বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/রাজনৈতিক ইচ্ছাপত্র

রাজনৈতিক ইচ্ছাপত্র।

বা

Political Testament

 হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণ করিবার সঙ্গে সঙ্গে সুভাষবাবুকে কারারুদ্ধকরিয়া রাখিবার আর কোন প্রয়োজন নাই বুঝিতে পারিয়াও ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট তাঁহাকে মুক্তিদান করিলেন না। ইতিপূর্ব্বে তিনি মহম্মদ আলি পার্কে এক বক্তৃতা দিয়াছিলেন এবং ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকায় ‘হিসাব নিকাশের দিন’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। এই উভয়ই রাজদ্রোহ সূচক আখ্যা দিয়া ভারত রক্ষা আইন অনুসারে গভর্ণমেণ্ট তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিলেন।

 সুভাষবাবু এই অবরোধ অত্যন্ত অসঙ্গত বলিয়া মনে করিলেন। যদিও তাঁহার স্বাস্থ্য একেবারেই ভঙ্গ হইয়া গিয়াছিল, তথাপি তিনি ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের অন্যায় আদেশের প্রতিবাদকল্পে অনশন ধর্ম্মঘট করিবার সঙ্কল্প করিলেন। কিন্তু এই আত্মঘাতী ব্যবস্থা অবলম্বন করিবার পূর্ব্বে ১৯৪০ সালের ২৬শে নভেম্বর তারিখে তিনি বাঙ্গালার গভর্ণর বাহাদুর, মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার নিকট যে পত্রখানি লিখিয়াছিলেন, তাহা ভারতের ইতিহাসে চিরদিন সুবর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। তিনি এই পত্রকে “Political Testament” বা রাজনৈতিক ইচ্ছাপত্র নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই পত্রের সারাংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইল।

 “এই পত্রে আমি আমার আত্মকাহিনী সম্বন্ধে যাহা কিছু বলিবার আছে তাহা বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিব, এবং যে কারণে আমি এই আত্মঘাতী ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছি তাহাও লিপিবদ্ধ করিব।”

 “আমার অবস্থা সম্বন্ধে আপনাদের নিকট যে কোন প্রতীকার পাইব, আমার এরূপ আশা নাই। সুতরাং আমি আপনাদিগকে দুইটি অনুরোধ করিব। আমার প্রথম অনুরোধ এই যে আপনারা আমার এই পত্রখানি গভর্ণমেণ্টের দপ্তরখানায় সযত্নে রক্ষা করিবেন। আমার দেশবাসিগণ—যাঁহারা আপনাদের উত্তরাধিকারী হইবেন, তাঁহারা যেন প্রয়োজন হইলে উহা প্রাপ্ত হইতে পারেন। আমি তাঁহাদের জন্য এই অন্তিমকালীন সংবাদ রাখিয়া যাইতেছি। ইহাকে আমার “Political Testament” বা রাজনৈতিক ইচ্ছাপত্র আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে।

 আমার সম্বন্ধে ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট যে আইন-বিরুদ্ধ ও অসঙ্গত কার্য্য করিতেছেন, তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য আমি এই বুঝিতে পারিয়াছি যে তাঁহারা প্রতিহিংসার বশবর্ত্তী হইয়াই এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কিন্তু এইরূপ প্রতিহিংসা-পরায়ণতার কারণ কি তাহা আমার নিকট দুর্ব্বোধ্য রহিয়াছে। এতাদৃশ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আমার কর্ত্তব্য কি আমার অন্তঃকরণকে আমি বার বার এই প্রশ্ন করিতেছি। আমার অদৃষ্টে যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহাই কি আমি মানিয়া লইব? অথবা অন্যায় অসঙ্গত এবং আইনবিরুদ্ধ কার্য্যের তীব্র প্রতিবাদ করিব? অনেক চিন্তা করিয়া আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে এই সকল প্রতিকূল অবস্থার নিকটে বশ্যতা স্বীকার করা আমার পক্ষে কোনও মতে সম্ভবপর নহে। এই সকল নীতি-বিরুদ্ধ ও আইন-বিরুদ্ধ কার্য্য করিলে যে পরিমাণে ধর্ম্মহানি হইতে পারে, ইহাদিগকে মানিয়া লইলে তাহা অপেক্ষা অধিকতর মহাপাতকের সঞ্চার হইবে সুতরাং ইহার প্রতিবাদ আমাকে করিতেই হইবে।

 কিন্তু আমি এতদিন যে ভাবে প্রতিবাদ করিয়াছি, তাহা আমার অরণ্যে রোদন করা হইয়াছে। সংবাদ পত্রে আন্দোলন, বক্তৃতা মঞ্চ হইতে নানাবিধ যুক্তি প্রদর্শন, গভর্ণমেণ্টের নিকটে আবেদন নিবেদন, ব্যবস্থাপক সভায় অশেষবিধ দাবির উল্লেখ প্রভৃতি নানাবিধ উপায় অবলম্বন করিয়াও আমি সুফল লাভ করিতে পারি নাই। এখন আমার পক্ষে একটি মাত্র পথ উন্মুক্ত আছে—তাহা হইতেছে—অনশন ধর্ম্মঘট।

