বিদায়-আরতি/সর্ব্বদমন
সর্ব্বদমন
আদি-সম্রাট্ সর্ব্বদমন—
পুরাণেতে যাঁরে ভরত বলে,
যাঁর. নামে সারা ভারতবর্ষ
আজো পরিচিত ভূমণ্ডলে,
শৈশবকালে খেলা ছিল যাঁর
সিংহের দাঁত গণিয়া দ্যাখা,
প্রতিভার বলে আর্য্য-দ্রাবিড়
নিবিড় ক’রে যে বাঁধিল একা,
গঙ্গা-যমুনা-সিন্ধু-কাবেরী
অভিষেক-বারি দিল যে ভূপে,
হিমালয় হ’তে মলয়-নিলয়
অঙ্কিত যাঁর যজ্ঞ-যুপে,
দীর্ঘতমার প্রাণের স্বপন
সত্য করিল যে মহামনা,
তাঁর ছেলে হ’ল কুল-কজ্জল!
হায়! বিধাতার বিড়ম্বনা!
আর্য্য শবর সবণর ভরণে
লভিলেন যিনি ভরত নাম,
তার ছেলে হ’ল প্রকৃতি-রুক্ষ,
পীড়নে দক্ষ, পালনে বাম!
সসাগরা নব-খণ্ড মেদিনী
পদতলে, তবু রাজা ও রাণী
অসুখে কাটান দিবস যামিনী
রাজ্য কীর্ত্তি বিফল মানি’।
স্তিমিত প্রদীপে তৈল টোপায়
মণি-ময়ূরের চঞ্চু দিয়া,
স্খলিত-বচন সর্ব্বদমন
মহিষীরে কন ক্ষুব্ধ-হিয়—
“বড় সাধ ক’রে পুত্রের, রাণী!
নাম রেখেছিলে ভুবনমণি,
নিখিল প্রজার মন্যু কুড়ায়ে
আজ সে ভুবন-মন্যু গণি।
অন্ধ-আতুরে কশাঘাত করে
শৈশব হতে এমনি রীতি,
দৃঢ়তার চেয়ে রূঢ়তা প্রবল,
যুবরাজ হয়ে পীড়িছে ক্ষিতি।
কোথা হ’তে ক্রুর এল এ অসুর
তোমার গর্ভে, হায়, মহিষী,
চণ্ডাল-পনা সব কাজে ওর,
আসে অভিযোগ দিবস-নিশি।
নিখিল প্রজার ওঠে হাহাকার—
কত আর শুনি, কত বা হেরি,
শুধু কলঙ্ক—কেবল পঙ্ক
ওরে ঘিরে যেন হয়েছে ঢেরি!
বেতালের মতো চিত্ত উহার
নিষ্ঠুরতায় নৃত্য করে
ক্ষত্রিয় হ’য়ে খড়গ হানে ও
ক্ষমা-ভিখারীর কণ্ঠ ‘পরে।
বিধাতার ও যে করে অপমান,
রাজার বাড়ায় পণপের বোঝা,
শক্রপুরীর কূপে বিষ দিয়ে
জয়ের রাস্তা করে ও সোজা!
তলোয়ার চেয়ে খুনীর ছোরায়
আস্থা উহার দেখি জেয়াদা,
এ যে অকার্য্য, এ যে অনার্য্য,
এ যে ধর্ম্মের অমর্য্যাদা।
নাম নিতে চায় অতি সস্তায়
যুদ্ধ না ক’রে হত্যা ক’রে,
পিতা আমি ক্ষমা অনেক করেছি,
রাজা আমি দিব শাস্তি ওরে।
রক্ষা-বেতন করিয়া গ্রহণ
সাজা দিতে কত করিব দেরী?—
দেশের ইচ্ছা—দশের ইচ্ছা—
ইচ্ছা সে জগদীশ্বরেরি।
মহিষী! সে মুঢ়ে এনেছি প্রাসাদে—
নিকটে নজর-বন্দী আছে;
পীযূষ পিয়েছে যার কাছে, আজ
বিষ পিষে সেই তাহারি কাছে।
স্থির হও,... ওকি? দৃঢ় কর মন,...
ছেলে সে আমারে,... দ্যাখো আমারে,...
