বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ২



নব্যপ্রস্তর ও তাম্রযুগের অস্ত্র ও বাবিরুষীয় শিল




দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বাঙ্গালার আদিম অধিবাসী ও আর্য্যবিজয়।

 বাবিরুষে ও মিশরে তাম্রের ব্যবহার—আর্য্যজাতির বাবিরুষে আগমন—কাশীয়জাতি—মিতান্নিরাজ্য—বাবিরুষে ও মিশরে লৌহের ব্যবহার—মিতান্নির আর্য্যরাজবংশ—ভারতে আর্য্যজাতির আগমন—বৈদিক সাহিত্যে বঙ্গ ও মগধের উল্লেখ—চেরজাতি ও কেরলরাজ্য—মিথিলায় আর্য্যোপনিবেশ—দ্রবিড়জাতি—দ্রাবিড়ভাষা—হলের মত—বাবিরুষে দ্রবিড়জাতি—সুমেরীয় ও দ্রবিড়গণ অভিন্ন—মধ্যভারতে বাবিরুষীয় দেবতা ও খোদিত লিপি—আর্য্যবিজয় কালে মগধ ও বঙ্গের অবস্থা—মগধ ও বঙ্গের প্রতি প্রাচীন আর্য্যগণের বিদ্বেষ।

 প্রাচীন মিশর, বাবিরুষ (Babylon) ও আসুর (Assyria) দেশের প্রাচীনকালের ইতিহাস পর্য্যালোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই সকল দেশে অতি প্রাচীনকাল হইতে তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রের প্রচলন ছিল। প্রত্নবিদ্যাবিদ্‌গণ অনুমান করেন যে, মিশরদেশে সাম্রাজ্যের যুগের পূর্ব্বে (Pre-dynastic Age) তাম্রের ব্যবহার আরব্ধ হইয়াছিল[১]। খৃষ্টের জন্মের চারি সহস্র বৎসর পূর্ব্বে মিশরদেশে প্রথম সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়, ইহার পূর্ব্ব হইতে মিশরে তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রের ব্যবহার ছিল। পণ্ডিতগণ মনুমান করেন যে, খৃষ্ঠের জন্মের চারি সহস্ৰ বৎসর পূর্ব্বে প্রাচীন বাবিরুষে তাম্রের ব্যবহার ছিল। মিশর, বাবিরুষ প্রভৃতি প্রাচীনরাজ্যে ২০০০ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দ পর্য্যন্ত তাম্রের ব্যবহার অপ্রতিহত ছিল। খৃষ্টের জন্মের সার্দ্ধ সহস্র বা দ্বিসহস্রবর্ষ পূর্ব্বে, প্রাচীন আর্য্যজাতি এসিয়াখণ্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত, মরুময় পুরাতন আবাসভূমি পরিত্যাগ করিয়া, দক্ষিণাভিমুখে অগ্রসর হইতে আরম্ভ করেন। আর্য্যগণের আক্রমণে, খৃষ্টের জন্মের পঞ্চদশ শতাব্দী পূর্ব্বে, বাবিরুষ ও মিশর দেশের প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলি ধ্বংস হইয়া যায়। খৃষ্টপূর্ব্ব ষোড়শ শতাব্দীতে আর্য্যবংশজাত কাশীয়জাতি (Kassites, Cossites Kash-shu) বাবিরুষ অধিকার করিয়া, নূতন রাজ্যস্থাপন করেন। কাশীয়গণ যে আর্য্যজাতীয় সে বিষয়ে এখন আর কাহারও সন্দেহ নাই। তাঁহাদিগের সর্ব্বপ্রধান দেবতার নাম সূর্য্যস্ এবং তাঁহাদিগের ভাষা আর্য্যজাতিসমূহের ভাষার অনুরূপ। কাশীয়গণের পবন দেবতার নাম মরুত্তস্ (সংস্কৃত মরুৎ)। ইঁহারা তাঁহাদিগের খোদিত লিপিসমূহে আপনাদিগকে খারি অর্থাৎ আর্য্যনামে অভিহিত করিতেন[২]। ববিরুষের উত্তর-পশ্চিমে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদদ্বয়ের মধ্যে আর্য্যবংশসম্ভূত পরাক্রান্ত মিতান্নিজাতি একটি স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে জর্ম্মন পণ্ডিত হিউগো উইঙ্কলার (Hugo Winckler) তুরুষ্করাজ্যে বোগাজকোই নামক স্থানে কালীকাক্ষরে (Cuneiform) লিখিত প্রাচীন মিতান্নিরাজগণের কতকগুলি মৃন্ময় সন্ধিপত্র আবিষ্কার করিয়াছেন। এই সন্ধিপত্রগুলিতে মিতান্নিরাজ মত্তিউয়জ, মিত্র, বরুণ, অরুণ, ইন্দ্র ও নাসত্যদ্বয় অর্থাৎ অশ্বিন্‌গণের নামগ্রহণ করিয়া সন্ধিপত্র আরম্ভ করিয়াছেন[৩]। মিশরদেশের প্রাচীন ইতিহাস হইতে জানিতে পারা যায় যে, খৃষ্টপূর্ব্ব সপ্তদশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীতে মিশরের প্রাচীন রাজবংশ এসিয়াবাসী যাযাবরজাতিসমূহকর্ত্তৃক অধিকারচ্যুত হইয়াছিলেন। এই সকল যাযাবরজাতি আর্য্যজাতির আক্রমণে পুরাতন বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিল। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, এই সময়ে আর্য্যগণও মিশরদেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন[৪]

