বিদ্যাসাগর-প্রবন্ধ/প্রথম কথা

প্রথম কথা—লোভহীনতা।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় এত বড় লোক বলিয়া জগতে এত মান্য তাহার কারণ কি? কত কত লক্ষপতি, কোটীপতি ধনাঢ্য ভারতে জন্মিতেছেন, মরিতেছেন, কে কাহার খোঁজ খবর রাখেন? কত মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হইতেছেন, যাইতেছেন, কে তাহার হিসাব রাখে? তবে আমরা কি জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এত পদাবনত?

 এই সাম্যবাদের দিনে, এই সমাজের বিশৃঙ্খলার কালে, আমরা তাঁহাকে সমবেতস্বরে আমাদের পূজ্য, দৃষ্টান্ত স্থানীয় বলিয়া স্বীকার করি কেন? তাহার উত্তরে সেই একটী প্রাচীন শ্লোকার্দ্ধ মনে পড়ে ‘‘আশা দাসী কৃতা যেন, তেন দাসায়তে জগৎ।” যিনি আশার কুহুকে ভুলেন না,লোভে মজেন না, জগৎ তাঁহার দাস। আমরা তাঁহার দাসানুদাস। বিদ্যাসাগর মহাশয় লোভ লালসা শূন্য ছিলেন। সে সম্বন্ধে তাঁহার নিজমুখ হইতে শ্রুত, দুই একটী গল্প বলিতেছি। দুইবার তিনি চাকরি ছাড়েন, তাহা বোধ করি অনেকেই জানেন। একবার চাকরি ছাড়ার পর তাঁহাকে তাঁহার জনৈক স্নেহশীল মুরূব্বি সাহেব ডাকিয়া লইয়া যান। বিদ্যাসাগর মহাশয় যাইবা মাত্র সাহেব জিজ্ঞাসা করেন, “বিদ্যাসাগর তুমি খাইবে কি?” বিদ্যাসাগর মহাশয় কথার তাৎপর্য্য বুঝিয়াও বুঝিলেন না, ভাণ করিয়া, পরিহাসচ্ছলে বলিলেন, “মহাশয় কি আমাকে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, যে জিজ্ঞাসা করিতেছেন আমি কি খাইব।” সাহেব তাহাতে একটু অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন “বিদ্যাসাগর ব্যঙ্গ পরিত্যাগকর। আমি তোমার আয়ব্যয়ের সমস্ত বৃত্তান্তই জানি। তোমার ত কিছুই সংস্থান নাই, সংস্থান করিতেও পারিবে না, তুমি যে চাকরি ছাড়িলে, তোমার চলিবে কি করিয়া?” এতদুত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন যে, তিনি জনৈক ভৃত্যের নিকট তাহা শিক্ষা করিয়াছেন, সে শিক্ষাটী এই।

 যে সময়ে এই কথোপকথন হয় তাহার কিছু দিন পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় বড় ম্যালেরিয়া জ্বরে পীড়িত হন। চিকিৎসকেরা স্থান পরিবর্ত্তনের পরামর্শ দিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্থান পরিবর্ত্তনদ্বারা স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য বর্দ্ধমানে যান। স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য বর্দ্ধমান যাওয়ার কথা শুনিয়া কেহ হাসিবেন না। তখন এই ভারতের সীমান্তব্যাপী লৌহবর্ত্ম প্রস্তুত হয় নাই, যে লোকে মনে করিলে লাহোর বা বোম্বাইয়ে, অথবা স্টীমার যাত্রা এত প্রচলিত হয় নাই যে সহসা মান্দ্রাজ বা কলম্বো যাইবেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এ সকল স্থানে যাইবার বিষয় মনে উদয় হয় নাই, বৈদ্যনাথ, মধুপুর পর্য্যন্ত তাঁহার মনে হয় নাই। কাজেই বর্দ্ধমানে স্থান পরিবর্ত্তন জন্য গেলেন। তখন বর্দ্ধমান বড় স্বাস্থ্যকর স্থান। যদিও তখন তথায় ইংরাজী কেতায় মিউনিসিপালিটীর