বিজ্ঞান দর্পণ/প্রথম খণ্ড/কার্ত্তিক ১২৮৯/রহস্য (দ্বিতীয় অধ্যায়)

রহস্য।

(পূর্ব্ব প্রকাশিতের পর।)

 চিৎপাত হইয়া বিছানায় শুইয়া পড়িলাম। এই শীতকালে কুল্ কুল্ করিয়া ঘাম হইতে লাগিল। একে ঘর অন্ধকার, আবার সমস্ত খড় খড়ি বন্ধ, যেন নিশ্বাস বন্ধ হইবার উপক্রম হইল। মারা যাই আর কি, থাকিতে পারিলাম না; খড় খড়ি খুলিব মনে করিয়া উঠিলাম। অন্ধকারে দেয়াল ধরিয়া আস্তে আস্তে যাইতে লাগিলাম; পর্দ্দায় হাত ঠেকিল, মনে করিলাম এই খানে জানালা আাছে; উঁ হুঁ, এ যে ছোট বিছানার মশারি। আাবার হাত বাড়াইয়া অগ্রসর হইলাম, দুই তিনবার চৌকিতে পা লাগিয়া “পপাত ধরণীতলে” হইবার উপক্রম হইল। একটা কিসের শব্দ হইল, ঠাওরাইয়া মনে করিলাম অন্ধকারে টিপ্‌কলে পা পড়াতে কলে জলের শব্দ হইতেছে। এইবার জানালা পাইয়াছি। পর্দ্দা সরাইয়া যেমন জানালা খুলিতে যাইব “বাবারে এ এ মাগো ও ও হি ই ই ই গেছি ই ই ই” লাফাইয়া যেমন পলাইব একখানি চৌকিতে পা লাগিয়া পড়িয়া গেলাম। এই শীতকালের রাত্রিতে বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা জল শ্রাবণের ধারার ন্যায় মস্তকে বর্ষণ হইয়াছে। জানালা মনে করিয়া সাওয়ার বাথের ভিতর ঢুকিয়াছিলাম। কাঁপিতে কাঁপিতে পোর্টমেণ্টো খুঁজিয়া আর একটী ইজের পরিলাম। লেপ মুড়ি দিয়া পুনরায় শয়ন করিলাম।

 বিছানায় শুইলাম বটে কিন্তু অন্ধকারে প্রাণ যেন আইঢাই করিতে লাগিল। ঠিক্ যেন যমযন্ত্রণা হইল। হঠাৎ মনে হইল আমি কি বোকা, অন্ধকারে এত কষ্ট পাইবার আগে যদি গ্যাস জ্বালিতাম। আর গ্যাস জ্বালিতে কষ্ট নাই, হাতোলটা টিপিলেই হইবে।

 পুনরায় উঠিয়া খুঁজিয়া খুঁজিযা হাতোলটি টিপিলাম। কই গ্যাস জ্বলিল না? ও আবার কি? এতরাত্রে ঘণ্টা বাজে কেন? ঐ যা, গ্যাশ জ্বালিতে এলার্ম ঘণ্টা বাজাইয়া দিয়াছি। সর্ব্বনাশ করিয়াছি, ছাদের উপর ভয়ানক শব্দ করিয়া ঘণ্টা বাজিতেছে; এখনি পাড়ার লোক ছুটিয়া আসিবে। কি করি, শব্দ থামাইবার উপায় জানি না। দৌড়িয়া হার্বির ঘরে যাই। এ ভিন্ন আর উপায় নাই; নল দিয়া কথা কহা, সেকাজ এ প্রাণ থাকিতে হইবে না। তাড়াতাড়ি যেমন যাইব, একটী টেবিলের উপর নানাবিধ খেলানা সাজান ছিল, ধাক্কা লাগিয়া সমস্ত হুড়মুড় করিয়া উল্টাইয়া পড়িল। এমম সময় হার্বি আসিয়া পড়িল।

 হার্বি।—কি হইয়াছে, ব্যাপার কি?

