বাজী রাও/পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়।
নিজাম-উল্-মুল্কের কুটিলতা—পালখেড়ের
যুদ্ধ—নিজামের পরাজয়।
কর্ণাটের যুদ্ধব্যাপারের পর হইতে বাজী রাও নিজাম-উল্-মুল্কের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিলেন। এতদিন দুই একটা সামান্য খণ্ডযুদ্ধে নিজামের কোন কোনও সেনানী বাজী রাওয়ের হস্তে পরাভূত হইলেওনিজামের লক্ষ্য। তিনি তৎপ্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন নাই। কিন্তু কর্ণাটের যুদ্ধে বিশেষরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া তিনি মহারাষ্ট্রীয়দিগের প্রচণ্ড শক্তির প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হইলেন। সুতরাং তাঁহাদিগের অভ্যুদয়-নিবারণ তাঁহার পক্ষে একান্ত আবশ্যক হইয়া উঠিল। প্রকৃত পক্ষে মহারাষ্ট্রীয়েরাই এই সময়ে নিজাম-উল্-মুল্কের একমাত্র ভীতির স্থল ছিলেন। দিল্লীর দরবারে প্রাধান্য লাভ করা এতদিন নিজামের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল; কিন্তু এক্ষণে সে লক্ষ্য পরিবর্ত্তিত হইল। ১৭২২ খৃষ্টাব্দে তিনি দিল্লীতে গিয়া বাদশাহী দরবারের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা সন্দর্শন করিলেন, তাহাতে বাদশাহের প্রধান মন্ত্রীর পদলাভ তাঁহার নিকট গৌরবকর বলিয়া বোধ হইল না। সুতরাং অল্পদিনের মধ্যেই তিনি দিল্লীর পদত্যাগ-পূর্ব্বক দক্ষিণাপথে আসিয়া স্বীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা-পরিতৃপ্তির স্বতন্ত্র ক্ষেত্র প্রস্তুত করিবার সংকল্প করিলেন। তিনি প্রথমেই দিল্লীর বাদশাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া আপনাকে দক্ষিণাপথের স্বাধীন নরপতি বলিয়া প্রচার করেন। দিল্লীর বাদশাহের জন্য তাঁহার কোনও ভয় ছিল না। দাক্ষিণাত্যে অক্ষুণ্ণ আধিপত্যস্থাপন-বিষয়ে মহারাষ্ট্রীয়েরাই তাঁহার নিকট বিঘ্নস্বরূপ বলিয়া বিবেচিত হইলেন। এই কারণে তাঁহাদিগের অধঃপাতসাধনই এখন হইতে তাঁহার জীবনের মূলমন্ত্র হইল ।
মহারাষ্ট্রীয়েরা মালব বিজয়-পূর্ব্বক গুজরাথ ও উত্তর ভারতে আপনাদের অধিকার-বিস্তারেনিজামের সন্তোষ। মনোযোগী হইয়াছেন দেখিয়া নিজাম প্রথমতঃ মনে মনে কিয়ৎ পরিমাণে সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। কারণ তিনি ভাবিয়াছিলেন, মহারাষ্ট্রীয়দিগের দৃষ্টি উত্তরভারতের দিকে নিবদ্ধ থাকিলে তিনি বলসঞ্চয়ের অবকাশ পাইবেন। তদ্ভিন্ন বাদশাহের সহিত মহারাষ্ট্রীয়দিগের যুদ্ধবাধিলে উভয় পক্ষেরই দৌর্ব্বল্য ঘটিবার সম্ভাবনা—অন্ততঃ বাদশাহের শক্তি তাহাতে ক্ষয়িত হইবে। কিন্তু কর্ণাটকের যুদ্ধে মহারাষ্ট্র-শক্তির সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। তখন তিনি মহারাষ্ট্রীয়দিগের হস্ত হইতে আত্মরক্ষার উপায় অবলম্বনে প্রবৃত্ত হইলেন।
