বাজী রাও।

পূৰ্ব্বভাষ।

কালচক্রের শোচনীয় পরিবর্ত্তনগুণে যে দেশ এক্ষণে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর লীলাক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে, যে দেশের ষষ্ঠাংশ অধিবাসীকে সুর্ভিক্ষের বৎসরেও অর্দ্ধাশনে জীবন যাপন করিতে হয়, সেই দেশ এককালে সর্ব্বপ্রকার সৌভাগ্য-সম্পদের নিকেতন বলিয়া জগতের নিকটে পরিচিত ছিল। “অনন্ত-রত্ন প্রসবিনী” বলিলে তখন একমাত্র ভারত-ভূমিকেই বুঝাইত। আমাদিগের এই জন্মভূমি এককালে সৰ্ব্বতোভাবে “রত্নগর্ভা বসুন্ধরা” নামের সার্থকতা সম্পাদন করিয়াছিল। কিন্তু শুকপক্ষীর মধুর কণ্ঠস্বরের ন্যায় ভারত-ভূমির এই কল্পতরু-সদৃশ রত্ন-প্রভবিতাই দুর্ভাগ্যক্রমে তাহার পরাধীনতার প্রধান কারণস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অতি প্রাচীনকাল হইতে পারসীক, গ্রীক, শক, হুণ, পাঠান, মোগল প্রভৃতি নানা জাতীয় যবনগণ ভারতবর্ষের ধনরত্নের লোভ-সংবরণে অসমর্থ হইয়া সময়ে সময়ে এই দেশ আক্রমণ করিয়াছেন। সেই সকল আক্রমণের মধ্যে গজনবী-বীর মামুদের আক্রমণই বিশেষ প্রসিদ্ধ। খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এই মহাবীর অর্থলোভে আকৃষ্ট ও ধর্ম্মোন্মাদে উন্মত্ত হইয়া উপর্য্যুপরি সপ্তদশ বার ভারতভূমিকে হিন্দুসন্তানের রক্তে প্লাবিত করিয়া, তাহার অপরিমেয় ধনরাশি লুণ্ঠন করেন। তাঁহার চেষ্টায় মোসলমানদিগের ভারত-বিজয়ের পথ সুগম হয়। ইহার পর প্রায় সাত শত বৎসর পর্যন্ত এই দেশ মোসলমানদিগের বিলোল দৃষ্টি অতিক্রম করিতে পারে নাই।

