বাজী রাও/সপ্তম অধ্যায়
সপ্তম অধ্যায়।
গুজরাথে চৌথ-প্রবর্ত্তন—ডভইর যুদ্ধে সেনাপতির পরাভব—সিদ্দিদিগের দমন।
গুজরাথের প্রতি মহারাষ্ট্রীয়দিগের অনেক দিন হইতে দৃষ্টি ছিল। নিজামের সহিত প্রথম যুদ্ধকালে বাজী রাও একবার গুজরাথ আক্রমণ করিয়াছিলেন। ১৭২৯ খৃষ্টাব্দে তিনি স্বীয় ভ্রাতা চিমণাজীকে মালবে প্রেরণ করিয়া স্বয়ং বহু গুজরাধে চৌথ।সৈন্য সহ গুজরাথে উপস্থিত হইলেন, এবং তত্রত্য সুভেদার সরবুলন্দ খানকে জানাইলেন যে, তিনি যদি মহারাষ্ট্রপতি মহারাজ শাহুর সার্ব্বভৌম শাসনচ্ছত্রতলে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া গুজরাথে চৌথ পদ্ধতির প্রবর্ত্তন ও সরদেশমুখী স্বত্ব মারাঠাদিগকে দান করেন, তাহা হইলে পেশওয়ে গুজরাথের শান্তিরক্ষার সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করিতে সম্মত আছেন। ইহার পূর্ব্বে মহারাজ শাহু তদানীস্তন সেনাপতি ত্র্যম্বক রাও দাভাড়ে, পিলাজী গায়কোয়াড় ও কণ্ঠাজী কদম প্রভৃতি মারাঠা সর্দ্দারের প্রতি গুজরাথ-বিজয়ের আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। তত্রত্য সুভেদার সরবুলন্দ খান প্রথমে প্রাণপণে তাঁহাদিগের গতিরোধের চেষ্টা করেন। তাহাতে অকৃতকার্য্য হইয়া তিনি দিল্লীর দরবারে সৈন্য-সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। দিল্লীশ্বর তখন বিলাস-সাগরে মগ্ন থাকায় সে প্রার্থনা ফলোপধায়িনী হইল না। কাজেই সরবুলন্দকে মহারাষ্ট্র সর্দারগণের সহিত সন্ধির প্রস্তাব করিতে হইল। তিনি মহারাষ্ট্রপতিকে চৌথ প্রদান করিতে স্বীকৃত হইলেন। কিন্তু পিলাজী গায়কোয়াড় ও কণ্ঠাজী কদম প্রভৃতি মারাঠা সর্দ্দারেরা তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া সমস্ত গুজরাথ পুনঃ পুনঃ লুণ্ঠন পূর্ব্বক ছারখার করিতে লাগিলেন। গুজরাথবাসীর দুর্দ্দশার সীমা রহিল না। তদ্দর্শনে দুঃখিত হইয়া বাজী রাও সরবুলন্দ খানের নিকট পূর্ব্বোক্ত প্রস্তাব উপস্থিত করেন। বলা বাহুল্য, মোগল শুভেদার সে প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন। অতঃপর উভয়ের মধ্যে যে সন্ধি স্থাপিত হইল, তদনুসারে,
(১) সুরত প্রদেশ ভিন্ন অবশিষ্ট সমস্ত গুজরাথের চৌথ ও সরদেশমুখীর স্বত্ব মহারাজ শাহুর প্রাপ্য হইল।
(২) গুজরাথ-বাসীকে দস্যু তস্কবাদির হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য মহারাষ্ট্র-পতি সর্ব্বদা ২৫শত সাদি-সৈন্য গুজরাথে রাখিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।
(৩) গুজরাথের বিদ্রোহপ্রিয় জমিদারদিগকে কোনও মহারাষ্ট্রীয় অতঃপর কোনও প্রকারে সহায়তা করিতে পারিবেন না, স্থির হইল।
এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষরকালে বাজী রাও প্রধান সেনাপতি ত্র্যম্বক রাও দাভাড়েকে গুজরাথে মোকাসা ও সরদেশমুখী স্বত্বের একাংশ প্রদান করেন। কিন্তু সেনাপতি দাভাড়ে ও তাঁহার সেনাপতির বিরাগ।সহচর কদম, গায়কোয়াড় প্রভৃতি সর্দ্দারেরা ইহাতে সন্তুষ্ট হইলেন না। কারণ, এই সন্ধির ফলে তাঁহাদিগের যথেচ্ছাচারের পথ রুদ্ধ হইল। বাজী রাওয়ের সর্ব্বত্র প্রতিপত্তিদর্শনে পূর্ব্ব হইতেই তাঁহাদিগের মনে বিদ্বেষের সঞ্চার হইয়াছিল। বিশেষতঃ বাজী রাও এই ব্যাপারে সেনাপতি প্রভৃতির আদৌ মতামত গ্রহণ করেন নাই বলিয়া তাঁহারা আপনাদিগকে অধিকতর অবজ্ঞাত বিবেচনা করিতে লাগিলেন।
ইতঃপূর্ব্বে নিজাম-উল্-মুল্ক বাজী রাওয়ের হস্তে পরাজিত হওয়ায় স্বীয় অবমাননার প্রতিশোধ লইবার অবসর খুঁজিতেছিলেন। কিন্তু তিনি স্বয়ং তাঁহার সহিত সন্ধি-সূত্রে আবদ্ধ থাকায় নিজামের কৌটিল্য।প্রকাশ্যভাবে তাঁহার শত্রুতাচরণ করা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বিবেচনা করেন নাই। এই কারণে তিনি তাহার প্রতিদ্বন্দ্বিগণকে গোপনে সহায়তা করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। এমন সময়ে দাভাড়ে প্রভৃতির অসন্তোষের বিষয় তাঁহার কর্ণগোচর হয়। তৎশ্রবণে অতীব আনন্দিত হইয়া তিনি এই বিদ্বেষাগ্নিতে ইন্ধনপ্রক্ষেপের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তিনি এই গৃহ-বিবাদে সেনাপতিকে সহায়তা করিতে প্রতিশ্রুত হওয়ায় ত্র্যম্বক রাও সসৈন্যে বাজী রাওকে আক্রমণ করিবার আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন এই সময়ে নিজাম তাঁহাকে সৈন্যদল বৃদ্ধির জন্য কিছু অর্থ সাহায্যও করিয়াছিলেন। পিলাঙ্গী গায়কোয়াড় প্রভৃতি কয়েকজন সেনানী পূর্ব্ববিদ্বেষবশে দাভাড়ের সহায় হইলেন। সুতরাং অল্প দিনের মধ্যেই সেনাপতি ৩৫ সহস্র সৈন্যসহ গুজরাথ হইতে বাজী রাওয়ের সর্ব্বনাশ সাধনের জন্য পুণাভিমুখে অভিযান করিলেন। তিনি প্রচার করিলেন যে, বাজী রাওয়ের প্রতিপত্তি অতিমাত্র বর্দ্ধিত হওয়ায় মহারাজ শাহুর শক্তি খর্ব্ব হইবার উপক্রম হইয়াছে। এ কারণে তিনি পেশওয়ের দর্প চূর্ণ করিয়া শাহর ক্ষমতা অব্যাহত করিবার জন্য যুদ্ধ করিতেছেন এবং দ্বাদশ জন প্রসিদ্ধ মারাঠা-সেনানী এই কার্য্যে তাঁহার সহায় হইয়াছেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, যাঁহারা পরস্পরের প্রতি চিরকাল বদ্ধবৈর ছিলেন, তাঁহাদেরও অনেকে আপনাদিগের বিবাদ ভুলিয়া এ সময়ে বাজী রাওয়ের বিনাশের জন্য সেনাপতির আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ফলতঃ অল্পবয়সে বাজী রাওয়ের অসাধারণ উন্নতি ও প্রতিপত্তি অনেকেরই চিত্তে তাঁহার প্রতি বিদ্বেষের সঞ্চার করিয়াছিল।
