বাজী রাও/তৃতীয় অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়।

পেশওয়ে পদলাভ—দেশের অবস্থা—নিজাম-

উল্‌ মুল্‌ক—পুণা—সন্ততি।

পিতার তার মৃত্যুকালে বাজীরাওয়ের বয়স প্রায় একবিংশ বৎসর ছিল। নবম বর্ষ বয়স হইতে পিতার সহিত প্রায় সকল অভিযানেই উপস্থিত থাকিয়া তিনি সমর-বিদ্যায় যেরূপ অভিজ্ঞতা লাভযোগ্যতা। করিয়াছিলেন, সর্ব্বদা রাজকার্য্য প্রত্যক্ষ করিয়া তিনি সেইরূপ রাজনীতিবিশারদ ও কার্য্য-কুশল হইতে পারিয়াছিলেন। এই কারণে বালাজী বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর মহারাজ শাহু বাজীরাওকে তৎপদে প্রতিষ্ঠিত হইবার সম্পূর্ণ যোগ্য বলিয়া মনে করিলেন। প্রতিনিধি শ্রীপতি রাও [] এবিষয়ে শাহুকে অন্য প্রকার পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু বালাজী বিশ্বনাথের মহৎ কার্য্যাবলীর বিষয় স্মরণ করিয়া এবং যুবক বাজী রাওকে মেধাবী ও রাজকার্য্যে উৎসাহসম্পন্ন দেখিয়া মহারাজ প্রতিনিধির কথায় সংকল্পচ্যুত হইলেন না।

 বালাজীর মৃত্যুর পূর্ব্বে, তদীয় নির্দ্দেশক্রমেই, বাজীরাও সৈয়দগণের প্রতিনিধি আলম আলীরপেশওয়ে পদ লাভ। সহায়তা করিবার জন্য একদল সৈন্যসহ খানদেশে গমন করিয়াছিলেন। পিতার মৃত্যুকালে তাঁহাকে সাসবড়ে উপস্থিত হইতে হয়। তথায় বালাজীর শ্রাদ্ধ, কর্ম্মাদি শেষ হইতে না হইতে মহারাজ শাহু বাজীরাওকে পিতৃপদের ভার গ্রহণ করিবার জন্য আহ্বান করেন। মহারাজের পত্র পাইয়া বাজীরাও, অম্বাজী পন্ত পুরন্দরে, রামচন্দ্র পন্ত ভানু ও চিমণাজী আপ্পা প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া রাজধানী সাতারায় উপস্থিত হন। ১৭২০ খৃষ্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল বাজীরাওকে পেশওয়ে পদে বরিত করিবার দিন স্থির হয়। এতদুপলক্ষে মহারাজের আদেশে রাজ্যের সমস্ত সর্দ্দার ও সম্ভ্রান্তব্যক্তিগণ আহুত হন। যথাসময়ে সেনাপতি ও অমাত্যগণে পরিবেষ্টিত হইয়া মহারাজ শাহু দরবার গৃহে সিংহাসনে সমাসীন হইলেন। তাঁহার আদেশানুসারে প্রতিনিধি শ্রীপতি রাও শুভ্রবেশধারী বাজীরাওকে যথাবিধানে পেশওয়ে পদে বরণ করিলেন। সে সময়ে সর্ব্বজন সমক্ষে তাঁহাকে রাজসম্মানের ও নূতনপদলাভের চিহ্ন স্বরূপ সনন্দ সহ, (১) চাদর, (২) সুবর্ণ-সূত্র খচিত পাগড়ি, (৩) জামেওয়ার নামক পরিচ্ছদ, (৪ কটিবন্ধনী, (৫) সুবর্ণাঙ্কিত উত্তরীয় বস্ত্র, (৬) কিংখাব, (৭) রাজমুদ্রা ও ছুরিকা, (৮) অসি চর্ম্ম, (৯) জরী পট্‌কা নামক জাতীয় পতাকা, (১০) চৌঘড়া নামক রাজসম্ভ্রমসূচক বাদ্যভাণ্ড, (১১) তিনটী হস্তী, (১২) একটা অশ্ব, (১৩) শিরপেঁচ, (১৪) মুক্তার মালা, (১৫) চোগা, (১৬) মুক্তাযুক্ত কর্ণভূষণ, (১৭) মুক্তাগুচ্ছময় শিরোভূষণ ও (১৮) সোনার কলমদান প্রদত্ত হইল।