 আর্য্যবিজয়ের পরবর্ত্তীকাল হইতে মিশর, বাবিরুষ প্রভৃতি প্রাচীন দেশসমূহে লৌহের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। আসুরদেশে খৃষ্টপূর্ব্ব দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ব্বে লৌহনির্ম্মিত অস্ত্রব্যবহারের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না[৫]। চীনদেশে খৃষ্টপূর্ব্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতে লৌহের ব্যবহারের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়[৬]। এই সকল কারণ দর্শনে অনুমান হয় যে, প্রাচীন আর্য্যজাতি লৌহনির্ম্মিত অস্ত্রের বলে, খৃষ্টপূর্ব্ব দ্বিসহস্র হইতে সার্দ্ধ সহস্ৰ বৎসর মধ্যে, প্রাচীন বাবিরুষ ও অসুররাজ্য জয় করিয়াছিলেন।

 বাবিরুষে এবং টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদদ্বয়ের মধ্যবর্ত্তী ভূভাগে প্রাচীন আর্য্যাধিকার চারিশত বর্ষের কিঞ্চিৎ অধিককাল স্থায়ী হইয়াছিল। মিশরের অষ্টাদশ সংখ্যক রাজবংশের তৃতীয় থুতমসিস্ (Thutmosis III) এসিয়াখণ্ডে যুদ্ধযাত্রাকালে মিতান্নিরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন। মিশরে কর্ণাকের প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে আবিষ্কৃত তৃতীয় থুতমসিসের প্রশস্তিতে এই ঘটনার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়[৭]। অদ্যাবধি মিশরে ও এসিয়ায় যে সমস্ত খোদিতলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা হইতে প্রত্নতত্ত্ববিদ্ হল আর্য্যবংশজাত মিতান্নিরাজগণের নিম্নলিখিত বংশপত্রিকা সংগ্রহ করিয়াছেন:—

 
সৌশ্‌শতর
 
 
 
 
 
 
 
 
প্রথম আর্ত্ততম
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
শুতর্ণ
 
 
মুতেমুয়া (কন্যা, ইহার সহিত মিশররাজ ৪র্থ থুতমসিসের বিবাহ হইয়াছিল।)
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আর্ত্তশুমর  আর্ত্ততমদশরত্তগিলুখিপা (কন্যা, ইহার সহিত মিশররাজ ৩য় আমেনহেতেপের বিবাহ হইয়াছিল।)
 
 
 
 
 
শুততর
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
মত্তিউয়জতদুখিপা (কন্যা, ইহার সহিত মিশররাজ ৪র্থ আমেনহেতেপের বিবাহ হইয়াছিল।)
ইতকম

দশরত্ত বা দশরথের সময় হইতে মিতান্নিরাজ্যের অবনতি আরম্ভ হয় এবং তাঁহার পুত্র মত্তিউয়জ ১৩৬৯ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দে খাতি (Khati বা Hittite) রাজ সুব্বিলুলিউমা কর্ত্তৃক পিতৃরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন[৮]। এই ঘটনার অল্পদিন পরে মিতান্নিরাজ্য খাতিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল। প্রাচীন বাবিরুষে, সেমিটিকজাতির সহিত সংমিশ্রণে, আর্য্যবংশসম্ভূত কাশীয়রাজগণ ক্রমশঃ দুর্ব্বল হইয়া পড়িতেছিলেন। খৃষ্টপূর্ব্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাবিরুষের আর্য্যরাজগণের অধিকার লুপ্ত হয়, এবং আর্য্যজাতির শেষ রাজা কাষ্টিলিয়াসু, আসুররাজ তুকুল্‌তি-নিনিব কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন[৯]। এসিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমসীমান্তে, খৃষ্টপূর্ব্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে, আর্য্যাধিকার বিলুপ্ত হইলেও, প্রাচীন ঐরাণে (বর্ত্তমান পারস্যদেশে), আর্য্যগণের উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল। ঐরাণবাসী পারসিক নামধারী আর্য্যগণই, পরবর্ত্তিকালে, প্রাচীন প্রাচ্যজগতে আসুর সাম্রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন।