মোগল বাদশাহের প্রদত্ত সনন্দের বলে মহারাষ্ট্রীয়েরা প্রতি বৎসর নিজামের রাজ্য হইতেনিজামের কৌশল। চৌথ ও সরদেশমুখী-বিষয়ক কর আদায় করিতেন। তদুপলক্ষে তাঁহার রাজ্যে প্রতি বৎসর মহারাষ্ট্রীয়দিগের গতিবিধি হইত। তাহা বন্ধ করিবার জন্য তিনি শাহুর নিকট প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন যে, মহারাজ যদি নিজাম রাজ্যের চৌথ ও সরদেশমুখীর স্বত্ব ত্যাগ করেন, তাহা হইলে নিজাম তাঁহাকে একেবারে কয়েক কোটী টাকা নগদ ও তাঁহার শাসনাধীন ইন্দাপুরের নিকটস্থ কয়েকটী পরগণা নিষ্কর জায়গীর-স্বরূপ প্রদান করিবেন। বাজী রাও এই প্রস্তাবে কখনই সম্মত হইবেন না, ইহা নিজামের অবিদিত ছিল না। এই কারণে বাজী রাওয়ের রাজধানীতে অনুপস্থিতি কালে তিনি মহারাজ শাহুর নিকট এই প্রস্তাব উপস্থাপিত করেন। রাজসভায় তাঁহার প্রস্তাবের সমর্থন করিবার জন্য তিনি প্রতিনিধি শ্রীপতিরাও মহাশয়কে বেরার অঞ্চলে জায়গীর দিবার লোভ দেখাইয়া বশীভূত করিয়াছিলেন। লঘুমতি প্রতিনিধি মহারাজ শাহুকে বুঝাইয়া দিলেন যে, নিজামের প্রস্তাবমত কার্য্য করিলে মহারাষ্ট্রীয়দিগের বিশেষ লাভ হইবে। কাজেই সরলমতি শাহু ঐ প্রস্তাবে সম্মতি দান করিলেন।
এমন সময়ে অওরঙ্গাবাদ অঞ্চল হইতে [১] বাজী রাও সহসা সাতারায় প্রত্যাবৃত্ত হইলেন।কৌশল-ভেদ। তিনি এই ঘটনার বিষয় শ্রবণমাত্র নিজামের কৌশল বুঝিতে পারিলেন। তিনি মহারাজ শাহুকে বুঝাইলেন যে,“কোনও কারণে নিজাম রাজ্যে চৌথ ও সরদেশমুখী আদায়ের স্বত্ব পরিত্যাগ করিলে উক্ত রাজ্যে আমাদিগের সার্ব্বভৌম প্রতিপত্তির হানি হইবে এবং নিজামের মহারাষ্ট্র-ভীতি কমিয়া গিয়া তিনি আমাদিগের বিরুদ্ধে গুপ্ত ষড়যন্ত্র করিবার সুবিধা পাইবেন।” মহারাজ শাহু পেশওয়ের যুক্তির সারবত্তা উপলব্ধি করিয়া পূর্ব্বোক্ত প্রস্তাবে স্বীয় অসম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। এই ঘটনায় প্রতিনিধির উপর মহারাজের অসন্তোষ জন্মিল এবং বাজী রাওয়ের প্রতি শ্রীপতি রাও বদ্ধবৈর হইলেন।
এই চাতুরী-জাল ছিন্ন হওয়ায় নিজাম আর এক কৌশল অবলম্বন করিলেন। তিনিনিজামের কুটিলতা। কোহ্লাপুরের সাম্ভাজীর পক্ষ অবলম্বন করিয়া মহারাষ্ট্র-সমাজে গৃহ-বিবাদানল প্রজ্বলিত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বর্ষশেষে শাহুর কর্ম্মচারিবর্গ চৌথ ও সরদেশমুখীর প্রাপ্য টাকা আদায় করিবার জন্য নিজামরাজ্যে উপস্থিত হইলে নিজাম বলিলেন, “মহারাজ শাহু ও মহারাজ সাম্ভাজী উভয়েই আমার নিকট মহারাষ্ট্রীয়গণের প্রাপ্য চৌথ প্রার্থনা করিতেছেন। এ অবস্থায় মহারাষ্ট্র রাজ্যের প্রকৃত অধিপতি কে, তাহা নির্ণীত না হইলে আমি চৌথ ও সরদেশমুখীর টাকা কাহাকেও প্রদান করিতে পারি না।” এই কথা বলিয়া তিনি মহারাজ শাহুর কর্ম্মচারীদিগকে স্বরাজ্য হইতে বিতাড়িত করিয়া দিলেন। নিজামের এ কৌশলও বাজী রাওয়ের নিকট অপরিজ্ঞাত রহিল না। তিনি বলিলেন, “চৌথ আদায় করিবার বাদসাহী সনন্দ যাঁহার নামে আছে, নিজাম তাঁহাকেই চৌথ দিতে বাধ্য। মহারাষ্ট্র রাজ্যের অধিকারী