দশম অধ্যায়।

পোর্তুগীজদিগের দমন—নিজামের সহিত

সন্ধি —বাজী রাওয়ের দেহত্যাগ—

চরিত্র-সমালোচনা।

বাজী রাওয়ের পেশওয়ে পদলাভ-কালে এদেশে পোর্ত্তুগীজেরা মহারাষ্ট্রীয়দিগের বলিষ্ঠ শত্রুর শ্রেণীতে পরিগণিত হইবার যোগ্যতালাভ করিয়া ছিলেন, একথা ইতঃপূর্ব্বে উক্ত হইয়াছে। পোর্তুগীজদিগকেফিরিঙ্গীর অত্যাচার। মহারাষ্ট্রীয়গণ ফিরিঙ্গী বলিতেন। গোয়া, দাভোল, দমণ, দীও, সাষ্টী, বসই প্রভৃতি স্থানে ফিরিঙ্গীদিগের অধিকার স্থাপিত হইয়াছিল। তাঁহারা এই সকল প্রদেশে যে কেবল দুর্গাদি নির্ম্মাণ-পূর্ব্বক আপনাদিগের অধিকার দৃঢ় করিয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন, তাহা নহে। এদেশবাসীর প্রতি ধর্ম্মসম্বন্ধে তাঁহারা যৎপরোনাস্তি অত্যাচার উৎপীড়ন করিতেন। তাঁহারা রোমান ক্যাথলিক পন্থাবলম্বী ছিলেন বলিয়া বলপূর্ব্বক অপরকে খৃষ্টান করা তাঁহাদিগের নিকট ধর্ম্মকার্য্য বলিয়া বিবেচিত হইত। বিধর্ম্মীদিগের প্রতি অত্যাচার করিয়া তাহাদিগকে খৃষ্টধর্ম্ম-গ্রহণে বাধ্য করিবার জন্য, তাঁহারা স্বদেশে একটী সভাস্থাপন করিয়াছিলেন। ভারতেও তাহার শাখা স্থাপিত হইয়াছিল। বিধর্ম্মীকে খৃষ্টধর্ম্মে বিশ্বাস করাইবার জন্য এই সভার সদস্যেরা যে সকল উপায় অবলম্বন করিতেন, তন্মধ্যে কারাগারে নিক্ষেপ, উপবাসাদির ক্লেশদান, বেত্রাঘাত, উত্তপ্ত ভাণ্ডোপরি স্থাপন, অঙ্গে জ্বলন্ত-বর্ত্তিকা বন্ধন ও প্রাণনাশ প্রভৃতিই প্রধান ছিল। ফলতঃ খৃষ্টানেরা এই সময়ে এদেশে আসিয়া যেরূপ পশুবৎ অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছিলেন, জগতে বোধ হয় আর কোনও ধর্ম্মাবলম্বীরা সেরূপ করেন নাই। তাঁহারা মোসলমানদিগেরও প্রতি এইরূপ অত্যাচার করিতেন।

 পোর্ত্তুগীজ-শাসিত প্রদেশের সমস্ত হিন্দু অধিবাসী নানা প্রকারে উৎপীড়িত হইয়া খৃষ্টধর্ম্মাবলম্বনেহিন্দুর কষ্ট। বাধ্য হইয়াছিলেন। ফিরিঙ্গি দিগের হস্তে ঐ অঞ্চলের যাবতীয় দেব-মন্দিরাদি বিধ্বস্ত হইয়াছিল। কোন স্থানে হিন্দুদিগকে ব্রত-নিয়ম বা যাগযজ্ঞাদি করিতে দেখিলে তাঁহারা তথায় উপস্থিত হইয়া ব্রতাচারী ও যজ্ঞকারীদিগকে বন্দী-পূর্ব্বক স্বধর্ম্ম-ত্যাগে বাধ্য করিতেন। এতদ্ভিন্ন তাঁহারা গ্রামের প্রাচীন জমীদারদিগের স্বত্বহরণ করিয়া তাঁহাদিগকে পথের ভিখারী করিয়াছিলেন। দরিদ্র শ্রমজীবী দিগকে তাঁহারা বিনা বেতনে বেগার খাটাইয়া লইতেন। কেবল তাহাই নহে, যাহারা বিনা পারিশ্রমিক-লাভে সমস্ত দিন তাঁহাদিগের কার্য্য করিত, তাঁহারা তাহাদিগকে একমুষ্টি অন্নদানও করিতেন না। ফিরিঙ্গীদিগের এইরূপ বিবিধ দুর্ব্যবহারে দেশ মধ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল।

