বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক
আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক।
১৯৪৪ সালের ৫ই এপ্রেল নেতাজী সীমান্ত প্রদেশের যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করেন। রেঙ্গুণ হইতে যাত্রা করিবার কয়েক ঘণ্টা পূর্ব্বে চারিজন স্বদেশহিতৈষী ব্যক্তির সাহায্যে তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক স্থাপন করিলেন। প্রথমতঃ এক কোটী টাকা মূলধন লইয়া এই ব্যাঙ্কের কার্য্য আরম্ভ হইল। পরিশেষে ইহার কার্য্যবৃদ্ধি হইবার সঙ্গে সঙ্গে রেঙ্গুণের সহরতলীতে দুইটি এবং টঙ্গি (Taunggy) নামক স্থানে একটি মোট তিনটি শাখাও স্থাপিত হইল। হবিব সাহেব নামে ব্রহ্মের একজন স্বদেশপ্রেমিক এবং শ্রীমতী হীরাবাঈ বেতাই নামে একজন ধনাঢ্যা রমণী তাঁহাদের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ এই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করিবার জন্য নেতাজীর হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। হবিব সাহেবের ধনসম্পত্তি এক কোটী টাকার উপর ছিল। এই দুই মহাপ্রাণ ব্যক্তির দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া ব্রহ্মদেশের অন্যান্য ভারতীয়গণ এই ব্যাঙ্কের ধন ভাণ্ডারে কোটী কোটী টাকা দান করিয়াছিলেন। পরে নেতাজী এই সকল স্বার্থত্যাগী এবং স্বদেশহিতৈষী ব্যক্তিগণকে সেবকই-হিন্দ উপাধিতে ভূষিত করিয়াছিলেন।
আজাদহিন্দ ব্যাঙ্ক রেঙ্গুণের ৯৪ নং পার্করোডে অবস্থিত ছিল। ইহা ব্রহ্মদেশীয় আইনানুসারে রেজিষ্টারি করা হয়। এই ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার পূর্ব্বে উক্ত প্রদেশে নেতাজী ভাণ্ডার (Nataji Fund) নামে একটি ধনভাণ্ডার খোলা হইয়াছিল। অস্থায়ী স্বাধীন গভর্ণমেণ্টের জন্য জনসাধারণের নিকট হইতে অর্থ সংগ্রহ করাই এই ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্য ছিল।
এই উপায়ে ব্রহ্মদেশে ১৫ কোটী এবং মালয়ে ৫ কোটী একুনে ২০ কোটী টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল। আজাদ গভর্ণমেণ্টের টাকা ভিন্ন জন সাধারণের টাকাও এই ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা হইত। ঐ টাকার পরিমাণ ৩০।৪০ লক্ষ হইবে। ১৯৪৫ সালের মে মাস পর্য্যন্ত এই ব্যাঙ্কের কাজ চলিয়াছিল। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট রেঙ্গুণ উদ্ধার করিবার সঙ্গে সঙ্গেই ইহার কাজ বন্দ হইয়া যায়। বন্দের সময়ে ব্যঙ্কে ৩৫ লক্ষ টাকা জমা ছিল।
নেতাজীর প্রতিষ্ঠিত আজাদ-হিন্দ ব্যাঙ্ক সম্বন্ধে সুবিখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা বিগত ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে যে একটি মনোজ্ঞ বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন, পাঠক পাঠিকাগণের অবগতির জন্য তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল।
ব্রহ্মদেশে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন তহবিলে যাঁহারা অর্থদান করিয়াছেন, শ্রীযুক্তা হীরাবাঈ বেতাই তাঁহাদের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মহিলা দাতা। তিনি বহু লক্ষ টাকার সোণা রূপা হীরক প্রভৃতির গহনা ও নগদ ৫১০০০ টাকা উক্ত ভাণ্ডারে দান করিয়াছেন, এবং ব্রহ্মদেশে রাণী ঝাঁসী বাহিনী গঠন করিবার জন্য বহু অর্থ সাহায্য করিয়াছেন। ভারতীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠানের (Indian Independence League) মহিলা শাখার সভানেত্রীরূপে ভারতীয় মহিলাদের সংগঠন কার্য্যে তিনি নিজের সমস্ত সময় নিয়োগ করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য প্রত্যেককে কিছু সাহায্য করিতে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯৪৪ সালের ২১ শে আগষ্ট