বাজী রাও/চতুর্থ অধ্যায়

চতুর্থ অধ্যায়।

মালবে অভিযান—দরবারে বক্তৃতা—চরিত্র

ও চিত্র—নূতন সৈন্য—কর্ণাট যাত্রা।

নিজাম উল্-মুস্কের বিদ্রোহের জন্য ১৭২০ খৃঃ খানদেশ হইতে মহারাষ্ট্রীয়দিগের প্রাপ্য চৌথ ও সরদেশমুখী সংক্রান্ত রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন উপস্থিতমালবে বাজী রাও। হয়। বাজীরাও পেশওয়ে হইয়াই শুনিলেন যে, খানদেশের মোগলেরা মহারাষ্ট্রীয় কর্ম্মচারীদিগের আদায় কার্য্যে বাধা দিতেছেন। এই কারণে তিনি রামচন্দ্র গণেশ নামক জনৈক মহারাষ্ট্রীয় সেনানীকে খানদেশে চৌথ ও সরদেশমুখীসংক্রান্ত প্রাপ্য আদায়ের জন্য প্রেরণ করিলেন। মোগলেরা রামচন্দ্র গণেশকে প্রাণপণে বাধা দিতে ত্রুটী করিলেন না। তথাপি সর্দ্দার রামচন্দ্র বাহুবলে মহারাষ্ট্রীয়দিগের সমস্ত প্রাপ্য আদায় করিয়া প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। পরবর্ত্তী বৎসরেও আদায়ে গোলযোগ ঘটায় বাজী রাও উদয়জী পওয়ারকে (প্রমারকে) সসৈন্যে গুজরাথে ও খানদেশে প্রেরণ করিতে বাধ্য হন। সেই সময়ে তিনি তাঁহাকে মালব দেশ আক্রমণ করিতেও আদেশ করেন। খৃঃ ১৬৯৮ অব্দ হইতেই মহারাষ্ট্রীয়েরা মালব দেশে চৌথ পদ্ধতি প্রবর্ত্তিত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। ১৭১৯ খৃঃ বালাজী বিশ্বনাথকে দিল্লী দরবার হইতে মালবে চৌথ প্রবর্ত্তনাধিকার-দানের আশ্বাস প্রদত্ত হয়। বাজী রাও বাহুবলে এই স্বত্ব লাভের চেষ্টা করেন। খানদেশে গমন কালে উদয়জী, বাজী রাওয়ের নিকট হইতে মালবের প্রত্যেক পরগণার রাজপুরুষের নামে, নির্ব্বিবাদে চৌথদান সম্বন্ধে মহারাজ শাহুর নামযুক্ত আদেশপত্র পাইয়াছিলেন। তিনি ১৭২২ ও ১৭২৩ খৃষ্টাব্দে মালব হইতে চৌথ ও সরদেশমুখী সংক্রান্ত সমস্ত প্রাপ্য আদায় করিয়া লইয়া আসেন। ১৭২৩ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে উদয়জী পওয়ারের সহিত স্বয়ং বাজীরাও ও তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা চিমণাজী আপ্পা মালবে উপস্থিত হন। রাজা গিরিধর নামক কোনও নাগর ব্রাহ্মণ তথাকার সুভেদার ছিলেন। তিনি মোগল পক্ষাবলম্বনপূর্ব্বক সমরলিপ্সু হইয়া তাঁহাদিগের গতি রোধে যত্ন প্রকাশ করেন। বলা বাহুল্য, তাঁহাকে যুদ্ধে পরাভব স্বীকার করিতে হয়।