 পোর্ত্তুগীজদিগের অত্যাচারে জর্জ্জরিত হইয়া অনেক হিন্দু স্ব স্ব জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া মহারাষ্ট্রআশ্রয়-প্রার্থনা। শাসিত দেশে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছিলেন। অনেকে সমুদ্রে ঝম্প দিয়া প্রাণত্যাগ-পূর্ব্বক দুঃসহ অত্যাচারের হস্ত হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছিলেন। কেহ কেহ বিদ্রোহী হইয়া তাঁহাদিগের কার্য্যে বাধা দিবার চেষ্টা করায় সবংশে নিহত হইয়াছিলেন। পরিশেষে হিন্দুগণ নিতান্ত উত্ত্যক্ত হইয়া মহারাষ্ট্রপতি শাহুর ও পেশওয়ে বাজী রাওয়ের শরণাপন্ন হইলেন। তাঁহারা তাঁহাদিগের নিকট এই বলিয়া এক আবেদনপত্র প্রেরণ করিলেন যে, মহারাষ্ট্রপতি যখন হিন্দুধর্ম্মের রক্ষক,তখন বিধর্ম্মী পোর্ত্তুগীজদিগের অত্যাচার হইতে হিন্দুদিগকে রক্ষা করা তাঁহার কর্ত্তব্য। এই আবেদনপত্র পাইয়া মহারাজ ফিরিঙ্গীদিগের হস্ত হইতে হিন্দুধর্ম্মীদিগের রক্ষার জন্য বাজী রাও ও চিমণাজী আপ্পাকে কোঙ্কণে প্রেরণ করিলেন। ফিরিঙ্গী দিগের দমনের জন্য শ্রীমদ্ ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীও তাঁহাদিগকে অনুরোধ করিয়াছিলেন।

 মহারাজ শাহুর পূর্ব্বেই এই অত্যাচার-কাহিনী বাজী রাওয়ের কর্ণগোচর হইয়াছিল এবংকুলবা-বিজয়। তিনি কোঙ্কণের অধিবাসীদিগকে অভয়দান করিয়া পত্রও লিখিয়াছিলেন। এক্ষণে মহারাজ শাহুর অনুমতি পাইবা মাত্র তিনি স্বকীয় বিজয়ী সৈন্যদল সহ কোঙ্কণে উপস্থিত হইলেন। মহারাষ্ট্র নৌ-সেনানী আংগ্রে পোর্ত্তুগীজগণের দমনে অসমর্থ হইয়া মহারাজ শাহুর সহায়তা প্রার্থনা করিয়াছিলেন। বাজী রাও তাঁহার সাহায্যের জন্য গমন করিলে কুলাবার নিকট শত্রু পক্ষের সহিত যুদ্ধ ঘটে। বাজী রাওয়ের সমরকৌশলে ফিরিঙ্গীদিগের সহিত যুদ্ধে মারাঠা সৈন্য বিজয়লাভ করে (১৭৩৫)।

 কুলাবায় পোর্ত্তুগীজদিগকে পরাজিত করিয়া বাজী রাও সাষ্টী (Salsette) ও বসই (Bassein)ঠাণা অধিকার। আক্রমণ করিলেন। তাঁহার চেষ্টায় প্রথমে বসইর নিকটবর্ত্তী ঘোড় বন্দর দুর্গ অধিকৃত হয়। তাহার পর ঠাণা (Tanna) নগর আক্রান্ত হইল। ঐ স্থানও বাজী রাও পোর্ত্তুগীজদিগের হস্ত হইতে উদ্ধার করিলেন। ইহার পর তাঁহাদিগের ‘বান্দরা’ নামক সেনা নিবাসের প্রতি বাজী রাওয়ের দৃষ্টি নিপতিত হয়। বাজী রাও বান্দরা আক্রমণ করিলে ইংরাজেরা বোম্বাই আক্রান্ত হইবার ভয়ে গোপনে পোর্ত্তুগীজদিগকে যুদ্ধসামগ্রীদানে সাহায্য করিতেছিলেন। পোর্ত্তুগীজদিগের সহিত যুদ্ধে জয়লাভের জন্য বাজী রাও সমরদক্ষ আরবী, মাওলী ও হেটকরীদিগকে[]স্বীয় সৈন্য-দলভুক্ত করেন। কিন্তু বান্দরা আক্রমণের পূর্ব্বেই তিনি সংবাদ পাইলেন যে, মহারাষ্ট্রীয়দিগের বিনাশের জন্য দিল্লীতে আবার নানা প্রকার চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র হইতেছে। কাজেই তাঁহাকে পোর্ত্তুগীজ-দমন পরিত্যাগ করিয়া উত্তর ভারতে গমন ও ভূপাল নামক স্থানে নিজামের পরাজয় সাধন করিতে হইল।

