নবম অধ্যায়।

ভূপালের যুদ্ধে নিজামের দর্পনাশ—

নাদির শাহের অভিযান।

তঃপূর্ব্বে মারাঠীগণের বিরুদ্ধে বাদশাহকে সাহায্য করিবার জন্য নিজাম উল্-মুল্ক্ সসৈন্যে দিল্লীতে আহূত হইয়াছিলেন। নিজামকে এই কার্য্যে তৎপরদিল্লীর সংবাদ। করিবার জন্য বাদশাহ তাঁহার পুত্রকে মালব ও গুজরাথ প্রদেশের সুভেদারীর সনন্দ প্রদান করিয়াছিলেন। দিল্লীতে বাজী রাওয়ের হস্তে বাদশাহী সৈন্যের পরাজয় ঘটিবার পর নিজাম-উল্-মুল্ক্ সসৈন্য উত্তর-ভারতে উপস্থিত হন। তিনি যাহাতে নর্ম্মদা উত্তীর্ণ হইতে না পারেন, তজ্জন্য বিশেষ যত্ন করিতে, বাজী রাও স্বীয় ভ্রাতা চিমণাজীকে দিল্লী হইতে পত্র লিখিয়াছিলেন। কিন্তু পোর্ত্তুগীজদিগের উপদ্রবের জন্য চিমণাজী সে বিষয়ে কিছুই করিতে পারেন নাই। কাজেই নিজাম নির্ব্বিঘ্নে নর্ম্মদা পার হইলেন, এবং দিল্লীতে গিয়া বাদশাহের সাক্ষাৎকার লাভ করিলেন। তখন বাদশাহ বাজী রাওয়ের সহিত যে সন্ধি করিয়াছিলেন, তাহা ভুলিয়া গিয়া নিজামকে মারাঠাগণের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতে লাগিলেন। কেবল তাহাই নহে, তিনি সামন্ত রাজপুত নরপতিদিগকেও নিজামের সহায়তা করিবার জন্য আদেশ করিলেন। বুন্দীর রাজা ভিন্ন আর সকলেই এ সময়ে নিজামের সহিত মিলিত হইয়াছিলেন। মহারাজ সওয়াই জয়সিংহও এই অভিযানে স্বীয় পুত্রকে সসৈন্যে নিজামের সহকারিতার জন্য প্রেরণ করিতে বাধ্য হন। রোহিলারাও এই যুদ্ধে যোগদান করিয়াছিল। এইরূপে দিল্লীশ্বরের সমস্ত সামন্ত নরপতিকে সঙ্গে লইয়া যখন নিজাম গঙ্গা-যমুনার অন্তর্ব্বেদী হইতে মালবের অন্তর্গত সিরোঞ্জে উপস্থিত হইলেন, তখন তাঁহার নিকট ৫০ সহস্র সৈন্য সংগৃহীত হইয়াছিল। তদ্ভিন্ন কোটার রাজা দুর্জ্জন সাল ও অযোধ্যার নবাব সাদত খানের ভ্রাতুষ্পুত্র বিংশতি সহস্র সৈন্য সহ নিজামের সহিত মিলিত হইবার জন্য যাত্রা করিয়াছিলেন। অওরঙ্গাবাদেও দশ বার হাজার মোগল সৈন্য বাজী রাওকে বাধা দিবার জন্য প্রস্তুত ছিল। অধিকন্তু নিজামের তোপখানাও অতি উৎকৃষ্ট ছিল। দিল্লী ত্যাগকালে নিজাম-উল্-মুল্ক বাদশাহের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, তিনি অতঃপর মারাঠাদিগকে মালবে পদার্পণ করিতে দিবেন না।[]