 গজনবী বংশের অধঃপতনের পর ঘোরবংশীয় শাহাব উদ্দীন নানাদেশীয় রণ-কর্কশ সৈনিকদল সংগ্রহ-পূর্ব্বক ভারতবর্ষ বিজয়ের আয়োজন করেন। তাঁহার নির্দেশক্রমে পরিচালিত হইয়া ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে একলক্ষ বিংশতিসহস্র তুরগ সেনা সহ ধর্ম্মোৎসাহ-প্রমত্ত দুর্দ্ধর্ষ আফগানগণ প্রবল সাগর-তরঙ্গের ন্যায় ভারতবর্ষে আপতিত হইলেন। এই সময়ের হিন্দু সৈনিকগণ তেজস্বিতা ও সমর-নিপুণতায় নবাভ্যুদিত মোসলমানদিগের অপেক্ষা কোনও অংশে হীন ছিলেন না; কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে আফগান জাতির নৈসর্গিক উগ্রতা, নবোদ্যম, ধর্ম্মোৎসাহ ও নবরাজ্য-জয়াশার কুহকিনী শক্তির সম্পূর্ণ অসদ্ভাব ছিল। তাঁহারা কেবল আত্ম-রক্ষিণী নীতির বশবর্ত্তী হইয়াই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। সাম্রাজ্য লাভের প্রবলাকাঙ্ক্ষা মোসলমানদিগকে যুদ্ধে অধ্যবসায়-সম্পন্ন করিয়াছিল। তথাপি সমর-কুশল প্রাচীন হিন্দুগণের সহিত যুদ্ধে এই নব-অভ্যুদয়-সম্পন্ন জাতি বহু বার পরাজিত হইয়াছিলেন। কোনও হিন্দুরাজ্যই স্বল্পায়াসে তাঁহাদিগের করায়ত্ত হয় নাই। [] অনেক স্থলেই তাঁহাদিগকে অধর্ম্ম-যুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করিযা জয়লাভ করিতে হইয়াছিল। সাম্রাজ্যপ্রয়াসী শাহাবউদ্দীন কূটনীতির প্রভাবে ও ত্রিংশৎ বৎসরের অব্যাহত চেষ্টায় আর্য্যাবর্ত্তের অধিকাংশ খণ্ডরাজ্যসমূহে মোসলমানদিগের অর্দ্ধচন্দ্রাঙ্কিত বিজয়কেতন আংশিকরূপে উড্ডীন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত মোসলমানদিগের অধিকার আর্য্যাবর্ত্তেই নিবদ্ধ ছিল। অতঃপর দক্ষিণ ভারতের প্রতি তাঁহাদিগের লুব্ধ দৃষ্টি নিপতিত হয়। তাঁহাদিগের মধ্যে খিলিজী বংশীয় আলা উদ্দীন প্রথমতঃ কপটনীতির বলে সরল প্রকৃতি মহারাষ্ট্রীয়দিগের রাজ্যে প্রবেশাধিকার লাভ করেন। তিনি দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলে, পঙ্গপাল-সদৃশ যবনসেনা মহারাষ্ট্রীয়দিগের স্বাধীনতা-হরণের জন্য দক্ষিণাপথে অবতীর্ণ হইতে লাগিল। তদানীন্তন মহারাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র রাও ও তদীয় জামাতা হরপাল দেব বিংশতি বৎসর পর্যন্ত স্বরাজ্য-রক্ষার চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের উদ্যম নিষ্ফল হইলেও মহারাষ্ট্রীয় সামন্তেরা বহুদিবস পর্য্যন্ত আপনাদিগের স্বাতন্ত্র্যে জলাঞ্জলি দেন নাই। কিন্তু ইহার পর মোসলমানের প্রবর্দ্ধমান শক্তির গতিরোধ করা ক্রমশঃ তাঁহাদিগের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল। মোসলমানেরা অসাধারণ অধ্যবসায় ও দুর্ব্বার রাজ্যলিপ্সা-বশে স্বল্পদিবসের মধ্যেই সমগ্র দক্ষিণ ভারত পুনঃ পুনঃ লুণ্ঠন করিয়া ছারখার করিয়া ফেলিলেন। ইতিহাসলেখক ফেরিস্তা বলেন, ১৩১০ খৃষ্টাব্দে তাঁহারা এক কর্ণাটক প্রদেশ লুণ্ঠন করিয়াই তিন শতাধিক হস্তী, বিংশতি সহস্র অশ্ব ও ৯৬ সহস্র মণ সুবর্ণ লাভ করিয়া ছিলেন। কেবল তাহাই নহে, তাহাদিগের অনুগ্রহে কর্ণাটক প্রদেশ সম্পূর্ণরূপে রজতশূন্য হইয়াছিল।

 এইরূপ কার্য্য পরম্পরার দ্বারা দক্ষিণভারতে মোসলমানদিগের অপ্রতিহত আধিপত্যের নিদর্শনস্বরূপ: ৩৪৭ খৃষ্টাব্দে “বাহামনি” রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইল। এই রাজবংশ ১৭৫ বৎসর কাল অক্ষুণ্ণ প্রতাপে মহারাষ্ট্র দেশ শাসন করে। অতঃপর সর্দ্দারগণের কলহ ও বিদ্রোহের ফলে বাহামনি রাজ্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত হইয়া যায়। এই রাজ্যপঞ্চকের অধীশ্বর সুলতানেরাও প্রায় এক শত বৎসর কাল প্রচণ্ডতেজে দক্ষিণাপথ শাসন করেন। মোসলমানদিগের এই সার্দ্ধদ্বিশত-বর্ষব্যাপী কঠোর শাসন-চক্রের পেষণে জর্জ্জরিত হইয়া মহারাষ্ট্রবাসী “ত্রাহি” “ত্রাহি” করিতেছিলেন। মহারাষ্ট্রদেশ হইতে আর্য্যধর্ম্ম ও আর্য্যবিদ্যা বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছিল। অধিকাংশ প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রে দেব মন্দিরাদির স্থানে মস্জে‌দ নির্ম্মিত হইয়াছিল।

