বিদায়-আরতি/বর্ষ-বোধন
বর্ষ-বোধন
তোমার নামে নোয়াই মাথা ওগো অনাম! অনির্ব্বচনীয়!
প্রণাম করি হে পূর্ণ-কল্যাণ!
প্রভাত পেলে যে প্রভা আজ, সেই প্রভা দাও প্রাণে আমার প্রিয়,
আলোয় জাগো সকল-আলোর-ধ্যান!
সন্দেহী সে ভাবছে—তোমার অব্যাহত কল্যাণেরি ধারা
বন্ধুরতায় বিফল নরলোকে,
চর্ম্মচোখের আর্শী হ’তে দিনে দিনে যাচ্ছে ঝ’রে পারা,
এবার জ্যোতি জাগাও মনের চোখে।
বীভৎস দুঃস্বপ্ন-ভরে বিশ্ব-হৃদয় উঠছে মুহু কেঁপে,
হাস্ছে যেন ভৈরবী ভৈরবে;
ভয়ের মেঘে ঝাপসা আকাশ, ভয়ের ছায়া সূর্য্যেরে রয় চেপে,
সে ভয় প্রভু! হরে ‘মা ভৈঃ’ রবে।
প্রীতি-শীতল এই পৃথিবী প্রেত-শিল হয় যাদের উপদ্রবে,
রুদ্র-রূপে তাদের কর নত;
দম্ভাসুরের দন্ত কাড়ো, মুখে-মধু কৈতবে—কৈটভে—
মাটির তলে পাঠাও কীটের মত।
রাজ-বিভূতি তোমার শুধু, বিশ্বধাতা! তিন ভুবনের রাজ!
ইঙ্গিতে যার জগৎ মরে বাঁচে;
মৃত্যু যাদের কর্বে ধূলো, বিড়ম্বনা তাদের রাজা সাজা,
পোকার-খোরাক তোমার আসন যাচে!
মানুষ সাজে বজ্রধারী, তোমার বজ্রদণ্ড নকল ক’রে,
স্পর্দ্ধাভরে পূজার করে দাবী।
জীয়ন্-কাঠির খোঁজ রাখে না, হয় ভগবান মরুণ-কাঠি ধ’রে,
দেবের ভোজো মুখ দিয়ে খায় খাবি।
যায় ভুলে সাম্রাজ্য-মাতাল কোথায় মিশর, কোথায় আসুরিয়া,
খাল্দি, তাতার, রোম সে কোথায় আজ,
কই বাবিলন, আরব, ইরাণ? কই মাসিডন, রয় কিনা রয় জীয়া
রখ-পাখীদের জরদগবের সাজ!
কই ভারতের বরুণ-ছত্র—দিগ্বিজয়ীর সাগর-জয়ের স্মৃতি?
মহাসোনা সুখত্রা আজ কার?
যব, শ্রীবিজয়, সমুদ্রিকা, বরুণিকা কাদের বাড়ায় প্রীতি?
সিংহলে কার জয়ের অহঙ্কার?
প’ড়ে আছে অচিন দ্বীপে হিস্পানীয়ার দর্প-দেহের খোলা—
ঝাঁজরা জাহাজ তিমির পাঁজর হেন,
পর্তুগীজের সমান ভাগে গোল পৃথিবীর নিলে যে আধ-গোল
ফিলিপিনায় পিন পুঁতে ঠিক যেন।
কোথায় মায়ারাষ্ট্র বিপুল মাওরি-পেরু-লঙ্কা-মিশর-জোড়া?
ছায়ার দেশে বুঝি স্বপন-রূপে?
হারিয়ে গতি ধাবন-ব্রতী ময়দানবের সিন্ধুচারী ঘোড়া
বাড়ব-শিখায় নিশাস ফেলে চুপে।
আজি বরষের নূতন প্রাতে আলোক-পাতে প্রাণ করে প্রার্থনা—
ওগো প্রভু! ওগো জগৎ-স্বামী!—
প্রণব-গানে নিখিল প্রাণে নবীন যুগেব কর প্রবর্ত্তনা,
জ্যোতির রূপে চিত্তে এস নামি’।
সকল প্রাণে জাগুক রাজা; যাক্ রাজাদের রাজাগিরির নেশা;
জগৎ জয়ের যাক্ থেমে তাণ্ডব,
ঘুচাও হে দেব! নিঃশেষে এই মানুষ জাতির মানুষ-পেষণ পেশা,
চিরতরে হোক্ সে অসম্ভব।
দেশ-বিদেশে শুনছি কেবল রোজ রাজাসন পড়ছে খালি হ’য়ে,
সে-সব আসন দখল কর তুমি,
মালিক! তোমার রাজধানী হোক সকল মুলুক এ বিশ্বনিলয়ে,
সত্যি সনাথ হোক এ মর্ত্তভূমি।
তোমার নামে মুইয়ে মাথা, অভয়-দাতা! দাঁড়াক জগৎ-প্রজা
ঋজু হ’য়ে তোমার আশীর্ব্বাদে,
তোমার যারা নকল, রাজা! তাদের সাজা আস্ছে নেমে সোজা
যুগান্তেরি ভীষণ বজনাদে।
অমঙ্গলের ভুজগ-ফণায় মঙ্গলেরি জ্বল্ছে মহামণি
কয় মোরে এই বিভাত-বেলার বিভা;
বিভাবরীর নাই আয়ু আর, বিমল বায়ু বলছে মুকুল গণি’—
কমল-বনে আসছে নবীন দিবা!