নির্ণয় করিবার তিনি কে? ফলতঃ মহারাজ সাম্ভাজীর সহিত আমাদিগকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিয়া উভয়ের বিনাশসাধনই নিজামের উদ্দেশ্য।” বাজী রাওয়ের এই কথায় শাহু নিজামের কার্য্য গর্হিত বলিয়া স্থির করিলেন এবং তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া চৌথ ও সরদেশমুখী আদায় করিবার হুকুম দিলেন। তদনুসারে ১৭২৭ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বাজী রাও রাজ্যের যাবতীয় যোদ্ধৃপুরুষদিগকে লইয়া অভিযানের আয়োজন করিলেন। নিজামও অওরঙ্গাবাদে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। বলা বাহুল্য, তিনি কোহ্লাপুরের মহাবাজ সাম্ভাজীকে ইতঃপূর্ব্বেই হস্তগত করিয়া তাঁহাকে শিখণ্ডীর ন্যায় স্বীয় সেনাদলের পুরোভাগে স্থাপন করিয়াছিলেন।
এই সময়ে নিজামের সহিত যে যুদ্ধ হয়, তাহাতে বাজী রাওয়ের অসাধারণ রণ-নৈপুণ্য প্রকাশপেশওয়ের কৌশল। পায়। তিনি প্রথমে নিজামের শাসনাধীন জাল্না প্রদেশে প্রবেশ করিয়া মোগলদিগকে লুণ্ঠন করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য ইওয়াজ খান নামক নিজামের একজন সর্দ্দার সসৈন্যে অগ্রসর হইলে তাঁহার সহিত কিয়ৎকাল সামান্যভাবে যুদ্ধ করিয়া, বাজী রাও প্রথমে মাহুর নগরের দিকে ও পরে একেবারে অওরঙ্গাবাদের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। অতঃপর তিনি বুহ্রানপুর লুণ্ঠন ও ভস্মসাৎ করিবার ভয় দেখাইয়া খানদেশে প্রবেশ করিলেন। তদ্দর্শনে নিজাম স্বীয় দলবল সহ বুহ্রানপুর-রক্ষার আয়োজন করিতে লাগিলেন। নিজামের সমস্ত সৈন্য বুহ্রানপুর অঞ্চলে সমবেত হইয়াছে দেখিয়া বাজীরাও স্বল্পসংখ্যক সৈন্য ঐ প্রদেশে প্রেরণপূর্বক প্রধান প্রধান সেনানী সহ সহসা গুজরাথে প্রবেশ ও তথাকার সুভেদার সরবুলন্দ খানকে যুদ্ধে জর্জ্জরিত করিয়া গুজরাথের বহু স্থান লুণ্ঠন করিলেন।
এ দিকে নিজাম তাঁহার অপেক্ষায় বুহ্রানপুরে বহুদিন যাপন করিলেন। অতঃপর, বাজীরাওয়েরঅবরোধে নিজাম। গুজরাথ আক্রমণের সংবাদ তাঁহার কর্ণগোচর হইল। যুবকের হস্তে এইরূপে প্রতারিত হওয়ায় ক্রুদ্ধ হইয়া তিনি পুণা দগ্ধ করিবার উদ্দেশে দক্ষিণমুখে যাত্রা করিলেন। বাজী রাও এই সংবাদ-প্রাপ্তি-মাত্র শ্যেনবৎ বেগে গুজরাথ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন,এবং মোগল শাসিত প্রদেশ লুণ্ঠন করিতে করিতে আহম্মদনগরের নিকটে আসিয়া নিজামের পৃষ্ঠদেশ আক্রমণ করিলেন। বাজী রাওকে পৃষ্ঠোপরি সমাগত দেখিয়া নিজামকে পুণার আভিমুখ্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইল। সুচতুর বাজী রাও তাহার সহিত বিবিধ খণ্ডযুদ্ধে ক্রমশঃ পশ্চাৎপদ হইয়া গোদাবরী-তীরবর্ত্তী পালখেড় নামক এক অতি বিকট স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য, নিজাম তখনও স্বীয় বিপদ আদৌ বুঝিতে পারেন নাই। এদিকে বাজী রাও শত্রুপক্ষীয় সৈন্যের চতুষ্পার্শ্ববর্তী অরণ্য দগ্ধ করিয়া তাহাদিগের আশ্রয়-গ্রহণের স্থান বিনষ্ট করিলেন। ইহার পর মহারাষ্ট্রীয় সৈনিকেরা চতুর্দ্দিক্ হইতে বেষ্টন-পূর্ব্বক সসৈন্য নিজামকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করিয়া ফেলিল। তখন নিজাম বাহাদুর স্বীয় অবস্থা বুঝিতে পারিয়া প্রাণপণে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। নিজামের তোপখানা মহারাষ্ট্রীয়দিগের তোপখানা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ছিল। সুতরাং সে যুদ্ধে বহুসংখ্যক মহারাষ্ট্র-সৈন্য বিনষ্ট হইল। তথাপি বাজী রাও বিচলিত হইয়া স্থানত্যাগ করিলেন না, এবং নিজামের সৈন্যদল যাহাতে নিকটবর্তী প্রদেশ হইতে কোনরূপে খাদ্যাদির সংগ্রহ করিতে না পারে, তাহার জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিলেন।
নিজামের সঙ্গে কোহ্লাপুরের মহারাজ সাম্ভাজী চন্দ্রসেন যাদব, রাও রম্ভা নিম্বালকরনিজামের দুর্দ্দশা। প্রভৃতি মারাঠা সেনানী ছিলেন। নিজাম তাহাদিগের সাহায্যে বাজী রাওয়ের পরাভবসাধনের জন্য মহারাজ সাম্ভাজীকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহাদিগের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ ঘটায় নিজামের দলে মহা গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। চন্দ্রসেন বলিলেন,— “আমার সৈন্যদলে মোগল সৈনিকের সংখ্যাই অধিক, তাহারা মারাঠাদিগের ন্যায় সমরকুশল ও কষ্টসহিষ্ণু নহে। এরূপ অবস্থায় আমি একাকী কি করিব”? সাম্ভাজী বলিলেন, “আমার সৈন্যসংখ্যা নিতান্ত সামান্য; পরন্তু আমার কর্মচারীরা গোপনে বাজীরাওয়ের পক্ষাবলম্বন করিয়াছে বলিয়া আমার সন্দেহ হইতেছে। অতএব তাহাদিগের হস্তে আমার প্রাপ্য অর্থ প্রদান করিবেন না।” তাঁহার কর্মচারীরা বলিতে লাগিল, “সাম্ভাজীর হস্তে অর্থদান করিলে তিনি বিলাস-ব্যসনে তাহা ব্যয় করিয়া ফেলিবেন এবং আমাদিগকে অনশন কষ্ট ভোগ করিতে হইবে, সৈন্যেরাও বিদ্রোহী হইয়া উঠিবে”। নিজাম বলিতে লাগিলেন, “তোমরাও মহারাষ্ট্রীয়, বাজী রাও-ও মহারাষ্ট্রীয়। তথাপি তোমরা তাহার কৌশল বুঝিতে না পারিয়া স্বয়ং বিপন্ন হইলে এবং আমাকে ও বিপন্ন করিলে। তোমাদের উপর নির্ভর করিয়াই আমার এই দুর্দ্দশা ঘটিল!” এইরূপ বৃথা কলহে কয়েক দিন অতিবাহিত হইল। কিন্তু কেহই আসন্ন বিপদ হইতে অব্যাহতি-লাভের উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলেন না। এদিকে খাদ্যাভাবে সকলেই দীনভাব ধারণ করিল। বাজী রাওয়ের সৈন্যদল হইতে শন্ শন্ শব্দে গুলি আসিয়া অনেকের ইহলীলা সাঙ্গ করিতে লাগিল। তখন নিরুপায় হইয়া নিজাম-উল্-মুল্ক সন্ধি প্রার্থী হইলেন ও তাঁহার অনশন-ক্লিষ্ট অনুচরগণের জন্য বাজী রাওয়ের নিকট খাদ্য দ্রব্যাদির প্রার্থনা করিতে লাগিলেন।