 এইরূপে হিন্দুস্থান “যবনস্থানে” পরিণত হইতেছিল দেখিয়া ধর্ম্মপ্রাণ মহারাষ্ট্রবাসী ভয়াকুল হইয়া উঠিলেন। কল্পনাবিহারী দাক্ষিণাত্য কবি সুখময় কল্পনাসাম্রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক দেশের দুরবস্থা বর্ণনায় মনোযোগী হইলেন।—

অবনাবতীত-পবনাশ্বশোভিনো,
ভব-নাগশায়ি-ভবনাবমর্দ্দিনঃ।
সবনাদি-কর্ম্মলবনায় দীক্ষিতাঃ,
যবনাশ্চরপ্তি ভুবনাতিভীষণাঃ।
বিশ্বগুণাদর্শ—১৬২ শ্লোক।

 “হিন্দুদিগের ধর্ম্ম কর্ম্ম লোপ করিবার জন্য যবনদিগের দুর্জ্জয় তুরঙ্গসেনা ভৈরববেশে দেশে দেশে দেবমন্দিরাদি ভগ্ন করিয়া বেড়াইতেছে”—ইত্যাদি শ্লোক তাঁহাদিগের লেখনীর মুখে নিঃসৃত হইতে লাগিল। রামদাস স্বামীর ন্যায় যোগাসক্তচিত্ত ব্যক্তিও দেশের দুঃখকাহিনী বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইয়া মর্ম্মস্পর্শী ভাষায় লিখিলেন,—

 যবনগণ বহুদিবস হইতে অত্যাচার করিতেছে, তাহাদিগকে শাস্তি দিতে পারে, হিন্দুগণের মধ্যে এমন চণ্ড পুরুষ কেহ নাই। দুষ্টগণের অত্যাচারে দেব-ব্রাহ্মণের উচ্ছেদ ঘটিয়াছে, সমস্ত ধর্ম্মকর্ম্ম স্রষ্ট হইতেছে, নামসংকীর্ত্তনও লোপ পাইয়াছে। তীর্থক্ষেত্র সকল বিধ্বস্ত, ব্রাহ্মণগণের আবাসস্থানসমূহ অপবিত্রীকৃত ও সমস্ত পৃথিবী (ভারতবর্ষ) বিপ্লবপূর্ণ হইয়াছে। ধর্ম্ম বিলুপ্ত হইয়াছেন। পাপিগণের বলবৃদ্ধি হওয়ায় ধার্ম্মিকগণ দুর্ব্বল ও দেবতাগণ অত্যাচার-ভয়ে লুক্কায়িত হইয়াছেন। ব্রাহ্মণগণ তিলকমালা প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়া যবনদিগের অনুকারী হইয়াছে। সকলের সুখসম্মান লোপ পাইয়াছে। যবনগণ দুর্ব্বল প্রজাকুলের প্রতি বিবিধ কটুভাষা প্রয়োগ করে ও তাহাদিগকে নানা প্রকার যন্ত্রণা দেয়।”

 খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে যে দেশের অবস্থা এইরূপ শোচনীয় ছিল, মদোদ্ধত মোগল সেনা প্রভঞ্জনবেগে যে দেশের গ্রাম নগরাদির উৎসাদন করিয়া বেড়াইত, সেই দেশে খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ কালে একজন যবন- সাম্রাজ্য-বিলোপকারী অসাধারণ-শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষের আবির্ভাব হইয়াছিল, ইহা সামান্য বিস্ময়ের বিষয় নহে। এই মহাপুরুষ সহ্যাদ্রির অঙ্কদেশস্থিত কোঙ্কণ প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে সাধারণ ব্রাহ্মণ-বংশে জন্ম-গ্রহণ করিয়া স্বীয় অলৌকিক শক্তি-প্রভাবে মহারাষ্ট্র-বাসীর অধিনায়কত্ব লাভ করেন। সমুদ্র-বলয়াঙ্কিতা ভারত-ভূমিকে বিধর্মী যবনদিগের দাসত্ব পাশ হইতে বিমুক্ত করিয়া হিন্দুস্থানে অখণ্ড হিন্দু-সাম্রাজ্য-স্থাপন ও উচ্ছিন্ন- প্রায় হিন্দু-ধর্ম্মের সম্যক্‌ প্রতিষ্ঠা—এই মহাপুরুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল। তিনি অকালে কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় তাঁহার সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় নাই । তথাপি তিনি তাঁহার স্বল্প অয়ুষ্কালের মধ্যে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন মোসলমান শক্তিকে দমিত করিয়া দক্ষিণে তুঙ্গভদ্রা-তীর হইতে উত্তরে যমুনা-তীর পর্যন্ত একটি বিশাল হিন্দু-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছিলেন। ভারতের বিগত সহস্র বৎসরের ইতিহাসে, এমন কি, দুর্দ্ধর্ষ শিখ ও রাজপুতদিগের ইতিবৃত্তেও এরূপ মহতী চেষ্টার উদাহরণ—এরূপ অসাধ্যসাধনের দৃষ্টান্ত আর পাওয়া যায় না । যে মহাপুরুষ যবনশাসিত ভারতে এই দুস্কর কার্য্য সাধনপূর্ব্বক চির-প্রণষ্ট হিন্দু-গৌরবের পুনঃ-

 প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম বাজী রাও । যে নীতি অবলম্বন করিয়া বাজী রাও এই দুষ্কর কার্য্য-সাধনে যত্নশীল হইয়াছিলেন, তাহার সম্বন্ধে এই পূৰ্ব্বভাষে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ছত্রপতি মহাত্মা শিবাজী এই নীতির উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। তাঁহার পরবর্তী মহা-রাষ্ট্রীয় বীরেরা উহার অনুসরণ করিয়া দক্ষিণাপথে আপনাদিগের প্রাধান্য রক্ষা করেন। কিন্তু বাজী রাওয়ের বুদ্ধিকৌশলে ও শৌর্য্য-বলেই ভারতের প্রায় সর্ব্বত্র ঐ নীতির বৈদ্যুতিক ক্রিয়া আরব্ধ হয় এবং তাহার ফলে ভারতবর্ষের অধিকাংশ প্রদেশ মোসলমানদিগের শাসন-পাশ হইতে বিমুক্ত হইয়া মহারাষ্ট্রীয়দিগের রাজচ্ছত্রতলে আশ্রয় লাভ করে। বাজী রাওয়ের পূর্ব্বে এরূপ ভাবে কেহ এই নীতির পরিচালন করেন নাই—করিবার অবসরও পান নাই। তাঁহার স্ব-সম-সময়ের সহযোগী রাজপুরুষগণের মধ্যেও তিনি ভিন্ন আর কেহই এই নীতির ঈদৃশ পরিচালনে সাহসী হন নাই। ইহাই বাজীরাওয়ের চরিত্রের একটি প্রধান বিশেষত্ব। এ বিশেষত্ব ভারতবর্ষের ইতিহাসে তৎপূর্ব্বে অপরিজ্ঞাত ছিল। বাজী রাওয়ের প্রায় এক শতাব্দী পরে ইংরাজেরা এই নীতির সময়োচিত সংস্কারপূর্ব্বক অনুসরণ করিয়া সমগ্র ভারত- সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হইতে সমর্থ হন। ইংরাজী ইতিহাসে ইহা The system of subsidiary alliance নামে পরিচিত। ইহার মহারাষ্ট্রীয় নাম “চৌথাই” বা চৌথ পদ্ধতি।