কামায়ুদে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা দিবস পালনার্থে ভারতীয়দের যে সভা হইয়াছিল, সেই সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু শ্রীযুক্তা বেতাইয়ের কার্য্যের প্রশংসা করিয়া তাঁহাকে সেবক-ই-হিন্দ রৌপ্যপদক দ্বারা ভূষিত করেন। শ্রীযুক্ত বসু আনন্দ ও গর্ব্ব প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, জাতির কল্যাণ কার্য্যে নারীগণ পুরুষগণ অপেক্ষা পিছনে পড়িয়া নাই। নেতাজী আরও বলেন “শ্রীযুক্ত বেতাই শুধু যে তাঁহার নিজের সর্ব্বস্ব দান করিয়াছেন তাহা নহে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁহার স্বামী শ্রীযুত হেমরাজ বেতাইকেও বহু লক্ষ টাকার সম্পত্তি দান করিতে সম্মত করিয়াছেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় নারীদের অবদানের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন।”
গুজরাটে শ্রীযুক্ত হেমরাজ বেতাইয়ের জন্ম হয়। তিনি ব্রহ্মদেশের আজাদ-হিন্দ ব্যাঙ্কের অন্যতম ডিরেক্টার ছিলেন। তিনি ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুরে যান। তখন পূর্ব্ব এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইবার উদ্দেশ্যে নেতাজী বসু তাঁহাদিগকে একটি ফণ্ড গঠন করিতে বলেন। সেখানকার সকল সম্প্রদায়ের মধ্য হইতে ১৫ জন প্রতিনিধি লইয়া তখন একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঐ সনের ডিসেম্বর মাস পর্য্যন্ত উক্ত কমিটির কার্য্য হয়। পরে নূতন কমিটি গঠিত হয়। শ্রীযুত বেতাই নূতন কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। ফণ্ড খোলার পর ভারতীয়দের নিকট হইতে আশ্চর্য্য রকমের সাড়া পাওয়া যায়। ১৯৪৪ সালের ৫ই এপ্রেল যখন আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক খোলা হয়, তখন পূর্ব্ব এশিয়ার প্রত্যেক ভারতীয় উহাকে সাহায্য করিতে আরম্ভ করেন। ব্যাঙ্ক স্থাপনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৩০০টি একাউণ্ট খোলা হয়, এবং ডিপজিটের পরিমাণ হয় ২০ হইতে ২৫ লক্ষ টাকা। দুই মাসের মধ্যে ব্যাঙ্কের দুইটি শাখা খোলা হয়। কিছুদিন পরে টঙ্গি নামক স্থানে আর একটি শাখাও খোলা হয়।
ব্যাঙ্কের অন্যতম ডিরেক্টর শ্রীযুত দীননাথ বলেন যে নেতাজী কর্ত্তৃক আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠার পর আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক স্থাপন একান্ত প্রয়োজন হইয়াছিল। দুইটি উদ্দেশ্যে নেতাজী এই ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। প্রথমতঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণরূপে জাপানীদিগের সাহায্য-নিরপেক্ষ হইতে চাহিয়াছিলেন। দ্বিতীয়তঃ পূর্ব্ব এশিয়ার ভারতীয়দের অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রকে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাহায্যার্থে নিয়োগ করিতে চাহিয়াছিলেন। জাপানীরা তাঁহার এই মনোভাব মোটেই পছন্দ করিতনা। তাহারা সর্ব্বদা চেষ্টা করিত অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারতীয়েরা যেন তাহাদের অধীন হইয়া চলে। কিন্তু এবিষয়ে নেতাজী দৃঢ় মনোভাব পোষণ করিতেন।
ভারতের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করিতে পূর্ব্ব এশিয়ার ভারতীয়েরা নেতাজীর প্রেরণায় কিরূপ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল তাহার একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়া শ্রীযুত দীননাথ বলেন যে রেঙ্গুনে ও অন্যান্য স্থানে যে সকল সভাসমিতি তাঁহারা আহ্বান করিয়াছিলেন, তাহাতে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, নেতাজীর ফুলের মালা এক লক্ষ টাকায় নীলামে বিক্রয় হইলে নেতাজীকে অপমানই করা হইবে। অবশেষে সেই ফুলের মালা ১২ লক্ষ টাকায় বিক্রয় হইয়াছিল।