 এদিকে বাজী রাও যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সহিত প্রায় ৮০ সহস্র সৈন্য সংগ্রহ করিয়া নর্ম্মদাপেশওয়ের রণসজ্জা। উত্তীর্ণ হইলেন। ১৭৩৮ খৃঃ জানুয়ারি মাসে ভূপাল (ভোপাল) নামক স্থানে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বাজী রাও নিজামকে উপযুক্ত শিক্ষা দান করিবেন, সংকল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার সৈন্যদল সত্বর গতিতে মালবে উপস্থিত হইতে বাধ্য হওয়ায় নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছিল। এই কারণে তিনি একেবারে নিজামকে আক্রমণ করিতে পারিলেন না। এই সময়ে নিজাম যদি বাজী রাওকে আক্রমণ করিতেন, তাহা হইলে সে যুদ্ধে জয়লাভ করা বাজী রাওয়ের পক্ষে অতীব কষ্টসাধ্য হইত। কিন্তু তিনি তাহা করিতে সাহসী না হইয়া ভূপাল নামক দুর্গের নিকট শিবির-সংস্থাপনপূর্ব্বক বাজী রাওয়ের আক্রমণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ঐ স্থানের একদিকে একটি নদী ও অপর দিকে একটি বিস্তীর্ণ জলাশয় ছিল। নিজামের বিবেচনা মতে তিনি অতি সুদৃঢ় স্থানেই আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 কিন্তু তাঁহার বুদ্ধিদোষে উহাই তাঁহার সর্ব্বনাশের কারণ হইল। প্রথম দিনের যুদ্ধেই নিজামেরসংঘর্ষ। পক্ষীয় ৫শত রাজপুত নিহত এবং ৭শত অশ্ব মহারাষ্ট্রীয়গণের হস্তগত হয়। মহারাষ্ট্র-পক্ষে ১ শত সৈনিক নিহত ও ৩ শতজন আহত হইয়াছিল। আর একদিনের যুদ্ধে মোসলমানগণের ১৫ শত সৈনিক গতাসু হয়। নিজাম দুর্গের আশ্রয়ত্যাগ করিয়া উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হইলে, সহজেই তাঁহার পরাজয় সাধন করিতে পারা যাইবে, ভাবিয়া বাজী রাও প্রথমে একটু দূরে সরিয়া গেলেন। কিন্তু নিজাম দুর্গের আশ্রয় ত্যাগ করিলেন না। তখন বাজী রাও নিজামকে চতুর্দ্দিক্‌ হইতে বেষ্টিত করিয়া অবরুদ্ধ করিলেন। নিজাম পিঞ্জরবদ্ধ হইয়া বাদশাহের নিকট সহায়তা চাহিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু তাঁহার প্রতি প্রধান মন্ত্রী খান দৌরার ও বাদশাহের আন্তরিক বিরাগ বশতঃ দিল্লী হইতে সাহায্য আসিল না। কাজেই নিজামের সহকারী রাজপুতেরা বাজী রাওয়ের শরণাপন্ন হইলেন। কিন্তু নিজামকে শিক্ষা দিবার জন্য বাজী রাও প্রথমে সে দিকে কর্ণপাত করিলেন না।

