বিদ্যাসাগর/ঊনবিংশ অধ্যায়
ঊনবিংশ অধ্যায়।
স্বাধীন জীবনের আভাস, ওকালতির প্রবৃত্তিত্যাগ, পিতামহীর মৃত্যু, পিতামহীর শ্রাদ্ধ, মন্ত্র গ্রহণে অপ্রবৃত্তি, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃত যন্ত্র ও ডিপজিটরী, পরোপকার ও উপকারে অকৃতজ্ঞতা।
সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের পদ-পরিত্যাগ, বিদ্যাসাগরের পক্ষে মঙ্গলপ্রদ হইল। পরবর্ত্তী জীবন-ঘটনা তাহার প্রমাণ। পরপদসেবায় মানব-জীবনের আত্মোৎকর্ষ-সাধন সহজে সম্ভবপর নয়। রূদ্ধদ্বার পিঞ্জরে আবদ্ধ সুন্দর শুকের যে অবস্থা, পরপদসেবী মানুষের অবস্থা তো তদতিরিক্ত নয়। স্বাধীন প্রাণে স্বাধীনভাবে কার্য্যপ্রসারণে কার্য্যবীরের যে সুবিধা, পরাধীন প্রাণে সে সুবিধা নাই। স্বাধীন প্রাণ মুক্ত পথে প্রধাবিত হয়। মানব-জীবনের উৎকর্ষ ও উন্নতি তাহাতেই আছে। যিনি যে পথে যাউন না কেন, মানুষ, আপন বুদ্ধিবশে, এক পথ দিয়া গিয়া স্বাধীন জীবনপ্রবাহে পার্থিব সুখের চরম সীমায় পৌছিতে পারে; আবার অন্য পথে গ্রিয়া অপর্থিব সুখের অন্তিম পর্য্যন্ত পাইতে পারে। সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল পদ পরিত্যাগ করিবার পর হইতে, বিদ্যাসাগর মহাশয়, স্বাধীন প্রাণে কার্য্য করিবার শত শত পথ আবিস্কার করেন। সে সকল পথ, ঐহিক প্রীতি-প্রতিষ্ঠার সম্যক্ অভিমুখী স্বাধীনভাবে কার্য্য করিতে পাইয়াছিলেন বলিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়, আধুনিক সভ্য-সমাজে পূর্ব-প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া গিয়াছেন। যাবৎ এ জগৎ, তাবৎই তাঁহার প্রতিষ্ঠা।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভ্রাতা বিদ্যারত্ন মহাশয়, নিম্নলিখিত বৃত্তান্তটী লিথিয়াছেন;—
“যে সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়, প্রিন্সিপাল পদ পরিত্যাগ করেন, সে সময় কলিকাতা সুপ্রিম-কোর্টের প্রধান বিচারক কলবিন্ সাহেব, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে উকীল হইবার জন্য পরামর্শ দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার পরামর্শানুসারে উকীল হওয়া যুক্তিসঙ্গত কি না, তাহা স্থির করিবার জন্য প্রত্যহ সকালে ও সন্ধ্যার সময়ে, তাৎকালিক প্রধান উকীল দ্বারকানাপ মিত্রের কার্য্যাবলী দেখিবার জন্য তাঁহার বাটীতে যাইতেন।[১] তিনি তথায় গিয়া দেখেন যে, টাকার জন্য হিন্দুস্থানী মোক্তারদের সঙ্গিত হুড়াহুড়ি করিতে হয়। দেখিয়া শুনিয়া ওকালতী কর্ম্মে তাহার ঘৃণা জন্মে। পরে তিনি কলবিন্ সাহেবকে গিয়া আপনার অভিমত প্রকাশ করেন। কলবিন্ সাহেব বলেন, “তোমার মত পণ্ডিত লোককে টাকার জন্য মোক্তারদের সঙ্গে হুড়াহুড়ি করিতে হইবে না। তুমি ওকালতী কর।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সে কার্য্য হইল না।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রামবাসী তদীয় পরম স্নেহভাজন ঐযুক্ত শশিভূষণ সিংহ মহাশয় আমাকে বলিয়াছেন,—