 এই স্থলে “পেশওয়ে” শব্দের ইতিহাস ও উক্ত পদের কর্ত্তব্যাদি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদানপেশওয়ে শব্দবিচার। করিলে তাহা নিতান্ত অপ্রীতিকর বা নিরর্থক হইবে না। পেশওয়ে শব্দ পারসীক “পেশওয়া” শব্দেরই রূপান্তরজাত। ছত্রপতি শিবাজীর আদেশে রচিত “রাজ-ব্যবহার-কোষ” নামক সংস্কৃত-পারসীক অভিধানে লিখিত আছে,—“প্রধানঃ পেশবা তথা।”

 প্রধান কাহাকে বলে ও তাহার কার্য্য কি কি, তৎসম্বন্ধে শুক্রনীতিগ্রন্থে এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়—

“পুরোধাশ্চ প্রতিনিধিঃ প্রধানঃ সচিবস্তথা।
মন্ত্রী চ প্রাড্‌বিবাকশ্চ পণ্ডিতশ্চ সুমন্ত্রকঃ।
অমাত্য দূত ইত্যেতা রাজ্ঞঃ প্রকৃতয়ো দশ॥”

 রাজার এই দশ প্রকৃতির মধ্যে—

“সর্ব্বদর্শী প্রধানস্তু সেনাবিৎ সচিবস্তথা॥” ৮৪॥
“সত্যং বা যদি বাসত্যং কার্য্যজাতঞ্চ যৎ কিল।
সর্ব্বেষাং রাজকৃত্যেষু প্রধানস্তদবিচিন্তয়েৎ॥” ৮৯॥

 ফলতঃ সমস্ত রাজপুরুষদিগের অনুষ্ঠিত কার্য্যাবলীর ও সর্ব্বপ্রকার রাজকার্য্যের যিনি পরিদর্শক, সেই সর্ব্বদর্শী রাজপুরুষ পুরাকালে ‘প্রধান’ নামে পরিচিত ছিলেন।

 মোসলমান নৃপতিগণের, বিশেষতঃ দাক্ষিণাত্য সুলতানদিগের, প্রধান মন্ত্রিগণ পেশবা নামেই অভিহিত হইতেন। মহারাষ্ট্র-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজীর প্রধান মন্ত্রীও প্রথমে পেশবা উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। মহারাজ শিবাজী স্বীয় রাজ্যাভিষেক-কালে সে উপাধির পরিবর্ত্তে প্রাচীন হিন্দু নীতিশাস্ত্রের অনুসরণ করিয়া “পণ্ডিত প্রধান” উপাধির প্রবর্ত্তন করেন। তদবধি সমস্ত মহারাষ্ট্র রাজ-মন্ত্রী “পণ্ডিত প্রধান” উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন[]। তথাপি পারসীক পেশওয়া শব্দের প্রচার হ্রাস পায় নাই। বরং শিবাজীর পৌত্র মহারাজ শাহুর রাজত্বকালে দেশে পারসীক শব্দের সমধিক প্রচারের সহিত “পেশওয়ে” শব্দ আবার রাজ-দরবারে পূর্ব্বস্থান অধিকার করিল। কিন্তু তখনও ইতিহাসে উক্ত শব্দের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। মহাবীর বাজীরাও ও তৎপুত্র বালাজী বাজীরাওয়ের অসাধারণ বিক্রমে ভারতের শাসনচক্র সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তিত হওয়ায় “পেশওয়ে” নাম ইতিহাসে বিশেষ প্রসিদ্ধিলাভ করে।