এই সময়ে অন্যান্য মহারাষ্ট্রীয় সেনানীগণ নিজামের সম্পূর্ণ বিনাশসাধনের জন্য বাজীমহত্ত্ব ও সন্ধি। রাওকে কঠোরতা অবলম্বনপূর্ব্বক যুদ্ধ চালাইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু মহানুভাব বাজী রাও তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন, “বিপন্ন শত্রুকে পীড়িত করা বীরধর্ম্মের অনুমোদিত কার্য্য নহে। এই অবস্থায় নিজামকে রসদ দিয়া ও সহায়তা করিয়া তাঁহার সহিত সন্ধি স্থাপন করাই কর্তব্য।” তদনুসারে উভয় পক্ষের কথাবার্তায় স্থির হইল,—
(১) নিজাম-উল্-মুল্ক কোলাপুরের সাম্ভাজীর পক্ষ পরিত্যাগ করিবেন।
(২) নিজাম রাজ্যে যে সকল মহারাষ্ট্রীয় কর্মচারী প্রতি বৎসর চৌথ প্রভৃতি আদায় করিতে গমন করেন, তাঁহাদিগের রক্ষার জন্য নিজাম স্বরাজ্যস্থ কতিপয় দুর্গ মহারাষ্ট্রীয়দিগকে দান করিবেন।
(৩) এবং চৌথ ও সরদেশমুখী সংক্রান্ত সমস্ত প্রাপ্য অবিলম্বে পরিশোধ করিবেন।
১৭২৮ খৃষ্টাব্দের ৬ই মার্চ্চ এই সন্ধি স্থাপিত হয়।
অতঃপর নিজাম বাজী রাওকে অভ্যর্থিত করিবার জন্য স্বীয় শিবিরে আহ্বান করিলেন।পেশওয়ের সাহস। অসাধারণ সাহসসম্পন্ন বাজী রাও দুই তিন জন মাত্র ভৃত্যসহ একাকী শত্রুশিবিরে গমনপূর্ব্বক নিজামের অভ্যর্থনা গ্রহণ করিলেন। কথিত আছে, বাজী রাও নিজামের শিবিরে প্রবেশ করিলে মোগল সুভেদার তাঁহার সাহস পরীক্ষার জন্য একদল অস্ত্রধারী প্রহরীকে আহ্বান করেন। তাঁহার ইঙ্গিতক্রমে প্রহরিগণ বাজী রাওকে হত্যা করিবার ভয় প্রদর্শন করিয়া সহসা তাহার বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলিত করে। তখন নিজাম জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কেমন, বাজী রাও! এখন তোমার প্রিয় সর্দ্দার শিন্দে হোলকর কোথায়? এই প্রহরিদল তোমায় আক্রমণ করিলে এখন কে তোমার রক্ষা করিবে?” এই কথা শুনিবা মাত্র বাজী রাও অসি নিষ্কোশিত করিয়া বলিলেন,— “আমার হস্তে এই তরবারি থাকিলে আমি এরূপ সহস্র প্রহরীর ব্যুহ ভেদ করিয়া আত্মরক্ষা করিতে পারি। কিন্তু ভবাদৃশ ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাসঘাত করিবেন বলিয়া আমার বোধ হয় না। তবে যদি এরূপ দুর্ঘটনাই ঘটে, তবে আমার শিন্দে হোলকর আমার নিকটেই থাকিবেন।” বাজীরাও এই কথা সমাপ্ত করিতে না করিতে সামান্য ভৃত্যবেশী রাণোজী শিন্দে ও মহ্লার রাও হোলকর অগ্রসর হইয়া নিজামকে সেলাম করিলেন! নিজাম এই ব্যাপারে বাজীরাওয়ের অসাধারণ সাহস ও সারল্য দর্শনে অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া বলিলেন,—“ইস্ মুল্কমে এক বাজী, ঔর সব পাজী!” অর্থাৎ এজগতে এক বাজীরাও ভিন্ন আর সকলেই পাজী (অধম)।”
- ↑ বাজী রাও কর্ণাট প্রদেশে যাত্রা করিলে নিজাম আপনার কতিপয় সর্দ্দারের প্রতি ঐ অঞ্চলের রক্ষার ভার অর্পিত করিয়া স্বয়ং মহারাষ্ট্রদেশের উত্তরাঞ্চল আক্রমণের আয়োজন করেন। এই কারণে বাজী রাওকে কর্ণাট হইতে প্রত্যাবর্তনের পর নিজামের অওরঙ্গাবাদ স্থিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে যাত্রা করিতে হয়। সেই অবকাশে নিজাম উল্লিখিত প্রস্তাব শাহুর নিকট উপস্থাপিত করিয়াছিলেন।