বিদ্যাসাগর-প্রবন্ধ/দ্বিতীয় কথা
যে কথা বলিতেছিলাম, আমাদের আপনাদের বিপদ আমরা আপনারাই ঘটাই। আমাদের কষ্টের কারণ আমরা আপনারাই সৃষ্টি করি। পরকে অকারণ নিমিত্তের ভাগী করি মাত্র। এই যে আমরা চারিদিকে নানাপ্রকার অভাবে পরিবেষ্টিত মনে করি,বাস্তবিকই কি আমাদের এত অভাব, এত কষ্ট, না আমরা পরের দেখিয়া অন্যের অনুকরণে আপনারা এই সকল অভাব ও কষ্ট সৃষ্টি করিয়া বাড়বানলের মত, গুটী পোকার ন্যায়, নিজের জালে নিজে জড়াইয়া মরি। আপনার অন্তরের আগুণে আপনারা দগ্ধ হই। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কতবার বলিতে শুনিয়াছি, আমরা গরীব বামুনের ছেলে আমাদের অভাব কি? আমাদের গাড়ী ঘোড়ার দরকার নাই, শাল রুমালের প্রয়োজন নাই, মোটাভাত মোটা কাপড় এক রকম করিয়া চলিয়া গেলেই হইল। যাহাদের তাহা না হইলেই চলে না তাহাদের বড় কষ্ট, বড় বিপদ। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বীয় জীবনে দেখাইয়াছেন যে, বাস্তবিক তাঁহার গাড়ী ঘোড়ার দরকার ছিল না। ইচ্ছা করিলে যে শ্রেণীর লোকে আজ কাল গাড়ী ঘোড়া ব্যবহার করিয়া থাকেন, সেই হিসাবে বিদ্যাসাগর মহাশয় যে গাড়ী ঘোড়া ব্যবহার করিতে পারিতেন না তাহা নহে। তাঁহার মনে সে ইচ্ছা ছিল না। তিনি চিরদিনই পদব্রজে যাইতেন, তবে নিতান্ত অসমর্থ হইলে সর্ব্বাপেক্ষা সুলভযান পাল্কীর সাহায্য লইতেন মাত্র। বেশভূষার সম্বন্ধে অধিক কি বলিব, সেত অধিক দিনের কথা নয়। আজও আমরা অন্তরে তাঁহাকে প্রত্যহই দেখিতেছি। সেই সামান্য চটী চর্ম্মপদুকা শোভিত পদযুগল, সেই স্বল্প মূল্যের শুভ্র থান কাপড়ের উপর পরিষ্কার অথচ সামান্য মোটা থান চাদর, সেই অধ্যাপকোচিত মুণ্ডিত অসীম বিদ্যাবুদ্ধির খনি মস্তকমণ্ডল, তাহাতেই তাঁহার কত শোভা, সে সৌন্দর্য্য দেখে কে? সে শোভা বসনের নয়, সে শোভা ভূষণের নয়, সে শোভা, সে সৌন্দর্য্য তাঁহার নিজের। যে রমণী প্রকৃত সুন্দরী, তাঁহাকে কতকগুলি রত্নালঙ্কারে বিভূষিত করিলে প্রকৃতির অপমাননা করা হয়, যেন তত সুন্দরী দেখায় না। সৌন্দর্য্যের খুঁত ঢাকিবার জন্যই বস্ত্রালঙ্কারের প্রয়োজন। যাহার সে খুঁত নাই তাঁহার আবার বস্ত্রালঙ্কারের আড়ম্বর কেন? যে ব্যক্তি, কার্য্যগুণে, চরিত্র বলে, কীর্ত্তিকলাপে, গুণাধিক্যে স্বনামখ্যাত, তাঁহার বেশভূষার আড়ম্বরের দরকার কি? বেশভূষা জনসমাজে তাঁহার আদর বাড়াইবে না। কিন্তু যাহার নিজের সে গুণগরিমা নাই তাহার মনে হয়, হয়ত বাহ্য আড়ম্বরে তাহার মূল্য বৃদ্ধি করিবে। কিন্তু তাহা কি হয়? মানুষ পুতুল নয় যে বাহিরের চাক্চিক্য বাড়িলে, চক্ষে চটক দেখাইতে পারিলে, নিজের শোভা দেখাইতে পারিলে লোকে চমৎকৃত হইবে। লোকে জীবন্ত মানুষের কাছে মনুষ্যত্ব চায়, যেখানে তাহা পায় সেখানে আদরঅপেক্ষা স্বতঃই করে, আর