বিদায়-আরতি/সেবা-সাম

সেবা-সাম

আলগ্‌ হ’য়ে আল্‌গোছে কে আছিস্‌ জগতে—
জগন্নাথের ডাক এসেছে আবার মরতে।
তফাৎ হ’য়ে তফাৎ ক’রে নাইক মহত্ত্ব,
দশের সেবায় শূদ্র হওয়াই পরম দ্বিজত্ব!
পিছিয়ে যারা পড়ছে তাদের ধ’রে নে ভাই হাত,
মিলিয়ে নেব কণ্ঠ আবার চল্‌ব সাথে সাথ,
জগন্নাথের রথ চলেছে, জগতে জয় জয়,—
একটি কণ্ঠ থাক্‌লে নীরব অঙ্গহানি হয়;
সাথের সাথী পিছিয়ে রবে,—কাঁদবে নাকি মন?
এমন শোভাযাত্রা যে হায় ঠেক্‌বে আশোভন।

 *   *   *

চিত্তময়ী তিলোত্তম ভাবাত্মিকা মোর,
মর্ত্তে এস নন্দনেরি নিয়ে স্বপন-ঘোর;
তোমার আঁখির আমল আভায় ফুটাও অন্ধ চোখ
আদর্শেরি দর্শনেতে জনম সফল হোক্‌।
জাগ কবির মানসরূপে বিশ্ব-মনস্কাম,—
সর্ব্বভুতে আত্মবোধে মহান্‌ সেবাসাম।

 *   *   *

এক অরূপের অঙ্গ মোরা লিপ্ত পরস্পর,—
নাড়ীর যোগে যুক্ত আছি নইক স্বতন্তর;
একটু কোথাও বাজলে বেদন বাজে সকল গায়,
পায়ের নখের ব্যথায় মাথার টনক ন’ড়ে যায়;
ভিন্ন হ’য়ে থাক্‌ব কি, হায়, মন মানে না বুঝ,—
ছিন্ন হ’য়ে বাঁচতে নারি,—নই রে পুরুভুজ।

 *   *   *

তফাৎ থেকে হিতের সাধন মোদের ধারা নয়,
ভিক্ষা দেওয়ার মতন দেওয়ায় ভর্‌বে না হৃদয়,
অনুগ্রহের পায়সে কেউ ঘেঁস্‌বে না গন্ধে,
আপন জেনে ক্ষুদ্‌ কুঁড়া দাও খাবে আনন্দে।
পরকে আপন জান্‌তে হবে, ভুল্‌তে আপন পর,—
অগাধ স্নেহ অসীম ধৈর্য্য অটুট নিরন্তর।
পিতার দৃঢ় ধৈর্য্য, মাতার গভীর মমতা
প্রত্যেকেরি মধ্যে মোদের পায় গো সমতা;
পিতার ধৈর্য্য মানব-সেবা কর্‌ব প্রতিদিন,
মাতার স্নেহ বিশ্বে দিয়ে শুধব মাতৃঋণ।

 *   *   *

দীপ্তিহারা দীপ নিয়ে কে?—মুখটি মলিন গো!
চক্‌মকি কার হাতে আছে?— জাগাও ফুলিঙ্গ,—
জাগাও শিখা—সঙ্গীর সব মশাল জেলে নিক্‌,
এক-প্রদীপের প্রবর্ত্তনায় হোক আলো দশদিক্‌।
এক প্রদীপে দিকে দিকে সোনা ফলাবে,
একটি ধারা মরু-ভূমির মরম গলাবে।

 *   *   *

সত্য সাধক! এগিয়ে এস জ্ঞানের পূজারী,
অজ্ঞমনের অন্ধগুহায় আলোক বিথারি’।
শিল্পী। কবি! সুন্দরেরি জাগাও সুষমা,—
অশোভনের আভাস — হ’তে দিয়ে না জমা।
কর্ম্মী। আনো সুধার কলস সিন্ধু মথিয়া।
দুঃস্থ জনে সুস্থ কর আনন্দ দিয়া।
সুখী! তোমার সুখের ছবি পূর্ণ হ’তে দাও,
দুখী-হিয়ার দুঃখ হর হরফ যদি চাও।
নইলে মিছে শ্মশানে আর বাজিয়ে ন বাঁশী,
হেস না ঐ অর্থবিহীন বীভৎস হাসি।
এস ওঝা! ভূতের বোঝা নামাও এবারে,
নিজের রুগ্ন অঙ্গ জেনে রোগীর সেবা রে।
জীবনে হোক্‌ সফল নব ত্রিবিদ্যা-সাধন,—
সহজ সেবা, সরল প্রীতি, চিত্ত-প্রসাধন।

 *  *  *

বিশ্বদেবের বিরাট্‌ দেহে আমরা করি বাস,—
তপন-তারার নয়ন-তারার একটি নীলাকাশ।
এক বিন দুই জানেনাকো একের উপাসক,
সবাই সফল না হ’লে তাই হব না সার্থক্‌।
নিখিল-প্রাণের সঙ্গে মোদের ঐক্য-সাধনা,
হিয়ার মাঝে বিশ্ব-হিয়ার অমৃত-কণা।
সবার সাথে যুক্ত আছি চিত্তে জেনেছি—
প্রীতির রঙে সেবার রাখী রাঙিয়ে এনেছি—
কাজ পেয়েছি, লাজ গিয়েছে, মেতেছে আজ প্রাণ,
চিত্তে ওঠে চিরদিনের চিরনূতন গান।

বেঁচে ম’রে থাক্‌ব না আর আলগ্‌—আল্‌গোছে;
লগ্ন শুভ, রাখব না আজ শঙ্ক- সঙ্কোচে।
বাড়িয়ে বাহু ধর্‌ব বুকে, রাখব মমত্ব,
মোদের তপে দগ্ধ হ’বে শুষ্ক মহত্ত্ব।
মোদের তপে কোঁকড়া কুঁড়ির কুষ্ঠা হ’বে দূর,—
শতদলের সকল দলের ফুর্ত্তি পরিপূর।
জগন্নাথের রথ চলিল, উঠেছে জয়রব,
উদ্বোধিত চিত্ত,—আজি সেবা-মহোৎসব।