 সে কালে মহারাষ্ট্রদেশের পক্ষে মালব প্রদেশ উত্তর ভারতে প্রবেশের দ্বার-স্বরূপ ছিল।বাজী রাওয়ের নীতি। এই কারণে বাজীরাও উহা সম্পূর্ণরূপে স্ব-করতলগত করিয়া ক্রমে ক্রমে মোগল শাসিত উত্তর ভারতে মহারাষ্ট্র সাম্রাজ্য-বিস্তারের সংকল্প করিয়াছিলেন। তিনি শৌর্য্যসাহস ও উৎসাহের অবতার ছিলেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এই কারণে তিনি রাজপ্রতিনিধি শ্রীপতিরাওয়ের বিশেষ ঈর্ষ্যার ভাজন হইয়াছিলেন। বাজী রাও যাহাতে স্বীয় বিক্রম ও কার্য্যদক্ষতা প্রকাশ করিয়া মহারাজ শাহুর অধিকতর প্রিয়পাত্র হইতে না পারেন, প্রতিনিধি মহাশয় সে বিষয়ে সর্ব্বদা যত্ন করিতেন। বাজী রাও মহারাজ শাহুর নিকট উত্তর-ভারতবর্ষে অভিযান করিবার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেই শ্রীপতিরাও নানাবিধ যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়া তাহার অকিঞ্চিৎকরতা প্রতিপন্ন করিতে অগ্রসর হইতেন। বাজী রাওয়ের ন্যায় মহারাজ শাহুরও উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারের বিশেষ ইচ্ছা ছিল। কিন্তু প্রতিনিধি শ্রীপতি রাও কয়েকবার এইরূপ প্রতিবাদ করায় সর্ব্বসম্মতিক্রমে এ বিষয়ের শেষ সিদ্ধান্ত করিবার জন্য মহারাজ একদিন সভা আহ্বান করিলেন। দরবারে সকল সর্দ্দার ও সামন্তগণ উপস্থিত হইলে প্রথমতঃ প্রতি নিধি মহাশয় বাজীরাওয়ের প্রস্তাবের উল্লেখ করিয়া তাহার প্রতিবাদে নানা কথার অবতারণা করেন। তিনি বলেন,—

 “পেশওয়ে স্বপক্ষীয় বলাবলের বিচার না করিয়া কেবল আগ্রহাতিশয্য-বশতঃ উত্তর ভারতবর্ষ-বিজয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন। প্রকৃত পক্ষেপ্রতিনিধির বক্তৃতা। বর্ত্তমান সময়ে একটী সামান্য বিদ্রোহদমনেরও আমাদিগের সামর্থ্য নাই। নিজামের মহাবলপরাক্রম সৈন্যসমূহ আমাদিগের দ্বারদেশে আসিয়া যুদ্ধপ্রার্থনা করিতেছে। তাহাদিগের রণকণ্ডুতি নিবৃত্ত করিতে আমরা অসমর্থ। অধিক কি, আমাদিগের প্রাপ্য চৌথ ও সরদেশমুখীর স্বত্বই আমরা সর্ব্বত্র নির্ব্বিরোধে আদায় করিতে পারিতেছি না। এ অবস্থায় বিদেশ-জয়ে প্রবৃত্ত না হইয়া অগ্রে স্বরাজ্যের দৃঢ়তা-সম্পাদনে যত্নশীল হওয়াই কর্তব্য। কোহ্লাপুবের সাম্ভাজীর সহিত আমাদিগের যে বিরোধ আছে, তাহার মীমাংসা ও কর্ণাটক অঞ্চলে মহাত্মা শিবাজী যে রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহার পুনরুদ্ধার না করিয়া উত্তর ভারতে অভিযান করা আমি কিছুতেই রাজ্যের পক্ষে হিতকর বলিয়া মনে করি না। পেশওয়ের ন্যায় আমারও শৌর্য্য-সাহস আছে। কিন্তু বিদেশে গিয়া শৌর্য্য-প্রকাশের ইহা উপযুক্ত সময় নহে।”