 মোগলদিগের আমলে দেশের শান্তিরক্ষা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে রাজ্য-রক্ষার আয়োজনে সাধারণতঃ রাজস্বের চতুর্থাংশ ব্যয়িত হইত। মহাত্মা শিবাজীর চেষ্টায় মহারাষ্ট্র শক্তি যখন দেশ মধ্যে প্রাধান্য লাভ করিল, তখন মহারাষ্ট্র নরপতিগণ দুর্ব্বল প্রতিবেশী রাজ্যের শান্তি-রক্ষার ও শত্রুর আক্রমণ-নিবারণের ভার গ্রহণ করিতে লাগিলেন। কাজেই সেই আশ্রিত রাজ্যের রাজস্বের চতুর্থাংশ বা চৌথ তাঁহাদিগের প্রাপ্য হইল। ফলতঃ “চৌথ” অপরের রাজ্য- রক্ষার্থ সৈন্যপোষণের বেতন ভিন্ন আর কিছুই নহে ।

 এইরূপ বেতন লাভ করিয়া স্বকীয় সৈন্য-পোষণের ব্যয়-ভার লাঘব করিবার কল্পনা প্রথমে শিবাজীই উদ্ভাবিত করেন। তিনি বহু দিন হইতে বিজাপুর ও লকোণ্ডার সুলতানদিগের এবং মোগল বাদশাহের নিকট তাহাদিগের রাজ্য বা রাজ্যাংশ রক্ষার ভার গ্রহণ ও তাহার বেতনস্বরূপ “চৌথ” স্বত্বের প্রার্থনা করিতেছিলেন। পরিশেষে ১৬৬৮ খৃষ্টাব্দে মোগলদিগের আক্রমণের ভয়ে বিপন্ন হইয়া দক্ষিণা- পথের সুলতানেরা শিবজীকে চৌথ-স্বরূপ বার্ষিক আট লক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হন ও তাঁহার সৈন্যসাহায্য লাভ করেন। সে সময়ে কেবল শিবাজীর সহায়তার ফলেই বিজাপুর ও গোলকোণ্ডা রাজ্য মোগল সম্রাটের সর্ব্বনাশকর আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইয়াছিল। এইরূপে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে সর্ব্বপ্রথম দক্ষিণ ভারতে ‘চৌথ’ প্রথার প্রবর্তন হয়।

 বলা বাহুল্য, আত্ম-রক্ষিণী নীতির বশবর্ত্তী হইয়াই রাজনীতিবিৎ শিবাজী এই চৌথ-পদ্ধতির উদ্ভাবন ও অনুসরণ করেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, পর রাজ্য-রক্ষার দায়িত্ব লইয়া তদ্বিনিময়ে তত্রত্য রাজস্বের চতুর্থাংশ লাভ করিতে না পারিলে ভারতে মহারাষ্ট্র শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হইবে না। কারণ, ইহার দ্বারা প্রথমতঃ পররাষ্ট্রের ব্যয়ে মহারাষ্ট্রীয়দিগের সৈন্য-সংখ্যা ও সামরিক বলের বৃদ্ধি সম্পাদিত হইবে। দ্বিতীয়তঃ, যে সকল রাজ্য মহারাষ্ট্র-সৈন্য কর্ত্তৃক রক্ষিত হইবে, সে সকল রাজা হইতে মহারাষ্ট্র-রাজশক্তির বিশেষ অনিষ্টের আশঙ্কা থাকিবে না। তৃতীয়তঃ, “চৌথ”, নামে শান্তিরক্ষার বেতন হইলেও কার্য্যতঃ উহা সামন্তের নিকট প্রধান রাজশক্তির প্রাপ্য করেরই নামান্তর। ইতিহাসজ্ঞ পাঠকের অবিদিত নাই যে, খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালে মার্ক ইস অব ওয়েলেস্‌লি মহোদয়ের প্রবর্ত্তিত “সব্‌সিডিয়ারি সিষ্টেম”ও এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সে যাহা হউক, ১৬৮০ খৃষ্টাব্দে শিবাজীর ইহলোক পরিত্যাগের পূর্ব্বেই দক্ষিণ ভারতের যাবতীয় হিন্দু ও মোসলমান রাজশক্তির সম্মতিক্রমেই তাঁহাদিগের রক্ষার ভারগ্রহণ ও তাহার বিনিময়ে চৌথ আদায় করিবার প্রথা মহারাষ্ট্র-সমাজে বদ্ধমূল হইয়াছিল।

