বিজ্ঞান দর্পণ/প্রথম খণ্ড/আশ্বিন ১২৮৯/রহস্য (প্রথম অধ্যায়)
রহস্য।
সম্পাদক মহাশয়, আপনি “বিজ্ঞানদর্পণ” প্রকাশ করিতেছেন শুনিয়া বড়ই আহ্লাদিত হইলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙ্গালির মধ্যে প্রায় কাহারও বিজ্ঞানে আস্থা নাই। অনেকেই বলেন “আমি কেরাণি হইয়াছি, চিরকাল কেরাণিগিরি করিয়া মরিব, বিজ্ঞান পড়িয়া আমার কি হইবে?” অনর্থক নীরস বিজ্ঞান তত্ত্বে মস্তক বিঘূর্ণিত করিব কেন? এটি তাঁহাদের বিষম ভ্রম! সকল বিষয়ের কিছু কিছু জ্ঞান থাকা ভাল। একদা বিজ্ঞান আমাকে অজ্ঞান বাঙ্গালি পাইয়া কিরূপ দুর্গতি করিয়া ছিল তাহা বলিতেছি, শুনিয়া আপনাকে কাঁদিতে হইবে।
ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিব এবং বড়লোক হইব, এই আশয়ে কালেজ ছাড়িয়া আমি বিলাতে গিয়াছিলাম। পাঁচ ছয় মাস লণ্ডনে থাকিতে থাকিতে আমার বিস্তর সাহেবের সঙ্গে আলাপ হইল। আমিও সাহেবদের সঙ্গে থাকিয়া এক-রকম সাহেব হইয়া পড়িলাম। বাল্যকাল হইতেই জামার সাহেব হইবার ইচ্ছা ছিল। কলিকাতায় একবার সাহেব সাজিয়া কয়েকজন বন্ধুকে এরূপ ভয় দেখাইয়াছিলাম যে, সে কথা মনে পড়িলে হাসি পায়। তাহারা আমাকে সে বেশে চিনিতে পারে নাই। তবু তখন পরচুলের দাড়ি গোঁফ করিয়াছিলাম। এখন আমার বেশ গোঁফ দাড়ি উঠিয়াছে এবং বাঙ্গালি ধরণে দাড়ি না রাখিয়া হুইস্কার রাখিয়াছি। রংটা কিছু কাল, তা প্রত্যহ যেরূপ সোপ ব্যবহার করি তাহাতে এরূপ ভরসা আছে, যে দেশে ফিরিয়া যাইলে নগেন্দ্রনাথ সরকার বলিয়া কেহ চিনিতে পারিবে না।
পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি যে, বিস্তর সাহেব ও ভাল ভাল বিবির সহিত আমার আলাপ হইয়াছে; কিন্তু তন্মধ্যে হার্বি নামক একজন ইঞ্জিনিয়ারের সহিত আমার বন্ধুত্ব হইল। হার্বিসাহেব খুব ভাল ইঞ্জিনিয়ার ও বড় ভদ্রলোক; হার্বির রাজসরকারে চাকরি, মাসিক বেতন একশত পাউণ্ড। আমাদের পরস্পরে এরূপ ভাব জন্মিল যে বাঙ্গালি ও ইংরাজে তদ্রূপ হইতে পারে না; দুই ইংরাজেই সম্ভবে। এইরূপে কিছু দিন যায়, এক দিন সম্বাদ আসিল যে, হার্বি সাহেবের খুড়ির কাল হইয়াছে; তিনি নিঃসন্তান হেতু মৃত্যুকালে হার্বির নামে সমস্ত বিষয় উইল করিয়া গিয়াছেন। এই সংবাদ পাইয়া, আমার বন্ধুর আনন্দের সীমা থাকিল না। আর চাকরি করিতে হইবে না; টেবিলের উপর পা তুলিয়া চিরকাল বড়মান্ষি করিতে পারিবেন; এই আনন্দে বন্ধু উন্মত্ত হইলেন। একেবারে চাকরিতে জবাব দিয়া পরদিনেই হার্বি লণ্ডন পরিত্যাগ করিয়া চলিলেন। যাইবার সময় আমাকে বলিয়া গেলেন “দেখ নগেন্দ্র, বোধ হয় তোমার পরীক্ষা শেষ না হইলে তুমি আমার বাটী দেখিতে যাইতে পারিবে না। তার এখনও আট মাস বিলম্ব আছে। যাহা