বিদ্যাসাগর-প্রবন্ধ/পঞ্চম কথা
পঞ্চম কথা—দান।
ধর্ম্ম শাস্ত্র প্রণেতা মহর্ষি মনু বলিয়াছেনঃ—
তপঃ পরং কৃত যুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে।
দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুর্দান মেকং কলেযুগে॥
মনুসংহিতা ১ম অধ্যায় ৮৬ শ্লোক।
সত্যযুগে তপস্যাই প্রধান ধর্ম্ম ছিল,ত্রেতায় জ্ঞান প্রধান, দ্বাপরে যজ্ঞই প্রধান এবং কলিতে কেবল দানই প্রধান ধর্ম্ম।
অনন্ত প্রতিভা সম্পন্ন, তপঃপ্রভাবময়, ভবিষ্য তত্ত্বজ্ঞ ভগবান মনু বুঝিয়াছিলেন কলিতে হিন্দুর এত কষ্ট, এত অভাব হইবে। সেই জন্য তিনি তাহার প্রতিবিধানের একমাত্র উপায় দানের এত মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিয়াছেন। প্রকৃত হিন্দুর দান সময় সময়ের উপর নির্ভর করে না,স্থলাস্থল সাপেক্ষ নহে, পাত্রাপাত্রদর্শী নহে। দানের প্রার্থী পাইলেই দান করিতে হইবে। ব্যবহারশাস্ত্রের প্রণেতাগণ যেমন নির্দ্দেশ করিয়াছেন যে সহস্র অপারাধী অপরাধ সকে শাস্তি ভোগ না করে তাহাও ভাল, কিন্তু যেন একজন নিরপরাধ ব্যক্তি অন্যায় শাস্তিগ্রস্ত না হয়, তেমনি ধর্ম্মজ্ঞানী প্রকৃত হিন্দু ইচ্ছা সহ অপাত্রে দান করিতে হয় তাহাও ভাল, তবুও যেন একজন উপযুক্ত পাত্র দানে বঞ্চিত না হয়। সুতরাং পাত্রাপাত্র বিবেচনা না করিয়া দান না করিয়া আমাদের চারা নাই। এতৎ সম্বন্ধে মহাভারতের একটা অতি মহৎ উপদেশ পূর্ণ গল্প আছে। পাণ্ডবদিগের রাজসূয় যজ্ঞের পর মহারাজ ধার্ম্মিক প্রবর পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের মনে মনে অভিমান হইয়াছিল যে তাঁহার মত দাতা পৃথিবীতে আর কেহ নাই। পৃথিবী জুড়িয়া তাঁহার দাতৃত্বের খ্যাতি বিকীর্ণ হইয়াছে। ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের এই প্রকার অহঙ্কার বুদ্ধির উদয় হয়। ভগবান অন্তর্য্যামী দর্পহারী শ্রীকৃষ্ণ তাহা জানিতে পারিলেন এবং পাণ্ডব শ্রেষ্ঠের দর্প বিনাশ করিয়া তাঁহাকে প্রকৃত দান কাহাকে বলে ও প্রকৃত দাতা কে তাহা বুঝাইবার জন্য মানস করিলেন। ভগবান ব্রাহ্মণ বেশ ধারণ পূর্ব্বক যৎকালে যুধিষ্ঠির অশুচি অবস্থায় আছেন এমন সময় তাঁহার সম্মুখীন হইয়া জানাইলেন যে তিনি ভিক্ষার্থী, তাঁহাকে অবিলম্বে তাঁহার প্রার্থিত ভিক্ষা দিতে হইবে, তাঁহার অনুমাত্র বিলম্ব সহে না। যুধিষ্ঠির সদা সদাচার রত, তিনি দেখিলেন অশুচি অবস্থায় দান শাস্ত্রসঙ্গত নহে, তাহাতে তাঁহার মন কুষ্ঠিত হইল, ব্রাহ্মণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ব্রহ্মণ, ক্ষণকাল বিলম্ব করুন, আমি শুচী হইয়া আপনার প্রার্থনা পূরণ করিতেছি। বলিতে বলিতে ব্রাহ্মণ তথা হইতে চলিয়া গিয়া তৎক্ষণাৎ কর্ণের নিকট উপস্থিত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে যেরূপ বলিয়াছিলেন ঠিক সেইরূপ বলিলেন। কর্ণও তথন যুধিষ্ঠিরের ন্যায় অশুচি অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু কর্ণ নিজ অবস্থার কথা এক কালে বিস্মৃত হইয়া ব্রাহ্মণের প্রার্থনা অবিলম্বে পূরণ করিলেন। মহারাজা যুধিষ্ঠির বড়ই ক্ষুণ্ণ হইলেন, তিনি এত বড় রাজাধিরাজ, তাঁহার উপর ধর্ম্মরাজ, ধার্ম্মিক প্রবর, তিনি দানে মানে আচারে ব্যবহারে ধর্ম্ম কর্ম্মে ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজা, অথচ একজন ভিক্ষুকের প্রার্থনা পূরণ করিতে পারেন নাই, কাজেই বড়ই ক্ষুণ্ণমনা হইলেন। ভগবান বাসুদেব এতদবস্থাপন্ন পাণ্ডব শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে দেখিয়া তাঁহার