 বাজীরাও উত্তর ভারতে প্রস্থিত হইলে চিমণাজী আপ্পা পোর্ত্তুগীজদিগের সম্পূর্ণ উচ্ছেদসাধনেরচিমণাজীর জয়লাভ। জন্য পূর্ণ দুই বৎসরকাল যুদ্ধ করিয়া সাঙ্গী, তারাপুর, মাহিম প্রভৃতি বহু প্রদেশ অধিকার করিলেন। মহারাষ্ট্রীয়েরা যে প্রয়োজন হইলে সম্মুখ সমরে পশ্চাৎপদ হইতেন না, পোর্ত্তুগীজদিগের সহিত যুদ্ধে তাহা প্রতিপন্ন হইয়াছিল। ইংরাজ ও হাব্‌সীগণ এই সকল যুদ্ধে মহারাষ্ট্রীয়দিগের বিপক্ষে সহায়তা করিয়া ও জয়লাভ করিতে পারেন নাই। মারাঠাগণের সহিত যুদ্ধে তাঁহাদিগের শতাধিক পোত-পূর্ণ যুদ্ধসামগ্রী নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছিল এবং কয়েকজন প্রসিদ্ধ সেনাপতি নিহত হইয়াছিলেন। চিমণাজী আপ্পারও বহু সহস্র লোক স্বধর্ম্ম ও স্বজাতির রক্ষার জন্য এই সকল যুদ্ধে অলৌকিক শৌর্য্য- প্রকাশ-পূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করে।

 দুই বৎসর কাল নানা স্থানে খণ্ড-যুদ্ধের পর ১৭৩৯ খৃষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রীয়েরা বসই আক্রমণবসইর যুদ্ধ। করেন। কোঙ্কণের মধ্যে বসই দুর্গ পোর্ত্তুগীজদিগের প্রধান আশ্রয়স্থান ছিল। ঐ স্থান অধিকার করিতে পারিলেই তাঁহাদিগের মূলোচ্ছেদ ঘটিয়া হিন্দুদিগের প্রতি সকল অত্যাচারের অবসান হইবে, ইহা ভাবিয়া চিমণাজী ঐ স্থান অধিকার করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিন মাস অবরোধের পরও ঐ দুর্গ তাঁহাদিগের হস্তগত হইল না। পোর্ত্তুগীজেরা ইউরোপ হইতে শিক্ষিত সৈন্য আনয়ন করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের তোপের সম্মুখে মহারাষ্ট্রীয় সেনা পুনঃ পুনঃ ছত্রভঙ্গ হইতে লাগিল। মারাঠারা সুড়ঙ্গ করিয়া বারুদের সাহায্যে দুর্গ-প্রাচীর উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন,—গোলাবর্ষণ করিয়া দুর্গপ্রাচীরে একটা ছিদ্রও করিয়াছিলেন। কিন্তু কিছুতেই ফলোদয় হইল না। তখন চিমণাজী আপ্পা দুর্গ অধিকারের প্রতিজ্ঞা করিয়া একদিন স্বীয় সর্দ্দারগণকে বলিলেন যে,“তোমরা যদি দুর্গে প্রবেশ করিতে না পার, তাহা হইলে আমাকে তোপের মুখে বাঁধিয়া গোলার সহিত দুর্গ-মধ্যে নিক্ষেপ কর!” তাঁহার এই কথায় উত্তেজিত হইয়া ‘হর হর মহাদেব’ শব্দে সকলে পুনর্ব্বার দুর্গ আক্রমণ করিলেন। তাহাতে মহারাষ্ট্রীয়দিগের বিজয় হইল। মারাঠারা বসইর দুর্গস্থিত ক্রুশ-চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া তথায় আপনাদিগের জাতীয় গৈরিক পতাকা উড্ডীন করিলেন (১৫ই মে)। এই যুদ্ধে মহারাষ্ট্রীয়েরা অসীম শৌর্য্য প্রকাশ করিয়াছিলেন []। শেষদিনের যুদ্ধে পোর্ত্তুগীজদিগের ৭ শত সৈনিকের প্রাণাত্যয় ঘটে। সর্ব্বশুদ্ধ দুই বৎসরের মধ্যে তাঁহাদিগের সহিত সমরে ১৪ সহস্র মহারাষ্ট্র সেনা হতাহত হইয়াছিল। কিন্তু এ আত্মত্যাগের ফলে গোয়া প্রদেশ ভিন্ন ফিরিঙ্গীদিগের অধিকৃত বহু স্থান মহারাষ্ট্রীয়দিগের হস্তগত হওয়ায় হিন্দুগণের নির্য্যাতন-ভোগের অবসান হয়। বসই দুর্গ অধিকার-কালে দুর্গাধিপতির পরিবারস্থিতা একটী মহিলা মহারাষ্ট্রীয় সৈনিকবৃন্দের হস্তগত হইয়াছিল। কিন্তু চিমণাজী আপ্পা তাঁহাকে সসম্মানে তাঁহার আত্মীয়গণের নিকট প্রেরণ করেন। বসইর খৃষ্টানদিগের মুখে এখনও এ সম্বন্ধে চিমণাজী আপ্পার প্রশংসা শুনিতে পাওয়া যায়।