হউক এই সময়ের মধ্যে আমিও এক রকম বাড়ীটি সাজাইতে পারিব। কিন্তু নিশ্চয় করিয়া বল পরীক্ষার শেষে আমার বাটীতে গিয়া দশ পনর দিন থাকিবে ত?” আমি বলিলাম “তার আর আপত্তি কি? কিন্তু জিজ্ঞাসা করি তোমার নিত্য এত পরিশ্রম করা অভ্যাস; এখনত আর কোন কাজই রহিল না; কিরূপে দিন কাটাইবে? উত্তর। “কেন, কাজের ভাবনা কি? পরের জন্য পরিশ্রম করিতে হইবে না বলিয়া কি আর কর্ম্ম নাই? আমি এথন হইতে নিজের বাটীতে কলবল প্রস্তুত করিব; যাওত দেখিতে পাইবে। আর ভাই বসিতে পারি না, শীঘ্রই ট্রেন ছাড়িবে।”
এই বলিয়া হার্বি সেক্হ্যাণ্ড করিয়া চলিয়া গেলেন।
এক মাস, দুই মাস করিয়া ক্রমে জলের মত আট মাস কাটিয়া গেল। পরীক্ষার সময় আসিল, ক্রমে তাহাও শেষ হইল। এই কয় মাসের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে হার্বির পত্র পাইতাম। প্রতি পত্রে তাহার সহিত দেখা করিবার অনুরোধ আসিত; প্রতি প্রত্যুত্তরে যথা সময়ে অনুরোধ রক্ষা করিবার মানস জানাইতাম। শেষ পত্রে হার্বি লিখিল “সোমবার বৈকালে ৪ টার ট্রেণে এখানে আসিবে, আমি গাড়ি লইয়া ষ্টেশনে অপেক্ষা করিব। এখানে তোমাকে পনর দিন থাকিতে হইবে, ইহার কম ছাড়িয়া দিব না।”
সোমবার বৈকালে একটি পোর্টমেণ্টো গুছাইয়া গাড়িতে উঠিলাম। হার্বির বাড়ী যাইতে যে ষ্টেশনে নামিতে হয়, তাহা লণ্ডন হইতে প্রায় পনর ক্রোশ দূরে। যথা সময়ে সেই ষ্টেশনে আসিয়া পঁহুছিলাম। হার্বি সেইখানে অপেক্ষা করিতেছিল। আমাকে দেখিয়া বিস্তর আহ্লাদ প্রকাশ করিল। দুইজনে তাহার গাড়িতে চড়িয়া চলিলাম।
কিছুদূর হইতে নিজের বাটী দেখিতে পাইয়া হার্বি বলিল “ঐ আমার বাড়ী দেখা যাইতেছে, ঐ যে বাগানের চতুর্দ্দিকের বাটীগুলি দেখিতেছ এসব আমার বন্ধুদের বাটী।” আমার বাড়ী থেকে সকলকার বাড়ীতে টেলিগ্রাফের তার বসাইয়াছি। যে দিন আমার কোন বিশেষ কাজ থাকে না, একজনকে টেলিগ্রাফ করি, আমার সহিত দাবা থেলিবেত শীঘ্র আইস—না হয় ত অপরকে বলি—সময় থাকেত চল শীকার করিতে যাই।”
কথা কহিতে কহিতে ফটকের কাছে আাসিয়া পঁহুছিলাম। হার্বি গাড়ি থামাইল। ফটক বন্দ ছিল কিন্তু খুলিবার জন্য গাড়ি হইতে নামিবার উপক্রম করাতে, হার্বি আমাকে স্থির হইয়া বসিতে বলিল।
ফটক আপনি খুলিয়া গেল। আমি আশ্চর্য্য হইয়া বলিলাম “বাঃ! ভারি মজাত! গেট আপনি খুলিয়া যায়।”
হাসিয়া হার্বি বলিল “কেন? বুঝিতে পারিলে না? গেটের দশ হাত এদিকে রাস্তায় একখানি লোহার পাত আছে, গাড়ি তাহার উপরে আসিতেই সেটা একটু নামিয়া গেল; এই লোহার পাতের আর ফটকের আংটার সঙ্গে মাটির নিচে দিয়া একটি লোহার শিক আছে। লোহার পাত নামিয়া যাওয়াতে ঐ শিক ফটকের আংটাকে ছাড়িয়া দিল; ফটকে স্প্রীং আছে, উহা আপনি খুলিয়া গেল। ভিতর দিকে ঠিক্ এই রকম আর একটা লোহার পাত আছে তাহার উপর দিয়া যখন গাড়ি যাইবে, ঠিক এইরূপে ফটক আপনি বন্ধ হইবে।”