চিন্তার ও বিষন্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। যুধিষ্ঠির আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বর্ণনা করিয়া বিস্তর খেদ প্রকাশ করিলেন। তাহা শুনিয়া শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনা জন্য বলিলেন, মহারাজ ব্রাহ্মণের জন্য আপনি চিন্তা করিবেন না, ব্রাহ্মণের অভাব তৎক্ষণাৎ পূর্ণ হইয়াছে। আপনার নিকট ভগ্নমনোরথ হইয়া ব্রাহ্মণ সূতপুত্র, কৌরবাশ্রিত, কর্ণের নিকট গিয়া আপনার অভাব জ্ঞাপন করেন। কর্ণও তখন আপনার ন্যায় অশুচি অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু তিনি তাহা না মানিয়া তদবস্থাগত হইয়াও ব্রাহ্মণকে তৎক্ষণাৎ দান করিয়াছেন। কর্ণ, সূতপুত্র, আচার ব্যবহারে সুশিক্ষিত নন, অশুচি অবস্থাতেই ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছেন। তাহাতে কর্ণের দানের ফল হয় নাই সত্য, কিন্তু ব্রাহ্মণের অভাব দূর হইয়াছে। তজ্জন্য আপনি চিন্তা করিবেন না। অসীম ধীশক্তিসম্পন্ন নৃপশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির সকলই বুঝিলেন। কে ব্রাহ্মণ, কি জন্য ভিক্ষার্থী হইয়া আসিয়াছিলেন সমস্তই বুঝিলেন। বুঝিয়া ভগবানের শরণাপন্ন হইলেন, বলিলেন দর্পহারী শ্রীমধুসূদন, বাস্তবিকই আমার বড় অহঙ্কার হইয়াছিল তাহার উপযুক্ত শিক্ষা পাইয়াছি। যুধিষ্ঠির শিক্ষা পান আর নাই পান, এই উপাখ্যান হইতে আমরা যথেষ্ট শিক্ষা পাইতেছি। যিনি প্রকৃত দানধর্ম্মে দীক্ষিত তিনি অবস্থা দেখবেন না, কালাকাল দেখিবেন না, পাত্রাপাত্র দেখিবেন না, ফলাফল দেখবেন না। দান করিতেই তাঁহার প্রীতি, তাহাতে আর কিছু স্বার্থ চাহেন না। দান সম্বন্ধে আমার এই কথা বলিবার কারণ আর কিছু নহে, বিদ্যাসাগর মহাশয় যেরূপ ভাবে দান করিতেন তাহা জগদ্বিখ্যাত। তিনি কখন কালাকাল,পাত্রাপাত্র, অবস্থা বা ফলাফল বিবেচনা করিতেন না। তজ্জন্য তাঁহার জীবদ্দশায় অনেকে তাঁহাকে অনেক দোষ দিতেন, তাঁহার পরলোক গমনের পর অনেকে অনেকরূপে সমালোচনা করিয়া থাকেন। কিন্তু আমার মতে তিনি যে ভাবে দান করিতেন সেই ঠিক হিন্দু ধর্ম্ম প্রবৃত্তি চালিত, হিন্দু প্রকৃতিগত ব্যবহার। ইহার উপর তাঁহার দানের অপর একটী মহৎ গুণ ছিল। তিনি অতি গোপনে দান করিতেন। খৃষ্ট ধর্ম্মশাস্ত্রে বিধান আছে, যে এক হস্ত যাহা দান করিবে অপর হস্ত তাহা যেন জানিতে না পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দান ঠিক সেই ভাবের গোপনে দান ছিল। দুই একটী কথা বলি। একদা একটী বিপন্ন ব্রাহ্মণের সহিত তাঁহার পথে সাক্ষাৎ হয়। শুনিলেন ব্রাহ্মণ তাঁহার কন্যাদায় হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য ঋণদায়ে জড়িত। উত্তমর্ণ কলিকাতার ছোট আদালতে নালিশ করিয়াছেন। গরিব ব্রাহ্মণ উপায়ান্তর নাই ভাবিয়া চিন্তায় আকুল। তিনি একদিন পথে যাইতে যাইতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সমস্ত বৃত্তান্ত জানাইলেন, কিন্তু যাঁহার সহিত এত কথা কহিলেন তিনি যে দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর তাহা তিনি জানিতে পারিলেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয় সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। পর দিন ছোট আদালতে যাইয়া মকদ্দমার সমস্ত বৃত্তান্ত জানিলেন এবং দাবির সমস্ত টাকা আয় খরচা জমা করিয়াদিলেন। মকদ্দমার দিন সকলেই অবাক্। উত্তমর্ণ অধমর্ণ উভয়েই বিস্মিত, কে টাকা জমা দিল। আদালতের বিচারাসনে আসীন হাকিম হইতে অর্থী প্রত্যর্থির