 এদিকে খাদ্যসামগ্রীর অভাবে নিজাম বিশেষ কৃশ হইতে লাগিলেন। তাঁহার পুত্র নাসির জঙ্গনিজামের পরাভব। এই সংবাদ পাইয়া পিতার সহায়তার জন্য সৈন্য সহ ভূপাল অভিমুখে আসিতেছিলেন। কিন্তু বাজী রাওয়ের নিদেশ-ক্রমে তাহার ভ্রাতা চিমণাজী আপ্পা স্বীয় সৈন্যবল সহ নাসিরের গতিরোধ করিতে লাগিলেন। পুত্রের বিলম্ব দেখিয়া নিজাম একবার সাহসপূর্ব্বক বাজী রাওয়ের বূহ্যভেদ করিবার চেষ্টা পাইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার সঙ্গে গুরুভার যুদ্ধোপকরণাদি থাকায় সে চেষ্টা সম্যক্‌ ফলবতী হইল না। পরন্তু বাজী রাও সসৈন্যে তাঁহার উপর আপতিত হওয়ায় তিনি ব্যতিব্যস্ত হইয়া ভূপাল দুর্গে প্রবেশ করিলেন। বাজী রাওয়ের নিকট দুর্গ প্রাচীর ভেদকরণোপযোগী আগ্নেয় অস্ত্রাদি না থাকিলেও তাঁহার সৈনিকগণের বাণ ও গুলির বর্ষণে জর্জ্জরিত হইয়া নিজামকে দুর্গের আশ্রয় পরিত্যাগ করিতে হইল। সেই সময়ে বাজী রাও তাঁহার তোপখানা অধিকার করিবার চেষ্টা করায় বহু সংখ্যক মহারাষ্ট্রীয় নিজামের তোপের মুখে উড়িয়া গেল! তথাপি বাজী রাওয়ের অদম্য সেনাদল তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ আক্রমণ করিতে ক্ষান্ত হইল না। নিজাম কিছুতেই মারাঠা সৈন্যের অবরোধ ভঙ্গ করিতে পারিলেন না। চতুর্ব্বিংশতি দিবস এইরূপ কষ্টে যাপন করিয়া নিরুপায় নিজাম বাজী রাওয়ের শরণাপন্ন হইলেন।

 নাসির জঙ্গের গতিরোধ করিবার জন্য বাজী রাও চিমণাজীকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতেতাঁহার দুর্দ্দশা। তিনি এক স্থানে বলিয়াছেন,—“নবাব (নিজাম-উল্‌-মুল্‌ক) বয়োজ্যেষ্ঠ, যুদ্ধ-ব্যাপারে বহুদর্শী ও বিচক্ষণ হইয়াও কিরূপে এত সহজে জালবদ্ধ হইলেন, তাহা ভাবিয়াই আমার পুনঃ পুনঃ বিস্ময়ের উদ্রেক হইতেছে। দিল্লী অঞ্চলে গুজব উঠিয়াছে, এইবার নিজাম-উল্-মুল্কের সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটিবে। এখন বঙ্গষের ন্যায় নবাবের দুর্গতি ঘটিতেছে। চারি দিনের অবরোধেই তাঁহার শিবিরে আটার দর টাকায় ৪ সের হইয়াছিল। হস্ত্যশ্বাদি অনাহারে কষ্ট পাইতে লাগিল। পরশ্ব ২৫এ রমজান (৬ই ফেব্রুয়ারি ১৭৩৮ খৃঃ) মোগল পাঠানেরা ভাড়ার গাড়ীর গরু খাইয়াছে। রাজপুতেরা উপবাস করিতেছে! আয়ামল্ল প্রভৃতি জাঠ সর্দ্দারেরা নবাবের সহিত সন্ধি করিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করিতেছেন।” এই পত্রের অপর স্থানে লিখিত আছে, “এ সময়ে তুমি যত পার, সৈন্যসংগ্রহ-পূর্ব্বক দাভাড়ে, ভোঁস্‌লে, যাদব, গায়কোয়াড় ও সরলস্কর প্রভৃতি দাক্ষিণাত্য সর্দ্দারগণকে সঙ্গে লইয়া আইস। যদি এই সময়ে সমস্ত মহারাষ্ট্রীয় সর্দ্দার একমত ও সমবেত হইয়া অধ্যবসায় প্রকাশ করেন, তাহা হইলে সমগ্র দক্ষিণ ভারত মোসলমানের শাসনপাশ হইতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত হইবে।” দুর্ভাগ্য ক্রমে মহারাজ শাহুর আদেশ সত্ত্বেও বাজী রাওয়ের প্রতি ঈর্ষাবশতঃ অনেক সর্দ্দারই এই সময়ে তাঁহার সহায়তায় ক্ষিপ্রতা প্রকাশ করিলেন না।

