বিদায় ভোজ/প্রথম পরিচ্ছেদ

বিদায় ভোজ।


প্রথম পরিচ্ছেদ।

 দৈনিক কার্য্য শেষ করিয়া বারান্দার ছাদে পায়চারি করিতেছিলাম। শনিবার রাত্রি আটটা বাজিয়া গিয়াছে। সুনীল অম্বরে পূর্ণচন্দ্র। জোছনায় চারিদিক উদ্ভাসিত। মলয় পবন প্রবাসীর দীর্ঘশ্বাসের ন্যায় থাকিয়া থাকিয়া শন্ শন্ শব্দে প্রবাহিত। সঙ্গে সঙ্গে রাজপথের ধূলিকণাগুলি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া জনগণের মনে অশান্তি আনয়ন করিতেছিল।

 এ হেন সময়ে সহসা আমার একজন বন্ধু সুশীলের কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হইল। প্রায় এক বৎসর হইল সুশীল পশ্চিমে গিয়াছিল। কতদিন তাহাকে দেখি নাই। তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমার মন অত্যন্ত চঞ্চল হইল। আমি আর নিশ্চিন্তমনে পদচারণা করিতে পারিলাম না। তৎক্ষণাৎ নিম্নে অবতরণ করিলাম। দেখিলাম, সুশীল একজন পুরাতন কনষ্টেবলের সহিত কথা কহিতেছে। সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমি তখনই তাহাকে উপরের বৈঠকখানায় লইয়া আসিলাম।

 কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্ত্তার পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত শীঘ্র ফিরিয়া আসিলে?”

 সুশীল হাসিয়া উত্তর করিল, “আমরা কি কোথাও গিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি। আমাদের অদৃষ্ট তেমন নয়! একটা সামান্য কাজের জন্য মা আমাকে বারম্বার পত্র লিখিয়াছিলেন। কি করি, কতদিন আর তাঁহার কথা অবহেলা করিতে পারি। বৃহস্পতিবারে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”

 আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি এমন কাজ যে, তুমি না থাকিলে হইত না?”

 আমার দিদির শ্বশুর ও শাশুড়ী তীর্থ যাত্রা করিয়াছেন। যাইবার পূর্ব্বে তাঁহারা আমার মাতাঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে আমাদের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকেও নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল।

 আ। কেন? তাঁহারা কি আর ফিরিবেন না?

 সু। অভিপ্রায় ত এই—তবে ঠিক বলিতে পারি না। কিন্তু সে যাহা হউক, এখন আমাদের মহা বিপদ। তুমি ভিন্ন অপর কেহই আমাদিগকে সে বিপদ হইতে মুক্ত করিতে পারিবে না।

 এই বলিয়া সুশীল এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল এবং আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার কথার তাৎপর্য্য বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি এমন বিপদ?”

 সুশীল বলিল, “বাড়ী হইতে একটী দামী আংটী চুরি গিয়াছে। এত চেষ্টা করিলাম কিন্তু আংটীটা পাওয়া গেল না। হয়ত আমাদিগকে উহার মূল্য দিতে হইবে।”

 আ। মূল্য কত?

 সু। শুনিলাম, পাঁচ হাজার টাকা। যদি বাস্তবিকই আংটীটি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কেমন করিয়া অত টাকা দিব?  আ। কবে চুরি হইয়াছে?

 সু। গত রাত্রে।

 আ। কেমন করিয়া চুরি হইল?

 সু। আহারাদির পর যখন সকলে বসিয়া গল্প-গুজব করিতেছিলেন, সেই সময়ে আমার এক জ্ঞাতি ভাইএর কন্যা তথায় উপস্থিত হয়। তাহার হাতেই সেই অংটীটী ছিল। আমার মাতাঠাকুরাণীই প্রথমে উহা দেখিতে পান এবং তাহার মূল্য জিজ্ঞাসা করেন। আমার ভ্রাতুষ্কন্যা মূল্য বলিলে পর উপস্থিত সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হন। মা তখন অংটীটী দেখিতে চান। মার দেখা হইলে আর একজন রমণী তাহা গ্রহণ করেন এবং যথেষ্ট প্রশংসা করেন। আর একজন মহিলা তাঁহার নিকট হইতে গ্রহণ করেন। এইরূপে সমাগত প্রায় সকলেই এক একবার সেই অংটীটী লন এবং দেখিয়া পরবর্ত্তী লোকের হস্তে প্রদান করেন। কিছুক্ষণ পরে আমার ভ্রাতুষ্কন্যা যখন তাহা ফিরিয়া চাহিল, তখন সকলেই বলিলেন, তাঁহাদের নিকট আংটীটী নাই। প্রত্যেকেই বলিলেন, অংটীটী দেখিয়া অপর ব্যক্তিকে প্রদান করিয়াছেন।

 আ। তোমার ভ্রাতুষ্কন্যা ত সেই স্থানেই ছিলেন?

 সু। না ভাই! সে মা’র হাতে অংটীটী প্রদান করিয়া অন্যত্র গিয়াছিল।

 আ। তোমার মাতাঠাকুরাণী কি বলেন?

 সু। বলিবেন আর কি, তিনি যাঁহার হস্তে আংটাটী দিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট হইতে চাহিলেন। কিন্তু তিনিও অপর এক ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিলেন।

 সুশীলের কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, যদি আংটীটী সত্য সত্যই চুরি গিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার আর পুনরুদ্ধারের উপায় নাই। কিন্তু সে কথা তখন সুশীলকে বলিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর জিজ্ঞাসা করিলাম, তখন সেখানে কোন অপর লোক ছিল?”

 কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া সুশীল উত্তর করিল, “না, যাঁহারা তখন সেখানে ছিলেন, তাঁহারা সকলেই আমাদের বিশেষ আত্মীয়।

 আ। কাহারও উপর সন্দেহ হয়?

 সু। না—তবে কাহার মনে কি আছে কেমন করিয়া বলিব?

 আ। ভাল করিয়া অন্বেষণ করিয়াছিলে?

 সু। আমাদের যতদূর সাধ্য। তবে তোমাদের চক্ষুর সহিত আমাদের চক্ষুর তুলনা হয় না। আমরা প্রাণপণে অন্বেষণ করিয়া যাহা বাহির করিতে পারি নাই, তুমি অতি অল্পকালের মধ্যেই তাহা বাহির করিয়া দিয়াছিলে। সেই জন্যই মা আমায় তোমার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন এবং তোমাকে আমাদের বাড়ীতে যাইবার জন্য বারম্বার অনুরোধ করিয়াছেন।