আমি। এরূপ কলের ফটক কই আর কোথাও দেখি নাই। ইহাতে তোমার ভারি সুবিধা হইয়াছে। হার্বি। সুবিধা নয়! আমাকে দরওয়ান রাখিতে হয় না।
গাড়ি বারাণ্ডার নিচে গাড়ি আসিল। দেখি, একজন সহিস দাঁড়াইয়া আছে; একজন চাকর ভিতরের দরজা খুলিতেছে। আামি কিছু না বলিবার পূর্ব্বেই হার্বি বলিল “দেখ, আমি কাহাকেও ডাকি নাই, তথাপি আমরা আসিয়াছি ইহারা জানিতে পারিয়াছে। ফটক খুলিবার লোহার পাত দেখিয়াছ, সেই পাতের সঙ্গে দুইটি ইলেক্ট্রিক্ তার আছে। আস্তাবলের ও চাকরদের ঘরের ঘণ্টার সহিত ঐ তারের যোগ আছে। লোহার পাতটি নামিয়া যাওয়াতে ঐ তারের দ্বারা দুইটি ঘণ্টা বাজিয়াছে। ঘণ্টার শব্দে ইহারা জানিতে পারিল যে, কেহ বাড়িতে আাসিতেছে।”
আমি। এটাও বড় মন্দ নয়। কোন ভদ্রলোককে আসিয়া অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হয় না।
বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। হার্বির ভগিনী পাশের ঘরে বসিয়াছিলেন, আমাদের দেখিতে পাইয়া নিকটে আসিলেন, হার্বি পরস্পরের পরিচয় দিয়া দিল। মিস হার্বিকে দেখিয়া, হার্বির ভগিনী বলিয়া বোধ হয় না। তাঁহার বয়স অনুমান ৫০ বৎসর। তাঁহাতে স্ত্রী জাতির মাধুর্য্য কিছুমাত্র নাই। তাঁহাকে দেখিলেই ইষ্টলিনের বর্ণীলিয়াকে মনে পড়ে। তিনি যথাসাধ্য মিষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন মহাশয় আসিতে কোন কষ্ট হয় নাইত?” এইরূপ আরও দুই একটি কথার পর তাহার কোন গৃহ কার্য্য মনে পড়াতে চলিয়া গেলেন।
উঠিবার শিঁড়ীর বাম দিকে দেখিলাম, একটা মোটা লোহার শিকের গায়ে কতকগুলি বাঁকান লোহার কাটি আছে; এক একটি কাটিতে এক একখানি ব্রুস লাগান আছে। কলটি দেখিয়া কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, জিজ্ঞাসা করিলাম “হার্বি, ওটা কি হে।”
হার্বি। কোন্টা! ওঃ। ওটি আমার ব্রুসের কল। দাঁড়াও তোমাকে বুঝাইয়া দিই। এই যে জমি হইতে এক ফুট উঁচুতে এক খানি চৌকি দেখিতেছ উহার উপর দাঁড়াইতে হয়, উহার উপর উঠিলেই তোমার ভরে আস্তে আস্তে চৌকি খানি নামিতে থাকে; আর নামিরার সময় তাহার মধ্যস্থিত কতকগুলি ঘড়ীর কলের মতন চাকাকে চালাইয়া দেয়, আর এই সকল বাঁকান ব্রুস লাগান শিক গুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া তোমার কোট পেণ্টুলেন ও জুতা ব্রুস করিতে থাকে। কিন্তু সকল অপেক্ষা উপরের হ্যাট ব্রুসটিই মজার। এটি দেখিতে ঠিক যেন একটি হ্যাট বাক্স দুই ভাগ করা। এখন ইহাদের মধ্যে বিলক্ষণ—
আমি। চমৎকার! চমৎকার! একবার ওঠ না। দেখি কেমন চলে।
হার্বি। তার আর আটক কি?