 পেশওয়ে পদের কর্তব্যাদি সম্বন্ধে মহাত্মা শিবাজীর সময়ে যাহা নির্দ্ধারিত হয় তাহা এই,—(১)পেশওয়ের কর্তব্যাদি। রাজকার্য্যবিষয়ক মন্ত্রণা, (২) সকল কর্ম্মচারীর মতৈক্যসাধন করিয়া রাজকার্য্যনির্ব্বাহ ও সকলের প্রতি সমদর্শিতা (৩) অনলসভাবে সর্ব্বদা সর্ব্বপ্রকারে রাজ্যের হিতসাধনে মনোযোগ, (৪) সৈন্যবলের সাহায্যে নব দেশ-বিজয়; (৫) শত্রুপক্ষের ও পররাষ্ট্র-সংক্রান্ত সমস্ত সংবাদসংগ্রহ, (৬) রাজকার্য্যবিষয়ক পত্রাদি রাজমুদ্রাঙ্কিত ও স্বনামাঙ্কিত করা। প্রধানের পদের বেতন বার্ষিক ১৩ সহস্র হোণবা প্রায় ৪৯ হাজার টাকা ছিল।

 বাজী রাও পিতৃপদে প্রতিষ্ঠিত হইলে তাঁহার উপর এই বাজী রাওয়ের মুদ্রা। সকল কার্য্যেরই ভার অর্পিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি দিগ্বিজয় ও সন্ধি-বিগ্রহাদিব্যাপারে অধিকাংশ সময় যাপন করিতেন বলিয়া তদীয় ভ্রাতা চিমণাজী মহারাজের নিকট থাকিয়া সকল রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। এই কারণে মহারাজ শাহু তাঁহাকে “নায়েব পেশওয়ে”র পদ ও উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন। মহারাজ শাহুর রাজত্বকালে “পেশওয়ে” নাম সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধি লাভ করিলেও সরকারি কাগজপত্রে “মুখ্যপ্রধান” ও “পণ্ডিত প্রধান” প্রভৃতি সংস্কৃত উপাধিরই ব্যবহার হইত। তদনুসারে বাজী রাওকে রাজসরকার হইতে “সমস্ত রাজকার্য্য ধুরন্ধর শ্রীমন্ত রাজমান্য রাজশ্রী বাজীরাও বল্লাল পণ্ডিত প্রধান” এইরূপ পাঠযুক্ত পত্রাদি লিখিত হইত। বাজীরাওয়ের রাজমুদ্রায় নিম্নলিখিত শ্লোকটি উৎকীর্ণ ছিল।—

“শাহু নরপতি হর্ষনিধান।
বাজীরাও বল্লাল মুখ্য প্রধা॥”

 বাজী রাও যখন পেশওয়ের পদলাভ করেন, তখন ভারতবর্ষের রাজনীতিকদেশের অবস্থা। অবস্থা কিরূপ ছিল, তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান করা আবশ্যক। তাহা হইলে পাঠক বাজী রাওয়ের কার্য্যপ্রণালীর মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন।

 এই সময়ে মারাঠা-সর্দ্দারগণের আত্মবিগ্রহ বহুল পরিমাণে শান্ত হইয়াছিল। তবে রাজবংশেরস্বদেশ। কলহে কতিপয় সর্দ্দার শাহুর পক্ষ ও অপরে কোহ্লাপুরের সাম্ভাজীর পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন। তথাপি বালাজী বিশ্বনাথের চেষ্টায় মহারাজ শাহুর পক্ষই প্রবলতা লাভ করিয়াছিল এবং দেশের দস্যুদল সম্পূর্ণ দমিত হইয়াছিল। দিল্লীর রাজপরিবর্ত্তন-ব্যাপারে মহারাষ্ট্রীয়গণ সহায়তা করায় তাঁহাদিগের প্রতিপত্তি উত্তরভারতে বিশেষরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

 ভারতবর্ষ মণিকাঞ্চনের জন্মভূমি, এই সংবাদ অবগত হইয়া পাশ্চাত্য-বণিকগণ ইহার পূর্ব্বেই পর্তুগীজ শক্তি। এদেশে পদার্পণ করিয়াছিলেন। প্রথমে পর্তুগীজ-বণিকেরাই মহারাষ্ট্রে আগমন করেন। কিন্তু দেশের অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা স্বল্পদিনের মধ্যে বাণিজ্য-বৃত্তি পরিত্যাগ-পূর্ব্বক রাজকীয় ব্যাপারে প্রবেশলাভ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ক্রমে এদেশীয় রাজন্যবর্গের ছিদ্রান্বেষণপূর্ব্বক তাঁহাদিগের সহিত শক্তিপরীক্ষার বাসনাও তাঁহাদিগের হৃদয়ে বলবতী হইল। পশ্চিমসমুদ্রের তীরবর্ত্তী বহুসংখ্যক বন্দর তাঁহারা অধিকার করিয়াছিলেন। ১৭২০ খৃষ্টাব্দে বাজী রাও রাজকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া দেখিলেন যে, পর্তুগীজগণ মহারাষ্ট্রীয়দিগের বলিষ্ঠ শত্রুর শ্রেণীতে পরিগণিত হইতে পারেন।