 বাজী রাও একজন সুবক্তা ছিলেন। তিনি প্রতিনিধির এইরূপ প্রতিবাদের উত্তরে ওজস্বিনী ভাষায় যে সুদীর্ঘ বক্তৃতা করেন, তাহার মম্মার্থ এইরূপ,—“প্রতিনিধির উপদেশ অতীব বিস্ময়কর। দেশের বর্ত্তমান প্রকৃত অবস্থা তাঁহার আদৌ হৃদয়ঙ্গম হয় নাই। বাস্তব পক্ষে মোগল সাম্রাজ্য-রূপ মহাতরু রাও বাজীর বক্তৃতা। এক্ষণে জীর্ণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে। উহার মূলে কুঠারাঘাত করিবার এতদপেক্ষা উপযুক্ত অবসর আর হইতে পারে না। কারণ, মোগল বাদশাহেরাও এখন মারাঠাগণের মুখাপেক্ষী হইয়াছেন। বীরশ্রেষ্ঠ মারাঠাগণেরই সাহায্যে এখন মোগলগণ আপনাদের অধিকার রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছেন। এ অবস্থায় মারাঠাগণ যথোচিত বিক্রম প্রকাশ করিলে সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁহাদিগের স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে—মোগল বাদশাহীর পরিবর্ত্তে ভারতবর্ষে হিন্দুসাম্রাজ্য স্থাপিত হইবে। নিজাম-উল্-মুল্‌কের ভয়ে মোগলরাজ্য-বিনাশের এ সুযোগ ত্যাগ করা আমি কখনই সুবুদ্ধির কার্য্য বলিয়া মনে করি না। এরূপ ভীত হইলে রাজ্যবৃদ্ধি হইবে কিরূপে? পরলোকগত মহারাজ শিবাজী, দৌলতবাদে অওরঙ্গজেবের ন্যায় প্রবল শত্রুর অবস্থিতিকালেও, বিজাপুর ও গোলকোণ্ডার সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযান করিতে বিরত হন নাই এবং উক্ত সুলতানদিগকে সম্পূর্ণ দমিত করিবার পূর্ব্বে কর্ণাটক অধিকারের সুযোগ পরিত্যাগ করেন নাই। মহারাজ সাম্ভাজীর মৃত্যুর পর মহারাজ রাজারামকেও বহুবার এরূপ সাহসিকতা প্রকাশ করিতে হইয়াছিল। স্বয়ং মহারাজ (শাহু) তখন মোগল হস্তে বন্দী হইয়াছিলেন, সমগ্র মহারাষ্ট্র দিল্লীশ্বরের হস্তগত হইয়াছিল। তথাপি, সুদুর জিঞ্জি দুর্গে অবস্থিতি করিয়াও মহারাজ রাজারাম মোগল শাসন উচ্ছেদের চেষ্টা করেন—স্বদেশে এইরূপ ঘোর বিপত্তি সত্ত্বেও তাঁহার সর্দ্দারেরা অওরঙ্গাবাদ প্রভৃতি মোগল প্রদেশ আক্রমণ করেন। প্রতিনিধির ন্যায় ভীরুতা প্রকাশ করিলে তাঁহারা কোনও কার্য্যই সাধন করিতে পারিতেন না। ফলতঃ নিজাম উল্‌-মুল্‌ককে ভয় করিবার কোনও কারণ নাই। কোলাপুরের সাম্ভাজীর সহিত যখন ইচ্ছা সন্ধি স্থাপন করিয়া কর্ণাটকের সুব্যবস্থা করিতে বিলম্ব হইবে না। ঈশ্বরের কৃপায় যখন আমরা মোগলদিগের হস্ত হইতে মহারাজের মুক্তি ও প্রণষ্টপ্রায় স্ব-রাজ্যের উদ্ধার সাধন করিতে পারিয়াছি, বাদশাহের সহায়তা ও প্রতিষ্ঠা করিয়া যখন অলৌকিক যশোলাভ করিয়াছি, তখন মহারাষ্ট্রীয় সৈন্যের বীর্য্য-বলে আমরা হিমালয়ের শিখরদেশস্থিত “আটকে” ছত্রপতির বিজয়পতাকা রোপণ করিতে পারিব—হিন্দুদিগের জন্মভূমি হিন্দুস্থান হইতে বৈদেশিকদিগকে বিতাড়িত করিতে পারিব। উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া যদি মহৎকার্য্য সাধন করিতেই না পারিলাম, তাহা হইলে রাজ্যের উচ্চ পদলাভ করিয়া ফল কি[]? মহারাজ আমাকে কেবল সনন্দ পত্রদান করুন, আমি নূতন সৈন্যদল গঠন করিয়া মোগল সাম্রাজ্য অধিকার করিতেছি। নিজাম-উল্ মুল্কের দমন করিবার ভারও আমার উপর থাকিল। সমগ্র যবনরাজ্যের উচ্ছেদপূর্ব্বক ভারতবর্ষে সর্ব্বত্র হিন্দুসাম্রাজ্য-স্থাপন করিবার জন্য ছত্রপতি মহাত্মা শিবাজীর বিশেষ ইচ্ছা ছিল। অকাল মৃত্যুর জন্য তাহার সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় নাই। মহারাজের (শাহুর) পুণ্যবলে আমি সে কার্য্য সাধন করিতেছি। বিশেষতঃ পিতৃদেবের সহিত উত্তর-ভারতে গিয়া আমি সেখানকার অবস্থা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া আসিয়াছি। হিন্দুস্থানের দেশীয় রাজন্যবর্গের সহিত এ বিষয়ে পূর্ব্বেই আমাদিগের সন্ধি স্থাপিত হইয়াছে। এখন কেবল মহারাজের আদেশ পাইলেই আমি কার্য্যসিদ্ধি করিতে পারি। কর্ণাটকের ও কোলাপুরের সাম্ভাজীর ব্যাপার যদি প্রতিনিধি মহাশয়ের নিকট বিশেষ গুরুতর বলিয়া বোধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে সম্প্রতি যে সৈন্য সজ্জিত আছে, তাহা লইয়া কতিপয় বড় বড় সর্দ্দারের সহিত তিনি সেদিকে গমন করুন। উত্তর-ভারত-বিজয়ের ভার মহারাজের আদেশ পাইলে আমি গ্রহণ করিতেছি।”