এই বলিয়া হার্বি চৌকির উপর উঠিয়া দাঁড়াইল; উঠিবামাত্র ব্রুসগুলি সুন্দর রূপে ঘুরিয়া কাপড় ঝাড়িতে লাগিল; কিন্তু উপকার টুপির ব্রুসটি যেমন তেমনি রহিল। যখন নিচের ব্রুসগুলির কার্য্য অর্দ্ধেক হইল, উপরের ব্রুসটি নামিয়া, টুপির চতুর্দ্দিকে বেগে বার দশ পনর ঘুরিয়া তফাৎ হইয়া পড়িল।
হার্বি নামিয়া আসিয়া বলিল “কেমন মজার কল? উঠে একবার ব্রুস হয়ে এস।
আমি। না, না, এখন থাক্। আর এক সময় তথন দেখা যাবে।
হার্বি। তবে ভাই তুমি একটু বস; আাহারের উদ্যোগ কতদূর হইল একবার দেখিয়া আসি।
হার্বি চলিয়া গেলে, কলটি নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলাম। ইচ্ছা হইল একবার উঠিয়া দেখি কি রকম চলে। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম ঘরে কেহই নাই। চৌকীর উপর উঠিলাম, ব্রুসগুলি পরিষ্কার রূপে কোট, পেণ্টুলেন ঝাড়িতে লাগিল। আর টুপির ব্রুস! ও বাবা! একি বিপদ! প্রাণ যায় যে!
আমার যে মাথায় টুপি ছিল না তা মনেই নাই। ফলে এরূপ যন্ত্রণা কখন ভোগ করি নাই। উঃ। টুপির ব্রুস দুটি মুথের উপর যোড়া লাগিয়া গেল। ভিতরের দুটি আংটাদ্বারা কাণদুটিকে উত্তম রূপে চিম্টাইয়া মুথের চতুর্দ্দিকে ঘুরিতে লাগিল। নাকে যে চামড়া রহিল এরূপ বোধ হইল না। আমি যেন ছাঁওনা তলায় বর দাঁড়াইয়া রহিলাম। দুঃথের মধ্যে নাক কান মলা খাইলাম কিন্তু কন্যারত্ন লাভ হইল না। মনে করিলাম নীচু হইয়া পলাই। বাবারে! যেমন নিচু হইব, পশ্চাৎ হইতে কাপড় ঝাড়া ব্রুস দুটী দুই গুঁতা মারিয়া খাড়া করিয়া দিল। সৌভাগ্যক্রমে শীঘ্রই যন্ত্রণার শেষ হইল। নামিয়া দেখি, হার্বি এক কোনে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে; হার্বির আর হাসি থামে না। আমি কাষ্ঠ হাসি হাসিয়া, সম্মুখের আরসিতে চেহারা দেখিলাম। প্রথমে হাসিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, এখন নিজের চেহারা দেখিয়া আর হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলাম না। মাথার চুলগুলি পাকাইয়া মন্দিরের চূড়ার মতন হইয়াছে। আর আমার সখের হুইস্কারের এক ভাগ কলের সাহায্যে গিয়াছে, অপরাংশ নাসিকা রক্ষা করিতে ব্যস্ত।
হার্বি কথঞ্চিৎ হাস্য সম্বরণ করিয়া বলিল “কি বিপদ! কলটা যে ঠিক আমার মাপের মতন; তা বুঝি ঠাওর নাই? আবার টুপি রাখিয়া উঠিতে গেলে কেন?” আমি বলিলাম যাক্ বেশ ব্রুস হওয়া গেল, আর ও কথায় কাজ নাই।”
“এখন কাপড় ছাড়িবে এস, আহার প্রস্তুত।” এই বলিয়া হার্বি আমাকে উপরের একটি ঘরে লইয়া গেল।
হার্বি। যে কয়দিন এখানে থাকিবে, এই ঘরটি তোমার।
আমি। বাঃ! ঘরটি ত বেশ বড়!