সৃষ্টি হয় নাই, কলের জলের অনুষ্ঠান হয় নাই, সহরের এখনকার মত শৃঙ্খলা সৌন্দর্য্য কিছুই ছিল না, তবুও তখন বর্দ্ধমান স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় সুতরাং বর্দ্ধমানে গিয়া কিয়ৎকাল অবস্থিতি করেন। কিন্তু সেখানে রোগীর পক্ষে একটী বড় অসুবিধা ছিল। ভাল দাদখানি চাউল পাওয়া যাইত না। সে জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় কলিকাতা হইতে কিছু পুরাতন সরু দাদখানি চাউল সংগ্রহ করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। যে ঘরে তিনি প্রতিনিয়ত থাকিতেন, সেই ঘরের এক কোণে সেই চাউলের পাত্রটী থাকিত। একদিন তিনি সেই ঘরে বসিয়া আছেন, এমন সময় তাঁহার জনৈক ভৃত্য আসিয়া উক্ত চাউল তিন মুষ্টি একটী পাত্রে করিয়া লইয়া গেল। ভৃত্য ভিক্ষা দিবার জন্য বহুকষ্টে আনীত রোগীর অনন্যোপায় দাদখানি চাউল লইয়া গেল মনে করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু অসন্তুষ্ট হইয়া ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “ভিক্ষাজন্য স্থানীয় চাউল লইবে, এ চাউল এখানে পাওয়া যায় না, ফুরাইলে বড় কষ্ট হইবে, এচাউল লইও না।” তদুত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় যাহা শুনিলেন তাহাতে তাঁহার জীবনের গতি ফিরিল, প্রকৃত জ্ঞানোদয় হইল। ভৃত্য বলিল, “মহাশয় ভিক্ষার জন্য তিন মুষ্টি চাউল লই নাই, আপনার আহারের জন্যই লইয়াছি।” এই কথা বলিয়া ভৃত্য কার্য্যান্তরে চলিয়া গেল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত লাগিল। কথা সামান্য, কিন্তু সময়ে সময়ে ঐরূপ সামান্য কথায় বড় একটা বিপর্য্যয় ঘটিয়া যায়। এমনি একটী সামান্য কথা, “দিন আখের হুয়া,” শুনিয়া পাইকপাড়া রাজবংশের পরম শ্রদ্ধাস্পদ পূর্ব্বপুরুষ, স্বনামখ্যাত, লালা বাবু বৈরাগ্য অবলম্বন করেন এবং বহুবিধ সৎকর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া বৃন্দাবনধামে নিজ কীর্ত্তিকলাপ স্থাপন করিয়া যান। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভৃত্যের সেই কথা কয়টীর যে ফল ফলিল তাহা অতি মহৎ, অতি গুরুতর। বিদ্যাসাগর মহাশয় ভাবিলেন “ভাল তিনমুষ্টি তণ্ডুলে যাহার দিনপাত হয় তাহার অর্থোপার্জ্জন জন্য এত কষ্ট কেন? পরাধীনতায় জীবন শেষ করা কেন? ব্রাহ্মণের ছেলে তিনদ্বারে দাঁড়াইলেই তিন মুষ্টি পাইব, তবে আবার পরপদ সেবার প্রয়াস কেন?” এইরূপ কথা মনে আসিল, মন প্রফুল্ল হইল, মনে এক অভূত পূর্ব্ব আনন্দ পাইলেন। ভৃত্যকে পুনরাহ্বান করিলেন এবং বাক্স হইতে দুইটী টাকা লইয়া তাহার হস্তে দিয়া বলিলেন, “বাপু, তুমি আমার গুরু। আমি এতদিন এত মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপকগণের নিকট যে শিক্ষা পাই নাই, এত শাস্ত্রালোচনা করিয়া যে জ্ঞান পাই নাই, আজ তোমার নিকট সেই শিক্ষা পাইলাম, সেই জ্ঞানলাভ করিলাম। তুমি আমার শিক্ষক, তুমি আমার গুরু। তুমি গুরু দক্ষিণা স্বরূপ এই দুইটী টাকা লও।” বিদ্যাসাগর মহাশয় কি