বাজী রাও/অষ্টম অধ্যায়
অষ্টম অধ্যায়।
মালব-অধিকার—বাদশাহী প্রদেশ আক্রমণ—মোগলদিগের পরাজয়।
গুজরাথের বিশৃঙ্খলা নিবারিত ও নিজামের সহিত সন্ধি স্থাপিত হওয়ায় দক্ষিণ ভারতে সম্পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইত্যবসরে মালবে ও মোগল সাম্রাজ্যে যে সকল রাজনীতিক পবিবর্ত্তন ঘটে, তাহাতে তৎপ্রতি বাজী রাওয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে মোগল সাম্রাজ্যের পায় সর্ব্বত্র অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল। দায়িত্ব-জ্ঞানশূন্য রাজ-পুরুষেরা প্রজার উপর স্বেচ্ছামত অত্যাচার করিতেন। হিন্দুস্থানে অসন্তোষ। মোগলদিগের দুর্ব্ব্যবহারে ও জিজিয়া করের জন্য রাজপুতনার হিন্দু রাজন্যবর্গ নিতান্ত উত্যক্ত হইয়া যবনসাম্রাজ্যের বিলোপ-কামনা করিতেছিলেন। এই কারণে তাঁহারা মহারাষ্ট্রীয়দিগের প্রবর্দ্ধমানশক্তি এবং স্বধর্ম্ম ও স্বজাতির রক্ষায় অনুরাগ সন্দর্শনে আশ্বস্ত হইয়া মোগলদমনে তাঁহাদের সহায়তাগ্রহণ করিতে কৃতসংকল্প হইলেন।
এই সময়ে মালবের রাজা গিরিধরের মৃত্যু হওয়ায় তদীয় আত্মীয় দয়া বাহাদুর ঐ প্রদেশের সুভেদারী লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার ক্রুরতায় ও অত্যাচারে মালববাসী নিতান্ত মালবে অরাজকতা।দুর্দ্দাশা-গ্রস্ত হইয়াছিল। অতিরিক্ত করভারে ও রাজস্ব-কর্ম্মচারীদিগের নিষ্ঠুর ব্যবহারে প্রপীড়িত হইয়া তত্রত্য কৃষককুল আর্ত্তনাদ করিতেছিল। মালবের ঠাকুরেরা (জমীদারেরা) সুভেদারের অত্যাচার সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া বহুবার দিল্লীর দরবারে প্রতীকার প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু তাহাতে কোনও ফললাভ হইল না। তখন তাঁহারা হতাশ হইয়া হিন্দুজাতির আশ্রয়-স্থল বাজী রাওয়ের শরণাপন্ন হইলেন। এই সময়ে জয়পুরের অধিপতি মহারাজ সওয়াই জয়সিংহ মহোদয় জ্যোতিষ শাস্ত্রে অনুরাগী ও হিন্দুদিগের পৃষ্ঠপোষক বলিয়া পরিচিত ছিলেন। মোগল দরবারেও তাঁহার বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। কিন্তু অত্যাচার-পরায়ণ মোগল সুভেদারদিগের হস্ত হইতে দুর্ব্বল হিন্দু প্রজার রক্ষা করিতে পারেন, এরূপ সামর্থ্য তাঁহার ছিল না। তথাপি হিন্দুদিগের দুর্দশাদর্শনে তাঁহার হৃদয় ব্যথিত হইয়াছিল। এই কারণে তিনি মালববাসীর ও রাজপুতনার সমস্ত রাজন্যবর্গের অনুরোধক্রমে বাজী রাওকে উত্তর ভারতে অভিযান-পূর্ব্বক মোগলদিগের শাসন-পাশ হইতে হিন্দুদিগের উদ্ধার সাধন করিবার জন্য গোপনে আহ্বান করিলেন। বলা বাহুল্য, বাজী রাওয়ের পক্ষে এই নিমন্ত্রণের আবশ্যকতাই ছিল না। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলা ও হিন্দু প্রজার বিড়ম্বনা দেখিয়া ইতঃপূর্ব্বেই উত্তর ভারতে মহারাষ্ট্র শাসন প্রবর্ত্তিত করিবার সংকল্প করিয়াছিলেন। সওয়াই জয়সিংহ-প্রমুখ রাজপুত নরপতিদিগের আহ্বানে তিনি অতীব উৎসাহসহকারে মোগল শাসন উচ্ছিন্ন করিতে অগ্রসর হইলেন।