 অনশন অবলম্বন করিলে কি লাভ হইবে তাহাও আমি চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি। অনশন অবলম্বন করিয়া ব্রিটিশগভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে আমি যে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি প্রাপ্ত হইবনা তাহাও আমি বিশেষরূপে অবগত আছি। সুতরাং অনশনব্রত অবলম্বন করিয়া আমি লাভবান হইবনা ইহাও একপ্রকার সুনিশ্চিত। Terence Macswiney এবং যতিনদাসের দৃষ্টান্ত আমি মানস নেত্রে অবলোকন করিতেছি। আমি বিশেষরূপেই অবগত আছি হৃদয়হীনতা ও মিথ্যা আত্ম-সম্মান বোধ ভিন্ন সেখানে আর কিছুই নাই।

 বর্ত্তমান অবস্থায় আমার জীবন দুর্ব্বিসহ বোধ হইতেছে। বিধিবিরুদ্ধ বা আইন-বিরুদ্ধ কার্য্যের সহিত আপোষ মীমাংসা করিয়া কোনওমতে নিজের সত্বাকে বজায় রাখা আমার প্রবৃত্তির একেবারেই বিরুদ্ধে। এরূপ মূল্য দিয়া জীবন রক্ষা করা অপেক্ষা জীবন বিসর্জ্জন দেওয়াই আমি শ্রেয়ঃ মনে করিতেছি। গভর্ণমেণ্ট পাশবিক বল প্রয়োগ করিয়া আমাকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিতে ইচ্ছা করেন, ইহার প্রতিবাদ কল্পে আমি বলিতে চাই, আমাকে মুক্তিদান করা হউক, নতুবা আমি মৃত্যুকে বরণ করিব। আরও বলিতে চাই যে আমার জীবন মরণ সমস্যা আমি নিজেই সমাধান করিব।

 এইরূপভাবে জীবন বিসর্জ্জন করিলে আপাততঃ কোনও লাভ হইবেনা একথা সত্য বটে; কিন্তু স্বার্থত্যাগ মাত্রেরই একটা সুফল আছে। একমাত্র স্বার্থত্যাগ ও আত্মবলিদান করিতে পারিলেই এক একটি মহৎ উদ্দেশ্য সংসাধিত হইতে পারে—ইহা সবদেশে এবং সর্ব্বকালেই একটি চিরন্তন সত্য। যাহারা ধর্ম্মার্থে জীবন বিসর্জ্জন করে, তাহাদের রক্তবিন্দুর উপরেই ধর্ম্মমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

 এই নশ্বর জগতে সকল পদার্থই ধ্বংশ প্রাপ্ত হইবে। কিন্তু সংস্কার বা আদর্শের ধ্বংশ নাই। একজন আদর্শবাদীর মৃত্যু হইতে পারে, কিন্তু তাহার মৃত্যুর পরে সেই আদর্শ সহস্র সহস্র ব্যক্তির অন্তরে মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া থাকে। বিবর্ত্তন বা ক্রমবিকাশের চক্র এইরূপেই ঘূর্ণায়মান হয় এবং পূর্ব্বপুরুষের ভাবধারা এইরূপেই পরবর্ত্তী পুরুষে সংক্রমিত হইতে থাকে। অশেষ দুঃখ কষ্ট এবং জীবন-ব্যাপী স্বার্থত্যগে র অগ্নিপরীক্ষার দ্বারাই এক একটি ভাবধারা পরিস্ফুট হইয়া সুফল প্রসব করে।

 কোন একটি মহৎ উদ্দেশ্য লইয়া সমগ্র জীবন অতিবাহিত করা এবং সেই উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য জীবন পর্য্যন্ত উৎসর্গ করা অপেক্ষা মানবের অধিকতর সান্ত্বনার বিষয় আর কি থাকিতে পারে? দেহাবসান হইলেও আত্মা জীবনের অসম্পূর্ণ কার্য্য সম্পাদন করিবার জন্য সমজাতীয় কতকগুলি আত্মার সৃষ্টি করিবে, ইহা অপেক্ষা অধিক তৃপ্তি আর কিসে হইতে পারে? প্রেরিত সংবাদ নদনদী পর্ব্বত প্রান্তর অতিক্রম করিয়া জন্মভূমির প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিব্যাপ্ত হইবে, এমন কি বিশাল বারিধিবক্ষ লঙ্ঘন করিয়া বিদেশীয়গণের উপরেও প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে ইহা অপেক্ষা আনন্দের বিষয় আর কি হইতে পারে? দেশ-মাতৃকার বেদীমূলে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মবলিদান করা অপেক্ষা মানবের আর কিছু কাম্য থাকিতে পারে বলিয়া আমার মনে হয় না।