জানতে পারলেন? জানিলেন যে তিন মুষ্টি তণ্ডুলে তাঁহার দিনপাত হয়। আর কি ভাবিলেন, ভাবিলেন যে ব্রাহ্মণের ছেলে তিন দ্বারে দাঁড়াইলে তিন মুষ্টি তণ্ডুল সংগ্রহ হইবে, তজ্জন্য পরাধীনতা কেন? ধন্য তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে,ধন্য তোমার ব্রহ্মতেজ! এইত ব্রাহ্মণের প্রকৃত লক্ষণ, এইত প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব। “তিলকং যজ্ঞসূত্রঞ্চাদি” ব্রাহ্মণ লক্ষণ ব্রাহ্মণের, সামাজিক ব্রাহ্মণের, বাহ্যিক সাধারণ লক্ষণ মাত্র। প্রকৃত ব্রাহ্মণ ভিতরের জিনিষ। লোভ লালসাহীন হওয়া ব্রাহ্মণের প্রধান কর্ত্তব্য। যিনি চরিত্রবলে রাজাধিরাজেরও পূজ্য, যিনি গুণগরিমায় সমগ্র ভারতে সমাদৃত, তাঁহার গোটাকত বাহ্যিক লক্ষণ মাত্র থাকিলে চলিবে কেন? বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্রাহ্মণত্বের এই সকল বাহ্যিক লক্ষণ, যজ্ঞসূত্র ব্যতীত আর কিছুই ছিল না, কিন্তু ভিতরে তিনি খাঁটী ব্রাহ্মণ। এই ভারতের দারুণ দুর্দ্দিনেও তাঁহার ব্রহ্মতেজ সমুদ্ভাসিত হইয়া ছিল। রাজদ্বারে প্রভূত সম্মান, উচ্চপদের দারুণ অভিমান, অর্থাগমের অমোঘ উপায়, ভোগবিলাসের, বিষয় বৈভবের সোপান সমস্তই তিনি পদাঘাতে বিদূরিত করিলেন। মনে ভাবিলেন কি? ব্রাহ্মণের ছেলে তিন দ্বারে দাঁড়াইলে তিন মুষ্টি পাইব, তাহাতেই আমার চলিবে। যে ব্যক্তি এইরূপ ভাবে চিন্তা করিতে পারেন তিনিই ব্রাহ্মণ, - ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হইয়া যিনি অর্থলোভে দিবানিশি দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন, কিছুতেই তৃপ্তিনাই, আশা মেটে না, সহস্র হইল ত লক্ষ চাই, লক্ষের পর লক্ষাধিক, ধিক সে ব্রাহ্মণ,তাহার আবার ব্রাহ্মণ্য কোথায়? তিনি ব্রাহ্মণ বংশে জাত বণিক, তিনি ত্রিসন্ধ্যা করুন, বিষ্ণুপূজা করুন, তিলকযজ্ঞসূত্র ধারী হউন, তিনি ব্রাহ্মণের চিত্রমাত্র; ব্রাহ্মণত্ব তাঁহাতে নাই। অর্থলোভী ব্রাহ্মণতনয়ের সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, পদলোভী, সম্মানাকাঙ্ক্ষী আভিজাত্যাভিমানী, বিলাসী ব্রাহ্মণগণ সম্বন্ধে ও ঠিক তাহাই বলা যায়। আমরা সর্ব্বদাই আক্ষেপ করি ভারতের দুরবস্থার জন্য। আর আমাদের এখন যেরূপ বুদ্ধি সূক্ষ্মতা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে কতই ভারতের উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করি। কিন্তু কখন কি আমরা ভাবি ভারতের সার কি? ভারতের প্রাণ কোথায়? ভারত কিসে এত বড় ছিল? আবার কি করিলেই বা সে মহত্ব পুনঃ লাভ করিতে পারে। ভারতের সার ব্রাহ্মণ, ভারতের প্রাণ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের তেজে ভারত বড় হইয়াছিল, আর ব্রাহ্মণত্বের অবনতিতেই ভারতের অবনতি হইয়াছে। যে হস্ত দ্বারা ষড়্‌দর্শন উপনিষদাদি ভারতের কীর্ত্তিস্তম্ভ সমূহ গ্রথিত হইয়াছিল, সে হস্ত ভিক্ষালব্ধ অন্নদ্বারা পরিপুষ্ট। সেই সকল মহাত্মা কখন খাট পালঙ্কে শয়ন করেন নাই, চেয়ার টেবিল দেখেন নাই, যান বাহন জানিতেন