এই সময়ে রাজধানী সাতারায় তাঁহার উপস্তিতি আবশ্যক হওয়ায় বাজী রাও স্বীয় যশস্বী সেনানী মহলার রাওয়ের প্রতি মালবে অভিযানের ভার অর্পিত করিলেন। মালব-বিজয়।মহলার রাও দ্বাদশ সহস্র সেনা সহ বুহ্রানপুরে উপস্থিত হইলে ইন্দোরের জমিদার রাও নন্দলাল মণ্ডল চৌধুরী তাহার প্রত্যুদ্গমনের জন্য নর্ন্মদাতীর পর্য্যন্ত অগ্রসর হন। এদিকে দয়া বাহাদুর ও এই সংবাদ অবগত হইয়া স্বীয় সৈন্যদল সহ মহারাষ্ট্রীয়দিগের গতিরোধের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তিনি সমস্ত প্রসিদ্ধ পথ ঘাটে মোগল সৈন্য স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু রাও নন্দলাল ও অপর ঠাকুরগণের সহায়তায় মহারাষ্ট্রবাহিনী নানা গুপ্ত পথে মালবে প্রবেশ-লাভ করিল। তাঁহাদিগের “হর হর মহাদেব” শব্দে দয়া বাহাদুর চমকিত হইলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে তাঁহার পাঠান সৈন্যের সহিত মহলার রাওয়ের মারাঠা সেনার সংঘর্ষ উপস্থিত হইল। দয়া বাহাদুর স্বয়ং হস্তি পৃষ্ঠে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া সৈন্য-চালনা করিতেছিলেন। এক প্রহরকাল তুমুল যুদ্ধের পর তিনি তিন সহস্রাধিক সৈন্য সহ নিহত হইলেন। বিজয়ী মহারাষ্ট্রীয়েরা মালব হইতে মোগল আমলদারগণের নিরাকরণ ও আপনাদিগের একাধিপত্য-স্থাপন-পূর্ব্বক সুশাসনে মালববাসী প্রজাপুঞ্জকে ও স্থানীয় ঠাকুরদিগকে সুখী করিলেন। ১৭৩২ খৃঃ।
এইরূপে মালব প্রদেশ হস্তচ্যুত হওয়ায় দিল্লীশ্বর মহম্মদ খান বঙ্গষের প্রতি উহার উদ্ধারের ভার অর্পণ করেন। কিন্তু বঙ্গষ বহু চেষ্টাতেও সে বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে না শাসনাধিকার লাভ।পারায় মহারাজ সওয়াই জয়সিংহের প্রতি মালবে মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভার অর্পিত হয়। বলা বাহুল্য, দিল্লী হইতে প্রত্যাবর্ত্তন-কালে বালাজী বিশ্বনাথ যখন জয়পুরপতির সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন, তখনই বাজী রাও ও জয় সিংহের মধ্যে বিশেষ সখ্য ঘটিয়াছিল। তদ্ভিন্ন মহারাষ্ট্রীয়দিগের মালব-বিজয়-ব্যাপারের মূলেও তিনি ছিলেন। এই দুই কারণে তিনি বাদশাহকে বাজী রাওয়ের সহিত বিরুদ্ধতাচরণের সংকল্পত্যাগ করিতে পরামর্শ দান করিলেন। দুর্ব্বল বাদশাহকে অগত্যা তাহাই স্বীকার করিতে হইল। মহারাজ জয়সিংহের চেষ্টায় বাজী রাও মৌথিকভাবে মালবের অস্থায়ী শাসনাধিকার প্রাপ্ত হইলেন। জয়সিংহ নামে মাত্র মালবের সুভেদার রহিলেন।