 এদিকে নাদির শাহের প্রস্থানের পর দিল্লীর অবস্থা এরূপ শোচনীয় হইল যে, বাজী রাওবাদশাহের সম্মান। চেষ্টা করিলে, অনায়াসে মোগলদিগের রাজধানীতে মহারাষ্ট্র-বিজয়-পতাকা রোপণ করিয়া মোগলবাদশাহীর বিলোপ সাধন করিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি তাহা করিলেন না। দিল্লীশ্বরের প্রতি মহারাজ শাহুর শ্রদ্ধাই ইহার প্রধান কারণ। তদ্ভিন্ন অন্ততঃ কিছু দিনের জন্য দিল্লীর সিংহাসনে সাক্ষিগোপালস্বরূপ একজন বাদশাহকে প্রতিষ্ঠিত রাখাও তাঁহার নিকট রাজনীতিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইয়াছিল। এই কারণে তিনি দিল্লীশ্বরের এই বিপন্ন দশাতেও ১০১টী স্বর্ণমুদ্রা উপঢৌকনসহ তাঁহার নিকট এক বশ্যতা-স্বীকারপত্র প্রেরণ করিলেন। বাদশাহ ইতঃপূর্ব্বে নাদির শাহের হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য বাজী রাওয়ের সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। কিন্তু বাজী রাও সমরায়োজনপূর্ব্বক অভিযান করিবার পূর্ব্বেই নাদির দিল্লী লুণ্ঠন-পুরঃসর প্রস্থান করেন। কাজেই বাজী রাওকে বাদশাহের এই বিপত্তিতে আন্তরিক সহানুভূতি-প্রকাশ ও স্বীয় বশ্যতা জ্ঞাপন করিয়া পত্র প্রেরণ করিতে হয়। দিল্লীশ্বর সেই পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার-পূর্ব্বক বাজী রাওকে গজ-বাজিসহ রত্নময় ভূষণ-পরিচ্ছদাদি-দানে প্রতিসম্মানিত করিলেন (১৭৩৯ খৃঃ ২২এ মে)। কিন্তু নিজাম-উল্‌-মুল্কের সহিত ভূপালে যে সন্ধি হয়, তাহার সর্ত অনুসারে বাজী রাওকে মালব প্রদেশের সুভেদারীর নূতন সনন্দ দিবার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তাহা রক্ষিত হইল না। বাজী রাও সেজন্য আর পীড়াপীড়ি আবশ্যক মনে করিলেন না। কারণ, বাদশাহও অতঃপর মালবের জন্য কোনও নূতন সুভেদার নিযুক্ত করিয়া পাঠান নাই।