 পর্তুগীজদিগের সমৃদ্ধি দেখিযা ফরাসী, ওলন্দাজ ও ইংরাজ বণিকেরাও এ দেশের ফরাসী ও ইংরাজ। ধনসম্পত্তি লুণ্ঠনের জন্য পশ্চিমভারতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। গোয়া, দমন, দীউ, বোম্বাই, খম্বায়ৎ, সাষ্টী (Satsette) সুরাট, চৌল, বসই, (Bassin) রাজাপুর, বেঙ্গুর্লে, প্রভৃতি স্থানে এই সকল বৈদেশিক বণিকের পণ্য-শালা স্থাপিত হইয়াছিল। কিন্তু তখনও ফরাসী অথবা ইংরাজেরা এ দেশের রাজ্য শাসন-ব্যাপারের সংস্রবে আসিতে পারেন নাই।

 উত্তর ভারতবর্ষে মোগল বাদশাহের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হইতেছিল। সৈয়দগণেরদিল্লীর অরাজকতা। চেষ্টায় মহম্মদ শাহ দিল্লীর সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। তিনি নিজে অতীব বিলাসপ্রিয় ও ব্যসনাসক্ত ছিলেন। তাঁহার কর্ম্মচারিবর্গেরও অকর্মণ্যতা সীমা অতিক্রম করিয়াছিল। সুতরাং রাজদরবার যথেচ্ছাচার ও বিলাসব্যসনের লীলাভূমি হইবে, বিচিত্র কি? ফলতঃ প্রজার উপর ঘোর অত্যাচার হইতে লাগিল। অথচ ব্যবস্থা-দোষে বাদশাহের দৈনন্দিন ব্যয় নির্ব্বাহের উপযুক্ত রাজস্বও আদায় হইত না। সুতরাং বাদশাহ ঋণ করিতে লাগিলেন। ঋণশোধের জন্য প্রজার উপর নিত্য নূতন কর বসিতে লাগিল। দুর্ব্বল প্রজার আর্ত্তনাদ শ্রবণ করে, উত্তর ভারতে এরূপ কেহ রহিল না।

 এই সময়ে অওরঙ্গজেবের আমলের একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিশারদ সর্দ্দার স্বীয় বাহুবলে ওনিজাম-উল-মুল্ক। বুদ্ধিকৌশলে ভারতে মোসলমানদিগের প্রণষ্টপ্রায় গৌরবের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবর্দ্ধমান মহারাষ্ট্রশক্তির গতিরোধের জন্য তিনি যে চেষ্টা করেন, তাহা বহু পরিমাণে সফল হয়। তাঁহার আবির্ভাব না হইলে মহারাষ্ট্রীয়েরা সমগ্র ভারতে একচ্ছত্র হিন্দুশাসন প্রবর্ত্তিত করিতে সমর্থ হইতেন। এই প্রসিদ্ধ সর্দ্দারের নাম মীর কমরুদ্দীন। খৃষ্টীয় ১৬৪০ অব্দে তাঁহার জন্ম হয়। সম্রাট্ অওরঙ্গজেবের সময়ে তিনি “চিন কিলিচ খাঁ” ও ফরুখ্‌শিয়ারের আমলে “নিজাম-উল্-মুল্ক” অর্থাৎ রাজ্যের সুব্যবস্থাকারী উপাধি লাভ করেন। ১৭১৭ খৃষ্টাব্দে সৈয়দেরা তাঁহাকে মালবের সুভেদাররূপে দক্ষিণাপথে প্রেরণ করিয়াছিলেন। বাদশাহকে করতলগত করিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁহার হৃদয়ে বলবতী ছিল। কিন্তু দিল্লীর দরবারে সৈয়দগণের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দর্শনে নিজাম-উল্‌ মুল্ক দক্ষিণ ভারতে ক্ষমতা- বিস্তার-পূর্ব্বক আপনার বলবৃদ্ধির সঙ্কল্প করিলেন।

