বিদ্যাসাগর-প্রবন্ধ/ভূমিকা
বিদ্যাসাগর—প্রবন্ধ।
রত্ন প্রসবিনী ভারতভূমিতে কত মহাত্মা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং স্বীয় স্বীয় জীবনে কত প্রকার সৎকর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া, ভারতের নাম চিরকালের জন্য সমুজ্জ্বল করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। শৌর্য বীর্য্য বলুন, ধর্ম্ম কর্ম্ম বলুন, প্রজ্ঞা প্রতিভা বলুন, দয়া দাক্ষিণ্য বলুন, ভারত ইতিহাসে কিছুরই দৃষ্টান্তের অভাব নাই। এই সকল মহাত্মা ভারতভূমিতে জন্মগ্রহণ করিয়া স্বীয় নামের সঙ্গে সঙ্গে জন্মভূমির নাম জগতে চির প্রসিদ্ধ করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আমরা আজ যে এত নির্বীয্য,কাপুরুষ আজ ও আমরা সেই মান্ধাতা সগর, ভীমার্জ্জুন, পৃথু প্রতাপাদির দেশবাসী বলিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে পারি। আজ আমরা ধর্ম্মকর্ম্মহীন হইয়াও নারদ, জনক, যুধিষ্ঠিরাদির নাম স্মরণ করিয়া আমাদের জীবন পবিত্র করিতে পারি। আমাদের এখন প্রজ্ঞা প্রতিভার লেশ মাত্র নাই, তবু ও আমরা সেই ব্যাস,বাল্মিকী, কণাদ,পতঞ্জলি,কালিদাস প্রভৃতি জগন্মান্য মহাত্মাগণের স্বদেশবাসী বলিয়া, স্পর্দ্ধা করিতে পারি এবং সময়ে সময়ে স্পর্দ্ধা করিয়াও থাকি। আর দয়া দাক্ষিণ্যের কথা আমাদের একালে না বলাই ভাল। আমরা যে, মহাত্মা ভীষ্ম কর্ণ হরিশ্চন্দ্রাদির জন্মভূমি ভারতের অধিবাসী, একথা স্মরণ করিতেই সাহস হয়। এই রূপ বহু সংখ্যক মহাত্মা ভারতে নানা সময়ে নানা স্থানে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন। কিন্তু কে কবে ঠিক কোথায় ভুমিষ্ঠ হন তাহার কোন নিদর্শন নাই। তাঁঁহাদের মানব-সাধারণ কার্য্যের কোন প্রকার বর্ণনাই কোথাও পাওয়া যায় না। বোধ হয় কোন দরকার ও নাই। বড়ই হউন বা ছোটই হউন সকলেই এক দিন এক স্থানে কোন না কোন সময়ে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। তাহা জানাতে বিশেষ কোন লাভ নাই, না জানাতেও ক্ষতি নাই। যাহা অলৌকিক, যাহা মানব সাধা দুষ্পাঠ্য তাহাই স্মরদুষ্পাঠ্য কীর্ত্তনযোগ্য। কালে তাহা লয় করিতে পারে না, মানুষ তাহা ভুলিতে পারে না। এক শ্রেণীর পণ্ডিতগণ এই সকল মহাত্মাগণের বা ইহাদের সম্বন্ধে ঘটনা বিশেষের অবিকল স্থান ও কাল নির্ণয় জন্য কত পরিশ্রম ও কত ব্যয় করিতেছেন। তাঁহাদের ভীষণ গবেষণা দেখিয়া চমৎকৃত হইতে হয়, তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ দিতে হয়, সময়ে সময়ে হাসি ও পায়। যাহা হউক একালে ইহা একটা বড় কার্য্য, পণ্ডিতোচিত কার্য, বড় বাহাদুরির কার্য। আমার ন্যায় ছোট মূখে বড় কথা ইহার প্রতিকূলে বলা নিষ্প্রয়োজন। বলিতেছিলাম এই যে মহাত্মাগণের মহৎ কীর্ত্তিকলাপই লোকের স্মরণ থাকে। ভীষ্ম কোন্ দিন কোন্ সময়ে ঠিক কোথায় ভুমিষ্ঠ হন, তাহা আমরা