“দ্বারকানাথ মিত্র, কেবল মক্কেলদের কাগজ-পত্র লইয়া ব্যস্ত থাকিতেন। তাঁহার পড়াশুনার সময় থাকিত না। বিদ্যাসাগর মহাশয়, ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন। মোকদ্দাম লইয়া থাকিলে পড়াশুনা হইবে না ভাবিয়া, তাঁহার ওকালতী করিতে প্রবৃত্তি হয় নাই।”
আধুনিক আদালতের অনেক উকীলকেই ষে টাকার জন্য হুড়াহুড়ি মারামারি করিতে হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় এক জন শান্তিপ্রিয় ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যে সেটাকে ঘৃণা করিবেন, তাহা বলা বাহুল্য; কিন্তু দ্বারকানাথ মিত্রের ন্যায় প্রতিষ্ঠাবান্ উকীল কি টাকার জন্য মোক্তারদের সঙ্গে ঐরূপ হুড়াহুড়ি করিতেন? এ কথাটা মনে স্থান দিতে কোন মতে সহজে প্রবৃত্তি হয় না। শশিভূষণ বাবু যাহা বলিয়াছেন, তাহা এক্ষণে সম্ভবপর ৰলিয়া মনে হয়।
বিদ্যাসাগর মহাশয়, অসীম সাহসে সংসার-সাগরে ঝাঁপ দিলেন। তাঁহার পুস্তকের কতকটা আয় ছিল বটে; কিন্তু ঋণও বিস্তুর ছিল। দানের তো ক্রটি হয় নাই। ঋণেও বিদ্যাসাগরের অদ্ভূত তেজস্বিতার পরিচয়।
সংস্কৃত কলেজের গ্রিন্সিপাল-পদ পরিত্যাগ কুরিবার অব্যবহিত পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতামহীর ৺গঙ্গালাভ হয়। পিতামহীকে পীড়িতাবস্থায় বীরসিংহ গ্রাম হইতে আনয়ন করা হইয়াছিল। এখানে ভাগীরথী-তীরে শালিখা ঘাটে ২০ বিশ দিন গঙ্গাজল মাত্র পান করিয়া তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁহার শ্রাদ্ধোপলক্ষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু অর্থ ব্যয়িত হইয়াছিল।
এতৎসম্বন্ধে বিদ্যারত্ন লিথিয়াছেন,—
“তাঁহার শ্রাদ্ধাদি কার্য্যে বিধবা-বিবাহের প্রতিবাদিগণ অনেক শক্রতা করিয়াও, কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। শ্রাদ্ধোপলক্ষে এ প্রদেশের বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতগণের সমাগম হইয়াছিল। অনেকে মনে করিয়াছিল, বিদ্যাসাগরের পিতামহীর শ্রাদ্ধে কোনও ব্রাহ্মণ ভোজন করিতে আসিবেন না; তাহা হইলেই পিতৃদেব মনোদুঃখে দেশত্যাগী হইবেন। যাহার এরূপ মনে করিয়াছিল, তাহারা অতি নির্ব্বোধ। কারণ, অগ্রজ মহাশয, দেশে অবৈতনিক ইংরেজি, সংস্কৃত বিদ্যালয় সংস্থাপন করিয়ছিলেন; প্রায় চারি পাঁচ শত বালককে বিনা বেতনে শিক্ষা ও সমস্ত বালককে পুস্তক কাগজ শ্লেট প্রভৃতি প্রদান করিতেন। ইহা ভিন্ন বাটতে প্রত্যহ ৬০টী বিদেশস্থ সম্ভ্রান্ত ও অধ্যাপকের বিদ্যার্থী সন্তানগণকে অন্নবস্ত্র প্রদান করিয়া অধ্যয়ন করাইতেন। মধ্যে মধ্যে অনেক ভিন্ন গ্রামের ছাত্রগণের চাকরি করিয়া দিতেন। তিনি দাতব্য ঔষধালয় স্থাপন করিয়ছিলেন। ডাক্তার বিনা ভিজিটে গ্রামের ও সন্নিহিত গ্রামবাসীদিগের ভবনে চিকিৎসা করিতে যাইত। নাইট স্কুলের ছাত্রগণের মধ্যে অনেকেই কলিকাতার বাসায় অন্নবস্ত্র পাইয়া, মেডিকেল কলেঞ্জে বিদ্যাশিক্ষা করিয়া চিকিৎসক হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত অনেকেই অর্থাৎ কি ধনশালী, কি মধ্যবিত্ত, কি দরিদ্র সকল সম্প্রদায়ের লোকই, বিপদাপন্ন হইয়া আশ্রয় লইলে, বিপদ হইতে পরিত্রণ পাইত। চাঁদা প্রদান করিয়া, বিস্তর বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া, তিনি সাধারণের অতিশয় প্রিয়পত্র হইয়াছিলেন। এবম্বিধ লোকের পিতামহীর শ্রাদ্ধে কেমন করিয়া শত্রুপক্ষ বিঘ্ন জন্মইতে পারে?”
শ্রাদ্ধে বিঘ্ন ঘটাইবার চেষ্টা যে না হইয়াছিল, এমন নহে; কিন্তু উক্ত অংশের কথাগুলি অতান্ত সন্দেহোদীপক, তৎপক্ষে সন্দেহ নাই। কোন সুত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট বাধা নহেন, এমন কোন প্রকৃত ধর্ম্মচারী শাস্ত্রদর্শী খ্যাতনামা ব্রাহ্মণপণ্ডিত শ্রাদ্ধোপলক্ষে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে আহার করিয়াছিলেন কি না, লোকে ইহা জানিতে ইচ্ছুক হয়। যাহাই হউক, বিদ্যাসাগর মহাশয়, পিতামহীর সপিণ্ড উপলক্ষেও পিতাকে অনেক অর্থসাহায্য করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় আত্মীয় পরিবারের স্ব-বিশ্বাসোচিত কোন ধর্ম্মানুষ্ঠানে কোনরূপ ব্যাঘাত করিতেন না; বরং আবশ্যকমত অর্থসাহায্য করিতেন। এরূপ কার্য্যের ফলাফল-সম্বন্ধে তাঁহার মতামত, কেহই জানিতে পারিতেন না; কিন্তু কোনরূপ ব্যাঘাত দেওয়া যে অকর্ত্তব্য, তাহা তিনি অনেক সময়েই বলিতেন।
পিতামহীর মৃত্যুতে বিদ্যাসাগর মহাশয় বড় শোকাকুল হইয়াছিলেন। পিতামহী তাঁহাকে প্রাণপেক্ষা ভালবাসিতেন। তিনিও পিতামহীকে অন্তরের সহিত শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন। বাল্য-কালে কলিকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পীড়া হইলে, এই পিতামহী বীরসিংহ হইতে ছুটির আসিয়া, তাঁহার সেবা-শুশ্রুষা করিতেন এবং রোগ অসাধ্য হইলে, সঙ্গে করিয়া বাড়ী লইয়া যাইতেন। যৌবনে কার্য্যাবস্থায়ও এইরূপ ভাবই ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় যা কিছু আদর-আবদার তাঁহারই নিকট করিতেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে এতই ভালবাসিতেন যে, কোন গুরুতর বিষয়ে অবাধ্য হইলেও, তিনি বিদ্যাসাগরের উপর রাগ করতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বংশে নিয়ম ছিল,—পিতা, মাতা, পিতামহ বা পিতামহী, মন্ত্র-দীক্ষা দিবেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দুই এক বার মন্ত্র দিবার প্রস্তাব করিয়া, বড় সুবিধা বিবেচনা করেন নাই; সুতরাং তিনি সে বিষয়ে ক্ষান্ত হয়েন। পরে তাঁহার জননী বিদ্যাসাগরকে মন্ত্র দিবার প্রস্তাব করেন। বিদ্যাসাগর বিবেচনা করিয়া লইব বলিয়া স্বীকার করেন। একদিন পিতামহী পীড়াপীড়ি করাতে, বিদ্যাসাগর মহাশয় মন্ত্রগ্রহণের একান্ত অব্যাহতি নাই ভাবিয়া পিতামহীকে নানা যুক্তি প্রদর্শন করিবার প্রয়াস পান। মন্ত্রগ্রহণে বিদ্যাসাগরের ইচ্ছা বা মত নাই বুঝিয়া, পিতামহী আর মন্ত্র লইবার কথা বলেন নাই। বেশী বলিলে, পাছে প্রিয়তম পৌত্রের প্রাণে কষ্ট হয় বলিয়া স্নেহ-বাৎসল্য-বিমুগ্ধ বৃদ্ধ পিতামহী ক্ষান্ত হইলেন। এমনই বাৎসল্য মোহ![২]