 শিবাজীর মৃত্যুর পর সম্রাট্ অওরঙ্গজেব মহারাষ্ট্রীয়দিগের স্বাধীনতা-হরণ-পূর্ব্বক তাঁহাদের শক্তি চূর্ণ করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু স্বাধীনতাপ্রিয় মহারাষ্ট্রীয় বীরগণের অসাধারণ শৌর্য্যগুণে তাঁহার সমস্ত যত্নই বিফল হয়। বিংশতি বৎসর যুদ্ধের পর খৃষ্টীয় ১৭০৫ অব্দে সম্রাট্ তাঁহাদিগের স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া তাঁহাদিগকে এক সনন্দপত্র দান করেন। অধিকন্তু দেশের অশান্তি নিবারণের মানসে তিনি তাঁহাদিগকে দক্ষিণ ভারতস্থিত মোগল শাসিত প্রদেশের ‘সরদেশমুখী’ স্বত্ব বা সমগ্র রাজস্বের দশমাংশ— বার্ষিক এক কোটী অশীতি লক্ষ মুদ্রা প্রদান করিতে স্বীকৃত হন। এজন্য অবশ্য সরদেশমুখের ন্যায় স্বকীয় সৈন্যের দ্বারা দক্ষিণাপথের বাদশাহী প্রদেশের শান্তিরক্ষার ভার তাঁহাদিগকে লইতে বলা হইল। কিন্তু মহারাষ্ট্রীয়েরা ইহাতে সম্মত ও সন্তুষ্ট হইলেন না। তাঁহারা বাদশাহের নিকট সরদেশমুখীর সহিত শিবাজীর উদ্ভাবিত চৌথ পদ্ধতির প্রবর্ত্তনাধিকারও প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। কারণ, সে সময়ে দেশে যেরূপ অসংখ্য রাজ্যের ও স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় রাজ-পুরুষের আবির্ভাব হইয়াছিল, তাহাতে পররাষ্ট্রে যথোপযুক্ত পরিমাণে সৈন্য-রক্ষার ব্যবস্থা না করিলে দেশে শান্তিস্থাপনের ও মহারাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখিবার সম্ভবনা ছিল না। কিন্তু সম্রাট্ সে স্বত্বদানে অসম্মত হওয়ায় পুনর্ব্বার যুদ্ধারম্ভ হয়। পরিশেষে ১৭১০ খৃষ্টাব্দে অওরেঙ্গজেবের পুত্র ফরুখশিয়র আংশিকভাবে ও তৎপরবর্ত্তী সম্রাট্ মহম্মদশাহ ১৭১৯ খৃষ্টাব্দে সম্পূর্ণভাবে মহারাষ্ট্রীয়দিগকে সরদেশমুখী স্বত্বের ও চৌথ পদ্ধতি প্রবর্ত্তনের সনন্দ প্রদান করিতে বাধ্য হইলেন। বাজী রাওয়ের পিতা বালাজী বিশ্বনাথ স্বয়ং দিল্লী গমন করিয়া শেষোক্ত সনন্দ পত্র লইয়া আসেন।