যেখানে তাহার অভাব যেখানে রঙ্গে রাঙ্গ্তায়, পোষাকে আসবাবে লোকলোচনে ধুলা দিতে পারে না। ইহাই আমার ধারণা,—বোধ করি ইহাই সত্য। যে কথা বলিতেছিলাম বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ জীবনে যেমন দেখাইয়াছেন সামান্য চাল চলনে থাকিলে বেশ সুখে থাকা যায়, চালচলনের আড়ম্বর বাড়াইলেই কষ্ট। যাঁহারা তাঁহার আচার ব্যবহার সর্ব্বদা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাঁহারা এ কথা ভাল বুঝিবেন। তিনি যে কেবল চটিযুতা ও থান চাদর পরিধান করিতেন তাহা নহে, বাকি আচার ব্যবহারেও তিনি ঠিক সেইরূপ করিতেন। তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিতে চাহিতেন,থাকিতে ভাল বাসিতেন, তজ্জন্যসকলকে অনুরোধ করিতেন। তাঁহার সেই বসিবার ঘরটী একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি। চারিদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পুস্তকাধারে অসংখ্যপুস্তক, সেই মোটামুটী অথচ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন টেবিল চেয়ার, কাষ্ঠ নির্ম্মিত কিন্তু কেমন পরিষ্কার। কয়েক খানি ছবি ও ছিল। এক এক খানি ছবির সহিত এক এক খানি ইতিহাসও ছিল। ছবি গুলি কাহার? তাঁহার পরমহিতৈষী কাপ্তেন মার্শেলের ও বেথুন সাহেবের, অপর ঘরে তাঁহার অপার স্নেহাধার জনক জননীর। সে বৈঠক খানায় কুশন চেয়ার, স্প্রিংয়ের গদী, বা বহুমূল্য সোফা ছিল না। কিন্তু তবু সেখানে সেই কাঠের চেয়ারে বসিয়া কত মহানুভব ব্যক্তি কত মহানন্দ লাভ করিতেন। আবার বলি বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্রাহ্মণ ছিলেন,—ভোগ বিলাস ব্রাহ্মণের লক্ষণ নয়। যে ব্যক্তি যত ভোগ বিলাস বাড়াইবে সে ব্যক্তি ব্রাহ্মণত্ব হইতে তত তফাতে গিয়া পড়িবে। এখনকার এই দারুণ সময়ে উদরান্নের জন্য আমাদিগকে নানা সাজে নানা সময়ে সাজিয়া বেড়াইতে হয়। লোকে বলে ভেক না হইলে ভিক্ষা পাওয়া যায় না। কিন্তু ভেকটা যেন ভিক্ষার জন্যই হয়, সর্ব্বসময় স্থায়ী হয় না। যখন না হইলে নয় তখন যে সাজে সাজাইয়া পুতুল বাজীর পুতুলের মত আমাদের কার্য্যনিয়ন্তারা আমাদিগকে নাচাইতে চান আমরা যেন, তাহা ছাড়া অন্য সময়ে আর সে সাজে কখন সাজি না। স্বর্গীয় বঙ্কিমবাবুর দেবীচৌধুরাণীর ন্যায় আমাদের ব্যবসাদারীর জন্য যতটুকু করিতে হয় সাজ পাঠ ঠিক যেন ততটুকুই থাকে। “রাণীগিরির ব্যবসাদারী” কথাটা সর্ব্বদা মনে রাখা চাই। তাহা হইলে কতকটা পরিত্রাণের উপায়। “রাণী গিরি” ভিতরে ঢুকিলেই আমরা মজিয়াছি। বিদ্যাসাগর মহাশয় পুতুল বাজির সং সাজিতেন না। তিনি জীবন্ত মানুষ ছিলেন, আমাদের ন্যায় নির্জীব পুত্তলিকাবৎ ছিলেন না। কতবার কত লোক চেষ্টা করিয়াও তাঁহাকে পুতুল সাজাইতে পারে নাই। সুতরাং তাঁহার পক্ষে ভিতর বাহির ছিল না। বাহিরটা যাহা ইহউক, ভিতরের চাল চলনটায় তাঁহার উপদেশের অনুসরণ করিতে পারিলে তাঁহার আশীর্ব্বাদে আমরা সুখে থাকিতে পারি।