প্রসঙ্গক্রমে এইখানে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আচারামুষ্ঠানাদিসম্বন্ধে দুই এক কথা বলি। তিনি তো পিতামহীর নিকট মন্ত্রগ্রহণ করেন নাই; পরস্তু সন্ধ্যাহিক পূজাদিতেও তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। তবে অপর কাহারও সন্ধ্যাহিক-ক্রিয়া দেখিয়া, তিনি নাসিক সঙ্কুচিত করিতেন না। আপন পরিবারের মধ্যে কাহারও প্রতি তৎসম্বন্ধে তাঁহার নিষেধও ছিল না। ব্রত-স্বস্ত্যয়নাদি ক্রিয়ায় কেহ কথন তাঁহার নিকট বাধা প্রাপ্ত হয় নাই। সন্ধ্যাহ্নিক আচারানুষ্ঠানে বিরত থাকিলেও, হিন্দুর আচার-সন্মত খাদ্যাখাদ্য-সম্বন্ধে তিনি অনেকটা বিচার করিতেন। মুরগী, মদ প্রভৃতি অথাদ্য-ভোজী তাঁহার সৌহার্দ্দসৌভাগ্য লাভ করিলেও, তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া, কখন নিজের বাড়ীতে খাওয়াইতে পারিতেন না। রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, কোন এক জন শক্তিশালী ব্যক্তি শ্যামাচরণ বাবু ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু ছিলেন। তিনি অখাদ্য খাইতেন বলিয়া, শ্যামাচরণ বাবু ও বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাঁহার বাড়ীতে কখন নিমন্ত্রণ খাইতে যাইতেন না।
এই বার বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বাধীন ভাবে অর্থোপার্জ্জনের পথ অবলম্বন করিলে, তাঁহার সংস্কৃত যন্ত্র ও সংস্কৃত ডিপজিটরী প্রধান ভরসাস্থল হয়। প্রেসে পুস্তক ও ডিপজিটরীতে নিজের ও অপরের পুস্তক, বিক্রীত হইত। বলা বাহুল্য, এই প্রেসে ও ডিপজিটরীতে অনেক লোকই প্রতিপালিত হইত। কিন্তু ক্রমে তিনি কোন কোন প্রতিপালিত কর্ম্মচারীর ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হইয়া পড়েন। কার্য্যে বিশৃঙ্খলা বিলক্ষণ হইয়াছিল এবং হিসাবপত্রেও যথেষ্ট গোলযোগ ঘটিয়াছিল। এই সব দেখিয়া, তিনি রাজকৃষ্ণ বাবুকে ডিপজিটরীর কার্য্যপরিদর্শন করিবার জন্য অনুরোধ করেন। রাজকৃষ্ণ বাবু, তখন ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে ৮০্ আশী টাকা বেতনে কর্ম্ম করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুরোধে তিনি ১২৬৬ সালের ৪ঠা পৌষ বা ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দের ১৮ই ডিসেম্বর ফোট উইলিয়াম্ কলেজ হইতে ছয় মাসের অবসর গ্রহণ করিয়া, ডিপজিটরীর কার্য্যতত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হয়েন। এই ছয় মাসের মধ্যে অসীম অধ্যবসায়-সহকারে কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া, তিনি ডিপজিটরীর সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খলতা করেন। তখন হিসাবপত্রও এরূপ সুশৃঙ্খল হইয়াছিল যে, অবশ্যকমত সকল সময়ে আয়-ব্যয়ের অবস্থা