 পূর্ব্বোক্ত প্রকারে দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়া নিজাম বাজী রাওয়ের শরণাপন্ন হইলে, সন্ধির কথাবার্ত্তাসন্ধির সর্ত্ত। স্থির হইল। সমস্ত মালবদেশ এবং নর্ম্মদা ও চাম্বেলের মধ্যবর্তী প্রদেশ যাহাতে নির্বিঘ্নে মহারাষ্ট্রীয়গণের হস্তগত হয়, তিনি বাদশাহকে বলিয়া তাহাই করিয়া দিবেন এবং যুদ্ধব্যয়স্বরূপ ৫০ লক্ষ টাকা অর্থ দণ্ড প্রদান করিবেন, এইরূপ প্রতিশ্রুত হইয়া নিজাম বাজী রাওয়ের কবল হইতে সে যাত্রা রক্ষা পাইলেন (১৭৩৮ খৃঃ ৭ই জানুয়ারি)। এই সময় হইতে মালবে মহারাষ্ট্রীয় অধিকার নিষ্কণ্টক হইল। এই যুদ্ধজয়ের সংবাদ স্বীয় কনিষ্ঠকে জ্ঞাপন করিবার সময় বাজী রাও (১৭৩৮ খৃঃ ৮ই জানুয়ারি) লিখিয়াছিলেন, “যে নবাব চৌথ ও সরদেশমুখী স্বত্বের নাম মুখে আনিতেন না, তিনি এখন সমগ্র মালব পরিত্যাগের সনন্দ স্বহস্তে লিখিয়া দিলেন! সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর-কালে বাজী রাওয়ের সৌজন্য। তাঁহার মুখ হইতে পশ্চাল্লিখিত কথাগুলি বাহির হইল;“আজ পর্য্যন্ত যাহা কখনও হয় নাই, এ সময়ে আমাকে তাহাই করিতে হইল।” এইরূপে যে মালবের সুভেদারী পদে তাঁহার পুত্র অল্প দিন পূর্ব্বে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, সেই মালবের সমস্ত অধিকার এক্ষণে তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে হইল, ইহা সামান্য ঘটনা নহে। মহারাজের তপোবলে ও পিতৃপুণ্যফলে এই দুষ্কর কার্য্য সাধিত হইয়াছে। নতুবা নবাবের ন্যায় অদ্বিতীয় ক্ষমতা শালীসৌজন্য। ব্যক্তির পরাভব-সাধন কত দূর সম্ভবপর ছিল, তাহা বুঝিতেই পারিতেছ।” বীরজনোচিত শৌর্য্যসাহসের সহিত এইরূপ দর্পহীনতা বাজী রাওয়ের চরিত্রে বহুস্থলে দৃষ্ট হয়। সে যাহা হউক, কোটার রাজা দুর্জ্জনসাল এই যুদ্ধকালে নিজামের পক্ষাবলম্বনে বাজী রাওয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাজী রাও যুদ্ধে জয়ী হইলে তিনি আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ও সখ্যস্থাপন করেন। দুর্জ্জনসালের শাসনাধীন “নহর গড়” দুর্গ মোসলমানেরা অধিকার করিয়া তথায় আপনাদিগের শাসন প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন। রাজী রাও তাহার উদ্ধারসাধন করিয়া উহা কোটাপতির হস্তে সমর্পণ করেন। ১৭৩৮ খৃষ্টাব্দের মার্চ্চ মাসের প্রারম্ভে এই ঘটনা ঘটে।