কিন্তু বাজী রাও মৌখিক অধিকার-লাভে সন্তুষ্ট হইবার লোক ছিলেন না। তিনি বাহুবলে যাহা লাভ করিয়াছিলেন, বাদশাহী সনন্দের বলে তাহা সুদৃঢ় করিবার চেষ্টা গুজরাথে বিপ্লব।করিতে লাগিলেন। কিন্তু দিল্লীর দরবার কিছুতেই তাঁহাকে লিখিত সনন্দ দান করিতে সম্মত হইলেন না। গুজরাথে মহারাষ্ট্রীয়েরা সরবুলন্দ খানের সহিত সন্ধি করিয়া যে চৌথ ও সরদেশমুখীর স্বত্ব লাভ করিয়াছিলেন, বাদশাহ তাহাও ন্যায় সঙ্গত বলিয়া স্বীকার করিতে অসম্মতি প্রকাশ করিলেন। কেবল তাহাই নহে, সরবুলন্দ খান বাজী রাওকে ঐ স্বত্ব দান করিয়াছিলেন বলিয়া দিল্লীর দরবার হইতে তাহাকে পদচ্যুত করিয়া যোধপুরের রাজা অভয় সিংহকে গুজরাথের সুভেদাররূপে প্রেরিত করা হয়। অভয় সিংহ অতীব ক্রূরপ্রকৃতি ছিলেন। তিনি স্বীয় পিতাকে হত্যা করিয়া যোধপুরের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত যুদ্ধে পিলাজী গায়কোয়াড়ের পরাজয় ঘটে। অতঃপর অভয় সিংহ গুপ্তঘাতকের দ্বারা তাঁহার বধসাধন করেন! এই ঘটনায় মহারাষ্ট্রীয়েরা ভীত না হইয়া বরং অধিকতর উত্তেজিত হন। তাঁহাদিগের উগ্র মূর্ত্তি প্রকাশিত হইলে অভয় সিংহ ভয় পাইয়া স্বদেশে পলায়ন করেন। গুজরাথ পুনর্ব্বার মহারাষ্ট্রীয়দিগের হস্তগত হইল। কিন্তু বাজী রাও বাদশাহের নিকট প্রার্থনা করিয়াও গুজরাথ ও মালবের সম্বন্ধে লিখিত সনন্দ পাইলেন না। এই সকল কারণে ১৭৩৩ খৃষ্টাব্দে তিনি যখন সিদ্দিদিগের বিরুদ্ধে অভিযান করেন, তখন তাঁহার সর্দ্দার শিন্দে ও হোলকরকে দিল্লীআগ্রা পর্য্যন্ত মোগল প্রদেশ আক্রমণ করিবার আদেশ করিয়া গিয়াছিলেন।
এতদ্ভিন্ন দিল্লী আক্রমণের আর একটা কারণ হইয়াছিল। বাজী রাওয়ের সামরিক ব্যয় অতিশয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁহার অনেক ঋণ হইয়াছিল। সৈনিকগণ সময়ে বেতন স্বামীজীর উপদেশ।না পাওয়ায় অতীব অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিল, বাজী রাও বড় বিপন্ন হইলেন। মহাত্মা রামদাস স্বামী যেমন রাজনীতি ও ধর্ম্মনীতি-বিষয়ে ছত্রপতি মহাত্মা শিবাজীর গুরু ছিলেন, সেইরূপ শ্রীমদ্ ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী নামে এক মহাপুরুষ বাজী রাওয়ের গুরু ও রাজনীতিক পরামর্শদাতা ছিলেন। বাজী রাও নিতান্ত বিপন্ন হইয়া এই সময়ে তাঁহাকে পত্র লিখেন। উত্তরে স্বামীজী তাঁহাকে লিখিয়া পাঠান যে,—“বিপদের সময় ধৈর্য্যলোপ তোমার ন্যায় ব্যক্তির অনুচিত। তুমি মালবদেশ সম্পূর্ণ অধিকারপূর্ব্বক দিল্লী আক্রমণের চেষ্টা কর। তাহা হইলেই অর্থকষ্ট-নিবারণ, ম্লেচ্ছ-দমন ও হিন্দু সাম্রাজ্যের বিস্তার― এই ত্রিবিধ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে।” এইরূপ উপদেশ-সম্বলিত পত্র পাঠ করিয়া বাজী রাও ধৈর্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক দিল্লীর অভিমুখে অগ্রসর হইবার সংকল্প করিলেন।
