বিদায় ভোজ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 থানায় ফিরিয়া আসিয়া স্নানাহার সমাপন করিলাম। পরে অপর একটী কার্য্যের জন্য পুলিশ আদালতে গমন করিলাম। তত্রত্য কার্য্য সমাপন করিতে বেলা দুইটা বাজিয়া গেল। যখন পুনরায় থানায় প্রত্যাগমন করিলাম, তখন বেলা প্রায় তিনটা।

 একে গ্রীষ্মকাল, তাহার উপর প্রচণ্ড রৌদ্র, কাহার সাধ্য ঘরের বাহির হয়। নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে আর কেহ সেই রৌদ্রে যাতায়াত করে না। আদালত হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম এবং একটী নিভৃত স্থানে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম।

 কিছুক্ষণ পরে ভাবিলাম, কেমন করিয়া সুশীলের উপকার করি। আংটীটা চুরি যাওয়ায় সুশীলের মাতার মন এত খারাপ হইয়া গিয়াছে যে, আংটী না পাইলে হয়ত তিনি উন্মাদ হইয়া পড়িবেন। তাঁহার অর্থের অভাব নাই, অর্থের জন্য তাঁহার বিশেষ কষ্ট হইবে না কিন্তু তাঁহার বাড়ীতে, তাঁহারই আত্মীয়ের দ্বারা অংটীটা চুরি হইয়াছে জানিয়া তিনি মর্মান্তিক দুঃখিত হইয়াছেন।

 এইরূপ চিন্তার পর আমি ভাবিলাম, করিমবক্সের সন্ধান জানিতে পারিলে সুশীলের মাতার বেয়ান ও বেহাইএর সংবাদ জানা যাইতে পারে। কিন্তু করিমবক্সের সন্ধান পাই কোথায়? কেমন করিয়া তাহাকে বাহির করি। ভাবিলাম, মিউনিসিপাল আপিসে গাড়ীর নম্বর ও অধিকারীর নাম লেখা থাকে। হয়ত সেখানে যাইলে করিমবক্সের ঠিকানা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু করিমবক্স সাধারণ নাম, হয়ত অনেক করিমবক্স ভাড়াটিয়া গাড়ীর অধিকারী। আমি কোন্ করিমবক্সের নিকট যাইব?

 কিছুক্ষণ এই প্রকার চিন্তা করিয়া অগ্রে মিউনিসিপাল আপিসে যাওয়াই যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম এবং তখনই একজন কনষ্টেবলকে একখানি গাড়ী আনিতে বলিলাম।

 যখন মিউনিসিপাল আপিসে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা চারিটা। যে সাহেব ভাড়াটীয়া গাড়ীর হিসাব রাখিতেন, তাঁহার সহিত আমার আলাপ ছিল। আমাকে দেখিয়া তিনি সাদর সম্ভাষণ করিলেন এবং বেলা অবসানে সেখানে গমন করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

 আমার কথা শুনিয়া তিনি তখনই একজন কেরানিকে আবশ্যকীয় পুস্তকাদি অনায়ন করিতে আদেশ করিলেন; পুস্তক আনিত হইলে তিনি স্বয়ং অতি মনোযোগের সহিত পরিদর্শন করিতে আরম্ভ করলেন।

 কিছুক্ষণ দেখিবার পর তিনি তিনজন করিমবক্সকে তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীর, দুইজনকে দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ীর অধিকারী জানিতে পারিলেন। আমি তাহাদের গাড়ীর নম্বর ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি একখানি কাগজে ঐ সকল বিষয় লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমিও তাঁহাকে শতশত ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম।

 গাড়ীতে উঠিয়া কাগজখানি পাঠ করিলাম; দেখিলাম, পাঁচ জন করিমবক্সের ভাড়াটীয়া গাড়ী আছে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, তাহারা সকলেই কলিকাতায় বাস করে।

 থানায় উপস্থিত হইয়া আমি একজন কনষ্টেবলকে সুশীলের বাড়ীতে পঠাইয়া দিলাম এবং সদানন্দকে সত্বর সঙ্গে করিয়া আনিতে আদেশ করিলাম। কারণ সে ভিন্ন সহজে আসল করিমবক্সের সন্ধান পাওয়া যাইবে না।

 সন্ধ্যার পূর্ব্বেই সদাকে লইয়া কনষ্টেবল ফিরিয়া আসিল। আমি সদাকে সঙ্গে করিয়া পুনরায় একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী করিয়া এক এক করিয়া করিমবক্সের আস্তাবলে যাইতে আরম্ভ করিলাম।

 প্রথম তিনটী করিমবক্স আমাদের করিমবক্স নহে। চতুর্থ করিমবক্সকে দেখিয়া সদা চিনিতে পারিল। সে তাহার সহিত আমাকে দেখিয়া অত্যন্ত ভীত হইল এবং একদৃষ্টে কাতর নয়নে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

 করিমের ভীতভাব ও বিষণ্ণবদন অবলোকন করিয়া আমার কেমন দয়া হইল। আমি মিষ্টবচনে বলিলাম, “আমি তোমার কোন অনিষ্ট করিবার জন্য এখানে আসি নাই, একটী বিশেষ কথা জানিবার জন্য তোমার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।”

 পরে সদানন্দকে নির্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এই লোকটীকে চেন?”

 করিম হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে বেশ চিনি, এক দেশের—এমন কি এক পাড়ার লোক।”

 আ। “সদার মনিবের বাড়ী হইতে কাল সকালে যে সওয়ারি লইয়া গিয়াছিলে, তাহাদিগকে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছ?”

 আমার কথা শুনিয়া করিম যেন আশ্চর্য্যান্বিত হইল। একবার আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আজ্ঞে—হাওড়া স্টেশনে। সেখানে যাইবার জন্যই ত গাড়ী ভাড়া করা হইয়াছিল?”

 আ। তুমি কত ভাড়া পাইয়াছিলে?

 করিমের কৌতূহল আরও বৃদ্ধি হইল। সে জিজ্ঞাসা করিল, “কেন মহাশয় এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? তাঁহারা আট আনার ভাড়া করিয়াছিলেন, তাহাই দিয়াছেন।”

 আ। শুনিয়াছি, কর্ত্তাটী বড় কৃপণ। সেই জন্যই জিজ্ঞাসা করিতেছি। তুমি যে পুরা ভাড়া আদায় করিতে পারিয়াছ, তাহাই যথেষ্ট।”

 আমার কথায় করিমের সাহস বৃদ্ধি হইল। সে হাসিয়া বলিল, “হুজুর! আপনি যথার্থই বলিয়াছেন। আধুলীটা বাহির করিতে আধ ঘণ্টা লাগিয়াছিল, তাঁহারা যে বড় ভাল লোক নয় তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি।”

 আমি দেখিলাম, কোচমানের বেশ সাহস হইয়াছে। মিষ্টকথায় এখন তাহার মনের কথা বাহির করিয়া লইতে পারা যায়। এই ভাবিয়া অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমরা কখন ষ্টেসনে উপস্থিত হইয়াছিলে?”

 ক। আজ্ঞে তখন বেলা প্রায় সাড়ে আটটা।

 আ। তাঁহারা কোন্ ট্রেনে গিয়াছে জান?

 করিমবক্স ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “কোন ট্রেনেই নয় বলিয়া বোধ হয়।”

 আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কি?”

 ক। তাঁহাদের কথাবার্ত্তা শুনিয়া ঐরূপই বোধ হইয়াছিল।

 আ। কি কথা? কখন শুনিলে?