 আমি। আগে ভাই তোমার ঘণ্টাটা থামাও, তারপর বলিতেছি।

 হার্বি। এই নাও ঘণ্টা থামিয়াছে, এখন নিচে যাই, পাড়ার লোক সব উঠিয়া টেলিগ্রাফ করিতেছে, তাহাদের বুঝাইয়া আসি।

 হার্বি টেলিগ্রাফ দ্বারা সকলকে বলিয়া আসিল, ভ্রমক্রমে এরূপ হইয়াছে; বাস্তবিক কোন বিপদ ঘটে নাই। আসিয়া গ্যাস জ্বালিয়া দিল।

 আমি। ভাই কিছু মনে করিও না, অন্ধকারে কেমন ঘুম হইল না, গ্যাস জ্বালিতে গিয়া এই কাণ্ড করিয়াছি।

 হার্বি। তার আর কি হইবে। এখন আমি শুইগে, দেখ, আমার জামা গায়ে দিবার সাবকাশ হয় নাই, শশব্যস্তে ছুটিয়া আসিয়াছি। বড় শীত ভাই পলাই।

 আমি। দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমার আর একটা কথা আছে। আমি আর এক বিপদে পড়িয়াছিলাম। টিউব দিয়া তোমাকে ডাকিতে গিয়া মিশ হার্বিকে ডাকাতে তিনি—

 হার্বি। থাক্, থাক্, সেকথা কাল শুনবো। তার জন্য ভাবনা কিসের? কাল সব ঠিক হইয়া যাইবে। আমি যাই।

 হার্বি চলিয়া গেল, আমার সব কথা বলা হইল না। সকালে মুখ দেখান ভার হইবে। এস্থান হইতে যদি কোন প্রকারে পলাইতে পারিতাম। ভাবিলাম না পারিই বা কেন? ঘড়িতে সবে ৪টা বাজিয়াছে, যদি যাইতে হয় ত এই সময় যাওয়াই ভাল। একটু পরেই লিডি নিশ্চয়ই উঠিবে, তাহার সহিত দেখা করা হইবে না। সঙ্গে রেলওয়ে গাইড ছিল দেখিলাম ৫টার সময় একখানি গাড়ি লণ্ডনে যাইবে। তাহ’লে এই বেলা যাওয়াই শ্রেয়। ছোট পোর্টমেণ্টোটা সচ্ছন্দে হাতে করিয়া লইয়া যাইতে পারিব।

 একখানি কাগজে লিখিলাম “আমি না বলিয়া চলিয়া গেলাম, কিছু মনে করিও না; আমার সম্বন্ধে যদি কেহ কিছু বলে, সে সব মিথ্যা জানিবে। লণ্ডনে যাইয়া সমস্ত বিষয় পত্র দ্বারা জানাইব।”

 টেবিলের উপর কাগজখানি রাখিয়া আস্তে আস্তে দরজা খুলিয়া বুট জোড়াটী হাতে করিয়া সিঁড়িতে নামিলাম। নিচে আসিয়া বুট পায়ে দিলাম। সম্মুখেই দরজা। দরজার ভিতর দিকে ভাল সবুজ সাটিনের পর্দ্দা। সরাইয়া দরজা ঠেলিলাম; বন্ধ; হ্যাণ্ডেল ঘুরাইলে খুলিতে পারে ভাবিয়া যেমন হ্যাণ্ডেল ধরিলাম—আ আ আ আ উ উ উ খুউন খুউউন। হার্বির চোর কলে পড়িয়াছি। দক্ষিণ হস্ত দ্বারা হ্যাণ্ডেল ধরিয়াছিলাম। উহাও আমার হস্তকে উত্তমরূপে ধরিয়াছিল। আমি ছাড়িলে সে ছাড়ে না। পোর্টমেণ্টো ফেলিয়া বামহস্ত দ্বারা দক্ষিণ হস্ত উঠাইতে গিয়া দুটী হাতই তাহাতে লাগিয়া গেল। কেবল হাতের যন্ত্রণা হইলে রক্ষা ছিল। সমস্ত শরীর তাড়িত বেগে (Galvanic shock) অস্থির।

 হঠাৎ কাঁপুনি থামিল; নিকটে একখানি চেয়ারে ধপাস করিয়া, বসিয়া পড়িলাম। সম্মুখেই হার্বি; সে আমার যন্ত্রণা দেখিয়া অপ্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “কিরূপে চোর কলে আাসিয়া পড়িলে” হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিলাম “বাড়ী যাইতেছিলাম; সমস্ত রাত্রি যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করিয়াছি, শেষে কষ্টের ধাড়ি পাইয়াছি। উঃ! ইহাতে আমাকে আধমরা করিয়াছে। এখন দরজা খুলিয়া দাও, আামি চলিয়া যাই।

 হার্বি। বিলক্ষণ; এস উপরে এস; যাবে কোথা?

