বিদ্যাসাগর-প্রবন্ধ/চতুর্থ কথা
চতুর্থকথা—আত্মমর্যাদা-মান-সম্রম।
পাঁচজন একত্র সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করিতে হইলে সকলেই যে এক রকমের লোক হইবে এমন কথন হয় না। নানা কারণে পরস্পর পার্থক্য থাকে, সেই পার্থক্য বশত মর্য্যাদার বিভিন্নতা হইয়া থাকে, সেই মর্য্যদা রক্ষা করা সমাজবন্ধনের মূলগ্রন্থি। তাহা নিজের জন্য নহে, তাহা সমাজের সুশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য, সকলের সুবিধার জন্য। যাহারা সমাজবদ্ধ হইয়া বাসকরে তাহাদেরই এই নিয়ম। এমন কি অনেক নিম্ন শ্রেণীর জীবের ভিতরও এই মর্যাদার তারতম্য লক্ষিত হয়। পিপীলিকা মধু মক্ষিকাদের ভিতর সর্ব্বদাই ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। অসভ্য মানবের ভিতর যাহারা দলবদ্ধ হইয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে তাহাদের ভিতরও এই মর্য্যাদা রক্ষার লক্ষণ লক্ষিত হয়। পূর্ব্বেই বলিয়াছি এই মর্য্যাদা রক্ষা করা সামাজিক লোকের সর্ব্বদা কর্ত্তব্য, তাহাতে যাহার মর্যাদা করিতে হয় তাঁহার উপকার নহে সমগ্র সমাজের উপকার। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই মান মর্য্যাদা বড়ভাল বুঝিতেন, তাহাতে সময়ে সময়ে তাঁহাকে অনেক দায়ে ঠেকিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহার বৃথাভিমান ছিলনা, সুতরাং সে সকল দায় তিনি অনায়াসে অতিক্রম করিতে পারিয়াছিলেন। যাহাতে তাঁহার মর্যাদাহানি হইয়াছে বুঝিতে পারিতেন তাহার প্রতিকার তিনি নিশ্চয়ই করিতেন। এখানে তাহার একটী দৃষ্টান্ত দিতেছি। যখন তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক তখন একদিন কোন কার্য্যসূত্রে তদানীন্তন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করতে যান। সাহেব একটা চেয়ারে বসিয়া টেবিলের উপর পদদ্বয় উত্তোলিত করিয়া একখানি পুস্তকাধ্যায়নে নিযুক্ত ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় যথা বিহিত অভিবাদন করায় সাহেব প্রত্যভিবাদন করিলেন না, পরন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় যাহা বলি বার জনা গিয়াছিলেন তাহা শুনিয়া সাহেব পুস্তকার্পিত নয়নে জবাব দিলেন। সাহেবের এই অভদ্রোচিত ব্যবহারে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিশেষ ক্ষুব্ধ হইলেন এবং অপমানিত জ্ঞান করিলেন। কিন্তু কাহাকেও কিছু বলিলেন না। সুযোগ অনুসন্ধানে রহিলেন। কিছু কাল পরে এক দিন দেখেন কার সাহেব সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরীতে আসিতেছেন, অমনি বিদ্যাসাগর মহাশয় তাড়াতাড়ি লাইব্রেরীর একখানি চেয়ারে বসিয়া টেবিলে চটী সুশোভিত পদযুগল সমুত্থিত করিয়া যেমন ভাবে কার সাহেবকে একদিন বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন সেই ভাবে পুস্তক হস্তে বসিয়া রহিলেনে। কার সাহেব গৃহের দ্বার দেশ পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় গ্রাহ্য করলেন না, অগত্যা সাহেব অমর্যাদার ভয়ে ফিরিয়া গেলেন, তাঁহার সে দিন সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরীতে প্রবেশ করা হইল না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের ন্যায় কার সাহেব এই খানেই থামিলেন না। তিনি সংস্কৃত কলেজের তদানীন্তন সম্পাদক ৺রসময় দত্ত মহাশয়কে বলিলেন, শিক্ষা বিভাগের কর্ত্তৃপক্ষ দিগকে জানাইলেন, একটা হুলুস্থুল করিয়া ফেলিলেন। এই সম্বন্ধে উক্ত