হার্বি। হাঁ, ঘরটি বড় বটে। যদি রাত্রিতে একলা এত বড় ঘরে থাক্তে ভয় হয়, আমি না হয় এই ছোট বিছানায় শোব।
আমি। না, না, এখন আর আমার বড় ঘরে শুয়ে ভয় হয় না।
হার্বি। (হাসিয়া) তবে ভাল। এই ঘরে অনেক রকম কল আছে, তোমাকে দেখাইতেছি। অন্ধকার হয়ে এল, আগে গ্যাসটা জ্বালা যাক্। আমার বাড়িতে গ্যাস আপনি জ্বলে, কাহাকেও জ্বালাইতে হয় না। নিচে কতক গুলি ব্যাটারি আছে। ব্যাটারির তার সমস্ত গ্যাসের সঙ্গে যোগ আছে। এই হাড়ের হাতোলটি টিপিলেই ব্যাটারি চলিবে; একটি তার সমস্ত গ্যাসের চাবি খুলিয়া দিবে, আর এইটিতে ইলেক্ট্রিসিটি দ্বারা গ্যাস জ্বালিয়া দিবে।
এই বলিয়া হার্বি হাতোলটি টিপিল। দেখিতে দেখিতে ঘরের গ্যাসগুলি দপ্ দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। আমি অবাক্ হইয়া রহিলাম।
আমি। আচ্ছা অত উঁচুতে একটা গ্যাস কেন? হার্বি। ঐ গ্যাসের উপর যে একটি পিতলের মোটা শিক দেখিতেছ, উহা কেবল পিতলের নয়; অন্য অন্য ধাতু মিশ্রিত ও এরূপ ভাবে তৈয়ারি যে অল্প উত্তাপেই বাঁকিয়া যায়; শিকটি বাঁকিয়া—
হার্বির কথার শেষ না হইতেই একে বারে ঘরের সমস্ত খড়্ খড়ি গুলি বন্ধ হইয়া গেল। জানালার পর্দ্দা আপনি পড়িয়া গেল। আমি যেন ভৌতিক ক্রীড়া দেখিতেছি, অবাক হইয়া হার্বির দিকে চাহিলাম। হার্বি ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিতে লাগিল “ঐ শিকটি উত্তাপে বাঁকিয়া ছাতে ঠেকিয়া থাকে। ছাতে একটি টিপ্কল্ আছে, সেইটিকে টিপিয়া ধরে। খড় খড়ি খোলা থাকিলে এক রকম স্প্রীং দ্বারা আট্কান থাকে; টিপ্কল টিপিলে সেই স্প্রীং অল্গা হইয়া যায়; আর অপর স্প্রীং দ্বারা খড় খড়ি বন্ধ হইয়া পড়ে। আাবার দেখ, খড় খড়ি বন্ধ হইলেই পর্দ্দার দড়ি আল্গা হইয়া আপনি পড়িয়া যায়।
আমি। ঐ যে আর একটি হ্যাণ্ডেল রহিয়াছে ওটিও ঠিক্ গ্যাস জ্বালিবার হ্যাণ্ডেলের মতন। উহাতে আবার A লেখা আছে। ওটি কিশের?