জানিতে মুহূর্ত্তমাত্রও বিলম্ব হইত না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা, রাজকৃষ্ণ বাবুর কার্য্যপ্রণালীসন্দর্শনে এতাদৃশ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন যে, তিনি তাহাকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ পরিত্যাগ করিয়া, ডিপজিটরীরই কার্য্যে স্থায়িরপে নিযুক্ত হইতে অনুরোধ করেন। অগত্য রাজকৃষ্ণ বাবু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ পরিত্যাগ করেন। এ কার্য্যে তাঁহার বেতন ১৫০্ দেড় শত টাকা হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সৌভাগ্যে এবং রাজকৃষ্ণ বাবুর প্রগাঢ় যত্নে প্রেস ও ডিপজিটরীর কার্য্য সবিশেষ সুশৃঙ্খলায় পরিচালিত হইয়া অনেকটা লাভজনক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু কেবল পরোপকারার্থে তাঁহাকে পরে এ প্রেসও বিক্রয় করিতে হইয়াছিল। সে কথা যথাস্থানে বলিব।
রাজকৃষ্ণ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আ-যৌবন সুহৃদ্। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গীন শ্রীবৃদ্ধিসাধনের মূলই বিদ্যাসাগর মহাশয় কৃতজ্ঞতাপ্রকটনের ইহা অন্যতম প্রমাণ। যে রাজকৃষ্ণ বাবুর বাড়ীতে বিদ্যাসাগর মহাশয় অন্তরতম আত্মীয়ের ন্যায় আহার, শয়ন প্রভৃতি নিত্য ক্রিয়া সম্পন্ন করিতেন, যে রাজকৃষ্ণ বাবু তাঁহাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় সম্মান ও শ্রদ্ধা করিতেন, যে রাজকৃঞ্জ বাবুর একটী শিশুকন্যার মৃত্যুতে বিদ্যাসাগর মহাশয় মৃতকল্প হইয়াছিলেন,[৩] যে রাজকৃষ্ণ বাবুর জননী বিদ্যাসাগরকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন, সেই রাজকৃষ্ণ বাবুর উন্নতিসাধন করা, বিদ্যাসাগরের পক্ষে বিচিত্র কি? কেবল রাজকৃষ্ণ বাবু কেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়, কত লোকের চাকুরি করিয়া দিয়াছেন, তাহার গণনা হয় কি? রাজকৃষ্ণ বাবু তো ঘনিষ্ঠ আত্মসম্পৰ্কীয়, কত দূর-সম্পৰ্কীয় অপরিচিত লোক ও তাঁহার প্রসাদে চাকুরী পাইয়া, অন্ন-সংস্থাপন করিয়া লইত।
দুঃখের বিষয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রসাদে যাঁহারা চাকুরী লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে অকৃতজ্ঞ, এমন কি, কোন উচ্চপদস্থ যশস্বী ব্যক্তি, তাঁহার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহা শুনিলে, লজ্জায় ঘৃণায় মর্মাহত হইতে হয়। এক ব্যক্তি, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চাকুরীর জন্য ধরিয়াছিল। তখন ঐ যশস্বী ব্যক্তি, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী। এই উচ্চ পদও, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রসাদেই প্রাপ্ত। তাঁহার অধীনে চাকুরী খালি ছিল। যে লোকটী চাকুরীর জন্য ধরিয়াছিল, সে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট হইতে উচ্চপদস্থ বাবুর নামে এক সুপারিস্ চিঠি