গুপ্ত হত্যা করিতে না কহি
বিষ ব’লে বিষ পিয়াবে তারে।
কুৎসিত এই অঙ্গের ব্রণ—
মমতা কোরে না অস্ত্রাঘাতে;
কুশ্রী করেছে সুনাম মোদের
কুশ্রী করেছে মানুষ-জাতে।
সেই সন্তান—শতদিকে যেই
ত্রি-কুলের খ্যাতি বাড়ায়ে তোলে,
নিন্দা-পঙ্কে ডোবায় যে নাম
তারে মানিবে কে পুত্র ব’লে?
দ্বিজাতি ক্ষত্র; দ্বিতীয় জন্ম
লভে সে ধর্ম্ম যুদ্ধ ক’রে;
বীরে ও খুনীতে ভেদ যে মানে না
ঠাই নাই তার দুনিয়া-ভোবে।
ঘৃণ্য সেজন কর্কশা-মন
কৃপায় কৃপণ কৃপাণ-পাণি,
কৃপা ক’রে তার দণ্ডের ভার
তোমার হস্তে দিতেছি রাণী!
দয়া করিয়াছি তোমার পুত্রে—
বধ্য মঞ্চে যাব না নিয়ে,
যে হাতে খেয়েছে প্রথম অন্ন
শেষ খাওয়া খাবে তাতেই, প্রিয়ে
ক্ষমা করিব না—মিনতি কোরো না—
ক্ষমার সীমার গেছে বাহিরে,
ক্ষমা যদি করি, সকল পুণ্য
এ রাহু করিরে গ্রাস অচিরে।
জীবনের ধারণ ম্লান করে যাঁরা
তাদেরি লাগিয়া দণ্ড ধরি,
ভয় করি মনুষ্যত্ব-লোপের,
বংশ-লোপের ভয় না করি।
ন্যায় মর্য্যাদা রাখিব অটুট,
বিচার করিব সুদৃঢ় মনে,
রাজ্য দূষিত হইতে না দিব
রাজার দেহের দুষ্ট ব্রণে।
প্রাণের উৎসে দিয়ে যে গরল
অনেক প্রাণের করিল হানি,
ভুল ক’রে তারে দিয়েছ পীযুষ,
সে ভুল ঘুচাও গরল দানি’।”
সহসা উঠিয়া সর্ব্বদমন,
ধবলিম রুদ্রাক্ষ হেন—
শঙ্খে তুলিল সঙ্কেতসুর;
রাণী নির্ব্বাক্, প্রতিমা যেন।
ইঙ্গিতে এল অভাগা পুত্র
ভুবন-মন্যু, প্রহরী সাথে;
ইঙ্গিতে এল বিষের পাত্র —
মা দিবে যে বিষ ছেলের হাতে।
বিষের পাত্র হাতে নিয়ে রাণী
বারেক চাহিল স্বামীর পানে;
নিশ্চল রাজা নিয়তির মত—
অমোঘ নিদেশ নীরবে দানে।
“পান কর, বাছা, কর্ম্মের ফল”
বিকৃত কণ্ঠে কহিল রাণী,
জননীর দান নিল যুবরাজ
অবিকৃত মুখে যুক্ত-পাণি।
বারেক হানিল বজ্র-চাহনি,
বারেক বাঁকিল অধর ভুরু,
তার পর মুখ মৃত্যু-পাংশু—
মরণের আগে মরণ-সুরু;
অধরের পুটে নিল কালকূট,
রাণী দেখে সব ধোঁয়ায় মেশে—
বিদ্যুৎ-ছুরি চেতনার ভুরি
কাটিল সহসা বজ্র হেসে।
গরলের কাজ করিল গরল,
বিচারক পিতা দেখিল চোখে,
মহিষীর অণর সংজ্ঞা হ’ল না
টুটেছে জীবন চণ্ড শোকে।
সে দিন হইতে কেহ কোনোদিন
হাসি দেখে নাই রাজার মুখে,
সংসার-সাধ হ’য়ে গেল বাদ,
আত্ম-প্রসাদ রহিল বুকে।
গেছে কত যুগ, কত দুখ সুখ,
নাই সে সর্ব্বদমন রাজা,
লুপ্ত বংশ, নাম আছে তবু
ন্যায়-ধরমের স্বর্গে তাজা।