হার্বি। A মানে এলার্ম। প্রত্যেক ঘরে ঐরূপ এক একটি জাছে। ছাতের উপর একটা প্রকাণ্ড ঘণ্টা আছে। নীচে একটি ইলেক্ট্রিক ব্যাটারির সহিত ঐ ঘণ্টার যোগ আছে। হ্যাণ্ডেল টিপিলেই ব্যাটারি চলে, আর ঘণ্টা ভয়ানক শব্দ করিয়া বাজিতে থাকে। ঘণ্টার শব্দ শুনিলেই প্রতিবাসীরা জানিতে পারে যে, কোনরূপ বিপদ ঘটিয়াছে। কিন্তু এ পর্য্যন্ত ঘণ্টার ব্যবহার হয় নাই।
এই ঘরে আর দুইটি কল আছে, ঐ যে কোণে পর্দ্দা ফেলা রহিয়াছে, উহা স্নান করিবার স্থান; উহার ভিতর, মাথার উপর খুব বড় সাওয়ারবাথ্ আছে, প্রবেশ করিলেই জল পড়িবে, কোন রূপ কল টিপিতে হইবে না। প্রাতঃকালে না হয় ঐ খানে স্নান করিও।
আমি। তাহবে এখন; আমার বোধ হয় তোমার যা কিছু কলরল এই ঘরেই শেষ করিয়াছ।
হার্বি। না ভাই, প্রত্যেক ঘরেই কিছু না কিছু আছে। আচ্ছা একবার দেখে এসদেথি কলে জল আছে কি না?
আমি। আছে, এইমাত্র জল আসিতেছে।
হার্বি। এইমাত্র আসে নাই। তুমি দেখিতে যাইবার সময় একটি টিপকল তোমার ডান পা দিয়ে মাড়াইয়াছ তাহাতেই জল আসিয়াছে, আাবার আসিবার সময় আর একটি মাড়াইবে তা হলেই কল বন্ধ হইবে।
আমি। আচ্ছা বুদ্ধি যাহ’ক। ভাবিয়া ভাবিয়া এত কাণ্ড করিয়াছ।
হার্বি। আর একটি জিনিষ এ ঘরে আছে। বিছানার কাছে এই যে তিনটি টিউব দেখিতেছ ইহা দ্বারা কথা কহা যায়। যাহাতে ১ লেখা আছে উহা অমার ঘর পর্য্যন্ত গিয়াছে, অপর দুইটি, একটি আমার ভগ্নির ঘরে ও আর একটি লিডির ঘরের সহিত যোগ আছে। শেষের দুইটি বোধ হয় তোমার কোন আবশ্যক হইবে না, তবে যদি লিডিকে সকালে চা আন্তে বল।
আমি। লিডি কে? দাসী নাকি? দেখিতে বেশ সুন্দর ত?
হার্বি। কেন দাসী হইলে কি সুন্দর হইতে নাই? কিন্তু এরি মধ্যে তোমার সেদিকে নজর পড়িয়াছে যে। দেখো, যেন কোন তামাসা করিও না, সে তামাসা বুঝে না।
আমি। ওকথা বল্লে যে? তুমি কি আমার চরিত্র জান না?
হার্বি। তোমার চরিত্র আমি বেশ জানি। তামাসা করিতেছিলাম মাত্র। এখন কাপড় ছাড়, আহার প্রস্তুত। আমিও কাপড় ছাড়িগে।
বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া মনে করিলাম একবার নল দিয়া কথা কহিয়া দেখি; ১ নম্বর নলে ফুঁ দিলাম, অপরদিক হইতে উত্তর আসিল “ব্যাপার কি,” আমি বলিলাম “আমার হইয়াছে তোমার কি বিলম্ব হবে?” “আমারও হইয়াছে, আইস।”
নীচে একটি বড় ঘরে আমরা তিন জনে আহার করিতে বসিলাম। আহারের পর মিস্ হার্বি উঠিয়া গেলেন।
হার্বি আমাকে তাহার কল কৌশল দেখাইতেছে এমন সময়ে ঘরে একটি ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল।
হার্বি। এ নিশ্চয় ডব সাহেব টেলিগ্রাফ করিতেছে। দেথি কি বলে?