 এই সময়েও শিন্দে-হোলকর প্রভৃতি বাজী রাওয়ের সর্দ্দারেরা কোঙ্কণ হইতে প্রত্যাবৃত্তনিজাম-রাজ্য আক্রমণ। হইয়া তাহার সহিত মিলিত হইতে পারেন নাই। ইত্যবসরে বাজী রাও রাজপুত ও বুন্দেলখণ্ডের অন্যান্য রাজন্যবর্গের সহিত মিত্রতা স্থাপন করিয়া নিজামের বিরুদ্ধে অভিনব অভিযানের আয়োজন করিতে লাগিলেন। ভূপালের যুদ্ধের পর যে সন্ধি হইয়াছিল, তাহার সমস্ত সর্ত্ত যথারীতি পালনে নিজামের অমনোযোগিতা দেখিয়া বাজী রাও দক্ষিণাপথ হইতে তাঁহার অস্তিত্ববিলোপ করিতে দৃঢ়-সংকল্প হইয়াছিলেন। কিন্তু রঘুজী ভোঁস্‌লে ও দামাজী গায়কোয়াড়ের সহিত সদ্ভাব না থাকায় বাজী রাওকে এই সময়ে একটু ব্যতিব্যস্ত হইতে হয়। এই কারণে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই রঘুজীর সহিত সাক্ষাৎপূর্ব্বক তাঁহাকে নিজামের সম্বন্ধে স্বীয় অভিপ্রায়-জ্ঞাপন ও তাঁহার সহিত মিত্রতাস্থাপন করিলেন। তিনি তাঁহাকে দক্ষিণ দিক্ হইতে কর্ণাটকস্থিত মোগল প্রদেশ আক্রমণ করিতে উপদেশ দিয়া স্বয়ং উত্তর দিক্ হইতে নিজামের বিরুদ্ধে অভিযান করিলেন।

 নিজাম-উল্‌-মুল্‌ক্‌ তখনও উত্তর ভারতে ছিলেন। দক্ষিণাপথে তাঁহার পুত্রগণের মধ্যেপ্রতিষ্ঠানের সন্ধি। ভ্রাতৃ-বিরোধের সূত্রপাত হইয়াছিল। নিজাম রাজ্যে অভিযানের ইহাই উপযুক্ত অবসর বিবেচনা করিয়া বাজী রাও প্রথমে নাসির জঙ্গকে আক্রমণ পূর্ব্বক দশ সহস্র সৈন্য সহ তাঁহাকে অওরঙ্গাবাদে অবরুদ্ধ করিলেন। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ‘বেদর’ হইতে বহুসংখ্যক সৈন্য নাসিরের সহায়তার জন্য আগমন করিল। এই উভয় সৈন্যদল মিলিত হওয়ায় শত্রুপক্ষের সংখ্যা ৪২ সহস্র হইল। তন্মধ্যে ১৯ হাজার অশ্বসাদী ও ২৩ হাজার বরকন্দাজ ছিল। তদ্ভিন্ন দেড়শত কামান ও তিন শত ধনুর্ব্বাণ-বাহক উষ্ট্রও তাঁহাদের সঙ্গে ছিল। বাজী রাওয়ের সৈন্য-সংখ্যার অল্পতাবশতঃ এই প্রচণ্ড সেনাদলের সহিত যুদ্ধে প্রথমে তাঁহাকে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয়। কিন্তু ইত্যবসরে চিমণাজী আপ্পা ও শিন্দে হোলকর আসিয়া তাঁহার সহিত যোগদান করায় তিনি মোগলদিগের ছত্রভঙ্গ করিতে সমর্থ হন। এই যুদ্ধকালে প্রায় ২/৩ মাস পর্যন্ত অন্ন-জলের কষ্ট সহ্য করিয়া মহারাষ্ট্র-সেনাকে বনে বনে মোগলদিগের পশ্চাদ্ধাবন করিতে হয়। এতদ্ভিন্ন এই সমর-ব্যাপারের জন্য প্রজাকুলেরও বিশেষ কষ্ট হইতেছিল। এই কারণে, নাসির জঙ্গ যখন পরাস্ত হইয়া তাঁহার নিকট সন্ধি প্রার্থনা করিলেন, তখন বাজী রাওকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহাতে সম্মতি প্রকাশ করিতে হইল। তদনুসারে প্রতিষ্ঠান নগরে ১৭৪০ খৃঃ ৩রা মার্চ উভয় পক্ষে সন্ধি হয়। এই সন্ধির বিনিময়ে খানদেশের অন্তর্গত খরগোণ ও হিণ্ডিয়া নামক দুইটি প্রদেশ মোগলেরা মহারাষ্ট্রীয়দিগকে দান করেন।