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই আড়ম্বরশূন্য সামান্য বেশভূষা তাঁহার কিসের পরিচায়ক? সরলতার-না অহঙ্কারের? অনেকের এ কথা অনেক সময় মনে উঠিতে পারে, অন্ততঃ আমার একদিন এ দুর্ভাবনা হইয়াছিল। এক খানি ইংরাজী সমালোচনা গ্রন্থ পাঠ করিতে করিতে একদা ভাষার সরলতা সম্বন্ধে পড়িয়াছিলাম যে, যে ভাষা লোকের একটু মাত্র মন আকর্ষণ করে না, মোটেই চক্ষে পড়ে না, লোকে পড়িয়াই ভাব গ্রহণ করে, ভাষার প্রতি লক্ষ্যমাত্র করে না, সেই ভাষাই খুব সরল। তাহা হইতে আমার অনেক কথা মনে আইসে। এই যে পাশ্চাত্য নিয়মানুকরণে আমাদের আজকাল সর্ব্বদাই সভা সমিতি হইতেছে। যখন দেখিলাম শ্রোতৃবর্গ বক্তৃতা শুনিয়া বক্তাকে প্রশংসা করিলেন, ধন্যবাদ দিলেন, করতালির রোলে সভাস্থল আলোড়িত করিলেন, পথে ঘাটে ঘরে বাহিরে বলিতে লাগিলেন অমুক বাবু বা অমুক সাহেব যে বক্তৃতা করিয়াছেন তাহা অতি উত্তম হইয়াছে, যখনই তাহা দেখিলাম, যখনই তাহা শুনিলাম, তখনই ভাবিলাম বক্তৃতা কিছুই হয় নাই, বক্তার অভীষ্ট সিদ্ধ হয় নাই, বক্তা কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই, বক্তার ভাব কেহ গ্রহণ করেন নাই, তাহাতে কেহ মজেন নাই, কারণ তাহা হইলে তাঁহার বক্তৃতার কথা মনে থাকিত না, তাঁহার কথিত বিষয় হৃদয়ঙ্গম হইয়া তদনুযায়ী কার্য্য হইত। যেখানে তাহা না হইল, সে খানে বক্তৃতার প্রশংসা হইল বটে, কিন্তু বক্তার শ্রম নিষ্ফল হইল। উপরে ভাষা সম্বন্ধে যাহা উল্লেখ করিলাম, বক্তৃতা সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, বেশভূষা সম্বন্ধেও ঠিক তাহাই বলা যাইতে পারে। যে খানে বেশভূষা, মানুষ ছাড়াইয়া উঠে, সে খানে বেশভূষারই প্রাধান্য থাকে; সেখানে বেশভূষার প্রশংসা হইতে পারে কিন্তু যাহার সে বেশভূষা তাঁহার কি হইল? তিনি খাট হইয়া পড়িলেন। তা সে বেশভূষা খুব বহুমূল্যই হউক বা সে যৎসামান্যই হউক। মোট কথা, আমার বক্তব্য এই যে, যে যেমন লোক তাঁহার সেইরূপ বেশভূষাই ভাল; তাহাতে অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া যতটা সামান্য করা যাইতে পারে তাহা করাই ভাল, তাহাকেই সরলতা বলে। তাহার অভাবের নাম অহঙ্কার বা অভিমান। বিদ্যাসাগর মহাশয় এত বড় লোক ছিলেন, সামান্য চটা যুতা থান কাপড় কি তাঁহার উপযুক্ত পোষাক, না তাঁহার সেটা অহঙ্কার বা অভিমানসূচক? একথার এক মাত্র উত্তর—তিনি যত বড়ই লোক ছিলেন না কেন, তিনি ত বিদ্যাসাগর বৈ আর কিছুই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অধ্যাপক, করিতেনও অধ্যাপনা। আচার ব্যবহারটাও ঠিক তাহাই ছিল। তাঁহার জীবনে