দত্ত মহাশয় একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নিজ ভবনে আহ্বান করিয়া ব্যাপারটা কি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় আনুপূর্ব্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া বলিলেন “কার সাহেব একজন বিলাতী শিক্ষক, সম্রান্ত ভদ্রলোক, তাঁহার নিকট হইতে দৃষ্টান্ত দ্বারা যে সদাচার শিক্ষা পাইয়াছি আমি ঠিক তাহারই অনুকরণ করিয়াছি, তবে তফাতের মধ্যে সাহেবের পায়ে ছিল বিলাতি বুট আর আমার পায়ে তালতলার চটী। সেই যা পৃথক।” কর্তৃপক্ষগণ এই বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট কৈফিয়ত তলব করেন তাহাতে তিনি উপরিউক্ত মর্ম্মেই জবাব দেন। উক্ত দত্তজ মহাশয় যখন এই ব্যাপার গইয়া বড়ই বিরক্তি প্রকাশ করেন, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ মূর্ত্তি ধারণ করলেন, বলিলেন “আমি চাকরি গ্রাহ্য করি না, আমার চাকরি যায় তাহাতে আমার ভয় ও নাই, ভবনাও নাই, আমি বামুনের ছেলে আমার ভাবনা কি? ভাবনা আপনাদের আপনার ভাবুন।” দওজ মহাশয় দেখিলেন এ বড় সহজ বামুনের ছেলেনয়, চাকরি গ্রাহ্য করে না, উপরওয়ালাকে অন্যায় ভয় করে না, পয়সার মায়া করে না, মর্য্যাদা হানি সহিতে পারে না। কাজেই চুপ করিয়া রহিলেন। কর্ত্তৃপক্ষগণও থামিয়া গেলেন।
আর একদিনের কথা বলি। লর্ড ডফরিণ যখন বড় লাট সেই সময় এক দিন আমাদের দেশের কয়েকজন পদস্থ ব্যক্তি দলবদ্ধ হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। কে কে গিয়াছিলেন নামের প্রয়োজন নাই, অনেকেরই স্মরণ আছে অধিক দিনের কথা নহে। এই সময়ে অভ্যাগত ব্যক্তিদিগের মধ্যে কয়েক জনের বিলাতী পরিচ্ছদ দেখিয়া বড় লাট ডফরিণ বিরক্ত হইয়া অনেক তিরস্কার করেন। মান খুঁজিতে গিয়া মুখের উপর ইঁহারা এইরূপ তিরস্কৃত ও অপমানিত হইয়া ফিরিয়া আসেন। সহরময় মহা গেলযোগ। সর্ব্বত্রই সেই কথার আন্দোলন, আলোচনা চলিতে লাগিল। ক্রমে এ কথা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শ্রুতিগোচর হইল। তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, যে কথা বলিলেন ঠিক্ সে কথা বলার আবশ্যক নাই, যাহা বলিলেন তাহার মর্ম্ম এই যে, “ইহরা যায় কেন? যেমন কর্ম তেমনি ফল। যাওয়াই বা কেন, অপমান বোধ করাই বা কেন?” এই উপলক্ষে নিজ জীবনের এক দিনের গল্প বলিয়াছিলেন। হালিডে সাহেব যখন ছোট লাট, তিনি নিয়ম করিয়াছিলেন প্রতি সপ্তাহে এক দিন করিয়া তিনি সকলের সহিত সাক্ষাত করিবেন। এই সাধারণ সাক্ষাতের দিন ছোট বড় কত লোকই তাঁহার সহিত সাক্ষাত করিতে যাইতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সাধারণ সাক্ষাতের দিনেই এক দিবস হলিডে সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আহ্বান করিয়া পাঠান। শিক্ষাবিভাগ সম্বন্ধে কোন বিশেষ পরামর্শ জন্য হালিডে সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আহ্বান করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিরূপিত সময়ে উপস্থিত হইয়া দেখেন, অপেক্ষা করিবার বৃহৎ ঘরে লোকে লোকারণ্য, কত রাজা মহারাজা, কত বিদ্বান বুদ্ধিমান, কত ধনী মানী লোেক সমবেত। উহারি ভিতর আর দুইদল হইয়া বসিয়া আছেন। একদিকে বুনিয়াদি ধনীর দল, অপর দিকে অন্যলোক। বিদ্যাসাগর মহাশয় উপস্থিত হইয়া একটু গোলে পড়িলেন। সকলেই তাঁহার পরিচিত। তিনি কোথায় বসেন। ক্ষণ কাল চিন্তা করিয়া গরিবের দলেই বসিলেন। অমনি অপর দলের একজন, আসিয়া তাঁহাকে হাত