 এই আর্য্যজাতির একশাখা ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পর্ব্বতশ্রেণী অতিক্রম করিয়া, পঞ্চনদ প্রদেশে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন। ইঁহারা ক্রমশঃ পূর্ব্বদিকে স্বীয় অধিকার বিস্তার করিয়াছিলেন এবং দুই তিন শতাব্দীর মধ্যে উত্তরাপথের অধিকাংশ হস্তগত করিয়াছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, মগধের দক্ষিণ অংশের প্রাচীন নাম কীকট। ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ঋগ্বেদের তৃতীয়াষ্টক রচনাকালে, পঞ্চনদ ও মধ্যদেশবাসী আর্য্যগণ, মগধদেশের অস্তিত্বের কথা অবগত ছিলেন[১০]। অথর্ব্ববেদসংহিতার ৫ম কাণ্ডে অঙ্গ ও মগধদেশের নাম আছে; সুতরাং ইহা স্থির যে, এই সময়ে অঙ্গ ও মগধদেশ আর্য্যগণের নিকট পরিচিত হইয়াছিল[১১]। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে[১২] ও মানবধর্ম্মশাস্ত্রে[১৩] পুণ্ড্রজাতির উল্লেখ আছে। পুণ্ড্রবর্দ্ধন যদি পুণ্ড্রগণের তৎকালীন বাসস্থান হয়, তাহা হইলে উত্তরবঙ্গ তখন আর্য্যগণের পরিচিত হইয়াছিল। ঐতরেয় আরণ্যকে[১৪] বঙ্গ শব্দের সর্ব্বপ্রাচীন উল্লেখ পাওয়া গিয়াছে। ঐতরেয় আরণ্যক রচনাকালে বঙ্গ, বগধ ও চেরদেশবাসিগণকে আর্য্যগণ পক্ষিবৎ জ্ঞান করিতেন। বঙ্গ, বঙ্গদেশের নাম; বগধ, হয় মগধের প্রাচীন নাম অথবা লিপিকরপ্রমাদের ফল; এবং চের, জাতি অথবা দেশবিশেষের নাম। মধ্যপ্রদেশের পার্ব্বত্য বর্ব্বরজাতিগণ আপনাদিগকে চেরজাতির বংশধর বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। চের, দক্ষিণাপথের একটি প্রাচীন রাজ্যের নাম; ইহার অপর নাম কেরল। অশোকের দ্বিতীয় গিরিশাসনে কেরলদেশের নাম আছে। প্রাচীন তামিল সাহিত্যে চেরদেশের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়[১৫]

 যে সময়ে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অথবা আরণ্যকে আমরা বঙ্গ অথবা পুণ্ড্রজাতির উল্লেখ দেখিতে পাই, সে সময়ে অঙ্গে, বঙ্গে, অথবা মগধে আর্য্যজাতির বাস ছিল না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ঐন্দ্রমহাভিষেকের বর্ণনায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, দুষ্মন্তের পুত্র ভরত একশত তেত্রিশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, ইহার মধ্যে আটাত্তরটি যমুনার নিকটে ও পঞ্চান্নটি গঙ্গাতীরে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল[১৬]। শতপথ ব্রাহ্মণে দেখিতে পাওয়া যায় যে, অগ্নি সরস্বতী-তীর হইতে সরযূ, গণ্ডকী ও কুশী নদী পার হইয়া সদানীরা-তীরে আসিয়াছিলেন, কিন্তু দক্ষিণে মগধে বা বঙ্গদেশে গমন করেন নাই। রাহুগণ মিথিলাদেশে আগমন করিলে উহা আর্য্যগণের বাসযোগ্য বলিয়া গণ্য হয়। বৈদিক-সাহিত্যে এই সকল উল্লেখ হইতে অনুমান হয় যে, সেই সময়ে অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, মিথিলা প্রভৃতি উত্তরাপথের পূর্ব্বসীমান্তস্থিত প্রদেশসমূহ নবাগত আর্য্যজাতির নিকট পরিচিত ছিল, কিন্তু তাহাদিগের অধিকারভুক্ত ছিল না। শতপথ ব্রাহ্মণে মিথিলার উল্লেখ দেখিয়া বোধ হয় যে, সেই সময়ে মিথিলায় আর্য্য-উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল, অথবা মিথিলা আর্য্যগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল[১৭]

 আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বসীমান্ত যখন আর্য্যোপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তখন এই সকল দেশ কোন্ জাতির বাসস্থান ছিল? ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ ও মগধবাসিগণের সহিত চেরদেশবাসিগণের অথবা চেরজাতির উল্লেখ দেখিয়া বোধ হয় যে, আর্য্যগণ যাহাদিগকে পক্ষিজাতীয় মনুষ্য মনে করিতেন, তাহারা একই বংশসম্ভূত জাতি। মধ্যপ্রদেশের পার্ব্বত্য উপত্যকা সমূহে যে সমস্ত বর্ব্বরজাতি অদ্যাবধি আপনাদিগকে চেরো বা চেরুবংশসম্ভূত বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে, তাহারা আর্য্য বংশজাত নহে। নৃতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, তাহারা দ্রবিড়জাতীয়।

 দ্রবিড়জাতি বহুকাল পূর্ব্বে ভারতবর্ষ অধিকার করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের ভাষা অনার্য্য, বর্ত্তমান সময়ে তাঁহারা মধ্যভারতে ও দাক্ষিণাত্যে বাস করিয়া থাকেন। দ্রাবিড় বা ডামিলভাষা এক্ষণে তামিল, তেলেগু, কাণাডা ও মলয়ালম এই চারিটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। এতদ্ব্যতীত মধ্যভারতের পার্ব্বত্য উপত্যকাসমূহে ও বালুচিস্তানে, দ্রাবিড়ভাষার বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা অদ্যাপি প্রচলিত আছে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম-সীমান্তে বালুচিস্তানের ব্রহুইজাতি দ্রবিড়জাতীয় ভাষা ব্যবহার করিয়া থাকে; ইহা হইতে ভাষাতত্ত্ববিদ্‌গণ অনুমান করেন যে, আর্য্যোপনিবেশের পূর্ব্বে দ্রবিড়গণ আর্য্যগণের ন্যায় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পার্ব্বত্যপথে ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন।

 সম্প্রতি প্রত্নবিদ্যাবিশারদ পণ্ডিত হল্ স্থির করিয়াছেন যে, এই দ্রবিড়গণ অতি প্রাচীন কাল হইতে ভারতবর্ষে বাস করিয়া আসিতেছেন, এবং ইঁহারাই খৃষ্টের জন্মের তিন সহস্র বর্ষ পূর্ব্বে বাবিরুষ অধিকার করিয়া, বাবিরুষ ও আসুরের প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন। বাবিরুষ ও আসুরের প্রাচীন অধিবাসিগণ সেমিটিকজাতীয়। ৩০০০ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দে, ভিন্ন বংশজ সুমেরীয় জাতি, এই আদিম অধিবাসিগণকে পরাজিত করিয়া নূতন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। সুমেরীয়গণ প্রাচীন কীলকাক্ষরের (Cuneiform Script) সৃষ্টিকর্ত্তা। বাবিরুষের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষমধ্যে প্রাচীন সুমেরীয় জাতির যে সকল প্রতিমূর্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা দেখিলে বোধ হয় যে, তাঁহারা সেমিটিক অথবা আর্য্যবংশসম্ভূত নহেন। হল্‌ অনুমান করেন যে, এই প্রাচীন সুমেরীয়জাতির অবয়ব ও মুখ বর্ত্তমান কালের দাক্ষিণাত্যবাসী অর্থাৎ দ্রবিড়জাতীয় হিন্দুগণের ন্যায়। তিনি অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষই দ্রবিড়জাতির প্রাচীন আবাসভূমি; এবং এই ভারতবর্ষ হইতে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে, দ্রবিড়জাতি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গিরিসঙ্কটসমূহ অবলম্বনে প্রাচীন ঐরাণ ও বাবিরুষ অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহারা যখন বাবিরুষ অধিকার করিয়াছিলেন, তখন তাঁহারা তদ্দেশীয় আদিম অধিবাসিগণ অপেক্ষা সভ্যতর, তাঁহারা তখন ধাতবঅস্ত্রের ব্যবহারে অভ্যস্ত, অঙ্কিত সাঙ্কেতিক চিহ্ন দ্বারা ভাব প্রকাশ করিতে শিক্ষা করিয়াছেন এবং নানাবিধ শিল্প তাঁহাদিগের আয়ত্ত হইয়াছে[১৮]

 অতি অল্পদিনপূর্ব্বে মধ্যভারতের পার্ব্বত্য উপত্যকাসমূহের কোন স্থানে একটি ক্ষুদ্র গোলাকার প্রস্তরনির্ম্মিত কীলক আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই কীলকটির গাত্রে কতকগুলি মনুষ্যমূর্ত্তি ও কতকগুলি অক্ষর আছে। এই কীলকটি এক্ষণে নাগপুরের চিত্রশালায় বা মিউজিয়মে আছে। কিছুদিন পূর্ব্বে এই কীলকটির চিত্রদর্শনে একজন ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেন যে, ইহাতে কীলকাক্ষরে একটি খোদিতলিপি আছে এবং কীলকটি বাবিরুষের একটি প্রাচীন মুদ্রা (Cylinder seal)। প্রাচীনকালে বাবিরুষে এই জাতীয় মুদ্রার (শিলমোহরের) বহুল প্রচলন ছিল। এই সকল প্রাচীন শিলমোহর গোলাকার, এবং আর্দ্র কর্দ্দমের উপরে উহা গড়াইয়া দিলে চতুষ্কোণ মুদ্রা মুদ্রিত হইয়া যাইত। প্রাচীন বাবিরুষে ও আসুরে, গ্রন্থ হইতে পত্রাদি পর্য্যন্ত সমস্তই লৌহকীলকদ্বারা কর্দ্দমে লিখিত হইত; লিখন শেষ হইলে লেখকের নামযুক্ত মুদ্রা, পত্র বা পুস্তকের শেষে মুদ্রিত হইত[১৯]। এই জাতীয় সহস্ৰ সহস্র মুদ্রা প্রাচীন আসুর, বাবিরুষ, এমন কি প্রাচীন মিশরে পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে[২০]। নাগপুর চিত্রশালায় যে কীলকটি আছে তাহাতে একদিকে দুইটি বৃহৎ মনুষ্যমূর্ত্তি, চন্দ্রসূর্য্যের চিহ্ন ও তিনটি ক্ষুদ্র মনুষ্যমূর্ত্তি আছে, এবং অপরদিকে দুই পংক্তি কীলকাক্ষর আছে। বৃহদাকার মনুষ্যদ্বয়ের মধ্যে বামদিকের মূর্ত্তিটি রমণীমূর্ত্তি, সম্ভবতঃ কোন দেবী; তিনি করযোড়ে অপর মূর্ত্তির সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন। অপর মূর্ত্তিটি বাবিরুষীয় পবনদেবতা আদাদের (Adad)। আদাদ প্রাচীনকালে সিরিয়াদেশে আমুরু (Amuru) নামে পূজিত হইতেন। খৃষ্টপূর্ব্ব দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, বাবিরুষরাজ মার্দুক-নাদিন্ আখি একল্লাতিনগর জয় করিয়া সেইস্থান হইতে আদাদের মূর্ত্তি বাবিরুষনগরে লইয়া গিয়াছিলেন[২১]। কীলকাক্ষরে খোদিতলিপি হইতে জানা যায় যে ইহা আদাদের সেবক লিবুরবেলীনামক কোন ব্যক্তির মুদ্রা। কীলকলিপির শেষভাগ ক্ষয় হইয়া গিয়াছে, আদাদের নাম ইহাতে পাঠ করা যায় না, তবে খোদিতলিপির পার্শ্বে আদাদের মূর্ত্তি দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, এইস্থানে দেবতা আদাদের নাম ছিল। “লিবুরবেলী” বাবিরুষীয় ভাষায় “ঈশ্বর বলবান্ হউন” বুঝায়। এই কীলকলিপি অনুমান দুই হাজার খৃষ্টপূর্ব্বাব্দে খোদিত হইয়াছিল। এই সময় প্রাচীন বাবিরুষে প্রাচীন রাজবংশের অধিকার কাল[২২]। মধ্যভারতে এই কীলকলিপির আবিষ্কার, পণ্ডিতপ্রবর হলের উক্তির যাথার্থ্য প্রমাণিত করিতেছে। দাক্ষিণাত্যে পাষাণনির্ম্মিত প্রাচীন সমাধিস্থান খননকালে মৃন্ময় শবাধারে মনুষ্যের শব আবিষ্কৃত হইয়াছে[২৩]। এই জাতীয় শবাধার প্রাচীন বাবিরুষের ধ্বংসাবশেষ মধ্যেও আবিষ্কৃত হইয়াছে[২৪]