বাজীরাও এই সংবাদ অবগত হইয়া প্রথমে কিছুমাত্র ভীত হন নাই। কিন্তু তিনি যখন শুনিলেন যে, নিজাম-উল্-মুল্ককের প্ররোচনায় এই গৃহবিবাদের উৎপত্তি হইয়াছে, এবং পেশওয়ের ঘোষণা ।সেনাপতির সহায়তার জন্য স্বয়ং নিজাম সসৈন্যে আগমন করিতেছেন, তখন তিনি যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সহিত সেনা সংগ্রহ-পূর্ব্বক সেনাপতির বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। তিনি ঘোষণা করিলেন যে, “সেনাপতি হিন্দু হইয়াও নিজামের পরামর্শক্রমে মহারাষ্ট্ররাজ্যে গৃহবিবাদের সূচনা করিতেছেন। তাঁহার এই কার্য্য হিন্দুধর্ম্মের ও প্রকৃষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত হইতেছে। অতএব যাঁহারা স্বরাজ্যের প্রকৃত মঙ্গলকামী, যাঁহাদিগের ধমনীতে এক বিন্দুও হিন্দুশোণিত প্রবাহিত হইতেছে, এ সময়ে তাঁহাদের প্রত্যেকেরই সেনাপতির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কর্ত্তব্য।’ এই ঘোষণার ফলে বাজী রাওয়ের সৈন্যদল কিয়ৎ পরিমাণে পুষ্ট হইল। বাজী রাও এইরূপে সৈন্যসংগ্রহের পূর্ব্বে এই বিপদ্বার্ত্তা পত্র দ্বারা মহারাজ শাহুর কর্ণগোচর করিয়া ছিলেন। কিন্তু দুর্ব্বল মহারাজ সেনাপতির দমনে অসমর্থ হইয়া বাজী রাওকে দাভাড়ের সহিত বিরোধ পরিত্যাগ পূর্ব্বক সন্ধিস্থাপন করিতে অনুরোধ করিলেন।
১৭৩০ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বাজী রাও ও চিমণাজী আপ্পা আত্মরক্ষার জন্য ১৮ সহস্র সৈন্য লইয়া সেনাপতি ত্র্যম্বক রাও দাভাড়ের বিরুদ্ধে যাত্রা করিলেন। তাঁহারা গুজরাথে উপস্থিত সন্ধির প্রস্তাব ।হইবার পূর্ব্ব হইতেই সেনাপতির নিকট সন্ধির প্রস্তাব প্রেরণ করিতেছিলেন। কিন্তু গৃহবিবাদ যে অনর্থের মূল, একথা না বুঝিয়া ও পেশওয়েকে ভীত ভাবিয়া সেনাপতি একেবারে যুদ্ধারম্ভ করিয়া দিলেন। বাজী রাও নর্ম্মদা উত্তীর্ণ হইতে না হইতে সহসা পিলাজীর পুত্র দামাজী গায়কোয়াড় তাঁহার জনৈক সর্দ্দারকে অনপেক্ষিতভাবে আক্রমণ-পূর্ব্বক পরাস্ত করায় সন্ধির আশা সুদূরপরাহত হইল। বাজীরাও এই পরাজয়ে কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। নিজামের সেনা যাহাতে গুজরাথে প্রবেশ করিতে না পারে, তিনি পূর্ব্বাহ্নেই তাহার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। নিজামও বাজী রাওয়ের বিক্রমের পরিচয় পাইয়াছিলেন। এই কারণে তিনি এ সময়ে প্রকাশ্যভাবে বাজী রাওকে আক্রমণ পূর্ব্বক সদ্যঃকৃত সন্ধি ভঙ্গ করিতে সাহসী হইলেন না।