ধরিয়া নিজের কাছে লইয়া বসাইলেন। বসিয়া তিনি সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, তাঁহারা কখন আসিয়াছেন। কেহ বলিলেন এক ঘণ্টা, কেহ দুই ঘণ্টা, কেহ তিন ঘণ্টা, কেহ বা বলিলেন গত সপ্তাহ বসিয়া বসিয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। কেহ বলিলেন দুই সপ্তাহ আসিয়া ফিরিয়াছেন। কেহ তিন সপ্তাহ। এই রূপ কথা বার্ত্তা হইতেছে ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ আগমন বার্ত্তা কাগজে লিখিয়া চাপরাশী দ্বারা সাহেবের গোচরে আনিলেন। অমনি হালিডেসাহেব চাপরাশী দ্বারা তাঁহাকে সেলাম দিলেন। চাপরাশী আসিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট দাঁড়াইয়া বলিল “লাট সাহেব সেলাম দিয়া।” যে ব্যক্তি তথন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত কথা কহিতে ছিলেন, বলা বাহুল্য তিনি সহরের একজন তদানীন্তন জনৈক সম্ভ্রান্ত পদস্থ লোক, তাঁহার নাম করিব না। তিনি মনে করিলেন তাঁহাকেই লাট সাহেব ডাকিয়াছেন; উঠিতেছেন অমনি চাপরাশী বলিল “আপকো নাহি, পণ্ডিত সাহেবকো।” ভদ্রলোকটী বড়ই অপ্রতিভ হইলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ক্ষুন্নমনে লাট সদনে গিয়াই প্রথম কথা জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি এই সকল আমাদের সমাজের সম্ভ্রান্ত লোককে এত কষ্ট দেন কেন?” তদুত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় যাহা শুনিলেন তাহাতে তাঁহার জ্ঞান লাভ হইল। হালিডে সাহেব বলিলেন “ইহারা আসে কেন? আমি ইহাদিগকে ডাকিতে যাই নাই। ইহারা যদি পাঁচদিন সাক্ষাত ন করিতে পাইয়া ফিরিয়া যায় আবার ষষ্ঠ দিবস আসিবে। কিন্তু আপনাকে যদি আর পাঁচ মিনিট দেরি করাইতাম তাহা হইলেই বোধ করি আপনি ফিরিয়া যাইতেন, আর ডাকিলে আসিতেন না, এই তফাৎ।” তাই ডফরিণ সাহেবের নিকট অপমানিত লোকদের সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিয়াছিলেন “ইহারা যায় কেন?” ইহা সাহেবদেরই কথা। আপনার মান আপনার ঠাই। মান ৰাখিতে না জানিলেই অপমানিত হইতে হয়। প্রসঙ্গচ্ছলে বিদ্যাসাগর মহাশয় মাননীয় ৺শম্ভুনাথ পণ্ডিত মহোদয়ের একটী গল্প সর্ব্বদাই বলিতেন। স্বর্গীয় শম্ভুনাথ বাবু একদিন হাইকোর্টের একজন জজ সাহেবের নিকট বসিয়া আছেন, এমন সময় চাপ রাশী আসিয়া সাহেবের হাতে এক খানি কার্ড দিল। সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া অভদ্রোচিত গালিগালাজ করিয়া চাপরাশিকে বলিলেন “বোলোযাকে ফুরশুৎ নাহি হায়।” চাপরাশী সাহেবের, বের মেজাজ জানিত, সেকথা আগন্তুককে না বলিয়া সাহেবের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া আছে। ক্ষণ কালপরে সাহেবের নজর পড়িল, সাহেব বিরক্তি সহকারে বলিলেন “আনে বোলো”। চাপরাশী দ্বারোদঘাটন করিয়া আগন্তুককে ঘরে প্রবেশ করাইতে না করাইতে সাহেব স্বয়ং দ্রুতপদে গিয়া সাদর অভ্যর্থনা করিলেন, দুই হাতে তাঁহার হস্ত ধারণ করিয়া নিজাসনের একাংশে উপবেশন করাইলেন। তখন স্বর্গীয় শম্ভুনাথ বাবু দেখিলেন আগন্তুক অপর কেহ নহেন, তাঁহারই বন্ধু সদর দাওয়ানি আদালতের প্রধান উকিল মুনসি আমির আলি সাহেব। শম্ভুনাথ বাবু বিদায় হইলেন। বিদায় কালে শুনিতে লাগিলেন জজ সাহেব মুন্সি মহাশয়ের নিজের ও বাটীর পরিজন বর্গের কুশল-বার্তা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। যিনি একমুহূর্ত্ত পূর্ব্বে যাহার আগমন বার্তা শুনিয়া ক্রোধে আত্মবিস্মৃত হইয়া অসাক্ষাতে