 এই সকল আবিষ্কার হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, প্রাচীন বাবিরুষবাসিগণের সহিত ভারতবাসী দ্রবিড় বা ডমিল জাতির অতি নিকট-সম্পর্ক ছিল এবং উত্তরাপথের পশ্চিমপ্রান্তে বালুচিস্তানে ব্রহুই জাতির অস্তিত্ব ও ভাষা হইতে প্রমাণিত হয় যে, এক সময়ে সম্ভবতঃ আর্য্যজাতির আক্রমণের পূর্ব্বে আর্য্যাবর্ত্তে ও দাক্ষিণাত্যে দ্রবিড়জাতির বিস্তৃত অধিকার ছিল। অধ্যাপক হল অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষই দ্রবিড়জাতির প্রাচীন বাসস্থান এবং তাঁহারা আর্য্যাবর্ত্ত হইতে পশ্চিমে প্রয়াণকালে বালুচিস্তানে যে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন, আধুনিক ব্রহুই জাতি সেই ঔপনিবেশিকগণের বংশধর। দ্রবিড়জাতির সহিত প্রাচীন বাবিরুষবাসী সুমেরীয় জাতির যে নিকট সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই; তবে ইহাও সম্ভব যে দ্রবিড়গণ বাবিরুষ অধিকার করিয়া, পরে ভারতবর্ষ অধিকার করিয়াছিলেন এবং প্রাচীন আর্য্যগণের ন্যায় মধ্য-এসিয়া অথবা উত্তর-এসিয়া তাঁহাদিগের প্রাচীন বাসস্থান ছিল।

 আর্য্যোপনিবেশের পূর্ব্বে যে প্রাচীন জাতি ভূমধ্যসাগর হইতে বঙ্গোপসাগর পর্য্যন্ত স্বীয় অধিকার বিস্তার করিয়াছিল, তাহারাই বোধ হয় ঋগ্বেদের দস্যু এবং তাহারাই ঐতরেয় আরণ্যকে বিজেতৃগণ কর্ত্তৃক পক্ষী নামে অভিহিত হইয়াছে। এই প্রাচীন দ্রবিড়জাতিই বঙ্গ মগধের আদিম অধিবাসী। নৃতত্ত্ববিদ্‌ পণ্ডিতগণ আধুনিক বঙ্গবাসিগণের নাসিকা ও মস্তক পরীক্ষা করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, তাঁহারা দ্রবিড় ও মোঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন। মগধে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ জাতীয় ব্যক্তিগণকে আর্য্য জাতীয় অথবা আর্য্যসংমিশ্রণে উৎপন্ন বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু বঙ্গবাসিগণকে জাতিনির্ব্বিশেষে দ্রবিড় ও মোঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণের ফল বলা যাইতে পারে।