লইয়া এক দিন বাবুর চাকুরী স্থানে তাঁহার বাসায় গিয়া উপস্থিত হয়েন। তখন বাবু, ইয়ারবর্গে পরিবেষ্টিত হইয়া, সোফায় বসিয়া আলবোলার তামাক খাইতেছিলেন। লোকটী সেই সময় তাঁহাকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লিখিত চিঠিখানি দেন। বাবু তখন তামাক টানিতে টানিতে একটু মৃদু হাসিলেন। ইয়ারবর্গ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?” বাবু বলিলেন, “ব্যাপার আর কি? বিদ্যাসাগর ব্যবসায় ধরিয়াছে। চাকুরী ক’রে দাও।” বাবুর কথা শুনিয়াই উমেদার অবাক্। কোন কথা না বলিয়াই তিনি তথা হইতে চলিয়া আসেন; কিন্তু লজ্জায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত আর সাক্ষাৎ করেন নাই। সহসা এক দিন তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়; সেই সাক্ষাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় বাবুর অকৃতজ্ঞতার পরিচয় পান।
অন্য এক সময়, কোন সরকারী অফিসে চাকুরী খালি হইয়াছিল। অফিসের যে বিভাগে চাকুরী খালি ছিল, বাগবাজারের ৺প্রিয়নাথ দত্ত সেই বিভাগের বড় বাবু ছিলেন। পূর্ব্বে যে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট হইতে উচ্চপদস্থ বাবুর নামে চিঠি লইয়াছিলেন, ইনি এক্ষণে এই চাকুরীর জন্য প্রিয়নাথ বাবুর নামে চিঠি লইবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট যান। প্রিয় বাবুর সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আদৌ আলাপ-পরিচয় ছিল না। সেই জন্য তিনি পত্র দিতে ইতস্ততঃ করেন; কিন্তু লোকটির নিতান্ত পীড়াপীড়িতে পত্র না দিয়া থাকিতে পারেন নাই। লোকটা চিঠি লইয়া, প্রিয় বাবুর নিকট যান। প্রিয় বাবুর আফিসে পাঁচটী চাকুরী খালি ছিল। কিন্তু এই কয়টা চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিবার নিয়ম হইয়াছিল। প্রিয় বাবু লোকটীকে পরীক্ষা দিতে বলেন। লোকটী সম্মত হন। পরীক্ষায় কিন্তু তিনি সপ্তম হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা রক্ষা হয় না ভাবিয়া, প্রিয় বাবু অত্যন্ত কাতর হন। অবশেষে কর্তৃপক্ষকে বলিয়' কহিয়া, তিনি আর দুইটী নূতন পদ বাড়াইয়া লন। ইহার একটা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লোক প্রাপ্ত হন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় পরে এই সংবাদ পাইয়া বলেন,—“বিচিত্র সংসার! আমি যাহার প্রকৃত উপকার করিয়াছি, সে আমার কথা রাখিল না; আর উপকার করা ত দূরের কথা, যাহার সহিত আলাপমাত্র নাই, তিনি আমার মর্য্যাদা রক্ষা করিলেন।”
এই কথা বলিয়াই বিদ্যাসাগর মহাশয়, তদ্দণ্ডেই ঘা বাজারে গিয়া, প্রিয়নাথ বাবুর সহিত আলাপ করেন।[৪]