কট্ কট্ কট্ কট্………
ও বলিতেছে কাল বৈকালে উহার বাড়ীতে জাহার করিতে হইবে। আমি বলি আমার এক বন্ধু আসিয়াছে।
কট্ কট্ কট্ কট্…………
ওহে তোমাকেও নিয়ে যেতে বলে; কি বল?
আমি। তা হানি কি।
কট্ কট্ কট্ কট্…………
হার্বি। তবে তাই ঠিক হইল।
ঘরে একটী পিয়েনো ছিল, হার্বি সেইটি বাজাইয়া গান গাইতে লাগিল। গান শেষ হইলে হার্বি বলিল, “এ পিয়েনোটি আপনি বাজে তা জান?
আমি। আপনি বাজে কি রকম, দম্ দিতে হয় বুঝি?
হার্বি। কিছু না। এই দেখ বাজিতে আরম্ভ হইল।
বাস্তবিক পিয়েনো বাজিয়া উঠিল। চাবিগুলি উঠিতেছে, পড়িতেছে, যেন কেহ বাজাইতেছে, অথচ নিকটে কেহই নাই। শেষে হার্বি ইহার রহস্য ভাঙ্গিয়া দিল। হার্বির বাড়ীর পাশে তাহার এক বন্ধু আছে; তাঁহারও ঠিক্ এই রকম একটি পিয়েনো আছে। সরু সরু তার দ্বারা একটীর চাবির সহিত অপরটির চাবির যোগ আছে। তারগুলি মাটির নীচে বসান আছে। একটীতে কোন গৎ বাজাইলে অপরটীতেও সেই গৎ বাজিতে থাকে।
এতক্ষণ হার্বি বাজাইতেছিল, এখন তাহার বন্ধু বাজাইতেছেন।
হার্বি। দেখ, আামি একটী বড় মজার চোর কল করিয়াছি যে, দরজা দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিতে হয়, উহাতে দুইটী পিতলের হ্যাণ্ডেল আছে। উহার সহিত একটী গ্যালভানিক ব্যাটারির যোগ আছে; যখন শয়ন করিতে যাই, একটী টীপ্কল দিয়া ব্যাটারি চালাইয়া দিই, যদি কোন চোর আসিয়া বাটীতে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করে, তা হইলেই তাহার সর্ব্বনাশ। হ্যাণ্ডেল ধরিবামাত্র তাহার সর্ব্বশরীর কাঁপিয়া উঠিবে; হাতের শিরগুলি এত অবশ হইবে যে, হাত তুলিয়া লইবার ক্ষমতা থাকিবে না, হ্যাণ্ডেল ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে। শেষে আমি আসিয়া ব্যাটারি বন্ধ করিয়া দিই।
আমি। মন্দ নয়! কিন্তু যদি তুমি টের না পাও, বোধ হর তাহাকে সমস্ত রাত্রি ঐ রূপ যন্ত্রণা পাইতে হইবে?
হার্বি। হ্যাণ্ডেল ধরিলেই আমার ঘরে একটি ঘণ্টা বাজিবে, তা হইলেই আমি টের পাইব।
রাত্রি অধিক হইল। আমরা শয়ন করিতে গেলাম। হার্বি আমার ঘরের দরজা পর্য্যন্ত আসিয়া গুড্নাইট বলিল। যাইবার সময় বলিয়া গেল “যদি কিছু আবশ্যক হয়, টীউব দিয়া, বলিয়া পাঠাইও।
শয়ন করিলাম। অল্প ক্ষণের মধ্যেই নিদ্রা আসিল। স্বপ্নে বোধ হইল যেন রেলের গাড়ি চড়িয়া কোথাও যাইতেছি। এঞ্জিনের বাঁশী বাজিতেছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। দেখি হার্বি নল দিয়া শিস্ দিতেছে; আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “খবর কি? উত্তর আসিল “বিশেষ কিছু নয়, কোন অসুখ হয় নাইত? আর বলিতেছিলাম যে প্রাতে নয়টার সময় আমরা আহার করিব।” আমি কতকটা রেগে বলিলাম “এতক্ষণ কোন অসুখ ছিল না, তুমি আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়াছ, এরূপ আর জাগাইও না।”