 উত্তরাপথের পশ্চিমাংশ আর্য্যগণ কর্ত্তৃক বিজিত হইবার বহুকাল পরেও মগধ ও বঙ্গ স্বাধীন ছিল। যে সময়ে শতপথ ব্রাহ্মণ রচিত হইয়া ছিল, সে সময়ে মিথিলায় আর্য্যোপনিবেশ স্থাপিত হইলেও, মগধ ও বঙ্গ আর্য্যজাতির নিকট মস্তক অবনত করে নাই। তখনও পর্য্যন্ত এই দেশদ্বয় আর্য্যাবর্ত্তের সীমাভুক্ত ছিল না। প্রবাদ শুনিতে পাওয়া যায় যে, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সৌরাষ্ট্র ও মগধ দেশে তীর্থযাত্রা বিনা অন্য কারণে গমন করিলে পাতিত্যদোষ জন্মিত ও পুনঃ সংস্কার আবশ্যক হইত[২৫]। বৌধায়ন ধর্ম্মসূত্রে দেখিতে পাওয়া যায় যে, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সৌবীর প্রভৃতি দেশে গমন করিলে শুদ্ধিলাভার্থ যজ্ঞবিশেষের অনুষ্ঠান করিতে হইত[২৬]। পূর্ব্বোক্ত নিষেধবাক্য দেখিয়া বোধ হয় যে, বৌধায়ন স্মৃতির রচনাকালেও বঙ্গ-মগধের প্রাচীন অধিবাসিগণ পিতৃপুরুষের পূজার্চ্চনারীতির ও প্রাচীন দেবসমূহের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই জন্যই গর্ব্বিত আর্য্যগণ উক্ত দেশসমূহে গমন সম্বন্ধে নিষেধবাক্য প্রচার করিয়াছিলেন।

 প্রাচীন সাহিত্যে আর্য্যগণকর্ত্তৃক মগধ ও বঙ্গ অধিকারের কোন উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। সুতরাং কোন সময়ে আর্য্যজাতি বঙ্গ ও মগধ অধিকার করিয়াছিলেন, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। সিংহলের ইতিহাস হইতে জানিতে পারা যায় যে, খৃষ্টপূর্ব্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিজয়সিংহ নামক বঙ্গদেশীয় কোন রাজপুত্র সিংহলে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন। এই ঘটনার মূলে সত্য আছে কি না তাহা বলিতে পারা যায় না, তবে ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হইবে যে, খৃষ্টপূর্ব্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ব্বে মগধে ও বঙ্গে আর্য্যসভ্যতা প্রচারিত হইয়াছিল। বিজয়সিংহ নাম অনার্য্য নাম নহে সুতরাং তাঁহার জন্মের পূর্ব্বেই বঙ্গ মগধের প্রাচীন অধিবাসিগণ পুরাতন ভাষা ও রীতি নীতি পরিত্যাগ করিয়া আর্য্যজাতীয় আচার ব্যবহার ও ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন।



পরিশিষ্ট (ক্)

 এসিয়াটিক সোসাইটির ভূতপূর্ব্ব সভাপতি মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত “Bengal, Bengalees. Their manners, customs and literature” নামক অপ্রকাশিত প্রবন্ধ অবলম্বনে এই পরিচ্ছেদ লিখিত হইয়াছে। শাস্ত্রী মহাশয় বঙ্গীয় সাহিত্যসম্মিলনের সপ্তম অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণে বলিয়াছেন, “আমার বিশ্বাস বাঙ্গালী একটি আত্মবিস্মৃত জাতি।…………। বাঙ্গালার ইতিহাস এখনও তত পরিষ্কার হয় নাই যে, কেহ নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন বাঙ্গালা Egypt হইতে প্রাচীন অথবা নূতন। বাঙ্গালা Nineva ও Babylon হইতেও প্রাচীন অথবা নূতন। বাঙ্গালা চীন হইতেও প্রাচীন অথবা নূতন। ………যখন আর্য্যগণ মধ্য এসিয়া হইতে পাঞ্জাবে আসিয়া উপনীত হন, তখনও বাঙ্গালা সভ্য ছিল। আর্য্যগণ আপনাদের বসতি বিস্তার করিয়া যখন এলাহাবাদ পর্য্যন্ত উপস্থিত হন, তখন বাঙ্গালার সভ্যতায় ঈর্ষ্যাপরবশ হইয়া তাঁহারা বাঙ্গালীকে ধর্ম্মজ্ঞানশূন্য এবং ভাষাশূন্য পক্ষী বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন।……

