পরিশিষ্ট।

শ্রীমদ্‌ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর পরিচয়।

 বেরার অঞ্চলে দুধেবাড়ী নামক গ্রামে সম্ভবতঃ ১৬৪৯ খৃষ্টাব্দে এই মহাপুরুষের জন্ম হয়। ইহার পিতৃমাতৃদত্ত নাম “বিষ্ণু পন্ত” ছিল। দ্বাদশবর্ষ বয়ঃক্রম-কালে তাঁহার পিতা মাতার মৃত্যু হওয়ায় নানারূপে বিপন্ন হইয়া তিনি সংসারের প্রতি বীতস্পৃহ হন। পঞ্চদশ বৎসর বয়সে তিনি বারাণসীতে গমনপূর্ব্বক বেদান্ত শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও তত্রত্য জ্ঞানেন্দ্র সরস্বতী নামক কোনও প্রখ্যাত পরমহংসের নিকট ব্রহ্মবিদ্যার দীক্ষাগ্রহণ করেন। তদবধি বিষ্ণু পন্ত ‘শ্রীমদ্‌ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী’ নামে পরিচিত হইলেন।

 দীক্ষা গ্রহণের পর তিনি উত্তরে বদরী নারায়ণ হইতে দক্ষিণে রামেশ্বর পর্যন্ত সমস্ত তীর্থক্ষেত্রাদির দর্শন করিয়া ১৬৮৬ খৃষ্টাব্দে কোঙ্কণে উপস্থিত হইলেন। তথায় চিপ্‌লুণের নিকটবর্ত্তী পরশুরাম ক্ষেত্রে দ্বাদশবর্ষ অজ্ঞাতবাস-পূর্ব্বক কঠোর তপস্যার পর তিনি একটি মঠ স্থাপন করেন। ক্রমে তাঁহার প্রতি সাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। মহারাষ্ট্র দেশের অধিকাংশ মান্য গণ্য ব্যক্তিই তাঁহার নিকট জ্ঞান ও ভক্তি-বিষয়ে উপদেশ গ্রহণ ও তাঁহার শিষ্যত্ব স্বীকার করেন। জঞ্জীরার সিদ্দিদিগের অনেকে তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন। বালাজী বিশ্বনাথও তাঁহার নিকট দীক্ষিত হইয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশ-ক্রমেই তিনি কোঙ্কণ পরিত্যাগের পর মহারাষ্ট্র রাজধানী সাতারায় কর্ম্মানুসন্ধানের জন্য উপস্থিত হন। বালাজী ও তাঁহার সন্ততিগণের প্রতি স্বামীজীর বিশেষ স্নেহ ছিল।

 স্বামীজী ভিক্ষার দ্বারা বহু অর্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তদ্ভিন্ন মহারাজ শাহু ও মহারাষ্ট্র সর্দ্দারেরা তাঁহাকে দেবসেবার উদ্দেশ্যে যে সকল ভূমিদান করিয়াছিলেন, তাঁহারও বার্ষিক আয় প্রায় ষোড়শ সহস্র মুদ্রা ছিল। তাঁহার হস্তাশ্বপদাতিকাদির সংখ্যাও নিতান্ত অল্প ছিল না। তিনি মৃত্যুকালে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৬৩৭৸৴৫ রাখিয়া গিয়াছিলেন! এতদ্বাতীত উৎকৃষ্ট রত্নালঙ্কারাদিও তাঁহার ধনাগারে ভূরিপরিমাণে সঞ্চিত ছিল। কিন্তু এইরূপ অতুল ধনসম্পত্তির অধিকারী হইয়াও স্বামীজী স্বয়ং কখনও গোমূত্র ও তক্র ভিন্ন অন্য দ্রব্য উদরস্থ করিতেন না! তাঁহার সঞ্চিত অর্থের অধিকাংশই তিনি সার্ব্বজনিক হিতার্থে ব্যয় করিতেন। অবশিষ্টাংশ দেবসেবায় ব্যয়িত হইত। তিনি দেশের নানাস্থানে দেবালয় ও ধর্ম্মশালাদির প্রতিষ্ঠা এবং কুপতড়াগাদির খননে প্রায় ৯ লক্ষ ২৭ হাজার ৫ শতাধিক মুদ্রা ব্যয়িত করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রিয় শিষ্য বাজী রাও ও অন্যান্য মারাঠা সর্দ্দারগণ তাঁহার নিকট লক্ষাধিক মুদ্রা ঋণ-সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। দেশের পথ ঘাটের সংস্কারের জন্য তিনি প্রায়ই জমীদার ও সর্দ্দারদিগকে আদেশ করিতেন। তাঁহার আদেশ সহসা কেহ লঙ্ঘন করিতে পারিত না। তিনি ভিক্ষা-সংগ্রহের জন্য দেশের সর্ব্বত্র ভ্রমণ পূর্ব্বক লোকের অভাব অভিযোগাদির বিষয় রাজপুরুষদিগের কর্ণগোচর করিয়া যথাসম্ভব তৎপ্রতীকারের ব্যবস্থাও করাইতেন।

 ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর দেশহিতৈষণা অতি উচ্চ অঙ্গের ছিল। যাহাতে মহারাষ্ট্র ধর্ম্ম ও মহারাষ্ট্র সাম্রাজ্যের উন্নতি হয়, সে বিষয়ে তিনি সর্ব্বদা যত্ন করিতেন। কোঙ্কণ হইতে সিদ্দি ও ফিরিঙ্গীদিগের সম্পূর্ণ উচ্ছেদসাধনের জন্য তিনি বহুবার মহারাজ শাহু, বাজীরাও, চিমণাজী আপ্পা, ও আংগ্রে প্রভৃতিকে প্ররোচিত করিয়াছিলেন। ইংরাজেরা যাহাতে সিদ্দি ও ফিরিঙ্গীদিগকে সহায়তা না করেন, সে জন্য তিনি বোম্বাইয়ে গিয়া তাঁহাদিগের সহিত সখ্য-সংস্থাপনের চেষ্টাতেও বিরত হন নাই। বিধর্ম্মীর সহিত যুদ্ধে প্রণোদিত করিবার সময় তিনি মহারাষ্ট্রীয় সেনানীগণকে রামায়ণ মহাভারতোক্ত বীরবৃন্দের সহিত তুলিত করিয়া পত্র লিখিতেন। কেবল তাহাই নহে, বন্দুক, কামান ও অসি ভল্লাদি অস্ত্র-দানেও তিনি তাঁহাদিগের সহায়তা করিতেন। সমরবিজয়ী সেনানীদিগকে তিনি দৈবানুগ্রহের চিহ্নস্বরূপ অস্ত্রশস্ত্রাদি দিয়া পুরস্কৃত ও পরিতুষ্ট করিতেও বিলম্ব করিতেন না। তাঁহার অলৌকিক দৈবশক্তিতে সাধারণের বিশ্বাস থাকায় তাঁহার আদেশ ও উপদেশ অনেক সময়েই দেশের রাজপুরুষদিগের দ্বারা দৈবাদেশ-রূপে পরিপালিত হইত এবং উহা তাঁহাদিগের অধিকাংশ কার্য্যকে ধর্ম্মভাবে সমুজ্জ্বল করিয়া তুলিত। অধিকাংশ মহারাষ্ট্র সর্দ্দারের জননী ও গৃহিণীগণ তাঁহাদিগের পুত্র ও স্বামী প্রভৃতির মঙ্গলের জন্য তাঁহার নিকট আশীর্ব্বাদ ও প্রসাদ প্রার্থনা করিয়া পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে পত্র লিখিতেন। পরমহংস ব্রহ্মেন্দ্রও তাঁহাদিগকে মন্ত্রপুত কবচাদি প্রেরণপূর্বক সেতুনির্ম্মাণ ও কূপ-খননাদি কার্য্যে অর্থ সাহায্য করিতে অনুরোধ করিতেন। লোকে তাঁহাকে ভার্গবের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিত।

 স্বামীজী স্বয়ং জিতেন্দ্রিয় হইলেও দেশ হিতসাধনের জন্য তাঁহাকে সময়ে সময়ে বিষম কোপ প্রকাশ করিতে হইত। কেহ তাঁহার আদেশ পালন না করিলে তিনি তক্র ও গোমূত্র-প্রাশন এবং ক্ষৌরকার্য্য পরিত্যাগ করিতেন। এজন্য কখনও কখনও তাঁহার দীর্ঘকাল অনশনে কাটিয়া যাইত। এ সংবাদ মহারাজ শাহুর কর্ণগোচর হইলে তিনি পাত্রমিত্রগণ সহ তাঁহার নিকট গিয়া তদীয় ক্রোধোপশমের চেষ্টা করিতেন।

 বাজীরাও ও চিমণাজী আপ্পার প্রতি ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর বিশেষ স্নেহ ছিল। স্বরাজ্যের হিতসাধনে ও হিন্দু-ধর্ম্ম-রক্ষায় তাঁহাদিগের আগ্রহ দেখিয়া তিনি তাঁহাদিগের বিশেষ পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। তিনি বাজী রাওকে প্রভূত অর্থ ঋণস্বরূপ দান করিয়াছিলেন। বালাজী বিশ্বনাথও তাঁহার নিকট অর্থ সাহায্য লাভ করিতেন। বাজী রাও যে সকল সমরাভিযান করিয়া স্বরাজ্য-বৃদ্ধি ও মোসলমান শক্তি খর্ব্ব করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা, স্বামীজীর নিকট যথাসময়ে অর্থ সাহায্য না পাইলে, তাঁহার পক্ষে কতদূর সম্ভবপর হইত, বলা যায় না।

 স্বামীজী প্রতি বৎসর শ্রাবণ মাসে সমাধিস্থ হইতেন এবং পূর্ণ এক মাসকাল যোগাবলম্বনপূর্ব্বক ভাদ্র শুক্লা চতুর্থীর দিনে গুহা ত্যাগ করিতেন। তাঁহার সমাধিবিসর্জ্জন-কালে মহারাজ শাহু স্বীয় সদস্যবর্গসহ তথায় উপস্থিত হইতেন। বাজী রাও ও চিমণাজী আপ্পার মৃত্যুর পর হইতে তাঁহার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইতে আরম্ভ হয়। বাজী রাওয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া তিনি কয়েক দিন গোমূত্র ও তক্র ত্যাগ করিয়াছিলেন। ১৭৪১ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে চিমণাজী ইহলোক ত্যাগ করিলে স্বামীজী রাজনীতিক ব্যাপার হইতে অবসর গ্রহণ করেন। ইহার অল্প দিন পরে তাঁহার মৃত্যু হয়।