 পরবর্ত্তী অব্দের প্রারম্ভে দিল্লী অঞ্চলে যে রাজনীতিক বিপ্লব উপস্থিত হইল, সে জন্য বাজীদিল্লীর বিপ্লব। রাওকে বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইতে হয়। কোঙ্কণ প্রদেশ হইতে দুর্ব্বৃত্ত পোর্ত্তুগীজদিগের আংশিক দমন করিয়া প্রত্যাবৃত্ত হইতে না হইতে তিনি সংবাদ পাইলেন যে, ইরাণের অধিপতি নাদিরশাহ দিল্লী আক্রমণ— পূর্ব্বক মোগলদিগের পরাভব ও ময়ূরসিংহাসন অধিকার করিয়াছেন! তাঁহার সহিত যুদ্ধে নিজাম পরাজিত, সাদত খান বন্দীভূত ও খান দৌরা নিহত হইয়াছেন। কেবল তাহাই নহে, তিনি একলক্ষ সৈন্যসহ দক্ষিণ ভারত আক্রমণেরও উদ্যোগ করিতেছেন। এই সংবাদে বাজী রাও কিছুমাত্র ভীত না হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত নাদির শাহের গতিরোধের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি নাসিরজঙ্গকে পত্র লিখিলেন যে,“নাদির শাহ হিন্দু ও মোসলমান উভয়েরই শত্রু; অতএব এ সময়ে আমাদিগের গৃহ-বিবাদ ভুলিয়া তাঁহার গতিরোধ সর্ব্বথা কর্ত্তব্য।” তিনি চিমণাজী আপ্পাকেও কোঙ্কণে পোর্ত্তুগীজদিগের দমন স্থগিত রাখিয়া সসৈন্যে তাঁহার সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত অনুরোধ-পূর্ব্বক ২৩এ মার্চ (১৭৩৯ খৃঃ) শুক্রবার এক পত্র লিখিলেন। সেই পত্রের কিয়দংশ এস্থলে অনুদিত হইল। বাজী রাও লিখিতেছেন,—  “শ্রীয়া সহ চিরঞ্জীব রাজশ্রী আপ্পা সমীপেষু, বাদশাহ ও তাঁহার আমীরেরা কাপুরুষতার জন্যবাজী রাওয়ের পত্র। ক্ষণে ক্ষণে অপদস্থ হইতেছেন। নবাব নিজাম-উল্-মুল্কের অবস্থাও অতীব হীন হইয়াছে। অতঃপর দক্ষিণ-ভারতে “ম্লেচ্ছ” শক্তির নাম গন্ধও রাখিব না। সমস্ত গড় কোট কেল্লা হস্তগত করিতে হইবে। তুমি বসইর (Bassein) যুদ্ধ-ব্যাপার শেষ করিয়া সসৈন্য অওরঙ্গাবাদে উপস্থিত হইলে সমস্ত মোগল-প্রদেশ-শাসনের ব্যবস্থা করা যাইবে। আমি খানদেশের বন্দোবস্ত করিতেছি। সংপ্রতি তোহমস্ত কুলি (নাদির শাহ) বাজী জিতিয়াছে। কিন্তু সমগ্র হিন্দু জাতি সমবেত হইয়া এসময়ে সাহস প্রকাশ করিলে এবং আমরা সমস্ত দাক্ষিণাত্য সৈন্যসহ অভিযান করিতে পারিলে, সর্ব্বত্র হিন্দুদিগেরই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে, এরূপ সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে।”