বাজী রাওয়ের আদেশে মহারাষ্ট্র-সেনা মালব হইতে চাম্বেল (চর্ম্মণ্বতী) নদীর তীরদেশ পর্য্যন্ত প্রসারিত হইল। মহলার রাও হোলকরের অধীনতায় এক দল সৈন্য সন্ধি-কামনা।আগ্রা অতিক্রম করিল। তাহাদিগের তাণ্ডব-নৃত্য-দর্শনে বাদশাহ শঙ্কিত হইলেন। প্রধান মন্ত্রী খান্-দৌরা মহারাষ্ট্রীয়দিগের নিকট সন্ধির প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন। বাদশাহের সহিত পরামর্শ করিয়া তিনি বাজী রাওকে মালবের চৌথ ও সরদেশমুখী এবং গুজরাথের সরদেশমুখী স্বত্বের সনন্দ দিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু বাদশাহের অধীন তুরাণী সর্দ্দারগণের প্রতিবন্ধকতায় সে প্রস্তাব রহিত হইল। তখন খান-দৌরা বাজী রাওকে জানাইলেন যে, বাদশাহ তাঁহার সন্ধির বিনিময়ে চাম্বেল নদীর দক্ষিণাঞ্চলস্থিত মোগল শাসিত প্রদেশ হইতে বার্ষিক ১৩ লক্ষ টাকা এবং পশ্চিমে বুন্দী ও কোটা হইতে পূর্ব্বদিকে বুধাবর পর্য্যন্ত সমস্ত রাজপুত-শাসিত প্রদেশ হইতে বার্ষিক ১০ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা করাদায়ের অধিকার দান করিতে প্রস্তুত আছেন। বাজী রাওকে শেষোক্ত অধিকার প্রদানে তুরাণীদের একটি গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। তুরাণী রাজপুরুষেরা মনে করিয়াছিলেন, রাজপুতনার করাদান উপলক্ষে মহারাষ্ট্রীয় ও রাজপুতদিগের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ উপস্থিত হইবে, উভয়েই গৃহ-বিবাদে জর্জরিত হইবেন, এবং সেই সুযোগে মোসলমানগণ আপনাদিগের প্রণষ্ট গৌরবের পুনরুদ্ধারের অবকাশ পাইবেন।
বাজী রাও দিল্লী দরবার-স্থিত মহারাষ্ট্র-দুতের মুখে এ সংবাদ অবগত হইলেন। মোগল দরবারের কপটতা ও গূঢ় অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া তিনি পূর্ব্ব প্রস্তাবের প্রত্যাহার পেশওয়ের প্রস্তাব।করত নিম্ন লিখিত প্রস্তাবগুলি বাদশাহের নিকট প্রেরণ করিলেন।
১। সমস্ত মালব প্রদেশ মহারাষ্ট্রীয়দিগকে জায়গীরস্বরূপ প্রদত্ত হউক।
২। ঐ প্রদেশের যে সকল অংশ রোহিলাদিগের শাসনাধীন রহিয়াছে, তাহা অধিকার করিবার অনুমতি প্রদান করা হউক।
৩। মাণ্ডু, ধার ও রাশীন—এই তিনটি দুর্গ মহারাষ্ট্রীয়দিগকে দেওয়া হউক।
৪। চামেলী (চাম্বেল) নদীর দক্ষিণস্থিত সমস্ত প্রদেশ জায়গীর-স্বরূপ এবং তথায় ফৌজদারী শাসনের অধিকার দান করা হউক।
৫। বাদশাহী ধনাগার হইতে নগদ ৫০ লক্ষ টাকা অথবা তৎপরিবর্ত্তে বঙ্গদেশের কিয়দংশ মহারাষ্ট্রপতির হস্তে অর্পিত হউক।