জানি না; ক্ষতি কি? তাহাতে ভীষ্ম ও মারা পড়েন নাই আমরাও তাহাকে ভুলিতে পারি নাই। সেইরূপ সকল মহাত্মার সম্বন্ধেই বলা যাইতে পারে। এই যে আমরা ইংরাজীতে রাশি রাশি জীবনচরিত দেখিতে পাই, বাস্তকিই একটা জাতির ভিতর এত অল্প কাল মধ্যে এত প্রকৃত লোক সাধারণের অতীত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিই জন্মিয়াছেন কি? এবিষয়ে আমার ঘোর সংশয়। আর ও আমার বিশ্বাস এইরূপ জীবন চরিত লিখিয়া ছাপাইয়া প্রচার করিয়া কি এই সকল লোককে কেহ চিরস্মরণীয় করিতে পারিবেন। তাহা কখনই হইবে না।
মানুষ মরিয়া গেলে আর সবই ফুরাইয়া যায়, থাকে কেবল তাঁহার চরিত্র ও গুণ। সে আবার কিরূপ চরিত্র,কি প্রকার গুণ? লোক সাধারণ চরিত্র বা গুণ নহে। লোকাতীত চরিত্র ও গুণ। তুমি আমি জন্মিয়াছি, কাজ কর্ম্ম করিতেছি, আহার নিদ্রা করিতেছি, রোগে শোকে ভুগিতেছি, সুখে দুঃখে জীবন কাটাইতেছি, তাহার পর মানবলীলা সংবরণ করিব। সব ফুরাইয়া যাইবে। আমাদের আবার স্মরণ কে করিবে, কেনইবা স্মরণ করিবে? যদি সহস্র পৃষ্ঠা বিশিষ্ট জীবনচরিত লিখিত ও মুদ্রিত হইয়া বিনা মূল্যে প্রচারিত হয় তাহাতে ও আমাদিগকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারিবে না। তবে সে আবর্জ্জনা গুলার প্রয়োজন কি? - অভিমান। কালের কাছে আদর আবদার নাই, মান অভিমান নাই। তুমি আমি হাজার চেষ্টা করি, কালের নিদারুণ হস্তে এসমস্তই বিস্মৃতি সাগরে নিমজ্জিত হইবে।
কেহ মনে করিবেন না যে আমি এত কথা কেন বলতেছি, এ সব ধান ভানিতে শিবের গান কেন? এখন বক্তব্য বিষয় ছাড়িয়া অপ্রাসঙ্গিক কথায় কাল ক্ষেপ কেন? অপ্রাসঙ্গিক নহে। যে প্রাতঃস্মরণীয় মহাত্মার নাম করিয়া আমাদের জীবন পবিত্র করিবার জন্য আজ আমরা প্রয়াস করিতেছি, উপরে লিখিত মহাত্মাগণের সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, তাঁহার সম্বন্ধে ও তাহাই প্রযোজ্য। তাহার অসীম গুণের কথঞ্চিৎ কীর্ত্তন করাই আমার অদ্যকার কার্য্য। তাঁহার জীবনচরিত বর্ণন করা আমার কার্য্য নহে, সাধ্যও নহে। মহাত্মা তাঁহার পিতামাতার সন্তান। অমুক দিন অমুক সময়ে, অমুক জেলার অন্তর্গত অমুক গ্রামে ভুমিষ্ঠ হইয়া পিতা মাতার স্নেহ ভালবাসায় প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। এ কথা আপনারা নাই শুনিলেন।
যে মহাত্মার গুণ সমুদ্রের কণামাত্র অদ্য আমি বর্ণন করিতে পারি কি না সন্দেহ। তিনি একজন অতি মহতী প্রতিভাশালী লোক ছিলেন। তাঁহার দিগন্তৰাপিনী প্রতিভার কথা আমা অপেক্ষা সহস্র গুণে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি দ্বারা উপযুক্তরূপে বর্ণিত হইয়াছে; তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। বিশেষতঃ আমার ধারণা প্রতিভা মানুষের সঙ্গে জন্মে। ইহা প্রাক্তনকর্ম্মজাত, ভগবানপ্রদত্ত, আজন্ম লব্ধ গুণ। চেষ্টা করিয়া ইহা পাওয়া যায় না। সকলের ইহা সমান থাকে না। ঘসিয়া মাজিয়া ইহার চাকচিক্য সাধন করা যায় মাত্র। আমরা প্রকৃত প্রতিভাশালী মহাত্মা খুব কমই দেখিতে পাই। যখন দেখিতে পাই তখন সৃষ্টির অপরাপর আশ্চর্য্য পদার্থের ন্যায় আমরা দেখিয়া চমৎকৃত হই, যাঁহার সেই প্রতিভা তাহাকে দেখিয়া চমৎকৃত হই, যিনি তাঁহাকে সেই প্রতিভা দিয়াছেন তাঁহার প্রতি ভক্তি সহকারে মন আকৃষ্ট হয়, আপনা আপনি ধন্য মনে করি। তাহাতে আমাদের কোন উপকার আছে বলিয়া বোধ হয় না। পর্ব্বতের স্থৈর্য্য, সমুদ্রের গাম্ভীর্য্য, কুসুমের মাধুর্য্য আমরা দেখিয়া থাকি, কিন্তু তাহা হইতে আমরা কিছু স্থৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, মাধুর্য্য শিক্ষা করি কি? তাহা করি না। প্রতিভা ও সেই রকম জিনিষ। ইহার পর্য্যালোচনা করিতে সময়ে সময়ে আমোদ হয় বটে কিন্তু তাহাতে আমরা বিশেষ কোন উপকার পাই না। তজ্জন্য আমার বিবেচনায় যাহাতে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে আমাদের কোন উপকার নাই, এমত নিঃস্বার্থ আমোদ এখন নাই করিলাম।
আমরা সকলেই স্বার্থপর, কমবেশী পরিমাণে হউক, সকলেই স্বার্থপর; স্বার্থের আকার প্রকার ভেদ হইতে পারে কিন্তু সকলেই স্বার্থপর। এই যে আজ আমরা এতগুলি লোকে সেই মহাত্মার গুণ কীর্ত্তন করিতে সমবেত; ইহাতে কি স্বার্থ নাই? স্বার্থ আত্মপ্রসাদ, স্বার্থ তাঁহার গুণ কীর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের জীবনে যতটা সাধ্য সেই সকল গুণ যাহাতে বর্ত্তায় তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দ্বারা একান্ত চেষ্টা করা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় জগন্মান্য লোক জগতের চিরন্তন শিক্ষক। যত দিন জীবিত থাকেন সাক্ষাত পক্ষে আদেশ উপদেশ দ্বারা, তিরস্কার পুরস্কার দ্বারা, দেখাইয়া শুনাইয়া, বুঝাইয়া পড়াইয়া,নানা প্রকারে শিক্ষা দেন, আর জীবনান্তে লোকাতীত সৎগুণের সহস্র দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়া চির কাল লোক শিক্ষা দিয়া থাকেন। সুতরাং ইহাঁরা মরিয়া ও মরেন না, মানবলীলা সংবরণ করিয়া ও মানবকে শিক্ষা দিতে ছাড়েন না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে আমরা এই রূপ কি কি দৃষ্টান্ত পাইছি এবং তাহা হইতে কি শিক্ষা পাইতে পারি, আজ আমরা তাহারই কিছু কিছু আলোচনা করিব।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গুণ কীর্ত্তন করিতে গিয়া, প্রথমেই ঘোর বিভ্রাট। কোন্ কথাটী আগে বলি। আমাদের ক্ষীণ চক্ষু তাঁহার তেজস্বীগুণগ্রামের মহিমায় ঝলসাইয়া যায় কিছুই ঠাওরাইতে পারিতেছি না, যে কোন্টী আগে বলি কোন্টী পরে বলি। তাঁহার জীবনে বলিবার কথা যেমন অধিক, আমাদের সময়ও তেমনি সংক্ষিপ্ত এবং তাহা অপেক্ষা সংকীর্ণ আমার ক্ষমতা। যাহা হউক প্রলাপের মত যখন যাহা মনে আইসে গোটাকতক কথা মাত্র বলিয়া যাই।