না, ভোগবিলাসের দাস ছিলেন না, যেমন তেমন করিয়া উদরান্ন চলিয়া গেলেই হইল, তাহাতেই পরম সন্তুষ্ট চিত্তে আপনার কর্ত্তব্য কর্ম্মে সর্ব্বদা নিরত থাকিতেন। এই সেদিনকার একটী কথা বলি। নবদ্বীপে রমানাথ বলিয়া একজন প্রগাঢ় নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। একদিন রমানাথ চতুষ্পাঠীতে বসিয়া সম্মুখে গ্রন্থ রাখিয়া চিন্তায় একাগ্রমনা হইয়া আছেন। এমত সময় তাহার পশ্চাদ্দেশে কৃষ্ণনগরের তদানীন্তন রাজা সমুপস্থিত। রমানাথ বাহ্যজ্ঞান শূন্য হইয়া শাস্ত্র চিন্তায় নিমগ্ন। কে আসিয়াছেন তৎ প্রতি কিছু মাত্র লক্ষ্য নাই। কিছুক্ষণ পরে নজর পড়িল, অপ্রতিভ হইয়া রাজাকে অভিবাদন করিয়া বসিবার জন্য আসন প্রদান করিলেন। রাজা বড়ই সন্তুষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের অসঙ্গতি হইয়াছে কি?” ভট্টাচার্য্যের তখনও ন্যায়ের অসঙ্গতি ভাবিলেন, বলিলেন “না অসঙ্গতি নহে অপর বিষয় ভাবিতে ছিলাম।” রাজা হাসিলেন। তাঁহার সাধু ভাষা প্রয়োগ স্থানোচিত হয় নাই ভাবিয়া স্পষ্টাক্ষরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভট্টাচার্য্য মহশায়ের কোন কিছু অভাব আছে কি? তদুত্তরে ভট্টাচার্য্য মহাশয় যাহা বলিলেন তাহা শুনুন; ভট্টাচার্য্য মহাশয় বলিলেন, “মহারাজ, আপনার প্রদত্ত ভূমি হইতে কৃষকেরা যে তণ্ডুল দেয় তাহাতে আমার সশিষ্য অন্নের সংস্থান বেশ আছে। আর ব্যঞ্জন জন্য কোন ভাবনা নাই। এই সম্মুখস্থ তিস্তিড়ী বৃক্ষটী দেখিতেছেন, ইহার ফল চয়ন করি, পত্রও চয়ন করি তাহাতেই আমাদের যথেষ্ট সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ হয়, আমার কোন অভাব নাই।” শুনিলেন ব্রাহ্মণের কি উত্তর; তিস্তিড়ীপত্রোপকরণে জীবন রক্ষা করেন তাহাতেই সন্তুষ্ট। আর অবস্থাটী কিরূপ। রাজা স্বয়ং অভাব আছে কি না সেবিষয়ে জিজ্ঞাসু। এখন কি আমি স্পষ্ট বলিতে পারিয়াছি যথার্থ ব্রাহ্মণ বলিতে কি বুঝি, কি চাই। ব্রাহ্মণ অর্থের দাস হইবে না, পদের দাস হইবে না, পরের দাস হইবে না; ব্রাহ্মণকে দাসত্বে আনে কে? অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বস্ত্রাঞ্চলে কাহার সাধ্য আবদ্ধ রাখে। সে সমস্ত দগ্ধ করিয়া স্বমূর্ত্তি ধারণ করিবেই করিবে। নিজের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করিবে, তেজ দেখাইবে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নির্লোভতা সম্বন্ধে অপর একটী কথা বলি। যখন বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রথম প্রচারিত হয় সে সময় বাঙ্গালা ভাষায় সে খানি প্রধান পুস্তক ছিল। এখনও যে ইহার স্থান কিছু নীচু হইয়াছে আমার তাহা বোধ হয় না। বাঙ্গালা ভাষার উচ্চতর পরীক্ষায় উহা নির্দ্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তক ছিল। যথেষ্ট বিক্রয় হইত। এক দিন তাঁহার জনৈক হিতৈষী সাহেব বন্ধু, নাম আমার ঠিক স্মরণ হইতেছে না, কাপ্তেন মার্শেল হইলে হইতে পারে, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিলেন যে, তিনি উক্ত পুস্তকের এক সংস্করণের সমস্ত টাকা লইবেন। তাহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্মত হইলেন। সাহেব সমস্ত সংস্করণ বিক্রয় করিয়া ব্যয় বাদে তিনসহস্র মুদ্রা সংগ্রহ করিলেন। তাহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নামে তিন হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ ক্রয় করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দিয়া বলিলেন, “দেখ, তুমি বড় অমিতব্যয়ী-কখন কিছু রাখিতে পার না, এই কাগজ রাখ, নষ্ট করিও না।” বিদ্যাসাগর মহাশয় কৃতজ্ঞতার সহিত সাহেব প্রদত্ত কাগজ লইয়া বাটী গেলেন। রাত্রিতে একবার মনে করিলেন তিন হাজার টাকার কাগজ, কেমন একটা ভাঙ্গা রকম, এটা পাঁচ হাজার করিবার চেষ্টা করিবেন। পরক্ষণেই মনে করিলেন—কি সর্ব্বনাশ! কি ভাবিতেছি। এ কোম্পানির কাগজ নয়, এযে সর্ব্বনাশের বীজাঙ্কুর,—তিন হইতে পাঁচ, পাঁচ হইতে দশ, দশ হইতে বিশ, এইরূপে ক্রমাগত অর্থসঞ্চয়ের দিকে দৃষ্টি পড়িলেই, তাহাতে মন মজিলেই আমার সর্ব্বনাশ হইবে, এখন আমার উপায় কি? এই ভাবনায় তাঁহার মন এত ব্যথিত হইল, মনে এত উদ্বেগ উপস্থিত হইল, তিনি রাত্রিতে নিদ্রা যাইতে পারিলেন না। কতক্ষণে রাত্রি প্রভাত হয়। রাত্রি প্রভাত হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রভাত হইবামাত্র অনন্যমনা হইয়া যে কোন প্রকারে হউক কাগজ বিক্রয় করিয়া প্রকৃতিস্থ হইলেন, তখন হাঁপ ছাড়িয়া প্রাণ বাঁচাইলেন। ভাবিলেন ঘরে যে কাল সাপ রাখিয়া ছিলেন তাহা দূর করিয়াছেন, এখন নিশ্চিন্ত। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা সামান্য চিন্তা আসিল, হিতৈষী সাহেব বন্ধু স্নেহপরবশ হইয়া তাঁহার উপকার উদ্দেশ্যে যাহা করিয়াছেন তাঁহার কাছে কি বলিবেন। ভাবিতে ভাবিতে সাহেবের বাড়ী গেলেন, প্রথমেই বলিলেন আমি আপনার নিকট একটী বিষয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি। আমি আপনার নিকট অশেষ অপরাধ করিয়াছি আপনি ক্ষমা করিবেন, প্রতিশ্রুত হইলে আমি বলিতেছি। সাহেব ভাবিয়া উঠিতে পারিলেন না, এতবড় অপরাধটা কি? অভয় দান করিলে বিদ্যাসাগরমহাশয় স্বকৃতাপরাধ ব্যক্ত করিলেন। কাগজ লইয়া যাওয়া হইতে বিক্রয় করা পর্য্যন্ত আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বিষয় বিবৃত করিলেন। সাহেব বুঝিলেন তাঁহার সাধু উদ্দেশ্য বিফল হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় বুঝিলেন তাঁহার সাধু উদ্দেশ্য সফল হইল। সাহেবেরা বড়একটা এমত ব্রাহ্মণ দেখিতে পান না বলিয়াই আমাদিগকে সর্ব্বদা অর্থের কুহকে প্রলোভিত করিয়া কত প্রকারে লাঞ্ছিত করেন। তাঁহারা জানেন যে প্রকৃত ব্রাহ্মণের কাছে অর্থ অনর্থের মূল, অর্থ সঞ্চয় অপেক্ষা বিপদ আর কিছুই নাই। হায়! এ প্রকার ব্রাহ্মণ আর অধিক নাই, তাই আমাদিগকে প্রতিনিয়ত এত বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হইতেছে। আমাদের কষ্টের কারণ আমরাই করি, পরকে নিমিত্তের ভাগী করি মাত্র।