বিদায়-আরতি/নীরব নিবেদন
নীরব নিবেদন
(বিশ্ববরেণ্য শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয সমীপে)
আজ নীরবে যাব প্রণাম ক’রে
একটু শুধু নিয়ে পায়ের ধূলো,
সঁপে মোদের প্রাণের অর্ঘ্য, কবি,
বল্ব নাকো বাক্য কতকগুলো!
বাক্য যে আজ শুধুই জ্বালার মালা,
হৃদয় সে যে রুদ্ধ ব্যথার ডালি;
মৌন মুখে তাই তোমারে দেখি
তিরিশ কোটির নয়ন দিয়ে খালি।
শঙ্কামূঢ় স্বদেশবাসীর পাশে
দেখি তোমায় আত্ম-বোধের ঋষ!
অভিচারের মন্ত্রে যখন ঘোলা
আকাশ জুড়ে নামে আকাল নিশি;—
জগৎ যখন নিচ্ছে বিভাগ ক’রে
মারণ এবং উচ্চাটনে মিলে,
সে সঙ্কটে সত্য-অনুরাগী
আত্ম-প্রদ মন্ত্র তুমি দিলে।
আত্মনিষ্ঠ মানুষ স্বয়ম্প্রভু,
মন ব’লে তার একটা মহাল আছে,—
ভয়ঙ্করের ভোজবাজীতে কভু
খাজ্না আদায় হয় না কো তার কাছে!
সেই মহালের খবর তুমি দিলে,
সূর্য্য জাগে তোমার তূর্য্য রবে;
মানুষ ব’লেই প্রাপ্য যে মর্য্যাদা
সে মর্য্যাদা পেতে হবেই হবে।
গুমোট রাতে আসঙ্কোচের হাওয়া
জাগ্ল—উষার নিশাসটুকুর মত,
নাগালে বৈকুণ্ঠ বুঝি এল—
তোমার পুণ্যে কুণ্ঠা হ’ল হত।
সত্য কথা সত্যযুগের কথা,
কলিযুগে চার্দিকে তার ঘাঁটি,
কলির মানুষ আমরা—ভাবি মনে
কামান যা’ কয় সেই কথাটাই খাঁটি।
গোলন্দাজের গোলা যে বোল্ বলে
সেই বুলিটাই বুঝি চরম বল,
আজ দিয়েছ তুমি সে ভুল ভেঙে
তিরিশ কোটির ঘুচিয়ে মনের মলা!
অপ্রমত্ত তোমার সরস্বতী
ভূভারতে দান করে আজ ভাষা,
সঞ্চারে বল আত্মাতে আত্মাতে,
বাক্যে মনে সত্য হবার আশা।
সাঁচার আদর জাগ্ছে তোমায় হেরে
মিথ্যাচারের মহাজনির হাটে,
কুষ্ঠিত দীন মনের উপর থেকে
ভ্রূকুটিময় মেঘ্লা বুঝি কাটে।
জীবন যাদের অসম্মানের বোঝা,
তলিয়ে যারা আছে অবজ্ঞাতে,
ইচ্ছা করার সহজ শক্তিটুকু
লুপ্ত যেন পঙ্গু পক্ষাঘাতে,
তাদের তুমি মুখ রেখেছ, কবি,
হাল্কা ক’রে দিয়েছ ঢের লাজে,
সবার দুখের ভাগ নিয়ে স্বেচ্ছাতে
তক্মা ছেড়ে এসে সবার মাঝে।
সারা ভরত ঋদ্ধ তোমার ত্যাগে,
ঘূচ্ল এবার টুট্ল মনের জরা,
তিরিশ কোটির প্রাণের স্পন্দ, কবি,
তোমার প্রাণের ছন্দে প’ল ধরা।