকারী অধ্যাপক শ্রীযুক্ত পঞ্চানন মিত্র কলিকাতা চিত্রশালায় যে সমস্ত নব্য-প্রস্তরযুগের আমূধ রক্ষিত আছে তাহা পরীক্ষা করিয়া দুই তিনটি লিপিযুক্ত কুঠারফলক আবিষ্কার করিয়াছেন (Indian Antiquary Vol. XLVII, 1919, pp. 57-64) এই সমস্ত নব্য-প্রস্তরযুগের আয়ুধ খননে আবিষ্কৃত হয় নাই। সেইজন্য প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূতত্ত্ব-অধ্যাপক শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র দাশগুপ্ত এই কুঠারফলকগুলির লিপি কুঠারফলকের সমসাময়িক কি না অর্থাৎ এই লিপিগুলি নব্য-প্রস্তরযুগের লিপি কি না সে বিষয়ে সন্দেহ করেন। এই সমস্ত কুঠারফলক হয়ত নব্য-প্রস্তরযুগের সহস্ৰ সহস্র বৎসর পরে মানবকর্ত্তৃক ব্যবহৃত হইয়াছিল এবং তৎকালে কেহ উহার উপরে কিছু লিথিয়া রাখিয়া থাকিবে।