 এই সন্ধি স্থাপিত হইবার পর মহারাজ শাহুর আদেশক্রমে চিমণাজী আপ্পা কোঙ্কণ ও বাজী রাও শিন্দে হোলকরের সহিত উত্তর ভারত অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কথিত আছে, দিল্লী অতিক্রম করিয়া আটক পর্য্যন্ত গমন করাই বাজী রাওয়ের এবারকার অভিযানেরপরলোক প্রাপ্তি। উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাহা সুসিদ্ধ হইল না। তিনি নর্ম্মদা তীরে উপস্থিত হইলে সহসা তাঁহার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইয়া তিনি নব জ্বরে আক্রান্ত হইলেন। এই জ্বরের আক্রমণ তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। ১৭৪০ খৃষ্টাব্দের ২৮এ এপ্রিল (বৈশাখ শুক্লা ত্রয়োদশী) ৪১ বৎসর বয়ক্রম কালে নর্ম্মদা তীরে তাঁহার জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাপিত হইল []। মৃত্যু-কালে তিনি তাঁহার প্রিয় সর্দ্দার শিন্দে ও হোলকরকে মোসলমানদিগের শাসনপাশ হইতে ভারতবর্ষের উদ্ধার-সাধন করিবার উপদেশ দিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যু-সংবাদে সমগ্র মহারাষ্ট্রে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছিল। মহারাজ শাহু শোকে অধীর হইয়াছিলেন। তাঁহার আত্মীয়গণের শোকের বর্ণনাই বাহুল্য।

 বাজী রাও বিংশতি বৎসর কাল পেশওয়ে পদে কার্য্য করিয়াছিলেন। তাঁহার কার্য্যকালেরতাঁহার চরিত্র। অধিকাংশ‍ই যুদ্ধাভিযানে অতিবাহিত হইয়াছিল বলিয়া তিনি রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বন্দোবস্ত বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ করিতে পারেন নাই। তাঁহার বীরত্ব ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিরূপ অসাধারণ ছিল, তাহা ইতঃপুর্ব্বে বহুস্থলে প্রদর্শিত হইয়াছে। তাঁহার চরিত্রে কোনও প্রকার নীচতা ছিল না। বরং অনেকস্থলে তিনি যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়াছেন, তাহা সর্ব্বত্র দেখিতে পাওয়া যায় না। তিনি দূরদর্শী, সরল ও দয়ালু ছিলেন। তদানীন্তন মহারাষ্ট্ররাজপুরুষদিগের মধ্যে তাঁহার ন্যায় সুশিক্ষিত ও সদ্বক্তা আর কেহই ছিলেন না। তাঁহার দয়ালুতা-গুণে নিজাম–উল্-মুল্ক, কয়েকবার রক্ষা পাইয়াছিলেন। অনেকের বিবেচনায় এই দয়ালুতার জন্যই তিনি রাজনীতিক্ষেত্রে পুনঃ পুনঃ বিপন্ন হইয়াছিলেন। তিনি রাজনীতিক কঠোরতার সহিত শরণাপন্ন নিজামের বিনাশসাধন করিতে পারিলে মহারাষ্ট্রীয়গণের একটা প্রধান কণ্টক দূরীভূত হইত।

 স্বরাজ্যে বাজী রাওয়ের অনেক শত্রু ছিল। প্রতিনিধি, রঘুজী ভোঁস্‌লে, সেনাপতি দাভাড়েতাঁহার শত্রু। ও গায়কোয়াড় প্রভৃতি সর্ব্বদা তাঁহার অনিষ্টচিন্তা করিতেন। এ সম্বন্ধে তিনি একদা শ্রীমদ্ ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীকে লিখিয়াছিলেন,—
“দাভাড়ে, গায়কোওয়াড় ও বাণ্ডে প্রভৃতি যে সকল সর্দ্দার স্বার্থবুদ্ধির বশবর্ত্তী হইয়া নানা দেশ লুণ্ঠন ও অসংখ্য প্রজার শান্তিনাশ করিয়াছেন, তাঁহারা আজ কোটী কোটী মুদ্রার অধিকারী হইয়াছেন, আর আমি অভাগা আজীবন তোমার ও প্রভুর (মহারাজ শাহুর) চরণে কায়মনঃ-সমর্পণ-পূর্ব্বক নিষ্কপটভাবে কার্য্য করিয়া আজ অন্নের কাঙ্গাল হইয়াছি!” ফলতঃ বাজী রাও চিরজীবন নিঃস্বার্থভাবে দেশের কার্য্য করিয়া সাধারণের যে ভক্তি ও প্রীতি আকর্ষণ করিয়াছিলেন, তাহা অনেকেরই চক্ষুঃশূল হইয়াছিল। নচেৎ তিনি কখনও কাহারও অনিষ্ট সাধন করেন নাই; বরং যে সকল সর্দ্দার সর্ব্বদা তাঁহার বিদ্বেষ করিতেন, তিনি দেশের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া তাঁহাদিগের সহিত মৈত্রীস্থাপন করিতেও বিরত হন নাই।