 বাজীরাওয়ের এই উৎসাহ ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া মহারাজ শাহু অতীব প্রীতমহারাজের প্রশংসাবাদ। হইলেন এবং তাঁহার ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়া বলিলেন,—“বালাজী পন্তের ঔরসে আপনার ন্যায় শৌর্য্যশালী ও কার্য্যদক্ষ ব্যক্তিরই জন্মগ্রহণ সম্ভবপর। আপনার ন্যায় কর্ম্মচারী যাহার অধীনতায় থাকেন, তাঁহার পক্ষে হিমালয়ের অপর পারস্থিত ‘কিন্নরখণ্ডে’ বিজয়পতকা রোপণ কিছুমাত্র আশ্চর্য্য ব্যাপার নহে—হিন্দুস্থান বিজয় ত অতি তুচ্ছ কথা! অতএব আপনি উত্তর-ভারতে গমন করুন; নিজাম-উল্-মুল্‌ক্‌ ও কর্ণাটকবিজয়ের ভার আমাদিগের উপর রহিল।” এই বলিয়া মহারাজ শাহু সুবর্ণ ছত্র-দণ্ড-ভূষণ-পরিচ্ছদাদি দানে তাঁহাকে সম্মানিত করিলেন। সেদিনকার দরবারে বাজীরাওয়ের বক্তৃতার ফলে মহারাষ্ট্রীয় সর্দ্দার-সমাজে তাঁহার প্রশংসার সীমা রহিল না। সাতরার দরবারে প্রতিনিধি শ্রীপতি রাওয়ের যে গৌরব ও প্রভুত্ব ছিল, এই ঘটনায় তাহা বিলক্ষণ হ্রাস পাইল। মহারাজ শাহুও বাজী রাওয়ের একান্ত পক্ষপাতী হইয়া পড়িলেন এবং তাঁহাকে উত্তর ভারত বিজয়ের জন্য সনন্দপত্র প্রদান করিলেন। ১৭২৫ খৃষ্টাব্দে এই স্মরণীয় ঘটনা ঘটে।