 বুদ্ধদেবের জন্মের পূর্ব্বে বাঙ্গালীরা জলে ও স্থলে এত প্রবল হইয়াছিল যে, বঙ্গরাজ্যের একটি ত্যজ্যপুত্র সাত শত লোক লইয়া নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপ দখল করিয়াছিলেন। তাঁহারই নাম হইতে লঙ্কাদ্বীপের নাম হইয়াছে সিংহলদ্বীপ। রামায়ণে লঙ্কাদ্বীপের নাম সিংহল দ্বীপ কোথাও নাই, কিন্তু ইহার পরে উহার লঙ্কা নাম উঠিয়া গিয়া ক্রমে সিংহল নাম সংস্কৃত সাহিত্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। প্রাচীন গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় যে, বড় বড় খাঁটি আর্য্যরাজগণ, এমন কি যাঁহারা ভারতবংশীয় বলিয়া আপনাদের গৌরব করিতেন, তাঁহারাও বিবাহসূত্রে বঙ্গেশ্বরের সহিত মিলিত হইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেন।………। যখন লোকে লোহার ব্যবহার করিতে জানিত না, তখন বেতে বাঁধা নৌকায় চড়িয়া বাঙ্গালীরা নানা দেশে ধান চাউল বিক্রয় করিতে যাইত, সে নৌকার নাম ছিল ‘বালাম নৌকা’। তাই সে নৌকায় যে চাউল আসিত তাহার নাম বালাম চাউল হইয়াছে; বালাম বলিয়া কোন ভাষায় কথা আছে কি না জানি না; কিন্তু তাহা সংস্কৃতমূলক নহে। তমলুক বাঙ্গালার প্রধান বন্দর। অশোকের সময় এমন কি বুদ্ধের সময়ও তমলুক বাঙ্গালার বন্দর ছিল। তমলুক হইতে জাহাজ সকল নানা দেশে যাইত।………। অনেক প্রাচীন গ্রন্থেও তমলুকের নাম পাওয়া যায়। তমলুকের সংস্কৃত নাম তাম্রলিপ্তি। তাম্রলিপ্তি শব্দের অর্থ কি, সংস্কৃত হইতে তাহা বুঝা যায় না। সংস্কৃতে তাম্রলিপ্তির মানে তামায় লেপা কিন্তু তমলুকের নিকট কোথাও তামার খনি নাই। তমলুক হইতেই যে তাম্র রপ্তানী হইত, তাহার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। বহু প্রাচীন সংস্কৃতে উহার নাম দামলিপ্তী অর্থাৎ উহা দামল জাতির একটি প্রধান নগর। বাঙ্গালায় যে এককালে দামল বা তামল জাতির প্রাধান্য ছিল, ইহা হইতে তাহাই কতক বুঝা যায়।”—মানসী, বৈশাখ ১৩২১, পৃঃ ৩৫৬-৫৮।

 অধ্যাপক হল্ তাঁহার নব প্রকাশিত গ্রন্থে, প্রাচীন সুমেরীয় জাতি ও দক্ষিণাত্যবাসী দ্রবিড়জাতির পূর্ব্বপুরুষগণের ষে সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়াছেন, নবাবিষ্কৃত বাবিলনীয় কীলকলিপি দ্বারা তাহার মূল্য কতদূর বর্দ্ধিত হইয়াছে, এই পরিচ্ছেদে তাহা দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছি।

 মহাভারতে বা রামায়ণে বাসুদেব, চন্দ্রসেন প্রভৃতি পৌণ্ড্রজাতীয় ও বঙ্গদেশীয় রাজগণের উল্লেখ আছে। অনাবশ্যক জ্ঞানে গ্রন্থমধ্যে তাহাদিগের উল্লেখ করি নাই। মহাভারত ও রামায়ণের ঐতিহাসিকতা এখনও তর্কের বিষয়, এতদ্ব্যতীত যে অংশে বাসুদেবপ্রমুখ রাজগণের নাম আছে, সেই অংশের বয়স কত তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই সকল কারণে এই গ্রন্থে মহাভারত বা রামায়ণের প্রমাণ গ্রহণ করা উচিত বোধ করি নাই।

 বাঙ্গালার বর্ত্তমান অধিবাসিগণের সহিত দক্ষিণ-ভারতের দ্রাবিড় ভাষাভাষী অধিবাসিগণের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। ইহার প্রমাণ প্রাচীন দ্রাবিড়-সাহিত্যে পাওয়া যায়। “নাগপূজক কয়েকটি জাতি বাঙ্গালা হইতে এবং ভারতের উত্তরাঞ্চল হইতে তামিলকম্ দেশে যায়। ইহাদের মধ্যে মরণ, চের ও পাঙ্গালা-থিরইয়র উল্লেখ্য। চেরগণ উত্তর পশ্চিম পাঙ্গালা হইতে দক্ষিণ-ভারতে যায়। সেখানে গিয়া তাহারা চেররাজ্য-স্থাপন করে। পাঙ্গালা যে বাঙ্গালা, তাহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারা যায়॥”……“একজন বাঙ্গালী বীর খৃষ্ট পূর্ব্ব সপ্তম শতকে রাজ্যে গমন করেন। তাঁহার নাম “লাক্‌-লোঙ্” (Lak-long) ইঁহার মাতৃকুল নাগবংশীয় ছিলেন। আনাম দেশের বিবরণে আছে যে, ইনি তাঁহার জন্মভূমি ‘বন-লাঙ্’ (Van-lang) পরিত্যাগ পূর্ব্বক আনামরাজকে বিতাড়িত করিয়া নিজে রাজা হন। এখানে ‘ঊকি’ নামে এক রমণীকে তিনি বিবাহ করেন। তাঁহার এই রাজ্যের নামও তিনি দেন—‘বন-লাঙ্’; রাজধানীর নাম ‘ফোঙ্-চু’। ইঁহাদের সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প আছে। গল্পগুলির উল্লেখ অনাবশ্যক। তবে সেই সমস্ত গল্প হইতে সার নিষ্কর্ষ করিতে পারা যায়। তদনুসারে বলিতে পারা যায় যে বন-লাঙের অধিবাসীরা ‘বন্’ বা ‘বঙ্’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই বন্ ও বঙ্গ অভিন্ন বলিয়াই বোধ হয়। এই বন্‌ বা বঙ্‌জাতি খৃষ্টপূর্ব্ব তৃতীয় শতক পর্য্যন্ত আনামে রাজত্ব করেন।”……“লাক্‌-লোঙ্ যিনিই হউন, ইনি যে বঙ্গদেশ হইতে আনামে গিয়াছিলেন, তাহা মানিয়া লইবার মত প্রমাণ সুপণ্ডিত জেরিনি-প্রমুখ পণ্ডিতগণ দিয়াছেন।”……

 শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের “বাঙ্গালীর ইতিহাস”, প্রবাসী ১৩২৮, পৃঃ ৬৩২-৩৩।

 শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার বহুপূর্ব্বে প্রাচীন ইতিহাসবেত্তা শ্রীযুক্ত বিজয়চন্দ্র মজুমদার মহাশয় ১৩১৭ সালের কার্ত্তিক মাসের নব্যভারতে “বঙ্গ নামের প্রাচীনতা” প্রবন্ধে এবং ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে History of the Bengali Literature গ্রন্থে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় আলোচনা করিয়াছিলেন। এই সম্বন্ধে প্রবাসী ১৩২৮, পৃঃ ৮৭৫ ও ২০১ দ্রষ্টব্য।


  1. Copper came gradually into use among the Pre-historic Southern Egyptians towards the end of the Pre-dynastic Age. And they must have obtained their knowledge of it from the Northerners.—H. R. Hall, The Ancient History of the Near East. p. 90.
  2. Ibid, p. 201.
  3. Mitteilungender Deutschen Orientgesellschaft—No. 35; Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, pp. 722-23.
  4. Hall’s Ancient History of the Near East, p. 212.
  5. The earliest evidence of Iron in Assyria is an inscription of Tiglath-Pileser (1120 B.C.) who Says: “In the Desert of Mitani near Araziki, which is in front of the land of Hatti, I slew four mighty buffaloes with my great bow and iron arrows”—Prehistoric Times, p. 8.
  6. British Museum Catalogue of Chinese Coins, p. 9.
  7. Maspero, The Struggle of the Nations. p. 268.
  8. H. R. Hall’s Ancient History of the Near East, p. 263.
  9. Ibid. p. 370
  10. কিম্। তে। কৃণ্বন্তি। কীকটেষু। গাবঃ। ন। আশিরম্।—ঋক্ সংহিতা ৩।৫৩।১৪।
  11. গন্ধারিভ্যো মুজবদ্ভ্যোঽঙ্গেভ্যো মগধেভ্যঃ—অথর্ব্বসংহিতা ৫।২২।১৪।
  12. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, (সাহিত্য-পরিষৎ গ্রন্থাবলী ৩৪), ৺রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অনুবাদ (পৃঃ ৫৯৭)।
  13. মানবধর্ম্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণের অদর্শনে যে সকল ক্ষত্রিয়জাতির বৃষলত্ব প্রাপ্তি হইয়াছিল, তাহাদিগের নামের মধ্যে পৌণ্ড্রগণের নাম আছে—মানবধর্ম্মশাস্ত্র, ১০।৪৩-৪৪।
  14. ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায় মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চের-পাদান্যন্যা অর্কমভিতো বিবিশ্র ইতি।—ঐতরেয় আরণ্যক ২।১।১।
  15. V. A. Smith’s Early History of India, pp. 456-57.
  16. ঐতরেয়ব্রাহ্মণ, ৺রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অনুবাদ, পৃঃ ৬৬৩।
  17. শতপথ ব্রাহ্মণ ২।১।১।
  18. H. R. Hall’s The Ancient History of the Near East, pp. 171-174.
  19. Ibid. 206.
  20. Maspero’s Dawn of Civilisation, p. 757.
  21. Hall’s Ancient History of the Near East, p. 399.
  22. বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ্ সুহৃদ্বর রায় বাহাদুর পণ্ডিত হীরালাল এক বৎসর পূর্ব্বে এই কীলকলিপির আবিষ্কার-বার্ত্তা আমাকে জানাইয়াছিলেন। পরে তিনি ইহার একটি প্রতিলিপি ও ছাঁচ (plaster cast) আমার নিকট পঠাইয়া দিয়া আমাকে উহা ব্যবহার করিতে অনুমতি দিয়াছেন। যে ইউরোপীয় পণ্ডিত এই কীলকলিপির পাঠোদ্ধার করিয়াছেন তাঁহার নাম L. W. King; Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. X, 1914, pp. 461-63.
  23. Anderson’s Catalogue and Handbook of the Archaeological Collections in the Indian Museum, Calcutta. pt. II. p. 426; Indian Antiquary, Vol. II. p. 233.
  24. Maspero’s Dawn of Civilisation, p. 686.
  25. অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্রমগধেষু চ।
    তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন্‌ পুনঃ সংস্কারমর্হতি।

    বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস ১ম ভাগ, ১ম খণ্ডে প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় ইহা মনুর বাক্য বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ১ম ভাগ, ১ম অংশ পৃঃ ৫০, পাদটীকা ১)। সম্প্রতি অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মিত্র প্রমাণ করিয়াছেন যে, ইহা মানব ধর্ম্মশাস্ত্রের শ্লোক নহে—যশোহর খুলনার ইতিহাস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৪৯।

  26. বৌধায়ন ধর্ম্মসূত্র। ১।১।২।