 দেশ হইতে যবন-শাসনের উচ্ছেদ করিবার জন্য বাজী রাওকে অতিরিক্ত সৈন্যপোষণ করিয়াতাঁহার ঋণ। বিষম ঋণজালে জড়িত হইতে হইয়াছিল। দেশের সর্ব্বোৎকৃষ্ট সৈনিকদিগকে সংগ্রহ করিবার জন্য তিনি প্রায়ই অতিরিক্ত অর্থব্যয় করিতেন। সময়ে সময়ে ঋণের জন্য তাঁহাকে কিরূপ বিপন্ন হইতে হইত, তাহা নিম্নে অনূদিত পত্র হইতে পাঠক বুঝিতে পারিবেন,—

শ্রীমৎ পরমহংস পরশুরাম বাবা স্বামীজীর শ্রীচরণেষু।

আজ্ঞাকারী সেবক বাজী রাওয়ের বিনীত নিবেদন—মহারাজ, খণ্ড—
জীর হস্তে যে আশীর্ব্বাদপত্র প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা পাইয়াছি। বাবা! তুমি নিজে সন্ন্যাসী হইয়াছ, আর আমাদিগকে সংসার প্রপঞ্চে ফেলিয়া রাখিয়াছ। সেই প্রপঞ্চে পড়িয়া লাভের মধ্যে আমার ২০ লক্ষ টাকা কর্জ্জ হইয়াছে; ঋণদাতাদিগের নরককুণ্ডে পড়িয়া আমি পচিতেছি। এই জ্বালা সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া গত বৎসর যখন “পিম্প্রী”তে তোমার সহিত সাক্ষাৎ হয়, তখন সমস্ত কার্য্যের ভার তোমার হস্তে অর্পণ-পূর্ব্বক নিঃসঙ্গভাবে দেবার্চ্চনায় মনোনিবেশ করিবার সংকল্প আপনাকে জ্ঞাপন করিয়াছিলাম। তখন আপনি কৃপা-পূর্ব্বক এই বলিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, “ভার্গবের চরণে যখন তোমার ভক্তি আছে, তখন নিশ্চয়ই তুমি সর্ব্বত্র বিজয়ী হইয়া বহু অর্থলাভ করিবে, তোমার ঋণ শোধ হইবে। ভার্গব তোমার সাহায্যকারী হইয়াছেন।” সেই আশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া এতদিন ধৈর্য্য ধারণ করিয়াছিলাম। কিন্তু ফলে কিছুই হইল না, যশোলাভ ভিন্ন এক কপর্দ্দকও ধনলাভ হইল না। এখন প্রতাহ আমাকে ঋণদাতাদিগের পায়ে ধরিতে হয়। শিলেদারদিগের পায়ে পড়িতে পড়িতে আমার কপালের চামড়া ক্ষয়িত হইয়া গেল। আর এরূপ সুখে আমার কাজ নাই। তুমি আইস ও নিজের কার্য্যভার নিজে গ্রহণ কর। অথবা সর্ব্বসঙ্গপরিত্যাগ করিয়া— তোমার নিকট গমন করিতেছি। তোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে যদি এই বৎসরের মধ্যে আমাকে রাজার ও মহাজনের ঋণ হইতে মুক্ত করিস, ত ভাল; নচেৎ তোর দেবতার সমক্ষে প্রাণত্যাগ করিব। তোর সন্তানকে ঋণ মুক্ত করিবি এরূপ আশ্বাস যদি পাই, তবে আরও ৮/১০ মাস জীবন ধারণ করিব। এই কথার মধ্যে যদি কোনও কপটতা থাকে, তবে তোরই দিব্য। অথবা তুই কেমন দেবতা যে, আমার মনের কপটতা বা নির্ম্মলতা বুঝিতে পারিতেছিস্ না। তুই যখন আমার বেদনা বুঝিলি না, তখন আমিই বড় ভাগ্যবান্! আমাদের লজ্জা রক্ষা করা তোরই কর্ত্তব্য। যদি লজ্জা থাকে, তবে আমার উদ্ধার করিয়া ব্রাহ্মণের অবশিষ্ট কার্য্য (অর্থাৎ ধর্ম্মরাজ্য প্রসার দ্বারা স্বধর্ম্ম-রক্ষা) আমার দ্বারা করাইয়া লও। আর যদি তাহা না করিস্, তবে আমার গরিবের উপর রাগ করিতেছিস্ কেন? তোর কার্য্য-ভার তুই ফিরাইয়া নে, এবং আমাকে এ প্রপঞ্চ হইতে মুক্তি দান কর্। আমি অন্য কোনও দেবতার সেবা করিবার চেষ্টা দেখি গে!”