 রাজসভায় বাজীরাও যেরূপ বীররসপূর্ণ বক্তৃতা করিয়া ছিলেন, তাঁহার শৌর্য্য ওবাজীরাওয়ের স্বভাব। সাহসও তদনুরূপ ছিল। তিনি এরূপ সুস্থকায় ও কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন যে, যুদ্ধাভিযান কালে সময়ে সময়ে ৮/১০ দিন পর্যন্ত অশ্ব-পৃষ্ঠে, কাঁচা ছোলা ও ভুট্টা হস্তসংঘর্ষে চূর্ণ করিয়া ভক্ষণ-পূর্ব্বক কালাতিপাত করিতেন। তাঁহার বুদ্ধিও অতীব বিশাল ছিল। রাজকার্য্যে তাঁহার ন্যায় ধুরন্ধর ব্যক্তি সে সময়ে মহারাষ্ট্রে আর কেহ ছিলেন না। তিনি অমায়িক ও ঋজু-স্বভাব ছিলেন, এবং কোনও প্রকার আড়ম্বর ভাল ভাসিতেন না।

 উচ্চ রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াও অভিযানাদির সময়ে তিনি সামান্য সৈনিকের ন্যায় একাকীতাঁহার চিত্র। অশ্বারোহণে ধাবিত হইতেন। এই কারণে কেহ তাঁহাকে সহজে সেনানী বলিয়া চিনিতে পারিত না। নিজামের সহিত তাঁহার বহু বার সংগ্রাম ঘটিলেও ১৭২৮ খৃঃ পর্য্যন্ত নিজাম তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করেন নাই। একদা তিনি বাজীরাওয়ের চিত্রদর্শনেচ্ছু হইয়া একজন সুদক্ষ চিত্রকরকে তাঁহার চিত্রাঙ্কনের জন্য আদেশ করিয়াছিলেন। বাজীরাও মালববিজয়ে অগ্রসর হইতেছিলেন, সেই সময়ে চিত্রকর তাঁহার সমীপবর্ত্তী হয় এবং তাঁহার তদবস্থার চিত্র অঙ্কিত করে। বাজীরাও তখন একটী ৭/৮ বিঘত উচ্চ বীর্য্যবান্ অশ্বে আরূঢ় হইয়া, স্কন্ধদেশে ভীমাকৃতি ভল্লস্থাপনপূর্ব্বক ভুট্টা ও কাঁচা ছোলার দানা হস্তে মর্দ্দন ও ভক্ষণ করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছিলেন। তাঁহার মস্তকে বস্ত্রাচ্ছাদিত শিরস্ত্রাণ, অঙ্গে লৌহময় কবচ, তদুপরি তুলাভরা কুর্ত্তা, কটিদেশে উলঙ্গ অসি ও তীক্ষ্ণধার ছুরিকা, পদে পাদবন্ধ; গলদেশে গ্রীবা-বন্ধ, সঙ্গে অশ্বের কবল-পাত্র ও তন্মধ্যে অশ্ববন্ধনের শঙ্কুনিচয়। কথিত আছে, বাজীরাওয়ের এইরূপ অপূর্ব্ব বীরমূর্ত্তি দেখিয়া নিজাম স্তম্ভিত হইয়া বলিয়াছিলেন,—“আল্লা পানাঃ ইয়ে ইন্সান্ হ্যায়, লেকিন্ মানিন্দ শয়তানকে হ্যায়; লাজিম্ হ্যায় কি ইস্‌সে সাথ হোষিয়ারি ঔর হিফাজৎসে রহনা চাহিয়ে!” অর্থাৎ এই ব্যক্তি মনুষ্য হইলেও শয়তানের সহচরবৎ অপ্রতিহত-শক্তিবিশিষ্ট বলিয়া বোধ হইতেছে। ইহার সহিত বিশেষ সাবধানতা-সহকারে চলা আবশ্যক। বলা বাহুল্য, যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন সত্ত্বেও নিজামকে বহুবার এই অসাধারণ বীরের হস্তে বিড়ম্বিত হইতে হয়।