৬। বারাণসী, প্রয়াগ, গয়া ও মথুরা এই চারিটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্রের সম্পূর্ণ শাসনাধিকার বিধর্মীদিগের হস্ত হইতে আচ্ছিন্ন করিয়া হিন্দুপতি মহারাজ শাহুকে প্রদান করা হউক।
৭। দক্ষিণ ভারতের “সর-দেশপাণ্ডে” পদের স্বত্ব মহারাষ্ট্রীয়দিগকে সমর্পিত হউক।
বাজী রাওয়ের এই সকল প্রার্থনার মধ্যে একটীর অধিক পূর্ণ হইল না। খান দৌরা বাজী রাওয়ের নিকট হইতে ৬ লক্ষ টাকা উপঢৌকন গ্রহণ করিয়া তাহাকে সমগ্র দক্ষিণা পথের “সরদেশপাণ্ডে” নামক পদের স্বত্ব দান করিসর লেন। এই স্বত্বানুসারে বাজী রাও নিজাম শাসিত প্রদেশের সমস্ত আয়ের উপর শতকরা ৫৲ টাকা বা মোট বার্ষিক দেশপাণ্ডে।নব্বই লক্ষ টাকা আদায় করিবার অধিকার পাইলেন। নিজামের সহিত খান দৌরার মনোমালিন্য ছিল। বলা বাহুল্য, তিনি নিজামকে অবজ্ঞাত কবিবার উদ্দেশেই বাজী রাওকে এই স্বত্ব দান করিয়াছিলেন। নিজামের উপর প্রভৃত্ব-বিস্তারের সুযোগ ত্যাগ করা অসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হওয়ায় বাজী রাও ছয় লক্ষ টাকা দিয়া এই স্বত্ব বাদশাহের নিকট ক্রয় করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করিলেন না। সুতরাং বাজী রাওয়ের প্রতি নিজামের বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাইল।
এ দিকে বাজী রাওয়ের সমস্ত প্রার্থনা পূর্ণ না হওয়ায় তিনি বাহু-বলে অভীষ্ট-লাভ করিবার আযোজন করিতে লাগিলেন। মহারাষ্ট্রীয়দিগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইতেছে দেখিয়া বাদশাহকেও আত্মরক্ষার উপায়ান্তর অবলম্বন করিতে হইল। তিনি নিজাম-উল্-মুল্ককে বন্ধুভাবে পত্র লিখিয়া তাঁহার পূর্ব্বকৃত বিদ্রোহাপরাধ মার্জ্জনা ও তাঁহার নিকট মহারাষ্ট্র-অভিযাননিবারণের জন্য সৈন্যসাহায্য প্রার্থনা করিলেন। বলা বাহুল্য, তাহাতে নিজামের আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তিনি কাল বিলম্ব না করিয়া স্বীয় সৈন্যদল সহ বাদশাহের সহায়তা করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন।
এই সংবাদ অবগত হইয়া বাজী রাও সসৈন্য দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পথিমধ্যে তিনি গুরুভার যুদ্ধোপকরণসমূহ বুন্দেলখণ্ডের রাজা জগৎ রায়ের নিকট রাখিয়া প্রথম সংঘর্ষ।