 নিজাম প্রথমতঃ ‘আসিফজা’ উপাধি গ্রহণ করিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা এবং মালব হইতেসৈয়দদিগের সর্ব্বনাশ। নর্ম্মদা-তীর পর্যন্ত সমুদায় ভূভাগ আক্রমণ করেন। তিনি আশীরগড় দুর্গ অধিকার করিতে সমর্থ হওয়ায় অধিকাংশ মোগলসর্দ্দার তাঁহার পক্ষভুক্ত হন। সৈয়দেরা এই সংবাদ পাইয়া দিলাবর খাঁ নামক জনৈক সেনানীকে নিজাম-উল্‌-মুল্‌কের বিরুদ্ধে পাঠাইয়া দেন। অওরঙ্গাবাদ হইতে হুসেন আলীর ভ্রাতুষ্পুত্র আলম্‌আলীও তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযান করেন। আলম্আলীর সাহায্যার্থ খণ্ডে রাও দাভাড়ে, দমাজী গায়কওয়াড় ও বাজীরাও প্রভৃতি মহারাষ্ট্রীয় সেনানীগণ গমন করিয়াছিলেন। বাজীরাও এই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং উপস্থিত হইয়াছিলেন কি না, তাহা জানা যায় না। এই যুদ্ধে নিজামের হস্তে আলম আলী ও দিলাবর খাঁকে পরাস্ত হইতে হয়। তাঁহাদিগের পরাভববার্তা-শ্রবণে হুসেন আলী দিল্লী হইতে বাদশাহকে লইয়া নিজামের বিরুদ্ধে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে, বোধ হয় বাদশাহের ইঙ্গিতক্রমেই, তাঁহাকে গুপ্তঘাতকের হস্তে প্রাণ হারাইতে হয় (খৃঃ ১৭২০ অক্টোবর)। অতঃপর তাঁহার ভ্রাতা আব্‌দুলও বন্দী হইয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।

 এইরূপে বিনা আয়াসে নিজাম উল্‌মুল্‌কের উন্নতির পথ পরিষ্কৃত হইল। বাদশাহ মহম্মদ শাহনিজাম ও বাজীরাও। তাঁহাকে স্বীয় প্রধান মন্ত্রীর পদে বরিত করিয়া রাজধানীতে আহ্বান করিলেন। কিন্তু বাজী রাওয়ের প্ররোচনায় বিজাপুর অঞ্চলে একটা বিদ্রোহের সূচনা হওয়ায় ১৭২২ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত নিজাম দিল্লী গমনের অবকাশ পান নাই। সে যাহা হউক, এইরূপে বাজী রাওয়ের পেশওয়ে পদ লাভ কালে মোসলমানদিগের মধ্যে নিজাম উল্-মুল্‌কই তাঁহার একমাত্র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে দক্ষিণ ভারতে বিরাজ করিতেছিলেন।

 পেশওয়ে-পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া বাজী রাও পুণার উন্নতিবিধানে মনোযোগী হইলেন। বাপুজীপুণার উন্নতি। শ্রীপতি নামক এক ব্যক্তি পুরন্দর দুর্গের অধিপতি ছিলেন। বাজীরাও তাঁহাকে পুণার সুভেদার পদে নিযুক্ত করিলেন। অতঃপর তিনি রম্ভাজী যাদব নামক এক জন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিকে বাপুজীর অধীনতায় থাকিয়া পুণাগ্রামকে সহরে পরিণত করিবার ভারার্পণ করেন। রম্ভাজী যাদবের চেষ্টায় কয়েক বৎসরের মধ্যেই পুণা বহুসংখ্যক ব্যবসায়ী ও কারিকরের বসতি স্থান হওয়ায় উহা ক্রমে সহরে পরিণত হইল।