“এরূপ আর জাগাইও না” বলিলাম বটে কিন্তু ঘুমাইলেত জাগাইবে; ঘুম আর হয় না; অনেক ক্ষণ এপাশ ও পাশ করিলাম নিদ্রা আসিল না। ভাবিয়া স্থির করিলাম, হার্বি যেমন আমাকে জব্দ করিয়াছে, আমিও উহাকে জব্দ করি। টিউব ধরিয়া হুইসল্ বাজাইলাম, কতকটা ঘুমন্ত স্বরে উত্তর আসিল “কেন?” আমি বলিলাম “আমার আর ঘুম হইতেছে না, হয় তুমি আমার ঘরে আাইস, নতুবা আামি তোমার নিকটে যাই, তুমি আসিলেই ভাল হয়। যেমন বলিয়াছিলে, আসিয়া ছোট বিছানায় শোও।”
উত্তর। আমি! আমি তোমাকে কি বলিয়ছিলাম? পাজি, নচ্ছার, হতভাগা! তোর চরিত্র এত খারাপ! সকালে উঠিয়া হার্বিকে এবিষয় বলিয়া তোকে উচিত শাস্তি দেওয়াইব।
ও বাবা! কি সর্ব্বনাশ! ভুলে দুয়ের নম্বর টিউব দিয়া হার্বিকে ডাকিতে তাহার ভগিনিকে আসিতে বলিয়াছি! এখন উপায়! পুনরায় টিউব দিয়া বলিলাম “মেম্ সাহেব, আমার ভুল হইয়াছে, আামি তোমার ভ্রাতাকে ডাকিতে তোমাকে ডাকিয়া ফেলিয়াছি।” কোনও উত্তর নাই। আবার বলিলাম “মেম্ সাহেব, শুনিতেছ কি?” উত্তর নাই। নিশ্চয় ভয়ানক রাগ করিয়াছে, আমার আর কোন কথা শুনিবে না। চেষ্টা বিফল দেখিয়া শয্যায় শয়ন করিলাম। মনে মনে ঘৃণা যে হইল তাহা আর বলিবার নয়। কি লজ্জা! একটা ৫০ বৎসরের বুড়িকে কি না আমার কাছে শুতে ডাকিয়াছি! ইহা অপেক্ষা আমার কেন মৃত্যু হইল না? আমি যেন মনে জানিলাম যে ভ্রম ক্রমে এরূপ হইয়াছে! মিস্ হার্বির ত বিশ্বাস হইল না। সকালে মুখ দেখাই কি করে! স্থির হইতে পারিলাম না; হার্বিকে জাগাইয়া এবিষয় বলিব মনে করিয়া পুনরায় হুইসেল দিলাম, বলিলাম “দেখ, নামে ভয়ানক ভুল হইয়াছে, দুই জনে একত্রে শয়ন করিব মনে করিয়া তোমাকে ডাকিতে মিস্ হার্বিকে ডাকিয়া বসিয়াছি; তিনি কি মনে করিলেন! যাই হোক, তার আর চারা নাই, এখন তুমি শীঘ্র আমার নিকটে আইস নতুবা আমি তোমার ঘরে যাইব।”
উত্তর শুনিয়া আমার চক্ষু স্থির; আমাতে আর আমি রহিলাম না। এতো হার্বির হেঁড়ে গলা নয়, এ যে জিলের আওয়াজ; এবারে সুন্দরী লিডি চাকরাণীকে ডাকিয়াছি। সে বলিতেছে “আ মরণ তোমার, আমার ঘরে আসিবে কেন যমের বাড়ী যাও না।” আমি তাড়াতাড়ী বলিলাম “ছি ছি, রাগ করিও না, আমার কথা আগে শোন।—আমার কথা চাপা দিয়া বলিতে লাগিল “কি শুন্বো লক্ষ্মীছাড়া মিন্সে, এই কাগজ দিয়া নল বন্ধ করিলাম, আর সকল কথা সকালে বলিয়া দিয়া তোমার মুখে খ্যাংরা মারিব।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।