 সনন্দ লাভ করিয়াও মহারাষ্ট্রীয়েরা সর্ব্বত্র চৌথ পদ্ধতির প্রবর্ত্তন করিতে পারিলেন না। দিল্লীশ্বরের সুভেদারেরা ও অপর স্বতন্ত্র–প্রায় রাজন্যবর্গ বিনা যুদ্ধে মহারাষ্ট্র-শক্তির রক্ষণাধীন হইতে অসম্মত হইলেন। নিজাম-উল্‌-মুল্ক এ বিষয়ে প্রধান প্রতিবাদী হইয়াছিলেন। এজন্য মহারাষ্ট্রীয়দিগকে ২০ বৎসর তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে হয়। বাজী রাও এই যুদ্ধের নেতৃত্বগ্রহণ করিয়া বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁহার সহিত যুদ্ধে পুনঃ পুনঃ পর্য্যুদস্ত হইয়া নিজামকে মহারাষ্ট্রীয়দিগের রক্ষণাধীনতা স্বীকার ও তাঁহাদিগকে চৌথ দান করিতে হয়। দক্ষিণাপথের অপর ক্ষুদ্র বৃহৎ রাজারাও ক্রমে মহারাষ্ট্রীয়দিগের প্রাধান্য স্বীকার করিতে বাধ্য হন। ফলতঃ বালাজী বিশ্বনাথ মোগল কর্ত্তৃপক্ষের নিকট হইতে তাঁহার স্বদেশবাসীর জন্য যে স্বত্বের সনন্দ আনয়ন করেন, বাজী রাওয়ের জীবনব্যাপী চেষ্টাতেই মহারাষ্ট্রবাসিগণ তাহার প্রকৃত ফলভোগের অধিকারী হইতে পারিয়াছিলেন।

 কেবল তাহাই নহে। বাদশাহী সনন্দ অনুসারে উত্তর ভারতে চৌথ আদায়ের অধিকার মহারাষ্ট্রীয় জাতির ছিল না। এই কারণে আর্য্যাবর্ত্তে আপনাদিগের আধিপত্য বিস্তারপূর্ব্বক চৌথ পদ্ধতির প্রবর্ত্তন করিবার কল্পনা বাজী রাওয়ের পূর্ব্বে কাহারও মস্তিষ্কে স্থান পায় নাই। বীরশ্রেষ্ঠ বাজীরাওয়ের বিশাল চিত্তক্ষেত্রেই সর্ব্বপ্রথম সমগ্র ভারতবর্ষকে চৌথ পদ্ধতি সূত্রে আবদ্ধ করিয়া কুমারিকা অন্তরীপ হইতে হিমাচলের শিখরদেশস্থিত “আটক” নগর পর্য্যন্ত বিশাল প্রদেশের শান্তিরক্ষার বা শাসন ও পালনের ভার গ্রহণ করিবার মহনীয় আকাঙ্ক্ষা সমুদিত হয়। মহারাজ শাহুর মন্ত্রিসমাজ ও সেনানীগণ বাজী রাওয়ের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা দর্শনে স্তম্ভিত হইয়া তাঁহাকে এই কার্য্যে প্রতিনিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষে হিন্দুশক্তির ও হিন্দুধর্ম্মের প্রাধান্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা ও বিধর্মীর শাসনপাশ হইতে সমগ্র ভারতবাসীর উদ্ধার সাধন প্রত্যেক মহারাষ্ট্রসুসন্তানের কর্তব্য—এই কথা বলিয়া বাজী রাও সকলের উৎসাহানল প্রজ্জ্বলিত করেন। এই প্রসঙ্গে মহারাজ শাহুর দরবারে তিনি ওজস্বিনী ভাষায় যে বক্তৃতা করেন, তাহা শ্ররণে সমস্ত মহারাষ্ট্র সর্দ্দারেরা একমত হইয়া ভারতে হিন্দু প্রাধান্য-স্থাপনে অগ্রসর হওয়াই কর্ত্তব্য বলিয়া স্থির করিলেন। শিবাজীর প্রবর্ত্তিত চৌথ পদ্ধতির সাহাযো ভারতবর্ষে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য অগ্রগমন-নীতির (Forward policy) প্রচারই বাজী রাওয়ের চরিত্রের বিশেষত্ব। ঐ নীতির অনুসরণে সমস্ত মহারাষ্ট্রীয়কে সমবেতভাবে নিয়োজিত করাই তাঁহার চরিত্রের প্রধান মহত্ত্ব। সেই মহত্ত্বের প্রভাবে হিন্দুস্থানে শতবর্ষপর্য্যন্ত হিন্দুর প্রাধান্য পরিরক্ষিত হইয়াছিল। এই কারণে সেই মহত্ত্বের ইতিহাস আমাদের সকলেরই আলোচনীয়।


  1. The popular notion that India fell an easy prey to the Mahomedans is opposed to the historical facts. - W. W. Hunter's A Brief History of the Indian people.