 বাজী রাও দেশের কার্য্য করিবার জন্য জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন, দেশের কার্য্য করিতেইপারিবারিক সুখ। তাঁহার জীবনপাত হইয়াছিল। তাঁহার কার্য্য-কলাপে সমগ্র মহারাষ্ট্র দেশ গৌরবান্বিত হইয়াছিল। ভগবানের অনুগ্রহে তিনি স্বীয় স্বভাবের অনুরূপ ভ্রাতা পাইয়াছিলেন। চিমণাজী আপ্পার ন্যায় শৌর্য্যশালী অনুগত ভ্রাতা অতি অল্পলোকের ভাগ্যে ঘটিয়া থাকে। তাঁহাদিগের সৌভ্রাত্র সকলেরই অনুকরণীয় ছিল বলিয়া শ্রীমদ্ ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী তাঁহাদিগকে রাম-লক্ষ্মণের সহিত তুলিত করিতেন। বাজী রাও গণপতির উপাসক ছিলেন। তাঁহার অলৌকিক সৌন্দর্য্যের সম্বন্ধে মহারাষ্ট্রে কয়েকটি আখ্যায়িকা প্রচলিত আছে। তাঁহার ভাগ্যে গুণবান্ ভ্রাতার ন্যায় গুণবতী ভার্য্যারও সমাবেশ হইয়াছিল। তদীয় সহধর্ম্মিণী কাশী বাঈ অতীব ধীর ও গম্ভীর-প্রকৃতি রমণী ছিলেন।

 ঐতিহাসিক সিড্‌নী ওয়েন সাহেব তদীয় India on the Eve of British Conquest নামক গ্রন্থে বাজী রাও সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, উপসংহারে তাহা উদ্ধৃত করিলাম।

 Baji Rao though a skilful politician and a profound statesman, was at the same time a comparatively straightforward, plain spoken soldier, prompt to act—a man for word and blow. Nizam-ul-Mulk, though especially in early life bold as a lion when his passions were aroused, and terrible as fate when he deemed the time for action come, was habitually cautious, calculating, given to a variety of expedients, fond of entangling his adversaries in a network of deplomacy and of reducing their strength by cuningly fomenting dissensions among their followers. pp. 185.

 Baji Rao’s attitude was simple, loyal and at the same time popular in extending his own conquests he defferred habitually to the Rajas authority, and, through his father's wise arrangements, promoted the interest of the whole community. That, in doing so, he should gradually supplant his master in effective influences and establish, on behalf of his own family, what amounted to a federal hegemony, if not a sovereignty, was natural, but did not involve a daily practice of cafty device, or the studious many-sidedness inevitable from Nizam-ul-Mulk’s ambiguous position. pp. 186.7.

  1. রত্নাগিরি অঞ্চলের বরকন্দাজদিগকে হেটকরী বলে। ইহারা লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। মাওলী সৈন্য মহাত্মা শিবাজীর সময় হইতে অসিযুদ্ধে বিশেষ খ্যাতি লাভ করে।
  2. এই যুদ্ধসম্বন্ধে বর্ণনা করিতে গিয়া গ্রাণ্ট ডফ্ সাহেব লিখিয়াছেন,—This remarkable siege, the most vigorous ever prosecuted by the Marathas. এণ্ডারসন সাহেবের মতে The siege was carried on with such extraordinary vigour, skill and perseverance, as perhaps Marathas have in no other instance displayed.
  3. ইতঃপূর্ব্বে ১২১ পৃষ্ঠার ১৯ পংক্তিতে বাজী রাওয়ের মৃত্যুদিবস ভ্রমক্রমে “১৭ই এপ্রিল”-রূপে মুদ্রিত হইয়াছে।