বিদায়-আরতি/দূরের পাল্লা
দূরের পাল্লা
ছিপ্ খান্ তিন্-দাঁড় —
তিনজন্ মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল,—জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নগর টাঁকশাল।
কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ চর জাগ্ছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলার ঢাক্ছে।
চুপ চুপ—ওই ডুব
দ্যায় পানকৌটি,
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোম্টার বউটি।
ঝক্ঝক্ কলসীর
বক্বক্ শোন্ গো,
ঘোম্টায় ফাঁক বয়
মন উন্মন্ গো।
তিন-দাঁড় ছিপখান্
মন্থর যাচ্ছে,
তিন জন মাল্লায়
কোন্ গান গাচ্ছে?
* * *
রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধূপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি।
মুখখানি মিষ্টি বে
চোখদুটি ভোম্রা
ভাব-কদমের—ভরা
রূপ দ্যাখো তোমরা!
ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হ’ল গোখ্রী!
ডাক পাখী ওর লাগি’
ডাক্ ডেকে হদ্দ,
ওর তরে সোঁত-জলে
ফুল ফোটে পদ্ম।
ওর তরে মন্থরে
নদ হেথ চল্ছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোল্ছে।
দুই তীরে গ্রামগুলি
ওর জয়ই গাইছে,
গঞ্জে যে নৌকা সে
ওর মুখই চাইছে।
আট্কেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পশ
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ।
পান বিনে ঠোট রাঙা
চোখ কালো ভোমরা,
রূপশালি- ধান-ভান।
রূপ দ্যাখো তোমরা।
* * *
পান সুপারি! পান সুপারি!
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেই শীর্ণি মেনে
চল্ রে টেনে বইঠা হেনে;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইঠা হানো—
সাত সতেরো কোপ কোপানে।
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো
নাচ্তেছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থম্কে গেল।
জম্জমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এল রাত্রি এল।
ঝাপ্সা আলোয় চরের ভিতে
ফির্ছে কারা মাছেয় পাছে,
পীর বদরের কুদ্রতিতে
নৌকো বাধা হিজল-গাছে।
* * *
আর জোর দেড় ক্রোশ—
জোর দেড় ঘণ্টা,
টান্ ভাই টান্ সব—
নেই উৎকণ্ঠা
চাপ্ চাপ্ শ্যাওলার
দ্বীপ সব সার সার,—
বৈঠার ঘায় সেই
দ্বীপ সব নড়ছে,
ভিল্ভিলে হাঁস তার
জল-গায় চড়্ছে।
ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সম্ঝে,
গাও গান, দাও শিশ্
বকশিশ্! বকশিশ্
খুব জোর ডুব্-জল,
বয় স্রোত, ঝির্ঝির্,
নেই ঢেউ কল্লোল,
নয় দুব নয় তীর।
নেষ্ট নেই শঙ্কা
চল সব ফুর্ত্তি,—
বক্শিশ্ টঙ্কা,
বক্শিশ্ ফুর্ত্তি।
ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
ঝাউ-গাছ দুলছে,
ঢোল্-কলমীর ফুল
তন্দ্রায় ঢুলছে।
লক্লক্ শর বন
বক্ তায় মগ্ন,
চুপ্চাপ চারদিক্—
সন্ধ্যার লগ্ন।
চারদিক্ নিঃসাড়,
ঘোর-ঘোর রাত্রি,
ছিপ্-খান তিন্-দাঁড়,
চারজন যাত্রী।
* * *
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে,
ঝাউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝির গানে—
স্বপন পানে পরাণ টানে।
তারায় ভরা আকাশ ওকি
ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
লুটিয়ে প’ল আচম্বিতে
কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে!
* * *
কেবল তারা! কেবল তারা!
শেষের শিরে মাণিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি।
কোথায় এল নৌকোখানা
তারার ঝড়ে হই রে কাণা,
পথ ভুলে কি এই তিমিরে
নৌকো চলে আকাশ চিরে।
জ্বলছে তারা, নিবছে তারা—
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়
জোনাক যেন পন্থা-হারা।
তারায় আজি ঝামর হাওয়া
ঝামর আজি আঁধার রাতি,
অগুন্তি অফুরান্ তারা
জ্বালায় যেন জোনাক্-বাতি॥
কালো নদীর তুই কিনারে
কল্পতরুর কুঞ্জ কি রে?—
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে—
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে।
বিনা হগওয়ায় ঝিলমিলিয়ে
পাপ্ড়ি মেলে মাণিক-মালা;
বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে
ফুল পড়িছে জোনাক-জ্বালা।
চোখে কেমন লাগ্ছে ধাঁধা—
লাগ্ছে যেন কেমন পারা,
তারাগুলোই জোনাক হল
কিম্বা জোনাক হল তারা।
নিথর জলে নিজের ছায়া
দেখ্ছে আকাশ-ভরা তারায়,
ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
জলে জোনাক দিশে হারায়।
দিশে হারায়, যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে?—
মরা গাঙ অণর সুর-সরিৎ
এক হয়ে যেথায় মেশে রে!
কোথায় তারা ফুরিয়েছে, তার
জোনাক কোথা হয় সুরু যে
নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
চোখ যে আলী রতন উছে।
* * *
আলেয়াগুলো দপ্দপিয়ে
জ্বল্ছে নিবে, নিব্ছে জ্বলে,
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাট্ছে বাতাস আকাশ-কোলে!
আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
একলা ছোটে বন বাদাড়ে
ল্যাম্পো-হাতে লক্ড়ি-ঘাড়ে;
সাপ মানে না, বাঘ জানে না,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুট্ছে চিঠি পত্র নিয়ে
বণ্রণিয়ে হন্নিয়ে।
বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
জাগ্ছে হাওয়া জলের ধারে,
চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে!
শুক্তারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচ্কিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ্ চলেছে নিঝুম স্রোতে।
ফির্ছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
মাল্লা মাঝি পড়ছে থ’কে;
রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
ধর্ছে কারা মাছগুলোকে।
চল্ছে তরী চল্চে তরী—
আর কত পথ? আর ক’ঘড়ি?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি—
ওই বাঁধা-বট ওর পিছনে
দেখ্ছ আলো? ঐ তো কুঠি,
ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
রাতের মতন আজ্কে ছুটি।
ঝপ্ ঝপ্ তিনখান্
দাড় জোর চল্ছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বল্ছে;
গুর্গুর্ মেঘ সব
গায় মেঘ-মল্লার,
দূর-পাল্লার শেষ
হাল্লাক্ মাল্লার!