বাজী রাও সসৈন্যে ধীরে ধীরে কুচ করিতে করিতে বড়োদা ও ডভই নামক স্থানের মধ্যবর্ত্তী বিশাল প্রান্তরে গিয়া উপস্থিত হইলেন! ১৭৩১ খৃঃ ১লা এপ্রিল ঐ স্থানে উভয় সেনাপতির পরাজয় ।পক্ষের তুমুল সংগ্রাম ঘটিল। বাজী রাওয়ের অদ্ভুত সৈনাপত্যগুণে ৩৫ সহস্র সৈন্যসহ বিপক্ষদল পরাজিত হইলেন। স্বপক্ষীয় সৈন্যগণ রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিতেছে দেখিয়া স্বয়ং ত্র্যম্বক রাও হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ-পূর্ব্বক ধনুর্ব্বাণ হস্তে বাজী রাওয়ের সমীপবর্ত্তী হইলেন ও তাঁহার সৈন্যের বিনাশ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে দুঃখিত হইয়া বাজী রাও তাঁহার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন,—“শত্রুর সহিত যুদ্ধে এরূপ শৌর্য্য ও সমর-কৌশল প্রকাশ করিলে, মহারাজের সন্তোষ ও যশঃ উভয়ই বৃদ্ধি পাইবে। আমার উপর এ বীরত্বপ্রকাশ কেন? আপনি যুদ্ধ স্থগিত করুন, আমি আপনার সহিত আসিয়া সাক্ষাৎ করিতেছি।” কিন্তু সেনাপতির রণোন্মাদ কিছুতেই নিবৃত্ত হইল না। তখন বাজী রাও স্বীয় সেনাদলে আদেশ প্রচার করিলেন,—“সেনাপতির প্রতি কেহ অস্ত্র ত্যাগ করিও না”। কিন্তু অল্পক্ষণ পরে যখন উভয় পক্ষে আবার ঘোর যুদ্ধ আরব্ধ হইল, তখন একজন সৈনিকের বন্দুকের গুলি সহসা সেনাপতির কর্ণমূল ভেদ করায় তিনি নিহত হইলেন। পিলাজী গায়কোয়াড়ের দুই পুত্রও এই যুদ্ধে নিহত হন। স্বয়ং পিলাজী আহত হইয়া পলায়ন করেন। বাজী রাওয়ের প্রিয় সর্দ্দার হোলকর ও শিন্দে এই যুদ্ধেও বিশেষ বিক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন। ১৭৩১ খৃঃ।
এইরূপে বিজয়ী হইযা পেশওয়ে সাতারায় প্রত্যাবৃত্ত হইলে প্রতিনিধি শ্রীপতি রাও তাঁহার বিরুদ্ধে অনেক কথা মহারাজ শাহুর কর্ণগোচর করিলেন। সেনাপতির মৃত্যুতে মহারাজ সখ্য ও সন্ধি ।অতীব দুঃখিত হইয়াছিলেন। কিন্তু বাজী রাও সমস্ত ঘটনা তাঁহাকে জ্ঞাপন করায় তাঁহার বিরাগ দূরীভূত হইল। তিনি ভূতপূর্ব্ব সেনাপতির পুত্র যশোবন্ত রাওকে সৈনাপত্য প্রদানপূর্ব্বক বাজী রাওয়ের সহিত তাঁহার সখ্য স্থাপন করিয়া দিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে আর যাহাতে কোনও প্রকারে বিসংবাদ না ঘটে, সে জন্য তিনি উভয়ের নিকট হইতে লিখিত প্রতিজ্ঞা-পত্র গ্রহণ করিলেন [১]। তদবধি গুজরাথের সম্পূর্ণ শাসনভার সেনাপতির উপর অর্পিত হইল। মালবে বাজী রাও সর্ব্ব-প্রধান হইলেন। পরন্তু ইহাও স্থির হইল যে, গুজরাথের রাজস্বের অর্দ্ধাংশ বাজী রাওয়ের হস্ত দিয়া রাজকোষে প্রেরিত হইবে, এবং সরবুলন্দ খানের নিকট হইতে প্রাপ্ত অন্যান্য প্রদেশের রাজস্ব সেনাপতি স্বয়ং রাজসরকারে প্রেরণ করিবেন। এই সময়ে মহারাজ শাহর চেষ্টায় পিলাজী গায়কোয়াড়ের সঙ্গেও বাজী রাওয়ের সখ্য হয় এবং গায়কোয়াড় শাহুর নিকট “সেনা-খাস-খেল” উপাধি লাভ করেন (১৭৩১ খৃঃ আগষ্ট)।