 মহারাজ শাহুর অনুমতি পাইয়া বাজীরাও দুই লক্ষ মুদ্রা ঋণ পূর্ব্বক নূতন সৈন্য সংগ্রহে প্রবৃত্তসেনাদল গঠন। হন। এতদিন সৈনিকদিগকে লুণ্ঠনের ভাগ দিবার অঙ্গীকার করিয়া অস্থায়ি ভাবে নিযুক্ত করা হইত। কিন্তু বাজীরাও সে প্রথা বহুল পরিমাণে রহিত করিয়া পর্য্যাপ্ত বেতন দান-পূর্ব্বক স্থায়ী সৈন্য-পোষণের ব্যবস্থা করেন। উত্তর-ভারতে মহারাষ্ট্র-ক্ষমতা-বিস্তারের জন্য তিনি যে সৈন্যদল গঠন করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে অনেকে ভবিষ্যতে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিতে সমর্থ হন। মহ্লার রাও হোলকর, রাণোজী শিন্দে (সিন্দিয়া), গোবিন্দ রাও বুন্দেলা,ও উদয়জী পবার প্রভৃতির নাম এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখ যোগ্য []। উদয়জী পবার ভিন্ন ইঁহারা সকলেই পূর্ব্বে অতি সামান্য অবস্থার লোক ছিলেন। কিন্তু পরে মহাবীর বাজী রাওয়ের সঙ্গ লাভ করিয়া ইতিহাসে অমরত্ব পাইবার যোগ্য হন।

 উত্তর ভারতবর্ষ-বিজয়ের সনন্দ লাভ করিয়া বাজী রাও বল্লাল প্রথমতঃ মালব প্রদেশে দুইবারমালবে অভিযান। অভিযান করেন। উভয় বারই সেখানকার রাজা গিরিধরের পরাজয় সাধনপূর্ব্বক তিনি তাঁহাকে করদানে বাধ্য করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করিবার পর যে লুণ্ঠন-ক্রিয়া আরব্ধ হয়, তাহাতে বহু সম্পত্তি তাঁহার হস্তগত হইয়াছিল। মহ্লার রাও হোলকর, রাণোজী শিন্দে ও উদয়জী পওয়ার এই যুদ্ধে বিশেষ শৌর্য্য প্রকাশ করিয়াছিলেন বলিয়া বাজীরাও তাঁহাদিগকে মালবের চৌথ ও সরদেশমুখীর টাকা আদায় করিবার বংশপরম্পরানুগামী স্বত্ব দান এবং সৈন্য-পোষণের জন্য “মোকাসা” [] নামক আয়ের প্রায় অর্দ্ধাংশ (তন্মধ্যে হোলকরকে শতকরা ২২॥৹, শিন্দেকে ২২॥৹ ও পওয়ারকে ১০ হিসাবে) গ্রহণ করিবার আদেশ করিলেন। (১৭২৫ খৃঃ) ঐতিহাসিক মালকম সাহেব বলেন,—বাজী রাওয়ের আমলে মহারাষ্ট্রীয় সেনানীদিগের সদ্ব্যবহার-গুণে মোগল শাসনে উৎপীড়িত মালববাসী তাঁহাদিগের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইয়াছিল। এই কারণে অল্প দিনের মধ্যেই ঐ প্রদেশ বিনা আয়াসে মহারাষ্ট্রীয়গণের সম্পূর্ণ হস্তগত হয়।