 ইহার দুই দিন পূর্ব্বে তিনি স্বীয় দীক্ষা-গুরু পরমহংস শ্রীমদ্‌ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীকে যে সুদীর্ঘ পত্রস্বামীজীকে লিখিত পত্র। লিখেন, তাহার একাংশ এইরূপ— “তোহমস্ত কুলি দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করিয়াছেন। চাকতাইদিগের (মোগলদিগের) সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হইল, সন্দেহ নাই। কিন্তু হিন্দুদিগের পক্ষেও ঘোর বিপৎকাল সমুপস্থিত হইয়াছে। আমার বিপত্তির সীমা নাই। আমি সৈন্যের ব্যয়-নির্ব্বাহ করিতে করিতে ঋণসাগরে মগ্ন হইয়াছি। তবে স্বামীজীর আশীর্ব্বাদ যতক্ষণ আমার মস্তকে বর্ষিত হইতেছে, ততক্ষণ আমি কোনও বিষয়ে চিন্তা করি না। কেবল আপনার অবগতির জন্য প্রকৃত অবস্থা বিবৃত করিলাম। ভবিষ্যকর্ত্তব্যতা-সম্বন্ধে উপদেশ প্রার্থনীয়।” পরে ২৪এ মার্চের পত্রে তিনি লিখিতেছেন,—“স্বামীজীর আশীর্ব্বাদপত্র পাইয়া পরম আনন্দলাভ করিলাম। তোহমস্ত কুলি খান দিল্লী অধিকার করিয়াছেন। (আমরা ভিন্ন) আর কেহ তাঁহার শত্রু নাই। এখন তিনি আমাদিগের ও আমরা তাঁহার শত্রু। অতএব দিল্লী হইতে তাঁহার দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা করিবার পূর্ব্বে যাহাতে সমস্ত মারাঠা সৈন্য চামেলী (চাম্বেল) নদী উত্তীর্ণ হইয়া তাঁহার গতিরোধ করিতে পারে, যাহাতে তিনি এদিকে অগ্রসর হইতে না পারেন, তাহার ব্যবস্থা করিতেছি। এসময়ে বড় গুরুতর বিপদ উপস্থিত হইয়াছে। আপনি অবশ্যই এবিষয়ে নিশ্চিন্ত নহেন। আপনার আশীর্ব্বাদে মঙ্গলই ঘটিবে।” এইরূপে বাজী রাও মহারাষ্ট্র সেনা একত্র করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। তিনি নাসির জঙ্গের ন্যায় সমস্ত রাজপুত রাজাদিগকেও গোপনে পত্র লিখিয়া নাদিরের গতিরোধে অগ্রসর হইতে উৎসাহিত করিয়াছিলেন। ফলতঃ নাদির শাহ যাহাতে চাম্বেল নদী উত্তীর্ণ হইতে না পারেন, বাজী রাও তাহার আবশ্যক উপায় অবলম্বনে কোনও প্রকার ত্রুটী করেন নাই।

 নাদির শাহের দিল্লী আক্রমণের কারণাবলী ও তৎকৃত অত্যাচার ও উৎপীড়নের আলোচনানাদির শাহ। এস্থলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে। তথাপি এ সম্বন্ধে একটী কথা বলা আবশ্যক। নাদির শাহ ভারতআক্রমণের যে সকল আয়োজন করিতেছিলেন, তাহা দিল্লীর দরবার বহুদিন জানিতে পারেন নাই। এমন কি, তিনি সিন্ধুনদের উপর সেতু নির্ম্মাণ-পূর্ব্বক পঞ্জাবে প্রবেশ করিবার পূর্ব্ব পর্যন্ত দিল্লীর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনও সংবাদ রাখিবার অবসর পান নাই। বলা বাহুল্য, বাজী রাওয়ের ভীতিই ইহার একমাত্র কারণ। বাজী রাওয়ের দমনের আবশ্যকতা দিল্লীর দরবারে বিশেষরূপে অনুভূত হওয়ায় সকলের দৃষ্টি সেই দিকেই নিবদ্ধ হইয়াছিল। সেই সুযোগে নাদির বিনা বাধায় দিল্লীর সমীপবর্ত্তী হইতে পারিয়াছিলেন। সে যাহা হউক, নাদির শাহ্ দিল্লী লুণ্ঠনপূর্ব্বক প্রায় ৩৭ কোটী টাকার ধনরত্নাদি প্রাপ্ত হইয়া সন্তুষ্টচিত্তে স্বদেশে প্রতিগমন করিলেন। সুতরাং বাজী রাওয়ের আর যুদ্ধাভিযানের প্রয়োজন হইল না।

  1. নিজামের এই সৈন্য-সংখ্যার বিবরণ চিমণাজী আপ্পা কর্তৃক ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দের ২২এ ডিসেম্বর (পৌষ শুক্লা প্রতিপৎ) তারিখে শ্রীমদ্‌ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীকে লিখিত পত্র হইতে গৃহীত হইল।