সেনাপতি ত্র্যম্বক রাও দাভাড়ে প্রতি বৎসর শ্রাবণ মাসে দেশবিদেশের ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণকে আহ্বান করিয়া তাঁহাদিগের পাণ্ডিত্য অনুসারে তাঁহাদিগকে দক্ষিণাদি দানে পুরস্কৃত দক্ষিণা ।করিতেন। তাঁহার মৃত্যুর পর সেই দক্ষিণা-দান-কার্য্য বন্ধ হইয়া যায়। মহারাজ শাহুর অনুমতি লইয়া বাজী রাও উহা পুনরায় প্রবর্ত্তিত করেন। এই কার্য্যে তাঁহার বার্ষিক ৬০৷৭০ সহস্র মুদ্রা ব্যয়িত হইত। তাঁহার পুত্র পেশওয়ে বালাজী বাজী রাওয়ের আমলে দক্ষিণার ব্যয় বার্ষিক ৬ লক্ষ টাকা পর্য্যন্ত বৃদ্ধি হইয়াছিল। ইংরাজেরাও ১৮৫১ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত এই দানকার্য্য অব্যাহত রাখিয়াছিলেন। তাহার পর হইতে ঐ টাকার একাংশ শাস্ত্রালোচনাপ্রিয় কতিপয় ব্রাহ্মণ-পরিবারকে প্রতি বৎসর নিয়মিতরূপে প্রদানের ব্যবস্থা করিয়া অবশিষ্ট টাকা “দক্ষিণা প্রাইজ কমিটি”-র কার্য্যে ও “দক্ষিণা ফেলোশিপ” পরীক্ষায় নিয়োজিত করা হইয়াছে। “দক্ষিণা প্রাইজ-কমিটি” হইতে মদ্যাপি মহারাষ্ট্রীয় ভাষার উৎকৃষ্ট গ্রন্থ লেখকেরা যোগ্যতানুসারে ৫০ টাকা হইতে ৫০০ টাকা পর্য্যন্ত পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।
সেনাপতির সহিত বিরোধ-শান্তির পর বাজী রাও নিজামকে এই গৃহবিবাদের মূল জানিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে ভীত হইয়া নিজাম নিজামের সহিত সন্ধি ।সন্ধির প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন। তিনি অতঃপর মহারাষ্ট্রীয়দিগের কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবেন না এবং বাজী রাওকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে দক্ষিণ-ভারতের সর্ব্বত্র আধিপত্যস্থাপন করিতে দিবেন বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায় বাজী রাও তাঁহাকে ক্ষমা করিলেন। এই সময়ে কিছুদিন সাতারায় অবস্থান-পূর্ব্বক রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শাসন-ব্যবস্থার সংস্কার দ্বারা বাজী রাও স্বদেশবাসীর সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির পথ পরিষ্কৃত করেন। পরবর্ত্তী বর্ষে মালবে গমনকালে নিজামের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ঘটে। তখন স্থির হয় যে, মালবে গমনাগমনকালে বাজী রাওয়ের সৈন্য খানদেশে নিজামের অধিকারভুক্ত স্থানে উপদ্রব করিতে পারিবে না; পক্ষান্তরে নিজাম ও চৌথ ও সরদেশমুখীর টাকা বিনা তাগাদায় পেশাওয়ের হস্তে যথানিয়মে প্রতিবৎসর প্রদান করিবেন।