 মহাত্মা শিবাজীর চেষ্টায় কর্ণাটক মহারাষ্ট্রীযদিগের অধিকৃত হইয়াছিল।কর্ণাটকে অভিযান। নিজাম দক্ষিণ ভারতের সুভেদারী লাভের পর ঐ প্রদেশ আপনার করতলগত করিয়াছিলেন। তাহা পুনরধি কার করিবার জন্য প্রতিনিধির বিশেষ ঔৎসুক্য ছিল। ১৭২০ খৃষ্টাব্দ হইতে মহারাষ্ট্র সেনানীগণ বহুবার নিজামকে আক্রমণ করিয়া কর্ণাট উদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোনও ফললাভ হয় নাই। পরিশেষে ১৭২৬ খৃষ্টাব্দে প্রতিনিধির পরামর্শক্রমে, সমস্ত সেনানীদিগের সমবেত ভাবে চারিদিক্ হইতে নিজামকে আক্রমণ করিবার প্রস্তাব স্থিরীকৃত হইল। তদনুসারে বাজী রাও মালববিজয়পূর্ব্বক প্রত্যাবৃত্ত হইলে প্রতিনিধি মহাশয়ের অনুরোধক্রমে মহারাজ শাহু তাহাকেও কর্ণাটক প্রদেশ-জয়ার্থ গমন করিতে আদেশ করিলেন। সেই সময় কর্ণাট-দেশে অভিযান করিবার উপযুক্ত অবসর বলিয়া বাজী রাওয়ের নিকট বিবেচিত না হওয়ায় তিনি স্বীয় অভিপ্রায় মহারাজ শাহুর গোচর করিয়াছিলেন। কিন্তু পরিশেষে প্রতিনিধির তুষ্টিসাধনোদ্দেশে তাঁহাকে সেই সময়েই যুদ্ধযাত্রা করিতে হইল। ফলে কর্ণাট হইতে চৌথ ও সরদেশমুখী সংক্রান্ত সমস্ত প্রাপ্য আদায় এবং ঐ প্রদেশের বহুল অংশের পুনরুদ্ধার সাধিত হইল বটে; কিন্তু সেখানকার অস্বাস্থ্যকর জলবায়ুর দোষে মহারাষ্ট্রীয় সৈনিক দিগের অনেকেই রোগে প্রাণত্যাগ করিল। (১৭২৬ খৃঃ অঃ)।

  1. বাজী রাওয়ের এই বাক্যে প্রতিনিধির অন্তরে বোধ হয় বিষম আঘাত লাগিয়াছিল।
  2. মহ্লার রাওয়ের পিতা পুণা জিলার অন্তর্গত নীরা নদীর তীরবর্ত্তী হোল নামক গ্রামের চৌগুলা বা গ্রাম রক্ষকের অধীন কর্ম্মচারী ছিলেন। মেষ-পালন তাঁহার পুরুষানুক্রমিক ব্যবসায় ছিল। মহ্লাররাও বাল্যকালে মেষচারণ করিতেন। যৌবনে তিনি মহারাষ্ট্রীয় সৈনিক বিভাগে প্রবেশ করেন। বাজীরাও তাঁহার বুদ্ধিমত্তার ও শৌর্য্যের পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে স্বীয় সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লন। ইহার পর ক্রমশঃ তাঁহার উন্নতি হইয়া তিনি বিশাল ভূখণ্ডের অধীশ্বর হইলেন।
     রাণোজী শিন্দে—গোয়ালিয়ারের সিন্ধিয়া বংশের আদিপুরুষ। তিনি প্রথমে মোগলদিগের অধীনতায় কার্য্য করিতেন। মোগলদিগের অবনতির সূত্রপাত ও স্বজাতির অভ্যুদয়-দর্শনে তিনি পেশওয়ে বালাজী বিশ্বনাথের নিকট বারগীর বা অশ্বসাদীর কার্য্য গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁহাকে প্রথমে সামান্য ভৃত্যভাবেই বহুদিন অতিবাহিত করিতে হয়। রাণোজীর কর্তব্যপরায়ণতা দেখিয়া বাজী রাও তাহার পদোন্নতি করেন। মহ্লার রাওয়ের সহিত ইহার বিশেষ হৃদ্যতা ছিল।
     গোবিন্দরাও বুন্দেলা রত্নাগিরি-জেলার অন্তর্গত নেওরে গ্রামের কুলকরণী বা গ্রাম-লেখকের পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর ইনি অন্নকষ্টে পীড়িত হইয়া বাজী রাওয়ের সেবকত্ব গ্রহণ করেন। কার্য্যতৎপরতাগুণে ইনি ১৭৩৩ খৃষ্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডের সুভেদার পদে নিযুক্ত হন। পানিপতের যুদ্ধে ইহার মৃত্যু হয়।
  3. যে কোনও প্রকার রাজস্বের ত্রি-চতুর্থাংশকে মোকাসা বলে।