 ১৭২৯ খৃঃ বাজী রাওয়ের আদেশে তদীয় বাসের জন্য পুণায় একটি সৌধনির্ম্মাণ-কার্য্য আরব্ধশনিবার বাড়া। হয়। উহার কিয়দংশ নির্ম্মিত হইলে তিনি ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে তথায় সপরিবারে বাস করিতে গমন করেন। তৎপূর্ব্বে সাসবড় গ্রামে তাঁহাদিগের বাসস্থান ছিল। এই সৌধনির্ম্মাণের কার্য্য ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দে পরিসমাপ্ত হয়। প্রায় পাঁচ বিঘা পরিমিত স্থানের উপর উহা নির্ম্মিত হইয়াছিল। তদানীন্তন রীতিক্রমে উহার চতুর্দিক্ সুদৃঢ় প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত হয়। তাহাতে সর্ব্বশুদ্ধ নয়টি বুরুজ ও পাঁচটি বড় বড় দ্বার ছিল। তন্মধ্যে প্রধান দ্বার দিল্লী দরজা নামে খ্যাত। কথিত আছে, উত্তর মুখে এই দ্বার নির্ম্মিত হইতেছে শুনিয়া মহারাজ শাহু অসন্তোষ প্রকাশপূর্ব্বক বলেন যে, “দিল্লীশ্বর আমার প্রভু; অতএব দিল্লীর দিকে প্রধান দ্বার থাকিলে, ও যুদ্ধবেশে সেই দ্বারপথে নিষ্ক্রান্ত হইলে দিল্লীর অবজ্ঞা করা হইবে।” বাল্যে অওরঙ্গজেবের দরবারে লালিত পালিত হওয়ায় শাহুর হৃদয়ে দিল্লীশ্বরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। এই কারণে বাজীরাওয়ের ইচ্ছাসত্ত্বেও শাহুর জীবনকালে ঐ উত্তর দিকের দ্বার-নির্ম্মাণ সম্পূর্ণ হয় নাই। মহারাজের মৃত্যুর পর বাজী রাওয়ের পুত্র বালাজী বাজী রাও উহার শেষ করেন। বাজী রাওয়ের সময়ে এই সৌধ চিত্রাদি বিবিধ উপকরণে সুসজ্জিত হইয়াছিল। পরবর্ত্তীকালে পেশওয়েদিগের বৈভববৃদ্ধির সহিত এই অট্টালিকা রাজপ্রাসাদের শোভা ধারণ করে। সহরের যে অংশে এই অট্টালিকা নির্ম্মিত হয়, তাহা “শনিবার পেঠ” নামে পরিচিত। তদনুসারে এই বাটী “শনিবার-বাড়া” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বর্ত্তমান রাজপুরুষেরা উহার অধিকাংশ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তথায় এক্ষণে ফৌজদারী আদালত স্থাপন করিয়াছেন।

 বাজী রাওয়ের মৃত্যুর পূর্ব্বে পুণা সহর কত দূর সমৃদ্ধ হইয়াছিল, তাহা “গর্ডন” নামক পুণার সমৃদ্ধি। তদানীন্তন জনৈক শ্বেতাঙ্গ ভ্রমণকারীর বর্ণনা পাঠ করিলে হৃদয়ঙ্গত হইবে। শ্বেতাঙ্গদিগের মধ্যে গর্ডন সাহেবই প্রথমে পুণায় পদার্পণ করেন। সুতরাং তাঁহার অদ্ভুত বর্ণ ও বেশবিন্যাস দেখিবার জন্য সহস্র সহস্র নাগরিক সমবেত হইয়াছিল। তিনি ১৭৩৯ খৃষ্টাব্দে পুণার অবস্থা দেখিয়া নিম্নলিখিত বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন,—

 “পুণার ন্যায় সুন্দর নগরী ভারতবর্ষে অতি অল্পই আছে; আমার চক্ষে এই সহর অতীব সমৃদ্ধিশালী বলিয়া বোধ হইল। বাজারে শাকশব্জীর স্তূপ দেখিলে বিস্ময় জন্মে। লোহার ও কামান প্রস্তুত করিবার কারখানা সহরের অনেক স্থানেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়। তন্তুবায়, মালাকার ও শিল্পীদিগের হস্ত-কৌশল দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়াছি। পুণার বাজারে পৃথিবীর যাবতীয় মালের আমদানি দেখিলাম। নগরবাসীদিগকে সুখ-সম্পদের ক্রোড়ে লালিত বলিয়া মনে হয়। এখানে ধনবানের সংখ্যাই অধিক। নাগরিকগণের সুন্দর বপু প্রচুর সুবর্ণরত্নাদিতে অলঙ্কৃত। এখানকার বাণিজ্য ব্যাপার-অতি বিস্তৃত। পুণা হইতে প্রত্যহ সহস্র সহস্র বিবিধপণ্যবাহী শকট দেশের সর্ব্বত্র গমন করিয়া থাকে। দিন দিন পেশওয়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সহিত পুণার বাণিজ্য-বৈভবেরও বৃদ্ধি হইতেছে।”