অভদ্রোচিত গালি গালাজ করিয়াছিলেন, তিনি সাক্ষাতে এত আপ্যায়িত করিতেছেন। শুনিতে শুনিতে পণ্ডিত মহোদয় বিদায় হইলেন। সেই অবধি শম্ভুনাথ বাবু নাকি আর কখন কোন সাহেবের সহিত সাক্ষাত করিতে যাইতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহেবদের সহিত সাক্ষাত করিবার কথা উঠিলেই এই গল্পটী করিতেন। যাঁহার নিজ মর্যাদা রক্ষাকরা আবশ্যক তিনি কেন এইরূপে অপমানিত হইতে যাইবেন। তাই তিনি বলিয়াছিলেন “ইহারা যায় কেন?” “ইহারা যায় কেন” একথা লোভলালসাহীন, সাংসারিক-দুরাশা-বিহীন বিদ্যাসাগর মহাশয় বুঝিবেন কেন? সে কথা আমরা বুঝি। তাহাতেই আমরা মজি। আমাদের অভাব কিছুতেই ঘুচে না,আশার কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। তাই পাগলের মত ছুটাছুটী করিয়া মান অভিমানে বিসর্জ্জন দিয়া আপনারাও অধঃপাতে যাই, দেশকেও অধঃপাতে লইয়া যাই। কবে আমরা বুঝিব মান এমন করিয়া হয় না, মান খুঁজিলে মান পাওয়া যায় না, মানের জন্য মাথা খোঁড়া খুড়ি করিলে মান পাওয়া যায় না। মান রাজদরবারে নাই, বিচারালয়ে নাই, সহরে নাই, জঙ্গলে নাই। মান সম্ভ্রম সমস্তই নিজের কাছে। নিজের গুণের জন্য মান হয়, নিজের চরিত্র জন্য মান হয়। যেখানে মান হইবার সেখানে আপনা হইতেই হয়,মানুষে চেষ্টা করিলে হয় না। এই সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আর দুই একটা কথা বলি। বড় লাট সাহেবের সহিত সাক্ষাত করিতে যাইবার জন্য বিশেষ সম্মানিত লোকদিগকে একটি পৃথক পথে যাইবার (Private entryর) ব্যবস্থা আছে। এই অধিকার খুব কম লোকের অদৃষ্টে ঘটে। বড় বড় রাজামহারাজাদেরও আকাক্ষণীয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার জন্য কথন স্বপ্নেও ভাবেন নাই, অথচ তাঁহার নাম সেই সম্মানিত ব্যক্তিগণের মধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে একটা বড় গোলযোগ। যখনই একটা কিছু দরবার হইবে তখনই উপস্থিত হইতে হইবে, তাহাতে আবার চটীজুতা থান কাপড় চলিবে না। তাঁহার বড় ভাবনা হইল। তিনি ভাবিতে ভাবিতে একদিন বড়লাট বাহাদুরের প্রাইভেট সেক্রেটারির আপিসে যেখানে সেই তালিকা প্রস্তুত ও রক্ষিত হয় তথায় উপস্থিত হইলেন। তখনকার প্রাইবেট সেক্রেটারী তাহার জনৈক বন্ধু সাহেব; যাইয়া সাহেবকে বলিলেন যে প্রাইবেট এণ্ট্রির ফর্দ্দটা দেখিবেন। সাহেব মনে করিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম তালিকা ভুক্ত দেখিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইবেন, আবার হয় ত আর কাহারও জন্য অনুরোধ করিবেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তালিকাটী হস্তে লইয়া সাহেবকে তাঁহার একটি অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুত করিয়া লইলেন। তালিকাটি হাতে লইয়াই নিজের নামটি কাটিয়া দিলেন। সাহেবকে বলিলেন “আমার অনুরোধ আপনি রাগ করিবেন না। আপনি অনুরোধ রক্ষা করিবেন প্রতিশ্রুত হইয়াছেন, আর সাহেবলোক একবার প্রতিশ্রুত হইলে তাহা কোন মতে প্রত্যাহার করেন না। কাজেই আমাকে আর কিছু বলিবেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম কাটা হইয়া গেল। অপর একটা কথা। যখন পণ্ডিতগণের সম্মানার্থ মহামহোপাধ্যায় উপাধির সৃষ্টি হয়, তখন জনৈক সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী বিদ্যাসাগর মহাশয় উক্ত উপাধি গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক কি না জানিতে যান। বিদ্যাসাগর মহাশয় অতি বিনীত ভাবে, মহাত্মার