একদল ক্ষিপ্রগামী সৈন্য সহ মোগল রাজধানী আক্রমণের জন্য অগ্রসর হইলেন। খান্ দৌরার অধীনতায় বাদশাহী ফৌজ তাঁহার গতিরোধের জন্য আগ্রা যাত্রা করিল। অযোধ্যার সুভেদার সাদত খান সহসা এক দল সৈন্তের সহিত আগ্রার সন্নিকটে মহারাষ্ট্রীয়দিগকে আক্রমণ করিলেন। তাহাতে কতিপয় মহারাষ্ট্রীয়-সৈন্য নিহত হওয়ায় হোলকর পশ্চাৎপদ হইয়া যমুনার অপর পারে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইলেন। এই জয়লাভে অতীব উৎফুল্ল হইয়া সাদত খান বাদশাহকে লিখিয়া পাঠাইলেন যে,—“আমরা দুই সহস্র মহারাষ্ট্রসেনা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত করিয়াছি। মহলার রাও হোলকর সাংঘাতিকরূপে আহত হইয়াছেন। এক জন মারাঠা সেনানী আমাদিগের হস্তে নিহত হইয়াছে। মহারাষ্ট্রীয়েরা প্রাণভয়ে চাম্বেল নদী উত্তীর্ণ হইয়া পলায়ন করিয়াছে। পলায়নকালে যমুনা পার হইতে গিয়া দুই সহস্র মারাঠা সৈন্য জলমগ্ন হইয়াছে!” বলা বাহুল্য, এই পত্রের বিবরণ সম্পুর্ণ অলীক ছিল। কিন্তু ইহাতে দিল্লীর দরবারে আনন্দস্রোত প্রবাহিত হইল। বাজী রাওয়ের দর্প চূর্ণ হইয়াছে বলিয়া দিল্লীর উমরাহেরা উৎসব করিতে লাগিলেন এবং আগ্রাস্থিত মহারাষ্ট্রীয় দূতকে অবজ্ঞাত করিয়া বিতাড়িত করিয়া দিলেন (১৭৩৪ খৃঃ)।
বাজীরাও তখন রাজপুতনায় ছিলেন। তিনি বুধাবরের রাজপুত রাজাকে পরাস্ত করিয়া তাঁহার নিকট কর গ্রহণ ও তথায় স্বীয় আধিপতা স্থাপন-পুরঃসর মহলার রাওয়ের সন্ধির প্রস্তাব।সৈন্যদলের সহিত মিলিত হইবার জন্য অগ্রসর হইতেছিলেন। এমন সময়ে হোলকরের পরাজয়বার্ত্তা তাঁহার কর্ণগোচর হইল। তিনি প্রত্যহ বিংশতিক্রোশ পথ অতিক্রমপূর্ব্বক বিদ্যুদ্বেগে দিল্লীর নিকটবর্ত্তী হইলেন এবং মহারাষ্ট্র-দূতের অবমাননার প্রতিকারস্বরূপ দিল্লী নগরীকে অগ্নিসংযোগে ভস্মসাৎ করিবেন বলিয়া ঘোষণা করিলেন। এই সংবাদে দিল্লীবাসীরা ভয়ে বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। কিন্তু বাজী রাও অকারণ নিষ্ঠুরতার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁহার নিকটে বাদশাহের মর্য্যাদারক্ষাও নীতিসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইল। এই কারণে তিনি দিল্লীমোগর লুণ্ঠন বা দাহ না করিয়া বাদশাহের নিকট সন্ধি-প্রার্থন-পূর্ব্বক একখানি পত্র লিখিলেন।
১৭৩৪ খৃঃ ১লা মে বাদশাহ মহারাষ্ট্র-দূতকে পুনর্ব্বার দিল্লীতে প্রেরণের জন্য বাজী রাওকে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু দিল্লীর অবস্থা সে সময়ে যেরূপ হইয়াছিল, মোগল-বিজয়।তাহাতে বাজী রাও মহারাষ্ট্র -দূতকে তথায় প্রেরণ নিরাপদ বলিয়া মনে করিলেন না। ইতোমধ্যে সাদত খান সমরলিপ্সু হইয়া সসৈন্যে আগ্রায় উপস্থিত হইলেন। বাজী রাও জানিতেন যে, বাদশাহ মহারাষ্ট্রীযদিগের সহিত সন্ধি-প্রার্থী হইলেও তাঁহার সর্দ্দার ও উমরাহেরা সে প্রস্তাবে প্রতিকূলতা করিতেছিলেন। এই কারণে বিনা যুদ্ধে তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির সম্ভাবনা ছিল না। তিনি যে স্থানে শিবির