 পেশওয়ে পদে অধিষ্ঠিত হইবার স্বল্পদিন পরে, ১৭২১ খৃষ্টাব্দের নবেম্বর মাসে বাজী রাও প্রথমপুত্র-লাভ। পুত্র লাভ করেন। তাঁহার নবজাত কুমারকে বাল্যকালে সকলে ‘নানা সাহেব’ বলিত। মহারাষ্ট্রীয় রীতিক্রমে বাজীরাও স্বীয় পিতার নামে তাহার নামকরণ করিয়াছিলেন। এই বালক ভবিষ্যতে বালাজী বাজী রাও নামে প্রসিদ্ধ হয়। বাজীরাও যে মহৎ উদ্দেশ্যসাধনে জীবনপাত করিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র বালাজী বাজী রাওয়ের চেষ্টায় তাহা বহুল পরিমাণে সুসিদ্ধ হয়। তাঁহার শাসনসময়ে ভারতবর্ষের অধিকাংশ প্রদেশে হিন্দু সাম্রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল। আবার তাঁহারই শাসনকালে মহারাষ্ট্রশক্তি পানিপথে বিষম আঘাত প্রাপ্ত হইয়া কিছু দিনের জন্য বিনম্র হইয়া পড়ে।

 সুপ্রসিদ্ধ রঘুনাথরাও বা রাঘোবা বাজী রাওয়ের দ্বিতীয় পুত্র। তিনি বিক্রমে বহুলাংশে পিতাররঘুনাথ রাও। সমকক্ষ হইয়াছিলেন। বাজীরাও যে “আটক” নগরে মহারাষ্ট্রীযদিগের বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন করিবার সংকল্প করিয়াছিলেন, তাহা রঘুনাথ রাও নিজ শৌর্য্যবলে সত্য ঘটনায় পরিণত করেন। কিন্তু রাজনীতিক দূর দৃষ্টির অভাবে ও স্ত্রীর বশীভূত হওয়ায় রঘুনাথের শেষ জীবন কলুষময় ও বিড়ম্বনার আধার হইয়া উঠে। সেই সঙ্গে মহারাষ্ট্র সাম্রাজ্যেরও বহুল ক্ষতি সাধিত হয়। সে যাহা হউক, এতদ্ভিন্ন বাজীরাও আরও দুইটি অপত্য লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের নাম রামচন্দ্র ও জনার্দ্দন পন্ত। তাঁহারা উভয়েই অল্পবয়সে ইহলোক পরিত্যাগ করেন। বাজীরাও স্বীয় পুত্রগণকে সুশিক্ষিত করিয়াছিলেন। বালাজী ও রঘুনাথরাওকে যুদ্ধবিদ্যার সহিত রঘুবংশ প্রভৃতি সংস্কৃত কাব্যও আয়ত্ত করিতে হইয়াছিল।

  1. ইনি প্রতিনিধি পরশুরাম ত্র্যম্বকের পুত্র। ছত্রপতি শিবাজীর সময়ে পেশওয়ের পদই মন্ত্রিসমাজের সর্ব্বোচ্চ পদ বলিয়া নির্দ্ধারিত হইয়াছিল। তৎপুত্র রাজারামের শাসনকালে রাজকার্য্য নির্ব্বাহের সৌকয্যার্থ প্রতিনিধির পদ সৃষ্ট হয়। ঐ পদের বেতন বার্ষিক ১৫ হাজার হোণ বা কিঞ্চিদধিক ৫৬ হাজার টাকা ছিল।
  2. এতদন্তর্গত “পণ্ডিত” শব্দ ব্রাহ্মণত্বের সূচকরূপে ব্যবহৃত হইত।