আর এক বার বিদ্যাসাগর মহাশয়, একটা লোকের চাকুরী করিয়া দিবার জন্য একটা লোককে অনুরোধ করিতে যান। এই ব্যক্তি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় এক-খানি সংবাদ পত্রের সম্পাদক হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ে অনুরোদ শুনিয়াই, ইনি বলিয়াছিলেন,—“এমন অনুরোধ করিবেন না। এখন আমি সম্পাদক। আমি যদি সাহেব সুবোকে অনুরোধ করি, তাহা হইলে, স্বাধীনভাবে আর লেখা চলিবে না।” বিদ্যাসাগর মহাশয়, এই কথা শুনিয়া, চলিয়া আসেন। তিনি যখন অনুরোধ করিতেছিলেন, সেই সময় তথায় কোন সওদাগর আফিসের সদর-মেট তথায় উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, চলিয়া আসিলে সেই সদর-মেট বাবুটাও, তাঁহার সঙ্গে চলিয়া আসেন। তিনি পথিমধ্যে অতি বিনয়-বাক্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলেন, “মহাশয়! লোকটীর ২০ (কুড়ি) টাকা মাহিনার চাকুরী হইলে চলিবে কি? তাহা যদি হয়, আমার অধীনে একটী চাকুরী খালি আছে। আমি তাহা আপনার লোককে দিতে পারি।”
সদর-মেটের সৌজন্যে বিদ্যাসাগর বিস্মিত হইয়া উপকৃতর অকৃতজ্ঞতা স্মরণে একটু হাস্য করিলেন। তিনি সদর-মেটের মহত্ত্বের প্রশংসা করিয়া, তাঁহারই কথা-মত আপনার লোকটিকে তাঁহারই আফিসে পাঠাইতে সম্মত হয়েন।
এরূপ অকৃতজ্ঞতার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। কেহ নিন্দা করিয়াছেন শুনিলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিতেন,—“সে কি রে, আমার নিন্দা? আমি তো তাহার কোন উপকার করি নাই।”
তিনি প্রায়ই বলিতেন,—“তিনি যাহার যত উপকার করিয়াছেন, তাঁহার নিকট তত অধিক প্রত্যুপকার প্রাপ্ত হইয়াছেন।”[৫]
উপকারীর প্রত্যুপকার তো দূরের কথা উপকারীর অপকার করার দৃষ্টান্ত— এ কলুষময় কলিকালে চারিদিকে দেদীপ্যমান![৬]
- ↑ এই দ্বারকানাথ মিত্র পরে হাইকোর্টের জজ হন
- ↑ স্বর্গীয় ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু মহাশয়ের মুখে এই বিষয়টী শুনিয়াছিলাম।
- ↑ রাজকৃষ্ণ বাবুর এই কন্যাটির মৃত্যুতে বিদ্যাসাগর মহাশয় শোকোচ্ছ্বাসপূর্ণ হৃদয়ে একটী গঙ্গা প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। সে রচনাটী তৃতীয় বর্ষের বৈশাখ মাসের “সাহিত্যে” প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহা প্রভাতী-সম্ভাষণ নাম পুস্তকাকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছে। গদ্যে ইহা করুণাত্মক কাব্য। পডিতে পড়িতে চক্ষের জল সংবরণ করা যায় না। প্রভাবতী কি করিত, কি বলিত, কি খাইত ইত্যাদি কবিতার ভাষায় লিখিত। ইহা কাব্যে রচনা শক্তিমত্তার পরিচয়।
- ↑ আনন্দকৃষ্ণ বসু মহাশয়ের নিকট হইতে এই কথা নিয়াছিলাম। তাঁহার নিকট হিতে প্রিয়নাথ বাবুর সন্ধান লইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রিয়নাথ বাবুর সহিত আলাপ নিতে যান।
- ↑ পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত রামসর্ব্বস্ব বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের মুখে এই কথা শুনিয়াছি।
- ↑ সাবিত্রী লাইব্রেরীর চতুর্দ্দশ অধিবেশনে শ্রীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ _এম, এ, বি, এল, মহাশয় কর্ত্তৃক পঠিত প্রবন্ধ।