 আামি। না, আমি থাকিব না, আমি নিশ্চয়ই যাইব। তোমার যে বাড়ী, এদিকে নল ওদিকে টিপকল, সেদিকে ব্যাটারি, সেখানে তার, মাথায় ঘণ্টা, যেন ভূতের আড্ডা। এখানে কি ভদ্রলোকে থাকিতে পারে। খোল দরজা খোল আামি যাই। আবার কি ট্রেণ ফেল হ’ব।

 হার্বি। নেহাত যাইবে? তবে দাঁড়াও সহিসকে গাড়ি তৈয়ার করিতে বলি, আমি তোমাকে ষ্টেসনে রাখিয়া আসিব। ততক্ষণ লিডিকে কিছু খাবার আানিতে বলি। সে এতক্ষণ উঠিয়াছে।

 এতক্ষণ কড়া কড়া কথা বলিতেছিলাম, লিডির নাম শুনিয়া হৃৎকম্প হইল। বলিলাম “না, না, খাবার কাজ নাই। আমি এই চলিলাম, গুড্‌বাই”।

 হার্বি। সে কিহে, পাঁচ মিনিট দাঁড়াইতে পার না?

 আামি। না ভাই মাপ কর, তার উঠিবার আগেই আমি চলিলাম, গুডবাই, গুডবাই।

 হার্বি। তবে এক মিনিট দাঁড়াও, আমি কাপড় ছাড়িয়া আদি, তোমার সঙ্গে যাইব। আমি। না ভাই, তোমার পায়ে পড়ি—

 এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হইল। আর দাঁড়াই, গুডবায় বলিয়াই দৌড়। ফটক পর্য্যন্ত দ্রুত আসিয়া মনে পড়িল এখানেও কি কেমন তার তোর আছে। পিছনে চাহিয়া দেখিলান হার্বি দাঁড়াইয়া। উচ্চৈস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম “কেমন হে, এখানে কোন রকম কষ্ট আছে?

 হার্বি। কষ্ট আবার কি। কোনও ভয় নাই।

 আামি। কোন রকম টিপ্‌কল নাই?

 হার্বি। না, না, তুমি সচ্ছন্দে যাও।

 পা দিয়া দরজা খুলিলাম। হাত দিলাম না। পাছে দরজা গায়ে ঠেকে, সাবধানে বাহির হইলাম।

 রাস্তায় আসিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলাম। ধড়ে যেন প্রাণ আাসিল।

 যথা সময়ে লণ্ডনে আাসিয়া পঁহুছিলাম। এখন আর আমার হুইস্কার নাই।

 দুই দিন পরে হার্বির এক পত্র পাইলাম। যদিও তামাসা করিয়া লিখিয়াছে তথাপি পড়িয়া আমার রাগ হইল। পত্রের কিয়দংশ এইরূপ—ছি, ছি, লিডির ঘরে যাইতে চেষ্টা করিয়াছিলে। ভাল কর নাই। ভদ্রলোক হইয়া দাসীর প্রতি ওরূপ ব্যবহার অতি ঘৃণার্হ। বিশেষ, বন্ধু বান্ধবের ভিতর ওরূপ চরিত্রের লোক হইলে বড় দুঃখ হয়।

 পত্রখানি খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলাম। প্রত্যুত্তর লিখিলাম না।

 কিছু দিন পরে হার্বি স্বয়ং আসিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করাতে পুনরায় তাহার সহিত আলাপ করিয়াছি, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিয়াছি আর তাহার বাড়ী যাইব না। দেখি বাঙ্গালীর প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয় কি না। শ্রীহেমলাল দত্ত।