স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা যুদ্ধের পক্ষে বিশেষ উপযোগী ছিল না। সুতরাং বাজী রাও দিল্লীর ঈশানকোণস্থিত একটা বিশাল প্রান্তরের দিকে সরিয়া গিয়া শিবের সংস্থাপন করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে সন্ধিসূচক পত্রপ্রেরণ ও পূর্ব্বস্থান পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া দিল্লীর উমরাহগণ বিপরীত বুঝিলেন। তাঁহারা বাজীরাওকে ভীত মনে করিয়া সহসা অষ্ট সহস্র সৈন্যসহ তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। তখন উভয় পক্ষে যুদ্ধ বাধিল এবং তাহাতে ৬ শত মোগল-সেনা নিহত হইল! তদ্ভিন্ন মোগল-পক্ষীয় একজন সর্দ্দার আহত ও একজন সেনানী নিহত হইলেন। এই যুদ্ধে মোগলদিগের একটী হস্তী ও দুই সহস্র অশ্ব মহারাষ্ট্রীয়দিগের হস্তগত হয়। অতি অল্পসংখ্য মারাঠা সৈন্য এসংঘর্ষে বিনষ্ট হইয়াছিল।
এই যুদ্ধে জয়লাভের পর বাজী রাও সসৈন্যে ক্ষণকাল বিশ্রাম করিতে না করিতে মীর কমর উদ্দীন খান নামক এক জন মোগল সর্দ্দার একদল সৈন্যসহ সহসা তাঁহাকে সন্ধি।আক্রমণ করিলেন। তখন সূর্য্য অস্তগমনোন্মুখ হইয়াছিলেন। সুতরাং স্বল্প ক্ষণ যুদ্ধের পর নিশার সমাগম হওয়ায় উভয় পক্ষই অস্ত্রসংবরণ করিলেন। বাজী রাও রাত্রিমধ্যে কমর উদ্দীনকে বেষ্টনপূর্ব্বক অবরুদ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার শিবিরের সন্নিকটে একটী ১৬ ক্রোশব্যাপী ঝিল থাকায় তাঁহার সে সুবিধা ঘটিল না। ইতোমধ্যে খান দৌরা ও সাদত খান মীর কমর উদ্দীনের সহায়তার জন্য আগমন করিলেন। কাজেই বাজী রাওকে তথা হইতে স্বীয় শিবির অধিকতর নিরাপদ স্থানে সরাইতে হইল। কিন্তু এই সমবেত মোগল সর্দ্দারেরা আর বাজী রাওয়ের সহিত সংঘর্ষ বৃদ্ধি করা সঙ্গত মনে করিলেন না। প্রথম যুদ্ধেই বাজীরাও ও তাঁহার মহারাষ্ট্রীয় সৈন্যের বিক্রম দেখিয়া দিল্লীর উমরাহগণের চৈতন্যোদয় হইয়াছিল। এক্ষণে তাঁহারা বিরোধে নিবৃত্ত হইয়া বাদশাহের পক্ষ হইতে বাজী রাওয়ের সহিত সন্ধির কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিলেন। সেই অবকাশে বাজী রাও গঙ্গা ও যমুনার অন্তর্ব্বেদীতে (দোয়াবে) স্বীয় অধিকার স্থাপন করিবার চেষ্টায় ছিলেন। এমন সময়ে সহসা মহারাজ শাহু তাঁহাকে কোঙ্কণ-স্থিত ফিরিঙ্গীদিগের দমনের জন্য আহ্বান করিলেন। কাজেই বাজী রাওকে (১৭৩৪ খৃষ্টাব্দে মে মাসে) বাদশাহের সহিত সন্ধি করিয়া যথাসম্ভব সত্বর সাতারায় প্রতিগমন করিতে হইল। এই সন্ধির ফলে বাজী রাও বাদশাহের নিকট হইতে মহারাজ শাহুর জন্য মালব প্রদেশের একচ্ছত্র অধিকার ও যুদ্ধব্যয়স্বরূপ ত্রয়োদশ লক্ষ মুদ্রা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।