 এখন স্পষ্টই বুঝিতে পারা যাইতেছে যে জীবনব্যাপী দুঃখ কষ্ট ভোগ করিয়া অথবা আত্মপ্রাণ বলি দিয়াও কোনও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। পার্থিব জীবনে হয়ত তাহার কিঞ্চিৎ ক্ষতি হইতে পারে, কিন্তু তাহার বিনিময়ে অমর জীবন লাভ করিয়া সেই ব্যক্তি শত সহস্রগুণে লাভবান হইতে পারে। ইহাই আত্মার বিশেষত্ব। জাতিকে বাঁচাইতে হইলে ব্যক্তিগত জীবন বলি দিতে হইবে। ভারত বাঁচিয়া থাকিবে এবং স্বাধীনতা অর্জ্জন করিয়া গৌরবের উচ্চশিখরে আরোহণ করিবে এই আশায় আজ আমাকে জীবন উৎসর্গ করিতে হইবে।

 উপসংহারে আমি আমার স্বদেশবাসীগণকে আমার অন্তিম কালের এই বাণী প্রেরণ করিতেছি—

 হে ভ্রাতৃগণ! ভুলিওনা দাসত্ব-শৃঙ্খল পরিয়া জীবন্মৃত হইয়া বাঁচিয়া থাকার ন্যায় অভিশাপ জগতে আর কিছুই নাই।

 ভুলিওনা—অন্যায় ও অবিচারের সহিত আপোষ মীমাংসা করিয়া বাঁচিয়া থাকার ন্যায় হীন ও জঘন্য অপরাধ জগতে আর কিছুই নাই।

 স্মরণ রাখিবে—মূল্যবান কিছু লাভ করিতে হইলে তোমার সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় পদার্থই দান করিতে হইবে—ইহাই শাশ্বত নিয়ম।

 স্মরণ রাখিবে—জীবন মরণকে তুচ্ছজ্ঞান করিয়া দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামে রত থাকার ন্যায় মহান্ ধর্ম্ম এজগতে আর কিছুই নাই।

 বর্ত্তমান শাসন কর্ত্তৃগণের উদ্দেশে আমি বলিতে চাই—অন্যায় অবিচার ও স্বৈরাচারের পথে উন্মাদের ন্যায় বিচরণ করিতে ক্ষান্ত হও। এখনও প্রতিনিবৃত্ত হইবার সময় আছে। যে অস্ত্র ফিরিয়া আসিয়া তোমারই বক্ষে বিদ্ধ হইবে, তাহা কদাচ নিক্ষেপ করিও না।

 আমার দ্বিতীয় এবং শেষ অনুরোধ এই যে আমার শান্তিময় মৃত্যুর প্রতিবন্ধক হইয়া পাশবিকবল প্রয়োগ করিতে প্রবৃত্ত হইওনা। Terence Macswiney, যতিন দাস, মহাত্মা গান্ধী এবং ১৯২৬ সালে আমি যখন অনশন আরম্ভ করি, গভর্ণমেণ্ট সঙ্কল্প করিয়াছিলেন যে তাঁহারা এব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবেন না। আমি আশা করি বর্ত্তমান ক্ষেত্রেও তাঁহারা ঐ নীতিই অবলম্বন করিবেন। অপর পক্ষে পাশবিক বলে আমার অনশন ব্রত ভঙ্গ করিবার চেষ্টা করিলে, আমি যথাসাধ্য বাধা প্রদান করিতে পরাঙ্মুখ হইবনা, এবং তাহার পরিণাম হয়ত ভয়ঙ্কর শোচনীয় হইতে পারে। আমি ১৯৪০ সালের ২৯শে নভেম্বর তারিখে অনশন আরম্ভ করিব।

 ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট ভালরূপই জানিতেন যে এই পত্র কোন দুর্ব্বলচেতা রাজনীতিবিদের পত্র নহে, পরন্তু ইহা একজন দৃঢ়চেতা সংগ্রামশীল স্বদেশ-প্রেমিকের পত্র—যিনি নিজের নির্দ্দিষ্ট নিয়ম প্রতিপালন করিবার জন্য যে কোনও মুহূর্ত্তে প্রাণ বিসর্জ্জন করিতে পারেন। গভর্ণমেণ্ট কিয়ৎকালের জন্য এবিষয়ে উচ্চবাচ্য করিলেন না, কিন্তু সুভাষচন্দ্রের অনশন আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহারা এই রাজবন্দীকে মুক্তিদানের আদেশ দিলেন। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে তাঁহার বিরুদ্ধে যে দুইটি অভিযোেগ আনীত হইয়াছিল, তিনি আরোগ্য না হওয়া পর্য্যন্ত তাহা স্থগিত রহিল। মুক্তিলাভের পর সুভাষচন্দ্র তাঁহার এলগিন রোডের বাটীতে বাস করিতে লাগিলেন।