উপযুক্ত নম্রতার সহিত বলিলেন “এত বড় উপাধির কি আমি যোগ্য?” বাস্তবিকই তাঁহার ধারণা যে তাঁহাকে মহামহোপাধ্যায় উপাধি দিলে উপাধির মর্যাদ্যা রক্ষা হইবে না। তিনি রাজি হইলেন না। তাঁহাকে মহামহোপাধ্যায় উপাধি দেওয়া হইব না। তাতে তিনি বড়ই সন্তুষ্ট ছিলেন। উপাধি সম্বন্ধে অপর একটী গল্প বলি। সকলেই জানেন গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে C. I. E. উপাধি প্রদান করেন। সে বার বোধ করি অগ্রে তাঁহার মত লওয়া হয় নাই, কারণ তাহা হইলে তিনি কখন তাহাতে সম্মত হইতেন না। রাজা উপাধি দিয়াছেন, ইচ্ছুক হউন, অনিচ্ছুক হউন, উপাধি গ্রহণ করিতেই হইল। কিন্তু উপাধি গ্রহণ সম্বন্ধে তাঁহার একটা বড় গোলযোগ, রাজসদনে দরবারি পোষাকে গিয়া উপাধি লইতে হইবে। যথা সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিমন্ত্রিত হইলেন। তিনি অগত্যা উপায়ান্তর না দেখিয়া তাঁহার প্রিয় নিভৃহ নিবাস কম্মটাড় চলিয়া গেলেন। উপাধি দেওয়ার দরবার ফুরাইয়া যাইলে কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় কলিকাতায় ফিরিয়া আসার কিছু দিন পরে লাটসাহেবের দপ্তর খানা হইতে একজন বাঙ্গালি কৰ্মচারী ও একজন চাপরাশী তাঁহাকে C. I. E. উপাধির পদক প্রদান করিতে যান। তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হস্তে গবর্নমেণ্ট প্রদত্ত পদক অৰ্পণ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাদের বিলম্ব করিবার কারণ বুঝিতে পারিয়া বলিলেন যে তাঁহার অনেক ধনী লোকের নিকট এইরূপ গবর্ণমেণ্ট প্রদত্ত মর্য্যাদাসূচক পদক লইয়া গিয়া যেরূপ পুরস্কার পান। তিনি অতি গরিব লোক তাঁহার নিকট সেরূপ প্রত্যাশা নাই। তিনি অনেক কষ্টে যাহা কিছু দিবেন তাহাতে তঁহারা সন্তুষ্ট হইবেন না। এমত অবস্থায় বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন আমি একটা কথা বলি তাহাতে আমারও সুবিধা তোমাদের সুবিধা হইবে। তিনি বলিলেন যে উক্ত ব্যক্তিদ্বয় যে পদক আনিয়াছিলেন তাহা রৌপ্যনির্ম্মিত, তাঁহারা তাহা বাজারে কোন বেনের দোকানে বিক্রয় করিয়া যে মূল্য পাইবেন, তাহা দুই জনে ভাগ করিয়া লন,আর বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পূর্ণরূপে ইহাও প্রতিশ্রুত হইলেন যে তিনি একথাকাহারও নিকট ব্যক্ত করিবেন না। রাজকর্ম্মচারী বাবু ও চাপারাশা অবাক, এমত কথা তাহারা কখনত শুনে নাই। ভাবিতে ও পারে না, যে উপাধি জন্য, যে পদক জন্য, আমাদের দেশের লোক কত চেষ্টা করেন, কত অর্থব্যয় করেন, রাজ- পুরুষদের কত উপাসনা করেন, কত লাঞ্ছনা ভোগ করেন, আর কত যে কি করেন,সে কথা না বলাই ভাল, এ হেন উপাধি সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এরূপ ঔদাস্য দেখিয়া কর্মচারী হয় বিস্ময়াপন্ন। তাহারা ত সামান্য কর্ম্মচারী, অনেক বুদ্ধিমান, বিজ্ঞলোকেও বিস্ময়াপন্ন হইবেন। একালে ইহা বড় একটা সহজ কথা নহে। তবে সেকথা লোক বুঝিয়া। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও একালের একটা সহজ লোক ছিলেন না। তিনি মর্য্যাদার জন্য, সম্মানের জন্য প্রয়াসী ও প্রত্যাশী হইবেন কেন? তিনি নিজ গুণে, নিজ চরিত্র বলে, নিজ অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, নিজ অসীম বিদ্যাবত্তায় রাজদ্বারে সম্মানিত, লোকের নিকট পূজিত, দেশে বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভগবান যাঁহাকে সম্মান দিয়াছেন তিনি মানুষের কাছে সম্মানের জন্য লালায়িত হইবেন কেন?