 করিম ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “হাওড়া স্টেশনে যাইবার সময় হ্যারিসন রোডের মোড়ে আমার একটী ঘোড়ার জোত খুলিয়া যায়। আমি তখনই গাড়ী থামাইয়া অবতরণ করি এবং জোত বাঁধিয়া দিই। যখন গাড়ী হইতে নামিতেছিলাম, সেই সময় কর্ত্তা বলিতেছিলেন, ষ্টেশন পর্য্যন্ত না যাইলে কোচমান সন্দেহ করিতে পারে।”

 কথাটা শুনিয়া আমার সন্দেহ হইল, ভাবিলাম, যাঁহারা তীর্থে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছেন, তাঁহারা এমন কথা বলেন কেন? কিন্তু সে সকল কথার উল্লেখ না করিয়া আমি হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত হইলাম। তখন গাড়ী ছাড়িতে অতি অল্প সময় ছিল। কর্ত্তার কথায় আমার সন্দেহ হওয়ায় আমি তখন ষ্টেশন ত্যাগ করিলাম না। গোপনে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের কার্য্য লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। তাঁহারা টিকিট কিনিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন না, বরং অন্য পথ দিয়া ষ্টেশন হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আমিও মনে মনে হাসিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলাম।

 যেরূপ করিয়া কোচমান ঐ সকল কথা বলিল, তাহাতে আমার কোনরূপ সন্দেহ হইল না। আমি তাহাকে পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাঁহারা এখন কোথায় আছেন বলিতে পার?”

 কোচমান ঘাড় নড়িয়া বলিল, “আজ্ঞে না হুজুর। পরের কাজে আমরা অত সময় নষ্ট করিতে পারি না। বিশেষত, সে দিন আমার ভাড়া অতি অল্পই হইয়াছিল বলিয়া আমি গাড়ী লইয়া সত্বর ঠিকা গাড়ীর আড্ডায় প্রস্থান করিয়াছিলাম।

 কোচমানের কথা শুনিয়া আমি সদাকে লইয়া পুনরায় থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। পরে সদাকে বিদায় দিয়া সুশীলের ভগ্নীপতির বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। সুশীলের সহিত বিশেষ ঘনিষ্টতা থাকায় আমি পূর্ব্বে দুই একবার তাঁহাদের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। সুতরাং সেখানে পঁহুছিতে বিশেষ কোন কষ্ট হইল না।

 সুশীলের ভগ্নিপতির নাম কেশবচন্দ্র। তিনি আমার পরিচিত ছিলেন। আমাকে সহসা সেখানে উপস্থিত দেখিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন এবং সাদর সম্ভাষণ করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

 আমি ভাবিলাম, একেবারে প্রকৃত কথা জ্ঞাপন করিলে হয়ত তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হইবেন, হয়ত আমাকে অপমানিত করিয়া বাড়ী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবেন, এই ভয় করিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “এই পথ দিয়া থানায় ফিরিতেছিলাম, অনেক দিন আপনার সহিত দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই বলিয়া একবার এখানে আসিয়াছি। কিন্তু আপনার পিতা কোথায়? তিনি ত প্রায়ই সদর-দরজায় বসিয়া ধূমপান করিতেন।”

 কেশবচন্দ্র হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আমার পিতা-মাতা উভয়েই তীর্থ দর্শনে গমন করিয়াছেন।”

 আমি যেন আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কবে? এই যে সেদিন বৈকালে পথে তাঁহার সহিত দেখা হইয়াছিল।”

 কে। আজ্ঞে হাঁ—তিনি গতকল্য প্রাতে কলিকাতা হইতে রওনা হইয়াছেন।

 আ। কোথায় যাইবেন?

 কে। কাশী।

 আ। কতদিনে ফিরিবেন?

 কে। সে কথা ঠিক বলিতে পারি না। তাঁহাদের যেমন অভিরুচি তেমনই করিবেন। আমার কথা তাঁহারা গ্রাহ্য করেন না।

 আ। বলেন কি! আপনি উপযুক্ত পুত্র, আপনার কথামত কার্য্য না করিলে এ বয়সে তাঁহাদিগকে অনেক কষ্ট পাইতে হইবে।

 কেশবচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “তাঁহাদের মনের কথা তাঁহারাই বোঝেন। মধ্যে পড়িয়া আমি কেন মারা যাই।”

 কেশবচন্ত্রের কথা শুনিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে,

তাঁহার পিতা-মাতা সে বাড়ীতে ফিরিয়া আইসেন নাই। তাঁহারা যে কোথায় গিয়াছেন, সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস করিলাম না। অগত্যা দুই একটা অপর কথা কহিয়া আমি কেশবচন্দ্রের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম।