বিদ্যাসাগর-প্রবন্ধ/তৃতীয় কথা
বিদ্যাসাগর মহাশয় যে সময় ভূমিষ্ঠ হন তাঁহার পিতা স্থানান্তরে গিয়াছিলেন। বাটী ফিরিয়া আসিতেছেন, পথে তাঁহার পিতামহের সহিত সাক্ষাৎ হয়, তাহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতামহ মহাশয় তাঁহার পিতাকে বলেন যে, তাহাদের বাড়ীতে একটী এঁড়ে বাছুর হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা বাড়ীতে আসিয়া তাড়াতাড়ি গোশালায় দেখিতে যান, তাহাতে তাঁহার পিতা সদ্যোজাত শিশু বিদ্যাসাগরকে দেখাইয়া বলেন এই এঁড়ে বাছুরের কথা বলিতে ছিলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয় বৃষ রাশিতে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন বলিয়াই হউক, অথবা পৌত্রের প্রতি ব্যঙ্গ করিবার মানসেই হউক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতামহ ঠাকুর তাঁহাকে এঁড়ে বাছুর বলিয়া ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক জীবনী লেখক ও অপর অনেক লোক বলিয়া থাকেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় চিরদিনই সেই কথা সার্থক করিয়াছেন। তাঁহার এঁড়ের গোঁ চিরকালই সমান ছিল। আমি কিন্তু তাহা বলি না, আমার সে মত নহে। এঁড়ের গো বলিতে যে হিতাহিতবিবেচনাশূন্যতা বুঝায়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ে তাহা আরোপ করিতে সাহসও হয় না, ইচ্ছাও হয় না, এবং তাহা নয় বলিয়াই আমার ধারণা। তাঁহার অধ্যাবসায়, কার্য্যে একাগ্রতা, আত্মনির্ভরতা, বাঙ্গালিদুর্লভ-স্বাধীনতা এত বেশি পরিমাণে ছিল যে, সহজে অনেক সময় অনেক লোক তাঁহাকে বড় একগুঁয়ে বলিয়া মনে করিতেন, এখনও করেন। মোট কথা তিনি যাহা ভাল বলিয়া বুঝিতেন, তদনুসারে কার্য্য করিতেন, তাহাতে কেহই তাঁহাকে কার্য্য হইতে বিরত করিতে পারিত না, কিছুতেই গন্তব্য পথ হইতে হটাইতে পারিত না, তিনি অচল অটলভাবে নিজ কর্ত্তব্য পালন করিতেন, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করিয়া, সহস্র বিপদ এড়াইয়া কৃতকার্য্যও হইতেন। কিন্তু তাহা বলিয়া তাঁহার ধারণা ভ্রমাত্মক, এ কথা বুঝাইতে পারিলে যে তিনি বুঝিতেন না, এ কথা ঠিক নহে। তাঁহার একাগ্রতার কথা অনেকেই জানেন, আমি এস্থলে দুই একটা কথামাত্র বলিব। তাঁহার এক সহোদরের বিবাহ কালে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে কাজ করিতেন। বীর সিংহের বাটীতে বিবাহ। তথায় তাঁহার মাতা ও সহোদরগণ আছেন, তিনি সকলের বড়। বিবাহ কার্য্যে তাঁহার উপস্থিতি একান্ত বাঞ্ছনীয় ও আবশ্যক। বিশেষতঃ তিনি না উপস্থিত থাকিলে তাঁহার মাতা মনোকষ্ট পাইবেন - তিনি এই সকল ভাবিয়া কলেজের অধ্যক্ষকে যথাসময়ে ছুটীর জন্য আবেদন করিলেন। ভ্রাতার বিবাহে ছুটীর আবশ্যকতা সাহেব বুঝিবেন কেন? সাহেব ছুটী দিলেন না, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আবেদন অগ্রাহ্য করিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ক্ষুণ্ণ মনে বিষণ্ণ ভাবে বাসায় ফিরিলেন। তৎপরে তিনি সমস্ত রাত্রি সেই ভাবনা ভাবিয়াছেন ও কাঁদিয়াছেন। এ কান্না বাটী প্রিয় লোকের বাটী যাওয়া হইল না বলিয়া কান্না নয়, স্ত্রীপুত্র প্রাণ গৃহস্থের স্ত্রীপুত্রের মুখাবলোকন সুখ হইতে বঞ্চিত হওয়ার কান্না নয়। এ কান্না মাতাও ভ্রাতার মনোকষ্ট হইবে,তাহা ভাবিয়া - নিজের কর্ত্তব্য সাধন হইবে না, তাহা ভাবিয়া। এ অন্তরের বড় পবিত্র কান্না, এ কান্না ভগবান শুনেন। পর দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজে গিয়া অধ্যক্ষকে বলিলেন, আপনি আমাকে অবকাশ দিন; যদি না দেন তাহা হইলে এই কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলাম। ইহাতে সাহেব চকিত হইলেন, ব্যাপারটা কি? বিদ্যাসাগর তিন চারি দিন ছুটীর জন্য কার্য্য ত্যাগ করেন। অগত্যা সাহেব ছুটী মঞ্জুর করিলেন। যেমন ছুটী মঞ্জর হওয়া অমনি সেই পথে সোজা বাটী যাত্রা। পথ অনেক, কিন্তু ক্ষমতা ততোধিক। ক্রমাগত ত্রুতপদে চলিলেন। একে বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাহাতে দ্রুতপদে, যাঁহারা তাঁহার গতি জানিতেন তাঁহারাই বুঝিতে পারিবেন, এ গতি সহজ নহে। সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করিয়া দামোদরের কূলে যখন উপনীত হইলেন, তখন দেখেন এবার বড় সঙ্কট,—দামোদরে বন্যা আসিয়াছে। পারের উপায় একমাত্র নৌকা তাহা অপর পারে। নৌকা আসিয়া লইয়া গেলে সময়ে বাটী পৌছান হয় না, মাতার দুঃখের উপশম হয় না। তখন মাতার চরণ স্মরণ করিয়া কূলপ্লাবী, খরস্রোত, ভীষণ দামোদর বক্ষে আত্মসমর্পণ করিলেন, সন্তরণ দ্বারা পার হইবার সঙ্কল্প করিলেন। তীরে যাহারা বসিয়া পারের ভাবনা ভাবিতে ছিল তাহারা পাগল ভাবিয়া প্রথমে নিবারণ করিল, কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতে কর্ণপাত করিলেন না, আপনার মনে সন্তরণ করিয়া দামোদর অতিক্রম করিয়া যথাসময়ে মায়ের শ্রীচরণ দর্শন করিয়া জীবন সার্থক করিলেন। এটা কি বলিবেন—নিতান্ত একগুঁয়েমি না? আমাদের দেশে ইহা একগুঁয়েমি, গোঁয়ারতামি আর যাহার যাহা বলিতে হয় সমস্তই, কিন্তু দেশান্তরে বা সময়ান্তরে হইলে, ইহাই বীরোচিত একাগ্রতা, পুরুষোচিত আত্মনির্ভরতাদি নানারূপে প্রশংসিত হইত। এরূপ অসীম সাহসিকতার কার্য্য নিজ কর্ত্তব্য বোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় কত যে করিতেন তাহা সমস্ত বর্ণনা করা সাধ্যাতীত। এই প্রকার ব্যবহারের ভালমন্দ বিচার করিতে হইলে যে উদ্দেশ্যে সেই প্রকার অমানুষিক ব্যবহার করা হয়, অসাধারণ উপায় অবলম্বন করা হয়, তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক তাহারই বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি মাতা ও ভ্রাতার মনোকষ্ট নিবারণ মানসে এই অসীম সাহসিকতার কার্য্য না করিয়া কোন অপকৃষ্ট স্বার্থসিদ্ধির জন্য করিতেন তাহা হইলে তাহাকে, একগুঁয়ে বলতে হয়, গোঁয়ার বলিতে হয়, যাহা বলিতে হয় বলুন তাহাতে আমি দুঃখিত নহি। কিন্তু তাহার উদ্দেশ্য সৎ,পবিত্র, মহৎ এবং তাঁহার কৃতকার্য্য সেইরূপ উদ্দেশ্যের সাধনোপায় সুতরাং তাহাও কখন গোঁয়ারতামি একগুঁয়েমি প্রভৃতি কলঙ্কিত আখ্যারযোগ্য নহে।
অপর একটা একগুঁয়েমির কথা বলি। যে সময় তাহার মেট্রপলিটান বিদ্যালয়ে সুপ্রসিদ্ধ শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকা না থাকা সম্বন্ধে কথাবার্ত্তা চলিতেছে, সেই সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় একদিন তাঁহার জনৈক সমবয়স্ক বন্ধুর সহিত একত্র বসিয়া গল্প গুজব করিতেছেন। আমিও নিকটে দাঁড়াইয়া ছিলাম। এমত সময় তাঁহার সেই বন্ধু তাঁহাকে বলিলেন “বিদ্যাসাগর, তুমি ভাল বুঝিতেছ না, সুরেন্দ্রকে ছেলেরা বড় ভালবাসে, সে ছাড়িলে তোমার কলেজের বড় ক্ষতি হইবে।” এইটুকু বলিতে না বলিতে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গবৎ জ্বলিয়া উঠিলেন, এমনই ভাব প্রকাশ করিলেন যে তাহা হইলে তিনি যে সন্দেহ করিতে ছিলেন আর তাহা রহিল না, সুরেন্দ্র বাবুকে ছাড়ানই তখনই কর্ত্তব্য স্থির করিলেন। তিনি বলিলেন তবে কি আমার কলেজ সুরেন্দ্রের উপর নির্ভর করে আমার তাহা দেখা চাই,তাহা হইলে সে কলেজ আমার না রাখাই ভাল।” যেমন প্রতিজ্ঞা তেমনি কাজ। ফলে সুরেন্দ্র বাবুর সহিত তাঁহার কলেজের সম্পর্ক তিরোহিত হইল। এটা কি একগুঁয়েমি, না আত্মনির্ভরতা? আমরা অবশ্য বড় বুদ্ধিমান এতটা একগুঁয়েমি বড় ভালবাসি না, কিন্তু যিনি পরের মুখাপেক্ষী হইয়া রাজসিংহাসন ভোগ করা অপেক্ষা আত্মনির্ভরতা সহকারে কুটীরবাসও শ্রেয়স্কর মনে করেন, যিনি মাসিক পাঁচ শত টাকা বেতন অপেক্ষা মুষ্টিভিক্ষা শ্রেয়স্কর মনে করিয়া ছিলেন, সেরূপ মনীষীর কথা স্বতন্ত্র। সেটা একালের ন্যায় ক্ষীণবীর্য্য লোকের পক্ষে ভাল লাগিবে কেন?
বিদ্যাসাগর মহাশয় অন্যায় রূপে আপনার মত সমর্থনের কদাপি চেষ্টা করিতেন না, সেটা তাঁহার বিচার বিতর্কে অনেক বুঝা যায়। তিনি কি বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে, কি অপর কোন বিষয়ে যার তার সঙ্গে বিচারে প্রবৃত্ত হইতেন, সকলকে তাঁহার মত বুঝাইতেন, সকলের মত বুঝিতেন, বুঝিয়া চলিতেন। তাহাতে কাহারও প্রতি অবজ্ঞা ছিল না, নিজের অভিমান ছিল না। বিদ্যাসাগর মহাশয় যে মোটেই একগুঁয়ে ছিলেন না, তাহার দৃষ্টান্ত সামান্য বিষয়ে এক দিন স্বয়ং পাইয়াছি। একদা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দুই জোড়া শাল ক্রয় করা দরকার হয়, বলা বাহুল্য নিজের ব্যবহার জন্য নহে। শাল কিনিতে হইবে তজ্জন্য তিনি উপযুক্ত পাত্রে ভার দিলেন, তাহার পরম প্রিয় ছাত্র শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে দুই জোড়া শাল আনিতে বলেন। এক দিন অপরাহ্ণে বসিয়াঅছেন এমন সময় মুখোপাধ্যায় মহাশয় চারি পাঁচ জোড়া শাল লইয়া গিয়া বলেন ইহার ভিতর দুই জোড়া পছন্দ করিয়া লউন। সেখানে আমিও ছিলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাকে পছন্দ করিতে অনুমতি করিলেন। আমি যে দুই জোড়া পছন্দ করিলাম বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিয়া বলিলেন তাহারও তাহাই পছন্দ, কিন্তু মুখোপাধ্যায় মহাশয় বলিলেন তদপেক্ষা অপর দুই জোড়া ভাল। বিদ্যাসাগর মহাশয় অমনি বিনা বাক্যব্যয়ে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের পছন্দ করা জোড়া দুইটী পৃথক করিয়া রাখিয়া বাকি ফেরত দিলেন। মুখোপাধ্যায় মহাশয়ও ফেরত লইয়া চলিয়া গেলেন। আমি কিছু আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয় এক কথায় নিজের পছন্দ ত্যাগ করিয়া অপর ব্যক্তির পছন্দ অনুমোদন করিলেন, এটা যেন একটু আশ্চর্য্য বোধ হইল। আমি কথা পাড়িলাম তিনি উত্তর করিলেন “আমি ত পাগল হইনাই যে নীলাম্বরের সহিত শালের বিচার করিব।” আমি ইতি পূর্ব্বে মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে চিনিতাম না, কখন দেখি নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট পরিচয় পাইলাম। বুঝিলাম যে বিদ্যাসাগর মহাশয় অন্যায় তর্ক করেন না। এমন লোককে একগুঁয়ে বলাটা অন্যায় অভিযোগ নয় কি? আমি বলি না, আর যিনি যাহা বলিতে হয় বলুন। যিনি কার্য্যশীল, কর্ত্তব্যনিষ্ট তাঁহারই এরূপ একাগ্রতা, আত্মনির্ভরতা সর্ব্বদাই বাঞ্ছনীয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে ইহার দৃষ্টান্ত বিস্তর।