কিছু লোভ লালসা ছিল না, যে তাহাতে তাঁহার আচার ব্যবহারের সহিত, তাঁহার কার্য্যাকার্য্যের সহিত, তাহার চটী যুতা থান চাদর সাজিত না। তিনি যদি বড় যুড়ী গাড়ীতে লিবারী যুক্ত ভৃত্যাদি দ্বারা সুসজ্জিত অষ্ট্রেলিয়া দেশজাত অশ্বদ্বয় যুক্ত মহামূল্যযানাভ্যন্তরে আসীন হইয়া চটী যুতা ও থান চাদর ব্যবহার করিতেন, তিনি যদি লাট মহালাটের সভার সদস্য হইয়া বা তাহার প্রার্থী থাকিয়াও চটী যুতা ও থান চাদর ব্যবহার করিতেন, তিনি যদি বড় বড় রাজপুরুষদিগের প্রসাদাকাঙ্ক্ষী বা প্রসাদ ভোগী হইয়াও চটী যুতা ও থান চাদর ব্যবহার করিতেন, তিনি যদি অর্থ সঞ্চয় করিয়া বাঙ্গলার একজন গণ্যমান্য জমীদার হইয়া নায়েব কারকুনে পরিবেষ্টিত কাছারি বাটীর মধ্যে সেই চটী যুতা ও থান চাদর ব্যবহার করিতেন তাহা হইলে বরং তাঁহার অহঙ্কার বা অভিমানের কথা উঠিতে পারিত। তাঁহার বাকি আচার ব্যবহার থান চাদর ও চটী যুতার সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়াছে, সুতরাং তাহাতে অভিমান বা অহঙ্কারের কিছুমাত্র কথা নাই। স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় একজন প্রকৃত মনীষী ছিলেন। তাহার সে কথায় ভুল হইবার নহে। ভুল হয় আমাদের ন্যায় স্থুল বুদ্ধি লোকের। কখন মনে হয়, হয়ত খুব সরলতা দেখাইলেই লোকে ভাল বলিবে, আমাকে ভাল দেখাইবে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম রক্ষণ করে কে? আমি যাহা, তাহা অপেক্ষা একটু ছোট বড় সাজিতে গেলেই সাজ ধরা পড়ে, কাকের ময়ুর পুচ্ছ খসিয়া পড়ে। তাইবলি আমার সামান্য বিবেচনায় যিনি যেমন লোক তাঁহার তেমনি চলাই ভাল, জোর জবরদস্তি করিয়া বেশ ভূষার আড়ম্বরও যেমন দূষণীয়, জোর জবরদস্তি করিয়া বেশ ভূষার খর্ব্বতা ও তেমনি নিন্দনীয়। লোক শিক্ষক, অধ্যাপকাগ্রগণ্য বিদ্যাসাগর মহাশয় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে নিজের জীবনে আমাদিগকে যে শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন তাহা আমাদের প্রতিনিয়ত মনে রাখিয়া তদনুসারে নিজ নিজ জীবনের কার্য্যাকার্য্য, আপন আপন চালচলন, ঠিক করিয়া চলিতে পারিলেই আমাদের ও সুবিধা ও স্বচ্ছন্দ, তাঁহার ও উপদেশের ও উদাহরণের সফলতা হয়। তিনি স্বর্গারোহণ করিয়াছেন কিন্তু তিনি আমাদের যে শিক্ষক ছিলেন সেই শিক্ষকই আছেন। তাঁহার পুস্তকে প্রদত্ত শিক্ষার নূতন সংস্করণ হইতেছে বটে কিন্তু তিনি নিজ আচার ব্যবহারে, চালচলনে দৃষ্টান্ত দ্বারা নির্ব্বাক ভাষায় যে মহতী শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন তাহার আর নূতন সংস্করণ হইবে না সে শিক্ষা চির দিন অক্ষুণ্ণ থাকিয়া তাঁহার ভক্তগণকে প্রতিনিয়ত তাঁহার পদানুসরণে নিরত রাখিবে। ইহাই আমার একান্ত বাসনা ও বিনীত প্রার্থনা।