১৭২৬ খৃঃ হইতে জঞ্জীরার সিদ্দিদিগের সহিত মহারাষ্ট্রপতির বিরোধ চলিতেছিল। সিদ্দিগণ কোনও ছিদ্র পাইলেই মহারাষ্ট্রীয়দিগের দেবমন্দিরাদি ভূমিসাৎ ও অন্য প্রকারে সিদ্দির পরাজয় ।তাঁহাদিগের ক্ষতিসাধন করিতে বিরত হইতেন না। এই কারণে ১৭৩০ খৃঃ মহারাজ শাহু প্রতিনিধি শ্রীপতি রাও ও অপর কতিপয় সেনানীকে কয়েক বার তাঁহাদিগের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদিগের কেহই সিদ্দিদিগকে বশীভূত করিতে পারেন নাই। পক্ষান্তরে সিদ্দিগণ বিজয়লাভে উন্মত্ত হইয়া হিন্দু প্রজাদিগকে বলপূর্ব্বক স্বধর্ম্ম-ত্যাগ করাইয়া ইস্লাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিতে লাগিলেন! কাজেই হিন্দুজাতির রক্ষক বাজী রাওকে মালব হইতে আহ্বান করিতে হইল। বাজী রাও রাণোজী শিন্দে ও মহলার রাও হোলকরকে মালবে রাখিয়া ১৭৩৩ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে স্বয়ং জঞ্জীরা অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহার সহিত যুদ্ধে সিদ্দিগণ পরাজিত হন। এই ঘটনায় ঐ অঞ্চলের ১১টা মহালের আয়ের অর্দ্ধাংশ মহারাষ্ট্রীয়েরা প্রাপ্ত হইলেন। মহাত্মা শিবাজীর রাজধানী রায়গড় ও অপর চারিটা প্রসিদ্ধ দুর্গও তাঁহাদিগের হস্তগত হইল। এইরূপে বহুসংখ্যক সর্দ্দারের চেষ্টায় তিন বৎসরে যে কার্য্য সিদ্ধ হয় নাই, বাজী রাও সমরক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইবা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তাহা সম্পূর্ণ সুসম্পন্ন হইল। তাঁহার এই কার্য্যে সন্তুষ্ট হইয়া মহারাজ শাহু বাজী রাওকে রায়গড় ও তন্নিকটবর্ত্তী প্রদেশের আধিপত্য প্রদান করিলেন।
- ↑ মহারাজ শাহু এই প্রতিজ্ঞাপত্র গ্রহণের পর ত্রাম্বক রাওয়ের জননী উমাবাঈয়ের হস্তে বাজী রাওকে অর্পণ এবং গতানুশোচনর ত্যাগপূর্ব্বক পেশওয়ের প্রতি অপতাবৎস্নেহের প্রকাশ করিতে তাঁহাকে সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ করেন। বাজী রাও-ও তাঁহাকে জননী বলিয়া সম্বোধন ও ক্ষমা প্রার্থনা করায় উমাবাঈয়ের ক্রোধশান্তি হইল। এই রমণী অসামান্যা তেজস্বিনী ছিলেন। পৌত্র যশোবন্ত রাও দাভাড়ের অপ্রাপ্তব্যবহার-কালে তিনি স্বয়ং শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানাদি করিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করেন। তিনি একদা আহম্মদাবাদের সুভেদার জোরাবর খান বাবী-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে পরাস্ত করিয়াছিলেন। সেই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং রণরঙ্গিণী বেশে হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণপূর্ব্বক যেরূপ অলৌকিক শৌর্য্য সহকারে যুদ্ধ পরিচালন করিয়াছিলেন, তাহাতে প্রীত হইয়া মহারাজ শাহু তাঁহাকে পুরস্কার-স্বরূপ সুবর্ণবলয় দান করেন। ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দে এই বীর রমণীর মৃত্যু ঘটে।