শোণিত লোলুপ পেয়াদা পর্য্যন্ত কেহই জানিতে পারিল না, কে টাকা দিল। সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত। কিন্তু ধর্ম্মের ঢাক আপনিই বাজে। কালে সকলেই টের পাইলেন যে এই সাক্ষাত দয়াবতার, কারুণ্যের মূর্ত্তিমান্ দেবতা, বিপদাপন্নের একমাত্র সহায় বিদ্যাসাগর মহাশয় গরিব ব্রাহ্মণকে এই দুস্তর ঋণদায় হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। এই একটা ঘটনার কথা বলিলাম মাত্র। তাঁহার দানের দৃষ্টান্ত না দেওয়াই ভাল, কারণ তাঁহার নিকট, তাঁহার স্মৃতির নিকট, তাঁহার আত্মীয়গণের নিকট,তাঁহার ভক্তগণের নিকট অপরাধী হইতে হইবে। ভক্ত ভগবানকে বলিয়াছিলেন, প্রভো, আমার তিনটী অপরাধ ক্ষমা কর। প্রথমতঃ তুমি অনির্ব্বচনীয় অথচ বাক্য দ্বারা তোমার স্তব করিবার চেষ্টা করিয়াছি, দ্বিতীয়ত তুমি সর্ব্বস্থায়ী অথচ তীর্থ যাত্রাদি দ্বারা তোমাকে স্থানবদ্ধ করিয়াছি, তৃতীয়তঃ তুমি অনন্ত অথচ তোমার রূপকল্পনা দ্বারা তোমাকে সীমাবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছি তাহাতে আমার অপরাধ হইয়াছে, ভগবন্, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা কর। আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দানের দৃষ্টান্ত নির্দ্দেশ করিয়া সেইরূপ অপরাধে অপরাধী হইতে ইচ্ছুক নহি। সেদান অনন্ত, সর্ব্বস্থায়ী ও অনির্ব্বচনীয়; এবং পূর্ব্বে যে কথা বলিতে ছিলাম তিনি এক জনকে যাহা দান করিতেন অপর কেহ তাহা জানিতে পারি না। তাঁহার একটা নিয়ম সর্ব্বদা দেখিয়াছি। তিনি দুইজনকে কখন এক সময়ে আসিতে বলিতেন না। কেহ একটার সময় আসিয়া একখানি পুস্তক লইয়া গেল, কেহ দুইটার সময় পাচটী টাকা লইয়া গেল, কেহ তিনটার সময় আসিয়া একখানি শীতবস্ত্র লইয়া গেল। সকলই তিনি ঠিক সংগ্রহ করিয়া রাখিতেন। কাহার জন্য কি আনিতেছেন, কাহাকে কি দিতেছেন, কেহ জানিতে পারিত না। আবার সকলকে নিষেধ ও ছিল তাঁহার দানের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করা না হয়। তিনি প্রচার করিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু সৎকর্ম্মের সৌরভ অনন্ত ব্যাপী। আপনার বাগানের কোন স্থানে একটি সুগন্ধ ফুল ফুটিয়াছে তাহাতে বাগান আমোদিত করিয়াছে। বায়ু গন্ধ ছড়াইয়া ফুলের সৌরভ বিকীর্ণ করিতেছে। ফুল তাহা চাহেনা, কিন্তু বাতাস আপনার কার্য্য আপনি করে। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ কৃত সৎকার্য্য কেহ জানিতে পারে তাহা চাহিতেন না, কিন্তু কাল তাহা প্রচার করিয়াছে। এইত প্রকৃত দান, প্রকৃষ্ট দান, নিস্বার্থ দান, নিষ্কাম দান, দানের জন্য দান। ইহা রাজদরবারে জানাজানি হইল না, গেজেটে কাগজে ছাপামাপি হইল না, লোকমুখে রটারটি হইল না। ইহাতে তিনি উপাধি পাইলেন না, ধন্যবাদ পাইলেন না, বাহবা পাইলেন না। ইহাতে তাঁহার নাম বাহির হইল না, মান বাড়িল না। তাহাই কি সত্য? ইহাতে তিনি যাহাকে দান করিলেন,তাঁহার আন্তরিক ধন্যবাদ পাইলেন, হৃদয়ের মান পাইলেন, নিজে মনের সুখ পাইলেন, ভগবানের আশীর্ব্বাদ পাইলেন। তাহার জন্ম সার্থক হইল। তিনি ধন্য হইলেন। আর আমরা কতবড় একটা প্রকৃত দানধর্ম্মের প্রকাণ্ড দৃষ্টান্ত পাইলাম। তাঁহার জীবনে মরণে আমরা যাহা দেখিয়াছি, শুনিয়াছি, তৎসমস্ত চিন্তা করি আর মুগ্ধ হই। এ বিষয়ে আমরা যে কখন তাঁহার অনুকরণ করিতে পারিব সে আশা নাই। আমাদের না আছে তেমন আর্থিক ক্ষমতা, না আছে তেমন প্রকৃত শিক্ষা, না আছে মন মানসিক শক্তি, আর না আছে তেমন ধর্ম্মের জন্য প্রগাঢ় অনুরক্তি।